Friday, September 30, 2022

ছোট গল্প - ঈশ্বর কেন সৃষ্টি করলো মানুষ || লেখক - অষ্ট দেয়াশী || Short story - Iswar Keno sristi korlo manush || Written by Asto deayshi


 


ঈশ্বর কেন সৃষ্টি করলো মানুষ

    অষ্ট দেয়াশী



ঈশ্বর যখন পৃথিবী সৃষ্টি করলো তখন পৃথিবী শুধু জল আর জল। ঈশ্বর ভাবতে লাগলো ঈশ্বর সৃষ্টি করলাম পৃথিবী কিন্তু শুধু জল হলে চলবো না স্থল ভাগ করতে হবে। তাই তিনি পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর একভাগ স্থল সৃষ্টি করলো। 

ঈশ্বর ভাবতে লাগলো স্থল ভাগটি কেমন যেন মরুভূমি। কি করা যায় ভাবছেন ঈশ্বর তাই তিনি উদ্ভিদ দের সৃষ্টি করলেন। উদ্ভিদ তো সৃষ্টি করলেন ঈশ্বর কিন্তু এই উদ্ভিদ কিভাবে বাঁচবে ঈশ্বর কে ভাবিয়ে তুললো তাই তিনি একদিন পশুদের সৃষ্টি করলেন পৃথিবীর বুকে। পশুরা সারা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। একদিন ঈশ্বর পৃথিবীর বুকে এলেন তিনি ভাবলেন পশুদের বনে বানায় কিন্তু বাকি জায়গা যেন কেমন বেমানান। ঈশ্বর ভাবতে লাগলো কি করা যায়। তাই তার ভাবনা দিয়ে তিনি মানুষ সৃষ্টি করে ফেললেন। কিন্তু তারা বন মানুষ ঘুরে বেড়ায় শিকার করে। এই বন মানুষ দের নিয়ে ও চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি কি ভাবে তার গড়া পৃথিবী সুন্দর হবে। তাই ধীরে ধীরে বন মানুষ গুলো কে মানুষের পরিনত করলেন। তবুও ঈশ্বরের চিন্তার আর শেষ নেই। কিভাবে তার গড়া পৃথিবী সুন্দর হবে দিনরাত তাকে ভাবিয়ে তোলে। তাই তিনি মানুষ কে ঘর বাঁধার বুদ্ধি দিলেন। মানুষ বুদ্ধি করে ঘর বাঁধা শুরু করে দিলেন। ঈশ্বর ভাবতে লাগলো ঘর তো ওদের বাঁধা হলো কিন্তু খাবে কি ওরা তাই তিনি পৃথিবীর বুকে শস্য উৎপাদন করার বুদ্ধি দিলেন। মানুষ চাষ করার বুদ্ধি দিলেন। ঈশ্বর ভাবতে লাগলো কিন্তু ওরা শস্য রাখবে কোথায় জায়গা দরকার তাই তিনি পৃথিবীর বুকে নানা রকম জিনিস করার কারিগরী শিক্ষা দিলেন। একের পর এক বুদ্ধি ঈশ্বর দিলেন মানুষ কে। মানুষ বুদ্ধিমান হয়েই ভাবতে লাগলো আমি যা করেছি তা অন্য কে দেবো কেন❓ এই কথা যেদিন থেকে মানুষের মধ্যে এই ভাবনা উদয় হলো সেদিন থেকে মানুষের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলো। প্রথমে ছিলো একটি জাতি পরে তারা নানা জাতিতে পরিনত হলো। তার পর থেকে শুরু হয়ে গেলো লড়াই। ঈশ্বর ভাবতে লাগলো তার গড়া পৃথিবী একি অবস্থা । ঈশ্বরকে দিনের পর দিন ভাবিয়ে তুললো কি করবেন তিনি প্রতি দিন ঘটে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে নানা ঘটনা। কিভাবে এর প্রতিকার করা যায়। আমি তো সৃষ্টি করলাম মানুষ কিন্তু মানুষ এ কি করছে নিজেদের মধ্যে। ঈশ্বর নিজে না এসে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে একজন করে জ্ঞ্যানী মানব মানবিকা কে পাঠিয়ে দিলেন ঈশ্বর রূপে। তারা পৃথিবীর বুকে এসে মানব প্রেমের বানী প্রচার করলেন। যুগে যুগে তারা এলেন মানুষ রূপে নানা বানী নিয়ে। 

সব ধর্মের জ্ঞ্যানী মানুষের একটাই কথা মানব প্রেম। কাউকে মেরে ভয় দেখিয়ে গায়ের জোরে কখনো ঈশ্বরকে লাভ করা যায় না। আজ যা তোমার এক নিমিষেই সব শেষ করে দিতে পারেন তিনি। ভবের ঘরে এসে এমন কিছু করো যাতে যুগে যুগে তোমাকে মনে রাখে মানব। আজ যা তোমার বলে ভাবছো তুমি কালতো ওটা অন্য জনের ছিল। এই পৃথিবীতে তোমার বলে কিছু নেই সব তার শুধু মায়ার খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে তোমায় সুন্দর পৃথিবী কে গড়ে তোলার জন্য।

ছোট গল্প - বাতাসে বারুদের গন্ধ || লেখক - সামসুজ জামান || Short story - Batase baruder gondho || Written by Samsuz Zaman


 


বাতাসে বারুদের গন্ধ

          সামসুজ জামান



আমার পাগল সুবর্ণ, বাতাসে বারুদের গন্ধ ভেসে আসে। আমি ঘুমের মাঝে আতকে উঠি। এমন তো হবার কথা নয়। এই ঘরে আমি ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই তাহলে কি বিদ্যুৎ বিভ্রাট হল? বিছানা ছেড়ে সারাঘর ঘুরে বেড়াই। সুইচ অন করি দুটো ঘরেরই। ডাইনিং স্পেসের আলো জ্বালি। বাথরুমে পরীক্ষা করে দেখি বিদ্যুতের পোড়া গন্ধ ওখানে তো নয়? তাহলে এই পোড়া গন্ধ রোজ রোজ আসে কেন আসে কেন? আর আসেই বা কোথা থেকে?

আসলে সুবর্ণ জানো, আমি অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। তোমার অদৃশ্য উপস্থিতি আমার সারা ঘরে ছড়ানো। এ ঘরের প্রত্যেকটা অনুতে পরমাণু তে তুমি ঘুরে বেড়াও সুবর্ণ। তুমি কি আমার কাছে থাকো? দেখো, আমি তো এত চিকিৎসা করালাম। কতজন আমায় পরামর্শ দিলেন মনোবিদ এর পরামর্শ নিতে। তাই শেষ পর্যন্ত আমি তো ডক্টর অনিল চ্যাটার্জীর কাছেও ছুটে গেলাম। তাঁর মত সুপ্রসিদ্ধ মনোবিদ পাওয়া খুব দুষ্কর ব্যাপার। তিনিও তো আমার সাথে কথা বললেন। আমার বাড়ির লোকেদের তিনিতো জানিয়েছেন যে আমি কোন অসুস্থ অবস্থায়ই নেই। 

কিন্তু জানো সুবর্ণ, ঘরের মধ্যে আমি যখনই থাকি তখন আমি শুধু তোমারই ছায়া দেখি। চোখটা একটু বন্ধ করলেও আজও আমি প্রতি মুহূর্তে তোমার অস্তিত্ব টের পাই। বিছানায় মাঝে মাঝে হাঁতড়ে দেখি আমার মন তো বলে পরিষ্কার তুমি আমার পাশে শুয়ে আছো। কিন্তু বিশ্বাস করো সুবর্ণ, তৌঋঋৎঋআমি অন্ধকারে তোমাকে স্পর্শ করার জন্য হাত পর্যন্ত বাড়াই। কিন্তু কিছুই খুঁজে পাইনা। সুবর্ণ, আমার চোখ ফেটে জল আসে। আমি একথা কাকে কিভাবে বলব বলো তো? তুমি কি আমায় একটু বোঝো না? তুমি কি এখনো সেই অবিশ্বাস মনের মধ্যে ভরে রেখে দিয়েছে সুবর্ণ? আমি কি করলে বাঁচব বলতো একটু সুস্থ হয়ে?

এর মানে কিন্তু অপব্যাখ্যা করোনা। এর মানে আমি এটা বোঝাতে চাইনি যে তোমাকে আমি ভুলতে চাইছি। তোমাকে ভুলে আমি বাঁচবো কিভাবে বলতো? তুমি সেদিন তো সম্পূর্ণ অভিমান নিয়ে চলে গেলে আমার কাছ থেকে। তুমি কি সত্যিই জানো না. আমি তোমায় কতখানি ভালবাসতাম? সুবর্ণ, যেদিন কলেজে নবীনবরণে তোমায় প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই তো আমি জানতে পারলাম যে তুমি আমার প্রতি কতখানি আকৃষ্ট ছিলে? যখন আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম আমি মনে করার চেষ্টা করলাম আমি কি তোমায় এর আগে কোনদিন কলেজের ক্যান্টিনে অথবা ছাত্রসংসদ হলে দেখেছি? আমার মন বলল আমি দেখিনি। কিন্তু আমি অবাক হলাম, দেখলাম. তুমি আমার নাড়ি-নক্ষত্র, প্রতিটা চালচলন অদ্ভুতভাবে যেন মুখস্ত করে নিয়েছো। আমি অবাক হলাম। লজ্জা পেলাম। কিন্তু অবাক হলাম এইজন্যে যে একটা ছেলে আমার মত এরকম একটা মেয়েকে এভাবে ভালোবেসেছে? সেই দিনই আমি নিজেকে তোমার প্রতি সমর্পণ না করে পারিনি সুবর্ণ। তবুও পরের দিন তুমি যখন ক্যান্টিনের টেবিলের নিচে দিয়ে আমার হাতটা ধরার জন্য হাতটা বাড়িয়ে ছিলে আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম সে তো একটা নারীর সাধারণ লজ্জায়। আবার তুমি নিজেকে কী অদ্ভুতভাবে সংবরণ করে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলে যখন বারবার, তখন আমার নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে যাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল কি জানো, মনে হচ্ছিল হাত ধরে নয়, তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার কপালে একটা আলতো চুমু দিলেও আমার মনের আশা এক কণাও মিটবে না। সুবর্ণ, তুমি বিশ্বাস করো, আমার ইচ্ছেটা আমার মনের ভেতরটা কুড়ে ফেললেও আমি তা পারিনি, কারণ আমি একেবারেই সেই মানসিকতার ছিলাম না। শুধু সেই মনোভাবের জন্য আমি নিজেকে অনেক কষ্ট করে ধরে রেখেছিলাম।কিন্তু আমার মন প্রাণ. আমার শরীরের প্রত্যেকটা অনু-পরমানু তোমাকে সেই দিনই আমি দিয়ে দিয়েছিলাম সুবর্ণ!

সুবর্ণ, এই দেখো তোমার যে ছবিটা আমার বেডরুমের শো কেসে উপস্থিত থেকে সব সময় আমার সাথে কথা বলে, তাকে নিয়ে আমি যে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছি। তুমি বুঝতে পারছ সুবর্ণ, তুমি এই অনুভূতি টের পাচ্ছো? আমার উষ্ণতা তোমাকে কি একটুও ছুঁতে পারছে না সুবর্ণ? তুমি সত্যি বলতো, তুমি আছো কিনা আমার পাশে পাশে? আর তুমি যদি দুষ্টুমি করে বল যে, আমার পাশে নেই, সে কথাটা কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যবাদিও যদি আমার পাশে দাঁড়িয়ে এই কথা বলে তা হলেও মেনে নেব না। আসলে তারা দেখবে কিভাবে বল তো? তোমাকে তো আমি রেখে দিয়েছি আমার হৃদয়ের কন্দরে কন্দরে। সেই অন্তস্থলের গোপন কথাটা জেনে নেয় কার সাধ্য? তোমার মনে পড়ে সুবর্ণ যেদিন তুমি সত্যিই আমায় ছাড়লে না, জোর করে একটা গান গাইতে বাধ্য করালে, সেদিন সকলের উপস্থিতিতে আমি তোমার উদ্দেশ্যেই গেয়েছিলাম রবীন্দ্র নাথের সেই ভালবাসার গান -- 'ও যে মানে না মানা। আঁখি ফিরাইলে বলে না না না'। তুমি সেদিন পড়তে পেরে ছিলে তো সুবর্ণ আমার মনের না বলা বাণীর সেই অনুরণন? তোমাকে আপ্লুত করতে পেরেছিল তো সেদিনের আমার মনের অব্যক্ত হাহাকার? আমার ভিতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া সেই যন্ত্রণার অনুভূতি ছুঁতে পেরেছিল তোমায়?

সুবর্ণ, যেদিন তুমি সেনাবাহিনীতে যোগদানের খবর দিয়ে আমার কোলের কাছে নামিয়ে দিলে একরাশ লাল গোলাপ, সেদিন আমি মেলাতে পারছিলাম না তোমার দুটো অনুভূতিকে। একজন সেনা হিসেবে ইউনিফর্মে তোমার ছবির কল্পনা করে আমার মনে হচ্ছিল যে এটা আমাদের ভালবাসার পথের বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিনা! তখনই লাল গোলাপ গুলো যেন অন্য অনুভূতি জাগিয়ে তুলে আমাকে আবার ভিজিয়ে দিচ্ছিল মনের ভেতর থেকে। আমি ভাবছিলাম গোলাপের পাপড়ির মত তোমার মন সত্যিই কি পারবে তোমাকে তোমার কর্মস্থলে যোগ্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে? আমি আসলে নানাভাবেই বুঝতে পারছিলাম তোমার মনটা একেবারেই ফুলের পাপড়ির মত নরম।

তারপর তুমি আমাকে অনেক কাঁদিয়ে সেদিন চলে গেলে। গতবছরের প্রায় এই সময়। আজকের এই সেনা দিবসের হিসেবে সঠিকভাবে বললে ১১ মাস ২২ দিন। তোমার পোস্টিং হলো ভারত-চীন সীমান্তে। সুবর্ণ, আমরা কি এর আগে জানতাম এভাবে ভারত চীন সীমান্তের এত খুঁটিনাটি? তুমি জানালে সীমান্তের কাছে দৌলত বেগের কথা। তুমি জানালে আলভি সামরিক ঘাঁটির কথা। আমরা তোমার কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে লাদাখের গাল ওয়ান সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত লাইন অফ কন্ট্রোল এর পাশাপাশি দু শো পঞ্চাণ্ন কিলোমিটার সড়ক বানানোর কথা। সুবর্ণ তুমি তোমার কাজের অবসরে যখন আমায় জানাতে যে এই সড়ক বানানোর ফলে লেহ থেকে দৌলতবেগ পৌঁছতে আগে দুদিন লাগতো কিন্তু এখন নতুন রাস্তা ব্যবহারের ফলে মাত্র ছয় ঘন্টায় পৌঁছানো যাবে, তখন একজন ভারতীয় হিসেবে আমাদের কত গর্ব হতো। আর তুমি সেই সীমান্ত প্রদেশে তোমার একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে আমাদের রাতের নিদ্রাকে কেমন অটুট রেখেছ! 

কিন্তু সেদিন হঠাৎই তোমার সুরের মধ্যে কেমন চঞ্চলতা ছিল। তুমি সেদিন হঠাৎই বললে আকসাই সীমান্ত চীন নিয়ন্ত্রিত হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে অথচ এটা ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর ওখানেই কেমন যেন একটু বেশি মাত্রায় উত্তেজনার ভাব। চীন এবং ভারত দুপক্ষের সেনাদের মধ্যেই অতিরিক্ত সতর্কতামূলক প্রস্তুতি চলছে। সেদিন তোমার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারছিলাম সুবর্ণ, তুমি অনেক কিছু গোপন করে যাচ্ছ। তোমার উত্তেজনা তুমি হয়তো ঠিক চেপে রাখতে পারছিলে না। আমি তোমার কথা বলার ছন্দের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিলাম একটা লালবাতির সতর্কতার মতো চিহ্ন। আমার চোখ থেকে জল ঝরে পড়লেও আমি গলার মধ্যে উত্তেজনা আনতে দিচ্ছিলাম না তবুও বোধহয় তুমি ধরে ফেললে সে উত্তেজনা। তুমি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলে যে ভারতের হাতে অতিরিক্ত আধুনিক এবং উন্নত মানের একশ চারটে ক্ষেপণাস্ত্র আছে। আরো কত কি কথাবার্তা তুমি বলে যাচ্ছিলে কিন্তু আমি বোধহয় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। ককিছুক্ষণ পর তুমি হঠাৎ আমাকে তোমার দেওয়া সেই গোপন নাম ধরে ডেকে উঠলে। সুবর্ণ, কী ছিল তোমার গলায়? আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। সেদিন আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। তারপর তুমি আমায় কত আদর করলে। আমার সেল ফোনের মধ্যে সেদিন সুবর্ণ তোমার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি পুরোমাত্রায় টের পেয়েছিলাম। আমি জানিনা এমন অবাস্তব ঘটনা মানুষের জীবনে কখনো ঘটে কিনা! লোকে হয়তো বলবে এটা অলৌকিক কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম -- সুবর্ণ, তুমি ষোলআনা আবির্ভূত হয়ে আমাকে সেদিন আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলে। আমার চোখের জল তুমিই তো মুছিয়ে দিয়েছিল সেদিন তোমার দুটো হাত দিয়ে। সত্যি করে বলতো সুবর্ণ তুমি কি অস্বীকার করতে পারো সেদিনের সেই উপস্থিতির কথা?

 আর পনেরোই জুনের কথা কি আর বলব বল তোমায়? টিভির সুইচ অন করলাম। টিভি চ্যানেলে সংবাদ শুনতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। তখন বড় বড় অক্ষরে দেখানো হচ্ছিল ভারত চীন সীমান্তের সেই আকসাই-এ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পনেরো জনের শহীদ হওয়ার খবর! জানো সুবর্ণ, আমি তখন ছুটে গিয়ে শোকেস থেকে তোমার ছবিটা তুলে আনতে গিয়েই হঠাৎ হাত ফস্কে ছবিটা পড়ে গেল একেবারে মেঝেতে। আর সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। জানো, আমি তখন উত্তেজনায় কাঁপছিলাম থর থর, থর থর করে। আর তখনই সেলফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখি তোমার মায়ের ফোন। মা ফোন করে কোনো কথা বলতে পারছেন না শুধু কাঁদছেন। হাউমাউ করে শুধু হাহাকার ধ্বনিই শোনা যাচ্ছে,কোন কথা নয়। মায়ের এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়ার কারণটা তখন আমার কাছে আর বিন্দুমাত্র অস্পষ্ট নয়। 

সুবর্ণ আজ তো সেনা দিবস। দেশজুড়ে সেনাদের জয়গান গাওয়া হচ্ছে। কত বড় বড় ভাষণ দেয়া হচ্ছে সেনাদের জয়ধ্বনী দিয়ে। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সেনাদের উদ্বুদ্ধ করে কত ভালো-মন্দ স্তোক বাক্য দিচ্ছেন। কিন্তু সুবর্ণ এসবের বাইরে তুমি শুনতে পাচ্ছ কি আজকের দিনে মায়ের প্রাণ ছেড়া সেই আর্তনাদের শব্দ? সুবর্ণ, তুমি দেখতে পাচ্ছো, এই হতভাগিনীর বুক ফাটা আফসোসের আর হা-হুতাশ এর ছবিটা!

জানো সুবর্ণ, আমি পরদিন মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কী যে বলেছিলেন সে কথা আমি বলে বোঝাতে পারবো না তবে তিনি আমায় অনুমতি দিয়েছেন যখনই আমার ইচ্ছে আমি তার কাছে যেতে পারি। আর সেই দিনই আমি আমার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি সুবর্ণ। 

ইদানিং একটা সমস্যা হয়েছে আমার। জানো. সব সময় আমি বাতাসে বারুদের গন্ধ পাই। কিছুতেই সে গন্ধ আমায় ছাড়ে না। আমার শয়নে,স্বপনে, জাগরণে সেই বারুদের গন্ধ আমার ভিতরের সবকিছু কুড়ে কুড়ে খেয়ে নিতে চায় সুবর্ণ। আর ইদানিং আমার মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে। কথা বলতে আমার একেবারেই ইচ্ছে করে না। আজকে তোমায় লিখে জানাচ্ছি তাই এই খোলা চিঠিতে। আমার মনের জমানো অনেক দুঃখ বেদনার কাহিনী --- খুব পরম ভক্ত যেমনভাবে ঠাকুর দেবতার কাছে নিজের মনের পরম শ্রদ্ধা বিশ্বাসের অঞ্জলি দেয়, ঠিক সেইরকম ভাবে তোমাকে উজাড় করে দিলাম সুবর্ণ আমার মনের না বলা কত কথা এই খোলা চিঠিতে। আমার এই খোলা চিঠির প্রত্যেকটা কথা ভগবান কি তোমার কাছে পৌঁছে দেবে না? দেবে, দেবে, নিশ্চয়ই দেবে। এটুকু পবিত্র বিশ্বাস আমার অন্তত আছেই। আর আজ এই সেনা দিবসে চোখের জলে চিঠিখানি লিখে তোমাকে আর একবার প্রণাম করে আমি পাকাপাকিভাবে মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি ; তুমি যেন আমায় ফিরিয়ে দিও না সুবর্ণ!

চোখ ভরা জল আর একবুক ভালবাসার হা-পিত্যেশ নিয়ে অধীর অপেক্ষায় রইলাম তোমার জন্যে। 

Thursday, September 29, 2022

রাজ্যে ICDS এ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা পদে নিয়োগ || WB ANGANWADI Helper, Worker Recruitment 2022 || ICDS Recruitment 2022 || ICDS Worker New Recruitment in Hooghly


 

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চাকরি প্রার্থীদের জন্য আবার নতুন সুখবর। ICDS তথা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা পদে নতুন নিয়োগ হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আপনি যদি মাধ্যমিক পাশ করে থাকেন তাহলে আপনার জন্য এটা একটা বড় সুযোগ। নিয়োগ টি হবে পশ্চিমবঙ্গের কিছু ব্লকের শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পের অধীনে। চাকরি সংক্রান্ত সম্পূর্ণ বিবরণ নীচে দেওয়া হল।





পদের নাম: অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকা।


মোট শূন্য পদ: 435টি।

নিয়োগ হবে হুগলি জেলায়। অফিসিয়াল ওয়েবসাইট নীচে দেওয়া আছে, সেখান থেকেই অনলাইন এ ফিলাপ করে নিন।




শিক্ষাগত যোগ্যতা: মাধ্যমিক পাশ করে থাকলেই আপনি এখানে আবেদন করার সুযোগ পাবেন।



বয়স: 18 থেকে 45 বছর। তবে এখানে 65 বছর পর্যন্ত আপনি চাকরি করার সুযোগ পাবেন।



নিয়োগ পদ্ধতি:

এই পদের জন্য 50 নম্বরের লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে।


*লিখিত পরীক্ষা হবে 35 নম্বরের-


গণিত – 10 নম্বর

ইংরেজি – 10 নম্বর

জনস্বাস্থ্য এবং সমাজে নারীর স্থান এবং মর্যাদা – 10 নম্বর

সাধারণ জ্ঞান – 5 নম্বর

*মৌখিক পরীক্ষা হবে 5 নম্বরের।


(3) 5 বছরের অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে প্রতি 3 বছরের জন্য 5 নম্বর এই ভিত্তিতে সর্বাধিক 10 নম্বর।


তারিখ: 

আবেদন শুরু 15.09.2022 তারিখ পর্যন্ত। আবেদন চলবে 15.10.2022 তারিখ পর্যন্ত।



গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট:


1. বয়সের প্রমাণপত্র (Self Attested)।


2. বাসিন্দা প্রমাণপত্র (Self Attested)।


3. কাস্ট সার্টিফিকেট ।


4. শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট।


5. পাসপোর্ট সাইজের ফটো 3 কপি।


6. ভোটার কার্ড






Apply now:

Click here 🔴


OFFICIAL WEBSITE: 


Click here 🔴



______________________________________________


চাকরি সংক্রান্ত আপডেট পেতে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন


Telegram group-


Please click here


Whatsapp group-


Please click here



Tuesday, September 27, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -20




সাত 


শ্যামলীদি ও আমি ময়নাকে দেখাশুনা করে বাড়ী ফিরছি । শ্যামলীদি গুম হয়ে বসে আছে । আমিও ট্যাক্সির জানালা পথে তাকিয়ে শ্যামলীদির ময়নার প্রতি স্নেহ ভালোবাসার কথা ভাবছি । দেখেছি ময়নাকে কাছে পেয়ে শ্যামলীদি গভীর ভালোবসায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে , যেন তারও মধ্যে মাতৃত্ব উদ্বেল হয়ে উঠেছে । সেই সময় আমার মনে হয়েছিল শ্যামলীদি যেন তার নিরুদিষ্টা মেয়েকে ফিরে পেয়েছে । মনে মনে কি যেন বিড় বিড় করে বলার সময় এই ফুটফুটে মেয়েটির মা হবার অধিকার চেয়েছিলো । এই রূপ কথা চিন্তা করার পর যেন বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছিলো ।

 ওর অবস্থা প্রত্যক্ষ করে এক সময় শ্যামলীদিকে বলে উঠলাম , এই শ্বাসরূদ্ধকর বিষাক্ত পরিবেশের মধ্যে থেকে কি কোন দিন মুক্তি পাবো না শ্যামলীদি ?

 না । গম্ভীর গলায় বলল শ্যামলীদি । যদিও কদাচিৎ পেয়ে থাকিস , এই মেকানিক্যাল রং করা সভ্য সমাজ আমাদের মতো পতিতাদের নারীত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে না , নোনা ধরা দেওয়ালের মতো আমাদের জীবন ধীরে ধীরে এইভাবে ধসে যাবে । এই ড্রাইভার ট্যাক্সি রূকো ?

 ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে যেতে শ্যামলীদি বলল , পদ্মা দেখতো , তোর রন্টুদাকে মনে হচ্ছে না? 

রন্টু নামটা শুনতেই শরীর যেন ছ্যাঁক করে উঠল । বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দেখলাম ও তো রন্টুদা । 

শোন্ পদ্মা , তুই বাড়ী যা , আমি একটু পরে যাচ্ছি । আমার হিতৈষী বন্ধুকে যখন অনেকদিন পর দেখা পেয়েছি , কোথায় থাকে কি করে একটু খোঁজ নেওয়া দরকার । শ্যামলীদিকে একা যেতে বাধা দিলাম । সে আমার বাধা না শুনে রন্টুকে অনুসরণ করে চলল । আমি নিরুপায় হয়ে বাড়ি মুখে রওনা হলাম । 

শ্যামলীদি যখন বাড়ী ফিরলো , অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে । সূৰ্য্য তখন মাথার উপরে । তার শিমূল ফুলের মতো রাঙ্গা মুখ দেখে বুঝতে পারলাম নিশ্চয় কোন কাণ্ড ঘটেছে নইলে মুখটা এতোখানি রাঙা হয়ে উঠবে কেন ।

 শ্যামলীদি একরকম শক্ত বাহু দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল , এবার আমি মরীয়া হলাম পদ্মা । আমার উপকারী বন্ধুর ঠিকানা দেখে এলাম । আর তার রেহাই নেই । আজ কালের মধ্যে শিবজীদাকে খবর দিতে হবে । বিলম্ব করা চলবে না নইলে শিকার হাত ছাড়া হবে । ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ঘাড় নাড়লাম । শ্যামলীদি আমার মত পেয়ে হাসি খুশি মনে ভেতরে প্রবেশ করল ।  

সেদিন সন্ধ্যায় শিবাজীদার আড্ডায় পৌঁছলাম । চারদিকে জমাট অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে । তারই বুক চিরে এগিয় চললাম শিবাজীদার আড্ডা বের করতে । বেগ পেতে হল না আড্ডায় পৌঁছতে । দুজন ষণ্ডা মার্কা লোক আমাদের কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল , আমরা কাকে চাইছি ?

 শ্যামলীদি বলল , শিবাজীদার কথা । ওরা শিবাজীদার কথা শুনে আমাদেরকে তার নিকট হাজির করল । বেশ সুন্দর ঘরখানি । মনে হল ঘরটা যেন একটা ছোট্ট সিনেমা হল । সারি সারি চেয়ার পাতা । নানা রকম আলোতে এনে দিয়ছে ঘরের সৌন্দর্যকে । আমরা উভয়েই তাকিয়ে দেখছিলাম । শিবাজীদার কথায় ফিরে পেলাম পূর্বের অবস্থাকে । 

তিনি বলললেন , বোল কি জরুরতে আ গয়ে ?

 শ্যামলীদি সংক্ষেপে রন্টুর নিয়ে কথা বলল । কোথায় গেলে পাওয়া যাবে তার ঠিকানা দিলো ।

শিবাজীদা শ্যামলীদির কথা শুনে চোখ দুটোকে বড় করে বসলেন - চিন্তা মত্ কর বহিন , কব তোদের পাশ হাজির করতে হোবে ? 

আমাদের কাছে হাজির করতে হবে না দাদা । তোমাদের আড্ডাতে ওকে এনে রাখবে ।

Tuesday, September 13, 2022

ছোট গল্প - ইন্দুবালা হত্যা রহস্য || লেখক - আশিস চক্রবর্তী || Short story - Indubala Rohosyo || Written by Ashis Chakrabarti


 

ইন্দুবালা হত্যা রহস্য

আশিস চক্রবর্তী


আমার নাম হৃষিকেশ রক্ষিত ।আমি একজন রিটায়ার্ড সরকারী গোয়েন্দা। দীর্ঘ তিরিশ বছর লাল বাজার হেড কোয়ার্টারে ক্রাইম ব্রাঞ্চের স্পেশ্যাল অফিসার হিসেবে নিযুক্ত থাকা কালীন, বিশেষ কিছু মার্ডার কেস এর সমাধান করার পর, ঘটনা গুলি ডাইরী তে লিখে রাখি। আজ যে ঘটনা আপনাদের শোনাতে যাচ্ছি সেটা হলো ইন্দুবালা হত্যা রহস্য। ঘটনাটি ঘটেছিল মৌলালীর বিখ্যাত স্বর্ণ ব্যবসায়ী জয়চাঁদ বড়াল এর বাড়ি। হত্যার খবরটা পাওয়ার পর , আমার সহকারী ইন্সপেক্টর পঞ্চানন সিকদার কে সঙ্গে নিয়ে ঘটনা স্থলে পৌঁছে গিয়ে দেখি বাড়ির পরিবেশ একে বারে থমথমে । বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতেই প্রথমে যেটা আমার চোখে পড়ল সেটা হল ডাইনিং এর দেয়ালে টাঙানো একটা গোপালের ছবি। বিরাট বাড়ির , তিন তলার ঠাকুর ঘরের সামনে সকলে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে । ঠাকুর ঘরের ভেতর মুখ থুবড়ে পরে রয়েছে জয়চাঁদ বড়াল এর মা ইন্দুবালা বড়াল। মুখের ভেতর থেকে সাদা ফেনা বেরিয়ে মেঝেতে গড়িয়েছে খানিকটা। দেখলেই বোঝা যায় ইন্দুবালা দেবী কে বিষ দেয়া হয়েছে। ঠাকুর ঘরের পূজার উপকরণ সব ওলট পালট হয়ে আছে। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে ইন্দুবালা দেবী ছটপট করেছেন খানিক ক্ষন। ডেডবডি ঠান্ডা। মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছে। ঘড়িতে এখন সাড়ে বারোটা । সে হিসেবে মৃত্যুর সময় অনুমান সকাল আটটা থেকে নটার মধ্যে। লাশ এবং সমস্ত ঠাকুর ঘর খুঁটিয়ে দেখার পর আমি পঞ্চানন কে তদন্তের জন্য বিশেষ কিছু নির্দেশ যেমন ফটোগ্রাফার এবং ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের আনানোর নির্দেশ দিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লাম। প্রথমেই বাড়ির সকলের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন। তাই উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললাম , " লাশ প্রথমে কে দেখেছে ? "

একজন মাঝ বয়স্ক মহিলা সামনে এসে জবাব দিল , " আমি সাহেব ! " 

" তোমার নাম কি ? "

" বীনা স্যার ! আমি এ বাড়ির কাজের লোক। "

" ও আচ্ছা ! কত বছর এখানে কাজ করছ ? "

" আজ্ঞে দশ বছর হবে !"

" তোমার কাজের সময় কতক্ষণ ? " 

" আমি সকাল ছটার মধ্যে এ বাড়িতে আসি । তারপর সারাদিন এ বাড়ির কাজ কর্ম করে বিকেলে বাড়ি ফিরে যায়! "

" তোমার বাড়ি কোথায় ? "

" হঠাৎ কলোনী। " 

" কে কে আছে বাড়িতে ! "

" আমার স্বামী আর সাত বছরের একটি মেয়ে !" 

 "স্বামী কি করে ? "

" আজ্ঞে ও কলের মিস্ত্রি !" 

" এবাড়িতে অপরিচিত কাউকে আসতে দেখেছিল এর মধ্যে ? কিংবা বাড়ির আশে পাশে কাউকে ঘোরা ফেরা করতে দেখেছিলে কি ? "

" না সাহেব ! সেরম তো কিছু চোখে পড়েনি ? "

" হুম ! আজকে সকালে ঠাকুর ঘরে এসে তুমি কি দেখেছিলে ? "

" ঘরের কাজ কর্মের সাথে সাথে মাইজীর খেয়াল রাখা ভি আমার কাজ। মাইজী অনেক বেলা হয়ে গেল তবু নীচে নামছে না দেখে আমি ঠাকুর ঘরে দেখতে এসে দেখলাম মাইজী পড়ে আছে। তখন দাদা বাবু কে ডেকে দেখায়। দাদা বাবু মাইজীর গায়ে হাত দিয়ে বললেন পুলিশে খবর দিতে । এ অন্য রকম মনে হচ্ছে ! "

" দাদা বাবু কে ! "

একজন ভদ্র লোক সামনে এগিয়ে এসে বললেন , " আজ্ঞে আমি ! আমি এ বাড়িতে ভাড়া থাকি। আমি একজন ডাক্তার ! দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওঁনাকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাই আমি অন্য কেউ লাশের গায়ে হাত দেবার আগে পুলিশে খবর দেয়ার পরামর্শ করি। "

" আপনি কি করে বুঝলেন হত্যা করা হয়েছে ? এটা সুই সাইড কেসও তো হতে পারে ? "

" আমি পেশায় একজন ডাক্তার । ডেড বডি দেখেই আন্দাজ করতে পারি যে হত্যা না সুই সাইড । সুই সাইড করতে নেমে কেউ নিশ্চয় স্নান করে পূজার ঘরে পূজা দিতে বসবে না। আর তাছাড়া ইন্দুবালা দেবী কে আমি কিছুটা চিনি। কাল রাত্রি অব্দি ওঁর সাথে কথা বলেছি । একবারও মনে হয়নি যে ওঁ আত্মহত্যা করতে পারেন। "

" হুম ! আপনার কথা কে সম্মান জানিয়েই বলছি , হয়তো ওঁ কাউকে বুঝতে না দিয়েই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন । তাই বাড়ির একেবারে নিরিবিলি স্থানে উঠে প্রত্যেক দিনের কাজ কর্ম সেরে ঈশ্বরের কাছে মান অভিমান জানিয়ে বিষ পান করলেন । যাক গে সে সব অনুমানের কথা। ক্রমশ প্রকাশ্যে আসবে এটা খুন না আত্মহত্যা ! এখন বলুন আপনার নাম ? "

" সুমিত ব্যানার্জী ! "

" আসল বাড়ি কোথায় ? "

" মেদিনীপুর ! "

" এখানে কত দিন আছেন ? " 

" বছর খানেক !" 

" আর কে থাকে আপনার সঙ্গে ? "

" কেউ নয় একা ! আমি ব্যাচেলর ! "

" কোথায় প্র্যাকটিস করেন ? "

" মৌলালীর মোড়ে আমার একটা চেম্বার আছে। " 

" ওকে ! ইন্দুবালা দেবী কি কোনো দিন কোনো শারীরিক সমস্যার কথার কথা আপনাকে জানিয়ে ছিলেন ? "

" বড় রকমের কিছু নয়। সাধারণ জ্বর সর্দি কাশি জন্য আমার কাছে আসতেন। " 

" রেগুলার কোনো ওষুধ কি খেতেন ? "

" যতদূর জানি , না ! "

"ওকে ! আপাতত এই টুকুই । প্রয়োজন পড়লে আরো কিছু কথা জানতে পারি !"

" ওকে অফিসার !এবার আমি কি আমার চেম্বারে যেতে পারি ? "

" আসুন ! কিন্তু আমাকে না জানিয়ে শহরের বাইরে নয় !"

" ওকে ! "

ডাক্তার সুমিত ব্যানার্জী চলে গেলেন। 


এরপর "ইন্দুবালা দেবীর অবর্তমানে এখন এ বাড়ির মালিক কে ? " এই প্রশ্নটা সর্ব সম্মুখেই রাখলাম। 

আমার কথা শেষ হতেই একজন মাঝ বয়স্ক লোক যে এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল , ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বললেন , " আজ্ঞে আমার নাম জয় চাঁদ বড়াল। আমি ওঁর বড় ছেলে। " 

" হুম ! এবাড়িতে আর কে কে থাকে ? "

" এঁদের পরিচয় তো আপনি পেয়েইছেন । এছাড়া আমার স্ত্রী লীনা। আর আমার পাঁচ বছরের ছেলে রুপু। আমার ছোট ভাই আর্মিতে চাকরি করে ও খুব একটা এখানে আসে না। লাস্ট এসেছে আজ থেকে মাস চারেক আগে। আর আমার এক পিতৃ মাতৃ হীন দুঃসম্পর্কের ভাগ্নে থাকে ।ওর নাম বিমল !"

" সে কোথায় ? "

" ওর তো ওষুধের কোম্পানি তে সেলস এর কাজ করে । তাই ভোর বেলা বেড়োয়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়। " 

" কোন কোম্পানি ? "

" লং লাইফ কোম্পানি !"  

" ওকে ! ও ফিরলে ওর সঙ্গে একবার কথা বলবো ! আপনার বাড়ি থেকে কিছু চুরি গিয়েছে কিনা লক্ষ্য করেছেন ? "

" উঁহু ! সেরম কিছু তো এখনো টের পায়নি। এরম ঘটনা ঘটলে কারো না কারো তো চোখে পড়ত ! "

" আপনার মায়ের মৃত্যুর জন্য কি , কাউকে সন্দেহ হয় ? "

" না স্যার ! সেরম কাউকে তো এখন মনে পড়ছে না !" 

" আপনারা বাদে ইন্দুবালা দেবীর কেউ নিকট আত্মীয় আছে ? "

" না স্যার ! "

" ইন্দুবালা দেবী কি কোনো উইল করেছিলেন ? "

" হ্যাঁ ! মাস খানেক আগে একবার আচমকাই আমাদের বংশের পুরোনো উকিল প্রকাশ চন্দ্র দত্ত কে ডাকিয়ে একটা উইল করেন ।" 

" ও আচ্ছা ! প্রকাশ বাবু কোথায় থাকেন ? "

" ধর্মতলায়!বাস স্ট্যাডের উল্টো দিকের গলিতে ওঁর বাড়ি ! "

" ওকে ! আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একবার কথা বলা প্রয়োজন। " 

" ওকে। আমি ডেকে দিচ্ছি। আসলে আমার মায়ের মৃত্যু তে ওই বেশি শক পেয়েছে। কারণ ওর সঙ্গেই মা বেশি কথা বলতো। "

" ওকে ! আমি ওঁকে এমন কথা বলবো না যাতে ওঁ কষ্ট পায়। " 


তারপর খানিক বাদে লীনা দেবী কে সঙ্গে করে উঠে এলেন জয়চাঁদ বড়াল। লীনা দেবী কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম , " কয়েক দিনের মধ্যে ইন্দুবালা দেবীর আচরনে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করে ছিলেন কি ? যেমন ধরুন খাওয়া দাওয়ায় মন নেই , কোনো দুশ্চিন্তা , অনিদ্রা কিংবা অপরিচিত কারো সঙ্গে দেখা করছেন এই জাতীয় ? "

"না !" খুব অল্প স্বরে জবাব দিলেন লীনা দেবী । 

" আপনি তো ওঁর সব সময়ের সঙ্গী ছিলেন , ওঁর কোনো শত্রু ছিল বলে আপনার মনে হয় ? বা আপনি কাউকে সন্দেহ করেন কি ? "

" ওঁর মতো মানুষের শত্রু থাকবে কি করে ? সকাল সন্ধ্যে ওঁ গোপাল সেবা নিয়েই থাকতেন। বাইরে খুব একটা বেরোতেন না। কারো সঙ্গে আজ অব্দি মুখ তুলে কথাও বলেননি ! ওঁর আবার শত্রু থাকবে কি করে ? আর বাড়ির সকলেই বিশ্বাসী মানুষ । ওঁকে মেরে কারো সুবিধে হবে বলে তো আমার মনে হয় না ! " 

" গত কাল তিনি সারা দিন কি কি করেছেন মনে আছে ? "

" হুম ! তিনি প্রতি দিনের মতো সকাল সকাল স্নান সেরে পুজো দিতে আসেন ঠাকুর ঘরে । তারপর ঘন্টা খানেক পর নীচে নামেন । এরপর সকালের খাবার খান। তারপর আমার সঙ্গে রান্না ঘরে ছিলেন। তারপর দুপুর বেলা পুনরায় গোপাল সেবা দিয়ে দুপুরের খাবার খান। তারপর ঘুমোতে যান। এরপর বিকেল বেলা ছাদে কিছুক্ষন ঘোরা ফেরা করেন। সন্ধ্যে বেলা ফের গোপাল সেবা দিয়ে গীতা পাঠে বসেন। তারপর রাত্রি বেলা খাবার খেয়ে শুতে যান। শুধু কাল বলে না , এই ছিল ওঁর প্রতিদিনের রুটিং। তবে সময় পেলেই গোপালের কাছে যেতেন। গোপাল কে তিনি নিজের সন্তান হিসাবেই মানতেন। " 


" হুম ! এর মানে গোপাল এর পূজার পর তিনি খাদ্য গ্রহণ করতেন। অর্থাৎ আজ সকালে তিনি খাবার খাননি। তাই খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেবার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এদিকে পূজা অসমাপ্ত । তাই পূজার প্রসাদ গ্রহণ করেছেন সে কথাও বলা যাচ্ছে না। লাশের গায়ে কোনো আঘাতের বা ধ্বস্তা ধ্বস্তির চিহ্নও নেই যে বলা যাবে কেউ জোড় করে বিষ খাইয়ে দিয়েছে । " 


জয়চাঁদ বড়াল ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন , " তাহলে স্যার আমার মা কে খুন করলো কে ? "

আমি বললাম , " সে প্রশ্ন তো রয়েইছে জয়চাঁদ বাবু তার সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন জুড়ে যাচ্ছে যে খুনটা কিভাবে হলো ? অর্থ্যাৎ বিষটা দেয়া হলো কিভাবে ? "  

জয় চাঁদ বাবুর সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আমি পঞ্চানন কে বললাম , " পঞ্চানন ! তুমি লাশ টাকে পোস্ট মোর্টেম এর ব্যবস্থা করে রিপোর্ট নিয়ে আমার সঙ্গে সন্ধ্যে বেলায় দেখা করো । আমি ততক্ষণ বাইরে টা একবার চক্কর দিয়ে আসি। কয়েকটা বিষয় জানা ভীষণ জরুরী হয়ে পড়ছে। "

পঞ্চনন জবাব দিল , " ঠিক আছে স্যার ! আমি আপনার সঙ্গে সন্ধ্যে বেলায় দেখা করছি। " 

এরপর আমি জয়চাঁদ বড়াল কে বললাম , " রাত্রি বেলা সকলকে এই বাড়িতে উপস্থিত থাকতে বলবেন। আমি একবার আসবো। " 


সমস্ত দিন তদন্তের স্বার্থে খোঁজ খবর চালিয়ে বেশ কিছু আশ্চর্য জনক ইনফরমেশন আমার হাতে উঠে এলো। সন্ধ্যে বেলা নিজের রুমে বসে ইন্দুবালা হত্যা রহস্যের সমাধান এর সূত্র সাজাচ্ছি এমন সময় ইন্সপেক্টর পঞ্চানন আমার রুমে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করল। তারপর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট টা আমার হাতে দিয়ে বলল , " বিষক্রিয়ার ফলেই মৃত্যু হয়েছে স্যার। কিন্তু প্রশ্ন এখন বিষটা কে দিল ? "

আমি পঞ্চানন কে বললাম , " আরো একটা প্রশ্ন পঞ্চানন ! বিষটা দিলো কি ভাবে ? কারণ ইন্দুবালা শেষ খাবার খেয়েছে রাত্রে ।আর জলের মাধ্যমে বিষ দেয়া খুব কঠিন কাজ। কারণ ওতে জলের স্বাদ ও গন্ধে পরিবর্তন আসে ! যে কেউ চট করে ধরে ফেলতে পারে ! " 

" হুম স্যার ! বড় জটিল কেস ! এদিকে আপনার কথা মতো গোপালের চরণামৃত পুজোর প্রসাদ সমস্ত কিছু পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে , কোথাও বিষের অস্তিত্ব নেই।গোটা ঘর বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও, এমন কি বাড়ির আশ পাশ টাও খুঁটিয়ে দেখেও বিষের কোনো শিশি বোতল উদ্ধার হয়নি। "

" ওসবে থাকবে না , সে আমি আগেই বুঝেছি ! " 

" তাহলে কেস টা কি স্যার ? " 

" আচ্ছা পঞ্চানন ! তোমার কি মনে হয় ? খুন টা কে করতে পারে ? "

" আমার মনে হচ্ছে ডাক্তার টা স্যার !" 

" কেন ? ইন্দুবালা কে খুন করে ওর কি লাভ ? "

" হয়তো ইন্দুবালা এমন কিছু গোপন ব্যাপার জানতো ডাক্তারের সমন্ধে , যার থেকে বাঁচাতেই ডাক্তার খুন টা করেছে। আর ডাক্তারদের কাছে বিষ দেয়া কোনো ব্যাপার না স্যার ! ওষুধের মাধ্যমে বিষ খাইয়ে দেয়া যেতেই পারে। "  

"তার মানে তুমি বলছো ইন্দুবালা দেবী ডাক্তারকে ব্ল্যাকমেইল করতো ! তোমার কথা অস্বীকার করছি না । তবে ওষুধের কারবার তো জয়চাঁদ বাবুর ভাগনেও করে। এবং সেও খুব সকালে উঠে বাইরে বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ সকালেই কাজটা সেরে ও বাইরে চলে যেতে পারে অনায়াসেই । "

" কিন্তু স্যার মোটিভ ? "

" মোটিভ সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা ! খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম ইন্দুবালা দেবী উইলে বিমলের জন্য কিছু রেখে যায়নি। আশ্রিত বিমল আশা করে ছিল কিছু পাওয়ার ! কিন্তু সে আশা ভঙ্গ হওয়ায় রাগ জন্মায় । আর তার থেকেই প্রতিশোধ। "

" হতে পারে স্যার ! আর কাজের মেয়ে বীনা ? "

" শোনো পঞ্চানন! একজন গোয়েন্দা হিসেবে আমার সন্দেহটা সবার প্রতিই ঘোরা ফেরা করছে। কারণ আমাদের কাজের সাফল্য নির্ভর করে অপরাধীর কাজ কর্ম ও মানসিক পরিস্থিতি বিচার করে । বিনার প্রতিও সন্দেহ নেই তা বলবো না । আজকে হটাৎ কলোনী গিয়ে যা জানতে পারি তা হলো , ও গরীব , অস্বচ্ছল, বিপদ যুক্ত পরিবারের সদস্যা । সে হিসেবে ওর খুন করার অনেক মোটিভ থাকতে পারে। সব থেকে সহজ যেটা তা হলো মূল্যবান কোনো জিনিস সরিয়ে ফেলা। যেটা হয়তো ইন্দুবালা দেবীর নজরে পড়েছিল। আর তার থেকেই খুন ! "

"কিন্তু স্যার জয়চাঁদ বড়াল তো বলছেন বাড়ি থেকে মূল্যবান কিছু খোয়া যায়নি ! "

" ধরে নিলাম জয়চাঁদ বড়ালের কথা সত্য ! কিন্তু এও তো হতে পারে মূল্য বান বস্তু টা ছিল ইন্দুবালা দেবীরই একার সম্পদ। যার সম্বন্ধে কেউ কিচ্ছু জানে না। আর সেটা টের পেয়ে বীনা হাতিয়েছে । এরম হয় জানতো পঞ্চানন ! বাড়ির বয়স্ক মানুষ জনের কাছে মহা মূল্যবান বস্তু সকলের অজান্তেই থেকে যায়। " 

" তা হয় স্যার ! আমার ঠাকুর দায় আমৃত্য আকড়ে ধরে ছিলেন একটা ব্রিটিশ পিরিয়ডের সোনার কয়েন। মৃত্যুর পর ওঁর বালিশের ভেতর থেকে সেটা উদ্ধার করা হয়। তাহলে বাকি থাকলো স্যার জয়চাঁদ বড়াল আর তার স্ত্রী লীনা দেবী ! "

" হুম ! ইন্দুবালা দেবীর মৃত্যুর জন্য দুঃখ টা ওরা দুজনেই বেশি পেয়েছে ! "

" হুম স্যার। নিজের সন্তান বলে কথা ! " 

" তাহলে এখন চলা যাক বড়াল বাড়ি। বাকি কথা ওখানেই হবে ! " 

" হ্যাঁ স্যার চলুন ! আপনি কি খুনি কে ধরে ফেলেছেন স্যার ? "

" হুম তা পেরেছি ! তবে আরো খানিকটা স্পষ্ট হওয়া দরকার আছে । তুমি ঠাকুর ঘরে তোলা লাশের ছবি গুলো সঙ্গে নিও । আরো একবার জেরা করার সময় ওগুলো দরকার হতে পারে। " 

" ওকে স্যার ! "



জয়চাঁদ বড়ালের বাড়ি পৌঁছে সেখানে দেখলাম ওরা সকলেই আমার অপেক্ষা করে একটা হল ঘরে বসে রয়েছে। প্রথমেই কাজের মেয়ে বীনার সঙ্গে আমার কথোপকথন শুরু করলাম। সারা দিন ঘুরে সংগ্রহ করা তথ্য এবারে আমার অস্ত্র হয়ে উঠল। বীনার আর্থিক অবস্থা ভালো নয় । সম্প্রতি ওর স্বামী রেলের লোহা চুরির দায়ে জেলে ঢুকেছে । অর্থ্যাৎ চুরির অভ্যাস ওর থাকলেও থাকতে পারে। আমার এসমস্ত কথা শোনার পর বীনা হাঁও মাও করে কেঁদে বলল , " আপনার সব কথা ঠিক সাহেব । কিন্তু আমি মাইজী কি খুন করিনি সাহেব। গঙ্গা মাইজীর কসম ! মাইজী আমাকে খুব ভালোবাসতো !" 


পরবর্তী কথা বার্তা শুরু হলো ডাক্তার সুমিত ব্যানার্জীর সঙ্গে । আমার মুখ থেকে , ওঁর চেম্বার যে এখন ঠিক ভাবে চলে না , আর বছর খানেক হলো মফস্বলের সরকারি হাসপাতালের চাকরি খুইয়ে এখানে এসে উঠেছেন, সে সব কথা মেনে নিলেন তিনি। তবে ওঁর সম্পর্কে শেষ তথ্য টা ছিল চমক প্রদ। ইন্দুবালা দেবীর স্বামী অর্থ্যাৎ জয়চাঁদ বড়ালের বাবা ডাক্তার সুমিত ব্যানার্জীর কাছে ভুল চিকিৎসায় মারা যান । এ কারণে ইন্দুবালা দেবীর সঙ্গে ডাক্তার বাবুর সম্পর্ক তেমন ভালো ছিলনা। তিনি বেশ কিছু বার সুমিত বাবুকে এ বাড়ি ছেড়ে উঠে যেতে বলে ছিলেন। কিন্তু সুমিত বাবু তাল বাহানা করে রয়েই গেছেন। এসমস্ত কথা শোনার পর ডক্টর ব্যানার্জী খানিক চোটে গিয়ে বললেন , " ভুল চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন এ কথার কোনোমানেই হয় না অফিসার! এতে আমার পেশা কে অপমান করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের পেশাতে রিস্ক নিতেই হয় ! আমি রুগীর অবস্থা অনুযায়ী জরুরী ওষুধ প্রয়োগ করেছিলাম। কিন্তু তাতে তিনি কোনো রেসপন্স করেন নি। আমি সে সময় ওদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি ! কিন্তু ওরা ডিসিশন নিতে দেরি করায় পেশেন্ট হার্ট ফেল করে মারা যায়। আর বাড়িয়ালার সঙ্গে মালিকের মনো মালিন্য থাকতেই পারে । এটা কমন ব্যাপার? এর জন্য কেউ কখনও কাউকে খুন করেছে বলে আপনি শুনেছেন কখনো ? "


" ডক্টর ব্যানার্জী ! খুন জিনিস টা আজকাল বড় সহজ ব্যাপার হয়ে পড়েছে । এর জন্য কোনো বড় মাপের মোটিভ এর প্রয়োজন হয় না ! আমি কিন্তু একবারও বলিনি ইন্দুবালা দেবীকে আপনি খুন করেছেন ! আমি কেবল আপনার বিষয়ে কিছু ইনফরমেশন শেয়ার করলাম। খুন শব্দটির উত্থাপন আপনি নিজেই করেছেন। আপনার প্রতি আমার সন্দেহটা খুব সামান্যই এই কারণে যে আপনি ইন্দুবালা দেবীর মৃতদেহ পরীক্ষা করে পুলিশে খবর দেবার কথা বলেছিলেন। আপনার মনে অন্য কোনো চিন্তা থাকলে আপনি এটাকে ন্যাচেরাল ডেথ হিসেব চালিয়ে দিতে পারতেন। আর তদন্তে এমন কিছু কথা এসে যেতেই পারে যা আপনার অনুকূল নাও হতে পারে। আমি কোনো মতেই আপনার পেশা কে অপমান করতে চাইনি। এবার আসি বিমলের কাছে। বিমল ইন্দুবালা দেবীর উইল এ নিজের অংশীদারীত্ব না থাকায় সামান্য অসন্তুষ্ট হয়েছে তাই তো ? "

বিমল কথাটা শুনে জবাব দিল , " দেখুন গোয়েন্দা বাবু। আপনার কথা সত্য। তবে আমি এও খুব ভালো মতো জানি যে আমার জন্মের পর বাবা মা মারা যাওয়ার কারণে আমাকে কেউ সহ্য করতে পারতো না। এছাড়া আমি এঁদের খুব কাছের কেউ না । ছেলে বেলা থেকে এখানে মানুষ হয়েছি তাই একটা কিছু আশা করেছিলাম । পাই নি। তাতে ঠিক আছে । ইটস ওকে ! " 

" কিন্তু আরো একটা বিষয় তুমি এড়িয়ে গেলে বিমল ! "

" কি বলুন তো ? "

"আমি খোঁজ করে দেখেছি তোমার কাজ টা আর নেই। তোমার ওষুধের কোম্পানি উঠে গেছে মাস দুই হলো। তুমি এখন সকাল থেকে রাত অব্দি কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছো। হুট করে কিছু টাকা হাতে এলে একটা নতুন ব্যবসা ফাঁদতে সুবিধেই হতো কি বলো ? "

বিমল মাথায় হাত দিয়ে কিছু ক্ষণ বসে রইল। তারপর একটা আফসোসের শব্দ ছেড়ে বলল , " তা বলে টাকার লোভে কাউকে খুন করা আমার পেশা বা নেশা কোনো টাই নয় ! আমি মনে করি খুন কে করেছে তা আপনি ভালো মতোই জানেন। তাই আর জল না ঘোলা করে সঠিক জায়গায় এগিয়ে যান ! "

কথা শেষ করে বিমল চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম বিমল বাস্তবতার চাপে কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছে। তাই ওর কথা বলার ভঙ্গিমায় কিছুটা রুক্ষ ভাব। আমি জয়চাঁদ বড়াল কে বললাম , " আপনার বাড়িতে ডাইনিং রুমের দেয়ালে যে গোপালের ছবিটা বাঁধিয়ে টাঙানো রয়েছে , সেটা কি আপনাদের ঠাকুর ঘরের গোপালের ? "

জয়চাঁদ বড়াল জবাব দিলেন , " হ্যাঁ ! মা ই ওটা বাঁধিয়ে রেখে ছিলেন । " 

" এই গোপালের মূর্তিটির বয়েস কত ? " 

" তা কেউ জানে না। বংশ পরম্পরায় আমাদের বাড়িতে আছে। " 

" এটা সোনার তো ? "

" মা তো তাই বলতেন ! "

" ওকে ! পঞ্চানন এবারে তুমি ঠাকুর ঘরে লাশের যে ছবি গুলো তুলিয়ে ছিলে সে গুলো একটু নিয়ে এসো । "

পঞ্চানন ছবি গুলো খামের ভেতর থেকে আমার হাতে দিল। আমি এবারে বীণাকে দিয়ে ডাইনিং রুমের দেয়ালের গোপালের ছবিটা আনিয়ে পাশাপাশি রাখলাম। তারপর জয়চাঁদ বড়াল কে বললাম , " দেখুন তো ! কিছু বুঝতে পারছেন কিনা ? "

জয়চাঁদ বড়াল দুটো ছবিতে চোখ বুলিয়ে বললেন , " ঠিক কি বলতে চাইছেন আপনি বলুন তো ? "

" আমি বলতে চাইছি ইন্দুবালা দেবীকে আপনিই খুন করেছেন ! "

কথাটা শোনা মাত্র লীনা দেবীর মুখ স্তম্ভিত হয়ে গেল। জয়চাঁদ বড়াল লাফিয়ে উঠে বললেন , " হোয়াট ! কি বলছেন কি আপনি ? আমি নিজের মা কে খুন করেছি ?"

" হ্যাঁ করেছেন ! "

" অফিসার আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন ? কি যা তা বলছেন ? আমি আমার নিজের মা কে খুন করতে যাবো কেন ? "

" আমি নই ! পাগল হয়ে গিয়েছিলেন আপনি মিস্টার জয়চাঁদ বড়াল ! ব্যবসায় মন্দা ! চতুর্দিকে ধার ! এতে আপনার মাথা খারাপ। এরই মধ্যে মা ইন্দুবালা দেবীর করা উইল যাতে আপনাদের ঈশ্বরের প্রতি কোনো ভক্তি ভাব না দেখে ইন্দুবালা দেবী নিজের সোনার গোপাল কে তাঁর মৃত্যুর পর দান করে গেছেন গোপীনাথ মন্দিরে। এটাতেই ছিল আপনার আপত্তি। কারণ প্রায় কয়েক কোটি টাকার গোপাল কে আপনি হাত ছাড়া করতে চাননি। এই নিয়ে ইন্দুবালা দেবীর সঙ্গে আপনার বচসাও হয়। এসব খবর জানতে পারি আপনাদের যিনি উইল লিখেছেন তাঁর কাছ থেকে । অর্থাৎ উকিল প্রকাশ বাবুর কাছ থেকে। তাই আপনি নিজেই নির্মাণ করেন একটা একই ছাঁচের গোপাল । যা ছিল সোনার জল করা সামান্য মূল্যের। তারপর সুযোগ খুঁজ ছিলেন সেটাকে কিভাবে বদলানো যায়। কারণ ঠাকুর ঘরে সব সময় থাকেন ইন্দুবালা দেবী ।আর গোপাল পরিবর্তন হলে ইন্দুবালা দেবীর নজরে সেটা পড়বেই। কারণ পূর্ব পুরুষের গোপালের চেহারার সঙ্গে তিনি ভালো ভাবেই পরিচিত।শেষ মেশ ইন্দুবালা দেবী কে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন আপনি। তাই ওঁকে খুন করে গোপাল পরিবর্তন করলেন। কিন্তু তাতেও আপনার মনের শান্তি মিটলো না। কারণ পরীক্ষা করে আপনি জানতে পারেন যে পূর্ব পুরুষের গোপাল টিও সম্পুর্ন সোনার নয় ! সোনার জল করা। তাই মা এর মৃত্যর আফসোস আপনার এবং লীনা দেবীর বেশি। আসলে আপনি কথার মার প্যাঁচ বুঝতে ভুল করেছেন। গোপাল ছিল ইন্দুবালা দেবীর সন্তানের মতো। আর সন্তান কে মা বাবারা সোনা ছেলে বলেই ডাকে। ইন্দুবালা দেবী বলতেন আমার সোনার গোপাল। সে সোনা কোনো ধাতু নয় ! আদরের ডাক ! আপনি একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী হয়েও সোনা চিনতে ভুল করলেন এতে আমার ভীষণ আফসোস হয় ! চক চক করলেই সব সোনা হয়না। তাই ছবির দুই গোপালের চেহারায় বিরাট পার্থক্য রয়েছে । যেটা প্রথম দিন আপনার বাড়িতে ঢুকেই আমার নজরে পড়েছিল ? " 

জয়চাঁদ বড়াল এবারে রক্ত চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , "আপনার কাছে কি প্রমান যে আমি মা কে বিষ দিয়ে খুন করেছি ? "

আমি হেসে বললাম , " আপনি চালাকি করে ছিলেন কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেন নি ? কারণ আপনাদের বাড়ির গোপালই আপনাকে ধরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সেবক কে খুন তিনি মেনে নিতে পারেন নি ! খুন করার পদ্ধতিটা আপনার বেশ অদ্ভুত। বিষ কথাটা মনে আসতেই সকলের মাথায় আসবে কোনো খাদ্য দ্রব্যে মিশিয়ে কাউকে খুন করা। যেহেতু ইন্দুবালা দেবী পুজো সেরে খাবার খেতেন । তাই তার আগে ওঁকে কিছুতে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানোর কথা ভাবলেই প্রসাদ কিংবা চরণামৃত এর কথা সবার মাথায় আসবে। কিন্তু আপনি তা করেন নি। এদিকে পূজা অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় ইন্দুবালা দেবী মারা গিয়েছেন তাই ওসব খাবারে বিষ মেশানোর প্রসঙ্গ আসে না। "

পঞ্চানন এবারে আমাকে জিজ্ঞাসা করল , " তাহলে বিষ খেলো কিভাবে স্যার ! "

আমি বললাম , " খুব সাধারণ ব্যাপার পঞ্চানন। অনেক সময় খুব সামান্য ব্যাপার আমাদের চোখ কে ধোকা দিয়ে দেয়। পূজার মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির মেয়েরা শঙ্খ বাজান। আর এই সুযোগ টা কাজে লাগিয়ে জয় চাঁদ বড়াল শঙ্খের মুখে বিষ লাগিয়ে রাখেন। আর শঙ্খ বাজানোর কয়েক মিনিট পরেই ইন্দুবালা দেবী মারা যান। তবে এই ব্যাপারে অবশ্যই ধন্যবাদ দেয়া উচিত ডক্টর ব্যানার্জী কে। উনি খুনের ব্যাপারটা আঁচ করে ছিলেন বলেই বুদ্ধি খাটিয়ে পুলিশে খবর দিতে বলেন। কি ডক্টর বাবু তাই তো ? "

ডক্টর ব্যানার্জি বললেন , " বেশ কিছু দিন ধরে ইন্দুবালা দেবীর সঙ্গে জয়চাঁদ বড়ালের তর্ক বিতর্ক চলছিল। রাত বিরেতে আমার কানে এসেছিল ব্যাপারটা। তাই ইন্দুবালা দেবীর আচমকা মৃত্যুতে সন্দেহ টা মনে জাগে।"


আমি বললাম , " ধন্যবাদ ডক্টর ব্যানার্জী ! পঞ্চানন , জয়চাঁদ বড়াল কে থানায় নিয়ে চলো। ইন্দুবালা দেবী হত্যা রহস্য এর ফাইল ক্লোজড। " 







Monday, September 12, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -19




 অবশ্যই দেখুন, কিন্তু আমার অনুরোধ জুতো পরে ভেতরে প্রবেশ করবেন না । পতিতালয় হলেও আমাদের এই ভগ্ন কুটিরে দেবতা বিরাজ করেন । 


ভেরি সরি । ঠিক আছে আমি এখান থেকে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিচ্ছি ।


 সে আপনার ইচ্ছে স্যার । অফিসার টর্চের আলোতে ভেতরটা লক্ষ্য করতেই উনি বললেন , ভেতরে একজন শুয়ে আছে উনি কে আপনার ? 


আমার পঙ্গু স্বামী , তিনি রোগ শয্যায় আছেন । প্লিজ ওকে জাগাবেন না । বহু কষ্ট করে ওকে ঘুম পাড়িয়েছি । জাগিয়ে দিলে সারারাত ঘুমাতে পারব না । 


অফিসার বললেন , ওকে জাগাবার দরকার নেই । আপনি অতি ভদ্র , আপনার ব্যবহারে অত্যন্ত খুশী । কিছুক্ষণের জন্য আপনার ঘুম নষ্ট করলাম বলে আমাকে ক্ষমা করবেন।


এখন আসি ওরা যাবার পর কপাটের খিল লাগিয়ে পাঞ্জাবীর কাছে এসে বলল , এবার উঠে পড়ুন দাদা । পুলিশ চলে গেছে । লোকটা তক্তাপোষের উপর বসে বলল , বহুত আচ্ছা কাম করেছিস বহেন । হামার নাম শিবাজী সিং আছে । এ এলাকার বহুত বড়া গুন্ডা আউর মাফিয়া আছি । লেকিন হামি সচকা পূজারী আছি । কোই আদমী বুরা কাম করলে বেইমানী করলে হামি তাকে বাঁচতে দেবে না । এক বড়া বেইমানি অফিসার কো জানসে মার দিয়া , ইসলিয়ে হামাকে জানসে মারনেকে অর্ডার দিয়া উঁচা মহলকা অফিসার। হামার মাথার দাম আছে পাঁচ লাখ রূপায়া । লেকিন তু এ লাইনমে ক্যায়সে আয়ে বহিন ! তু বহুত বড়া আদমীকে লেকড়ী আছিস । 


শ্যামলী বলল , আপনাকে সব কথা জানাচ্ছি । আপনি শুনুন । সংক্ষেপে প্রকাশ করল শ্যামলীদি । আমি পাশের ঘর হতে হাজির হয়েছি পুলিশরা প্রস্থান করতেই । প্রকাশ করার পর শ্যামলীদির চোখ দুটো জলে ভরে গেল । 


শিবাজী সিং শ্যামলীদির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল , রোনা মত্‌ বহিন এবার বোল হামার দ্বারা কুছ কাম হোবে ? শ্যামলী বলল , হ্যাঁ দাদা , এই লোকটাকে খোঁজ করে বের করতে হবে । আমি আপনাকে ওর একখানি ফটো দিচ্ছি । আপনার কাজে লাগবে । শ্যামলী ডায়রী হতে ফটোটা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল , এই কুলঙ্গার আমাদের ২ জনকে এই পতিতালয়ে বিক্রি করেছে । শিবাজী সিং দাঁতপাটিকে কড় কড় করে বলল , সোচ্ ম বহিন । তোরা হামার বহিন আছিস্ । হামি তোদেরকে কথা দিলাম , এই আদমী কো জলদী সে হাজির করবো তুমলোগকা পাশ । হামারা পত্তা লিখলো । কৌন কাম কে জরুরত হোবেত হামরা পাশ চলা জানা , কৌই ডর নেহি । হাম ঐ শালাকো ফটো লিয়ে যাচ্ছি । হাম চলতা বহিন , এ জায়গা মে রহনা ঠিক হোবে না । চলে বহিন তুমলোক শো যাও ।


 শিবাজী সিং বেরিয়ে গেলো । শ্যামলীদি ওর পিছন পানে তাকিয়ে দন্তে দত্ত চেপে আপন মনে বলতে শুরু করল , এবার পল্টু বাবু আর কতদিন লুকিয়ে থাকবে মশাই । তোমাকে একটি বার কাছে পাবার জন্য অনেক সাধনা করেছি , কিন্তু বারে বারে তুমি আমার নাগালের বাইরে চলে গেছো । যে কোন উপায়ে তোমায় দর্শন এবার পাবই ।


 তারপর শ্যামলীদি দাঁতগুলো বজ্রের মত কড়মড় করতে থাকল । শিবাজী সিং এর আশ্বাসে শ্যামলীদি পল্টু কে যেন নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ফেলল । প্লটুর দেখা না পাওয়া পর্যন্ত শ্যামলীদির জীবনে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ দারুন বেড়ে গেলো । শ্যামলীদিকে শোবার জন্য অনুরোধ করলাম দুজনে পুনরায় শুয়ে পড়লাম । রাত যে কত হবে ঠিক জানা নেই । শোবার একটু পরেই ধীরে ধীরে বেহুঁশ হয়ে পড়লাম । 


পরদিন ময়নার কথা মনে পড়তেই চোখ আমার ছল্ ছল্ করতে থাকলো । আমার জীবন তো মরুভূমি । তাই এই মরুভূমির মধ্যে ময়নাকে মরূদ্যান ভেবে নিয়েছি । ময়নার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার পর থেকে এক অনাস্বাদিত পূর্ণ পলকে আমার দেহমন ভরে উঠেছে ।


 শ্যামলীদিকে বললাম ময়নাকে দেখতে যাবার জন্য । তাকে পিড়াপিড়ী করাতে সে বলল , নিশ্চয় যাবো । কেন যাবো না ? ময়না তোর গর্ভজাত সন্তান না হলেও তুই মায়ের দায়ীত্ব স্কন্ধে নিয়েছিস । সে দায়িত্ব তোকে জীবন দিয়ে পালন করতে হবে মনে রাখিস । এটাই নারী জাতীর আদর্শ ।


 আমার কাছ হতে সরে পড়লো শ্যামলীদি । তার অভিমান ও ক্ষোভের কারণ কিছুটা অনুমান করলাম । সেও তো চেয়েছিল পাঁচজন নারীর মতো মা হতে , একটা ছোট্ট সংসারে সুখের নীড় বাঁধতে । কিন্তু বিধাতা তা হতে দেয়নি । ভদ্র মানুষের সমাজ হতে আমার মতো তাকেও আবর্জনার মতো দূরে সরে যেতে হয়েছে । আর কি অতীত সে ফিরে পাবে ? 


অকস্মাৎ দেবী বাবুর ডাকে আমার চিন্তার সূত্র কেটে গেল । বললাম , ভেতরে আসুন বাইরে কেন ? আমার অভ্যর্থনায় দেবী বাবুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । একটু বসুন , চা করি । 


দেবী বাবু কোন আপত্তি করলেন না । দেবী বাবুকে ঘরের চারিপাশ দেখতে দেখে বললাম , কি দেখছেন ? আপনার বাড়ির মতো আমাদের বাড়ীতে এতো আভিজাত্যের ছড়াছড়ি আছে কি , নেই । মনে রাখবেন এটা পতিতালয় । আপনাদের বাড়ীর মতো পবিত্র পরিবেশ খুঁজলে মিলবে না । কিন্তু আমাদের এই পাপ দেহের অভ্যন্তরে চিরন্তন নারীমন সুপ্ত হয়ে আছে । অনুকূল পরিবেশ পেলেই এই শাশ্বত নারীমনের জাগরণ ঘটবে । দেবী বাবু কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন , বাধা দিয়ে বললাম একটু বসুন , চা করে আনি তারপর আপনাকে কথা শোনাব । খানিক পরে প্রবেশ করে দেখলাম তিনি কিসের চিন্তায় মগ্ন হয়েছেন । মনে হল তার অতীতের ফেলে আসা দিনগুলির কথা চিন্তা করছেন । তিনি কত উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রহীন সমাজ বিরোধী ব্যক্তি ছিলেন । এই কলঙ্কিত জীবনের পাপ অজিতাকে মর্মে মর্মে দগ্ধ করেছে । একজন পতিতা তার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য যেভাবে নারীত্বের গৌরব নিয়ে নিজের জীবনকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করে তুলেছে তার নজির মেলে না ।


 ঈশ্বর কত রকমের মানুষ সৃষ্টি করেছেন । এই দেবীবাবুই একদিন কি ছিলেন । সেই অমানুষটার আজ কত পরিবর্তন ঘটেছে । কার জন্য এই পরিবর্তন ? নিশ্চয় এই পরিবর্তনের পিছনে কোন মহৎ প্রেরণা আছে। 


সহসা দেবীবাবুর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো । আমার পায়ের শব্দে তিনি চমকে উঠলেন । একি , কি ভাবছেন ? ভাবছেন আমি যাবো না , এই তো ? দেবীবাবুর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো । 


তিনি বললেন , না মানে ---


কোন ভয় নেই । নিন চা খান । ময়নাকে যখন মেয়ে বলে মেনে নিয়েছি ওকে না


সুস্থ করে ছাড়বো না । আপনি না এলেও যেতাম । শুধু আমি নই , শ্যামলীদিও আজ যাবে । দেবীবাবুর আনন্দ হল না তা নয় । 


কিন্তু ওর মুখ পানে তাকিয়ে থাকাতে তিনি মুখখানি নিচু করলেন । বুঝতে পারিনি । আমার চোখ দুটো কেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে চেয়েছিলো । আগে কতবার তো ওকে দেখেছি , কিন্তু কিসের লালসা জানিনা । কয়েকবার ঢোক গিললাম । কেন এমন হল । বার বার মনকে জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও কোন উত্তর পেলাম না । বার বার মনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে মনের কপাটকে খুলতে পারলাম না । অবশ্য একথা আমি আজো বিস্মৃতি হয়নি যে আমি একজন বারবনিতা ।


 একজন ভদ্র এবং আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তির কাছে আশ্রয় পাওয়া আমার স্বপ্নের অগোচরে , লোভ আমার নেই , বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার ক্ষমতাও আমার নেই , কিন্তু এক মহান কর্তব্যের আহ্বানে ছুটে চলেছি । সেইজন্য দেবীবাবুর পরামর্শ মতো কাজ আমাকে করতেই হবে । আমার নারীমনে কখন যে প্রেমের জোয়ার এসোছিল বুঝতে পারিনি । ক্ষণিকের তরে ভুলে গেলাম পতিতার জঘন্য নোংরামী , নিশি - যাপনের দুর্নিবার মোহ । আমি তখন আমার হৃদয় - মন্দিরে প্রেমের দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি । তখন আমার দেহ মন্দির পবিত্র সৌরভে সুরভিত হয়ে গেছে , আমার অন্তরে বিকশিত হয়েছে সতীত্বের শ্বেত শতদল । একসময় সমস্ত চিন্তা ভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দেবীবঝুর সাথে আমরা উভয়ে বেরিয়ে পড়লাম।


                                 ক্রমশ...

Saturday, September 10, 2022

ছোট গল্প - মাসির বাড়ি || লেখক - দীপঙ্কর সাহা || Short story - Masir Bari || Written by Dipankar saha


 

মাসির বাড়ি
দীপঙ্কর সাহা



-এক-
মাঝরাতে কাজলদিঘী স্টেশনে

রাত বারোটায় স্টেশনে নামতেই ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। গা টা ছমছম করে উঠলো আমার, জায়গাটা শুনেছি ভালো নয়। আগে যতবারই এসেছি, সব বারই দিনের বেলায়। কিন্তু এই বার সব কিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। 

কাজলদিঘী স্টেশন একটা অত্যন্ত ছোটো গ্রাম্য রেল স্টেশন, সারাদিনে গুটি কয়েক প্যাসেঞ্জার ট্রেন মাত্র দাড়ায় এখানে।

আমার ট্রেনটা ছিল সাড়ে আট ঘন্টা লেট। পথে এক জংশন স্টেশনে ট্রেনটা দাড়িয়ে আছে তো দাড়িয়েই আছে। কোন একটা ট্রেন নাকি আগে কোথাও ডিরেইলড হয়েছে, ফলে দুর্ভোগ যাত্রীদের। তার উপর আমার ট্রেনটা হলো প্যাসেঞ্জার ট্রেন, অন্যান্য সব ট্রেনের শেষে ওটার গতি হলো। 

পৌছবার কথা ছিল দুপুর সাড়ে তিনটেয়, পৌছলাম রাত বারোটায়। রাত সাড়ে নটার ট্রেন ধরে আমার ফেরার কথা ছিল, কিন্তু আজ সব কিছু উল্টো পাল্টা হয়ে গেল। 

আমি যাচ্ছি রমা মাসির বাড়ি, এই কাজলদিঘী রেল স্টেশন থেকে সাত আট কিলোমিটার দূরে মাসিদের গ্রাম, নারায়ণপুর। কিন্তু এই অজ পাড়াগাঁয়ের স্টেশনে এত রাতে কি আর গাড়ি ঘোড়া কিছু পাবো! এই হতচ্ছাড়া গ্রাম্য স্টেশনে তো ওয়েটিং হল বা রুমের কোনও অস্তিত্বও নেই। 

এই নাম না জানা গ্রাম্য জায়গায় তো হোটেলও পাবো না। কি করি তাই ভাবতে ভাবতে স্টেশন থেকে বেড়িয়ে এলাম। বাইরে বার হতেই দেখি কেষ্টদা রিক্সা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। 

-আরে কেষ্টদা, তুমি আজকাল রিক্সা চালাও নাকি? জানতাম না তো! 

কেষ্টদা কানে খুবই কম শোনে, ইশারায় আমায় রিক্সায় উঠে বসতে বলে। আমি আমার গন্তব্যে যাবার এক পরিচিত বাহন পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বেচেঁছি, উঠে বসতেই রিক্সা ছেড়ে দেয়। কেষ্টদা রিক্সা চালাতে থাকে হাওয়ার বেগে। 

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গ্রামের রাস্তায় আলোর আশা করি না। আকাশের দিকে চেয়ে দেখি শুধু কিছু তাঁরা মিটমিট করে জ্বলছে, চাঁদের দেখা নেই। মনে পড়ে গেলো চার দিন আগে মায়ের একাদশী গেছে, অর্থাৎ আজ তো অমাবস্যার রাত, চাঁদের দেখা পাবো কেমন করে? এই ঘোর অন্ধকারে কেষ্টদা কেমন করে এত জোর গতিতে রিক্সা চালাচ্ছে ভগবান জানেন। 

আমার ভয়, রিক্সা উল্টে মুখ থুবড়ে না পড়ি রাস্তার ধারে। কেষ্টদাকে বললাম - একটু আস্তে চালাও। কেষ্টদা কানেই নিলো না আমার কথা, বোধহয় শুনতে পেলো না। 

-দুই-
রমা মাসির কথা 

রমা মাসি আমার মায়ের ছোটবেলার 'বকুল-ফুল' পাতানো বোন বা বন্ধু। আমার মামাবাড়ি অর্থাৎ মায়ের বাপের বাড়ির পাশেই ছিল রমা মাসির বাপের বাড়ি। দুজনায় গলায় গলায় নাকি ভাব ছিল ছোটো বেলা থেকেই। 

তারপর দুজনের দুই জায়গায় বিয়ে হয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দুজনেরই মন খারাপ, কিন্তু এমনই যোগাযোগ, বেশ কিছু বছর বাদে দুজনে আবার এক জায়গায় এসে জড় হন। একদম সেই ছোটবেলার মতোই পাশাপাশি বাড়িতে। 

আমার বাবা ছিলেন রাজগ্রাম হাইস্কুলের হেডমাস্টার, সেই স্কুলেই রণজিৎ মেসো যোগ দেন এ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার হিসাবে। অনেক দিন পর মাসিকে আবার কাছে পেয়ে, মা বলে, - ছাড়াছাড়ি হলেই হলো, এর নাম হলো প্রাণের টান।

রাজগ্রাম হাইস্কুলের কাছেই থাকতাম আমরা। পায়ে হেটে যাতায়াত করেছি স্কুলে। আমাদের বাড়ি আর রণজিৎ মেসোর বাড়ি ছিল একদম পাশাপাশি। একদম শিশু বয়সে, দিনের বেশির ভাগ সময় নাকি আমি কাটাতাম রমা মাসির বাড়িতে। মাসির সন্তান হয়নি, আমাকেই মাসি ছোটো বেলা থেকে পুত্র স্নেহে মানুষ করেছেন। 

কিন্তু কয়েক বছর পর স্কুল মালিকের সাথে কি সব বিতর্ক বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, মেসো চাকরি ছেড়ে দেন, বলেন - পরের গোলামী বা চাকরি আর না। এইবার গ্রামে গিয়ে ভূমিপুত্রের মতো থাকবো, চাষবাসের কাজ করবো। 

কেষ্টদা ছিল রণজিৎ মেসোর ক্ষেতে কাজকর্ম করার লোক। ছোটখাটো চেহারা, দেখলেই বোঝা যায় অল্পবুদ্ধির মানুষ, কানেও একদম কম শোনে, তবে প্রচন্ড পরিশ্রমী এবং বিশ্বাসী লোক। তিন চার জনের কাজ একা হাতে করে নেয়। 

এর প্রায় এক যুগ বাদে মেসো দেহ রাখেন। মাসি নিরক্ষর মানুষ। যতদিন মেসো ছিলেন, মেসোর হাতের লেখায়, মাসির পাঠানো পোষ্টকার্ড প্রতি সপ্তাহে আসতো আমাদের বাড়ির ঠিকানায়। মা-ও চিঠির উত্তর দিতো সাথে সাথে। 

যে আমলের কথা বলছি, সে আমলে মোবাইলতো দুরের কথা, টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ছিলো না বললেই চলে, বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে। 

তারপর থেকে, কয়েক মাস অন্তর আমি বাড়ি এলে মাঝে মাঝেই মা আমাকে পাঠাতো মাসির গ্রামে। মেসোর অবর্তমানে মাসির চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কয়েক মাস অন্তর মাসির খবর নিতে না যেতে পারলে মা একটু অস্থিরের মতো করতো। 

খোঁজ খবর নিতে গেলেও মাসির কাছে থেকে আসতে হতো অন্তত একবেলা। এবং অতি অবশ্যই মাসির হাতের রান্না খেয়ে আসতে হতো । মাসির রান্নার স্বাদ এবং স্নেহের স্বাদ মনটা জুড়ে থাকতো বেশ কিছু দিন। 

-তিন-
মাসির বাড়ি

এবার এসেছি বছর খানেক বাদে, এক বছর তিন চার মাস পর। অফিসে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাড়িতেও আসা হয়নি অনেক দিন। ফলে দুই এক বছরের উপর হলো, মাসির খোঁজ খবরও নেওয়া হয় নি। 

রিক্সা চলছে ঝড়ের বেগে, একদম উড়িয়ে নিয়ে কেষ্টদা পৌঁছে দিলো মাসির বাড়ি, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাকে নামিয়ে দিয়ে কেষ্টদা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, মাঝরাতে গ্রামে যে অন্ধকার এত গভীর হয়, না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। 

-মাসি, ও মাসি কোথায় তুমি, কেমন আছো? আমি হাঁক পাড়তেই এক আবছা সাদা থান শাড়ির আবির্ভাব হলো, আমি প্রণাম করতে পায়ে হাত দিতে গেলাম, একটা ঠান্ডা মেঝের শীতল স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম মাত্র, আর সেই সাদা থান শাড়ি চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

এক দুর্বিষহ আতঙ্কে আমি দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে দৌড় লাগলাম পিছন দিকে, ঘণ অন্ধকারে কিসে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই। 

জ্ঞান ফিরলো পরদিন সকালে, দেখি মাঠের মধ্যে শুয়ে আছি, গা হাত পায়ে অসম্ভব ব্যথা, উঠে বসলাম খানিকটা প্রচেষ্টার পর। মাঠে শুয়ে থাকা অবস্থায়, দেখতে পাচ্ছিলাম, দু-তিনটি অচেনা মুখ ঝুঁকে আছে আমার দিকে। 

গ্রামের লোকজনদের কাছে জানতে পারলাম, মেসোর মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকে জমির কাজ সেরে স্টেশনের কাছাকাছি এক রিক্সা মালিকের রিক্সা চালাবার কাজ নেয় কেষ্টদা। বছর খানেক আগে এক অমাবস্যার রাতে মালিকের রিক্সা জমা দিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফেরার পথে, সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় তার। 

মাসির প্রতি দিন নদীতে স্নান করার বাতিক ছিল। কেষ্টদার মৃত্যুর দিনই সকাল বেলা ভরা অমাবস্যায় নদীতে বান আসে এবং মাসি সাতার কাটতে গিয়ে ভেসে যান। তিন চার কিলোমিটার দূরে তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায় পরদিন। 

Thursday, September 8, 2022

উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -7


 


১৫


পিসেমশায় বললেন, চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা- কালী- বাসুলী - তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে "শিবত্ব" লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।এখানেই বলে রাখি যে- প্রাচীন ও মধ্যযুগের বঙ্গবাসী পরবর্তীকালে নগর গড়ে তুললেও সে তার আদিম পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য কখনও পরিত্যাগ করেনি কিংবা বিস্মৃত হয়নি। এই বাঙালি মননের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নগরেও পূজা হয়েছে। উপচার হল পূজার উপকরণ। 


রতন বললো, আমার বাবা বলেন এমন কী, পূজার উপচারেও দেখা যায় নিষাদ উপকরণ। আপত চাল, তিল, জল, দুধ, কুশাগ্র, দই, যব, শ্বেতসরিষা, চন্দন, বিল্বপত্র বা বেলপাতা, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, ডালিম, বেল, অশোক, মানকচু, ধান, কলাগাছ, গম, মাষকলাই, তিসি। এ সবই প্রাচীন বাংলার লোকজসমাজের কৃষিপণ্য।এখানেই বলে রাখি যে প্রাচীন বাংলার নিষাদসমাজের তান্ত্রিক বিশ্বাস ও বাহিরাগত (আর্যরা প্রাচীন বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল বলে) আর্যবৈদিক মতের কিছু পার্থক্য রয়েছে। বহিরাগত আর্যদের বৈদিক ধর্মবিশ্বাসটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক।


পিসেমশাই বলেন, ঠিক  পক্ষান্তরে বাংলার অনার্যদের তান্ত্রিক মত মাতৃতান্ত্রিক। তা ছাড়া আর্যদের বৈদিক মত হল ঋষিজ: তার মানে দার্শনিক বা ফিলোফফিক্যাল। এ কারণে মানবকল্যাণে এর ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। অন্যদিকে তান্ত্রিকমত মুণিজ বা বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় জগৎসংসারে জীবজগতে এর প্রভাব প্রত্যক্ষ। সনাতনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত হল- দর্শনের সামগ্রিক দৃষ্টি এবং তন্ত্রমতের খন্ডিত বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একত্রিত হলেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। এ কারণেই বেদের যজ্ঞ এবং তন্ত্রের পূজা সম্মিলিত ভাবে সনাতনধর্মকে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে।পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ"।।এর তাৎপর্যঃ হলো "হে পার্বতি! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক"।


১৬ আমি বললাম আপনি আজ মাংসসাধনা সম্বন্ধে বলবেন বলেছেন।


পিসেমশাই বললেন মাংসাধনা  হচ্ছে, "মা, রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশভূত; যে ব্যক্তি সতত উহা ভক্ষণ করে, তাহাকেই মাংসসাধক বলা যায়। মাংসসাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে বাক্যসংযমী মৌনাবলম্বী যোগী"।মৎসসাধনার তাৎপর্য আরও গূঢ় ও প্রতীকী। "গঙ্গা-যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সতত চরিতেছে, যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে, তাহার নাম মৎস্যসাধক। আধ্যাত্মিক মর্ম গঙ্গা ও যমুনা, ইড়া ও পিঙ্গলা; এই উভয়ের মধ্যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস, তাহারাই দুইটি মৎস্য, যে ব্যক্তি এই মৎস্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ প্রাণারামসাধক শ্বাস-প্রশ্বাস, রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টিসাধন করেন, তাঁহাকেই মৎস্যসাধক বলা যায়"।আমি বললাম, তাহলে এই সাধনায় মাছ, মাংস, নারী, মদ সবকিছুর প্রয়োজন আছে। পিসেমশায় বললেন, ধারণা আরও পরিষ্ককার করতে হবে। এই সাধনা এইরকম।"...শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ পারদতুল্য আত্মার অবস্থিতি, যদিও ইহার তেজঃ কোটিসূর্য্যসদৃশ, কিন্তু স্নিগ্ধতায় ইনি কোটি চন্দ্রতুল্য। এই পরম পদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনী শক্তি সমন্বিত, যাঁহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, তিনিই প্রকৃত মুদ্রাসাধক হইতে পারেন"।মৈথুনতত্ত্ব সম্বন্ধে 'অতি জটিল' বিশেষণ আরোপ করা হয়েছে আগমসার গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, মৈথুনসাধক পরমযোগী। কারণ তাঁরা "বায়ুরূপ লিঙ্গকে শূন্যরূপ যোনিতে প্রবেশ করাইয়া কুম্ভকরূপ রমণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন"। আবার অন্য ঘরানার তন্ত্রে বলা হচ্ছে, "মৈথুনব্যাপার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ, ইহা পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইলে সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে"।যে 'সাধারণ' লোকেরা তন্ত্রের প্রথম উদ্গাতা ছিল এবং ম-কার যাদের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ, তাদের প্রতি পুরোহিতশ্রেণীর আশংকা, "...সাধারণ লোকে উদ্দেশ্য ও প্রকৃত মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তন্ত্রশাস্ত্র ও তন্ত্রোক্ত পঞ্চ-মকারের প্রতি ঘোরতর ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন"। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য, উভয় ঘরানার তন্ত্রেরই আকর উৎস বিভিন্ন আগমশাস্ত্র। আগমশাস্ত্র বস্তুতঃ আদি প্রযুক্তি প্রকৌশলের গ্রন্থিত সংগ্রহ। খেটেখাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষই আদিতে যাবতীয় আগমশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিল। কালক্রমে এইসব ভৌতশাস্ত্র আধিদৈবিক অতীন্দ্রিয় কর্মকান্ডের রূপ পরিগ্রহ করে ইতরজনের নাগালের বাইরে চলে যায়। 'সাধারণ' জনগোষ্ঠীর নৈতিকতায় 'মৈথুন' কখনই 'কদর্য, কুৎসিত' বোধ হয়নি। এই বোধটি আর্যায়নের সঙ্গে এসেছিল। শাস্ত্রকার এভাবে ব্যাখ্যা করছেন, "...আপাততঃ মৈথুন ব্যাপারটি অশ্লীলরূপে প্রতীয়মান হইতেছে, কিন্তু নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিলে, তন্ত্রশাস্ত্রে ইহার কতদূর গূঢ়ভাব সন্নিবেশিত আছে তাহা বুঝা যাইতে পারে। যেরূপ পুরুষজাতি পুংঅঙ্গের সহকারিতায় স্ত্রীযোনিতে প্রচলিত মৈথুন কার্য করিয়া থাকে, সেইরূপ 'র' এই বর্ণে আকারের সাহায্যে 'ম' এই বর্ণ মিলিত হইয়া তারকব্রহ্ম রাম নামোচ্চারণ রূপে তান্ত্রিক অধ্যাত্ম-মৈথুন ক্রিয়া নিষ্পাদিত হইয়া থাকে"।শারীরিক মৈথুনের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন আলিঙ্গন, চুম্বন, শীৎকার, অনুলেপ, রমণ ও রেতোৎসর্গ - তেমনই আধ্যাত্মিক মৈথুন ও যোগক্রিয়ায় তার সমান্তরাল কৃত্য, সেখানে 'তত্ত্বাদিন্যাসের' নাম আলিঙ্গন, ধ্যানের নাম চুম্বন, আবাহনের নাম শীৎকার, নৈবেদ্যের নাম অনুলেপন, জপের নাম রমণ আর দক্ষিণান্তের নাম রেতঃপাতন। এই সাধনাটির নাম 'ষড়ঙ্গসাধন' এবং শিবের ইচ্ছায় একে 'অতীব গোপন' মোহর দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া "কলির জীব পঞ্চ ম-কারের মর্ম বুঝিতে পারিবে না বলিয়া কলিতে ইহা নিষিদ্ধ হইয়াছে"। অতএব ইতরজনের জন্য এইসব দর্শন অধরা হয়ে গেল এবং  তাদের হাতে শেষ পর্যন্ত চক ছাড়া আর কিছু থাকতে দিল না। শুদ্রজন ও নারী এই সব শাস্ত্র প্রণয়নের সময় একই ধরনের সম্মান লাভ করত। সাধনযোগিনী নির্বাচনের যে প্রথাপ্রকরণ  বর্ণিত হয়েছে, সেখানে নারীকে এক ধরনের  পণ্য হিসেবে বোধ হতে পারে। নামে নারীই 'শক্তি', কিন্তু শক্তি সাধনের সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে, তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু উল্লেখ করা যায়। যেমন, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিনী নারী শান্তিদায়িনী। সে হবে গৌরাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, সর্বদা অমৃতভাষিণী ও রক্তনেত্রা। শঙ্খিণী নারী হয় মন্ত্রসিদ্ধকারী। সে হবে দীর্ঘাঙ্গী এবং নিখিল জনরঞ্জনকারিণী। এসবে মতান্তর থাকতে পারে। যে নারী নাগিনী গোত্রের, তার লক্ষণ হলো শূদ্র, খর্বা, নাতিদীর্ঘ, দীর্ঘকেশী, মধ্যপুষ্টা ও মৃদুভাষিণী। এরপর কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, দন্তুরা, মদতাপিতা, হ্রস্বকেশী, দীর্ঘঘোণা, নিরন্তর নিষ্ঠুরবাদিনী, সদাক্রুদ্ধা, দীর্ঘদেহা,  নির্লজ্জা, হাস্যহীনা, নিদ্রালু ও বহুভক্ষিণী নারীকে ডাকিনী বলা হয়।শাক্তদের মধ্যে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের নাম পশু আচারী ও বীরাচারী। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল প্রভেদ হচ্ছে পঞ্চ-ম কারের প্রচলন আছে, পশ্বাচারে তা নেই। কুলার্ণবতন্ত্রে এই দু' প্রকার আচারকে আবার সাত ভাগ করা হয়েছে। বেদাচারের থেকে বৈষ্ণবাচার উত্তম, বৈষ্ণবাচার থেকে শৈবাচার উত্তম, শৈবাচার থেকে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার থেকে বামাচার উত্তম, বামাচার থেকে সিদ্ধান্তাচার উত্তম, সিদ্ধান্তাচারের চেয়ে কৌলাচার উত্তম। কৌলাচারের চেয়ে উত্তম ।বিভিন্ন দেবতা এবং বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর। যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে। দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা ও বজ্রবৈরেচনী বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী। পূর্ণাভিষেকের সময় স্বয়ম্ভূ-কুসুমাদির প্রতি যে শুদ্ধিমন্ত্র উচ্চারিত হয় তা এরকম আবার ব্রহ্মশাপ বিমোচন মন্ত্র, শুক্রশাপ বিমোচন মন্ত্র বা কৃষ্ণশাপ বিমোচন মন্ত্র মদ্যের প্রতি উৎসর্গিত হয়। এই সব শুদ্ধি মন্ত্র বা উৎসর্গ মন্ত্রে যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তা এরকম। রজস্বলা স্ত্রীলোকের রজ, স্বয়ম্ভূ পুষ্প বা স্বয়ম্ভূ কুসুম মানে স্ত্রীলোকের প্রথম রজ , কুন্ডপুষ্প মানে সধবা স্ত্রীলোকের রজ, গোলকপুষ্প মানে বিধবা স্ত্রীলোকের রজ এবং বজ্রপুষ্প মানে চন্ড এই লক্ষণটি তন্ত্রচর্চায় ইতরযানী স্বীকৃতির নিদর্শন। এই সব 'পুষ্প' বামাচারী তন্ত্র সাধনার জরুরি উপকরণ। বাউলচর্যাতেও আমরা এজাতীয় পদ্ধতির প্রচলন দেখতে পাই।তন্ত্র শাস্ত্রে বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা আছেন। ব্যক্তি বিশেষে কেউ কালী, কেউ তারা কেউ বা জগদ্ধাত্রীকে ইষ্ট করেন। এছাড়া অন্যান্য দেবীরাও আরাধ্যা হয়ে থাকেন। উক্ত সব শক্তি দেবীর দীর্ঘ তালিকা নথিবদ্ধ আছে। এই সাধন প্রণালীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অতি জরুরি বিষয়। বিভিন্ন তন্ত্রে, যেমন পিচ্ছিলা তন্ত্র, বিশ্বসার তন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতিতে গুরুর লক্ষণ বিবৃত হয়েছে। গুরুকে সর্বশাস্ত্র পরায়ণ, নিপুণ, সর্ব শাস্ত্রজ্ঞ, মিষ্টভাষী, সুন্দর, সর্বাবয়ব সম্পন্ন, কুলাচার বিশিষ্ট, সুদৃশ্য, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী ইত্যাদি গুণশীল হতে হবে। শিষ্যের জন্যও নানা লক্ষণবিচার রয়েছেশিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু বীজমন্ত্র উপদেশ দেন। এই বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবীর জন্য পৃথক হয়। এই বীজমন্ত্রগুলি অতীব গুহ্য তাই তন্ত্রকারেরা তাদের গোপন রাখার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ও তার নতুন অর্থ সৃষ্টি করেছেন। এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকারী ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন। একে আদিম ক্ল্যাসিফায়েড কোডিং প্রসেসও বলা যায়।এক আধটা উদাহরণ দিই। '




১৭


পিসেমশাই বললেন এসব কথা সব জায়গায় বলতে নেই। আমি বললাম, না বললে আমরা জানব কি করে। পিসেমশাই বললেন, এখন তো জানা সহজ। গুগুল এর দয়া ছাড়া আছে কত বই।পড়তে হবে। শুনতে হবে বেশি।পিসেমশাই বললেন,   কালীবীজ' মন্ত্র, 'বর্গাদ্যং বর্ণহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম'। এখানে 'বর্গাদ্য' শব্দের প্রতীক হচ্ছে 'ক', 'বর্ণহি' শব্দের 'র', 'রতি' শব্দে 'ঈ' এবং তাতে বিন্দু যুক্ত। সব মিলিয়ে যে প্রতীকী শব্দটি তৈরি হলো তা হচ্ছে 'ক্রীং'। এইভাবে 'ভুবনেশ্বরী বীজ' 'হ্রীং', 'লক্ষ্মীবীজ' 'শ্রীং'। যৌগিক বীজও আছে, যেমন 'তারাবীজ' 'হ্রীং স্ত্রীং হূ ফট' বা 'দুর্গাবীজ' 'ওঁ হ্রীং দূং দুর্গয়ৈ নমঃ'। এই তালিকাটি অতি দীর্ঘ ও এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এছাড়া এমন কিছু বীজ আছে যেগুলি বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।তন্ত্রসাধনে 'গ্রহণ'-এও সিদ্ধিলাভ সম্ভব। হিন্দু শাস্ত্রে 'গ্রহণ' নিয়ে অনেক বিধি-নিষেধ প্রচলিত থাকলেও তান্ত্রিক মতে, তান্ত্রিক সাধনার যাবতীয় সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত সময় চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ। সমস্ত তান্ত্রিক তাঁদের মন্ত্র সাধনা এবং গুপ্ত সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য বছর ভর গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন। তন্ত্র শাস্ত্রে এমন কিছু সাধনার উল্লেখ আছে, যাতে সিদ্ধি লাভ করতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম আর কঠোর সাধনা করতে হয়। গ্রহণের সময় সেই সাধনায় বসলে অতি সহজে এবং অল্প সময়ে সাফল্য আসে। এবার জেনে নিন, কী কী সাফল্য পাওয়া যেতে পারে গ্রহণকাল থেকে,চাকরি বা ব্যবসায় উন্নতি: চাইলে গ্রহণের আগে স্নান সেরে পুজোর ঘরে শ্রীযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। যন্ত্রের সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিন। গ্রহণ শুরু হওয়ার পর পঞ্চোপচারে শ্রীযন্ত্রের পুজো করুন। গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই মন্ত্র জপ করতে থাকুন: 'ওঁ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলে কমলালয়ে প্রসীদ প্রসীদ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলভ্যে নমঃ'। বাড়িতে আলাদা করে কোনও ঠাকুরঘর না থাকলে যে কোনও শান্ত, পবিত্র স্থানে যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে পারেন।মামলায় জয় লাভ: সম্ভব যদি গ্রহণ শুরুর সময় বগলামুখী যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গোটা হলুদ, হলুদ ফুল আর কেশর দিয়ে পুজো করার পর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। একই সঙ্গে পুজোর পর একটি তিনমুখী রুদ্রাক্ষও যন্ত্রের সামনে রাখতে হবে। গ্রহণ যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ গোটা হলুদের মালা হাতে নিয়ে এই মন্ত্র জপ করতে হবে: 'ওঁ হ্রীং বগলামুখী সর্বদুষ্টানাং বাচং মুখং পদং স্তংভয় জিহ্বা কীলয় বুদ্ধি বিনাশায় হ্রীং ওঁ স্বাহা'।তন্ত্রের ভুল ব্যবহার থেকে মুক্তি: পেতে চাইলে গ্রহণের সময় একটি হলুদ, বড়ো, দাগহীন পাতিলেবু নিয়ে নিজের শরীরের ওপর সাতবার বুলিয়ে বা ঘুরিয়ে লেবুটিকে চার টুকরোয় কেটে ফেলুন। এবার সেই চারটি টুকরো চৌরাস্তার চার দিকে ফেলে দিয়ে আসুন।ভূ-লোকে রিদ্ধি-সিদ্ধি লাভের জন্য একটি মহাকুঞ্জিকা রচনা করেন মহাগৌরী পার্বতী। তিনি বলেন, তাঁর যে ভক্ত তাঁকে স্মরণ করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে, সে এই সংসারে জীবন সুখ-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে। ধন-ধান্য এবং সমৃদ্ধির অভাব হবে না। এটি একটি গুপ্তমন্ত্র। এই মন্ত্র পাঠ করলে মারণ, মোহন, বশীকরণ এবং উচ্চাটন ইত্যাদি উদ্দেশের সিদ্ধি হয়।এই মন্ত্রটি হল-- ওম এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে। ওম গ্লৌং হুং ক্লীং জুং সঃ জ্বালয় জ্বালয় জ্বল জ্বল প্রজ্বল প্রজ্বল এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে জ্বল হং সং লং ক্ষং ফট্ স্বাহা।নমস্তে রুদ্ররুপিণ্যৈ নমস্তে মধুমর্দিনী। নমঃ কৈটভহারিণ্যৈ নমস্তে মহিষার্দিনী।। নমস্তে শুম্ভহন্ত্রয়ৈ চ নিশুম্ভাসুরঘাতিনী।। জাগতং হি মহাদেবী জপং সিদ্ধং কুরুষ্ব মে। এংকারী সৃষ্টিরুপায়ৈ, হ্রীংকারী প্রতিপালিকা।। ক্লীংকারী কামরুপিণ্যৈ বীজরুপে নমোস্তু তে। চামুণ্ডা চণ্ডঘাতী চ য়ৈকারী বরদায়িনী। ভিচ্চে চাভ্যদা নিত্যং নমস্তে মন্ত্ররুপিণি।। ধাং ধীং ধূং ধূর্জটেঃ পত্নী বাং বীং বুং বাগদীশ্বরী। ক্রাং ক্রীং ক্রুং কালিকা দেবী শাং শীং শুং মে শুভং কুরু।। হুং হুং হুংকাররুপিণ্যৈ জং জং জং জম্ভনাদিনী। ভ্রাং ভ্রীং ভ্রুং ভৈরবী ভদ্রে ভবান্যৈ তে নমো নমঃ।। অং কং চং টং তং পং য়ং শং বীং দুং এং বীং হং ক্ষং ধিজাগ্রং ধিজাগং ত্রোটয় ত্রোটয় দীপ্তং কুরু কুরু স্বাহা।। পাং পীং পূং পার্বতী পূর্ণা খাং খীং খূং খেচরি তথা।। সাং সীং সুং সপ্তশতী দেব্যা মন্ত্রসিদ্ধিং কুরুষ্ব মেব।। ইদং তু কুংজিকায় দেবী হীনাং সপ্তশতীং পেঠত্‍‌। ন তস্য জায়তে সিদ্ধিররণ্যে রোদং যথা।।দুর্গা-মন্ত্রে দূর হবে সব বিপত্তি। রতন বললো, কেউ যদি  দুঃখ-দারিদ্র্যে জর্জরিত হয়, তার থেকে মুক্তির মন্ত্র আছে ?বা পারিবারিক কলহ রাতের ঘুম কেড়েছে ?


Wednesday, September 7, 2022

ছোট গল্প - জোনাকি ও দীর্ঘশ্বাস || লেখক - রোকেয়া ইসলাম || Short story - Jonaki oo Dirghaswas || Written by Rokeya Islam


 

জোনাকি ও দীর্ঘশ্বাস 

রোকেয়া ইসলাম 




বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে তিন বছরের ছেলে হাত বাড়িয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়ালো। তখন সন্ধ্যা রাতের দুয়ারে জোরেশোরে  কড়া নাড়ছে। অন্য বেবিট্যাক্সি থেকে মামা ও দেবর তড়িঘড়ি করে নামলো। জোনাকির স্বামী আহাদ বেবিট্যাক্সি ভাড়া মেটাতে না মেটাতেই দরজা খুলে দিলো আহাদের চেয়ে একটু বয়েসী এক ভদ্রলোক। তার নাম আবদুল মতিন । 

জোনাকি আকাশ ছোঁয়া খুশি আর নব অঙ্কুরিত আনন্দের ডালি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। আজ থেকে এই বাড়িটা ওদের নিজেদের। কোনো ভাড়া নেই, ভাগ নেই, ভাড়া দেবার তাগাদা নেই,ভাড়াটিয়া নামক "উঠুলি" পরিচয় নেই, ওরাই মালিক। অপার আনন্দে আপ্লুত জোনাকি। 

সবাই ড্রয়িং রুমে বসে। মাঝারি ধরণের চাকুরিজীবীর ড্রইং রুম বলতে যা বোঝায় তেমনি এটা। পাঁচজনের বসার মতো ব্যাবস্থা। তবে মতিন সাহেব   ভাড়ায় বেশ কয়েকটি ফোল্ডিং চেয়ার এনে রেখেছেন। 

জোনাকি জানে ওরা ভেতরের ঘরে থাকবে। বারান্দা ধরে ভেতরের ঘরে চলে যাওয়া যায়। 

এই রুমটি বেশ বড়সড়। বসা বা শোয়ার মত কোন ফার্নিচার নেই। 

ধোয়ামোছা রুমটায় আহাদ সকালেই লেপ-তোশক চাদর-বালিশ-পাটি কিনে রেখে গিয়েছিল। 

দেবর আর ছোটমামা মিলে বিছানা বিছিয়ে দেয় পাটপাট করে। বাইরে থেকে ব্যাগ সুটকেস টেনে নিয়ে আসে। 

মোটামুটি রাত্রিযাপনের স্বাস্থ্যকর  সুব্যাবস্থা হয়ে যায়। 

পাশের ঘর থেকে ভারি ভারি কথা টাকা পয়সার আদান প্রদান সিগনেচার,  সবশেষে চা মিষ্টির শব্দ ভেসে আসে। প্রত্যেকটা শব্দকে হীরেমানিক্যের মত করে সংগ্রহ করে জোনাকি। 

দুপক্ষের লোকজন চলে গেলেও ছোটমামা আর দেবর রইলো ওদের সাথে। 

আহাদ ঘরে ঢুকে সবকিছু সুন্দর ও ঝামেলা মুক্তভাবে সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে,  নিজেও বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে।

এই ফাঁকে জোনাকি ছেলের কাপড়চোপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে নিজেও সুস্থির হয়ে নেয়। 

জোনাকিকে বাথরুম থেকে বেরুতে দেখেই ওঠে পড়ে আহাদ। দেবরকে নিয়ে রাতের খাবার কিনতে বের হয়ে দরজা অবধি পৌঁছাতেই মতিন সাহেব ও তার স্ত্রী লিপি খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে। 

জোনাকির সাথে লিপির পরিচয় করিয়ে দেয় মতিন সাহেব । জোনাকি লিপির রুপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঝকঝকে গায়ের রঙ থেকে হলুদ আভা বের হচ্ছে। ছিপছিপে গড়ন নাক চোখ ঠোঁটের আকৃতি অপূর্ব। 

সকাল সকাল আহাদ নাস্তা কিনে আনার সময় কাঁচা বাজারও করে নিয়ে। একটুপরে কেরোসিনের চুলা বাসন কোসন বটিসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে আসে,  

পুরাতন সংসারি জোনাকি নতুন সংসারের আমেজে শুরু করে নতুন শহরে নব জীবনযাত্রা। 

এক সপ্তাহ পরে জোনাকির পুরাতন সংসারের জিনিসপত্র চলে আসবে। এইসময়ের মধ্যেই মতিন লিপিও চলে যাবে তাদের নতুন আবাসে। 

লিপি ওর তিনরুমের সংসারকে একরুমে গুটিয়ে বাঁধাছাঁদা করছে। 

মতিন টাকা পাইপাই করে বুঝে নিয়েছে আহাদ কাগজপত্র বুঝে নিয়েছে। 

একজন সংসার ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্যজন গুটিয়ে ফেলছে। এরমাঝেই একটু একটু কথায় কাছে আসে দুজন। 

চলুন ছাদে গিয়ে বসি। 

জোনাকির কথায় চমকে যায় লিপি। 

ছাদে যাবেন, ভাই জানে তো। 

আরে জানাজানি কি আছে। ছাদটা তো বাড়িরই অংশ। চলুন তো যাই আগে। আকাশ দেখি, খোলা বাতাস গায়ে মাখি। 

লিপি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জোনাকির উচ্ছ্বাস ভরা চোখের দিকে। 

ছাদে হাঁটছে জোনাকি আর লিপি। 

এই বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল বিহারি কলোনী হিসাবে।  বাড়িগুলো পৌঁনে দু'কাঠা জমির ওপর তৈরি। সরকারিভাবে একই নকশায় তৈরি, চুন শুরকির ঢালাই দেয়া লম্বা ঘরকে তিনটে রুমে বিভক্ত করা। একপাশে বাথরুম রান্নাঘর সামনে একটু খোলা জায়গা। 

এই রোডে এই বাড়িটাই একেবারে আলাদা এটা তিনতলার ফাউন্ডেশন দেয়া,  একতলা হবার পরই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। 

তখনই আঁটকে যায় বাড়ি তৈরির কাজ। 

দেশ স্বাধীন হবার পর মালিকানা বদলাতে থাকে।আহাদ তিনহাত বদলে চতুর্থ মালিক। 

নিচে চলুন তো সন্ধ্যা হয়ে এলো। 

একটু পরে যাই, এই তো সবে এলাম। 

না না চলুন তো। 


জোছনা রাতে, দুপুরের বৃষ্টিতে ছাদে আসেন তাই না। 

না কখ্খনো না কোনদিনও না। 

লিপির রুক্ষ কন্ঠস্বর ওর লাবন্যময় রুপের সাথে একেবারেই বেমানান। কোথায়  লুকিয়ে রাখে ওর এই কর্কশ স্বরের ডিপো,  কে জানে। 

জোনাকি লিপির কন্ঠস্বরকে একদম পাত্তা দেয় না, নিজের মত করেই চারপাশ দেখতে থাকে 

বড় রাস্তার উপর এই বাড়ি, রাস্তার ওপাশে মসজিদ স্কুল, হাতের নাগালে কাঁচা বাজার মার্কেট বড় ঔষধের দোকানসহ নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা, হাঁটা পথের দূরত্বে বাসস্ট্যান্ড। তাহলে মতিন সাহেবের মত ঘোরেল মানুষ তড়িঘড়ি এই বাড়িটা হাত ছাড়া করলেন কেন? তাও জলের দরে!  

সূর্য ভোরের আলোর নধর দেহটা সারাদিনের রুপালী তাপে পুড়িয়ে লাল করে অভিজ্ঞতাটুকু পৃথিবীতে রেখে ডুবছে নিশ্চিত ফিরে আসার অঙ্গীকারে। 

সন্ধ্যার মোহন রঙরুপের সবটুকু বিভা লিপির মুখে অপরুপ ছায়া ফেলে।  এক নারীকে কি অনন্য অসাধারণ লাগছে। রুপসী লিপিকে কি যে অসামান্য সুন্দর লাগছে। 

লিপির চোখে চোখ পড়ে জোনাকির,  ওর চোখের নিচে এতো কালি কেন!  মনে হয় কতরাত ঘুমায়নি ও। 

সুগঠিত স্বাস্থ্যের অধিকারী স্বামী, গোল্লা গুল্লু দুই ছেলে, স্বামীর নির্দিষ্ট বেতনের চাকরি নিরিবিলি সংসার, সবমিলিয়ে তো নির্ঝঞ্বাট জীবন। আর নিজের গা ভরা ঐশ্বর্যময় রুপ। তার আবার ঘুমের অসুবিধা কোথায়। 

ফুঁ দিয়ে মাইক পরীক্ষা করা হচ্ছে শুনেই লিপি বুঝে যায় মসজিদে এখনই মাগরেবের আজান হবে। 

চলুন এবার নিচে। 

জোনাকি ততোক্ষণে সন্ধ্যার অধরা  অপরুপ রূপে বিমুগ্ধ হয়ে গেছে। 

লিপি ওর হাত ধরে টান দেয়। 

চলুন তো এবার 

আজান শেষ হোক তারপর যাই

আমি কখনও আজানের সময় ছাদে থাকি না।চলুন

কন্ঠস্বর আগের চেয়েও তীক্ষ্ণ। জোনাকির নিরাসক্ত দৃষ্টিতে চোখ ছুঁয়ে দুপদাপ নেমে পড়ে লিপি। 

খোলা ছাদে হাঁটছে জোনাকি। সূর্য প্রতিদিনের মতোই  চেনা অথচ  অচেনা নতুন রুপে রক্তিম পথে ছুটছে। আজানের শব্দে জেগে যায় পুরো এলাকা। 

হঠাৎ জোনাকি ঘাড়ের কাছে দীর্ঘশ্বাস আর মৃদু স্পর্শ। লিপি ফিরে এসেছে ভেবে পেছন ফিরতেই দমকা বাতাস ওর খোলা চুলগুলো এলোমেলো করে উড়িয়ে দেয়,  এবার কোনকিছু না ভেবেই সিঁড়ি ভাঙতে থাকে জোনাকি। 

দীর্ঘশ্বাস আর মৃদু স্পর্শে জোনাকির ঘুম ভেঙে যায়। সফল সঙ্গম শেষ নিসাড়ে ঘুমাচ্ছে আহাদ। জোনাকিরও তো এখন গভীর ঘুমে থাকার কথা তাহলে কি নতুন জায়গার কারণে ওর ঘুম ভেঙে গেল ভাবতেই পাশের ঘর থেকে চাপা কন্ঠস্বর ভেসে আসে রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে। 

মহিলার সাথে তো খুব খাতির পাতিয়ে ফেলেছো।  তা তোমার নাগরের কথাও কি বলেছো নাকি ওকে। 

কি বাজে বকছো এতো রাতে। 

আমি বাজে তাই না, বাজে বকছি আর তুমি কী? ঘরে ভাতার বাইরে লাঙ্গ ছিনাল মাগী। হায়রে মাগীর রুপ, জ্বইলা গেলাম রুপের আগুনে। 

চুপ কর তুমি চুপ কর,  পাশের ঘরে ওরা আছে। 

আছে তো কী হইছে আজ না জানলেও কাল তো জানবেই। আহাদ সাহেব তো বারবার জিজ্ঞেস করছিলো আমি কেন দামি জায়গা হাতছাড়া করলাম। 

মতিন সাহেব চুপ কর থাকে। নারী-পুরুষের দীর্ঘশ্বাসে রাতের প্রহর দীর্ঘ মনে হয় জোনাকির। 

ওঠে দাঁড়াতেই মতিন সাহেবের কন্ঠে নিরবে কাত হয়ে কান খাঁড়া করেশুয়ে পড়ে জোনাকি। 

কেমনে তারে বলি আমার ঘরের রুপে বাড়ি পুড়াইছে। দেহের রঙ্গে আমার কপাল পুড়ছে। বৌয়ের বিগারে নাগর উতলাইছে। খারাপ মাগী আমার ঘরে হান্দাইছে। 

এগুলো তোমার ভুল ধারণা,  বুঝবে একদিন কত বড় ভুল করলে জীবনেও শুধরাতে পারবে না তা। 

ঔ মাগী আমি ভুল করছি আর তুই কি করছোস তর নাগরের সাথে, তোর ঘাড়ে নখের দাগ, তুই দেখাস নাই আমাকে। ভুল আমি করছি। 

মতিনের উত্তেজিত কন্ঠে নরম আওয়াজ ঢালে লিপি 

আমার যা মনে হয়েছে যা অনুভব করেছি সেটাই বলেছি। বলাটা কি ভুল। 

তোর নগরকে কি ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিস নতুন বাসার। আমি না থাকলে দুইজনে শুবি। 

আমি তো জানি না কোথায় যাচ্ছি কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাদের। 

বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ে জোনাকি। কলজে কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ওর কানে ঝাপটা মারে। 

কার মন বেশি খারাপ? মতিন সাহেবের না লিপির। 

মতিন সাহেবের কথায় বাড়ি বিক্রি করার মূল রহস্য টের পায় জোনাকি। লিপিকে উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওর ভেতরটা কতটা বহির্মুখী। 

উপরে স্বামী সন্তান অন্তপ্রাণ এক নারী। যতটুকু দেখেছে এই দুদিন। লিপির অন্তঃমুখী স্বভাবটা টেনেছে জোনাকিকে। অথচ ভেতরে ভেতরে কতটা বহির্মুখী একবারও বুঝতে পারেনি জোনাকি। 

মানুষ চেনা বড় কঠিন। 

কতটুকু চিনেছে লিপিকে কতটুকু চিনেছে মতিন সাহেবকে? প্রশ্নটা রাতের ঘুমকে গুঁড়িয়ে চুরমার করে দেয়। 

দুপুরের রান্না শেষ করে ছেলেকে গোসল করিয়ে ভাত খাইয়ে গল্প শোনাচ্ছে তখনই লিপি ঘরে ঢোকে। 

মেঝেতে পাতা বিছানায় দুজনে পা ছড়িয়ে বসে। জোনাকির চোখ জোড়া লিপির সুন্দর মুখের ভূগোল পরিক্রমা করতে থাকে বারবার। 

আপনারা তিনজনই থাকবেন বাসায়। 

মেয়ে, এই ছেলের ছোট। কাজকর্মের ঝামেলায় ওর অযত্ন হবে তাই মায়ের কাছে রেখে এসেছি,  তাকেও নিয়ে আসব, আর আছে শাশুড়ির আমলের একজন মহিলা। সংসারের কাজে সাহায্য করবে সেও থাকবে। স্বামীর ব্যাবসার লোকজনের আসাযাওয়া তো আছেই। আত্মীয় স্বজনরা কেউ না কেউ থাকেই। 

তাহলে সমস্যা হবে না,  আমার সাথে থাকার মত কেউ ছিল না। দুই ছেলে আর মতিন। আমার গায়ের রঙটা আরো সমস্যা। 

কন্ঠটা বুঁজে আসে লিপির। খপ করে ধরে ফেলে জোনাকি লিপির অস্পষ্ট কন্ঠস্বর।

কী ধরণের সমস্যা? 

লিপি এবার ওর ঠোঁট জোড়ায় টিপতালা মেরে দেয়।  আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জোনাকিকে দেখতে থাকে। 

জোনাকি লিপির মত টকটকে ফর্সা নয়, চেহারা সুরতও চৌকশ নয়। 

নিজের গায়ের রঙ নিয়ে আফসোস ছিল জোনাকির কিন্তু হীনমন্যতা নেই কোনকালেই। এই মূহুর্তে লিপির দৃষ্টির কাছে আফসোসটা প্রকট হয়ে ওঠে।  তিনটে ঠেলাগাড়িতে  দীর্ঘদিনপর সংসার তুলে বিদায় নিতে আসে লিপি। জোনাকিকে জড়িয়ে ধরে। এই কয়টা দিনেই কতটা কাছে এসেছে দুজন মনের অজান্তেই। আজ যাবারকালে বিষয়টা প্রকট হলো। 

চোখ মুছে দুজনই।

সাবধানে থাকবেন,  আর যখন তখন ছাদে যাবেন না। 

আরো কিছু বলার উপক্রম করতেই দেখে ঘাড়ের কাছে মতিন সাহেব দাঁড়িয়ে। জোনাকির পিঠে হাত রেখে এগুতে থাকে আস্তে হাতটা সরে যায় লিপির দেহের টানে। 

লিপির কি মায়া পড়ে গেছে জোনাকির জন্য? ওকে ছাদে যেতে বারণ করলো কেন লিপি? 

পরদিনই পুরো সংসার ট্রাকে তুলে নিয়ে আসে আহাদ সাথে শাশুড়ীর আমলের  মিনার মা। 

নতুন উদ্যমে সব গুছিয়ে নেয়। নতুন বাড়ি দেখতে আসে জোনাকির মা বাবা। ফিরে যাবার সময় কোলের মেয়েকে জোনাকির কোলে দিয়ে যায়। নতুন বাড়ি এখন ঝলমল করে ওঠে সংসার আনন্দের  আপন বিভায়। 

এতোকিছুর মধ্যে ছাদটা প্রিয় হয়ে গেছে জোনাকির কাছে। খুব ভোরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, ছাদের সিঁড়ির প্রথম ধাপে বসে বই পড়ে গান শোনে। বিকেলে ছেলেমেয়েসহ ছাদে পাটি বিছিয়ে গল্প করে। ওরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলে। জোছনা রাতে একাকী ছাদে হাঁটে। 

লিপির সাবধান বাণী মনেও পড়ে না জোনাকির। 

একদিন ভর সন্ধ্যায় কি কারণে যেন মেয়ে কাঁদছে তার শব্দ ভেসে আসে ছাদে। দ্রুত নামতে থাকে জোনাকি, হঠাৎ পেছনে ধাক্কা এবং ঘাড়ের কাছে  আঁচড় অনুভব করে,  তাল সামলে নিতে পাশের দেয়াল ধরতে ধরতে মনে হলো কে যেন আঁচল টেনে ওকে পড়ে যাওয়া আঁটকে দিল। পেছন ফিরে দেখে বাতাসে আঁচল উড়ছে। মেয়ের কান্নার শব্দ জোরে হতে ভেতরে চলে আসে জোনাকি। 

লিপি আর মতিন সাহেব এসেছিল ছেলের স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিতে, স্কুলের কাজ সেরে মতিন সাহেব কাঁচা বাজারে ঢোকে তার আগে লিপিকে রেখে যায় জোনাকির কাছে। 

লিপি আজ সুযোগ পেয়ে খুলে দেয় ওর মনের অবরুদ্ধ জানালা। কীভাবে মতিনের মিথ্যে সন্দেহ তেতো হয়ে গিয়েছে ওর মিষ্টি জীবন। সন্দেহ মতিনকে মানসিক রোগীতে রুপান্তরিত করেছে। যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতেও প্রতিদিন স্বামীর সুস্থতা কামনা করে। সমাজের ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারে না,  এমনিতেই ঘরে দিবানিশি লাঞ্জিত হচ্ছে ঘটনার সত্যতা বিচার না করেই সমাজ ওকে লাঞ্জিত করবে। বড়বোনকে কিছুটা বলেছিল,  বড়বোনও মতিনের সাথে তাল মিলিয়েছে। হাড়ির একটা ভাতে টিপ দিয়েই পুরো সামাজিক অবস্থা বুঝে নিয়েছে লিপি। সহ্য করার নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে অসহনীয় জীবনটায়। বাড়ি বিক্রি করেছে লিপির সব গহনা বিক্রি করেছে। লিপিকে সামান্য প্রসাধনী কিনে দেয় না কোন আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ওকে নিয়ে যায় না। সারাক্ষণ লিপিকে চোখে হারায়, সন্দেহ আর ভালবাসা এক বাড়িতে থাকে না,  নাকি থাকে বুঝতে পারে না লিপি। বুঝতে পারে না ওর রূপের কারণে না মতিনের ভালবাসার আধিক্য ওর সহজ যাপন মরণসম বাঁচা  হয়ে গেল। 

হাজারো যন্ত্রণার কথা বলতে ফুঁপিয়ে  কেঁদে ফেলে লিপি। 

মতিন ভাই কি তেমন কাউকে পেয়েছে যাকে ঘিরে সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে?

মুখ ফসকে বলে ফেলে জোনাকি 

সে আরেক যন্ত্রণার ইতিহাস। সন্দেহের পোকা মাথায় ঢোকার পর থেকে নানাভাবে খুঁজতে থাকে আমাদের আশেপাশের পুরুষ মানুষের দৃষ্টি কেমন তারা কীভাবে কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর আরেক পন্থা অবলম্বন করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি বলে আশেপাশে লুকিয়ে থাকতো। বাড়ির চারপাশে নজর রাখতো আমি কী করি কোথাও যাই কিনা,  কেউ আসে কিনা?  একবার গোপনে ছাদে ওঠে দেখে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা স্টেশনারি দোকানে বসে আছে এক তরুণ। লাগলো তার পেছনে। খবর নিয়ে জানলো দোকান মালিকের পুত্র স্থানীয় এক কলেজে পড়ে। মাঝে মাঝে বাবার কাজে সাহায্য করতে আসে। কিছুদিন তাকে নিয়ে খুব যন্ত্রণা দিতে থাকে। অথচ তরুণকে কিছুই বলে না,  একসময় তরুণ দেশের বাইরে চলে গেলে মতিন আবার আরেকজনকে আবিষ্কার করে তাকে নিয়ে যন্ত্রণা দিতে থাকে। 

রাতে ঘুম ভেঙে যায় জোনাকির।  ছাদে কারো হাঁটাচলা শব্দ রড টানাটানির প্রকট শব্দ। আহাদ আর মিনার মাকে জাগিয়ে ছাদে যায় জোনাকি। 

পুরো ছাদ থৈ থৈ করছে জোছনা। একখণ্ড রডও কোথায়ও পড়ে নেই। নিচের কলাপসিবল গেটে তালা, লোকজন আসবে কীভাবে!

আহাদ সহজ সমীকরণ দেয়,  পাশের বাসার কোন পরীক্ষার্থী রাত জেগে পড়ছে মাঝে মাঝে চেয়ার টানছে, রাতের শব্দহীন সময়ে সামান্য শব্দটাই জোরে বাজছে জোনাকির কানে। হাই তুলতে তুলতে নিচে নেমে যায় আহাদ। ঘুম ভাঙা বিরক্তি নিয়ে আগেই নেমে গেছে মিনার মা। 

মাতাল জোছনায় হাঁটছে জোনাকি। কেউ যেন পিঠে দু'হাত দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। অনুভূতিটা প্রবল হতেই ব্লাউজের একটা অংশ ধরে টেনে ধরার অনুভব টাও টের পায়। 

থমকে দাঁড়ায় জোনাকি, ফেলতে যাওয়া পায়ের পাতাটা  যদি ফেলতো তাহলে সেটা ছাদের কংক্রিটে নয় শূন্যে ফেলতো ফলাফল হতে পায়ের টানে জোনাকির শরীরটা মাটিতে গিয়ে পড়তো। নিশ্চিত দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেল!  

একটু সুস্থির হয়ে খেয়াল করে কেমন করে এতোটা কিনারে চলে এলো,  নিজের উপর কি নিয়ন্ত্রণ নেই ওর!

ওর পেছনে কারা এই অশরীরী। একজন ধাক্কা দিতে চায় অন্যজন আঁটকে দিতে চায়। 

পড়িমরি করে নামতে থাকে জোনাকি হঠাৎ ঘাড়ের কাছে নখের আঁচড়ের স্পর্শ পায়। সিঁড়ির শেষ ধাপে ওর কানের কাছে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হয়,  পেছন ফিরতেই মনে হয় একটা ছায়া আঁধারে মিশে গেল। এবার সমস্ত শরীর জুড়ে ভয়ের কাঁপুনি শিরদাঁড়া দিয়ে আতংকের ঢল নামে। 

দৌড়ে এসে ঘরের ছিটকিনি আঁটকে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকে ভেতরে ভয় নিয়ে। 

ভোরের আলো ফুটতেই ভয় নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। জোনাকি মনের ভেতরের দ্বিধা নিয়ে তাকায় দিনের প্রথম আলোর দিকে।

ওর বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। এই সময়ের মধ্যে কোনদিন কোন কথা গোপন করেনি আহাদের কাছ থেকে। এই প্রথম যতবার রাতের ঘটনা দিনে বলতে চেয়েছে ততোবারই লিপির দুঃসহ জীবন জটিল যাপনের চিত্র লিপির চোখের জলে ভেসে ওর কাছে এসেছে।

আহাদও যদি মতিনের মত ভুল বুঝে ওকে ওর সুস্থির যাপনকে অস্থির করে তোলে!

জোনাকি তো ছোটবেলা থেকেই অন্যদের তুলনায় সাহসী। এতোদিনে তো বুঝতে পারছে দীর্ঘশ্বাস আঁচড়ের বিষয়টা শুধু ওর সাথেই হচ্ছে আর কারো সাথে নয়। ছেলেমেয়েদের একা একা ছাদে না দিলেই সমস্যাটা কাটান যাবে।

একরাতে আহাদ বাসায় নেই। ওর ব্যবসায়ের দুজন লোকও বাসায় নেই। ছেলেমেয়ে দুজন পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। মিনার মা নিচে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যাবেলায়ই।

মাথার কাছের জানালা খুলে ঘুমিয়েছে জোনাকি।

প্রবল আলোর স্রোতে ঘুম ভেঙে যায় ওর। এতো ভুলো মন ওর,  আলো জ্বেলে ঘুমিয়েছে!  ওঠে লাইট নিভিয়ে পাশ ফিরে শুতেই লাইট জ্বলে ওঠে। ওর সমস্ত শরীরের লোম কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিরাতে কলাপসিবল গেটে তালা দেয়া, ভেতরের কাঠের মূল দরজা হুড়কো টেনে বন্ধ করা, প্রত্যেক ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয়া। ও নিজে করে। কখনো ভুল হয় না।আজও হয়নি। তাহলে? জোরে মিনার মাকে ডাকতে গিয়ে গলা জড়িয়ে আসে ভয়ে।

লাইট নিভে যায়।কেউ যেন পুরো ঘর জুড়ে হাঁটছে এলোপাথাড়ি। উপস্থিতি নিরব হলেও অনুভব সরব। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

ভয়ে কলজে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, প্রচণ্ড তৃষায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিতেও সাহস হচ্ছে না।

অশরীরী হেঁটে চলছে অবিরাম। হুট করে খুলে যায় দরজা। হু হু করে দমকা বাতাস ঘরে ঢোকে। জোনাকি বুঝতে পারে বাইরে প্রচণ্ড ঝড় বইছে। ভয়ংকর কড়কড় শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অঝোর বৃষ্টি আওয়াজ বুঝতে পারে। চাদর আর বালিশে সর্বাঙ্গ মুড়ে অধমরা হয়ে পড়ে থাকে। নিজের শ্বাস প্রশ্বাসও অচেনা মনে হয়।

অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারে অশরীরী আর নেই। তবুও মুখের ওপর থেকে বালিশ সরিয়ে চাদরের তলা থেকে বের হবার সাহস শক্তি কোনটাই অবশিষ্ট নেই জোনাকির। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে, সাথে থাকে ভোরের প্রতীক্ষা।

দিনের সূচনা হতেই দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়ায়। গতরাতের ঝড়বৃষ্টির কোন লক্ষ্মণ দেখতে পায় না জোনাকি। তবে পেছনে কারো উপস্থিতি টের পায় ভয়ে ভয়ে তাকাতেই দেখে মিনার মা দাঁড়িয়ে আছে।

আলতো স্পর্শ দীর্ঘশ্বাস আর গভীর রাতে ছাদে রড টানাটানি নিয়ে কেটে গেছে এবাড়িতে কয়েক বছর।

সরকার বিহারি কলোনীর দায়িত্ব দেয় পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর। আহাদ দৌড়াতে থাকে পূর্ত মন্ত্রণালয়ে দলিল নিজের নামে করার জন্য। মন্ত্রণালয়ে দৌড়াতে গিয়ে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েকবার বলেছে শালা মতিন তুই বড় ধড়িবাজরে। ফাউ ফাউ কতগুলো টাকা নিয়ে গেলি আমার কাছ থেকে।

সরকারি মূল্য পরিশোধ করেই নিঝঞ্ঝাট মালিকানা বুঝে সুস্থির নিশ্বাস ফেলে আহাদ।

আহাদের সাথে জোনাকিও দৌড়াতে থাকে বাড়ির  আদি মালিকের খোঁজে। বিজলি মহল্লার সেখানেই পায় চুন্নু বকশীকে। বয়স আশির কোটা ছুঁই ছুঁই। সহজে মুখ খোলে না। সরু দৃষ্টিতে তাকাতো জোনাকির দিকে।পরে এনজিওর লোক ভেবে অনেক তথ্য দিয়েছে।

জোনাকিদের বাড়ির মূল মালিক  ছিল আরফান খান। সে ছিল এই রোডের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী। যেমন ছিল তার টাকার অহংকার তেমনি ছিল তার সৌখিনতা আর বদমেজাজ। তার ছিল অসম্ভব সুন্দরী তিন কন্যা। বড়মেয়ে লাভলী বেগমের সাথে গোলার টেকের বাঙালি তরুণ কামালের প্রেম হয়ে যায়। কথা জানাজানি হয়। পুরো দেশ জুড়ে তখন ঊনসত্তরের উত্তাল সময়।

আরফান খান পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হলেও বিহারের জামশেদপুরের পাঁচ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আসা খান বাঙালি সমাজকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। প্রথম জীবনে অভিজাত স্বচ্ছল অবস্থান থেকে পরবর্তী জীবনে রিফিউজি।  এদের কোন দেশ নেই। দেশপ্রেমও নেই। থাকে না মাটির প্রতি সংযোগ।

ঊনসত্তরের উত্তাল আন্দোলন এদের পুনরায় রিফিউজি জীবনে পর্যবসিত করতে পারে, সেই শংকাও ভেতরে তীব্রভাবে কাজ করে। অন্যদিকে কামাল একজন খাঁটি বাঙালি পরিবারের সংস্কৃতিমনা সন্তান।

আরফান খান কামালের সাথে একান্তে কথা বলতে চান। শুনে আনন্দে আত্মহারা লাভলী। তার অহংকারী পিতা তার প্রেম মেনে নিয়েছে এরচেয়ে পৃথিবীতে আনন্দের আর কী আছে। লাভলী নিজেই কাবাব বানাতে বসে যায় ওর বোনেরাও দুএক পদ তৈরি করে,  বিশেষ পদ তৈরি করে আরফান খান নিজে। 

পরদিন ভোরে আশেপাশে লোকজন দেখতে পায় তুরাগে জলে কামালের দেহের নিম্মাঙ্গ এবং জলের উপর পাড়ে শুয়ে আছে উর্ধাঙ্গ। 

পরদিন বিকেলেই আরফান খানের পরিবারে  আরেকটি জানাজার আয়োজন করতে হয়। 

লাভলী ঝুলছিল তাই কামালের দেয়া মহরমের মেলা থেকে কেনা ওড়না গলায় বাঁধে। 

চলে যাবার আগে জেনে গিয়েছিল আরফানের নিষ্ঠুর চাতুর্য। 

হেরে গেল আরফানের  ভয়ংকর মানসিকতার কাছে কামাল আর লাভলীর প্রেম। 

দেশ স্বাধীন হবার পর ওরা এদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায়। 

চুন্নু বকশী এটুকুই জানে। 

সেদিনের সেই একতলা বাড়িটা ছ'তলা হয়েছ। 

একতলা  দোকান এবং দোতলা অফিস  কমার্শিয়াল হিসাবে ভাড়া তিনতলা চারতলা জুড়ে জোনাকির ভরভরন্ত সংসার। পাঁচতলা ছতলা দু ইউনিট করে চার ভাড়াটিয়ার কাছে ভাড়া। 

এতো বছরে কত ভাড়াটিয়া এলো গেলো,  কেউ কখন লিপির আর জোনাকির সমস্যার কথা বলেনি। 

এখন ছাদ বাগানে জোছনা রাতে হাঁটাহাঁটি করে দোলনায় দোল খায় জোনাকি। রোজ বিকেলে বাগানের যত্নআত্তি নিজেই করে। 

দীর্ঘকাল দীর্ঘশ্বাস আর আঁচড়ের স্পর্শ পায় না। 

সেদিনের সেই দোকানটাও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়েছে। ক্যাশ কাউন্টারের আরামদায়ক চেয়ারে বসে পৌঢ় ভদ্রলোক। 

তার দিকে তাকিয়েই দীর্ঘকাল পরে লিপির জলভরা চোখ জোড়া মনে পড়ে।

বুক কাঁপিয়ে বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সোনাকির।