ছোট গল্প - মাসির বাড়ি || লেখক - দীপঙ্কর সাহা || Short story - Masir Bari || Written by Dipankar saha


 

মাসির বাড়ি
দীপঙ্কর সাহা



-এক-
মাঝরাতে কাজলদিঘী স্টেশনে

রাত বারোটায় স্টেশনে নামতেই ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। গা টা ছমছম করে উঠলো আমার, জায়গাটা শুনেছি ভালো নয়। আগে যতবারই এসেছি, সব বারই দিনের বেলায়। কিন্তু এই বার সব কিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। 

কাজলদিঘী স্টেশন একটা অত্যন্ত ছোটো গ্রাম্য রেল স্টেশন, সারাদিনে গুটি কয়েক প্যাসেঞ্জার ট্রেন মাত্র দাড়ায় এখানে।

আমার ট্রেনটা ছিল সাড়ে আট ঘন্টা লেট। পথে এক জংশন স্টেশনে ট্রেনটা দাড়িয়ে আছে তো দাড়িয়েই আছে। কোন একটা ট্রেন নাকি আগে কোথাও ডিরেইলড হয়েছে, ফলে দুর্ভোগ যাত্রীদের। তার উপর আমার ট্রেনটা হলো প্যাসেঞ্জার ট্রেন, অন্যান্য সব ট্রেনের শেষে ওটার গতি হলো। 

পৌছবার কথা ছিল দুপুর সাড়ে তিনটেয়, পৌছলাম রাত বারোটায়। রাত সাড়ে নটার ট্রেন ধরে আমার ফেরার কথা ছিল, কিন্তু আজ সব কিছু উল্টো পাল্টা হয়ে গেল। 

আমি যাচ্ছি রমা মাসির বাড়ি, এই কাজলদিঘী রেল স্টেশন থেকে সাত আট কিলোমিটার দূরে মাসিদের গ্রাম, নারায়ণপুর। কিন্তু এই অজ পাড়াগাঁয়ের স্টেশনে এত রাতে কি আর গাড়ি ঘোড়া কিছু পাবো! এই হতচ্ছাড়া গ্রাম্য স্টেশনে তো ওয়েটিং হল বা রুমের কোনও অস্তিত্বও নেই। 

এই নাম না জানা গ্রাম্য জায়গায় তো হোটেলও পাবো না। কি করি তাই ভাবতে ভাবতে স্টেশন থেকে বেড়িয়ে এলাম। বাইরে বার হতেই দেখি কেষ্টদা রিক্সা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। 

-আরে কেষ্টদা, তুমি আজকাল রিক্সা চালাও নাকি? জানতাম না তো! 

কেষ্টদা কানে খুবই কম শোনে, ইশারায় আমায় রিক্সায় উঠে বসতে বলে। আমি আমার গন্তব্যে যাবার এক পরিচিত বাহন পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বেচেঁছি, উঠে বসতেই রিক্সা ছেড়ে দেয়। কেষ্টদা রিক্সা চালাতে থাকে হাওয়ার বেগে। 

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গ্রামের রাস্তায় আলোর আশা করি না। আকাশের দিকে চেয়ে দেখি শুধু কিছু তাঁরা মিটমিট করে জ্বলছে, চাঁদের দেখা নেই। মনে পড়ে গেলো চার দিন আগে মায়ের একাদশী গেছে, অর্থাৎ আজ তো অমাবস্যার রাত, চাঁদের দেখা পাবো কেমন করে? এই ঘোর অন্ধকারে কেষ্টদা কেমন করে এত জোর গতিতে রিক্সা চালাচ্ছে ভগবান জানেন। 

আমার ভয়, রিক্সা উল্টে মুখ থুবড়ে না পড়ি রাস্তার ধারে। কেষ্টদাকে বললাম - একটু আস্তে চালাও। কেষ্টদা কানেই নিলো না আমার কথা, বোধহয় শুনতে পেলো না। 

-দুই-
রমা মাসির কথা 

রমা মাসি আমার মায়ের ছোটবেলার 'বকুল-ফুল' পাতানো বোন বা বন্ধু। আমার মামাবাড়ি অর্থাৎ মায়ের বাপের বাড়ির পাশেই ছিল রমা মাসির বাপের বাড়ি। দুজনায় গলায় গলায় নাকি ভাব ছিল ছোটো বেলা থেকেই। 

তারপর দুজনের দুই জায়গায় বিয়ে হয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দুজনেরই মন খারাপ, কিন্তু এমনই যোগাযোগ, বেশ কিছু বছর বাদে দুজনে আবার এক জায়গায় এসে জড় হন। একদম সেই ছোটবেলার মতোই পাশাপাশি বাড়িতে। 

আমার বাবা ছিলেন রাজগ্রাম হাইস্কুলের হেডমাস্টার, সেই স্কুলেই রণজিৎ মেসো যোগ দেন এ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার হিসাবে। অনেক দিন পর মাসিকে আবার কাছে পেয়ে, মা বলে, - ছাড়াছাড়ি হলেই হলো, এর নাম হলো প্রাণের টান।

রাজগ্রাম হাইস্কুলের কাছেই থাকতাম আমরা। পায়ে হেটে যাতায়াত করেছি স্কুলে। আমাদের বাড়ি আর রণজিৎ মেসোর বাড়ি ছিল একদম পাশাপাশি। একদম শিশু বয়সে, দিনের বেশির ভাগ সময় নাকি আমি কাটাতাম রমা মাসির বাড়িতে। মাসির সন্তান হয়নি, আমাকেই মাসি ছোটো বেলা থেকে পুত্র স্নেহে মানুষ করেছেন। 

কিন্তু কয়েক বছর পর স্কুল মালিকের সাথে কি সব বিতর্ক বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, মেসো চাকরি ছেড়ে দেন, বলেন - পরের গোলামী বা চাকরি আর না। এইবার গ্রামে গিয়ে ভূমিপুত্রের মতো থাকবো, চাষবাসের কাজ করবো। 

কেষ্টদা ছিল রণজিৎ মেসোর ক্ষেতে কাজকর্ম করার লোক। ছোটখাটো চেহারা, দেখলেই বোঝা যায় অল্পবুদ্ধির মানুষ, কানেও একদম কম শোনে, তবে প্রচন্ড পরিশ্রমী এবং বিশ্বাসী লোক। তিন চার জনের কাজ একা হাতে করে নেয়। 

এর প্রায় এক যুগ বাদে মেসো দেহ রাখেন। মাসি নিরক্ষর মানুষ। যতদিন মেসো ছিলেন, মেসোর হাতের লেখায়, মাসির পাঠানো পোষ্টকার্ড প্রতি সপ্তাহে আসতো আমাদের বাড়ির ঠিকানায়। মা-ও চিঠির উত্তর দিতো সাথে সাথে। 

যে আমলের কথা বলছি, সে আমলে মোবাইলতো দুরের কথা, টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ছিলো না বললেই চলে, বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে। 

তারপর থেকে, কয়েক মাস অন্তর আমি বাড়ি এলে মাঝে মাঝেই মা আমাকে পাঠাতো মাসির গ্রামে। মেসোর অবর্তমানে মাসির চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কয়েক মাস অন্তর মাসির খবর নিতে না যেতে পারলে মা একটু অস্থিরের মতো করতো। 

খোঁজ খবর নিতে গেলেও মাসির কাছে থেকে আসতে হতো অন্তত একবেলা। এবং অতি অবশ্যই মাসির হাতের রান্না খেয়ে আসতে হতো । মাসির রান্নার স্বাদ এবং স্নেহের স্বাদ মনটা জুড়ে থাকতো বেশ কিছু দিন। 

-তিন-
মাসির বাড়ি

এবার এসেছি বছর খানেক বাদে, এক বছর তিন চার মাস পর। অফিসে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাড়িতেও আসা হয়নি অনেক দিন। ফলে দুই এক বছরের উপর হলো, মাসির খোঁজ খবরও নেওয়া হয় নি। 

রিক্সা চলছে ঝড়ের বেগে, একদম উড়িয়ে নিয়ে কেষ্টদা পৌঁছে দিলো মাসির বাড়ি, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাকে নামিয়ে দিয়ে কেষ্টদা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, মাঝরাতে গ্রামে যে অন্ধকার এত গভীর হয়, না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। 

-মাসি, ও মাসি কোথায় তুমি, কেমন আছো? আমি হাঁক পাড়তেই এক আবছা সাদা থান শাড়ির আবির্ভাব হলো, আমি প্রণাম করতে পায়ে হাত দিতে গেলাম, একটা ঠান্ডা মেঝের শীতল স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম মাত্র, আর সেই সাদা থান শাড়ি চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

এক দুর্বিষহ আতঙ্কে আমি দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে দৌড় লাগলাম পিছন দিকে, ঘণ অন্ধকারে কিসে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই। 

জ্ঞান ফিরলো পরদিন সকালে, দেখি মাঠের মধ্যে শুয়ে আছি, গা হাত পায়ে অসম্ভব ব্যথা, উঠে বসলাম খানিকটা প্রচেষ্টার পর। মাঠে শুয়ে থাকা অবস্থায়, দেখতে পাচ্ছিলাম, দু-তিনটি অচেনা মুখ ঝুঁকে আছে আমার দিকে। 

গ্রামের লোকজনদের কাছে জানতে পারলাম, মেসোর মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকে জমির কাজ সেরে স্টেশনের কাছাকাছি এক রিক্সা মালিকের রিক্সা চালাবার কাজ নেয় কেষ্টদা। বছর খানেক আগে এক অমাবস্যার রাতে মালিকের রিক্সা জমা দিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফেরার পথে, সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় তার। 

মাসির প্রতি দিন নদীতে স্নান করার বাতিক ছিল। কেষ্টদার মৃত্যুর দিনই সকাল বেলা ভরা অমাবস্যায় নদীতে বান আসে এবং মাসি সাতার কাটতে গিয়ে ভেসে যান। তিন চার কিলোমিটার দূরে তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায় পরদিন। 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024