উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -18


 


নিজের ভুল সংশোধন করবার পর শেষ সম্বল মা মরা মেয়েটাকে বাঁচাবার কসুর করলাম না । অনেক ডাক্তারকে চিকিৎসা করালাম কোন ফল হলো না । আমিও দু'বছর ডাক্তারি পড়েছিলাম , কিন্তু নিজের নৈতিক অধঃপতনকে ডেকে এনে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে ঢেকে দিলাম ব্যাভিচারের ঘন কৃষ্ণ মেঘে।


 একদিন বিশিষ্ট অভিজ্ঞ ডাক্তারদের অনুরোধ করলাম যাতে মেয়েটাকে বাঁচানো যায় । সকলেই ভালোভাবে পরীক্ষা ও ব্যাক হিষ্টি শুনে সাজেশন দিলেন বা তারা একযোগে এই মত প্রকাশ করলেন যে , শিশুটি যদি কোন মেয়েকে নিজের মা বলে মেনে নিতে পারে , তাহলে শিশুটি বেঁচে যাবে । কারণ মেয়েটির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেশী ছিল । আপনাকে এমন এক মহিলার সন্ধান করতে হবে যার সঙ্গে আপনার স্বর্গত পত্নীর চেহারায় অনেকটা সাদৃশ্য আছে। 


বিচিত্র আমাদের দেশ । এই দেশে বিভিন্ন চেহারার মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন । এমন কথা নয় যে ময়নার মায়ের মতো এ্যাকজাক্ট দ্বিতীয় কোন মেয়ে জন্মগ্রহণ করেনি । অনেক সময় প্রত্যক্ষ করা গেছে যে একই চেহারায় অনেক নারী এবং পুরুষকে অবশ্য ওরা কেউ কারো সঙ্গে আত্মীয়তা সম্পর্কে আবদ্ধ নয় । সুতরাং দেবীবাবু যদি একটু চেষ্টা করেন , তাহলে তার স্ত্রীর অনুরূপ চেহারার নারী পেতে পারেন।


 পদ্মাদেবী , সবই তো শুনলেন , ডাক্তারদের কথা মতো আমি বিভিন্ন স্থানে আমার স্ত্রীর মতো একটি রমনী খুঁজে বেড়াতে লাগলাম । কিন্তু কোন ফল হল না । ভাবলাম মেয়েটাকে আর ফিরে পাবো না । তাই মনের দুঃখে , অনুশোচনায় একদিন এই মহানগরীর কোন স্থানে বসে ভাবছিলাম নানান কথা , সেই অবসরে নজরে পড়লো আপনাকে , সাথে আপনার শ্যামলীদিও ছিলেন । কিন্তু তখন ব্যাভিচারিনী বলে বুঝতে পারিনি । কিছু বলার আগে ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম । আপনাদের ফলো করলাম , দেখলাম এক কদর্য বঙ্গীতে গিয়ে উঠলেন । ন্যায় অন্যায়ের কোন প্রশ্ন তা তুলেই জেনে নিলাম আপনাদের কথা । আপনাদের আদরি মাসী অর্থ গৃধনু । তারপর আদরী মাসীকে বশীভূত করে আপনাকে আনার সুযোগ খুঁজছিলাম । কিন্তু আপনি ভুল বুঝে , আমাকে অবজ্ঞা করে তাড়িয়ে দিলেন । আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা । মেয়েকে আমার সুস্থ করতেই হবে এবং আপনাকে নিয়ে যেতেই হবে । আমার পত্নী চন্দ্রা ও আপনার মধ্যে চেহারায় এত বেশী সাদৃশ্য যে মনে হয় যেন আপনারা একই মায়ের দুই যমজ কন্যা।


 আপনি আমার প্রতি বিরক্ত বোধ করছিলেন বলে আদরি মাসীকে চেপে ধরেছিলাম । তিনি বলেছিলেন , শ্যামলীদিকে মত করতে । কারণ শ্যামলীর সাথে তার মেলামেশা গভীর । তাই পরদিন শ্যামলীকে সব কথা বললাম । মাতৃহারা ছোট শিশু ময়নাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য আমার এই প্রচেষ্টার কথা শুনে তিনি আনন্দিত হলেন । আপনাকে ময়নার মা হয়ে পাঠাতে রাজী হলেন।


 তারপর - তারপর আপনাকে এখানে আনার সমস্ত চেষ্টা সার্থক হলো । এই মাতৃহারা শিশুটির দায়িত্ব আজ থেকে আপনার হাতেই তুলে দিলাম । কিন্তু একটু সতর্ক থাকবেন , যাতে ময়না কোন দিন আপনাকে ভুল বুঝতে না পারে । সে আপনাকে মা বলে মেনে নিয়েছে । তবে আপনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই । আমার ময়নার মা হয়ে , আপনি একটি ছোট্ট শিশুর জীবনকে বাঁচিয়ে তুলতে সাহায্য করলেন , সেজন্য আপনাকে আমি এক মহীয়সী নারী বলে মনে করি । ময়নাই আমার শেষ সম্বল।


 এই কথা বলার পর দেবীবাবুর মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো এবং চোখ দিয়ে কৃতজ্ঞতার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। 


আমি কথা দিলাম ময়নার লুপ্ত মাতার দায়িত্বভার আমি নিজের হাতে তুলে নেব । তার আগে আপনাকে ক্ষমা করতে হবে এ কারণে , অজান্তে আপনাকে অনেক অপমান করেছি।


 তিনি বললেন , আপনার ব্যবহারে মোটেই রাগ করিনি । বরং আপনার এই মহৎ কাজের জন্য আপনার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকব। 


সেদিন কোন রকম ময়নার কাছে কাটিয়ে ফিরে এলাম বিকেলে । দেবীবাবু পৌঁছে দিয়ে গেলেন । বস্তীতে এসে শ্যামলীদিকে আঁকড়ে ধরলাম । চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা উষ্ণ জল নির্গত হতে থাকল । শ্যামলীদির কাছে ময়নার কথা প্রকাশ না করে থাকতে পারলাম না । বুকের ভেতরটা যেন টন টন করে উঠল । অব্যক্ত যন্ত্রণায় নিজেকে স্থির থাকতে না পেরে বলল উঠলাম , একি করলে শ্যামলীদি , আমি এখন বিবেকের দংশন জ্বালায় ক্ষত - বিক্ষত । একজন পতিতা নারী হয়ে একটি নিষ্পাপ মেয়েকে মাতৃত্বের সোহাগ দিয়ে নিজ কন্যা বলে কিভাবে গ্রহণ করবো? 


শ্যামলীদি সান্ত্বনা দিয়ে বলল , ওরে আমরা পতিতা হলেও আমাদের অন্তরে নির্মল মাতৃত্ব ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত । উপরে আমাদের দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না । এই মাতৃস্নেহ যেন অন্তঃসলিলা । ময়নাকে গর্ভে না ধরে ওর মুখ দিয়ে যে মায়ের ডাক শুনেছিস, এজন্য তোর নারী জীবন ধন্য মনে করবি। কিন্তু সমাজের কি নিষ্ঠুর বিচার, কোনো এক বীরঙ্গনা নারী যদি সন্তান ব্রতী হয় তাহলে রেহাই নেই কুৎসা ও কলঙ্কের জালিমা তাদের ভাগ্যকে বিড়ম্বিত করে তুলবে । ধিকৃত ও লাঞ্ছিত জীবনের পশরা নিয়েই আমাদের যাত্রাপথ শুরু।



 রাতে শোবার পর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না । শ্যামলীদি অনেক আগেই শুয়ে পড়েছে । আমার মনে অতীতের বহু স্মৃতি আমাকে পাগল করে তুলল । সময়ে অসময়ে এবং কারণে অকারণে অতীতের বহু সুখ দুঃখের চিত্র আমার মনের আস্তিনায় ভিড় করতে লাগল । যদি আমি এই অধঃপতিত জীবনকে বেছে না নিতাম তাহলে আর পাঁচজন নারীর মতো স্বামী পুত্র নিয়ে সুখের স্বর্গ গড়ে তুলতে পারতাম । মনে হয় পূর্ব জন্মের বহু সঞ্চিত পাপের জন্য আমাকে এই ধিকৃত ও লাঞ্ছিত জীবনের কলঙ্ক নিয়ে ঘর করতে হচ্ছে । বন্দিনী হয়ে দিনের পর দিন পুরুষের মনোরঞ্জনের কাজে লাগছি।


 আজ না হয় পিপাসায় আকুল হয়ে এক ফোঁটা জলের আশায় শীতল সরোবরে ছুটে চলেছি । অবাক্ত পিপাসাকে মিটাতে চলেছি ময়নাকে স্নেহ করে । হঠাৎ কপাটে ধাক্কা হওয়ার জন্য বিস্মৃত হলাম । শ্যামলীদিকে উঠালাম । এই ঘটনায় একটু ভীত হলাম । শ্যামলীদি তার বিছানা হতে উঠে চোখ কচলাতে শুরু করল ।


 শুনতে পেলাম কার কণ্ঠস্বর যেন ভেসে আসছে । বহিন খিড়কী খোলে , কৌই ডর নেহি।


শ্যামলীদি চোখ রগড়ানো বন্ধ করে ধীরে ধীরে দরজার কাছে গিয়ে কপাট ফাঁক করতেই নজরে পড়ল এক হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ ব্যক্তিকে । পরণে চুস প্যান্ট ও গায়ে সেঁটে থাকা কালো গেঞ্জি । মাথায় কালো পাগড়ী । এক মুখ দাড়ি । দাড়িতে যেন সূক্ষ্ম কালো জালি দিয়ে দুগালকে চেপে রেখেছে । হাতে মোটা সোটা একটা বালা । লোকটা যে পাঞ্জাবী তাতে কোন সন্দেহ নেই । হাতে উদ্যত রিভলভার।


 ঐ অবস্থা দেখে শ্যামলীদি ও আমি পাষাণবত হয়ে গেছি । আমাদের অনড় অবস্থা দেখে লোকটা বলল , কৌই ডর নাই বহিন , হাম বহুত বিপদ মে পড়েছি । মুঝে কুছ জায়গাদো । হারামী বাচ্চা পুলিশ হামারা পিছা করেছে । তুম লোককা কৌই ডর নেহি । দেরী মত কর বহিন , জলদী দরজা খোল। 


শ্যামলী বুঝতে পারল কোন মানুষ বিপদে পড়েছে বা পুলিশের তাড়া খেয়েছে কারণ এই এলাকা একেবারে এক নম্বরী । আমি যে ভয় পেলাম না তা নয় , শ্যামলীদিকে কপাট খুলতে নিষেধ করলাম।


 শ্যামলী আমার কথা না শুনে কপাট খুলতেই লোকটা অর্থাৎ পাঞ্জাবী তো বটেই , আধা বাংলা মিশিয়ে বলল , হামাকে পনদেরহ মিনিট কা লিয়ে চুপনে কা জায়গা দে

জলদী কর বহেন মেরে পিছে পুলিশ হ্যায় । শ্যামলীদি দ্বিধা না করে প্রবেশ করতে বলল। 


পুনরায় কপাট লাগিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বলল , এই তক্তাপোষের উপর কম্বলটা ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ুন । পাগড়ীটা খুলে ফেলুন । জলদী করুন , আর একথা মনে রাখবেন , পুলিশ এলে পর যা বলবার আমি বলব । আপনি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকুন। 


পাঞ্জাবী শ্যামলীদির নির্দেশ মতো কাজ করল । আমাকে পাশের রূমটাতে শুয়ে পড়তে বলল আলো নিভিয়ে । পাঁচ / সাত মিনিটের মধ্যে পুনরায় কপাটে ঠক্ ঠক্ শব্দ । বেশ কয়েকবার শব্দ হবার পর শ্যামলীদি ঘুমের ভাব দেখিয়ে ধরা গলায় বলল , এত রাত্রে কি দরকার ? রাত্রি দশটার পর কোন খদ্দেরকে আমি এলাউ করি না।


 কপাট খুলে ঢুলু ঢুলু চোখে বলল , ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিলেন স্যার । দুই জন পুলিশ অফিসার ও তিন জন কনস্টেবল অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে বললেন , আপনাদের বাড়ীর মধ্যে কোন লোক প্রবেশ করেনি?


 শ্যামলীর উত্তর , তা জানিনে স্যার , যদি মনে করেন তল্লাশি করতে পারেন । আপনাদের সহযোগিতা করা আমার কর্তব্য মনে করি।

তাহলে ভেতরটা একটু দেখতাম।



                          ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024