Sunday, April 23, 2023

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -41


 


এগারো


পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেবীকে প্রাতঃরাশ করিয়ে স্নানে রত হলাম। দেবী আপন বাড়ীতে কর্তব্যে হাজিরা দিতে গেলো। ময়নাকে ঘুম হতে উঠিয়ে ওকে সাজিয়ে গুছিয়ে অর্থাৎ নিত্যকার পদ্ধতি অনুযায়ী স্কুলে পাঠিয়ে দিলাম বানীদার সাথে। আজ মঙ্গ লবার।

মঙ্গলাচন্ডীর মন্দিরে গিয়ে পূজো দিয়ে বাড়ী গেট খুলতেই নজরে পড়লো, একজন লোক বারান্দায় পায়চারি করছেন। পরিধানে দামী পাঞ্জাবী ও সাদা ধবধবে পায়জামা। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, মুখে ধূমপানের পাইপ। তার সুঠাম দেহ। আমার অনুমান, দেবীদাসের বাবা ছাড়া অন্য কেউ নন। অনুমানের সত্যতা যাচাই করবো কি করে ?

দ্বিতীয়তঃ ভদ্রলোককে দেখে আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেছে। কি করে তাকে সম্বোধন করবো। তারপর প্রথম সাক্ষাতেই যদি টালবাহানা হয়ে যায় তাহলে আর বলার নেই। উপায় হলো, বাড়ী হতে করালীদা আমাকে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বলল, দিদিমরি ছোট বাবুর বাবা এসেছেন।

ইনি দেবীর বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুর মশাই। মিনিট খানেক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শ্বশুর মশাইকে নিরীক্ষণ করতে থাকলাম। তার মুখখানি গাম্ভীর্য পূর্ণ। জানি না তার কাছে কি ব্যবহার পাবো। যদি আমাকে না মেনে নেন বা আমার পরিচয় বাড়ী প্রবেশ করার আগে পেয়েছেন, তাহলে কি হবে আমার?
মনে জোর না আনতে পারলেও মনকে শক্ত করতেই হবে। ভাগ্যে যা হবার তা হবে। যদি অদৃষ্টে আমার বিপর্যয় থাকে কেউ খন্ডন করতে পারবে না। কোন প্রকারে দুরু দুরু বুক নিয়ে শ্বশুর মশাইয়ের কাছে গিয়ে তাকে প্রণাম করে বললাম, বাবা, কখন এলেন ?

তিনি প্রথমতঃ হকচকিয়ে গেলেন, পরে আমার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললেন, বাঃ বাঃ সেই চোখ, সেই নাক, মুখ, তোমার মধ্যে যেন আমার স্বর্গতা বৌমা চন্দ্রাকে দেখতে পাচ্ছি। সুশীলবাবুর পত্রে চন্দ্রার মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলাম। বড় অভিমানিনী ছিল মা চন্দ্রা, নইলে কেন অকালে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।

শ্বশুর মশায়ের চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তিনি দেবীর নিয়ে প্রসঙ্গ তুললেন। দেবীকে নিয়ে প্রসঙ্গ তুললেন।

দেবীকে নিয়ে এক দারুন স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু সব আশা আকাঙ্খা বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। যখন শুনলাম দেবী ভালো হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দিয়েছে, তখন আর থাকতে পারলাম না। পাগল ছেলেকে দেখতে ইচ্ছে করলা। আর ইচ্ছে করলো তোমাকে দেখতে। দেবীকে সৎ পথে তুমিই এনেছো মা। তবে তোমার পরিচয় এখনো পাইনি।

আমি বললাম, বাবা আপনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, সারা পথ যানবাহনে এসেছেন, চলুন বিশ্রাম নেবেন তারপর সব কথা শোনাব।

হ্যাঁ মা, সত্যিই আমি ক্লান্ত। চলো কিছু খেয়ে বিশ্রাম করবো। বাবাকে যত্ন সহকারে খাইয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করলাম। আমার আয়োজন, পরিবেশনে অত্যন্ত প্রশংসা করে বললেন, অনেকদিন পর তৃপ্তি সহকারে আহার করলাম মা। তোমার মতই চন্দ্রা বৌমা যত্ন সহকারে সেবা-শুশ্রূষা করতো।

স্থির করলাম, চন্দ্রাদি বাবাকে কিভাবে সেবা শুশ্রূষা করতো তা আমার গৃহস্থালীর কর্মের মধ্যে শিখে নিতে হবে। বাবাকে সুখী করার জন্য আমার চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবেনা না। যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

বাবা পাশের রুমে বিশ্রাম করছেন। আমি যত্ন সহকারে বাবার জন্য নানাবিধ রুচিসম্পন্ন খাবার তৈরীতে মনোনিবেশ করলাম। মনটা আমার রান্নার দিকেই পড়েছিলো। অতীত বা ভবিষ্যতের দিকে কোন খেয়ালই ছিলো না। এক সময় দেবী রান্না ঘরে প্রবেশ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আজ তোমার আশাপূর্ণ হলো রমা। এই দেখো রেজেষ্টারী ম্যারেজের দলিল। অরূপবাবু আমার হাতে দিয়ে বললেন, এই আনন্দ সংবাদ যেন খুব শীঘ্র তোমাকে জানাতে পারি। এবার নিশ্চয় তোমার মানসিক চিন্তার অবসান হলো।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললাম, বাবা এসেছেন খবর পেয়েছো? দেবী ভীত হয়ে বলল, কখন এসেছেন? বাবার শরীর ভালো আছে তো?

হ্যাঁ বাবার শরীর ভালো আছে। তিনি এখন বিশ্রাম করছেন। বাবার আগমন বার্তা শুনে দেবী বেশ চিন্তামগ্ন হলো। ওর ঐ রূপ অবস্থা দেখে বললাম, বাবার আগমন বার্তা শুনে তুমি মুষড়ে পড়লে কেন?

দেবী নম্রকণ্ঠে বলল, বাবার সম্মুখে কি করে দাঁড়াবো তাই ভাবছি।

ওসব চিন্তা মনে না এনে বাবার কাছে যাও, বাবার ভালো মন্দের খবর নাও। তাছাড়া সুশীলবাবু তোমায় নিয়ে সমস্ত বিষয় আলোচনা করেছেন, সেই জন্য ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। দেবী কথা না বাড়িয়ে তার বিশ্রাম ঘরে প্রবেশ করলো। আমি পুনরায় কাজে মন দিলাম।

দুপুর বেলা, রান্নার কাজ শেষ করে ওদের সকলের খাবার ব্যবস্থা করলাম। তিনি বিচক্ষণ ও ধনী ব্যক্তি তবু তিনি ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেতে রাজী হলেন না। বাবার কথা মত তকতকে মেঝের উপর আসন পেতে খাবার ব্যবস্থা করলাম। ভয়ে ভয়ে খাবার পরিবেশন করতে শুরু করেছি, সে সময় আমার বক্তীর কথা মনে উদয় হতে চক্ষু ছেপে জল আসতে শুরু করলো। কি অদৃষ্ট আমার, আজ যেভাবে আমার শ্বশুর মশাইকে সেবা শুশ্রূষা করছি, সেদিন যদি আমার জন্মদাতা পিতাকে সেবা শুশ্রূষা করতে পারতাম, তাহলে আজ ওকথা মনে উদয় হয়ে মনকে পীড়া দিতো না। বাবাকে আশ্রয় দিয়ে একদিনও মনের মতো সেবা যত্ন করতে পারিনি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে ছিলাম। কিন্তু কেন তার প্রত্যুত্তরে মনের নিকট কোন জবাব দিহি করতে পারিনি। শুধু মনের জ্বালা ও বেদনাকে চেপে রেখেছিলাম।

বাবার আহার করা দেখে বেশ ভালো লাগলো। তিনি এই বয়সে বেশ সুন্দরভাবে আহার করে থাকেন তাতে আশ্চর্য হবার কথা দেখলাম। দই এর প্রতি বাবার ভীষণ আগ্রহ এবং ওটা তার রুচিসম্মত খাদ্য বলে মনে হলো। তাই দই এর মাত্রা বেশী দিলাম। তিনি বাধা দিলন না। বললেন, এই দই কেনা দই বলে মনে হচ্ছে না বৌমা?

বললাম, আমি তৈরী করেছি।

বাঃ বড় তৃপ্তি পেলাম তোমার তৈরী দই খেয়ে।

আমার প্রশংসা শুনে দেবী বঙ্কিম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ওদের খাওয়া শেষ হলে পর, বাবাকে বিশ্রাম করার ব্যবস্থা করলাম। অর্থাৎ যাতে সব দিক দিয়ে তাকে তৃপ্তি করতে পারি তারই চেষ্টা আমার প্রবল । সারাদিন কোন প্রকারে কাটলো।

রাত্রে আমাদের উভয়ের ডাক পড়লো। আমি ও দেবী হাজির হয়ে নত মুখে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকাতে বাবা পাশে বসতে বললেন। অন্তরে আমার দুঃশ্চিন্তা বা দুর্ভাবনা ছিলো না। বিশেষ করে তার স্নেহ আদর আমার মালিন্যকে দূর করে দিয়েছিলো। বুকে সাহস নিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। দেবী একটু দূরে বসলো নত মুখে।

একটু পর তিনি বললেন, দেবী তোমার পরিবর্তনে অনেক খুশী হয়েচি। সুশীলবাবুর পত্রে তোমার সৎ মনোবৃত্তি বা সৎ পথে চলার জন্য আমি কতখানি যে মানসিক শান্তি লাভ করেছি তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবে না। তোমাকে কতখানি ভালোবাসতাম তা হয়তো জানো। কিন্তু এতদিন তার বিনিময়ে কি দিয়েছো? শুধু ঘাত, প্রতিঘাত ও মানসিক অশান্তি। তোমার ভুলের জন্য বৌমাকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে। বলতে পারো, সেকি এমন অপরাধ করেছিলো?

দেবী নিরুত্তর। তিনি বলে চলেছেন, তোমার জন্য মা হারা ময়না ফুলের শুষ্ক কুড়ির মতো ম্লান হয়ে যাচ্ছিলো। যাক ঈশ্বরের কৃপায় আমার মা রমাকে পেয়ে সেই ফুলের কুড়ি বিকশিত হবার অনুকূল পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। অতীতকে ভুলে এ বছর নব প্রভাতে সূর্যালোকে নিজেকে যেমন উদ্ভাসিত করেছো, সুতরাং সেই আলো অম্লান রাখার চেষ্টা করবে।

Monday, April 10, 2023

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -40


 


আমি আড়চোখে তাকিয়ে ওর মুখের ভাবকে লক্ষ্য করছিলাম । কিন্তু কেন এইভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । কোন অজুহাত দেখিয়ে বাহানা করে ওখান হতে সরে পড়লাম । বিকাশ ও দেবী কোন রূপ বাধা দিলো না । কিন্তু আমার মনের কৌতূহল রয়েই গেল । একটু পরে শুনলাম , সে বাড়ী গেছে । ওর বাবার শরীর খারাপের জন্য থাকতে পারেনি । ওর নাম জয়ন্ত তা পরিচয়ের সময় জেনেছিলাম । বিশেষ করে সে বিকাশের বাল্যবন্ধু বলেই এই বিয়েতে এসেছিলো নতুবা আসতো না । কারণ ওর বাবার শরীর অসুস্থ । বিকাশকে সে কথা বলে গেছে । কিছুক্ষণের মধ্যে ওর কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারবো কি ? কারণ তার চোখ কি চাইছিলো জানার কৌতুহল রয়ে গেল । বিকাশের বিয়েতে এসে মনটা অনেকখানি প্রফুল্লতায় ভরিয়ে তুলেছিলাম সত্যি তবে , জয়ন্তকে নিয়ে কেমন যেন একটা সমস্যা উদয় হলো । দেবীকে কোন কথা বলিনি । সব কথা চেপে রাখলাম । ধীরে ধীরে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো । বিকাশদের বিয়ে ব্যতীতে বৈদ্যুতিক আলোগুলো এক সময় জ্বলে উঠলো । মনে হলো আলোর শোভাতে একটা মোহময়ী রূপ চারিদিকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে । এমন ঝকঝকে বিভিন্ন আলোকসজ্জা কখনো দেখিয়ে দেবীর সাথে বাইরে এসে অনেকক্ষণ আলোর লুকোচুরি খেলা দেখেছি ময়নার নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছি । এক সময় আমাদের ডাক পড়লো । বিকাশ এবার রাজকুমারী আনতে যাবে । ভিনদেশে । বর বেশে আমার কাছে এসো । তার যাত্রা শুভ হোক প্রার্থনা করলাম ঈশ্বরের কাছে দেবী বিকাশের সাথে রওনা হলো । এতো বড় বাড়ীতে লোকগুলো কমে যেতে কোলাহলের মাত্রা বেশ কমলো । এক সময় মাসীমা আমায় ডাকলেন ও বললেন তিনি আমার সাথে গল্প করবেন । মাসীমাকে অনুসরণ করে তার শোবার ঘরে উপস্থিত হলাম । তিনি তার পাশে বসিয়ে বললেন , তোমার কথা বিকাশের কাছে শুনেছি । বিকাশ আমার পুত্র হলেও সে কোন কথা লুকায় না । কিছু মনে করো না মা , আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মা ও মেয়ের । বিকাশের কাছে তোমাদের পারিবারিক ঘটনা শুনে বড় দুঃখ পেয়েছি । তোমার বাবা দরিদ্র পীড়িত জীবনে বহু আশা আকাঙ্খা নিয়ে তোমার দাদাকে ডাক্তারী পড়াছিলেন , সে যদি ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে যেতে পারতো , তাহলে তোমাদের কোন ভাবনা চিন্তা থাকতো না । কিন্তু তোমাদের ভাগ্যের এমনি নিষ্ঠুর পরিহাস যে তোমাদের সব আশা আকাঙ্খা ধুলিসাৎ করে দিয়ে তোমার দাদার জীবনে করুণ ট্রাজেডি এনে ছিলো । যাক দুঃখ করে কি হবে । দেবীর কাছে নতুন জীবনে তুম সুখী হবে বলেই আশা রাখি । আচ্ছা মা , একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে ? তুমি কি অনেক পোকায় খাওয়া ফল ? ও কথা শুনে আমার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন হিমা হয়ে গেলো । এবার আমি সোজা হয়ে বসে থাকতে পারলাম না । আমার শরীরটা যেন ঘোর ঘোর করছে । আমার দম যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে আমি বমি করবো । পর পর দুই তিন বার হাই তুলে আর সামলাতে পারলাম না । প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাথরুমে গিয়ে বমি করলাম । ছানার মতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো । মাসীমা আমাকে অনুসরণ করে বাথরুমে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললেন , কোন ভয় নেই মা , এ অম্লের বমি নয় , তুমি মা হতে চলেছো । আমি শিউরে উঠলাম । চলো আমার সাথে তোমার দুর্ভাবনাকে কাটিয়ে দিই । কি করবো ভাবছি , মনে হচ্ছে এখন হতে ছুটে পালিয়ে যাই । কিন্তু এমন পিঞ্জরাবদ্ধ যে কোন উপায় নেই । লজ্জা , ঘৃণা , পরিত্যাগ করে তার সাথে পুনরায় শোবার ঘরে হাজির হলাম । আমাকে তক্তাপোশে শুইয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন , তুমি ভয় পাচ্ছো আমি তোমার সব কিছু জানতে পেরেছি বলে ? তাহলে তুমি জেনে থেকো মা , তুমি যেমন অনেক পোকায় খাওয়া , আমিও তেমনি দুই পুরুষের দংশনে ক্ষত হয়েছি । তবে কি বলতো পারো আমি অশুচি নই ? বহু সংসারে তোমার মতো নারী বিদ্যমান । তারা বধূ হয়ে নির্বিঘ্নে স্বামী পুত্র নিয়ে সংসার করছে । হয়তো তাদের অতীত সবার কাছে গোপন রাখে । যেমন আমার কথা ধরো , আমিও একজন শয়তানের পাল্লায় পড়ে গর্ভে বাচ্চা এনে নিজেকে অপবিত্র করেছিলাম । মা , বাবা , সেই অপবিত্রকে ঢাকা দিয়ে টাকার জোরে এক সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলের সাথে বিয়ে দিলেন । একবার তলিয়ে দেখলেন না আমি কি । টাকার জোরে সব সব তলিয়ে গেলো । হয়তো তলিয়ে গেল সত্য , কিন্তু আমি যে অশুচি তা কোনদিনই অকপটে অস্বীকার করতে পারবো না । আজ একথা তোমাকেই প্রকাশ করলাম , কারণ যাতে তোমার মন একটু হালকা হয় । বিকাশের কাছে তোমার ইতিহাস শুনে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করেছিলো । সে তোমাকে এ বিয়েতে আনতে রাজী হয়নি । বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে তার মনকে দুর্নিবার করে ওকে সত্যের সন্ধান দিয়েছি । প্রয়োজন যদি হয় দেবীকেও বুঝিয়ে বলবো । নানা আলোচনা , সমালোচনায় আমার মনের উদ্বেগ পরিস্কার করে দিলেন । মাসীমার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হলাম । সেদিন মাসীমার কথায় অনেকখানি শক্তি পেয়ে ছিলাম । আমাদের কলঙ্কিত জীবনে অনেক সময় উল্কার মতো ঝড় আসছে । মানিয়ে নিতে হবে সেই ভয়ঙ্করকে । কারণ আমি যে একজন বারবণিতা , তাই নয় কি ? বিকাশদের বাড়ী হতে আপন বাড়ীতে এসে মনটা ভারী চঞ্চল হয়ে উঠল । দেবী নিশ্চয়ই জানবে আমি মা হতে চলেছি । কিন্তু প্রথমতঃ আমি তাকে জানাব কি করে । একথা দেবীর কানে গেলে সে নিশ্চয় আনন্দিত হবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । তবু তাকে একথা বলতে পারলাম না । বার বার চেষ্টা করেও আমার মুখকে বন্ধ করে দিতে লাগলো । দেবীর পাশে শুয়ে আছি মনটা বড় উসখুস করছে । পাশে ময়না গভীর ঘুমে আছন্ন । দেবীর পরের পর নবকল্লোলের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে আর বালিশের উপর মুখ গুঁজে আমি আমার ভাবনার রাজ্যে ডুবে আছি । এক সময় দেবী পাশ ফিরে শুতেই আমার প্রতি চোখ রেখে বলল , রমা , এখনো ঘুমোও নি ? কথা না বলে ঘাড় নাড়লাম । আমি লক্ষ্য করছি বিকাশদের বাড়ী হতে এসে তুমি কেমন যেন হয়ে গেছো । মাসীমা কি কিছু বলেছেন ? না । 

তাহলে এমন চিন্তান্বিত কেন ? কোন কথা না বলে দেবীর লোমশ বুকে হাত বুলোতে থাকলাম । কি করে ওকথা বলবো জানি না পুরুষেণ মন , হয়তো এই অবস্থায় তার মনে অনেক অশুভ চিন্তা ভাবনা এবং অমুলক সন্দেহ দেখা দিতেও পারে এই জন্যই আমার ভয় । অবশ্য আমার এই আসন্ন মাতৃত্বের জন্য দেবীদাস সন্দিগ্ধ হয়ে আমার উপর রূঢ় আচরণ করবে কথা আমার মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করলো । দেবীর ডাকে আমার চিন্তার জালে ছেদ পড়লো । চিন্তা কিসের বলতো ? না , মানে - কি হয়েছে বলো না ? বলবো , রাগ করবে না তো ? বলেই দেখো না । তখন দেবীর লোমশ বুকের মধ্যে আমার হাত । আমি মা হতে চলেছি । রমা । আমাকে বুকে চেপে ধরলো । এই সংবাদ জানাবার জন্য এতো লজ্জা , তো ভয় ? এই সংবাদে আমি কি দুঃখিত হবো ভেবেছো ? আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম রমা । আর একথা মনে রাখতে যদি পুত্র লাভ করি নাম রাখবো বাপ্পা । আর মেয়ে হলে তুমিই ঠিক করবে সে নাম । দেবীর বুকে মুখ লুকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজে অনেকখানি শান্তি পেলাম । ভয় , ডর আমার কেটে যাচ্ছে বটে কিন্তু শেষ পরীক্ষা এখনও হয়নি । দেবীর বুক হতে মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম , বাবা কবে আসবেন । দেবীদাস স্বত্বঃস্পর্শভাবে বলল , সত্যি ও কথা বলতে ভুলে গেছি । বাবা আগামী সপ্তাহের মধ্যে আসবেন । সুশীলবাবুকে পত্র দিয়ে জানিয়েছেন এবং একথাও জানিয়েছেন আমি ব্যবসা বাণিজ্য ঠিক মতো তদারক করছি বলে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন । তোমার বাবা যদি আমাকে মেনে না নেন তাহলে কোথায় স্থান পাবো ? সে চিন্তা কোনদিন করবে না । মনে রাখবে সুশীলবাবু যখন তোমাকে মেনে নিয়েছেন বাবার দিক দিয়ে কোন বাধা বিঘ্ন আসবে না । সুশীলবাবু চিন্তা করেই আমাদের বিয়েতে মত দিয়েছেন । তিনি যখন বাবার বিশ্বস্ত বন্ধু সুতরাং ঐ চিন্তায় নিজেকে দূর্বল করে হেয়প্রতিপন্ন করো না । আরেকটা সুখবর আমাদের রেজেষ্টারী হচ্ছে আগামী পরশু দিন । সুশীলবাবু ও হাজির থাকছেন । দেবীদাসের কথা শুনে আর মনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা না রেখে নিদ্রায় মগ্ন হলাম । সেই নিদ্রায় এক দারুন স্বপ্ন দেখেছিলাম । আমার কোলে ফুটফুটে জ্যোৎস্নার ন্যায় এক সন্তান আসছে । স্বপ্নে আমি ও দেবী আদরে , চুম্বনে নবজাত শিশুকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছি । দেবী সন্তান লাভ করেছে বলে প্রচুর টাকা খরচা করছে । তিন দিন গরীব দুঃখীদের দান করছেন দেবীর বাবা । মহা আনন্দ সমারোহে ভরিয়ে তুলছেন রায় বাড়ীকে । এছাড়া আরো কত কি উৎসব । এ যেন এলাহি ব্যাপার । ঐ স্বপ্ন দেখতে দেখতে এক সময় ঘুম ভেঙ্গে গেলো দেবীর হাত আমার দেহের উপর পড়তে । কোথায় আমার নবজাত শিশু আর কোথায় বা সেই এলাহি ব্যাপার । তবে কি এই স্বপ্ন আমার জীবনে একেবারে ব্যর্থ হবে ? যদি সেই স্বপ্ন ব্যথ হয় তবে বারে বারে আমার মনকে কেন আশা আকাঙ্খায় ভরিয়ে দেয় । আমার স্বপ্ন কি বাস্তবে রূপয়িত হবে না ? জীবন তরী কি মাঝদরিয়ায় ডুবে যাবে ? চিরকালই কি নৈরাশ্য ও ব্যর্থতার অন্ধকারে ডুবে থাকবো ? এই অন্ধকারের বুক ভেদ করে নতুন আকাশে সোনালী সূর্য কি উঠবে ? জানি না এরপর ভাগ্যে কি আছে ।