উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -43


 

 ক্রমশঃ অতিথিরা বিদায় গ্রহণ করলেন। সকলের আশীর্বাদে মনে হলো আমার জীবন সত্যিই মধুময় হয়ে উঠবে। কিন্তু হায়রে পোড়া কপাল বিধাতার অভিশাপ থেকে আমর নিস্কৃতি নেই। বাবা সকলকে বিদায় করেও মনকে শান্তিতে রাখতে পারলেন না। সুশীলবাবুর জন্য, তিনি বিশেষ কাজে বাইরে গেছেন। আমি বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, এক সময় দেবীর কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো।


দেবী পাশের রূমে কাকে যেন বলছে, খবরদার বলছি এক অসহায় মেয়ের সর্বনাশ করবি না। আমি তার সব কিছু জেনেই তাকে স্ত্রীরূপে স্বীকার করেছি।


লোকটা যে কে তা আমার অজানা নয়। সে ঝড়ের বেগে বলে চলেছে, দেবী তুই যে একজন বারবনিতাকে বিয়ে করে তোদের আভিজাত্যকে কলুষিত করবি তা ভাবতেও পারিনি। এই ভারতবর্ষে কি মেয়ে দূর্লভ যে, একজন অপবিত্রকে হৃদয়ে স্থান দিয়ে মনের তৃষ্ণাকে নিবারণ করতে হবে?


ঐ শয়তানের কথা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। পাশের রূমে গিয়ে বিছানার উপর লুটিয়ে পড়লাম। কি ভয়ানক দংশন, যার ফলে অসহ্য যন্ত্রণায় এপিঠ- ওপিট করতে থাকলাম। গৃহ দেবতার বিগ্রহ মূর্তি বক্ষে ধারণ করে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বললাম, আমি যা কল্পনা করেছিলাম তাই করলে ঠাকুর ? তোমাকে নয়ন জলে পুজো করে কোন ফল পেলাম না তবে মনে রেখো পাষাণ দেবতা, আমাকে যদি পুনরায় অন্ধকূপে ফিরে যেতে হয়, তাহলে তাহলে আমি তোমাকে কোন মুহুর্তের জন্য ডাকবো না।


হঠাৎ দেবীদাসের বাবার কর্কশ ধ্বনি শুনে স্থির থাকতে পারলাম না। তিনি বলে


উঠলেন, ছিঃ ছিঃ দেবী তুমি এখনো সেই পথ ত্যাগ করোনি। তোমার সাহসের কম


নেই তাহলে, তুমি ভেবেছো কি? একজন বারবনিতাকে এই পবিত্র প্রাসাদে আশ্রয় দিতে লজ্জা করলো না? দেবী বলল, আপনি রমাকে চেনেন না। এই সমাজের কাছে অপবিত্র হলেও সে


আমার স্ত্রী। আপনি শান্ত হোন। আপনাকে সব কথা বলবো।


তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি কারো কথা শুনতে চাই না, তুমি রমাকে পরিত্যাগ করো। তাকে দূর দূর করে বাড়ী হতে বের করে দাও। আপনি উত্তেজিত হবেন না।


শোন দেবী তুমি যে বিবেচনাহীন কাজ করেছো, তাতে তুমি ক্ষমার অযোগ্য। হয় এই বাড়ীতে রমা, নতুবা আমি থাকি।


ওকথা শুনে কোন প্রকারে স্থির থাকতে পারলাম না। এক রকম টলতে টলতে


টেবিলের কাছে গিয়ে কাগজ নিয়ে কয়েকটা কথা ঐ কাগজ টুকরোতে লিখে করালীর


হাতে দিয়ে বললাম, এই পত্রটা তোমার দাদা বাবুর হাতে দিও, আমি চললাম।


বিলম্ব না করে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম। আমি জানতাম আমার মতো মেয়ের স্থান কোথাও হবে না। আমাদের ছায়া স্পর্শ করলে যদি অপবিত্র হয়ে যায় সেই ভয়ে কেউ কাছে আসতে চাইবে না।


বেরুবার সময় ময়নাকে একটি বার দেখার সাধ জেগেছিলো, কিন্তু পারিনি পাশের ঘরে ময়না তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি প্রথমেই ভুল করেছিলাম বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে গিয়ে। কেন সেই বস্তীতে আমার জীবনটা কাটালাম না। যদি তাই করতাম গভীর মর্মভেদী যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না।


কিন্তু তা পারিনি, কেন? কেউ উত্তর দেয়নি শুধু প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসেছে। সেই প্রতিধ্বনি সহ্য করতে না পেরে ছুটে চলেছি অন্ধকার পিচ ঢালা রাস্তায়। হঠাৎ এক সময় ট্যাক্সির ধাক্কায় রোডে ছিটকে পড়লাম তারপর আমি অজ্ঞান।


দেবীর বাবা একইভাবে চিৎকার করে চলেছেন। আমি শেষ কথা জানিয়ে দিচ্ছি, একটা বারবনিতা মেয়ের এখানে আশ্রয় হবে না। দেবীও কথা শুনে নেতিয়ে পড়লো। কোন প্রকারে রমাকে তার হৃদয় মন্দির হতে পরিত্যাগ করতে পারবে না। একটা অসহায় মেয়ে অন্ধকার জীবনের বহুদিন পর একটু চাঁদের আলো দেখেছিল তার কাছে আশ্রয় পেয়ে। ওকে তাড়িয়ে দেবীর পক্ষে কোনদিন রমার মনে দুর্বিসহ যন্ত্রণা দেওয়া সম্ভব হবে না।


দেবী বলল, সহজ এবং সুস্থ মনে তাকে স্ত্রী বলে স্বীকার করেছে। তহলে কি হবে? বাড়ী হতে কি করে বিতাড়িত করবে। দেবী এক রকম চিৎকার করে উঠল।


এ অন্যায়, অবিচার, বাবা।


দেবীর বাবা কর্কশ কণ্ঠে বললেন, তাহলে তুমি থাকো দেবী, আমি চললাম। হেমন্তবাবু প্রস্থান উদ্যত হতেই সুশীলবাবু এসে হাজির হলেন।


হেমন্তাবাবুকে অগ্নিশর্মা দেখে ধীর কণ্ঠে বললন, কি ব্যাপার রায় বাবু আপনি


উত্তেজিত হয়ে কোথায় যাচ্ছেন?


সুশীলবাবুকে দেখে হেমন্তবাবু আরো তেলেবেগুনে হয়ে বললেন, আপনি আগামীকাল কাজে ইস্তফা দিয়ে যেখানে খুশী চলে যাবেন? আপনাকে সৎ, নিষ্ঠাবান বলে মনে করতাম, কিন্তু এখন দেখছি তার উল্টো। আপনি পত্রে কেন জানাননি, দেবী একজন বারবনিতাকে বিয়ে করেছে? আর আপনি কেন রেজেষ্টারী ম্যারেজে সাক্ষী রইলেন।


সুশীলবাবু বললেন, এবার বুঝতে পারলাম আপনার অভিমানের কারণ। কিন্তু দেবী কোন অন্যায় করেনি রায় বাবু।


এর পরেও বলছেন দেবী কোন অন্যায় করেনি।


আমার অভিধানে বলে তাই।


সুশীলবাবু? চিৎকার করে উঠলেন হেমন্তবাবু।


দেখুন রায় বাবু দেবী যে অন্যায় করেনি তার প্রমাণ আমি দেব। আর একথাও জানবেন, আপনি আপনার বাগদত্তা পুত্রবধূকে ফিরে পেয়েছেন। সঠিক সত্য যতই নির্মম হোক না কেন, তাকে মেনে নেওয়ার মধ্যে আর যাই থাকুক না কেন অন্তত গ্লানি নেই, লজ্জাও নেই, ঘৃণাও নেই। আশাকরি একথা অস্বীকার করবেন না।


আপনার খেয়ালী পনায় কান দিয়ে আমার কানকে ক্লান্ত করবেন না। আপনার অপরাধের জন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে। আগামীকাল আপনাকে নানাবিধ দোষের জন্য বরখাস্ত করবো।


সুশীলবাবু নম্র কণ্ঠে বললেন, নিশ্চয় ; আপনার আদেশ আমি মাথা পেতে মেনে নেব, যদি আমি অন্যায় করে থাকি। কিন্তু আমি অপরাধ না করে যদি আপনার এক বাগদত্তা পুত্রবধূ ঘরে তুলে এনেছি, তাহলে তার বিনিময়ে আপনি আমাকে কি দেবেন? আর একথা কোন দিন অস্বীকার করতে পারবেন না চন্ডীপুরের জমিদার ব্রজকিশোর বাবুর প্রথম পুত্র সীতাংশুশেখর সিংহের কন্যাকে আপনি পুত্রবধূ বলে বরণ করে নেবেন একথা আপনি বলেন নি? একথা আপনি একদিন বলেছিলেন, এমন কি দেবীর বিয়ের সময় সে মেয়ের খোঁজ নেবার জন্য আমাকে চন্ডীপুরে পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোন প্রকারে তাদের সন্ধান আনতে পারিনি।


হেমন্তবাবু ওকথা শুনে ক্রোধকে একেবারে নীচে নামিয়ে কৌতুহলের সঙ্গে বললেন, আপনি কি বলতে চান, সীতাংশু শেখর সিংহের কন্যা এই রমা ?


হ্যাঁ।


কি করে জানলেন আপনি ?


ওদের রেজেষ্টারীর জন্য দেবী যখন আমার কাছে পরামর্শ নিতে এলো, এবং রমার নিয়ে সমস্ত ঘটনা শুনলাম রমার ও তার পরিবারের পরিচয় পেয়ে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। কারণ সে বারবনিতা বলে। কিন্তু ওদের পরিবারকে ধ্বংস করার একমাত্র মূল হচ্ছে এই দেবী। দেবীর জন্য বিপথগামিনী, এই দেবীর জন্য জমিদার পুত্র সীতাংশ বাবুকে দিনের পর দিন অনাহারে, অনিদ্রায় ফুটপাতে কাটিয়ে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। সুশীলবাবু রমার জীবনের কাহিনী প্রকাশ করলেন। একমাত্র রমার জন্যই ময়নার রোগ মুক্ত হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024