Thursday, June 30, 2022

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -8


 


আট




বেলা তিনটে নাগাদ টেলিফোন ভবনের নীচে এসে দাঁড়াল ঋজু। অনেক দিন পর এ রকম সময় ও এল। আগে প্রায়ই আসত। ওর জন্য টিফিন দিয়ে যেত। আপেল, আমসত্ত্ব, কাজু, কিসমিসের প্যাকেট, দই, সন্দেশ। কিন্তু কোনও দিনই আঙুর আনত না। প্রথম দিন আঙুর দেখেই কণিকা বলেছিল, আমি আঙুর খাই না। ওটা ঠাকুরের নামে উৎসর্গ করে দিয়েছি।


অত টিফিন দেখে কণিকা বলেছিল, এত খাবে কে?


— তুমি।


— পাগল নাকি? এ তো আমার এক সপ্তাহের টিফিন।


— যতটা পারবে, খাবে। না খেতে পারলে ফেলে দেবে।


— পয়সার জিনিস ফেলে দেব?


— তা হলে অন্যদের দিয়ে দিও।




তখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে ও। টিফিন দিতে আসার জন্য ঋজুকে অনেক আগে বাড়ি থেকে বেরোতে হত। তাই কণিকাই একদিন বলেছিল, শুধু শুধু এ সব দেওয়ার জন্য তোমাকে এত আগে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে না। আমাদের বেয়ারাটাকে দিয়ে আমি যা হোক কিছু আনিয়ে নেব।


তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই এটা ওটা সেটা নিয়ে ও চলে আসত। কিন্তু ওর আজকের আসাটা একদম অন্য কারণে।


সে দিন ওর অফিসের কাছে এসেও ঋজু কোনও ফোন করেনি। কণিকা বুঝি ভাবতেই পারেনি, ও আসবে। তাই গেটের কাছে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে গিয়েছিল সে। ওকে দেখে ঋজুরও কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল। ও তো এমনিতে এত সাজে না! তা হলে কি ও অন্য কোথাও যাবে!


ঋজুর সঙ্গে ও যখন প্রথম প্রথম দেখা করত, তখন ঠিক এ রকমই সাজত।


কণিকা জিজ্ঞেস করল, তুমি হঠাৎ?


— হঠাৎ কোথায়? আমি তো আসিই।


— কই, কাল তো আসোনি। পরশুও আসোনি। তার আগের দিনও বোধহয় না।


— দু’-একদিন আসিনি দেখে কি কোনও দিনই আসব না?


— আমার একটু কাজ আছে।


— কোথায়?


— অনিতায় যাব।


— অনিতা? মানে দেশপ্রিয় পার্কের ওখানে? ওই লেডিজ টেলারের কাছে?


— হ্যাঁ। দুটো ব্লাউজ করতে দেওয়া আছে।


— তুমি থাকো সেই সল্টলেকে। আর ব্লাউজ বানাতে দাও দেশপ্রিয় পার্কে।


— ওরা ভাল বানায়, তাই।


— ঠিক আছে চলো, আমি যাচ্ছি।


— তোমার অফিস নেই?


— পরমার্থদাকে বলা আছে।


— তুমি অনিতায় যাবেই?


— হ্যাঁ।


— সে যেতে পারো। কিন্তু আমি আবার ভাবছি, রেডি আছে তো?


— দেওয়ার ডেট কবে?


— গত কাল না পরশু ছিল।


— বিলটা দেখি।


কণিকা ব্যাগ হাতরাতে লাগল। এক বার এই চেন খোলে, এক বার ওই চেন। এক বার এই খোপ তো এক বার ওই খোপ। ঋজু বলল, কোথায় রেখেছিলে?


— ব্যাগেই তো রেখেছিলাম।


— ভাল করে দেখো।


— দেখছি তো।


— বিল না হলে দেবে?


কণিকা বলল, এমনি আমাকে চেনে। বহু দিন থেকে ওখানে করাচ্ছি তো। কিন্তু বিল না হলে ওরা দেবে কী করে? বিলের নম্বর দেখেই তো ওরা বার করে।


— তা হলে আজকে ছেড়ে দাও। বাড়ি গিয়ে খুঁজে দেখো, অন্য কোথাও রেখেছ কি না। না পেলে, আগে ফোন করে কথা বলে তার পরে যেও।


— ঠিক আছে তাই করি। ওই যে চোদ্দো নম্বর, আমি আসি। ট্রামটা থামতেই কণিকা উঠে পড়ল। ওর পেছনে পেছনে ঋজুও। রাজাবাজার ট্রাম ডিপোতে নেমে ওরা যখন অটো ধরার জন্য হাঁটতে হাঁটতে রাজাবাজার মোড়ের দিকে যাচ্ছে, কণিকার ফোন বেজে উঠল। কণিকা সে দিকে কর্ণপাত না করে ঋজুকে বলল, তুমি এ ভাবে চলে এলে, কোনও অসুবিধে হবে না তো? আগে কিন্তু অফিস, এটা মনে রেখো। আচ্ছা, এ বার হলদিয়ার অনুষ্ঠানটা হচ্ছে না? তপনদাকে কিন্তু আগে থেকে বলে রেখো, আর যাকে যাকে বলার, মনে করে বোলো, এ বার যেন কোথাও বাদ না যাই।


গত বছর তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, সবাইকে ঋজু ধরেছিল, যাতে পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্র সদনের কবিতা পাঠে কণিকার নামটা থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে কোনও কারণেই হোক, ওর নামটা ছিল না। পরে তপনদা বলেছিলেন, সামনের বার একটু আগে থেকে মনে করিয়ে দিও।


রাজাবাজার থেকে ওরা যখন অটোয় উঠল, আবার বেজে উঠল কণিকার ফোন। ঋজু বলল, তোমার ফোন বাজছে।


— তাই? যেন শুনতেই পায়নি, এমন ভান করে ব্যাগের সামনের খোপ থেকে ফোনটা বার করে অন করল কণিকা। চারিদিকে গাড়ির এত প্যাঁ পুঁ, অটোর ঝাঁকুনি আর তার মধ্যে এত নিচু স্বরে কণিকা কথা বলছে যে, সে কী বলছে, কিছু শোনা তো দূরের কথা, ওর মুখের ভঙ্গিমা দেখেও বোঝার উপায় নেই, ঝগড়া করছে না প্রেম করছে।


ওদের কমপ্লেক্সের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কণিকা বলল, তা হলে ঠিক আছে। তুমি অফিসে পৌঁছে কিন্তু একটা ফোন করে দিও।


— চা খাওয়াবে না?


— যাবে? কথাটা এমন ভাবে কণিকা বলল, ঋজু বুঝতে পারল, ও মনেপ্রাণে চাইছে, সে যাতে ওর বাড়িতে না যায়।


মহাদেববাবু এ সময় থাকেন না। মেয়েরাও পড়তে যায়। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে কণিকা বসে পড়ল খাটের এক ধারে। যেখানে ছোট্ট একটা তেপায়ার উপরে রাখা আছে ল্যান্ড ফোন।


আগে ঘরে ঢুকলেই কণিকা শাড়ি ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে শালোয়ার কামিজ পরে নিত। এবং অবাক কাণ্ড, প্রত্যেক বার কামিজটা উল্টো করে পড়ত। শুধু কণিকাই নয়, বড় বাবি ছোট বাবিরাও বাড়িতে যখন থাকে, উল্টো করেই জামাকাপড় পরে। কিন্তু সে দিন ঋজু দেখল, কণিকা বসেই আছে। শাড়ি ছাড়ার নাম নেই। হাত-মুখ ধোয়ার বালাই নেই। চা করা তো অনেক পরের ব্যাপার।


খুব বেশি হলে পাঁচ-সাত মিনিট। ল্যান্ড ফোন বেজে উঠল। কণিকা খাটের এক ধারে বসে। তার সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঋজু। ফোন ধরার জন্য ঋজু হাত বাড়াতেই, তার আগেই ফোনটা তুলে নিল কণিকা, হ্যাঁ, পৌঁছে গেছি। পরে ফোন করছি।


ঋজুর সন্দেহ দানা বাঁধছে। ও জিজ্ঞেস করল, কে?


— আমার এক বন্ধু।


— কী নাম?


— তুমি চিনবে না।


— নামটা বলো না।


— নাম বললে চিনবে?


— তোমার বলতে অসুবিধে কোথায়?


— অসুবিধে আছে। বলেই, শাড়ি ছাড়তে লাগল ও।




মাসখানেক আগে একটা ছেলে এসেছিল ঋজুর কাছে। নাম দীপঙ্কর। অল্প বয়স। ভীষণ স্মার্ট। লেখালিখি করতে চায়। বিশেষ করে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট। যাবার সময় তার নম্বরটা দিয়ে গিয়েছিল সে। ঋজু তাকে ফোন করে অফিসে আসতে বলেছিল।


রিসেপশনে বসে তাকে বলেছিল, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। কেউ যেন টের না পায়। জানো তো, বিশ্বের সমস্ত এডস রোগীরা মিলে একটা সংগঠন তৈরি করেছে। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাচ্ছে। গিফট পাঠাচ্ছে। এবং সম্পর্ক একটু ঘনিষ্ঠ হলেই সেই দেশে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করছে। প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে নিচ্ছে। বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। আর এই ভাবেই সুস্থ লোকেদের শরীরে এডসের বীজ বপন করে তারা কেটে পড়ছে।


— তাই নাকি? দীপঙ্কর অবাক। 


— শুধু তাই নয়, সেই সংগঠন সারা পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহরে তাদের শাখা অফিসও খুলেছে। যাদের উদ্দেশ্য ওই একই। সম্প্রতি কলকাতাতেও এ রকম একটা চক্রের সন্ধান পেয়েছি আমরা। কিন্তু আমাদের কারও পক্ষে এই কাজটা করা খুবই মুশকিল। কারণ, অনেকেই আমাদের চেনে। তাই, আমরা এমন একজনকে চাইছি, যাকে কেউ চেনে না, একদম আননোন। যে ছায়ার মতো অনুসরণ করে পুরো ঘটনাটা বার করে আনতে পারবে। ওরা কাদের সঙ্গে মিশছে। কোথায় মিট করছে। এবং কী ভাবে এই চক্রটাকে চালাচ্ছে, সব, সব।


— কিন্তু আমি তো কাউকে চিনি না।


— আমি একজনের খোঁজ পেয়েছি। সে টেলিফোন ভবনে কাজ করে। ছুটির পরে এই কাজে মেতে ওঠে। তাকে দু’-চার দিন ফলো করলেই তুমি সব খোঁজ পেয়ে যাবে। সে কোথায় কোথায় যাচ্ছে, কার কার সঙ্গে দেখা করছে, সব। আর জানামাত্র তুমি আমাকে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করবে। ও বাসে উঠলে তুমিও বাসে উঠবে। ও ট্যাক্সি নিলে তুমিও ট্যাক্সি নেবে। ও যদি কোনও হোটেলে গিয়ে ঢোকে, তুমিও সেই হোটেলে ঢুকবে। বুঝেছ? দু’-চার দিন একটু ছায়ার মতো লেগে থেকে দেখো তো, কোনও খবর পাও কি না। এই নাও, এই কাজে তো অনেক খরচ আছে। আপাতত এই ক’টা টাকা তোমার কাছে রাখো। বলেই, তার দিকে পাঁচশো টাকা এগিয়ে দিয়েছিল। তার পরে বলেছিল, লাগলে, পরে আবার দেবো। কেমন?


দীপঙ্কর অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল। পর দিন বিকেলে কণিকা অফিস থেকে বেরোতেই, ঋজু তাকে দূর থেকে দেখিয়ে দিয়েছিল। ব্যাস।


রাতেই সব খবর ফোনে পেয়ে গিয়েছিল ঋজু। অফিস থেকে বেরিয়ে এ দিক ও দিক ভাল করে দেখে নিয়ে ডালহৌসির মিনিবাস স্ট্যান্ড থেকে একডালিয়ার মিনিতে উঠেছিল সে। তার পর সোজা গিয়ে নেমেছিল গড়িয়াহাটের মোড়ে। উল্টো দিকে আনন্দমেলার সামনে দাঁড়িয়েছিল একটি লোক। পরনে সাদা জামা সাদা প্যান্ট। কালো শ্যু। হাতে সাদা মোবাইল। তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে কিছুটা গিয়ে, বিজন সেতুর একটু আগেই, রাস্তা পারাপার হওয়ার যে ওভার ব্রিজটা আছে, তার বাঁ দিকে ঘুরে একডালিয়া রোড ধরেছিল ওরা। এভারগ্রিন ক্লাবের উল্টো দিকে পারিজাত অ্যাপার্টমেন্টের পাশ দিয়ে ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্স ধরে সোজা এগিয়ে গিয়েছিল। তার পর বাঁ-হাতি রাস্তা ধরে ট্রাম রাস্তায় পড়ার আগেই, আই টি আই পাঁচিলের উল্টো দিকে ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্ট— অ্যামব্রোসিয়া। তার দোতলায় উঠে গিয়েছিল ওরা।


দীপঙ্কর ভেতরে ঢোকেনি। বাইরে, একটু দূরে কোনাকুনি উল্টো ফুটপাথে অপেক্ষা করছিল সে। পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট, আধ ঘণ্টা, পঁয়তাল্লিশ মিনিট। প্রায় এক ঘণ্টা হতে চলল। ওরা কখন বেরোবে কে জানে! সিগারেট ধরিয়ে দীপঙ্কর যখন একমনে টান দিচ্ছিল, হঠাৎ খেয়াল করল, ওরা দোতলা থেকে নেমে একটা ট্যাক্সিতে উঠছে। ট্যাক্সিটা ডান দিকে ঘুরে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে চলে গেল।

— তুমি পেছনে গেলে না কেন? 

দীপঙ্কর বলল, ওখানে আর ট্যাক্সি ছিল না।

— ওহ্‌। ঠিক আছে। কাল আর এক বার যেও।

— ও কে। কিন্তু কাল যে টাকাটা দিয়েছিলেন, তার প্রায় সবটাই খরচ হয়ে গেছে।

— ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমার কাছ থেকে এখন কাজ চালাও। পরে আমি দিয়ে দেবো।


পর দিন আবার ওদের পিছু নিয়েছিল দীপঙ্কর। এ বার আর ফোন নয়, রাতে সোজা ওর অফিসে চলে এসেছিল সে। বলেছিল, টেলিফোন ভবন থেকে ট্রামে করে ধর্মতলায় এসে, দূরপাল্লার বাসগুমটি থেকে একটা বাস ধরেছিল মেয়েটা। কত নম্বর ও জানে না। মেয়েটা উঠেছে দেখে সে-ও উঠে পড়েছিল। নেমেছিল উল্টোডাঙার মোড়ে। ক্যাপিটাল ইলেকট্রনিক্সের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল কালকের সেই লোকটা। তার সঙ্গে ও একটা গলির মধ্যে ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিল। বাইরে থেকেই ও খেয়াল করেছিল, ওরা একটা কেবিনে ঢুকে বসতেই বেয়ারা এসে পর্দা ফেলে দিয়েছিল। আধ ঘণ্টাটাক ছিল। তার পর বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাটকোর মোড় পর্যন্ত এসে মেয়েটা উঠে গিয়েছিল অটোতে। আর লোকটা পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাসে।


কণিকা কেন তার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করছে, ঋজুর কাছে এখন তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে । অথচ নিজে হাতে-নাতে ধরতে না পারলে কিছু বলতেও পারছে না। ভিতরে ভিতরে গুমরাচ্ছে। এই দুটি ঘটনা, বিশেষ করে কালকের ঘটনাটা ওকে এতটাই ছুঁয়ে গেছে যে, এই নিয়ে ও একটা কবিতাও লিখে ফেলেছে। মুখে কিছু বলতে না পারলেও, এই কবিতাটা শুনিয়েও তো ও তাকে বুঝিয়ে দিতে পারে, ও যেখানে যা করছে, ও সব জানে।

সেই কবিতাটা শোনানোর জন্যই সকালে ও ফোন করেছিল কণিকার অফিসে। ঋজুর ফোন বুঝতে পেরেই ও বলেছিল, এখন ভীষণ ব্যস্ত। যা বলার সংক্ষেপে বলো।

ঋজু বলেছিল, তা হলে এখন থাক। তোমার অফিস ছুটির পরে দেখা করে নেব।

ও বলেছিল, না, আজকে হবে না। আমি একটু অন্য জায়গায় যাব।

— অনিতায়?

— না। আমাদের অফিসের একজনের বিবাহ বার্ষিকী। সেখানে যাব।

— আমি পৌঁছে দিয়ে আসব?

— না। আমরা কয়েক জন কলিগ মিলে একসঙ্গে যাব।

— তা হলে!

— তোমার যদি খুব দরকার থাকে, দুপুরের দিকে আসতে পারো।

— ক’টায়?

— দুটো, আড়াইটে, তিনটে।


তাই তিনটে নাগাদ ওর অফিসের নীচে এসেছে ঋজু। এসেই, ফোন করেছে কণিকাকে। দু’মিনিটও লাগেনি। কণিকা নেমেই বলল, যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। অনেক কাজ আছে।

ঋজু বলল, একটা কবিতা লিখেছিলাম। তোমাকে শোনাতে চাই।

— শোনাবার কী আছে, যখন ছাপা হবে, দেখে নেব।

— না, আসলে তোমাকে নিয়ে লেখা তো।

— ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি পড়ো।

ঋজু পড়ছিল। কবিতা শেষ হওয়ার আগেই কণিকা বলল, সব মিথ্যে। বানিয়ে বানিয়ে কী সব হাবিজাবি লেখো।

— সব বানানো?

— হ্যাঁ। বানানো।

— লোকটা কে?

— বাজে কথার উত্তর দেওয়ার মতো সময় নেই আমার। আমি চললাম। গটমট করে অফিসের ভিতরে ঢুকে গেল ও।


ঋজু যখন রাতে ওর বাড়িতে ফোন করল, কণিকাই ধরল। কী চাই?

— লোকটা কে?

— যেই হোক, তোমার জেনে লাভ?

— বলবে না?

— আচ্ছা, কে কী বলল, কোথায় হাবিজাবি কী শুনলে, সে সব নিয়ে ঝগড়া করতে তোমার খুব ভাললাগে, না?

— কথা ঘুরিয়ো না। আমি যে প্রশ্ন করছি, তার উত্তর দাও।

— আমি ফালতু কথার উত্তর দিই না।

— এটাই তোমার শেষ কথা?

— বললাম তো। তোমার যদি ভাল না লাগে অন্য রাস্তা দেখো। আমার কাছে আসতে হবে না। প্রচুর মেয়ে বাজারে ঘুরছে, যে কোনও একটা ধরে নাও।

— এই সব কি যা তা বলছ?

— তোমার মতো ছেলের সঙ্গে এর থেকে ভাল ভাবে কথা বলা যায় না।

— তা হলে তুমি বলবে না? তাই তো?

— না-বলার কিছু নেই। তুমি তাকে চেনো। তোমাদের অফিসেই কাজ করে।

— আমাদের অফিসে? কী নাম?

— নাম বলব না।

— কোথায় আলাপ হল?

— যে দিন তোমাকে নিয়ে মুক্তাঙ্গনে ঋজু সন্ধ্যা হল, সে দিন ওই অনুষ্ঠানে যাবার জন্য আমি সিটিসি-তে উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। বাসটায় এত ভিড় ছিল যে, গড়িয়াহাটের মোড়ে বাসটা দাঁড়াতেই, ভিতর থেকে হুড়মুড় করে সব নামতে লাগল। ঠেলাঠেলিতে আমিও নেমে পড়লাম। ওই বাসে আর উঠতে পারিনি। কে যেন হিল জুতো দিয়ে আমার পা-টা মাড়িয়ে দিয়েছিল। খুব লেগেছিল। আমি যখন রাস্তার এক ধারে গিয়ে একটু নিচু হয়ে পা দেখছি, পাশ থেকে একজন বলে উঠেছিল, কী হয়েছে, লেগেছে? ‘হ্যাঁ’ বলতেই ছেলেটি রাস্তার উপরেই হাঁটু গেড়ে বসে আমার পা দেখতে লাগল। বারণ করা সত্ত্বেও পকেট থেকে রুমাল বার করে আমার পা মুছতে মুছতে বলল, ছুলে গেছে তো... দাঁড়ান, একটা ব্যান্ডেড নিয়ে আসি।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত। কোত্থেকে একটা ব্যান্ডেড নিয়ে এসে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল সে। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন? আমি বললাম, রাসবিহারীতে। মুক্তাঙ্গনে। ও বলল, চলুন। আমিও ওই দিকে যাব।

অটো করে যখন প্রিয়ার সামনে দিয়ে যাচ্ছি, কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ছেলেটা ফিসফিস করে বলল, মুক্তাঙ্গনে যাচ্ছেন? এ দিকটা বোধহয় ভাল করে চেনেন না, না? প্রথম বার যাচ্ছেন, তাই তো? চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে পৌঁছে দেব। তবে, তার আগে একটা ছোট্ট কাজ আছে। একটু কফি কিনব।

কফি? কফি তো যে কোনও দোকানেই পাওয়া যায়! আমি কী ভাবছি, ছেলেটা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল। বলল, এ কফি লেক মার্কেট ছাড়া আর কোথাও পাবেন না। র কফি। এখানে একশোরও বেশি রকমের কফি পাওয়া যায়। এরা শুধু কফিই বিক্রি করে। আমিও মনে মনে ভাবলাম, তা হলে এক বার দেখেই যাই দোকানটা।

কফি কেনার পরে ছেলেটা বলল, এখানে সাউথ ইন্ডিয়ান ফুডের খুব ভাল একটা রেস্তোরাঁ আছে, যাবেন? আমি বললাম, কোথায়? ছেলেটা বলল, এই তো সামনেই, প্রেমা ভিলা।

আর চুপ করে থাকতে পারল না ঋজু। বলল, সে কী! তুমি তাকে চেনো না, জানো না। রাস্তার একটা ছেলে বলল, আর অমনি তুমি তার সঙ্গে চলে গেলে?

— হ্যাঁ। এমন করে বলল, না করতে পারলাম না।

— তার পর?

— মুখোমুখি বসে যখন মশলা ধোসা খাচ্ছি, দেখি, খাবে কী, ছেলেটা আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, কী দেখছেন? ও বলল, আপনাকে। আমি কী বলব, বুঝতে পারলাম না। কথায় কথায় ও জেনে নিল, আমি কোথায় কাজ করি। আমি বিবাহিত কি না। ক’টা সন্তান। সব, সব। তার পর বলল, আমি যদি মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে দেখা করি, আপনার কোনও অসুবিধে নেই তো?

— তুমি রাজি হয়ে গেলে?

কণিকা বলল, এমন করে বলল, তা ছাড়া তুমিও তখন রেগুলার আসছ না। কী করব!

— বয়স কী রকম?

— বয়স? কত হবে! বছর তিরিশ-বত্রিশ। আমার ভাইয়ের চেয়েও ছোট হবে।

একটু রেগে গিয়ে ঋজু বলল, তাতেই তুমি মজে গেলে?

— আবার বাজে কথা বলছ।

— আমি নই। বাজে কথা বলছ তুমি। এতক্ষণ যেটা বললে পুরোটাই মিথ্যে।

কণিকা বলল, মিথ্যে হলে মিথ্যে।

— সত্যি কথা বলো।

— সত্যি কথা? ঠিক আছে, তা হলে তাই বলি। আমাদের অফিসের যে অনুষ্ঠানটা ছিল, মনে আছে? রোটারি সদনে?

মনে করার চেষ্টা করল ঋজু, রোটারি সদনে!

— তাও ভুলে গেছ, না? তা, সেখানে ওই প্রোগ্রামটা ও কভার করতে এসেছিল। আমি তো মঞ্চের পেছনে ছিলাম। সবাইকে ব্রোসিয়র-ট্রোসিয়র দিচ্ছিলাম। যাওয়ার সময় গেস্টদের, প্রেসের লোকজনদের মিষ্টির প্যাকেট-ট্যাকেটগুলো দিচ্ছিলাম। তখনই ওর সঙ্গে আলাপ।

— ব্যাস? তার থেকে একেবারে প্রেম? শুতে চলে গেলে?

— এই, একদম বাজে কথা বলবি না।

ঋজু অবাক। সে কী এমন বলল যে কণিকা একেবারে তুমি থেকে তুই-তোকারিতে নেমে এল! তবু বলল, বাজে কথা?

— বাজে কথা নয় তো কি? আমাকে কোনও দিন তুই ফোন করবি না। যদি ফারদার ভুল করেও করিস, আমি কিন্তু তোর বউকে ফোন করে সব বলে দেবো।

ও এত টেনশনে ছিল যে কণিকা কখন রিসিভার নামিয়ে রেখেছে, ঋজু বুঝতে পারেনি। ও একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। এই জন্যই কি গত বছর তথ্যকেন্দ্রের পুজো সংখ্যায় কণিকার কবিতা ছাপার জন্য অরূপ সরকারের কাছে তাবেদারি করার সময় অরূপ ওকে বলেছিলেন, একে তুমি কত দিন চেনো?

তখন আবেগে হাবুডুবু খেতে খেতে ঋজু বলেছিল, জন্ম-জন্মান্তর থেকে।

অরূপ বলেছিলেন, তাই নাকি? তোমাদের এত প্রেম? চল্লিশ বছর বয়সের পরে আবার কোনও প্রেম হয় নাকি?

— তা হলে কী হয়?

— শুধু সেক্স।

— ওটা তোমার ভুল ধারণা। আমাদের কত দিনের প্রেম জানো?

— যত দিনেরই হোক, আমি তোমাকে হার্ট করতে চাই না, তবু বলছি, যখন ভাঙবে, এত ঠুনকো কারণে ভাঙবে, তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না।

— যাঃ। মুখে ‘যাঃ’ বলেছিল ঠিকই, কিন্তু মনটা ভীষণ ভারী হয়ে উঠেছিল ঋজুর। ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছিল। অরূপদা হঠাৎ এ রকম কথা বললেন কেন!


                                              ক্রমশ...

Wednesday, June 29, 2022

ছোট গল্প - ফল্গুধারা || লেখক - চৈতালী রায় || Short story - Falgudhara || Written by Chaitali Ray


 

ফল্গুধারা

    চৈতালী রায় 




দিব্যেন্দু সকালে চা খেয়ে খবরের কাগজটা ওল্টাতে ওল্টাতে ভাবলো - আজ শর্মিলাকে সব কথা খুলে বলবো।
দিব্যেন্দু পুরুলিয়ার ছেলে। কলেজে পড়তে কলকাতায় এসেছিলো। একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো। বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। বাড়ির সকলেই ওর দিকে তাকিয়েছিল একটা চাকরির জন্য।
দিব্যেন্দু শর্মিলাদের বাড়িতে আসে - তাও প্রায় বছর ঘুরতে চললো। শর্মিলা তার মনের চারপাশে গন্ডী দিয়েছে। ভেতরে যাই হোক - বাইরে কিছুই যেন প্রকাশ না পায়। শর্মিলার কথায় সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ সব এলেও মনের কোন খবর বাইরে আসে না। সে স্রোতা হয়ে গল্প শোনে। দিব্যেন্দু বলে, বন্ধু হিসেবে তুমি খুব ভালো বন্ধু।
অফিস থেকে ফিরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে দিব্যেন্দু শর্মিলাদের বাড়িতে এলো । ওকে কিছুটা খুশি খুশি লাগছে। বললো - আজ তোমাকে তমালির কথা বলবো। তমালি আমার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু। তখন কলেজে পড়ি। ওর দাদা আমার সাথে পড়তো। একদিন ওর দাদা আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে গেলো। বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গিয়ে ওর বোন তমালির সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। দেখলাম, ও একটা বই পড়ছে। এরপর আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ওদের বাড়িটা কেমন অদ্ভুত ধরনের। সকলেই সকলের সামনে সব কথা বলে। সাধারণ বাড়িতে যেমন একটা আব্রু থাকে, সেটা ওদের নেই। ওরা এই খোলামেলা মেলামেশাকেই প্রগ্রেশিভ চিন্তা বলে। ওদের বাড়ি থেকে কোনরকম বাধা না আসায় আমাদের সম্পর্কটা খুব সহজেই গাঢ়ত্বে পরিণত হলো। এরপর আমি চাকরি পেলাম। আমার ছোট ভাইবোনেরা পড়াশোনা এবং সমস্ত কিছুর জন্যই আমার ওপর নির্ভরশীল হলো।
তমালিদের সব ভাই - বোনেরা গান - বাজনা, রাজনীতি এসবে যুক্ত ছিলো। একদিন তমালি বললো, কয়েক মাসের জন্য আমি বাইরে যাবো। আমার ব্যাগটা তুমি গুছিয়ে দাও। আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম - আমাকে আগে বলোনি তো ! ও খুব সহজেই বললো - এতে বলার কি আছে। এখন তো বললাম। ওর বাড়ির সকলে বললো - আমাদের বাড়ির মেয়েরা এভাবে প্রতিপদে মত নিয়ে চলতে অভ্যস্ত নয়। আমরা মনে করি তাতে ওদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। আমার কিছুটা অভিমান হলো। কিন্তু বিশ্বাস করো - ঐ ব্যাগটা গোছাতে মেয়েদের জিনিসপত্র এই প্রথম হাত দিয়ে নেড়ে, গোছাতে আমার এক তীব্র অনুভূতি হয়েছিল। যাই হোক পরদিন তমালি ওর আরো কয়েকজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে চলে গেলো। তাতে ওদের বাড়ির কেউই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো না।
ফিরে আসার পর ও আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। আমিই বারকয়েক ওদের বাড়ি গেছি , বলেছে - ও এখন খুব ব্যস্ত সময় দিতে পারবে না। শর্মিলা শুনতে শুনতে ভাবছে - এইবার এ প্রসঙ্গটা থেমে যাক। আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা দমবন্ধ করা ভাব উঠে আসছে। শর্মিলার চোখের দৃষ্টি থেকে দিব্যেন্দু ক্রমশঃই দূরে সরে গিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ওকে কোনদিনও না ছুঁয়েও যেন ছোঁয়া হয়ে গেছিলো। মনের ভেতরে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো জল পড়তে লাগলো। আর সে শব্দকে ঢাকতে শর্মিলা ঠোঁটের মাঝে এক চিলতে হাসি মেলে ধরলো। দিব্যেন্দু বলে চললো - দিন চারেক আগে তমালি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। বললো - এবার আমরা বিয়েটা সেরে ফেলবো। রেজিস্ট্রির জন্য আবেদন করবো। আমি ওকে কিছুই বলতে পারলাম না। বিশ্বাস করো আমার প্রচন্ড আনন্দ হলো। দেখলাম - আমি ওকে আজও সেরকমই ভালোবাসি। আগামীকাল দু'জনে মিলে আমরা উকিলের কাছে যাবো।
শর্মিলা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো - আগামী দিনের জন্য শুভেচ্ছা রইলো। বাইরে তখন বৃষ্টি না হলেও শর্মিলার আকাশে বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি দাপাদাপি করতে লাগলো।

Sunday, June 26, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -8


 

বাবা উদাস হয়ে জানালার পানে তাকিয়ে ছিলেন চক্ষুদ্বয়কে স্থির করে। আচার্য্য মশায়ের এতো ভাষণ দেওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম। গত কয়েক মাস আগে বাবা ওদের কোন এক মজলিসে বলেছিলেন, দাদা ডাক্তারী পাশ করলে যে সুদিন ফিরে আসবে তাতে তার খরচা তুলে নেবেন। আচার্য্য মশায় ঠাকুরদার আমল হতেই আমাদের প্রতি হিংসুটে ছিলেন। তিনি উপনিষদের কথা ব্যাখ্যা করে বোঝালেন সত্য, কিন্তু এসময়ে আমাদের কোন ফল হলো না বরং শোকের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো। 


বাবা তার কথায় আরো দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে কিভাবে দিনগুলো কাটাতেন তা ঈশ্বরই জানেন। তবুও নিজেকে শক্ত করে নানা ভাবে বাবাকে বুঝিয়ে কয়েক মাস অশেষ দুঃখ ভোগের পর মনে চাঞ্চল্য কাটিয়ে স্থৈর্য আনলাম সত্য, কিন্তু বাবা কোন প্রকারে দাদার কথা ভুলতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। তার এই শোকাহত জীবনের মুখচ্ছবি আমাকে আকুল করে তুলে ছিল। তাই ঐ জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঐ দৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে আমাদের উভয়ের মৃত্যু কামনা করতাম। আবার কখনও কখনও ভাবতাম আমাদের জীবন রথ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। 

প্রতিদিনই একরকম উপবাসে দিন যেতো। সুতরাং দারিদ্রই ছিলো তখন দৈনন্দিন জীবনের সাথী। নৈরাশ্য, ব্যর্থতা ও অনটন নিয়ে তখন ঘর পেতে বসেছিলাম।

 এভাবে কত দিন চলবে। দৈন্য পীড়িত, সংসারে আয়ের উৎস সন্ধানে ব্রতী হলাম। কিন্তু উৎসের সন্ধান সহজলভ্য হলো না। প্রাইভেট টিউশানির প্রতিযোগীতায় পরাজিত হলাম। একদিন ভাবলাম দূর সম্পর্কের পিসিমার বাড়ী হতে বেড়িয়ে আসি। আমাদের দুরাবস্থার কথা শুনিয়ে যদি কিছু সাহায্য পাই, তাহলে হয়তো কয়েকটা দিন চল যাবে। কিন্তু বাধা দিলেন রন্টুদা আমাদের বাড়ীতে এসে। আমি ভাবতেই পারিনি এই সময়ে রন্টুদা আমাদের বাড়ীতে আসবে।

 নিজেদের অন্ন জোটানো বিশাল কষ্ট দায়ক; প্রথমেই বলেছি অধিকাংশ দিন আমাদের পিতা - পুত্রীকে অনাহারে থাকতে হতো। রন্টুদা এসে হাজির হয়ে মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে দিতেই আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। ভেতর থেকে যেন কান্নাকে ঠেলে নিয়ে এলো। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। রন্টুদা অনেক প্রবোধ দেবার পর কান্না থামল বটে, কিন্তু বার বার দাদার কথা মনে পড়তেই যেন পুনরায় কান্নাতে দেহ-

মনকে দুর্বল করে ফেলল। কোনো প্রকারে নিজেকে সামলে নিয়ে ওর জলযোগের ব্যবস্থা করলাম। 

রন্টুদা কিছুক্ষণ পর অতিনম্র গলায় বলল, সুমন্ত যখন কলকাতায় খুন হয় তখন। আমি কলকাতায় ছিলাম না। অনেক পরে আমি কলকাতায় এসেছি। এসে সুমন্তর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি আর থাকতে পারলাম না। তোদের অবস্থা আমি জানি, এই দুর্দিনে যদি তোদের পাশে এসে না দাঁড়াই তাহলে আমি চিরদিনের জন্য অকৃতজ্ঞ রয়ে যাবো। 

সুমন্তর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি স্থির থাকতে পারিনি রমা। বার বার মন কাঁদতো তোদের কিভাবে দিন কাটছে, তোরা কেমন আছিস, কি করে তোদের সংসার চলছে, তোদের অগ্নিদগ্ধ জীবনে যদি একটুখানি সান্ত্বনা দিতে পারি তাহলে জানবো আমি তোর আপন দাদার কাজ করলাম। হ্যাঁরে, তোদের হাট - বাজার কোথায়। একটা থলে দে, কিছু আনাজপত্র নিয়ে আসি। 

আমি কি করবো ভাবছি। আমার মুখপানে তাকিয়ে বললেন, আমি সব বুঝি, হলেটা দে, এবার বল বাজারটা কোথায়। 

বললাম। আমাকে উনুন ধরাতে বলে রন্টুদা বাজারের অভিমুখে পা পাড়ালো। আমি উনুন ধরিয়ে বাবাকে একটা প্লেটে দুটো মিষ্টি দিয়ে বললাম, বাবা সকাল থেকে খালি পেটে আছো, দুটো মিষ্টি খাও। বাবা মিষ্টি দুটো হাতে নিয়ে নাড়া - চাড়া করতে দেখে ভাবলাম, কতদিন হল বাবা, মিষ্টি, সন্দেশ, চোখে দেখেনি তাই চোখ দুটো আমার জলে ভরে গেলো। বাবা কিছুক্ষণ পর মুখে মিষ্টি একটা প্রবেশ করাতেই কাশতে শুরু করলো। আমি জলের গ্লাসটা নিয়ে বাবাকে জলপান করালাম।

 কোন প্রকারে দুটো মিষ্টি খেয়ে পুনরায় জানালার পাশে গিয়ে বসলো। পূর্বের মত উদাসীনভাব। তার অন্তরের জমাট বেদনা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাবার চোখ দিয়ে টপ্ টপ্ করে জল ঝরছে। প্রবোধ দিলেও বাবা শান্ত হয় না। এক সময় রন্টুদা থলি ভর্তি আনাজপত্র তরিতরকারী, চাল, ডাল ইত্যাদি এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, এগুলো রাখ। তিন - চার দিনের আহার আছে। আজকে শুক্তো, ডাল ও আমের চাটনী করবি, সুন্দর ভাত খেয়ে নেব। মনে কোন দ্বিধা আনিস না রমা। বিধাতার অভিশাপে তোদের জীবন মরুময় হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনি। তবে তোদেরকে আমি হারতে দেব ন। আমি একটা পথ বের করবই। আমি যখন এসে পড়েছি তখন তোদেরকে এইভাবে দিন কাটাতে দেব না। আজই উপার্জনের জন্য উৎস বের করবই।

 রন্টুদার কথামত শুক্তো, ডাল, আমের চাটনি দিয়ে বাবা ও রন্টুদাকে খাবার পরিবেশন করলাম। হঠাৎ বাবা কেঁদে ফেললেন, রন্টুদা ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকলো, একটু পর বলল, আপনি কাঁদবেন না মেসোমশায়, আমি তো আছি। মনে করুন আমি সুমন্ত, দুঃখকে ভুলে যাবার চেষ্টা করুন। আর ভুলতে হবেই। আমি জানি উপযুক্ত পুত্রকে হারিয়ে কেউ শান্তিতে থাকতে পারে না। বারংবার তার মুখচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবেই। আপনি ভারসাম্য হারাবেন না। নইলে রমা বাঁচবে না। আপনার যন্ত্রণা দেখে ও কোন প্রকারে ভালো থাকবে না। মর্মে মর্মে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। আপনাকে দাঁড়াতেই হবে। কোন চিন্তা নেই আপনার, আমি সর্বদাই আপনার পাশে আছি। সর্বদাই আপনাদের সাহায্য করবো।

Friday, June 24, 2022

ছোট গল্প - থিম || লেখক - চিরঞ্জিৎ সাহা || Short story - Theme || Written by Chiranjit Shaha


 


    থিম

        চিরঞ্জিৎ সাহা 


    

অষ্টমীর রাতেই ঘটল বিপর্যয়টা। ঘড়ির কাঁটা সবে আটটা পেরিয়েছে। বাইরে তখন লাখো মানুষের ঢল। হঠাৎই জ্বলে উঠল মূল মণ্ডপের সামনের দিকের বৈদ্যুতিক তার। কয়েক সেকেন্ড আলোর দপদপানি। মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল সব। ছিটকে আসা আগুনে ঝলসে উঠল মাতৃমূর্তির একাংশ। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল লাইনসমেত রেলগাড়ি।




তারপর পেরিয়ে গেছে তিনটে ঘন্টা। প্রাথমিকভাবে দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেও দায়িত্বসহকারে তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে মুক্তিদূতের স্বেচ্ছাসেবকগণ। পুড়ে যাওয়া থিমের মাতৃমূর্তিকেও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্যত্র। পরিবর্তে সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে শাস্ত্রীয় উপাচারের নিমিত্তে নির্মিত মণ্ডপের একপাশে রাখা ফুট তিনেকের সাবেকি দুর্গাপ্রতিমা। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই। সামনে অপেক্ষমান বিশাল জনসমুদ্র। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙছে দর্শনার্থীদের। উদ্যোক্তাদের তরফে মাইকে বারংবার আশ্বস্ত করা হলেও পরিস্থিতি পুরো বিশ বাঁও জলে।





জনপ্রিয় সংবাদপত্র থেকে লিডিং নিউজ চ্যানেল , প্রখ্যাত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকার --- পুরস্কারের বন্যা এবার মুক্তিদূতে। ইতিমধ্যেই বাইশটা পালক তাদের স্বর্ণখচিত মুকুটে , অপেক্ষা করছে আরও কয়েকটা। মিডিয়ার ফোকাস জুড়ে শুধুই মুক্তিদূত। পঞ্চমী থেকেই জনারণ্য মণ্ডপে। উদ্যোক্তাদের অভিনব প্রচার কৌশল আর সাধারণ মানুষের মুগ্ধতায় চড়ে মনমাতানো থিমের খবর ছড়িয়ে পড়েছে শহরের কোণায় কোণায়। তিলোত্তমার বাইরে থেকেও ভিড় জমিয়েছেন অনেকে।






অকস্মাৎ এমন বিপর্যয়ে রীতিমতো মাথায় হাত পুজো কমিটির সদস্যদের। অনেকে চেষ্টা করেও কোনোরকম কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না অভিজ্ঞ থিম মেকার সৌমিক সিনহা। বছরের পর বছর ধরে অভিনব সব মণ্ডপ সে উপহার দিয়ে এসেছে দর্শনার্থীদের। বিদেশেও কাজ করেছে প্রচুর। সৌমিক সিনহা সততই যেন মণ্ডপজগতের ফিদা হুসেন। চমকপ্রদ পরিকল্পনা আর চোখ জুড়ানো ফিনিশিংয়ে তার জুড়িমেলা ভার।






এহেন ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেরিয়ারে এই প্রথম। মা দুর্গার ছোট্ট মূর্তিটাকে স্বভাবসিদ্ধ তুলির টানে থিম প্রতিমার স্থলাভিষিক্ত করার উপযোগী করে তুললেও বাধ সাধল রেললাইন। ভাঙা অংশগুলো জোড়ার যথাযথ কোনো কৌশল মাথায় আসছে না কিছুতেই। তার ওপর টানা তিনঘন্টা গোটা মণ্ডপ পুরো অন্ধকারে। যথাসাধ্য চেষ্টার পর শেষমেষ রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হল সৌমিকের ইলেকট্রিশিয়ানরা। ইউটিউবে দীর্ঘক্ষণ চোখ রাখার পরও মিলল না সার্কিট মেরামতির কোনো উপযুক্ত কৌশল। ওদিকে রেললাইনের সঠিক মুখগুলোও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই। কপালে চিন্তার ভাঁজ শহরের সেরা থিম মেকারের। মধ্য হেমন্তেও গলদঘর্ম পুজো কমিটির সদস্যরা। লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি ভিড়ের মাঝে মণ্ডপ ভেঙে পড়ার মতো অনভিপ্রেত ঘটনা; সবমিলিয়ে সামনের বছর পুজোর লাইসেন্স বাতিল কেবল সময়ের অপেক্ষা মুক্তিদূতের।





দেশ-বিদেশে উচ্চ প্রশংসিত সৌমিকের এই আকাশচুম্বী সাফল্যের পিছনে ভ্যাবলা ক্ষ্যাপার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। অনবদ্য সব শৈল্পিক চিন্তাভাবনা সৌমিকের মগজাস্ত্রে ভর করার পর সেটার সার্থক বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ওই আধপাগলা ছেলেটা। নিখুঁত স্কেচে গোটা প্ল্যানটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভ্যাবলাকে বুঝিয়ে দেয় সৌমিক ; তারপর ছেনি , হাতুড়ি নিয়ে নেমে পড়ে কাজে। পেন্টিং কিংবা মাটির যাবতীয় কাজ থিম মেকার নিজে করলেও থার্মোকল আর লোহালক্করের সম্পূর্ণ দায়িত্ব থাকে ভ্যাবলার বিশ্বস্ত হাতে। ইলেকট্রিকের কাজেও ওর জুড়িমেলা ভার। প্রায় এক হাজার লেবার সৌমিকের আন্ডারে থাকলেও ভ্যাবলার মতো অমন দক্ষ নয় কেউ। পাগলটা শ্রমিক নাকি জাতশিল্পী --- ভেবে মাঝেমধ্যে ঘাবড়ে যায় সৌমিক নিজেই। 





অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও মোট সতেরোটা প্যান্ডেলের কাজ প্রবাদপ্রতিম থিম মেকার সৌমিক সিনহার হাতে। গত সালে দশমী পেরোতে না পেরোতেই টাকার থলি নিয়ে ওর জন্য ঝাঁপিয়েছিলেন মুক্তিদূতের সহসভাপতি। কন্ট্রাক্টে সই করতে দেরি করেনি ধুরন্ধর শিল্পী নিজেও। তারপর মার্চ মাসে গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনার থাবা। দুর্গাপুজোর সম্ভাবনা কমতে শুরু করেছিল ক্রমেই। তৈরি হচ্ছিল উদ্যোক্তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার পরিস্থিতি। কিন্তু জুনের শুরুতেই কমিটির তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় , পুজো হচ্ছেই। কাজ শুরু করার অনুরোধ জানানো হয় সৌমিককে। 


তারপর টানা সাড়ে চার মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম আজ ধ্বংসের মুখে। মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে দীর্ঘক্ষণ মানুষকে আটকে রাখার পর শেষমেষ নিজেদের অপারগতা স্বীকার করে সমবেত দর্শনার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন মুক্তিদূতের সভাপতি। সীমাহীন অপেক্ষায় ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে জনতার। ব্যারিকেড টপকে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করতে শুরু করেছে মণ্ডপের অক্ষত অংশ। সৌমিকের কলার চেপে ধরলেন মুক্তিদূতের সম্পাদক --- " এতক্ষণ ধরে এসব ছিনালি না করে তোমার হেডমিস্ত্রিকে তো ডাকতে পারতে , বাড়া। কোথায় ওই লাটসাহেব ? তুমি তো শালা স্পটেই আসো না। সব নষ্টামি তো ওই পাগলই করেছে। পুরস্কার আর ফুটেজের লোভে তুমি তো সবে গতকাল থেকে ঘুরঘুর করা শুরু করেছো প্যান্ডেলে। " 


--- " ফালতু কথা একদম বলবেন না। শহর জুড়ে আরও ষোলোটা প্যান্ডেল আছে আমার। পুরস্কার ওরাও পেয়েছে। আর আমি থিমমেকার ; মিস্ত্রি নই। সব প্যান্ডেলেই সমান সময় দিয়েছি আমি। বাকিটা আমার লেবাররা করেছে। ভ্যাবলা আমার টিমের সবথেকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লেবার। এখানে পুরো দায়িত্বটা ও নিজের কাঁধে নিয়েছে বলেই আমার আসার প্রয়োজন পড়েনি খুব একটা কিন্তু মূল প্ল্যান তো আমারই ছিল। "


--- " তা এই লোডশেডিং ,মণ্ডপ ভাঙার প্ল্যানও কি তোমার , খোকা? কত খেয়েছো অপনেন্ট ক্লাবের কাছ থেকে? " 


--- " মুখ সামলে মুরারিদা। হাতে-কলমে কাজটা কিন্তু ভ্যাবলা করেছে ,আমি না। আজ ও থাকলে হয়তো …. "


--- " তা শালা ফোন করো না ওই ঢ্যামনাকে! "


--- " ওর ফোন নেই দাদা। "


--- " তাহলে বাঞ্চোদ আমার গাড়িটা নিয়ে ওর বাড়ি যাও। মাঝপথে এভাবে পুজো বন্ধ হলে আমাদের রেপুটেশন কোথায় নামবে ,ভাবতে পারছো? ওদিকে পাবলিক তো প্যান্ডেল ভেঙে পুলওয়ামা বানিয়ে দিচ্ছে। "


--- " ওর ঠিকানা জানি না ,স্যার। "


--- " গাঁজা কি ফ্যাদের সাথে মিশিয়ে টেনেছো নাকি বাড়া? তোমার লেবার আর তুমি জানো না বাড়ি কোথায়? "


--- " আপনি কিন্তু সীমা ছাড়াচ্ছেন মুরারিদা। আপনাকে মিথ্যে বলে লাভটা কী আমার? " 


--- " ও মা গো! টুরু ন্যাকা! যাই হোক , পুলিশ হয়তো আমার পুজো বছর তিনেকের জন্য ব্যান করবে কিন্তু তোমার কেরিয়ার কিভাবে খতম করতে হয় --- সেটাও আমি দেখে নেব আলবাত। আলটিমেটলি উদ্যোগ আমাদের হলেও মণ্ডপ কিন্তু তোমারই তৈরি। " 


--- " সেকথা তো আমি একবারও অস্বীকার করিনি , দাদা। তবে প্রথম থেকেই আমি কিন্তু বারবার বলেছিলাম স্পেসের ওপর রেললাইন দাঁড় করানোটা ভীষণ মুশকিলের কাজ। আপনি তো আমার কথা পাত্তাই দিলেন না ; উল্টে চটে গিয়ে বললেন ,আপনাদের কোন কর্তা নাকি পিডব্লুডি-এর বড়ো ইঞ্জিনিয়ার! বছরে দুটো করে ব্রিজ বানায়। এসব মামুলি কাজ নাকি সে কেনি আঙুলে সামলে নেবে। "


--- " তোমার ওই পাগলাচোদা মিস্ত্রি তো সদানন্দকে হাতই দিতে দেয়নি কাজে! সারাদিন শালা মালের বোতল নিয়ে পড়ে থাকত মাঠে। কি যে করেছে , তা তো দেখতেই পাচ্ছি। "


--- " ফাইনাল টেস্টিংয়ের দিন কিন্তু আপনার ক্লাবের লোকেরাও পরখ করে নিয়েছিল পুরোটা। তখন কিছু বলেননি কেন? আজও তো দেখলাম তিনঘন্টারও বেশি সময় ধরে চেষ্টা করলেন ওনারা! সব নাকি রাজ্য সরকারের কারিগরি বিভাগের বড়ো বড়ো আধিকারিক অথচ থিমের একটা খেলনা রেললাইন জুড়তে গিয়েই হাওয়া পুরো ফুটুস দুরুম আর ওই বিদ্যুৎ সচিব না বোসবাবু কি যেন নাম ---- শালা একটা কানেকশন ঠিকঠাক করে লাগাতে পারে না ; আবার সরকারের লাখ লাখ টাকা লুটছে প্রতিবার। ইঞ্জিনিয়ার শালা! " 


--- " ওরা পারছে না বলেই তো তোমার ভ্যাবলাকে ঢাকতে বলছি সৌমিক। কিন্তু তোমার তো দেখছি বাড়া ধনুক ভাঙা পণ। অন্য ক্লাবগুলোর থেকে যা খেয়েছো , তার দশগুণ বেশি দেব ভাই । প্লিজ ওকে ফোন করো একটা। সম্মান যে পুরো স্যাকারিন হয়ে গেল। "


--- " আমি ওর ঠিকানা বা ফোন নম্বর কিছুই জানি না মুরারিদা। মোবাইল ও ইউজও করে না। "


--- " থাম বাড়া। "






মিথ্যে বলেনি সৌমিক। ভ্যাবলার ফোন নম্বর ও জানে না সত্যিই। বাড়ির ঠিকানাও গত দশ বছরে ভ্যাবলা বলতে চায়নি কোনোদিন। প্রবল জোরাজুরির পরও প্রতিবারই ওর পাথরসুলভ মৌনতার কাছে শেষমেষ হার মানতে বাধ্য হয়েছে সৌমিকের যাবতীয় প্রয়াস। বছর দশেক আগে মৌলালির অফিসে সৌমিকের সাথে প্রথমবার দেখা করতে আসে ভ্যাবলা। মুখ দিয়ে সেদিনও মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল ম ম করে। থিমমেকার হিসেবে সেসময় একরকম অখ্যাতই সৌমিক। কাজও পেত হাতে গোনা দু-চারটে। নেশার ঘোরে ভ্যাবলা যেটুকু বলেছিল তার সারমর্ম দাঁড়ায় --- কলকাতার কোনো এক বিখ্যাত ডেকরেটরের আন্ডারে লেবারের কাজ করত ও। পরপর লসের ধাক্কায় হঠাৎই ব্যবসা গোটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিক। কর্মহারা ভ্যাবলা তাই দিশাহীন। বাইরে বড়ো পোষ্টার দেখে পেট চালানোর দায়ে অগত্যা যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়েছে সৌমিকের সাথে। একটা কাজ পেলে খুব ভালো হয়। প্যান্ডেলের কাজে নিজেকে ভীষণ দক্ষ বলেই দাবি করেছিল ভ্যাবলা। 






সৌমিক তখন একেবারেই নতুন এই ব্যবসায়। দুটো বড়ো পুজোর বায়না এলেও পর্যাপ্ত সংখ্যক লেবার হাতে নেই বললেই চলে। ভ্যাবলাকে টিমে নিতে তাই ভাবতে হয়নি এক মুহূর্তও। মাতাল ভ্যাবলাও নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যায় সৌমিকের বলা দৈনিক দুশো টাকার প্রস্তাবেই। সাথে সারাদিনের মদ। হাতে মদের বোতল নিয়ে ভ্যাবলা নেমে পড়ল কাজে । প্রতিদিনই তার মুন্সিয়ানায় মুগ্ধ হতে থাকল সৌমিক। ক্রমে ভ্যাবলা হয়ে উঠল সৌমিক ক্রিয়েশনের বেস্ট লেবার। প্রতি বছর পুজোর তিনমাস আগে নিয়ম করে সে হাজির হয় কলকাতায় সৌমিকের অফিসে। কাজ পুরোপুরি শেষ করে গ্রামের বাড়িতে ফেরে ষষ্ঠীর রাতে। সময়ের সাথে সাথে সৌমিকের খ্যাতি আজ আকাশ ছুঁয়েছে। মাইনে বেড়েছে ভ্যাবলারও। তিনমাস কাজের বদলে ষাট হাজার টাকা এখন সৌমিক তুলে দেয় ওর হাতে। সাথে ঢালাও মদের খরচ তো আছেই। বহুবার জিজ্ঞাসা করার পরও বাড়ির ঠিকানাটা কিছুতেই জানতে পারেনি সৌমিক। সুন্দরবনের বেশি একটা শব্দও বের করতে পারেনি ওর মুখ থেকে। ঘাটায়নি আর সৌমিকও। কত লেবারই তো কাজে আসে প্রতিবার। কজনের ঠিকানাই বা ঠিকঠাকভাবে জানে ও। তবে ভ্যাবলার মতো দক্ষ শিল্পী সৌমিকের টিমে আর দুটো নেই , রোয়াবও তাই অনেক বেশি। 





মুঠোফোনের ঝাঁ-চকচকে দুনিয়া এখনও অচেনা ভ্যাবলার কাছে আর একপক্ষে তা যেন শাপে বরই হয়েছে সৌমিকের। মোবাইল থাকলে এতদিনে বড়ো অঙ্কের টোপ দিয়ে ঠিক ওকে দলে ভিড়িয়ে নিত অন্য কোনো থিম মেকার। ভ্যাবলা যেন সৌমিকের কাছে স্বয়ং ঈশ্বরের প্রেরিত দূত । ভরপেট মদ আর পুরোপুরি স্বাধীনতা পেলেই পাগলটা বেজায় খুশি। সৌমিকও তাই ওর কাজে হস্তক্ষেপ করে না কোনোদিন। স্কেচের পর একটা গোটা মণ্ডপ প্রতিবছর ছেড়ে দেয় ভ্যাবলার হাতে। মাটির কিংবা ছবির ব্যাপারটা নিজের হাতে নামিয়ে দিয়ে এলেও ভ্যাবলার প্যান্ডেলের ইলেক্ট্রিক বা শোলার কাজে নাক গলায় না ভুলেও। মহালয়ার দিন সন্ধ্যেবেলা গোটা কাজ পার্টিকে একবার দেখিয়ে নেয় ভ্যাবলা। কিছু চেঞ্জের প্রস্তাব এলে সেরে ফেলে পরের দিনগুলোতে কিন্তু তার আগে কেউ নাক গলালেই মটকা যায় গরম হয়ে। বোতল ভেঙে তাড়া করতেও ভাবে না দুবার। এভাবেই চলে আসছে আজ প্রায় দশটা বছর। সবথেকে বড় বাজেটের পুজোটা নির্ভয়ে সৌমিক এখন ছেড়ে দেয় ভ্যাবলার ওপর আর তাতে ফার্স্ট প্রাইজও মিস হয়না কোনোদিন। 




এবছর ভ্যাবলার আসা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল সৌমিক। একেই লকডাউনে ট্রেন-বাস সব বন্ধ। তার ওপর অতিমারিতে বেঁচে আছে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই কোনো। উপায় ছিল না যোগাযোগেরও। সবমিলিয়ে সতেরোটা পুজো হাতে থাকলেও কাজ নামানো নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিল ছেলেটা। যদিও ততদিনে স্কেচ কমপ্লিট হয়ে গেছে প্রায় সবকটারই। রথের দিন সকালে সাইকেল নিয়ে হঠাৎই সৌমিকের অফিসে এসে এসে হাজির ভ্যাবলা। দেখামাত্রই ভূত দেখার মতো আঁৎকে উঠল সৌমিক। এ যেন সাক্ষাৎ ঈদের চাঁদ।  অতিমারির মাঝেও সাইকেল পায়ে সুদূর সুন্দরবন থেকে যে উদয় হবে ভ্যাবলার , দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি সৌমিক। ভ্যাবলাকে নিয়ে সটান সে হাজির হল মুক্তিদূতের অফিসে। সৌমিকের প্ল্যান শুনেই উল্লাসে ফেটে পড়লেন ক্লাবকর্তারা। কিন্তু কেমন যেন মিইয়ে গেল ভ্যাবলা। থিমটা শুনেই ইতস্ততভাবে বলে উঠল --- " এটাকে কি কিছুতেই পাল্টানো যাবে না সৌমিকবাবু?" রে রে করে উঠলেন সম্পাদক --- " আরে এই থিমের জন্যই তো কর্পোরেট টাকা দেবে আমাদের। পাগলা নাকি আপনি? সৌমিক ভাই , তুমি তো পুরো লেজেন্ড আছো , দেখছি! মাশাল্লাহ প্ল্যানিং বিলকুল। " ভ্যাবলার বিরোধিতার কারণে তাকে প্যান্ডেলের কাজে রাখার ব্যাপারে সম্পাদকমশায় প্রবল আপত্তি জানালেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা শেষমেষ সামলে নিল সৌমিক। মিষ্টিমুখ দিয়ে সমাপ্তিতে পৌঁছল আলোচনা পর্ব।





গাড়িতে যেতে যেতে এবং অফিসে এসে একপ্রস্থ গোটা বিষয়টা সৌমিক ভ্যাবলাকে ব্যাখ্যা করে দিল নিখুঁতভাবে। পরদিন থেকেই অস্ত্র আর বোতল হাতে শিল্পী লেগে পড়ল কাজে। নির্ধারিত দিনের আগেই শেষ করল কাজ। মাঝে সৌমিকও গিয়ে ঢুঁ মেরে এসেছে কয়েকবার। ভ্যাবলার কাজে স্তম্ভিত মুক্তিদূতের কর্তারাও। মণ্ডপ পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসা ইঞ্জিনিয়ার থেকে ইলেকট্রিশিয়ান --- সকলেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিল ভ্যাবলা পাগলের নৈপুণ্যকে। কিন্তু শিল্পী বরাবরের মতোই নির্বিকার। বোতল হাতে বিস্ফারিত চোখে শুনে চলে সব। তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে পঞ্চমীর রাতে হঠাৎই উধাও হয়ে যায় সৌমিকের অফিসের একতলার লেবার রুম থেকে।  পড়ে থাকে বিছানা , ব্যাগ আর পারিশ্রমিকের টাকা। দেয়ালে মদের বোতল দিয়ে লিখে দিয়ে যায় --- " পার্ক সার্কাসের বস্তিতে শালা ছড়িয়ে দিস এই টাকা। মৃত্যু নিয়ে খেলছে চুদির পোলা। "





ইতিমধ্যেই মুক্তিদূতের মণ্ডপে এসে হাজির হয়েছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। দর্শক হাঙ্গামায় ভেঙে গুড়িয়ে গেছে সব। গ্রেফতার মুক্তিদূতের তিন বড়ো কর্তা এবং সৌমিক সিনহা। গভীর অন্ধকারে কুলতলির এক নদীর তীরে মদের বোতল হাতে পড়ে ভ্যাবলা। বাড়ি তার ভেসে গেছে বছর বারো আগের আয়লায়। তারপর থেকে ভাড়া থাকা এর ওর কুঁড়েঘরে। গতবছর ফনী এসে খেল বউটাকে। চাষের জমি গেল আমফানের পেটে আর ছেলেটা রেলে কাটা পড়ল লকডাউনে মহারাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে। হতাশ ভ্যাবলা ঠিক করে আর কোনোদিন পা রাখবে না কলকাতায়। করবে না আর থিমের কাজ। যে মায়ের পুজোর আয়োজনে আন্তরিকভাবে  প্রাণপাত করে চলেছে সুদীর্ঘ দশ বছর ধরে , সেই মা-ই তো ওকে সুখ দিল না কোনোদিন। বরং ধাপে ধাপে এক এক করে কেড়ে নিল সব। প্রখর রোদে সারাটা দিন সাইকেল চালিয়ে সৌমিকবাবুকে কাজ ছাড়ার কথা জানাতে যেতেই আবারও হাতে এল নতুন কাজের প্রস্তাব। থিমের প্ল্যানটা শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় ওর  --- " হাঁটল ওরা হাজার মাইল , ফিরবে বাড়ি বলে / ক্লান্ত হয়ে লাইনে শুল , কাটল গলা রেলে। " কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় কোনোক্রমে। মণ্ডপ নির্মাণে রেখে দেয় মোক্ষম কিছু খুঁত যা সাধারণের চোখে পড়া রীতিমতো অসম্ভব। অষ্টমীর রাতে ভোল্টেজ বাড়তেই ফেল করে সার্কিট। চাপ পড়তেই ভেঙে পড়ে থিমের রেললাইন। সবই আদতে ভ্যাবলার নিখুঁত কৌশলের ফল। এভাবেই নিঃস্ব এক জাতশিল্পী নিজের মতো করে প্রতিবাদ করে এলিট সমাজের বর্বরোচিত মানসিকতার। গরিবের মৃত্যুকে হাতিয়ার করে কর্পোরেটের পুরস্কার জয়ের পরিকল্পনায় বিছিয়ে দিয়ে যায় মানবিক কাঁটা।





ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটে। পুলিশ সিল করে দিয়েছে মুক্তিদূতের মণ্ডপ। নদীর তীরে খালি গায়ে পড়ে রয়েছে ভ্যাবলা। স্বপ্নে সে দেখছে হাজার তারার ঝলকানি। পথে মৃত লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক প্রাণ খুলে হাসছে যে…. 

Thursday, June 23, 2022

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -7


 


সাত

টেলিফোন ভবনে ঢোকার মুখেই পর পর তিন-চারটে কয়েন-বুথ। এক টাকার কয়েন ফেলে ঋজু টপাটপ বোতাম টিপল কণিকার মোবাইলে— আমি এসে গেছি।
— কে বলছেন?
থমকে গেল ঋজু। এত দিন কথা বলার পরেও ওর গলার স্বরটা কণিকা চেনে না! — আমি।
— ও।
— কখন নামবে?
— আমি বেরিয়ে পড়েছি।
আর এক বার ধাক্কা খেল ঋজু। কয়েক দিন আগে পর্যন্ত ও প্রায় রোজই ঠিক এই সময়ে আসত। এসে, ফোন করলে কণিকা নামত। কোনও কোনও দিন পাঁচ-দশ মিনিট, আবার কখনও সখনও আধ ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হত ওকে। কিন্তু কণিকা তো কোনও দিন পাঁচটার আগে বেরোয় না! তা হলে কি পাঁচটা বেজে গেছে! ও কোনও দিন ঘড়ি পরে না। সামনে দিয়ে একটা লোক যাচ্ছিল। ও তাকে জিজ্ঞেস করল, ক’টা বাজে? লোকটা বলল, পাঁচটা পঁচিশ।
মাত্র দু’দিন আসেনি সে। তাতেই এই! একটু অপেক্ষা করতে পারল না!

মুক্তাঙ্গনের ওই অনুষ্ঠানে ঋজুর অনেক বন্ধুবান্ধব এসেছিল। যাদের সঙ্গে ওর নিয়মিত যোগাযোগ আছে, তারা যেমন এসেছিল, এসেছিল তারাও, যাদের সঙ্গে ওর দেখা হয় ছ’মাসে ন’মাসে এক-আধ বার। এসেছিল বারুইপুরের হাননানও। তার সঙ্গে এসেছিল বীরেন্দ্র পুরকাইত নামে একজন। উনিও বারুইপুরে থাকেন। বারুইপুরের লোক শুনেই, অত ব্যস্ততার মধ্যেও ঋজু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বারুইপুরের কোথায় থাকেন?
উনি বলেছিলেন, সুবুদ্ধিপুরে।
— সুবুদ্ধিপুরে? আমি তো আগে ওখানে পড়াতে যেতাম।
— অত দূরে?
— না না, ওখানে আমাদের একটা বাড়ি আছে।
— কোথায়?
— সালেপুরে।
— তাই নাকি? আগে ওখানে থাকতেন?
— না না। আসলে, সানন্দায় আমি একটা গল্প লিখেছিলাম। সেটা নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিল। সে সময় মা বললেন, যতই পুলিশ প্রোটেকশন দিক, রাজনীতির লোকেরা তো ভাল হয় না। অত রাত করে ফিরিস। কে কখন পেছন থেকে কী করে দেবে, কী দরকার? জায়গা যখন আছে, ক’টা দিন বারুইপুরে গিয়ে থাক না... তখন তিন-চার মাস ছিলাম। সকালে উঠে কী করব! সময় কাটত না। সেই সময় ওই টিউশুনিটা করতাম।
— কাকে পড়াতেন?
— তার নাম কি আর মনে আছে? ছেলেটার বাবা পুলিশে কাজ করত। ওরা তিন ভাই। ওদের বাড়িতে তিন-চারটে বকফুল গাছ ছিল।
— ও, বুঝে গেছি, বুঝে গেছি। শীতলদের বাড়ি। আমার পাশেই থাকে।
— তাই নাকি? ওরা ভাল আছে?
— হ্যাঁ হ্যাঁ, শীতলের বড় ছেলে, যার নাম লালু, সে তো এখন এল আই সি করে। মেজোটা বোধহয় উচ্চ মাধ্যমিক দেবে... কি দিয়েছে। আর ছোটটা মনে হয় এইট না নাইনে পড়ে।
— বাবা, এত বড় হয়ে গেছে? কত দিন ওদের দেখিনি!
— একদিন আসুন না গরিবের বাড়ি। ওদের সঙ্গেও দেখা করে যাবেন।

না। বীরেনবাবুর আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য নয়, তার ক’দিন পরেই ঋজু তাঁর বাড়ি গিয়েছিল, শুধুমাত্র ওই সুযোগে তার এক সময়ের ছাত্র লালুদের বাড়িতে ঢু মারার লোভে।
লোভই তো। ছাত্রের মা, যাঁকে ও বউদি বলে ডাকত, তিনি তখন বেশ ডাগরডোগর। কেউ বলবে না, উনি তিন-তিনটে বাচ্চার মা। গায়ের রং একটু মাজা ঠিকই, কিন্তু মুখখানা খুব ঢলোঢলো। প্রথম দর্শনেই ওই মুখের মোহে পড়ে গিয়েছিল ও।
তাই, উনি যখন বলেছিলেন, আমার তিনটে ছেলেকেই পড়াবেন। বড়টা থ্রি-তে পড়ে। মেজোটা টুয়ে। আর ছোটটা তো এখনও স্কুলেই ভর্তি হয়নি। সামনের বছর হবে। ওদের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওকেও একটু অ আ ক খ, এ বি সি ডি, এক দুই শিখিয়ে দেবেন, ব্যাস। কত দিতে হবে?
ও তখন বলেছিল, আপনার যা মনে হয়, দেবেন। আপনি যদি এক টাকাও দেন, আমি পড়াব।
উনি কী বুঝেছিলেন, কে জানে! হয়তো ভেবেছিলেন, দৈনিক এক টাকা হিসেবে পেলেও তাঁর ছেলেদের ঋজু পড়াবে। তাই পরের মাসে মাস্টারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ঝকঝকে তিনটে দশ টাকার নোট।
পড়ানোটা ছিল অজুহাত, আসলে সকালবেলায় ও ওই বাড়ি যেত শুধু বউদির মুখখানা দেখার জন্য। রবিবারও বাদ দিত না। সকাল সাতটার মধ্যে ঢুকে পড়ত। যতক্ষণ না ওদের মা, স্কুলে যাবার জন্য ওদের তাড়া লাগাতেন, ও পড়িয়ে যেত।
ছাত্রের বাবা শীতলবাবু কাজ করতেন পুলিশে। এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর টানা ছ’দিন করে তাঁর নাইট ডিউটি পড়ত। অতটুকু-টুকু বাচ্চাদের নিয়ে বউ একা থাকবে! তাই, পাশের বাড়ির একটা ছেলেকে তাঁর বাড়িতে রাতে থাকার জন্য বলেছিলেন উনি। ছেলেটা থাকত।
একদিন বোধহয় একটু বেশি সকালেই চলে গিয়েছিল ঋজু। গিয়ে দেখে, দরজা দেওয়া। ঠক্ ঠক্ করতেই খুলে গিয়েছিল সেটা। ভিতরে ঢুকে দেখে, বারান্দার চকিতে, যেখানে ও বাচ্চাদের নিয়ে পড়াতে বসে, সেখানে শুয়ে আছে ওই ছেলেটা। আর তার পাশে বউদি। ও তড়িঘড়ি ভিতর-ঘরে চলে গিয়েছিল। সে ঘরে মশারির ভিতরে তখন তিন-তিনটে বাচ্চাই ঘুমে কাদা।
হাত কামড়েছিল ঋজু। আহা! শীতলবাবু যদি তাকে রাতে থাকার জন্য বলতেন! কিন্তু না। কোনও দিনই তার ভাগ্যে শিকে ছেড়েনি। তাই বউদি স্নান সেরে ভিতর-ঘরে ঢুকলেই, ওই ঘর আর বারান্দার মাঝখানে যে জানালাটা ছিল, তার নীচে ছিল বেশ খানিকটা ফাঁকা। ও সেখান দিয়ে বউদির শাড়ি ছাড়া দেখত। ব্লাউজের বোতাম আটকানো দেখত। এবং বেশির ভাগ দিনই দেখত, উনি বোতাম লাগাতে গিয়ে বারবারই ভুল করছেন। উপরের হুকটা নীচের ঘরে। নীচের হুকটা উপরের ঘরে। তাই বারবার খুলছেন আর আটকাচ্ছেন।

চেতলায় ফিরে আসার পর কার কাছে যেন ঋজু শুনেছিল, ওই ছেলেটার সঙ্গে বউদির অবৈধ সম্পর্কের কথাটা নাকি জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। তাই ওই ছেলেটার বাড়ির লোকেরা রাতারাতি একটা মেয়েকে ধরে তার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। সেই কবেকার কথা! তার মানে বউদি এখন ফাঁকা!
বীরেনবাবুর বাড়িতে এক কাপ চা খেয়েই সেই বউদির বাড়িতে ছুটেছিল ও। বাড়িতে তখন কোনও ছেলে ছিল না। এত দিন বাদে ওকে দেখে চমকে গিয়েছিলেন বউদি। আসুন আসুন বলে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভিতরে ঢুকে ঋজু অবাক। ঘরদোর সব পাল্টে গেছে। অনেক জিনিসপত্র হয়েছে। কথায় কথায় ও জেনেছিল, লালু এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে। এল আই সি করে। শেয়ার কেনাবেচা করে। বাড়ির দালালিও করে। এই জমির পাশেই একটা প্লট কিনেছে। লোন নিয়ে বাড়ি করছে। ঋজু বলেছিল, আপনি কিন্তু আগের মতোই আছেন।
উনি বলেছিলেন, তাই নাকি?


তখন বইপ্রকাশ করার জন্য তরুণ কবি-লেখকদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর্থিক অনুদান দিত। সে বার ঋজু পেয়েছিল। পুরো দু’হাজার টাকা। অষ্টআশি সালের দু’হাজার টাকা মানে প্রচুর টাকা। চার ফর্মার একটা বই করতে কি অত টাকা লাগে! হাতে টাকা ছিল। টাকা থাকলে বেড়ালের বাচ্চাও কেনা যায়। তাই ঋজু যখন শুনল, তার ছাত্ররা খুব কাছ থেকে কোনও দিন প্লেন দেখেনি, তখন লালুকে ও বলেছিল, তোমাকে একদিন দমদম এয়ারপোর্টে নিয়ে যাব। ওখানে মুহুর্মুহু প্লেন নামে আর ওঠে। একদম সামনে থেকে দেখতে পারবে।
শীতলবাবু সে কথা শুনে বলেছিলেন, তা হলে ওদের মাকেও নিয়ে যান না... ও-ও তো সামনাসামনি কখনও প্লেন দেখেনি। দেখে আসতে পারবে। আমি ভাড়া দিয়ে দেবো।
ঋজু বলেছিল, আমার কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু ওদের মা যদি যায়, তা হলে ওর ওই দুই ভাই কার কাছে থাকবে? শীতলবাবু বলেছিলেন, কেন? আমার কাছে। আমার তো নাইট ডিউটি। আটটার আগে তো বেরোব না। তার আগেই তো আপনারা চলে আসবেন, না কি?
মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দাদা যাচ্ছে শুনে, মেজো আর ছোটটাও যাবার জন্য বায়না ধরেছিল। শীতলবাবু বলেছিলেন, এখন কিছু বুঝবি? বড় হ। পরে যাবি।

ট্রেনে করে শিয়ালদায় নেমে ফর্টি ফাইভ বাস ধরে সোজা দমদম বিমান বন্দরে গিয়েছিল ওরা। দশ টাকা করে টিকিট কেটে ভিতরে। সব জায়গা ঘুরে দেখেছিল। উপরে উঠে অনেকক্ষণ ছিল। সেখানে আরও লোক। কেউ সি অফ করতে এসেছে। কেউ নিতে। ওদের মতো শুধু প্লেন দেখার জন্য বোধহয় কেউই যায়নি। যাদের ছাড়তে এসেছে, তারা দেখতে পাচ্ছে কি পাচ্ছে না কে জানে, এরা হাত নেড়ে যাচ্ছে। প্লেন উড়ে গেছে আকাশে। তখনও হাত নাড়ছে কেউ কেউ। যেন ওরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে এ দিকে।
ঋজু একদম সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল লালুকে। কয়েক জনের পেছনে ও। ওর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বউদি। হঠাৎ ও বলে উঠল, ওই যে, ওই যে দেখুন, ওই প্লেনটা, ওটা এখন ল্যান্ড করবে। দেখুন কী ভাবে নামছে... দূরে ছোট্ট চিলের মতো উড়তে থাকা প্লেনটাকে আঙুল দিয়ে দেখাতে গিয়ে একটু ঝুঁকে পড়েছিল ঋজু। ইচ্ছে করেই বউদির শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর একেবারে লেপটে দিয়েছিল।
প্লেনটা যখন ল্যান্ড করে গেছে। এয়ার বাস লাগানো হয়ে গেছে। যাত্রীরা একে একে নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। তখনও ও ওই একই ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল।
পেছন ফিরে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল বউদি। হাসিটা দেখেই ও বুঝেছিল, বউদি টের পেয়েছে।
তাই সে দিন রাস্তা পার হওয়ার সময় এক হাতে লালু আর অন্য হাতে বউদির হাত ধরেছিল অনায়াসে। রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়ার শেষে, হাত ধোয়ার পরে বউদির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল নিজের রুমাল। কথা বলতে বলতে এক ফাঁকে ও বলে দিয়েছিল, আপনার হাসিটা কিন্তু মারাত্মক। যে কোনও পুরুষকে ঘায়েল করার পক্ষে যথেষ্ট।
— তাই বুঝি?
— কেন, আপনি বুঝতে পারেন না?
— না। বলেই, হেসে ফেলেছিলেন তিনি। সেই হাসির মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে ছিল।
তার পরেও অনেক কথা হয়েছিল ওদের। কখনও সখনও আকার-ইঙ্গিতেও। যাতে লালু বুঝতে না পারে।
অথচ ফেরার সময় যখন শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠতে যাবে, বউদি বললেন, এটায় না, এটায় না। এর পরের, পরেরটায় উঠব।
— কেন? এটা তো ফাঁকা আছে।
— না, ফাঁকার জন্য না। ও আসবে বলেছে।
— কে?
— ওই যে, আমাদের পাশে থাকে না... তুমি দেখেছ তো। ওই যে গো, যে আমাদের বাড়িতে রাতে শুতে আসে, সেই ছেলেটা।
কথাটা শুনে ওর সারা শরীর কেমন যেন শীতল হয়ে গেল।

সেই বউদি এখনও একই রকম। এতটুকু বদলাননি! ঋজু তাকিয়ে আছে।
— কী দেখছ?
— কই, কিছু না তো।
— কিছু না বললে হবে? আগে তো জানালার তলা দিয়ে খুব দেখতে। মনে আছে?
ও ঝট করে বউদির মুখের দিকে তাকাল। দেখল, বউদি ঠোঁট কামড়ে হাসছেন।
সন্ধ্যা নেমে গেছে। তবু ফেরার সময় ছেলে যে বাড়িটা করছে, সেটা দেখানোর জন্য ওকে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলেন বউদি। দু’তলা অবধি হয়েছে। তিন তলার কাজ চলছে। দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই মিস্ত্রিরা গেছে। তিন তলা দেখাতে দেখাতে একটা দেয়ালের আড়ালে যেতেই ও ঝপ করে বউদিকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। বউদি বললেন, ভারী দুষ্টু হয়েছ তো। কেউ দেখে ফেললে?
— কেউ দেখবে না।
— না, কিচ্ছু বলা যায় না।
— চলুন, আমরা বরং ওই সিঁড়িতে গিয়ে বসি।
— ভীষণ ময়লা।
— তাতে কী হয়েছে? রুমাল আছে তো।
সিঁড়ির একটা ধাপে পাশাপাশি বসল ওরা। এখানে কারও চোখ পৌঁছবে না। বউদিকে ও জাপটে ধরল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বউদির শরীরের নানান জায়গায় হাত চলে যেতে লাগল ওর।

ট্রেনে আসতে আসতে ওর মনে হয়েছিল, ধ্যাৎ, কণিকা কিছুই না। তার থেকে এ অনেক ভাল। সপ্তাহে অন্তত এক বার করে যদি আসা যায়! সপ্তাহ মানে তো সাত দিন। বাকি ছ’দিন কী হবে! এত দূরে এসে পোষাবে না। তা ছাড়া এঁর তিন-তিনটে ছেলেই এখন বড় হয়ে গেছে। তারা যদি টের পায়! কণিকার মেয়েদের মতো অতটা লিবারেল তো এরা নাও হতে পারে! তখন? তার চেয়ে অফিসে ঢোকার আগে এক ফাঁকে কণিকা, মন্দ কী! কিন্তু সেই কণিকা যে তার জন্য অপেক্ষা না করে অফিস থেকে বেরিয়ে যাবে, তার গলার স্বর চিনতেই পারবে না, ঋজু ভাবতে পারেনি।
রাতে যখন বাড়িতে ফোন করল, ছোট বাবি বলল, মা খাবার গরম করছে। পরে আবার যখন করল, শুনতে পেল, মা আলমারি গোছাচ্ছে। অনেক রাতে ফের যখন করল, কণিকাই ধরল— হ্যাঁ, কী হয়েছে? বারবার ফোন করছ কেন?
— এ ভাবে কথা বলছ!
— তা হলে কী ভাবে বলব? ক’টা বাজে এখন? কেউ কোনও ভদ্রলোকের বাড়িতে কি এত রাতে ফোন করে?
— আমি আগে কয়েক বার করেছিলাম। তুমি তখন ব্যস্ত ছিলে, তাই...
— তাই কী? রাত সাড়ে এগারোটায় ফোন করতে হবে?
— তুমিই তো বলেছিলে...
— না। একদম করবে না। বলেই, লাইনটা কেটে দিল কণিকা।
পর মুহূর্তেই ফোন করল ঋজু। দেখল এনগেজড। তার পর আবার। দশ মিনিট পর আবার। এক ঘণ্টা পরেও দেখল, সেই একই। এনগেজড। এনগেজড। এনগেজড। মোবাইলে যে কথা বলবে, তারও উপায় নেই। ওটা অফ।


                                      ক্রমশ...
_____________________________________________

ষষ্ঠ পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন -


অষ্টম পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন -

Tuesday, June 21, 2022

ছোট গল্প - বোধনের রোদ্দুর || লেখক - রঞ্জিত মল্লিক || Short story - Bodhoner Roddur || Written by Ranjit Mallick


 


বোধনের রোদ্দুর

রঞ্জিত মল্লিক





                          "........শঙ্খ শঙ্খ মঙ্গল গানে
                ..........জননী এসেছে দ্বারে......."

              পুজো আসতে আর বেশী দেরী নেই। শরৎ প্রকৃতির নয়নাভিরাম রঙীন জ্যামিতি প্রতিনিয়ত ইঙ্গিত দিচ্ছে মা দশভূজার মর্ত্যে আসার আগমন। ঢাকের মাতাল করা মোলায়েম মল্লারে ভেসে আসছে আগমনীর সুর।

             তাঁর টুকরো টুকরো অণু, পরমাণু  চোখে মুখে ছড়াতেই উৎসবের আনন্দে বুকের "ভিসুভিয়াস"টা দপদপ করে উঠছে সকলের। শিরায় শিরায় ফুটন্ত হিমোগ্লোবিনে আবেগের আঁচ ধরা পড়ছে।

             শতুর পাড়ার পুজো এবারে পঞ্চাশে পড়ল। পাড়ার সকলের ব্যস্ততা বেশ তুঙ্গে। প্রতিদিনই চলছে শলা পরামর্শ। পুজোকে সার্বিকভাবে সফল করে তুলতে সকলেই দল দলে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। আট থেকে  আশি সকলের চোখে মুখে খুশীর ঝলসানো সোনামুগ রোদ্দুরটা হামাগুড়ি  দিচ্ছে।

             পঞ্চমীর সকাল থেকেই শুরু হল নিন্মচাপের দাপুটে ব্যাটিং। সকলের  মনখারাপ,  দুর্ভোগের শেষ নেই। অনেকের চিন্তা পঞ্চাশ বছরের পূর্তির আনন্দটাই না মাটি হয়ে যায়।

                 শতু সারাদিন ঘরের মধ্যেই ছিল গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে। বৃষ্টির চোখ রাঙানি বাড়তেই একটু বিছানায় গাটা এলিয়ে দিল। মা ঘরে ঢুকতেই বলে  উঠল," কি রে, অবেলায় ঘুমোচ্ছিস?শরীর খারাপ?"
             "আসলে কদিন ধরেই মনটা ভাল নেই।"
              "একটু বাইরে ঘুরে আয়, দেখবি মনটা ঠিক চাঙ্গা হয়ে গেছে।"
             "মা, তুমি আবার জ্ঞান দিতে শুরু করলে। তুমি না...."

               মা আর কথা না বাড়িয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। 

              পুজো আসলেই শতুর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।  চারটে দিন নিজেকে  গৃহবন্দি রাখে। কারণ ও উৎসবের গন্ধ গায়ে মাখতে চায়না। পুরানো অতীত ওকে নাড়িয়ে দেয়। 

                       

                 সপ্তমীর দুপুরে  বাচ্চাটার চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল। নিম্নচাপ তখনও চলছে। যদিও প্রকোপ কমেছে। কুকুরের বাচ্চাটা অতিবৃষ্টিতে  ড্রেনের গভীর  জলে পড়ে সাঁতার কাটছে। আর বাঁচার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওর  মা  গতকালই মারা গেছে। ভারী গাড়ির নীচে চাপা পড়ে। 

                 শতু ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে ঐ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে ওকে ঘরে নিয়ে আসে। ওর শরীরের সমস্ত নোংরা ময়লা পরিষ্কার করে ওকে কিছু খেতে দেয়। খাবার পেয়ে বাচ্চাটার মেজাজ ফুরফরে হয়ে ওঠে। 

              বুকের উষ্ণতায় দুবার গলা ছেডে ডেকেও ওঠে। ডাক শুনে মিতাদেবী পাশের ঘর থেকে এসেই মেয়েকে কড়া ধমক," তোর কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান আছে, এমন শুভ দিনে এই কুকুরটাকে কেউ ঘরে তোলে? ওর শরীরে কি রোগ আছে কে জানে?"
           "মা, তুমি এবার থামবে? অনেক্ষণ ধরে যা নয় তাই বলে যাচ্ছ।"
          "আমি কিছু বললেই দোষ, তাই না?"
           "মা, প্লিজ! একটু চুপ কর।"
           "আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত তাহলে কিছুতেই....."

             কথা শেষ হবার আগেই শতু মায়ের মুখের দিকে তাকায়,"মা, তুমি আজ একথা বলছ? তোমার ডেসানকে মনে পড়ে না? সেই ছোট্ট আদুরে ডেসান?"

               ডেসানের কথা উঠতেই মিতাদেবী কোথায় যেন তলিয়য়ে যান। বুকের ভিতরটা চিন চিন করে ওঠে ব্যথায়। বাচ্চাটার  দিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ ভেজা চোখটা নতুন শাড়ির আঁচলে মোছেন।

                সন্ধ্যের পর থেকেই বৃষ্টির বন্দিশ কমতে থাকে।  আকাশ তবুও মেঘলা। মিতাদেবী রাতে রান্নাঘরে এসে দেখেন কুকুরের বাচ্চাটা গোটা রান্নাঘরটা নোংরা করে  রেখেছে। মেজাজ গেছে সপ্তমে। তবে সেটা সাময়িক। একটু পরেই ফুটন্ত মেজাজ নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ভিজে শীতল হতে শুরু করেছে। 

                 ..........  ......... ........  ..........

             " ........  জাগো দুর্গা.......
               .........  .........  তুমি জাগো......."

              আজ মহাষ্টমী। সকালে  ঢাকের  শব্দে ঘুম ভাঙে  শতুর। দেখে কুকুরের বাচ্চাটা ঘরে, বারান্দাতে ছোট একটা বল নিয়ে খেলছে।  নতুন জায়গাতে এসে আদর যত্ন পেয়ে  ওর মুখে খুশী ঝলসে  উঠছে। 

             অষ্টমীর অঞ্জলি শেষ হলে মিতাদেবী পুজোর পুষ্প শতু, কুকুরের বাচ্চাটার মাথায় একটু ঠেকিয়ে ওদের জন্যে মঙ্গল কামনা করেন। তারপর শতুর পড়ার ঘরে ঢুকে দেওয়ালে ডেসানের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন। 

                বাসি ফুলের মালাতে, ধুলোর চাদরে  ডেসান ফটোফ্রেমে  সদ্য ফোটা শিউলির মতন হাসছে। শতু ঘরে ঢুকেই ধুলো ঝেড়ে  ওর ছবিতে নতুন মালাটা চড়িয়ে দিল। আজ ডেসানের মৃত্যুবার্ষিকী। পুজোর আনন্দে সবাই ভুলে গেলেও মিতাদেবীর  মেয়ে   ঠিক মনে রেখেছে। 

              রান্নাঘর থেকে ডেসানের পছন্দের পদের গন্ধ ভেসে আসছে। আজ পুজোর দিন, মিতাদেবী ডেসানের কথা ভেবে হালকা কিছু বানিয়েছেন। যদিও প্রতি বছর ওর মৃত্যুদিনে ওর পছন্দের কিছু না কিছু বানানো হয়।

                ঝুপ করে সন্ধ্যে নামতেই চন্দননগরের আলোতে গোটা পাড়া ডুবে গেল। একটু পরেই সন্ধিপুজো বসবে। পাড়ার কচি কাঁচারা মণ্ডপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের হাতে ক্যাপ ফাটানো পিস্তল। ক্যাপের ফট্ ফট্ শব্দে চারিদিক মুখরিত। 

               "বাজলো তোমার.....
                ............ আলোর বেণু........"

             ১০৮টা প্রদীপ জ্বলে উঠতেই শতাব্দী পুচকেটাকে কোলে করে মণ্ডপে আসল। ওকে দেখেই সবাই স্তম্ভিত।  আজ বহু বছর পরে ও মা অপর্ণার মুখ দেখল। এমনিতেই ও পুজোর দিনে নিজেকে.....

              প্রদীপের আলোতে ঝলমল করছে পুচকে "ডেনে"র  এর মুখ। "ডেন" নামটা শতাব্দীর দেওয়া। "ডেসান" এর ক্ষুদ্র সংস্করণ। "ডেসান" এর নাম, শরীরের  ভিতরেই "ডেন" এর গন্ধ লুকিয়ে আছে।

               মিতাদেবী পুজো দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।

                              *************

               শতুর বাবা তখন বদলির চাকরি নিয়ে চলে গেলেন বোলপুরে। শতু হোস্টেলে পড়াশোনা করছে। একমাত্র ছেলে অনুষ্টুপও বৌমাকে নিয়ে চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালুরুতে আছে। প্রাইভেট কোম্পানী।  ছুটি কম।  মিতাদেবী একা থাকেন। অত বড় বাড়িতে ভয় করে। 

               শতাব্দী তখন বন্ধুর কাছে খোঁজ পেয়ে ছোট্ট ডেসানকে বাড়িতে আনল। মাকে একটু সঙ্গ দেবে বলে। এর  তিন মাস পরেই অনিকেতবাবু স্ট্রোকে মারা যান। শোকের ছায়া ঘিরে ধরল গোটা পরিবারকে। 

                বাবা মারা গেলে বাবার সরকারী  চাকরিটা অনুষ্টুপ পেল। স্বার্থপরের মতন ফ্ল্যাট নিয়ে কলকাতাতে চলে এল। মিতাদেবীর একাকীত্বের জীবনে তখন থেকেই ডেসানের রোল প্লে শুরু। 

               টানা চার বছর  বিপদে আপদে আগলে রেখেছে উনাকে। ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল হল এই চারপেয়ে, অবলা,প্রভুভক্ত ডেসান। মিতাদেবীর পর শতু দিদিমণিই ওকে বেশী আদর করত, ভালবাসত।  

              বহুবার চুরির হাত থেকে মিতাদেবীকে বাঁচিয়েছে। উনার শরীর খারাপ হলেই ছুটে গিয়ে চিৎকার করে পাশের বাড়ি থেকে কখনো সবিতা আন্টি, কখনো জয়া বৌদিকে ডেকে এনেছে। 

               মিতাদেবীর এখনও বেশ  মনে আছে সেইদিনটাও ছিল অষ্টমীর সকাল। সবে পুজো বসেছে। মিতাদেবী অঞ্জলির জন্যে তৈরী হচ্ছেন। বাড়িতে একা। সবাই বেরিয়েছে।  হঠাৎ শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে উনি চোট পান। পরিস্থিতি বুঝে ডেসান  ছুটে গিয়ে সবিতা আন্টিকে ডাকতে যায়।
            
            সেই শেষবারের মত বাড়ি থেকে ওর বেরোনো।  আর ফেরেনি।  আসার পথে রাস্তা পেরোতে গিয়ে ফোর হুইলারের চাকায় পিষ্ট হয় ওর নিষ্পাপ শরীর। শতাব্দী যখন ফিরল তখন দেখে,  ডেসানের রক্তমাখা থেঁতলানো শরীর রাস্তার এক কোণে পড়ে রয়েছে। মৃত শরীরের উপর মাছি ভন ভন করছে। পথ চলতি মানুষ কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে দেখে  পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। 

                

               বহু বছর পার হয়েছে। ডেসান চলে গেছে না ফেরার দেশে। তবে পুজো আসলেই ওর টাটকা  স্মৃতি ঝলসে ওঠে। আজ বহু দিন পরে ওর মৃত্যুবার্ষিকী আর অষ্টমী একই দিনে পড়েছে। কোইন্সিডেন্স!

              সন্ধিপুজো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। শতাব্দীর আলতো ছোঁয়ায় মিতাদেবীর সম্বিৎ ফিরল।

"মা, আমি ডেনকে নিয়ে একটু উনিশ পল্লী আর বিদ্রোহী ক্লাবের ঠাকুরটা দেখে আসছি। সময় পেলে শক্তি নগর, পাঠক পাড়া, সীমান্ত পল্লীর ঠাকুরগুলো দেখে নেব। ফিরতে একটু দেরী হলেও হতে পারে। তুমি চিন্তা করো না।"
                "সাবধানে যাস মা, দেখিস যেন কোন বিপদ....."

             কথা শেষ হয়না। মিতাদেবী দেখেন শতাব্দীর কোলে পুচকে ডেন যেন ডেসানেরই হারিয়ে যাওয়া অতীত। 

              নিম্নচাপ কেটে গিয়ে তারায় ঝলমল করছে অষ্টমীর সন্ধ্যে। ডেনকে পেয়ে শতাব্দীর মনের উঠোনে আজ বোধনের রোদ্দুর। মিতাদেবীর চোখ থেকে নামছে পবিত্র আশ্বিনের শিশিরের নোনা চন্দন। ঠিক নিম্নচাপের মতই। তার ছিঁটে ফোঁটা মনে হল যেন ডেনের নরম, স্নিগ্ধ পশমেও পড়ল। 

             মিতাদেবী সকলের মঙ্গল কামনায় মা উমার কাছে প্রার্থনা করলেন। মায়ের মুখে কোজাগরী চাঁদের হাসি উথলে উঠছে।

            চারিদিকে আলোর বন্যায় মেখে আধুনিক গান আর মাঝে মাঝে বাজির শব্দ ভেসে আসছে। বৃষ্টি থেমে গিয়ে একটু গরমও ধরেছে। মিতাদেবী বেশ কিছুক্ষণ পরে গুটি গুটি পায়ে চ‍ৌরাস্তার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ একটা চেনা কণ্ঠস্বরে পায়ের গতি শ্লথ করলেন।

                "মিতু, অ্যাই মিতু! চিনতে পারছিস?"
                 "কে? ও মা! নন্দা! কবে এসেছিস? কতদিন পরে......"
                 "নে ধর, আইসক্রিম। যা গরম!"
       
             দুই বন্ধুর হাসি, আড্ডাতে বোধনের রোদ্দুরে যখন জোয়ারের ভরা কোটাল, তখন শতাব্দী ডেনকে নিয়ে একটার পর একটা মণ্ডপ পেরিয়ে শক্তিনগরের দিকে পা বাড়াল। 

              "দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী........
              ......... মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে......."

Monday, June 20, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -7


 


তিন 




ক্রমান্বয়ে বছরের পর বছর কেটে গেলো। কিভাবে যে কাটলো তা আমি ও বাবা ছাড়া কেউ অনুভব করেনি। দাদার ডাক্তারী পড়া প্রায় শেষ হতে চলেছে। জমি জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। উপরন্তু হেট মাস্টার মশায় সুরজিৎ বাবু কিছু টাকা ধার দিয়েছেন। এখন আর টাকার দরকার হবে না। এবার একবছর Compulsary Internship করার পর বাড়ী আসবে। কলেজে থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে ওতে নিজের খরচা সুন্দরভাবে চালিয়ে নিতে পারবে।






 দাদার পত্র পেয়ে আমরা উভয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বড় চিন্তায় ছিলাম এ কারণে বাবা কপর্দক হীন ছিলেন। সুখ যে কি জিনিস তখন ভুলে ছিলাম অতীত তো অনেক আগেই ভুলে গেছি। তাই দুঃখকে আকড়ে ধরে দিন যাচ্ছিল আমাদের দারিদ্রের অমানিশা কেটে সুখের স্বর্ণালি প্রভাতের প্রতীক্ষায় ছিলাম। অনেক সময় ভাবতাম, সেই সুখের তরীতে নিশ্চয় চড়তে পারবো। 






কিন্তু বাবার ও আমার আশা কি পূর্ণ হয়েছিলো? সত্যি বলছি, আমি এক ভোরের স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে দেখছিলাম, আমার দাদা ডাক্তারী পাশ করে গ্রামে এসে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় একটা ছোট ডিসপেনসারি করেছে। মহামান্য গণপতি চ্যাটার্জী নানা সুগন্ধি ফুলে সাজানো ডিসপেনসারিকে উদ্বোধন করলেন। এই শুভ দিনে মাননীয় রামকমলবাবু ছেলের গৌরবজ্জ্বল জীবনের কথা স্মরণ করে বাবাকে মাল্য ভূষিত করলেন। তিনিই প্রথম ঠাকুরদার কাছে ডাক্তারী পড়াবার প্রস্তাব করেছিলেন।






 রামকমলবাবুর ভাষায় তাঁর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দিনটি গৌরবের ছটায় দীপ্ত হয়ে ফিরে এলো। দারিদ্র্যের দুঃসহ যাতনা অভাব অনটনের দারুন মর্মপীড়া সহ্য করেও বাবা যে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন এজন্য গ্রামের জনগণ বাবাকে অভিনন্দিত করলেন। সকলের মুখে বাবার গুনগান শুরু হলো। শুরু হলো বাবার জয়ধ্বনি। বাবার জয়ধ্বনি শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো ও দেখলাম কোথাও কিছু নেই। শূন্য গৃহে বাবা তখনও ছিন্ন কম্বল জড়িয়ে ঘুমে অচেতন।








ধীরে ধীরে কলসীর কাছে গিয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে পুনরায় আমার জীর্ণ বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। পরদিন ঐ মধুর স্বপ্নের পরিবর্তে আমাদের জীবন নাট্যের গভীর শোকের দুঃসহ দুঃখের কালো যবনিকা নেমে এলো। যে বার্তায় চোখের জলে সাগর হয়, যে বার্তায় মানুষের মনে এনে দেয় দিগন্ত ব্যাপ্ত অস্পষ্ট পরিবেশ।




গ্রামের পিওন সতীশবাবু বাবার হাতে যত্ন সহকারে টেলিগ্রাফের কাগজটা এনে হাজির করলেন। মেডিকেল কলেজ থেকে আসছে টেলিগ্রাফ, ওতে লেখা "Come Sharp Sumanta Serious" বাবা বজ্রাহত হয়ে পড়লেন। সেই সময় মনে হল, বাবার শরীরের সব গ্রন্থীগুলো যেন সাময়িকের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তবুও মনে জোর এনে সুরজিৎ বাবুর কাছে দৌড়ালেন। তিনি তো বিশ্বাস করতে পারলেন না। তথাপি কাল বিলম্ব না করে কলকাতার অভিমুখে যাত্রা করলেন উভয়েই।




 তারপর?




তারপর সব শেষ, সব কিছু ব্যর্থ হয়ে গেলো। আমাদের সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলো। শুধু শোক আর শোক। দেখা গেলো আমাদের জীবনে আশা ভঙ্গের হাহাকার। কতই না আশা করেছিলাম, দাদা ডাক্তারী পাশ করলে আর অভাব থাকবে না। দারিদ্র ক্লিষ্ট জীবনে সুখের মধুর স্পর্হ লাভ করবো। কিন্তু বাবার সমস্ত আশা মরুভূমির মরীচিকার মতো প্রতারণা করলো। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম, দুঃসহ দারিদ্রের মধ্যে দাদার অকাল মৃত্যু অদৃষ্টের অন্ধ বিচার ছাড়া একে আর কি বলা চলে? তবে কি গরীবদের স্বপ্নই রয়ে গেলো? বাড়ীতে এসে বাবা প্রায় অর্দ্ধ পাগল হয়ে গেলেন। কারো সাথে বাক্যালাপ করেন না, কেবল চোখ দিয়ে দরদর জল ফেলতে থাকেন। দাদার মৃত্যু সংবাদ অনেক আগেই পেয়েছিলাম। কারণ ঐ সংবাদ চাপা থাকে না। দাদার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। বুকে যেন শেল বিদ্ধ করলো। মনে পড়লো সেই মহান অ্যাস্ট্রলজারকে। তিনি বলেছিলেন সুমন্ত ডাক্তারী পাশ করে সবল ও সুস্থ দেহে পুনরায় গ্রামে ফিরে আসবে, ভয়ের কোন কারণ নেই। ঐ দিন মহান অ্যাস্ট্রলজারকে কোটি কোটি প্রণাম জানাতে ইচ্ছে করছিলো। কারে বা দোষ দিই। হবে বা একথা ঠিক, দাদা যে কলকাতা হতে ডাক্তারী পড়া শেষ করে সুস্থ শরীরে ফিরে আসবে না তা আমার স্বপ্নেরও অগোচরে ছিল। সেই শোকের তীব্রতা আমাকেও উন্মাদ করে তুলেছিলো। কিন্তু দাদার মৃত্যু রহস্য জানার জন্য আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ছিলাম। সুরজিৎ বাবুর কাছে শুনেছিলাম দাদার কোন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাদাকে হত্যা করেছে। মৃত্যুকালে তার হত্যাকারীর নাম বলেনি। পরে জানতে পেরেছিলাম দাদার হত্যাকারী আমার আপনজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় দাদার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়েও পারিনি। ধীরে ধীরে সবই বুঝতে পারবেন আমার। জীবনের পটভূমিকা, শুধু একটুখানি ধৈর্য রাখুন।






সে হত্যাকারী দাদার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতায় শত্রুতা সাধন করেছিল। কলেজের প্রিন্সিপ্যালও কল্পনা করেননি এরকম কান্ড হবে। দাদা খুনীকে চিনতে পেরেছিলো কিন্তু তার এই অমানুষিকতার জন্য শাস্তির পথ উন্মুক্ত করে যায়নি। পুলিশ ইন্সপেক্টার মৃত্যু পথযাত্রী দাদাকে খুনীর নাম জিজ্ঞাসা করলেও দাদা সেই সময় নীরব ছিল। কে সে? যদি তোকে একটি বার পেতাম তাহলে— মনের রাগ মনেই চেপে ছিলাম। শুধু দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলাম।






 শোকে জর্জরিতা এক অসহায় নারীর করুণ ক্রন্দন অনেকেরই শোনা আছে। সেই ক্রন্দনের স্বরূপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। হয়তো কোন শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা ডিকেন্স ঐ করুণ কান্না শুনে থাকলে কলমে তার বর্ণনা দিতে পারতেন। সেই সময় আমাদের ভাঙ্গা ঘরের টুকরো ইঁটগুলো পর্যন্ত আমাদের এই গভীর দুঃখে সমব্যথী হয়েছিলো। দাদার এই অকাল মৃত্যুর জন্য ভগবানের নিষ্ঠুর বিধানের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু কেউ তখন সান্ত্বনা দেবার ছিলো না। উপরন্তু বাবাকে আরো শোকাহত ও জর্জরিত করার চেষ্টা করলেন। 






সন্ধ্যের দিকে পাড়ারই বিজ্ঞ আচার্য্য মশায় লাঠির উপর ভর দিয়ে আমাদের ভগ্ন কুটিরে উপস্থিত হলেন। মনে হল, এই সময় তার জ্ঞান গর্ভ উপদেশাবলি বাবার দুঃসহ অন্তর বেদনাকে প্রশমিত করবে।






 তিনি বললেন, আমি জানি সীতাংশু, তুমি অনেক উচ্চ আশা করে ছিলে তোমার পুত্র দেশের ও দশের কাজে প্রাণ উৎসর্গ করলে তোমার আশা আকাঙ্খা পূর্ণ হতো। কিন্তু মানুষ মনে করে এক, ভগবান করেন অন্যরূপ। তাই উপনিষদে বলেছেন---




 ঈশা বাস্য মিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ


তেন ত্যক্তেন ভুঞ্চীথা মা গৃধঃ কস্যন্বিদ ধনম ।।




 এই বিশ্ব গতিশীল চলমান। সর্বদাই চলছে ও সর্বদাই পরিবর্তন হচ্ছে। মুহুর্তের জন্য এর বিরাম নেই। সেজন্য এর নাম জগৎ। এই জগতের যা কিছু আছে সে জাগতিক প্রত্যেক বস্তুই গতিশীল চলমান। কিন্তু এই চলমান জগৎ একটি অচল সত্তারই অভিব্যক্তি মাত্র। আবার ঈশ্বর সমগ্র জগৎকে আচ্ছাদন করে আছেন। অথবা বলা চলে, তিনি সকল বস্তুর অন্তরে বাস করছেন। মানুষকে এই অন্তর্যামী ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে হবে। বুঝতে হবে ঈশ্বরের সত্তা নিরপেক্ষ, কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। সর্বভূতে ঈশ্বরকে দর্শক করতে হবে। এই প্রকারের অনুভূতি যার হয়েছে তার পক্ষে এ জগতের কোন বস্তুর উপর কোন রূপ আসক্তি বা মোহ থাকতে পারে না।




 কিন্তু যেখানে ত্যাগ নেই আছে মোহ, আছে আসক্তি সেখানে দেখা দিবে দুঃখ দৈন্য ও অশান্তি। যিনি আসক্তি হীন তিনি স্বাধীন। মানুষকে কামনা বাসনা ত্যাগ করে জগৎকে ঈশ্বরের প্রকাশ মনে করে ভোগ করতে হবে। এই ভাবে যিনি ভোগ করতে পারেন তিনি আনন্দ লাভ করেন। তাই ঋষিরা বলেন, ‘তক্তেন ভুঞ্জীখা” ত্যাগের দ্বারা ভোগ করতে হবে।