তিন
ক্রমান্বয়ে বছরের পর বছর কেটে গেলো। কিভাবে যে কাটলো তা আমি ও বাবা ছাড়া কেউ অনুভব করেনি। দাদার ডাক্তারী পড়া প্রায় শেষ হতে চলেছে। জমি জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। উপরন্তু হেট মাস্টার মশায় সুরজিৎ বাবু কিছু টাকা ধার দিয়েছেন। এখন আর টাকার দরকার হবে না। এবার একবছর Compulsary Internship করার পর বাড়ী আসবে। কলেজে থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে ওতে নিজের খরচা সুন্দরভাবে চালিয়ে নিতে পারবে।
দাদার পত্র পেয়ে আমরা উভয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বড় চিন্তায় ছিলাম এ কারণে বাবা কপর্দক হীন ছিলেন। সুখ যে কি জিনিস তখন ভুলে ছিলাম অতীত তো অনেক আগেই ভুলে গেছি। তাই দুঃখকে আকড়ে ধরে দিন যাচ্ছিল আমাদের দারিদ্রের অমানিশা কেটে সুখের স্বর্ণালি প্রভাতের প্রতীক্ষায় ছিলাম। অনেক সময় ভাবতাম, সেই সুখের তরীতে নিশ্চয় চড়তে পারবো।
কিন্তু বাবার ও আমার আশা কি পূর্ণ হয়েছিলো? সত্যি বলছি, আমি এক ভোরের স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে দেখছিলাম, আমার দাদা ডাক্তারী পাশ করে গ্রামে এসে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় একটা ছোট ডিসপেনসারি করেছে। মহামান্য গণপতি চ্যাটার্জী নানা সুগন্ধি ফুলে সাজানো ডিসপেনসারিকে উদ্বোধন করলেন। এই শুভ দিনে মাননীয় রামকমলবাবু ছেলের গৌরবজ্জ্বল জীবনের কথা স্মরণ করে বাবাকে মাল্য ভূষিত করলেন। তিনিই প্রথম ঠাকুরদার কাছে ডাক্তারী পড়াবার প্রস্তাব করেছিলেন।
রামকমলবাবুর ভাষায় তাঁর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দিনটি গৌরবের ছটায় দীপ্ত হয়ে ফিরে এলো। দারিদ্র্যের দুঃসহ যাতনা অভাব অনটনের দারুন মর্মপীড়া সহ্য করেও বাবা যে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন এজন্য গ্রামের জনগণ বাবাকে অভিনন্দিত করলেন। সকলের মুখে বাবার গুনগান শুরু হলো। শুরু হলো বাবার জয়ধ্বনি। বাবার জয়ধ্বনি শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো ও দেখলাম কোথাও কিছু নেই। শূন্য গৃহে বাবা তখনও ছিন্ন কম্বল জড়িয়ে ঘুমে অচেতন।
ধীরে ধীরে কলসীর কাছে গিয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে পুনরায় আমার জীর্ণ বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। পরদিন ঐ মধুর স্বপ্নের পরিবর্তে আমাদের জীবন নাট্যের গভীর শোকের দুঃসহ দুঃখের কালো যবনিকা নেমে এলো। যে বার্তায় চোখের জলে সাগর হয়, যে বার্তায় মানুষের মনে এনে দেয় দিগন্ত ব্যাপ্ত অস্পষ্ট পরিবেশ।
গ্রামের পিওন সতীশবাবু বাবার হাতে যত্ন সহকারে টেলিগ্রাফের কাগজটা এনে হাজির করলেন। মেডিকেল কলেজ থেকে আসছে টেলিগ্রাফ, ওতে লেখা "Come Sharp Sumanta Serious" বাবা বজ্রাহত হয়ে পড়লেন। সেই সময় মনে হল, বাবার শরীরের সব গ্রন্থীগুলো যেন সাময়িকের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তবুও মনে জোর এনে সুরজিৎ বাবুর কাছে দৌড়ালেন। তিনি তো বিশ্বাস করতে পারলেন না। তথাপি কাল বিলম্ব না করে কলকাতার অভিমুখে যাত্রা করলেন উভয়েই।
তারপর?
তারপর সব শেষ, সব কিছু ব্যর্থ হয়ে গেলো। আমাদের সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলো। শুধু শোক আর শোক। দেখা গেলো আমাদের জীবনে আশা ভঙ্গের হাহাকার। কতই না আশা করেছিলাম, দাদা ডাক্তারী পাশ করলে আর অভাব থাকবে না। দারিদ্র ক্লিষ্ট জীবনে সুখের মধুর স্পর্হ লাভ করবো। কিন্তু বাবার সমস্ত আশা মরুভূমির মরীচিকার মতো প্রতারণা করলো। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম, দুঃসহ দারিদ্রের মধ্যে দাদার অকাল মৃত্যু অদৃষ্টের অন্ধ বিচার ছাড়া একে আর কি বলা চলে? তবে কি গরীবদের স্বপ্নই রয়ে গেলো? বাড়ীতে এসে বাবা প্রায় অর্দ্ধ পাগল হয়ে গেলেন। কারো সাথে বাক্যালাপ করেন না, কেবল চোখ দিয়ে দরদর জল ফেলতে থাকেন। দাদার মৃত্যু সংবাদ অনেক আগেই পেয়েছিলাম। কারণ ঐ সংবাদ চাপা থাকে না। দাদার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। বুকে যেন শেল বিদ্ধ করলো। মনে পড়লো সেই মহান অ্যাস্ট্রলজারকে। তিনি বলেছিলেন সুমন্ত ডাক্তারী পাশ করে সবল ও সুস্থ দেহে পুনরায় গ্রামে ফিরে আসবে, ভয়ের কোন কারণ নেই। ঐ দিন মহান অ্যাস্ট্রলজারকে কোটি কোটি প্রণাম জানাতে ইচ্ছে করছিলো। কারে বা দোষ দিই। হবে বা একথা ঠিক, দাদা যে কলকাতা হতে ডাক্তারী পড়া শেষ করে সুস্থ শরীরে ফিরে আসবে না তা আমার স্বপ্নেরও অগোচরে ছিল। সেই শোকের তীব্রতা আমাকেও উন্মাদ করে তুলেছিলো। কিন্তু দাদার মৃত্যু রহস্য জানার জন্য আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ছিলাম। সুরজিৎ বাবুর কাছে শুনেছিলাম দাদার কোন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাদাকে হত্যা করেছে। মৃত্যুকালে তার হত্যাকারীর নাম বলেনি। পরে জানতে পেরেছিলাম দাদার হত্যাকারী আমার আপনজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় দাদার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়েও পারিনি। ধীরে ধীরে সবই বুঝতে পারবেন আমার। জীবনের পটভূমিকা, শুধু একটুখানি ধৈর্য রাখুন।
সে হত্যাকারী দাদার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতায় শত্রুতা সাধন করেছিল। কলেজের প্রিন্সিপ্যালও কল্পনা করেননি এরকম কান্ড হবে। দাদা খুনীকে চিনতে পেরেছিলো কিন্তু তার এই অমানুষিকতার জন্য শাস্তির পথ উন্মুক্ত করে যায়নি। পুলিশ ইন্সপেক্টার মৃত্যু পথযাত্রী দাদাকে খুনীর নাম জিজ্ঞাসা করলেও দাদা সেই সময় নীরব ছিল। কে সে? যদি তোকে একটি বার পেতাম তাহলে— মনের রাগ মনেই চেপে ছিলাম। শুধু দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলাম।
শোকে জর্জরিতা এক অসহায় নারীর করুণ ক্রন্দন অনেকেরই শোনা আছে। সেই ক্রন্দনের স্বরূপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। হয়তো কোন শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা ডিকেন্স ঐ করুণ কান্না শুনে থাকলে কলমে তার বর্ণনা দিতে পারতেন। সেই সময় আমাদের ভাঙ্গা ঘরের টুকরো ইঁটগুলো পর্যন্ত আমাদের এই গভীর দুঃখে সমব্যথী হয়েছিলো। দাদার এই অকাল মৃত্যুর জন্য ভগবানের নিষ্ঠুর বিধানের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু কেউ তখন সান্ত্বনা দেবার ছিলো না। উপরন্তু বাবাকে আরো শোকাহত ও জর্জরিত করার চেষ্টা করলেন।
সন্ধ্যের দিকে পাড়ারই বিজ্ঞ আচার্য্য মশায় লাঠির উপর ভর দিয়ে আমাদের ভগ্ন কুটিরে উপস্থিত হলেন। মনে হল, এই সময় তার জ্ঞান গর্ভ উপদেশাবলি বাবার দুঃসহ অন্তর বেদনাকে প্রশমিত করবে।
তিনি বললেন, আমি জানি সীতাংশু, তুমি অনেক উচ্চ আশা করে ছিলে তোমার পুত্র দেশের ও দশের কাজে প্রাণ উৎসর্গ করলে তোমার আশা আকাঙ্খা পূর্ণ হতো। কিন্তু মানুষ মনে করে এক, ভগবান করেন অন্যরূপ। তাই উপনিষদে বলেছেন---
ঈশা বাস্য মিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্চীথা মা গৃধঃ কস্যন্বিদ ধনম ।।
এই বিশ্ব গতিশীল চলমান। সর্বদাই চলছে ও সর্বদাই পরিবর্তন হচ্ছে। মুহুর্তের জন্য এর বিরাম নেই। সেজন্য এর নাম জগৎ। এই জগতের যা কিছু আছে সে জাগতিক প্রত্যেক বস্তুই গতিশীল চলমান। কিন্তু এই চলমান জগৎ একটি অচল সত্তারই অভিব্যক্তি মাত্র। আবার ঈশ্বর সমগ্র জগৎকে আচ্ছাদন করে আছেন। অথবা বলা চলে, তিনি সকল বস্তুর অন্তরে বাস করছেন। মানুষকে এই অন্তর্যামী ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে হবে। বুঝতে হবে ঈশ্বরের সত্তা নিরপেক্ষ, কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। সর্বভূতে ঈশ্বরকে দর্শক করতে হবে। এই প্রকারের অনুভূতি যার হয়েছে তার পক্ষে এ জগতের কোন বস্তুর উপর কোন রূপ আসক্তি বা মোহ থাকতে পারে না।
কিন্তু যেখানে ত্যাগ নেই আছে মোহ, আছে আসক্তি সেখানে দেখা দিবে দুঃখ দৈন্য ও অশান্তি। যিনি আসক্তি হীন তিনি স্বাধীন। মানুষকে কামনা বাসনা ত্যাগ করে জগৎকে ঈশ্বরের প্রকাশ মনে করে ভোগ করতে হবে। এই ভাবে যিনি ভোগ করতে পারেন তিনি আনন্দ লাভ করেন। তাই ঋষিরা বলেন, ‘তক্তেন ভুঞ্জীখা” ত্যাগের দ্বারা ভোগ করতে হবে।
No comments:
Post a Comment