দুই
দাদার পত্র এলো, এ বছর পূজোতে সে বাড়ী আসবে ও সাথে একজন বন্ধু আসবে। জগৎ আলো করে মা দশভূজা আসছেন দিন সাত/ আট পরে। পর পর দু'বছর দাদা পূজোতে বাড়ী আসেনি। আমাদের অভাবের দিন আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। বাবার শরীর ভেঙ্গে গেছে। তবুও সমানভাবে উপার্জন করে চলেছেন। বাবার সেই আশা, দাদাকে ডাক্তারী পাশ করাতে হবে। তাই ভালো পুষ্টিকর খাবারের মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে। সাধারণ দুস্থ পরিবার যেমনভাবে বেঁচে থাকে আমাদের অবস্থা সেই রকম। শুধু এ চিন্তা করতাম, এদিন আমাদের থাকবে না। মানুষ অনেক কষ্টের পর সুখ পায়।
সেই আশাতে তাকিয়ে থাকলাম, সেই দিনটা কবে হবে। দাদার বন্ধু আসবে শুনে একটু ভয় পেলাম। কারণ আমাদের দারিদ্রের মধ্যে কি করে তাকে আপ্যায়িত করবো। চিন্তাকুল মনেও বাবা নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সুমন্ত ও তার বন্ধু আসছে , এতো বড় আনন্দের কথা। সে জন্য চিন্তা করার কি আছে। ওরে যে আসবে সেও মানুষ, হয়তো দুটো দিন আমাদের কষ্ট হবে। তুই বড় সংসারী হয়ে গেছিস দেখছি। সংসারের হাল হাতে নিয়েছিস বলে এতা চিন্তা কেন ? আমি তো আছি।
শুধু সংসারের কথা ভাবছিলাম না , ভাবছিলাম আসন্ন দুর্গা উৎসবে মধুময় দিনগুলোতে সাজ পোষাকের অনটনে কিভাবে অন্যান্যদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবো।
বাবা একদিন বলে ছিলেন জানিস মা আমাদের এখনো পর পর তিন বছর এই দারিদ্রের মধ্যে দিন যাপন করতে হবে। পরিবারে বস্ত্রের অভাব ছিলো যথেষ্ট, কিন্তু সংসারের কথা চিন্তা করে বস্ত্রের অভাব মেটাতে পারিনি।
স্থির করলাম, দাদার বন্ধু এলে পর পাশের বাড়ী হতে আতিথ্যের যাবতীয় ব্যবস্থা করবো। তাছাড়া গরীবের কি উপায় থাকতে পারে।
সপ্তমীর আগের দিন পশ্চিম দিগন্তে সূর্য্যের ম্লান রশ্মি মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন দাদা ও তাঁর বন্ধু রন্টু উপস্থিত হলেন সমভিব্যাহারে। দাদার বন্ধু রন্টুদার চেহারা দেখে আমি বিরামাবিষ্ট হলাম। গৌরবর্ণ চেহারা, পাতলা মুখ , কোকড়ান মাথা ভর্তি চুল। চোখের দৃষ্টিও তীক্ষ্ম। ভ্রু দুটো যেন কোন শিল্পী এঁকে দিয়েছেন, পরিধানে আভিজাত্যের ছাপ। বিশেষ করে ওর নয়ন ভুলানো রূপ আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। আমি এ পোষাকে তার সামনে থেকে সংকুচিত হয়েছিলাম। এমন সময় দাদার ডাক শুনতে পেলাম।
দাদা ও রন্টুদার যথাচিত আদর আপ্যায়ণ করলাম। এই ভাবে সেইদিনের রাতটা কেটে গেলো। বারবার সেসময় মনে উদয় হয়েছিলো, ঐ মানুষ আমাদের এই দীন অবস্থার মধ্যে থাকতে পারবেন কি না। বড়লোকের ছেলে পালঙ্গের উপর শুয়ে নিশিযাপন করেছেন। এই বাড়ীতে অসুবিধাতো হবেই। ওকে ঠিক মতো আপ্যায়িত করতে পারবো কিনা সেজন্য দাদার উপর ভীষণ রাগ হয়েছিলো কেন জেনে শুনে এখানে তাকে উপস্থিত করলো। নানান চিন্তার মধ্যে রাত কাটালাম।
পরদিন সকালে উঠে সংসারের কাজে লিপ্ত হলাম, বাড়ীর চারিপাশে ঝাড়ু দিচ্ছিলাম রন্টুটা কখন হতে যে আমার মুখপানে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ পিছন ফিরতেই চোখে চোখ পড়তেই আমি লজ্জায় সংকুচিত হয়ে বাড়ীর ভেতরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কেন ওভাবে তাকিয়ে ছিলো! তবে কি সে আমার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়েছিলো?
ভুল ভাঙ্গলো ঘন্টা তিন পর। যখন ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে বলল, কি রে রমা, আমায় দেখে ভীষণ লজ্জা পেলি।
একজন প্রবাসী অপরিচিতের মুখে জীবনে প্রথম পরিচয়ে এরকম কথা শুনব কোন মুহুর্তের জন্য ভাবতে পারিনি। অপলক দৃষ্টিতে তার মুখপানে তাকিয়ে ছিলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুতে চাইছিলো না। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আমার চিন্তা মুক্ত করে বলল, কি ব্যাপার এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? তোর নিকট তোর সুমন্তদা যেমন আমাকেও সেরূপ ভাবিস।
আমি আরো চমকে উঠলাম। আমি আজ পর্যন্ত কোন ছেলের নিকট হতে এরূপ সৌজন্যমূলক আচরণ পাইনি। পাড়ার অনেক যুবক আমাকে উত্যক্ত করেছে, আমার প্রতি কটাক্ষপাত করেছে। সে সময় নিজেকে আমি অসহায় বোধ করেছি। আমি ওদের আচরণ দেখে প্রতিবাদ করতে পারিনি। শুধু মনে পড়তো ঠাকুরদার কথা। যদি ঠাকুরদা বেঁচে থাকতেন বা আমাদের পূর্বের অবস্থা বজায় থাকতো তাহলে কোন প্রকারে একথা বলার দুঃসাহস পেতো না। আমাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে আমাকে বিপাকে ফেলার জন্য অনেকেই হীন ষড়যন্ত্র করেছিলো।
রন্টুদার কথাতে আমার ঘোর কাটলো। সে বলল, চল এই মহাপুজার দিনে আমরা সকলে সেজেগুজে প্রতিমা দর্শন করে আসি। ওকথা বলে রন্টুদা ভেতরে গিয়ে তার এটাচি হতে ভালো প্রিন্টের একটা শাড়ী বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, শোন এবার বাড়ীর কাজকর্ম বন্ধ করে আমাদের সাথে মেলা দেখতে যাবি। দুর্গাপূজায় মেলা বসতো আমাদের পুরানো বাড়ীর সামনে। ধূমধাম কম হতো না। ঠাকুরদার আমলে পূজোর চারদিন গ্রামবাসীদের উনুনে আঁচাদিতে হতো না। কারণ মহাভোজের ব্যবস্থা করতেন! এখন সব মুছে গেছে। মেজকাকা কোন প্রকারে পূজো চালাচ্ছেন। যদি বাবা পূজোতে কিছু সাহায্য করতেন, মেজকাকা অমানুষিকতার জন্য মন চাইতো না।
আমি শাড়ীটা হাতে নিতে লজ্জা করছিলাম, কিন্তু দাদার কথায় লজ্জা বিসর্জন দিতো হলো। কোন প্রকারে শাড়ীটা হাতে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
সকাল হতেই পুরানো বাড়ীতে সানাই বেজে চলেছে। সানাই এর সুর কানে আসতেই মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো। কি আনন্দই না ছিলো ঠাকুদার আমলে। পূজোর চারদিন দশ ভূজার আগমনে মহাসমারোহে, উৎসব প্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠতো। সেই সময় ঠাকুরদার নিকট হতে চরম স্নেহ ও ভালোবাসা লাভ করেছি। এখন ঐ পূজা মণ্ডপে প্রবেশাধিকার আছে কিন্তু আগের মতো অধিকার নেই।
তাই বাবা বারবার বলেছেন, যদি দশভূজাকে প্রণাম করার ইচ্ছা থাকে তাহলে। যেও, তবে বেশী বিলম্ব করা চলবে না। দাদা, আমি ও রন্টুদা প্রতিমা প্রণাম করতে গেলাম। রন্টুদার স্বভাব ও আদর্শ আমাকে মুগ্ধ করে তুললো। সেই জন্য রন্টুদার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা গভীর হয়ে উঠলো। আমি সত্যিই আনন্দিত হলাম আরেক দাদাকে পেয়ে।
ক্রমশ...
_______________________________________________
চতুর্থ পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন--
No comments:
Post a Comment