ছোট গল্প - হীরা রহস্য || লেখক - আশিস চক্রবর্তী || Short story - Hira Rahasya || Written by Ashis Chakrabarti


 


হীরা রহস্য 

           আশিস চক্রবর্তী





গাড়িতে উঠতে উঠতে পঞ্চানন আমাকে জিজ্ঞাসা করল , " স্যার ! আমরা এই নতুন পোশাক পরে যাচ্ছি কোথায় ? আর এই গাড়িটা কার ? "
আমি বললাম , " এ ভাড়ার গাড়ি পঞ্চানন !নতুন পোশাক,  সাজগোজ, এসব কোনো তদন্তের কারণে আমাদের ছদ্মবেশ , একথা  ভেবো না। আজ তুমি আমি ছুটির মেজাজে যাচ্ছি একটা নিমন্ত্রণ এটেন্ড করতে ! "
" নিমন্ত্রণ ! কার বাড়ি স্যার ? "  
" আমার ছেলে বেলার বন্ধু বটুকেশ্বর এর বাড়ি । মস্ত বড়লোক বাড়ি ছেলে। কাজ কর্ম তেমন করে না। বাপ ঠাকুর দার অঢেল সম্পত্তি ওতেই ওর চলে যায়। আর বাকি সময় টা শখের থিয়েটার করে। দেশের বাড়ি মুর্শিদাবাদ। এখন কলকাতায় বাড়ি কিনে একাই থাকে। কাল রাত্রে আমাকে ফোন করে আসতে বলল। এও বলল একটা নাকি সারপ্রাইজ আছে ! ভাবলাম , আমার সকল কর্মের সঙ্গী তুমি , তাই ওখানে তোমাকে ছেড়ে একা যায় কি করে বলো পঞ্চানন !"
" তা স্যার ভালোই করেছেন । সারা দিন চোর খুনি বদমাইশ ঘেঁটে ঘেঁটে মাথায় কেমন চড়া পড়ে গেছে। আজকে একটু  রিলাক্সসেশন হবে। "

সময় টা  সন্ধ্যে। বটুকেশ্বর এর বাড়ি পৌঁছে দেখলাম আমাদের পূর্বে আরো চার জন এসে উপস্থিত। বটুকেশ্বর একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। চার জনই বটুকেশ্বর এর বর্তমান বন্ধু। একজনের নাম  নীলাদ্রি শেখর । ওঁ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার । লম্বা চওড়া সুপুরুষ। পার্ক স্ট্রিটে নাকি একটা চেম্বার আছে। দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন পরেশ চন্দ্র বড়াল। বড় বাজারের সোনা ব্যবসায়ী।বেঁটে খাটো গোলগাল মানুষ। তৃতীয় ব্যক্তি হলেন শম্ভু নাথ প্রধান । কাপড় কোম্পানি তে চাকরি করেন। লোকটার কপাল থেকে গাল অব্দি একটা কাটা দাগ থাকার জন্য ভদ্রলোকের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। এবং সর্বশেষ ব্যক্তিটি হলেন নিলোৎপল স্যানাল। এঁর পোশাক আশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক আর্থিক ভাবে দারুন অসচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কাজ কর্ম তেমন নেই। বটুকেশ্বর সকলের সামনে আমাদের প্রকৃত  পরিচয় টা গোপন রাখল। এর কারণ জানবার জন্য আমি ভুরু কুঁচকে ফেললে, বটুকেশ্বর আমার কানের কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল , " ক্রমশ প্রকাশ্য !" 
বটুকেশ্বর এর বলা পরিচয় অনুযায়ী এখন আমার পেশা স্টিল ফ্যাক্টরির মালিক এবং পঞ্চানন আমার সেক্রেটারি। প্রত্যেকের সঙ্গেই আলাপ আলোচনা শুরু হলো। হালকা মেজাজে খাওয়া দাওয়া কথাবার্তা চললো। খাওয়া শেষ হলে  বটুকেশ্বর বলল , " সাইলেন্স প্রত্যেকে !"
তারপর আমার দিকে চেয়ে ও পুনরায় বলল , "ঋষিকেশ ! তোকে আমি বলে ছিলাম আজকে আমাদের সকলের এই দেখা সাক্ষাৎ শুধু মাত্র  খাওয়া দাওয়ার কারণের জন্য নয় । এর মাঝে   একটা সারপ্রাইজ আছে । যেটা এই মুহূর্তে আমি তোকে জানাবো। সেটা হলো আমাদের প্রত্যেকের কাছেই একটা করে অতীব মূল্য বান বস্তু রয়েছে। সেগুলোর আজকে প্রদর্শনী হবে। অর্থাৎ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছে থাকা মূল্যবান বস্তু গুলি একে অপরকে দেখাবো। এই অভিনব প্রপোজাল টা অবশ্য আমিই ওদের কে দিই ।  আর সকলেই তাতে রাজি হয় । "
পঞ্চানন বেশ উৎসাহ পেয়ে বলল , " মূল্য বান বস্তু ! আবার প্রত্যেকের কাছে ? গ্রেট ! এতো সারপ্রাইজ নয় মশায় ! পুরো সারপ্রাইজ বৃষ্টি !  কই সেসব ? "
বটুকেশ্বর এবার দেরি না করে পাশের ঘরে গিয়ে আলমারী খুলে একটা ছোট্ট বক্স নিয়ে এলো। তারপর সেটা খুলতেই লাল মখমলের কাপড়ের ভেতর থেকে আলোর ঝলকানি চোখে এসে ধাক্কা দিল। এরপর লাল কাপড় টা সম্পুর্ন ভাবে সরাতেই আলোর বিচ্ছুরণের যেন বন্যা নামলো। উপস্থিত  সকলের চোখে মুখে বিস্ময় ! একটা নীল হীরক। সোনা ব্যবসায়ী  পরেশ বাবু যেন লাফিয়ে উঠলেন। তারপর সেটা হতে তুলে নিয়ে চোখের সামনে এনে দেখে বললেন , " ম্যাগনিফিসেন্ট ! এ তুমি কোথায় পেলে বটুক ? "
" এ কি আজকের জিনিস ! কে কবে কোথা থেকে এটিকে আমদানি করে ছিল , কেউ জানে না ! আমরা বংশ পরম্পরায় একে ধারণ করে চলেছি। মার মুখে শুনেছিলাম এ খুব লাকি জিনিস ! আজকের বাজারে এর মূল্য কয়েক কোটি তো বটেই ! " 
হোমিওপ্যাথি ডাক্তার নীলাদ্রি বাবু বললেন , " জিনিস টা দেখতে সুন্দর ! তবে এর দাম নিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেললে বটুক ভাই ! হীরা টার যা সাইজ তাতে মেরে কেটে লাখ পাঁচেকের বেশি হবে না ! কি বলো পরেশ ? "
" এর সঠিক ধারণা আমার নেই ! কারণ এ জিনিস আমি আগে কখনও দেখিনি ! " জবাব দিলেন পরেশ বাবু। 
নিলোৎপল স্যানাল কে দেখলাম এক দৃষ্টে হীরাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে। তিনি কোনো কথা বললেন না । শম্ভু নাথ বাবু বললেন , " বটুক ! এমন মূল্যবান বস্তু তুমি বাড়িতে রেখে বুদ্ধিমান এর কাজ করোনি।  একা এ বাড়িতে থাকো। এদিকে কলকাতায় যা চুরি ডাকাতি বেড়েছে , তাতে এ জিনিস ব্যাংকের লকারে রাখায় ঠিক ! "
এবারে বটুকেশ্বর হীরা খানি পুনরায় আলমারীতে রেখে এসে বলল , " কই হে ডাক্তার তোমার বস্তুটি কই ? "
ডাক্তার নীলাদ্রি শেখর নিজের ফুলহাতা শার্টের অস্তীন গুটিয়ে হাত টা বললেন , " এই দেখো ! "
সকলেই ওর হাতের দিকে চেয়ে দেখলাম , একটা রূপালী বর্ণের হাত ঘড়ি যার সমস্ত যন্ত্রাংশ দৃশ্য মান আর সেগুলি স্বর্ণ বর্ণের। নীলাদ্রি শেখর এবারে বললেন , " আমার এক ধনী পেশেন্ট দীর্ঘদিন জটিল রোগে ভুগে বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়ে ছিল। আলোপ্যাথি , কবিরাজী , ঝাড়ফুঁক কিছুই সে বাকি রাখেনি। শেষ মেশ আমার কাছে টানা কিছু বছর চিকিৎসা করে সুফল পেয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে এই ঘড়িখানি আনিয়ে আমাকে উপহার দেয়। এর সঠিক মূল্য আমি জানি না। " 
পরেশ বাবু গলা ঝেড়ে বললেন , " এ সোনার ঘড়ি ? কাল একবার দোকানে এনো তো নীলাদ্রি ! দেখবো! রাতে ঠিক ধরা যায় না ! "
" ওকে ! তবে এ শুধু সোনার ঘড়ি নয় ! বডি টা প্লাটিনামের ! এবং যন্ত্রাংশ গুলি  পিওর গোল্ড !  সন্দেহ থাকলে দেখবেন কষ্টি পাথরে ঘষে ! তবে এ ঘড়ি কলকাতার বাজারে কেউ খুলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে ! " বললেন নীলাদ্রি শেখর ।
 শম্ভু বাবু বললেন , " সোনার ঘড়ি এখন আকছাড় এর ওর হাতে দেখা যায় ! এ বহু মূল্যবান কোনো বস্তু নয় । খুব মামুলী একটা ব্যাপার ! তবে প্লাটিনামের সাথে আমি তেমন ভাবে পরিচিত নয় ! "
নীলাদ্রি বাবুর এ কথাটি পছন্দ না হওয়ায় ওঁ বললেন , " এই ঘড়ি আকছার দেখা যায় ? বেশ ! তো তোমার কাছে কি জিনিস আছে দেখি ? " 
শম্ভু বাবু ওনার কোর্টের পকেট থেকে একটা কাপড়ে জড়ানো বস্তু বার করল তারপর সেই কাপড়ের আস্তরণ সরিয়ে একটা চামড়ার পুঁথি মেলে ধরে বললেন , " এই পুঁথি টি আমার ঠাকুরদার বাবা তিব্বত থেকে আনিয়ে ছিলেন। কোনো এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর লেখা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের খণ্ডিত পুঁথি ! এ বস্তুটি যেমন দুষ্প্রাপ্য তেমন মূল্যবান ! " 
পঞ্চানন পুঁথিটি হাতে তুলে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলো। ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। জেনুইন জিনিস। এই বস্তুর মূল্য টাকার মাধ্যমে ঠিক করা যায় না। একে একে সকলেই পুঁথি টি ছুঁয়ে দেখে আশ্চর্য হলো।
পরেশ চন্দ্র বড়াল পকেট থেকে বার করলেন একটা রুপোর খঞ্জর। আকারে বেশ ছোট । তবে আকর্ষণীয় এবং ওর গায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিহ্ন আঁকা রয়েছে । বস্তু টি সর্ব সম্মুখে দেখিয়ে বললেন , " একবার এক বে আইনি কাজ করে ফেলেছিলাম। এ কথা আজ অব্দি কাউকে বলিনি। এই খঞ্জর টির প্রকৃত মালিক ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ ! গোপনে এক নিলামী তে হাজির হয়ে এটা আমি কিনে ফেলি। পরে অবশ্য জানতে পারি যে জিনিসটি মিউজিয়াম থেকে চুরি করে বিক্রি করা হয়েছিল। " 
আশ্চর্য সুন্দর  খঞ্জর টি। আবার কুৎসিত ও বটে। কারণ কত মানুষ এই অস্ত্রে খুন হয়েছিল তার ঠিকনেই । ওটা দেখে এক প্রকার ঘৃণার সঞ্চার হলো আমার শরীরে।   এরপর এলো নিলোৎপল স্যানাল এর পালা। ভদ্রলোক প্রথমেই আমতা আমতা করে বললেন , " হাজার চেষ্টা করে আমি মূল্যবান কিছু জোগাড় করতে পারিনি। কারণ আমার কাছে বহু মূল্যবান কিছু নেই । এখানে আসার মুহূর্তে মনে পড়ল আমার ঠাকুরদার কথা। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পুলিশের গুলিতে মারা যান। মৃত্যুর সময় ওনার জামার বুক পকেটে ছিল এই কলম টা ! "

বলে , নিলোৎপল কলমটা বার করে দেখালেন। কলমটার প্রতি দেখলাম কারো যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কেও বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে কলমটার প্রতি দেখল না। আমি কলমটা  হাতে ধরে নিয়ে দেখলাম ওটা একটা কাঠের কলম যাতে নক্সা কাটা রয়েছে। কলমের একদিকে ঘষে খানিকটা ভেঙে গিয়েছে। এটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে ব্রিটিশ সৈনিকের নিক্ষিপ্ত বুলেট নিলোৎপল এর দাদুর দেহে ঢোকার সময় কলম টিতে প্রথমে আঘাত করেছিল। আমি ভক্তি ভরে কলম টাকে মাথায় ছুঁইয়ে ফেরত দিয়ে বললাম , " এর মূল্য বোঝবার মতো ক্ষমতা আমাদের কারো নেই । একে সঙ্গ ছাড়া হতে দেবেন  না। " 

এরপর নীলাদ্রি শেখর সোফা থেকে উঠে বাথরুম এর দিকে গেলেন ।  বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে লম্বা বারান্দা ধরে হেঁটে বাথরুম যাবার পথ।মিনিট দশ পর বাথরুমে যাবার পথে নীলাদ্রি শেখর এর আর্তনাদ শুনে আমরা অবাক হয়ে ছুটে গিয়ে  দেখলাম নীলাদ্রি শেখরের কপাল ফেঁটে রক্ত ঝরছে আর ওঁ কপালে হাত দিয়ে মেঝেতে পড়ে ছটকাচ্ছে আর বলছেন , "  আমার ঘড়ি ! আমার ঘড়ি নেই ! ছিনতাই হয়ে গেছে ! " 
নীলাদ্রি শেখর এর হাতে ঘড়ি নেই। আমি পঞ্চানন কে বললাম , " পঞ্চানন তুমি বাড়ির পিছন দিকটা যাও ! আমি সামনে যাচ্ছি ! আর  আপনারা কেউ একজন নীলাদ্রি বাবুর কাছে থেকে বাকি জন সমস্ত ঘর খুঁজে দেখুন অপরাধী ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারে। ছিনতাই কারী বেশি দূর যেতে পারিনি। " 
আমরা ছুটে যেতে যেতে শুনলাম শম্ভু নাথ প্রধান বলছেন , " ফাস্টটেড বক্স নিয়ে এসো বটুক তাড়াতাড়ি ! মাথায় ব্যান্ডেজ না করলে রক্ত থামবে না !" 
প্রায় আধ ঘন্টা সকলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও অপরাধী কে পাওয়া গেল না। ফিরে এসে দেখলাম ঘরে খাটের ওপর নীলাদ্রি বাবু শুয়ে রয়েছেন। মাথায় ব্যান্ডেজ। বটুকেশ্বর ক্রমাগত দুঃখ প্রকাশ করছে। 
" আমার জন্যই এটা হলো! আমি কেন যে সবাই কে মূল্যবান বস্তু গুলি আনতে বললাম ! ছি ! ছি ! নীলাদ্রির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। "
নীলাদ্রি শেখর হা হতাশ করছে। আর বলছেন , "আমি এখুনি গিয়ে থানায় কমপ্লেন লেখাবো ! আমার সাধের মূল্যবান ঘড়ি ! ওহ ! বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল আমার ! "
  সকলের মুখ থমথমে। আমি কোনো উপায়ন্তর না দেখে  নিজের খোলস ছেড়ে বললাম , " আপনার শরীর অসুস্থ্য ! এখন একটু রেস্ট নিন। আর আপনার ঘড়ি খোঁজার দায়িত্ব আপনি আমাকে দিন। আসলে বটুক আমার আসল পরিচয়  গোপন করেছে। আমার নাম ঋষিকেশ রক্ষিত !  লাল বাজার হেড কোয়ার্টার এর ক্রাইম ব্রাঞ্চ এর আমি একজন উচ্চ পদস্থ অফিসার। আর ও হলো ইন্সপেক্টর পঞ্চানন চক্রবর্তী ! আমার সহযোগী । "
এ কথা শোনার পর এক মুহূর্তেই সকলের মুখে আলো খেলে গেল। পরেশ বাবু বললেন , " তাহলে তো কোনো সমস্যায় নেই ! কিন্তু এতো দেখছি বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা ! আপনার মতো একটি সরকারি গোয়েন্দা বাড়িতে থাকতে এই ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেল ? "
আমি বললাম , " এর জন্য আমি ভীষণ দুঃখিত ! কিন্তু এর সুরাহা না করে আমি যাচ্ছি না ! নীলাদ্রি বাবু আপনি বলুন তো আপনার সঙ্গে ঠিক কি ঘটেছিল ? "
নীলাদ্রি বাবু বললেন , " আমি বাথরুম থেকে ফেরার পথে মাথায় তীব্র আঘাত অনুভব করি। সঙ্গে সঙ্গে চোখটা অন্ধকার হয়ে যায় আর আমি মাটিতে পড়ে যায় !কিছু ক্ষনের জন্য আমার সেন্স চলে যায়। এরপর লক্ষ্য করি আমার হাতে ঘড়ি নেই। "
আমি কথা টা শোনার পর বটুকেশ্বর কে বললাম , " তুই একবার তোর হীরা টা দেখে আয় তো ঠিক আছে কিনা ? "
বটুক আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র চিন্তিত মুখে ছুটে গেল পাশের ঘরে আলমারীর দিকে । তারপর উপস্থিত সকলের কানে এলো বটুকের কন্ঠ স্বর , " সর্বনাশ ! " 
সে ঘরে পঞ্চানন আর আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম আলমারীর দরজা খোলা হীরার ফাঁকা  বাক্স টি পরে রয়েছে । পঞ্চানন বলল , "  অর্থাৎ চোর প্রথমে হীরা চুরি করে নীলাদ্রি বাবুকে ঘায়েল করে পালিয়েছে প্লাটিনামের ঘড়ি নিয়ে পালিয়েছে ! কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কাজ টা করল কিভাবে ?  স্যার আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন ? " 
আমি কোনো জবাব না দিয়ে বললাম , " সকলে একবার এক ঘরে এসে বসুন তো ! আর বটুক তোর বাড়ির কাজের লোক দের একবার ডেকে পাঠা ! "

কথামত সকলে হাজির হল ঘরে।  নীলাদ্রি বাবু যন্ত্রনায় কাতর হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। প্রথমেই বাড়ির কাজের লোক দের জিজ্ঞাসা বাদ শুরু করলাম। বাড়িতে মাত্র দুটি কাজের লোক । একজন আজকের জন্য নিযুক্ত রান্নার ঠাকুর আর অন্য জন ঘোর দোর পরিষ্কার রাখবার জন্য বারো মাসের কাজের লোক। পঞ্চানন বলল , " স্যার আমার মনে হচ্ছে মূল্যবান বস্তু গুলোর প্রদর্শন চলা কালীন এদের মধ্যে কেউ লুকিয়ে সমস্ত কথা শুনেছিল। তারপর সুযোগ বুঝে সরিয়েছে। এক্ষুনি কয়েক ঘা চাপিয়ে ,  সার্চ করলে বেরিয়ে পড়বে ! " 
দুজনেই ভয়ে গুটিয়ে রয়েছে আর বার বার বলছে , " আমরা কিছু জানি না স্যার ! এঘরে আসিনি একবার ও ! "
আমি পঞ্চানন কে বললাম , " পঞ্চানন দুটোকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুব ভালো মতো জিজ্ঞাসা করো আর সার্চ করে দেখো কিছু পাও কিনা ! কিছু না বললে থানায় নিয়ে যাবে ! "
পঞ্চানন ওকে স্যার  বলে কাজে লেগে পড়ল ! আমি বটুকেশ্বর কে বললাম , " ভাই ! বলতে অস্বস্তি হচ্ছে তবুও বলছি ,  আমার যা মনে হচ্ছে  কাজ বাইরের কারোর পক্ষে সম্ভব না ! এখানে যারা উপস্থিত আছে তাদের মধ্যে কেউ একজন করেছে ! "
একথা শোনার পর আমন্ত্রিত সকলের মুখটা কেমন বিরক্তি আর অপমানে লাল হলে গেল। আমি ফের বললাম , " প্রয়োজনে বটুক তুই আমাকে আর পঞ্চানন কেউ জিজ্ঞাসাবাদ বা সার্চ করতে পারিস তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই ! যেহেতু ঘটনা স্থলে আমরা ছিলাম তাই আমরাও সন্দেহর তালিকায় থাকাটা স্বাভাবিক ! " 
আমার কথা শুনে বটুক বলল , " কি যা তা বলছিস হৃষিকেশ ! তোরা এসবে জড়াবি কেন ? যা হয়েছে যাক ! সবই আমার কপালে ছিল ! কিন্তু এর জন্য আমি আমার বন্ধুদের এ ভাবে বাড়িতে ডেকে অপমানিত করতে পারবো না  ! শুধু তো আমার জিনিস নয় ! নীলাদ্রির ঘড়িটা আমার কারণে গেল বলে আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে !" 
পরেশ চন্দ্র বড়াল বললেন , " মান সম্মানের আর বাকি থাকলো কি বটুক ? তোমার পুলিশ বন্ধু আমাদের চোর ভাবছেন ! নাও জেরা শুরু করো আর আমাদের সার্চ করে দেখো। "
বটুক লজ্জায় মুখ লুকালো। নিলোৎপল কিছু বললেন না। শম্ভুনাথ প্রধান চিৎকার করে বললেন , " ছি ছি ছি ! শেষে বন্ধুর আমন্ত্রনে এসে চোর সাজতে হলো ! "
নীলাদ্রি বাবু বললেন , " যা করবার তাড়াতাড়ি করুন আমার শরীর খারাপ করছে ! মাথা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ! " 
ইতিমধ্যে পঞ্চানন পাশের ঘর থেকে ফিরে এসে বলল , " স্যার ! ওরা মুখ খুলছে না ! সব জায়গা সার্চ করেও কিছু পাইনি। জিনিস গুলো নিশ্চয় আলাদা কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে রেখেছে ! থানায় নিয়ে গিয়ে চাপ দিলেই সব বের করে দেবে। "
আমি বললাম , " নাও পঞ্চানন এক এক করে আমাদের সার্চ করো। প্রথমে আমাকে দিয়ে শুরু করো। " 
পঞ্চানন আমার কথা শুনে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ,আমি পুনরায় বললাম , " দাঁড়িয়ে থেকো না ! কাজ শুরু করে দাও। তোমাকে আমি সার্চ করবো ! "
ওকে স্যার বলে পঞ্চানন একে একে সকলকে সার্চ করা শুরু করল । ওকেও সার্চ করলাম আমি। কারো কাছে কিছু মিললো না। এবার পঞ্চানন আমার দিকে তাকিয়ে বলল , "মিথ্যে  স্যার সময় নষ্ট করছেন। বরং ওদের দুটোকে থানায় নিয়ে গিয়ে টর্চার করলে মাল বেরিয়ে যেত। "
আমি বললাম , " পঞ্চানন ! সার্চ করা তোমার ঠিক মতো হয়নি ! "
পঞ্চানন বলল , " মানে স্যার !  "
"মানে টা শম্ভুনাথ বাবু বলবেন !"  বললাম আমি।
শম্ভুনাথ বাবু বললেন , " আপনি কি বলতে চাইছেন ? আমি চুরি করেছি ? আমাকে সার্চ করলেন ! কিছুই পেলেন না!মান হানি করেও আপনার শান্তি নেই ! এবার কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে আমি কোর্টে যাবো ! "
" উঁহু ! চটে যাচ্ছেন কেন ? আপনি চুরি করেছেন একথা আমি তো আপনাকে বলিনি ! তবে চোরের সঙ্গ দিয়েছেন  ! "
" এসব কথার অর্থ কি ? আপনি কিন্তু যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করছেন ! "
" বাড়াবাড়ির আর দেখলেন কত টুকু ! এবার দেখাচ্ছি বাড়াবাড়ি কাকে বলে ! পঞ্চানন ডাক্তার বাবুর মাথার ব্যান্ডেজ টা খোলো তো ! "
পঞ্চানন বলল , " কেন স্যার ! "
" আহা ! বড্ড প্রশ্ন করো তুমি ! যা বলছি তাই করো ! "
ডাক্তার নীলাদ্রি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন , " এসব কি হচ্ছে এখানে ? "
" আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনি অসুস্থ্য ! বসে পড়ুন ! "
এরপর পঞ্চানন নীলাদ্রি বাবুর ব্যান্ডেজ খুলতেই সেখান থেকে রক্তমাখা  হীরাক খন্ড মেঝেতে পড়ল। অমনি সঙ্গে সঙ্গে সকলে চমকে উঠল নীলাদ্রি ও শম্ভুনাথ প্রধান বাদে। পঞ্চানন হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে আমি বললাম , " তোমার সব প্রশ্নের জবাব আমি দিচ্ছি পঞ্চানন! মূল্যবান বস্তুর প্রদর্শন এর আমন্ত্রণ পেয়ে  নীলাদ্রি শেখর ও শম্ভুনাথ বাবুর মাথায় এই প্ল্যানটা আসে। নীলাদ্রি পরিকল্পনা মাফিক টয়লেট যাবার পথেই পাশের ঘর থেকে হীরা টা চুরি করে নেয়। তারপর ওঁর নকল সোনার ঘড়িটা টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে নিজের মাথায় নিজে আঘাত করে বাথরুমের বাইরে আসে।তারপর নাটক শুরু করে । তখন হীরা ওর কাছেই ছিল। এরপর মাথায় আঘাত লাগা এবং ঘড়ি চুরির খবর পেয়ে  আমরা সকলে যে যেদিকে পেরে ছিলাম ছুটে গিয়েছিলাম চোরের খোঁজে। খুব সম্ভবত বটুকও সেই সময় ফাস্টেড বক্স এনে দিয়ে চোর খুঁজতে ছুটে ছিল। আর সেই সময় আহত নীলাদ্রি শেখর এর সঙ্গে ছিলেন একমাত্র শম্ভুনাথ প্রধান । তিনিই নীলাদ্রি শেখর এর চুরি করা হীরাক খন্ড টি ওঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিতে সাহায্য করেন । আঘাতের ব্যান্ডেজ এর সঙ্গে হীরা নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন নির্বিঘ্নে। প্ল্যান টা ভালোই ছিল দুজনের । কারো সন্দেহ হবার কথা নয়। তবে ঋষিকেশ রক্ষিত এসে পড়ায় প্ল্যান টা সাকসেস হলো না। আমার সন্দেহ টা জাগলো দুটো কারণে । এক মাথার সামনে আঘাত লাগা , এবং নীলাদ্রি বাবুর চোর বা আঘাত কারী কে না দেখতে পাওয়া এই দুটি বিষয়ে। কারণ সত্যি সত্যি চোর সামনে থেকে আঘাত করলে নীলাদ্রি বাবু দেখতে পাবেন। আর পেছন থেকে আঘাত করলে মাথার সামনে আঘাত করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে নিজে নিজে আঘাত করলে একজন ডাক্তার হিসেবে নীলাদ্রি বাবু মাথার সামনেই আঘাত করবেন । কারণ পিছন দিকে আঘাত করার সাহস তিনি পাবেন না , ওখানে ব্রেন এর গুরুত্ব পূর্ণ অংশ থাকে। আঘাতটা খুব সামান্যই চেয়ে ছিলেন নীলাদ্রি বাবু। কারণ হীরা লুকোনোর জন্য ব্যান্ডেজ করাটা জরুরী ছিল। আমি দুঃখিত নীলাদ্রি এবং শম্ভুনাথ প্রধান বাবু আমার জন্য আপনাদের এতো সুন্দর প্ল্যানটা সাকসেস হলো না। পঞ্চানন এদের দুজন কে থানায় নিয়ে চলো। "
বটুক আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল , " দারুন উপকার করলি ভাই ! এটা আমার খুব লাকি ! "
আমি ওকে একটা প্রশ্ন না করে পারলামনা , " আচ্ছা প্রথম দিকে তুই আমার আর পঞ্চানন এর পরিচয় সবার কাছে গোপন রেখেছিলি কেন ? "
বটুক মাথা নামিয়ে বলল , " আমাদের মধ্যে নিলোৎপল এর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় ! তাই এরম একটা অবস্থা হবার আশঙ্কা করে ছিলাম। তাই হাতে নাতে চোর ধরবার জন্য তোর পরিচয় গোপন করে ছিলাম। "
বটুকেশ্বর এর এই কারণ টা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। কিন্তু ওর এই কাজের জন্য আসল চোর ধরাপড়ার কারণে ওকে আর কিছু বললাম না। 





Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024