ফল্গুধারা
চৈতালী রায়
দিব্যেন্দু সকালে চা খেয়ে খবরের কাগজটা ওল্টাতে ওল্টাতে ভাবলো - আজ শর্মিলাকে সব কথা খুলে বলবো।
দিব্যেন্দু পুরুলিয়ার ছেলে। কলেজে পড়তে কলকাতায় এসেছিলো। একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো। বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। বাড়ির সকলেই ওর দিকে তাকিয়েছিল একটা চাকরির জন্য।
দিব্যেন্দু শর্মিলাদের বাড়িতে আসে - তাও প্রায় বছর ঘুরতে চললো। শর্মিলা তার মনের চারপাশে গন্ডী দিয়েছে। ভেতরে যাই হোক - বাইরে কিছুই যেন প্রকাশ না পায়। শর্মিলার কথায় সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ সব এলেও মনের কোন খবর বাইরে আসে না। সে স্রোতা হয়ে গল্প শোনে। দিব্যেন্দু বলে, বন্ধু হিসেবে তুমি খুব ভালো বন্ধু।
অফিস থেকে ফিরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে দিব্যেন্দু শর্মিলাদের বাড়িতে এলো । ওকে কিছুটা খুশি খুশি লাগছে। বললো - আজ তোমাকে তমালির কথা বলবো। তমালি আমার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু। তখন কলেজে পড়ি। ওর দাদা আমার সাথে পড়তো। একদিন ওর দাদা আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে গেলো। বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গিয়ে ওর বোন তমালির সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। দেখলাম, ও একটা বই পড়ছে। এরপর আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ওদের বাড়িটা কেমন অদ্ভুত ধরনের। সকলেই সকলের সামনে সব কথা বলে। সাধারণ বাড়িতে যেমন একটা আব্রু থাকে, সেটা ওদের নেই। ওরা এই খোলামেলা মেলামেশাকেই প্রগ্রেশিভ চিন্তা বলে। ওদের বাড়ি থেকে কোনরকম বাধা না আসায় আমাদের সম্পর্কটা খুব সহজেই গাঢ়ত্বে পরিণত হলো। এরপর আমি চাকরি পেলাম। আমার ছোট ভাইবোনেরা পড়াশোনা এবং সমস্ত কিছুর জন্যই আমার ওপর নির্ভরশীল হলো।
তমালিদের সব ভাই - বোনেরা গান - বাজনা, রাজনীতি এসবে যুক্ত ছিলো। একদিন তমালি বললো, কয়েক মাসের জন্য আমি বাইরে যাবো। আমার ব্যাগটা তুমি গুছিয়ে দাও। আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম - আমাকে আগে বলোনি তো ! ও খুব সহজেই বললো - এতে বলার কি আছে। এখন তো বললাম। ওর বাড়ির সকলে বললো - আমাদের বাড়ির মেয়েরা এভাবে প্রতিপদে মত নিয়ে চলতে অভ্যস্ত নয়। আমরা মনে করি তাতে ওদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। আমার কিছুটা অভিমান হলো। কিন্তু বিশ্বাস করো - ঐ ব্যাগটা গোছাতে মেয়েদের জিনিসপত্র এই প্রথম হাত দিয়ে নেড়ে, গোছাতে আমার এক তীব্র অনুভূতি হয়েছিল। যাই হোক পরদিন তমালি ওর আরো কয়েকজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে চলে গেলো। তাতে ওদের বাড়ির কেউই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো না।
ফিরে আসার পর ও আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। আমিই বারকয়েক ওদের বাড়ি গেছি , বলেছে - ও এখন খুব ব্যস্ত সময় দিতে পারবে না। শর্মিলা শুনতে শুনতে ভাবছে - এইবার এ প্রসঙ্গটা থেমে যাক। আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা দমবন্ধ করা ভাব উঠে আসছে। শর্মিলার চোখের দৃষ্টি থেকে দিব্যেন্দু ক্রমশঃই দূরে সরে গিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ওকে কোনদিনও না ছুঁয়েও যেন ছোঁয়া হয়ে গেছিলো। মনের ভেতরে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো জল পড়তে লাগলো। আর সে শব্দকে ঢাকতে শর্মিলা ঠোঁটের মাঝে এক চিলতে হাসি মেলে ধরলো। দিব্যেন্দু বলে চললো - দিন চারেক আগে তমালি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। বললো - এবার আমরা বিয়েটা সেরে ফেলবো। রেজিস্ট্রির জন্য আবেদন করবো। আমি ওকে কিছুই বলতে পারলাম না। বিশ্বাস করো আমার প্রচন্ড আনন্দ হলো। দেখলাম - আমি ওকে আজও সেরকমই ভালোবাসি। আগামীকাল দু'জনে মিলে আমরা উকিলের কাছে যাবো।
শর্মিলা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো - আগামী দিনের জন্য শুভেচ্ছা রইলো। বাইরে তখন বৃষ্টি না হলেও শর্মিলার আকাশে বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি দাপাদাপি করতে লাগলো।

No comments:
Post a Comment