উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -9


 


বাবা অনেকখানি শান্ত হয়ে চোখের জল মুছে খাবারে মন বসালো। কোন প্রকারে দুপুরের খাবার খেয়ে রন্টুদা ও বাবা পৃথক পৃথক বিশ্রাম করতে থাকলো। আমি কোন প্রকারে খাবার খেয়ে জিনিষপত্র বাগিয়ে দেওয়াল ঠেস দিয়ে উদাস হয়ে অতীতের কথাকে চোখের সামনে টেনে এনে কোন রাজ্যে যে চলে গিয়েছিলাম জানি নে। এ এক কঠিন প্রতিযোগিতা, এই দৈন্য দারিদ্র্যতার প্রতিযোগিতায় জিততে কি পারবো?



 মাথার কোষে কোষে চিন্তা, বাবার যে অবস্থা তার পক্ষে উপার্জন করা কোন মতেই সম্ভব নয়। আর্থিক অন্বেষণের কোন পথ খোলা নেই। কে আমাকে কাজ দেবে। কার কাছে গেলে দুমুঠো অন্ন যোগাড় করতে পারবো। এই চিন্তায় আমাকে পাগল করে তুলেছিল। আমি জানি আমাদের গ্রামে যে সব নিম্ন জাতির মেয়েরা কাজ কর্ম করে, সেটা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। ওরা কেউ আমাকে সাথে নেবে না। হঠাৎ রন্টুদার ডাকে আমার তন্দ্রা কাটলো, আমাকে কাছে ডাকলো। আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। 



রন্টুদা বলল, আমি জানি তুই কিসের জন্য মন মরা হচ্ছিস। শোন রমা, তোর মতো হাজার হাজার মেয়ে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করছে। বিভিন্ন ফার্মে, কারখানায় দিন মজুরী করে বাঁচার জন্য লড়াই করছে। সেই সুযোগ গ্রাম গঞ্জে নেই। আমাদের কলকাতায় প্রচুর মেয়ে বিভিন্ন কর্ম করছে, বিভিন্ন অফিস, আদালতে ও নানা প্রতিষ্ঠানে কর্ম করে, এমনকি লটারির টিকিট বিক্রি করে বাঁচার চেষ্টা করছে। তবে এই গ্রামে পড়ে থাকলে তোদেরকে তিলে তিলে মরতে হবে। এর কোন ব্যতিক্রম নেই। একমাত্র উপায় হলো আমার সাথে কলকাতায় চল কাজের যোগাড় করে দেব। আমার বাড়ীতে থাকার কোন অসুবিধা হবে না। তারপর নিজেকে স্বাবলম্বী করে মেসোমশায়কেও কলকাতায় নিয়ে যাবি। আশাকরি কোন অভাব থাকবে না। বিশেষ করে কলকাতা গেলে মনে হয়। মেসোমশায় ও পুত্রশোক ভুল যাবেন।


 মনে রাখবি আমি যখন আছি তোদের কারো অসুবিধা হতে দেব না। তোরা আমার অতি আপন তাই তোদের কাছে ছুটে এসেছি। সুমন্তর সাথে এসে তোদের অবস্থা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। 


রমা কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন, তুমি যে প্রস্তাব দিচ্ছো আমার মনপুতঃ হলেও বাবা কি রাজী হবেন? কলকাতার নাম শুনলেই তিনি ক্ষেপে উঠবেন। তাছাড়া বাবার অবস্থা ভালো নয়। গভীর শোকাহত।



রন্টুদা বলল, একেবারে সত্য কথা বলেছিস। কিন্তু রমা, এছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। তাছাড়া দুটো প্রাণীকে অনাহারে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মেসোমশায়ের যে অবস্থা আমি ভালো বুঝছি না। কোন পথে তিনি পা বাড়াবেন বুঝতে পারছি না। তোকে বোঝাতে হবে। এছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে না। তুই মেসোমশায়কে ভালো করে বুঝিয়ে রাজী করা। আমার বিশ্বাস দুই / তিন মাসের মধ্যেই মেসোমহাশয়কেও কলকাতায় নিয়ে যেতে পারবি। রাত্রে মেসোমশায়কে বুঝিয়ে রাজী করিয়ে আমরা আগামী পরশুদিন রওনা হবো।


 আমি রন্টুদার কথায় রাজী হলাম বহু চিন্তা ভাবনা করে। 


রাত্রে খাবার খেয়ে বাবার শোবার ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। কলকাতার নাম শুনে বাবা চিৎকার করে উঠলেন। এই বিষয়ে তিনি দৃঢ় স্বরে অসম্মতি জানালেন। কুচক্রী, লোলুপ, বিশ্বাসঘাতক কলকাতায় তিনি তার মেয়েকে কিছুতেই পাঠাবেন না।


 বাবাকে আমি অনেক করে বোঝালাম, এছাড়া আর আমাদের গত্যন্তর নেই। আমি বাবাকে আরো বললাম, তুমি তো জানো বাবা, দারিদ্রের জন্য আমরা উপেক্ষিত ও অবজ্ঞাত। যখন বিধাতার নিষ্করুণ অভিশাপ আমাদের সংসারটিকে ছারখার করে দিয়ে গেল তখন হিংস্র মানুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে আমরাও রেহাই পাবো না। মানুষের রক্ত মাংসের হাত, মানুষ এর হাতকেই বাধা দিতে পারে না। অন্য শক্তিকে কি করে বাধা দেবে। আমাদের অভাবের সুযোগ নিয়ে বর্বর মানুষ আমাকে নারীত্বের চরম অবমাননার পথে ঠেলে দেবে। 


বাবার মুখাখানি ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠলো। সেই প্রসঙ্গে রন্টুদা বলল, আপনি কি চান মেসোমশায় অভাবের তাড়নায় রমার জীবনের পঙ্কিলতার আবর্তে ঘুরপাক থাক? জানেন এই বর্তমান যুগে মানুষ বড় জঘন্য হয়ে গেছে। সর্ব বিষাক্ত নিঃশ্বাস সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মানুষকে পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে। আপনাদের পাড়ারই ছেলে বোদা কেন রমাকে অপমানিত করবে। 


আমি অবাক হলাম বোদার প্রসঙ্গ রন্টুদা কিভাবে জানলো। বোদা চরিদ্রহীন ছেলে কি করেই বা জানলো। এখানে মানুষের মূল্যবোধ নেই। নারীত্বের চরম অপমান নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে বোদা আমাকে তার কারবারে টেনে নিতে চেয়েছিলো। তিনি চান আমাকে ঘরে রেখে আমার জীবন সংগ্রামে তিনি নেমে পড়বেন। সমস্ত শোক দূর করে কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আবার নতুন করে জীবনযাত্রা শুরু করবেন। বাবা শক্ত হবেন, কোমর বাঁধবেন, মেরুদন্ডকে সোজা করবেন। 


বাধা দিয়ে রন্টুদা বলল, এই দুর্বল শরীর নিয়ে পরিশ্রম করা চলবে না আপনার। কখন কি বিপদ হবে বলা যায় না। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখুন রমার যেমন করে হোক

চাকুরী করে দেবো। আমি আপনার ছেলের মতো, রমা যেমন আমার বোন আমারতো কর্তব্য আছে। হয়তো অর্থ দিয়ে সহযোগীতা করতে পারবো না সত্য, কিন্তু রমার উপার্জনের পথ নিশ্চয় করতে পারবো। আপনার আশীর্বাদে আমি যেন নিশ্চয়ই এই ঝঞ্ঝা বিধস্ত পরিবারটিকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে পারি। আপনার যখন ইচ্ছে হবে দেখার জন্য আমাকে পত্র দিয়ে জানাবেন আমি যথা সময়ে পৌঁছে দেব। “মৌনং সম্মতি লক্ষনম ”। 


মনে হলো বাবা রাজী হয়েছেন। বাবাকে আর বিশেষ কিছু বলতে হলো না। রন্টুদা বাবার হাতে কয়েকটা একশো টাকার নোট দিয়ে প্রণাম করে বললো, আমাকে যখন পুত্রসম ভালোবেসেছেন তখন আমি আজীবন আমার জীবনের শেষ রক্ত বিন্দুটুকু দিয়ে সুমন্তের বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করতে চেষ্টা করব। 


কলকাতায় ফিরে যখন সুমন্তর মৃত্যু সংবাদ শুনে বড় মর্মাহত হয়েছিলাম তখন আমার চোখের সম্মুখে তৎক্ষণাৎ আপনার ও রমার মুখচ্ছবি ভেসে উঠেছিলো। কিভাবে আপনারা বেঁচে আছেন। কেউ না জানুক আমি তো জানতাম কিভাবে দুঃখ - যন্ত্রণাকে জান নিত্য সাথী করে সুমন্তকে মানুষ করছিলেন। আপনার জীবনের এই নিষ্করুন ব্যর্থতায আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। তাই ছুটে এলাম আপনাদের সাহায্য করতে। আমার উপর আপনি পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারেন আমার দ্বারা কোন ক্ষতি হবে না।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024