ছোট গল্প - পুনর্জন্ম || লেখক - অরুণিমা দাস || Short story - Punorjonmo || Written by Arunima Das


 

পুনর্জন্ম

   অরুণিমা দাস 



সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর পাশ ফিরতেই হাতের যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে জিনিয়া। ভয় চোখে বিছানার একপাশে শুয়ে থাকা আয়ুশের দিকে তাকায়। অঘোরে ঘুমোচ্ছে আয়ুশ। কে বলবে গত রাতে এই আয়ুশই তাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করেছে আর মারধোর করেছে। জিনিয়া কিছুতেই বুঝতে পারে না তার সাজগোজে স্বামীর কেনো এত অনীহা। বিয়ের পর দুমাস হয়ে গেলো একদিনের জন্যও আয়ুশ তাকে সাজগোজের কোনো জিনিস কিনে দেয়নি,উপরন্তু বলেছে ন্যাচারাল থাকো, এটাই আমার পছন্দ। ওই রুশ পাউডার গালে লাগিয়ে আর ঠোঁট লিপস্টিকে লাল করে আমার সামনে কোনোদিন আসবে না,আমি এগুলো মেনে নিতে পারবোনা কিছুতেই। এসব ভাবতে ভাবতে জিনিয়া উঠে গিয়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে লাগলো,পিঠ ঘোরাতেই আয়নায় দেখলো সুস্পষ্ট কালসিটে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো জিনত। আয়ুশের ঘুম ভেঙে গেলো কান্নার শব্দে, উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো জিনিয়া কে। বললো কি হয়েছে কাঁদছো কেনো। জিনিয়া অবাক হয়ে তাকালো স্বামীর দিকে। কি অদ্ভুত তো, কাল রাতে যে মানুষটা এত হিংস্র হয়ে উঠেছিল সে আজ সকালে এরকম ভালোমানুষ! কি করে সম্ভব হয় এটা। আয়ুশকে বললো রাতের কিছু কথা মনে নেই তোমার। আয়ুশ বললো কিছু হয়েছিল নাকি রাতে। আমি তো নিশ্চিন্তে ঘুমোলাম। আর তুমি কাঁদছো কে? বলে জিনিয়ার হাত টা ধরে, জিনিয়া হাতটা সরিয়ে নেয়। আয়ুশ বললো আবার নিশ্চয়ই ভারী কাজ করে হাতে ব্যথা করছে তোমার। দাও মলম লাগিয়ে দিই। জিনিয়া বললো না থাক, আমি চা করি ব্রেকফাস্ট বানাই। রান্নাঘরে গিয়ে জিনিয়া ব্রেকফাস্ট রেডী করতে থাকে। কদিন সবকিছু ঠিক চললো, একদিন অফিস থেকে ফিরে আয়ুশ দেখে জিনিয়া সুন্দর করে সেজেছে আর গাঢ় করে লিপস্টিক লাগাচ্ছে ঠোঁটে। জিনিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায় আর হিসহিস করে বলে ওঠে সাজতে বারন করেছিলাম তো তোমায়, পছন্দ করি না আমি সাজগোজ করা মেয়েমানুষ দের। বলেই সব জিনিয়ার সব সাজ সরঞ্জাম ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর মাটিতে ফেলে জিনিয়ার চুল মুঠি ধরে মারতে থাকে। কোনরকমে জিনিয়া নিজেকে বাঁচিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। আয়ুশ চুপ করে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। সেদিন রাতে আর আয়ুশের সাথে এক বিছানায় শোয় না জিনিয়া। ঘুম আসে না ওর চোখে, সমস্ত শরীর জুড়ে যন্ত্রণা ওর। মানসিক শান্তি টাই চলে গেছে ওর। মনে মনে ভাবে এরকম চলতে দেওয়া যাবে না আর,ঠিক করে কালকেই মামাতো দাদা সঞ্জীবকে ফোন করে সব বলবে। জিনাতের দাদা সঞ্জীব মাইন্ড রিডিং নিয়ে  পড়াশোনা করছে। হয়তো কিছুটা হলেও হেল্প করতে পারবে। রাত কেটে সকাল হবার পর আয়ুশ আবার স্বাভাবিক মানুষ, অফিস যাওয়ার সময় জিনিয়াকে বলে যায় আজ বাইরে ডিনার করতে যাবো তোমায় নিয়ে, রেডী থেকো সিম্পল ভাবে। জিনাত কিছু বলে না,চুপ থাকে। আয়ুশ বেরিয়ে যাওয়ার পর ফোন লাগায় দাদাকে, ফোনে সব শুনে সঞ্জীব বলে তুই এতদিন বলিসনি কেনো রে পাগলী? সাজগোজ নিয়ে অনেকের সমস্যা থাকে, কিন্তু কিভাবে সেই সমস্যার উৎপত্তি তার মনে সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো কোনো সুন্দরী মেয়ে আয়ুশকে ঠকিয়েছে, তাই হয়তো সাজগোজের ব্যাপারে ওর বিতৃষ্ণা। কিন্তু তুই যা বললি শুনে বুঝলাম এখন এটা ওর মানসিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর প্রপার কাউন্সেলিং এর দরকার রে। আমার এক বন্ধু আছে, নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট ডা: শুভম ঘোষ, খুব ভালো মানুষ। তুই নিয়ে আয় আয়ুশকে,ওর মনের কথা জানার খুব দরকার রে।


জিনিয়া ভাবলো এমনিতেই অনেক টা দেরী হয়ে গেছে দাদাকে জানাতে তার ওপর আরও দেরী করলে হয়তো আয়ুশের সমস্যা আরও বাড়তে পারে। আয়ুশ অফিস থেকে ফিরলে জিনত বলে জানো আমার দাদা সঞ্জীব আজ কল করেছিল, আমাদের দুজনকে ডেকেছে একটা জায়গায় নিয়ে যাবে বলে। কোনো সন্দেহ না করে আয়ুশ রেডী হয়ে জিনিয়ার সাথে বেরিয়ে পড়ে। জিনিয়া আয়ুশ কে নিয়ে সোজা পৌঁছয় ডা: ঘোষের চেম্বারে, সঞ্জীব আগেই চলে গেছিলো। ওদের আসতে দেখে সঞ্জীব এগিয়ে গিয়ে ওদের নিয়ে আসে। আয়ুশ বলে এটা কোথায়। সঞ্জীব বলে আমার ওয়ার্ক প্লেস এটা। তোমরা এসো, আমি একটু কাজ সেরে নিয়ে তোমাদের ডিনারে নিয়ে যাবো। কথায় কথায় আয়ুশ কে ভুলিয়ে ডা: ঘোষের কেবিনে নিয়ে আসে সঞ্জীব। আগে থেকেই শুভম কে সব বলে রেখেছিলো সঞ্জীব। শুভম আয়ুশকে বলে বসুন আপনি, একটু আলাপ করা যাক আপনার সাথে। সঞ্জীব আর জিনিয়া কে পাশের একটা ঘরে বসতে বলে শুভম। আয়ুশ বসার পর শুভম এবার আসল কথায় আসে,জিজ্ঞেস করে কি করেন। বাড়ী কোথায় এবং পরিবারের কথা। আর এসব বলতে বলতে বলে ফেলে আপনার ওয়াইফ এত সাদা মাটা ভাবে কেনো থাকেন। সাজলে তো ওনাকে খুব ভালো লাগবে। শুভম লক্ষ্য করে সাজ গোজের কথা শুনে আয়ুশের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, টেবিলে সজোরে ঘুষি মেরে বলে আই হেট মেক আপ। প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন শুভম বুঝে ফেলে কিছু অতীত তো নিশ্চয় আছে আয়ুশের যার জন্য ও এতটা ঘৃনা করে সাজগোজ কে। ঘরের লাইট অফ করে দেয়, একটা হালকা মিউজিক চালিয়ে দেয়। আর ইশারায় সঞ্জীব আর জিনিয়া কে বলে কানে হেড ফোন লাগিয়ে নিতে। এরপর প্রশ্ন শুরু করে আয়ুশ কে। মনের কথা সব খুলে বলতে থাকে আয়ুশ। যখন ছোট ছিল, বয়স তখন পাঁচ ছয় হবে পড়তে যেত এক স্কুলের ম্যাডামের কাছে, একাই পড়ত। সেজে গুজে থাকতেন ম্যাডাম সব সময়। আয়ুশকে দেখেই পরম আদরে নিজের কাছে টেনে নিতেন। বাচ্চা আয়ুশ তখনো ম্যাডামের অভিসন্ধি বুঝতে পারেনি।


তারপর কিছুক্ষণ পড়াশোনা করানোর পর ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ করে লাউড স্পিকারে মিউজিক চালিয়ে দিয়ে শুরু হতো আয়ুশের ওপর অত্যাচার। আর বলা হতো মা বাবাকে জানালে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে। আয়ুশ অত্যন্ত যন্ত্রণা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। ভয়ে বাবা মাকে কিছু বলেনি। একদিন আয়ুশের প্যান্টে রক্তের দাগ দেখে ওর মা জিজ্ঞেস করে ওকে কি হয়েছে। আয়ুশ সব বলে মা কে, কিন্তু সুরাহা কিছু হয়নি কারণ ওই ম্যাডামের প্রতিপত্তি ছিল ওই এলাকায়। আয়ুশকে ওর বাবা বলেছিলেন সব চেপে যেতে।  এভাবে ক্লাস ফাইভ অবদি চলার পর আয়ুশকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ঘটনার রেশ এতটাই গভীর যে আয়ুশের অবচেতন মনে আজও দগদগে ঘা হয়ে আছে। শুভম মিউজিক অফ করে ঘরের আলো গুলো জ্বেলে দেয়। জিনিয়া ঝর ঝর করে কেঁদে শুভম কে বলে কি নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন ম্যাডাম। আয়ুশের মনে এত কষ্ট কোনোদিন ও বলেনি আমায়। শুভম বলে ওর মা বাবার যে কাজ টা করা উচিত ছিল সেটা আজ আপনি করছেন জিনিয়া। এবার বুঝলেন তো আপনার স্বামী কেনো সাজগোজ করা পছন্দ করেন না। কারণ ওনার মনে তো সেই ম্যাডামের ছবি গেঁথে আছে আর সেই ছবি ওনার মনকে ক্ষত বিক্ষত করে বারংবার। আপনার স্বামী পেডোফিলিয়ার স্বীকার ছিলেন। উনি ছিলেন প্যাসিভ ভিকটিম। আর ওই ম্যাডাম এভাবে কত বাচ্চার ক্ষতি করেছেন কে জানে। জিনিয়া বললো ও ঠিক হয়ে যাবে তো। শুভম বললো আমি কিছু মেডিসিন দিচ্ছি সময় মত খাওয়াবেন আর বেশ কিছু সিটিংয়ে আমি ওনার কাউন্সেলিং করবো। সময় লাগবে, ধৈর্য্য ধরতে হবে। জিনিয়া বললো আমি সব করবো ডা: ঘোষ। ওকে আজ তাহলে আসুন, বলে প্রেসক্রিপশনটা ধরিয়ে দেন জিনিয়ার হাতে। আয়ুশ মাথা নিচু করে বসেছিল, ডা: ঘোষ বললেন যান বাড়ী যান, আপনি একদম সুস্থ আছেন। আয়ুশকে নিয়ে জিনিয়া আর সঞ্জীব বেরিয়ে পড়ে। জিনিয়া সঞ্জীব কে বলে এই ঘটনার জন্যই হয়তো আয়ুশের বিয়েতে অনীহা ছিল। এটা আমি শুনেছিলাম কিন্তু কেনো অনীহা সেটা বুঝিনি। সঞ্জীব বললো চিন্তা করিস না, সব ঠিক হবে। শুধু ওকে ওষুধ গুলো টাইম মত খাওয়াস। ডা: ঘোষের কাউন্সেলিং আর স্ত্রী জিনিয়ার আন্তরিকতায় আয়ুশ রিকভার করছিল তাড়াতাড়ি। এরপর জিনিয়া ঠিক করে আয়ুশের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ওর মা বাবার সাথে কথা বলবে। একাই গেলো ও, আয়ুশকে নিয়ে যায়নি। গ্রামে গিয়ে ওর মা বাবার সাথে কথা বলে সবটা জানতে পারে আর ওদের বলে কেনো ওরা কোনো স্টেপ নেয়নি। জিনিয়াকে ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ি জানায় সমাজের ভয়ে ওরা কিছু করেনি। জিনিয়া বলে আপনাদের জন্য আমার বিবাহিত জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল,আমিও যদি সমাজের ভয় করতাম তাহলে আর আপনাদের ছেলেকে সুস্থ করতে পারতাম না। আর ম্যাডামের খবর জানতে চাইলে আয়ুশের বাবা বলেন তিনি এখানে থাকেন না আর। শ্বাশুড়ী মায়ের থেকে আয়ুশের ঘর কোনটা জেনে নিয়ে জিনিয়া যায় সেই ঘরে। আলমারি, পুরনো খাতা বই ঘেঁটে বের করে এক ডায়েরী যেখানে আয়ুশের কষ্টের কাহিনী লেখা ছিল। ডায়েরীটা নিয়ে নেয় জিনিয়া, এটা যে ডা: ঘোষ কে দিতে হবে। গ্রামের বাড়ী থেকে রাতে ফ্ল্যাটে ফেরে জিনিয়া। আয়ুশ এসে গেছিলো অফিস থেকে। ওকে খাবার খাইয়ে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় জিনিয়া। নিজেকে আজ বেশ হাল্কা লাগে ওর। এরপর রেগুলার কাউন্সেলিং,ওষুধ আর জিনিয়ার সেবায় একদম সুস্থ হয়ে ওঠে আয়ুশ। মনের ক্ষত গুলো সেরে উঠেছে ওর। একদিন সেই পুরোনো ডায়েরী টা আয়ুশের হাতে পড়ে যায়। আয়ুশ নিজের লেখা গুলো পড়ার পর ডায়েরীর শেষ কয়েকটা পাতায় জিনিয়ার লেখা পড়ে বুঝতে পারে কত ভুল করেছে সে, ছোটবেলার ঘটনা গুলোকে নিজের মনে লুকিয়ে রেখে শুধু নিজেকেই না স্ত্রী জিনিয়াকেও কষ্ট দিয়েছে। পাশের ঘরে গিয়ে জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে ক্ষমা করে দিতে তাকে। তার এই যে নতুন জীবন যে জিনিয়ার দেওয়া, তাই এখন থেকে তার ভালো মন্দ সব কিছুর ভার জিনিয়ার হাতে থাকবে। জিনিয়া খুব খুশি হয় স্বামীর পরিবর্তন দেখে। আয়ুশকে বলে সব ভুলে যাও, আজ থেকে আমরা নতুন করে সব শুরু করি চলো। আয়ুশ বলে আগামী রবিবার একটা পার্টির আয়োজন করি বাড়িতে, তোমার দাদা, ডা: ঘোষ আর আমাদের দুজনের বাবা মায়ের উপস্থিতি ,ব্যাস এই টুকুতেই আমি খুশি। জিনিয়া বললো একদম আর সব আয়োজন আমরা দুজনে মিলে করবো। রোববার দিন সন্ধে বেলায় ছোট্ট অনুষ্ঠানে হাজির ছিল সবাই আর সবার সামনে আয়ুশ জিনিয়াকে গিফট করে মেক আপ বক্স  আর বলে যার মন এত সুন্দর সে না সাজলেও সুন্দরই লাগবে, তাও এটা দিলাম মনের মত করে সেজো। জিনিয়া আয়ুশের কানে কানে বললো সাজিয়ে দিয়ো তুমি। সকলের হাসি আনন্দে ঘর ভরে উঠলো।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024