উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -13


 


পাঁচ 


পরদিন রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাত। আমার চোখের জল তখনও শুকায়নি । সারা রাত কেঁদে কেঁদে মুখাবয়ব বিকৃত করে তুলেছিলাম । শুষ্ক পুষ্পের ন্যায় মুখের রূপলাবণ্য নষ্ট হয়ে গেছিলো । মনে মনে বিদ্রোহী হলাম , কোন মতেই আমি দেহপসারিনী হয়ে সমস্ত নারী সত্ত্বাকে বিসর্জন দিতে পারব না। 


পুরুষের অত্যাচার কোন মতেই সহ্য করতে পারবো না । সেই সময় আমি আত্মহননের কথা চিন্তা করছিলাম । জানবো কলকাতায় চাকরী করতে এসে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছি । বাবার জন্য মনটা আরো কেঁদে উঠল ! তবুও আমি মরবো। 

ক্ষণিকের জন্য সব কিছু মায়া ত্যাগ করে লুকিয়ে গলায় ফাঁসি দিতে উদ্যত হলাম । কিন্তু আমার শুভাকাঙ্খীনী শ্যামলীদি আমাকে মৃত্যু হতে বাঁচালেন । নইলে বেশ সুযোগই পেয়েছিলাম আত্মহত্যা করার । যেই ঝুলে পড়ার চেষ্টা করেছি , কোথা হতে যে তিনি ছুটে এলেন জানতে পারিনি । ভেতরে প্রবেশ করে আমাকে ও অবস্থায় দেখে রাগে অভিমানে দারুন জোরে বাম গালে একটা চড় মেরে বললেন , মরতে চাইছিস না ? গত রাত্রে কি বললাম ? আমাদের শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তাই দেখতে হবে। 

আমি মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকি । কিছুক্ষণ পর সস্নেহে আমাকে বললেন , জানিস ? ইচ্ছে করলে আমিও মরতে পারতাম , এই বাম হাতের মধ্যমা অঙ্গুলিতে আংটিটা দেখছিস্ এটা হীরার । যখন খুশী মরতে পারতাম । কিন্তু মরব না প্রতিশোধ নেব । সেই অপেক্ষায় বেঁচে আছি । বিশ্বাসঘাতকার দন্ড পল্টু কে পেতে হবে । সহসা তার চোখ দুটো হতে যেন আগুন বেরিয়ে আসতে লাগলো। 


একটু পর নিজেকে শান্ত করে পুনরায় বলল , তুই পল্লীর মেয়ে , এতো ছলাকলা বুঝিস্ না । সকলকে বিশ্বাস করিস বলে তো রন্টুকে দাদা বলে গ্রহণ করেছিলি , আর আমি ? কলকাতা শহরের শিক্ষিতা মেয়েও পল্টুর চালাকি বুঝতে পারিনি । বুঝতে পারিনি তার বিজনেস , বুঝতে পারিনি তার শাট্য ও বিশ্বাসঘাতকতাকে । সরল অন্তঃকরণে পল্টু কে অনুসরণ করেছিলাম । এমনকি ওর জন্য দেবতুল্য বাবা ও দাদাকে ত্যাগ করতে কুণ্ঠাবোধ করিনি। 

তথাপি -শ্যামলীদিদির চোখ দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরুতে থাকল । রাগে অভিমানে ও উত্তেজনায় তার অধরকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরলো । আমি আনত মুখে স্থির হয়ে বসেছিলাম । এক সময় শান্ত হবার পর বললেন , সমস্ত ঘটনা না প্রকাশ করলে বুঝতে পারবি না । হয়তো এই কাহিনী শুনে মনকে একটু হালকা করতে পারবি । আর আমিও তোর কাছে প্রকাশ করে সাময়িকভাবে শান্তি পাবো । শ্যামলীদি বলতে শুরু করলেন।

 বি.এস.সির পরীক্ষার পর বাড়ীতে বসে আড্ডা দিত শ্যামলী । একদিন আবদার করে ওর বাবা বললেন , মিছেমিছি বাড়ীতে বসে কাজ নেই । তার চেয়ে তোর দাদার চেম্বারে যোগ দিলে ওর অনেক উপকার হবে । ওকথা শুনে তার মন আনন্দে নেচে উঠলো । কারণ শ্যামলী জনসেবায় নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে পারবে বলে। 

ধীরে ধীরে চিকিৎসা বিদ্যার বহু কাজে পারদর্শীতা অর্জন করল । দাদা সুভাষবাবু ভীষণ ভালোবাসতেন ও অহংকার করে বলতেন , শেষ পর্যন্ত শ্যামলী তার মতোই একজন ডাক্তার হয়ে উঠবে । কিন্তু শ্যামলীর এম.এস.সি. পাস করার ভীষণ ইচ্ছে। 


একদিন কথার ছলে বলল , ডাক্তার হয়ে আমার কাজ নেই । এম.এস.সি. পড়ে অধ্যাপিকা হব । কাজের মধ্যে ডুকে থেকেও ভাই বোনের তর্কবিতর্ক চলত । এভাবে কয়েকটা মাস সুন্দরভাবে কেটে গেল। 

একদিন ওর দাদার অনুপস্থিতিতে চেম্বারে একজন বলিষ্ঠবান যুবকের আবির্ভাব ঘটল । তার পরিচয় তিনি একজন Medical Representative, গৌরবর্ণ চেহারা,
মুখশ্রী বেশ সুন্দর , সুঁচালো নাক , করুণ চাহনী , ভূ - গুলো যেন কোন মৃৎশিল্পী দিয়েছেন । মুখে মিষ্টি হাসি । ওর চেহারা দেখে এক অজানা আকর্ষণে ওর প্রতি হয়ে উঠেছিলো শ্যামলীদি। মনে হয়েছিলো তার হারানো প্রেমিককে যেন ওর মধ্যে খুঁজে পেলেন। চেহারার কোন পার্থক্য নেই। মনে হলো ওর যমজ ভাই যেন ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার ডাকে চমকে উঠলো, সুভাষবাবু আছেন?

দাদা বাইরে গেছেন।

আজ ফিরবেন? 

না, কোন দরকার থাকে তো বলে যেতে পারেন।

দরকার মানে , এই মাসে এই সব ঔষধগুলো বের হয়েছে । ব্যবহার করতে বলতাম। আমাদের কাজ তো বুঝতে পারছেন। 

যদি আপত্তি না থাকে আপনার শ্যাম্পলগুলো দিয়ে যান দাদাকে দেব । ভদ্রলোক কাল বিলম্ব না করে ঔষধের উপকারিতা বুঝিয়ে বললেন । ওর মধুক্ষরা বানী আমার তৃষিত প্রাণে শান্তির বারি সিঞ্চন করল। ওর কথাগুলো শুনে ওকে বিজ্ঞ বলে মনে করল। 

তার নাম ঠিকানা জানতে চাইলে পর তিনি একটা Identity Card দিলেন । ওতে লেখা পি . বিশ্বাস ও নীচে ঠিকানা । তার কাজ শেষ হবার পর বিদায় নেবার জন্য ছা ছটপট করতেই শ্যামলীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।

যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ? তিনি বললেন।

স্বাচ্ছন্দে বলতে পারেন।

আপনার কোন যমজ ভাই আছে?

 না , আমার কোন ভাই বা বোন নেই । পিতা মাতার একমাত্র সন্তান আমি । কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন করলেন কেন বলুন তো?

একটু লজ্জায় পড়ল শ্যামলী । একটু আমতা আমতা করে বলল শ্যামলী , ঠিক আপনার মতো একজন লোককে দেখেছিলাম । তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।

আচ্ছা আজ উঠি, হাতে অনেক কাজ।

অনিচ্ছা সত্বেও তাকে বিদায় সম্বৰ্দ্ধনা জানালো শ্যামলী। তিনি অদৃশ্য হবার পর শ্যামলী বিগত জীবনের ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতি তাকে উতলা করে তুলল । বাঁধ ভাঙ্গা জলের মতো আমার অবরুদ্ধময় প্রেমের বন্যা গতিময় হয়ে উঠল।

মনে পড়ল সলিলের কথা । সলিল আমার কলেজের ক্লাসমেট , একই সাথে পড়াশুনা করতাম । ওকে দেখতে ঠিক পি . বিশ্বাসের মতই । সলিলের ভালোবাসা আমার অজ্ঞাত অন্ধকারাচ্ছন্ন পথকে যেন আলোক বর্তিকা দেখিয়ে উদ্ভাসিত করে তুলেছিল। কিন্তু বিধাতার অমোঘ বিধানে কালবৈশাখী ঝড়ে আমাদের সুখের নীড় গেল ভেঙ্গে। আমাদের রঙীন আশা ও স্বপ্ন মলিন ধূসরে পরিণত হলো। বিবর্ণ হলো আমাদের গভীর ভালবাসার কথা। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে সেিলর জীবন, সমাধিতে পরিণত হল। সলিলের কথা মনে আসতেই কিছুক্ষণের জন্য ঐ স্বপ্ন বিভোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কোন কাজেই মন বসছিল না তার। ওর সদা সর্বদা মন দৌড়াতে থাকল।




                                 ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024