উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -9


 

নয়



প্রতিদিন পত্রিকার অফিস থেকে বেরিয়ে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ ক্রশ করে ঋজু ও পারে যাবে। আনন্দবাজারে। কিন্তু এই পাঁচ মাথার মোড়ে হুসহাস করে কোথা থেকে যে কখন হঠাৎ হঠাৎ করে সামনে গাড়ি এসে পড়ে, এক মুহূর্ত আগেও তা টের পাওয়া যায় না। ঋজু দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুস্তান বিল্ডিংয়ের সামনে। গাড়িগুলি থামলে রাস্তা পার হবে।
হঠাত্‌ একটা গাড়ি প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষে তার সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়িটার পেছনে পর পর আরও অনেকগুলি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। ওই গাড়িটা থেকে ঝটপট কয়েক জন নামলেন। তাঁদের একজনকে ও চেনে। তিনি দীপ প্রকাশনের কর্ণধার শঙ্কর মণ্ডল। ওরা ফাঁকা পেয়েই গাড়িরাস্তার অর্ধেকটা পেরিয়ে গেল। ও দিককার গাড়িগুলো তখনও থামেনি দেখে ডিভাইডারের সামনে ওঁরা দাঁড়িয়ে পড়লেন।
ঋজু হাত দেখিয়ে ছুটে আসা গাড়িগুলিকে পাশ কাটিয়ে শঙ্করবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল— কোথায়?
— আরে তুমি? চলো, আমরা চাঙোয়ায় যাচ্ছি।
— আমি তো মদ খাই না।
— মদ না খাও, খাবার খাবে।
— অনেকক্ষণ বেরিয়েছি। অফিসে যেতে হবে।
— চলো চলো, দশ মিনিট দেরি হলে কিচ্ছু হবে না। চলো তো।
ঋজু ভাবল, ভালই হল। এই ফাঁকে নিরিবিলিতে কথাটা বলে ফেলা যাবে। কথাটা শঙ্করদাকে বলার জন্য ও সুবোধ সরকারকেও বলেছিল। উনি বলেছিলেন, বললেন। কিন্তু উনি এত কাজে ব্যস্ত থাকেন, এ রকম একটা মামুলি কথা মনে করে কাউকে বলার মতো সময় কি তাঁর আছে! যখন বলেছেন, বলবেন, তখন নিশ্চয়ই তাঁর সময়-সুযোগ মতো বলবেন। হয়তো ইতিমধ্যে বলেও ফেলেছেন। তাও, আর এক বার যদি ও বলে, সেটা কি খুব খারাপ হবে? ঋজু ওদের সঙ্গে রাস্তা পেরিয়ে চাঙোয়ায় ঢুকে পড়ল।

শঙ্করবাবু গত বছর ঋজুর একটা বই করেছিল। ছোটদের গল্পের বই বড়— মামার বাঘ শিকার। সেই বইয়ে পাতায় পাতায় ছবি এঁকেছিলেন সুব্রত চৌধুরী। দুর্ধর্ষ প্রচ্ছদ। আট মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় সংস্করণ বেরিয়েছিল। এ বছরও একটা করছে। সেটাও ছোটদের। বইয়ের নাম— ব্ল্যাকবোর্ডে ভূত। বইটার প্রুফ দেখছে ঋজু নিজেই। সে দিন সেকেন্ড প্রুফ দিতে গিয়ে দেখে, যিনি প্রুফ দেওয়া-নেওয়া করেন, তিনি সিটে নেই। তাই তাঁর চেয়ারের সামনেই অপেক্ষা করছিল সে। হঠাৎ ও দেখল, টেবিলের বাঁ পাশে যেখানে কারেকশন করা প্রুফগুলি ডাই করে রাখা থাকে, তার উপরে যে প্রুফটা রয়েছে, সেই বইয়ের লেখিকার নাম কণিকা রায়।
কণিকার বই! এখান থেকে! এ অন্য কোনও কণিকা নয় তো! এ দিক ও দিক তাকিয়ে স্ট্যাপেল করা প্রুফের তাড়াটা নিয়ে ও উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। হ্যাঁ, এটা তার কণিকারই বই।
ও, এই জন্যই সে দিন ‘ফারদার যদি ফোন করিস, তা হলে তোর বউকে ফোন করে সব বলে দেব’ বলে অমন হুমকি দেওয়ার ক’দিন পরেই, নিজে থেকেই ওকে ফোন করে বলেছিল, কী ব্যাপার, কোনও ফোন-টোন নেই কেন? ভুলে গেলে নাকি?
ও তখন বলেছিল, তুমিই তো ফোন করতে বারণ করেছ।
কণিকা বলেছিল, ও, তুমি আমার মুখের কথাটাই শুনলে! বুকের ভিতরের কথাটা শুনতে পেলে না! এই তুমি আমাকে ভালবাসো!
ঋজু বলেছিল, আমি সত্যিই তোমাকে ভালবাসি কণিকা।
— ভালবাসলে এত দিন ফোন না করে থাকতে পারতে না।
— ফোন করিনি ঠিকই, কিন্তু তুমি কি জানো, পরমার্থদাকে জিজ্ঞেস করে দেখবে, প্রত্যেক দিন রাত্রিবেলায় অফিস থেকে বেরিয়ে আমি তোমার অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মনে মনে ভাবতাম, আমার কণিকা এই গেট দিয়ে অফিসে ঢোকে! ছুটির পরে সিঁড়ির ওই ধাপগুলো পেরিয়ে ও এখানে এসে দাঁড়ায়! ট্রামে ওঠে! সামনে রাজাবাজারগামী কোনও ট্রাম দেখলেই মনে হত, আজ বিকেলেও ও হয়তো এই ট্রামে করেই বাড়ির দিকে গেছে! কোন সিটে বসেছিল ও! কোন সিটে! কত ভেবেছি, আর মনে মনে কত কেঁদেছি, তুমি জানো?
কাঁদো-কাঁদো গলায় কণিকা বলেছিল, জানি জানি। সেই জন্যই তো তোমাকে ফোন করলাম। তোমাকে ছাড়া আমিও থাকতে পারছি না। সে দিন তোমাকে রাগের মাথায় ও রকম কথা বলার পর আমিও সারা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। শুধু চোখের জলে বুক ভাসিয়েছি।
— নতুন কিছু লিখেছ?
— না।
ঋজু বলেছিল, মনে আছে? গত বছর লিখেছিলে, দিল্লির বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন-এর ‘দিগঙ্গন’-এ, ওই যে গৌতম ভট্টাচার্য...
— আমি কি ছাই ও সব জানি? তুমি নাও, তুমিই পাঠাও। তুমি জানবে।
— ওরা ওদের পরের সংখ্যার জন্য কবিতা চেয়েছে, দেবে?
— আমার এখন কোনও লেখা মাথায় আসছে না।
— যা হোক, যে কোনও কিছু নিয়ে আট-দশ লাইন লিখে দাও না।
কণিকা বলেছিল, আমি পারব না। তুমি লিখে দাও।
— সেটা ঠিক না কণিকা। পরে তোমারই খারাপ লাগবে।
— ঠিক আছে, তা হলে একটা থিম দাও, দেখি, লিখতে পারি কি না।
থিম নয়, ঋজু একটার পর একটা লাইন বলে গেল, আর কণিকা তা টুকে গেল। লেখা শেষ হওয়ার পর ঋজু বলল, এ বার পড়ে দেখো।
কণিকা বলেছিল, তুমি বলে দিয়েছ, আমি আর কী দেখব? ঠিক আছে, এটা ফ্রেস করে লিখে রাখব।
— যদি কিছু পাল্টাবার হয়, পাল্টিও। আমি পরে কালেক্ট করে নেব।

পর দিন ঋজু যখন অফিসে ঢুকছে, দেখে, ওদের রিসেপশনে কণিকা বসে আছে। ও ভেবেছিল, কণিকা বুঝি ওই লেখাটা দিতেই এসেছে। তাই বলল, কপি হয়ে গেছে?
— কীসের কপি?
— গত কাল যে লেখাটার কথা বললাম।
— ওহ্‌, না গো। একদম সময় পাইনি।
— ও, আমি ভেবেছিলাম, তুমি বুঝি ওই লেখাটা দিতে এসেছ।
— না গো, এখানে অন্য একটা কাজে এসেছি।
— কী কাজ?
— একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
— কার সঙ্গে?
— দুটো কার্ড দেব।
— কীসের কার্ড?
— আমরা একটা এনজিও খুলেছি তো, সামনের সপ্তাহে সেটার ইনোগরেশন। তার কার্ড। তোমারটা পরে দিয়ে যাব। দুটোই এনেছি। একটা আনন্দবাজার আর একটা টেলিগ্রাফের।
— এনজিও?
— হ্যাঁ, তোমাকে বলিনি, না? আসলে এত দ্রুত হল ব্যাপারটা। আমরা এখন মূলত অনগ্রসর শ্রেণির লোকজনদের নিয়েই কাজ করছি।
— তাই?
হঠাৎ ঋজুর মনে হল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই বলল, তুমি কতক্ষণ আছ?
— আছি।
— তা হলে বসো। আমি একটু ডিপার্টমেন্টে মুখটা দেখিয়ে আসি।

এসে দেখে, কণিকা নেই। গেট থেকে বেরিয়ে এ দিকে ও দিকে তাকাতেই দেখে, উল্টো দিকে গাছতলার চায়ের দোকানে ও চা খাচ্ছে। ওর সামনে রতনদা। রতনতনু ঘাঁটী।
ঋজু চমকে উঠল। শেষ পর্যন্ত রতনদার সঙ্গে! কিন্তু ও তো বলেছিল, ছেলেটা টেলিগ্রাফে কাজ করে! কিন্তু রতনদা তো ওখানে কাজ করে না। ও তো আনন্দমেলায় করে। তা হলে কি ও মিথ্যে বলেছিল!
গুটিগুটি পায়ে ওদের সামনে যেতেই রতনদা ওকে বলল, দ্যাখ, কে এসেছে। চা খাবি তো?
চা খেতে খেতেই কণিকা বলল, মেয়েরা গাড়িতে আছে।
— গাড়ি!
— ওই যে, তোমাদের ওই গেটের কাছে সিগারেটের দোকানটা আছে না, ওর ঠিক উল্টো দিকে। যাও। ওদের দেখতে পাবে।
ঋজু সে দিকে হাঁটতে লাগল।

ওর সঙ্গে আলাপের কিছু দিন পর থেকেই কণিকা বলছিল, একটা গাড়ি কিনবে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাত্‌ কোনও সুন্দর রঙের গাড়ি দেখলেই ও বলত, এই রংটা ভাল, না? কখনও সখনও গাড়ির কোনও শো রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় হুট করে ও ভিতরে ঢুকে পড়ত। জানতে চাইত, কোন মডেলের কত দাম।
ওর সঙ্গে সম্পর্কটা যখন টালমাটাল, যে কোনও সময় ভেঙে যেতে পারে, সে সময় কণিকা একদিন বলেছিল, এতই যদি ভালবাসো, একটা গাড়ি দেখেছি, পঞ্চাশ হাজার টাকা কম পড়ছে। দাও না, দেখি, তোমার কত প্রেম।
ঋজু অবাক হয়েছিল। সে তাকে কতটা ভালবাসে, পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে সেটা প্রমাণ করতে হবে! ঋজু দেয়নি।
গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঋজু ভাবতে লাগল, তা হলে কে দিল! কে! রতনদা!

দুই বাবিই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল। ঋজুকে দেখেই এগিয়ে এল— কেমন আছেন আঙ্কেল?
— খুব ভাল। তোমরা কেমন আছ?
— ভাল। মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
— হ্যাঁ, চা খাচ্ছে।
— এটা আমাদের গাড়ি।
ঋজু দেখল, ডিপ ব্লু রঙের মারুতি। এক্কেবারে নতুন। সিটের প্লাস্টিক পর্যন্ত ছেঁড়া হয়নি। ছোট বাবি গাড়ির গেট খুলে ঋজুকে বলল, বসে দেখুন না কেমন হয়েছে।
— না গো। এইমাত্র অফিসে এলাম তো। কাজ আছে।
— বাবা, আপনি দেখছি পুরো পাল্টে গেছেন। বড় বাবি বলল।
ওদের কথা হচ্ছিল। কণিকা পাশে এসে দাঁড়াল— কী ব্যাপার, সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, পুরো সাদায় সাদা।
ঋজু আজ সাদা জামা সাদা প্যান্ট পরেই এসেছে। ও প্যান্টের পকেট থেকে সাদা ধবধবে একটা মোবাইল বার করে বলল, এটাও সাদা।
কণিকা বলল, সাদা কিনেছ কেন? ক’দিন পরেই দেখবে, এটা আর সাদা থাকবে না। হাতে হাতে কেমন লালচে হয়ে যাবে।
— সে হোক। তোমার তো এই রংই পছন্দ।
— আমার! সাদা রং!
— না হলে তুমি ওর কাছে যাবে কেন?
— কার কাছে?
— যার সঙ্গে গড়িয়াহাটে আনন্দমেলার সামনে দেখা করতে গিয়েছিলে।
মেয়েদের দিকে তাকিয়ে কণিকা বলল, দেখলি, কেমন করে। দেখলি তো। বিশ্বাস হল?
আদরের গলায় ছোট বাবি বলে উঠল, আঙ্কেল, কী হচ্ছে কী?
বড় বাবি বলল, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না আঙ্কেল।
কণিকা বলল, নে, ওঠ ওঠ। চল।
ওরা গাড়িতে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।

ঋজু যখন কণিকাকে রাত্রে ফোন করে বলল, কী, রাগ কমেছে?
কণিকা বলল, না। মেয়েদের সামনে তুমি ও রকম করলে কেন? ওরা কী ভাবল বলো তো?
— ঠিক আছে, দাও। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।
— না, বলতে হবে না। ওরা ও ঘরে পড়ছে। যা বলার আমি বলে দিয়েছি। এই শোনো না, আমি বলছিলাম কি, আমাকে একটা থিম দাও না।
— থিম? কালকে দিলাম না!
— হ্যাঁ, কিন্তু আমার না আরও তিন-চারটে লাগবে। আমাদের অফিস থেকে একটা স্যুভেনুর বেরোচ্ছে তো, সবাই জানে, আমি লিখি। আমার কাছে ওরা এক গুচ্ছ কবিতা চেয়েছে।
ঋজু মনে মনে বলল, ও, কবিতার সময় আমি! আর প্রেম করার সময় রতনতনু ঘাঁটী, না! অথচ মুখে বলল, আমি একটু ভেবে নিই। একটু পরেই তোমাকে রিং ব্যাক করছি, কেমন? বলেই, ও সোজা নেমে গেল একতলায়। পেজ ফোর-এ। অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে। সেখানে বসেন ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী। তিনি বুক রিভিউ সেকশনটা দেখেন। সমালোচনার জন্য তাঁর কাছে প্রচুর বই জমা পড়ে। তিনি যেখানে বসেন, তার ডায়ে-বাঁয়ে, সামনে পেছনে, মেঝেতে পর্যন্ত টাল দেওয়া বই। অত রাত পর্যন্ত সিনিয়ররা কেউ থাকেন না। থাকেন শুধু কল্যাণ পণ্ডিত, শিলাদিত্য সেন আর মাঝে মাঝে প্রমোদ বসু। ও কল্যাণকে বলে সেখান থেকে কয়েকটা কবিতার বই বেছে নিল। বলল, খানিকক্ষণ পরে দিয়ে যাচ্ছি।
উপরে গিয়ে ফোন করল কণিকাকে। বলল, নাও, লেখো। তবে, তার আগে তোমাকে একটা কবিতা শোনাই, কেমন? সদ্য লিখেছি। দেখো তো কেমন হয়েছে। বলেই, কিছু দিন ধরে ওর টেবিলের সামনে ঝুলতে থাকা শঙ্খ ঘোষের কবিতাটার দিকে তাকাল ও। শুধু ওর টেবিলেই নয়, কারও বোধহয় খুব মনে ধরেছিল কবিতাটা, তাই জেরক্স করে প্রত্যেকের টেবিলের সামনেই একটা করে ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সে। ও সেটা গড়গড় করে পড়ে গেল। তার পর বলল, কেমন হয়েছে?
কণিকা বলল, ঠিকই আছে। তবে, স্টোরি ওরিয়েন্টেড। আর একটু ঘষামাজা করলে ভাল হবে। না করলেও চলবে। খারাপ না।
ঋজু অবাক। যে কবিতা নিয়ে চার দিকে হইহই পড়ে গেছে। সেই কবিতা সম্পর্কে ওর এই জাজমেন্ট! তার পর একটু থেমে ও বলল, নাও, লেখো। বলেই, কৃষ্ণা বসুর কবিতার বই থেকে একটা, মল্লিকা সেনগুপ্তের বই থেকে দুটো আর কাবেরী রায় চৌধুরীর বই থেকে একটা কবিতা বলে গেল এমন ভাবে, থেমে থেমে, পস দিয়ে দিয়ে, যেন সেই মুহূর্তে ভেবে ভেবে ও লাইনগুলো বলছে। কবিতা বলা শেষ হওয়ার পর ঋজু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কণিকা বলল, অনেকক্ষণ টয়লেট পেয়েছে গো, তোমাকে আমি পরে ফোন করছি। কিন্তু না। কণিকা আর ফোন করেনি।
দীপ প্রকাশনে ‘ব্ল্যাকবোর্ডে ভূত’-এর সেকেন্ডে প্রুফ দিতে গিয়ে যিনি প্রুফ নেন, তিনি না-থাকায় কণিকার প্রুফয়ের তাড়াটা নিয়ে ও উল্টেপাল্টে দেখেছিল। দেখতে দেখতে ওর ভ্রূ কুঁচকে গেল। কে দেখেছে এটা! হাতের টানগুলো খুব চেনা চেনা। কার! কার! কার! ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতেই বুঝতে পারল, এটা রতনতনুর দেখা। তার মানে কণিকা যে রতনদার সঙ্গে সে দিন দেখা করতে গিয়েছিল, সেটা প্রেম-ট্রেম নয়, এই প্রুফটার জন্য। আর সে কি না রতনদাকে নিয়ে ওই সব ভেবেছিল! ছিঃ। তার পরেই আর একটা চমক। ও দেখল, মাঝে মাঝেই তাকে ফোনে বলা এবং বিভিন্ন সময়ে লিখে দেওয়া বহু কবিতা যেমন ওই বইটাতে আছে, তেমনি আছে সে দিন কৃষ্ণাদি, মল্লিকাদি আর কাবেরীর বই থেকে বলা ওই কবিতাগুলিও।

রবিবার রবিবার সুবোধ সরকারের বাড়ি যায় ঋজু। সুবোধের সঙ্গে দীপ প্রকাশনের কর্ণধার শঙ্করবাবুর খুব ভাল সম্পর্ক। সুবোধের পর পর কয়েকটা বই করেছে ওরা। কারও বই করার জন্য সুবোধ অনুরোধ করলে ওরা না বলতে পারে না। ঋজুর বইয়ের কথাও উনিই বলে দিয়েছিলেন। তাই তার পরের রবিবারই দীপ প্রকাশন থেকে কণিকার বই বেরোবার কথাটা সুবোধকে বলল ঋজু। তার সঙ্গে এও বলল, বইটাতে কী ভাবে ঢুকে পড়েছে কাবেরীর কবিতা, কৃষ্ণাদির কবিতা এবং মল্লিকাদির কবিতা।
সুবোধ হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। সে কী গো, কী করেছ কী, মল্লিকার কবিতাও... এই মল্লিকা শোনো...
মল্লিকাদি সুবোধের স্ত্রী। কলেজে পড়ান। শুনে বললেন, যাঃ, এটা ঠিক করোনি ঋজু। ওকে বলে দিও, বই থেকে যেন ওই কবিতাগুলো ও বাদ দিয়ে দেয়। আমার কিছুই হবে না। ছাপা হলে ওরই বদনাম হবে। লোকে হাসাহাসি করবে।
ঋজু বলেছিল, আমার সঙ্গে এখন ওর আর কোনও যোগাযোগ নেই। আপনাদের ফোন-টোন খারাপ হলে ও-ই তো ইনিসিয়েটিভ নিয়ে ঠিক করে দেয়। কথাবার্তা হয়। সুবোধদা, ও ফোন করলে, আপনি বরং ওকে বলে দেবেন। সুবোধ বলেছিলেন, আমি ওকে পাব কোথায়!
ঋজু বলেছিল, ওকে কেন, তা হলে শঙ্করদাকে বলে দেবেন।

সুবোধদা কী মনে করে বলবেন! তাই শঙ্করবাবুদের সঙ্গে চাঙোয়ায় ঢুকে চিপস্‌ খেতে খেতে, ওর সঙ্গের লোকেরা যাতে শুনতে না পান, গলার স্বর অত্যন্ত নিচু করে ব্যাপারটা বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে গেল ঋজু। এবং এও বলল, ওদের লেখাগুলি আগেই ছাপা হয়েছে। বইও বেরিয়ে গেছে। আপনি চাইলে, আমি দেখাতে পারি। কোনওটা দে’জ-এর বই, কোনওটা আনন্দ-র। বুঝতেই পারছেন, এ বই বেরোলে কী হবে! প্রকাশক না করুক, যদি কবিরাই আইনি পথে যান, সে ঝামেলা কিন্তু প্রকাশক হিসেবে আপনাকেই পোহাতে হবে।
শুনে তো শঙ্করবাবু থ'। মদ খাওয়া মাথায় উঠেছে। বললেন, তাই নাকি?
ঋজু জিজ্ঞেস করল, কার ক্যান্ডিডেট ও?
শঙ্করবাবু বললেন, আমাদের উপদেষ্টা মণ্ডলীর একজনের।
— কী নাম তাঁর?
— আব্দুস সাত্তার।
— আব্দুস সাত্তার! বাবা, একেবারে মন্ত্রীকে পাকড়েছে।
শঙ্করবাবু জড়ানো গলায় বললেন, এখন দ্যাখো, ও মন্ত্রীকে পাকড়েছে, না মন্ত্রী ওকে পাকড়েছে।
ঋজু জানতে চাইল, উনি কী বলেছিলেন?
— না, সে রকম কিছু না। একদিন ফোন করে বললেন, আমার এক বন্ধু আছে, কণিকা রায়। খুব ভাল কবিতা লেখে। সব জায়গায় ছাপা হয়। দেশ, সানন্দা, এমনকী আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যাতেও ওর লেখা বেরিয়েছে। তা, আমি বললাম, তা হলে পাঠিয়ে দিন। কিন্তু উনি আর তাকে পাঠাননি। লোক দিয়ে তার পাণ্ডুলিপিটা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
— আপনি পড়েও দেখেননি!
— ভাই, এত বই ছাপা হয়, আমার কি সব পড়া সম্ভব? তা ছাড়া, এই সব কবিতা গল্পের বই ছেপে আমার কোনও লাভ হয় না। আমার আসল ব্যবসা স্কুলের বই। সিজিন শুরু হয়ে গেছে। এই তো মাদ্রাসা বোর্ডে কালই এক গাদা বই পাঠাতে হবে...
উনি বলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঋজুর কানে সে সব কিছুই ঢুকছিল না। ও তখন ভাবছিল, মাদ্রাসা বোর্ড! তার মানে ওই স্কুলগুলিতে বই ধরাবার জন্য শঙ্করদার প্রয়োজন আব্দুস সাত্তারকে। আর সেই আব্দুস সাত্তার যদি কারও বই করার জন্য ওঁকে রিকোয়েস্ট করেন, উনি কি সেটা কখনও ফেলতে পারবেন? উনি আবার অনগ্রসর শ্রেণির মন্ত্রীও।
ও দিকে কণিকাও সে দিন বলল, ও একটা এনজিও খুলেছে। অনগ্রসর শ্রেণির লোকজনদের নিয়ে কাজ করছে। তার মানে এই মন্ত্রীর সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উনিই হয়তো বলেছেন, এ ধরনের কাজ করতে। যাতে নানান খাতে কণিকাকে উনি কিছু টাকা পাইয়ে দিতে পারেন। ওর গাড়ি কেনার যে পঞ্চাশ হাজার টাকা কম পড়েছিল, সেটা হয়তো ওখান থেকেই এসেছে। আর কেউ কি কাউকে এমনি এমনি কিছু পাইয়ে দেয়, না কারও জন্য কিছু করে! নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে কণিকার একটা কিছু আছে। আর সেটা যে কী, সেটা ভেবে নিতে এক মুহূর্তও সময় লাগল না ওর।

মহাধুমধাম করে বইমেলার ইউ বি আই অডিটোরিয়ামে দীপ প্রকাশনের বিয়াল্লিশখানা বই বেরোল। বেরোল কণিকার বইও। না, দীপ প্রকাশনের ব্যানারে নয়। অদ্ভুত এক প্রকাশনীর নামে। যার কোনও অস্তিত্বই নেই। অথচ প্রকাশনীর ঠিকানা— ২০৯এ, বিধান সরণি, কলকাতা ৬। দীপ প্রকাশনেরই অন্য আর একটি বাড়ির অ্যাড্রেস। পাশাপাশি ঋজুর বইও বেরোল। ও বারবার করে প্রুফ দেখে দিয়েছিল। সেখানে প্রকাশনীর জায়গায় দীপ প্রকাশনের নাম ছিল। কিন্তু ও যখন বই হাতে পেল, দেখল, দীপ প্রকাশন নয়, সেখানে ছাপা হয়েছে— পাবলিশিং প্লাস। এটা নাকি সদ্য হয়েছে। ওদেরই সিস্টার কনসার্ন। যার নামে দীপ প্রকাশন, শঙ্কর মণ্ডলের ছেলে দীপ্তাংশুই নাকি এর কর্ণধার। ঋজু তাজ্জব। এই খেলাটা আবার কে খেলল!




                                   ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024