ছোট গল্প - তেপান্তরের মাঠ || লেখক - ঈশিতা বিশ্বাস চৌধুরী || Short story - Tepantorere math || Written by Isita biswas Chowdhury
তেপান্তরের মাঠ
ঈশিতা বিশ্বাস চৌধুরী
১
প্যানডেমিকের জন্যে অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়না তিতিরের। কি যে এক রোগ এলো অফিস কাছারি, স্কুল, কলেজ, মার্কেট এমনকি পার্কটাও বন্ধ। বাড়ি থেকে না বেরোতে পেরে খুব মন খারাপ ক্লাস সিক্সের তিতিরের। মা, বাবা দুজনেরই ওয়ার্ক ফর্ম হোম চলছে। কতদিন কোথাও না গিয়ে বাড়িতেই বন্দি জীবন কাটছে তাদের। সেই একঘেয়ে অনলাইন ক্লাস আর টিভিতে কার্টুন। কতদিন তার প্রিয় বন্ধুদের সাথে দেখা হয়না ।
আজ দুপুরে ফোনে গেম খেলার জন্য মার কাছে বকা খেয়ে মন খারাপ করে বসে আছে সে। তাদের ঊনত্রিশ তলার ফ্ল্যাটের সতেরো নাম্বার ফ্লোরের ব্যালকনিতে বসে এসব ভাবছিল সে। চোখের থেকে জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে।
মায়ের মন দূর থেকে সবই লক্ষ করে। মেয়ের দুঃখের কারণ রুমা ভালোই বোঝে। তিতিরকে সুন্দর একটি ভ্যাকেশন উপহার দেবার জন্যে প্ল্যান করতে থাকে সে। তাই লকডাউনের শিথিলতা দেখা দিলেই একদিন ভোরে সবাই মিলে তারা বেরিয়ে পড়ে যে দিকে দুচোখ যায়। তিতির জানতে চায় "বাবা আমরা কোথায় যাচ্ছি?"
বাবা বললেন, "এই কৃত্তিম শহর থেকে অনেক দূরে যেখানে শান্তি বিরাজ করে।"
তিতির তো এতদিন পরে বেরিয়ে ভীষণ আনন্দ পায় ।
বেশ কিছুটা আসার পর তারা একটা ছোট্ট ধাবায় এসে দাঁড়ালো ব্রেকফাস্ট করবার জন্য। খড়ের চাল এবং বাঁশ দিয়ে বানানো ছোট্ট দোকান। লালমাটি এবং রাস্তার দু'পাশে শাল সেগুনের বিশাল জঙ্গল । মা তাকে জিজ্ঞেস করল ,"কি খাবে তিতির ? দুধ কর্নফ্লেক্স পাওয়া যাবেনা, ব্রেড অমলেট খাবে কি? " ডিম খেতে সে ভালোবাসে তাই আপত্তি করল না। দোকানের আঙ্কেলটা কি সুন্দর গরম গরম ব্রেড-অমলেট বানিয়ে দিল তাদের। মা-বাবা সঙ্গে মাটির ভাঁড়ে চা খেলো।মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ বাতাসে দু'ধারের জঙ্গল দুলে উঠছে। এক অদ্ভুত মর্মর ধ্বনি চারিপাশে। তিতির মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে খাবার খেতে থাকে। ব্রেকফাস্ট শেষ করে তারা গাড়িতে উঠে বসলো। এই রাস্তায় গাড়ি সেরকম চলে না মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে তাদের পাশ দিয়ে।
বেশ কিছুটা চলে আসার পর সে বললো,"আর কতক্ষন বাবা?"
"এই তো এসে গেছি।" মা বলল ,"সামনেই লাভপুর বলে একটা জায়গা আছে সেখানে এক জঙ্গলের মধ্যে একটি রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। যদিও সেটি সম্পর্কে খুব একটা তথ্য ইন্টারনেটে নেই তবে রিভিউ আছে খুব ভালো। তাই আমরা এখানে আসব স্থির করি। আশা করি তোমার ভালো লাগবে। তুমি তো আগে কোনদিন জঙ্গলে আসোনি তাই তোমাকে নিয়ে এলাম। এখানে জঙ্গলে হাতি, চিতাবাঘ নানারকম বন্যপ্রাণী, হরিণ বিভিন্ন রকম পাখি দেখতে পাবে । আমরা কাল একটা জিপ ভাড়া করে জঙ্গলটা ঘুরে দেখব । কি এখন খুশি তো ?"
তিতিরের আর অপেক্ষা সহ্য হয়না! কতক্ষণে গিয়ে রিসোর্টে পৌঁছাবে সেই কথা ভাবতে ভাবতে চঞ্চল হয়ে পড়ে সে। খানিকটা যাবার পর হাইওয়ে ছেড়ে একটি মেঠো রাস্তায় ঢুকে পরে তারা। তিতিরের বাবা সুবীর, জিপিএস অন করে রেখেছে । লালমাটির রাস্তা ধরে গাড়িটি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগোতে থাকে। গাড়ি এসে দাঁড়ায় রিসোর্টের লোহার গেটের সামনে । দারোয়ান গেট খুলে দিলে তাদের গাড়ি এসে সোজা দাঁড়ায় একটি ঘাসের লনে।
জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত রিসর্টটি অতীব সুন্দর। নাম 'প্রান্তিক রিসর্ট' । চারিদিকে বিভিন্ন নাম না জানা পাখিদের কলতান শোনা যাচ্ছে। সেরকম সূর্যালোক প্রবেশ করে না এখানে ।
এখন দুপুরে বড় বড় গাছের ছায়া পড়ে অপূর্ব সুন্দর লাগছে চারপাশের পরিবেশ। পুরো অঞ্চল ঘিরে ছোট ছোট কটেজ বানানো। চারিদিকে কাঁটাতার দিয়ে ফেন্সিং করা। তাদের জন্য কটেজ আগে থেকে বুকড ছিল। সব ফর্মালিটি শেষ হলে, একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল ,
"স্যার আমার নাম নবীন, দিন আপনাদের জিনিসপত্র রেখে আসি।" গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে
কটেজটি একদম জঙ্গলের প্রান্তে। কটেজের ঠিক পেছনে বিশাল জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। সুবীর জিজ্ঞেস করল, "রিসোর্ট কি ফাঁকা নাকি ভাই সেরকম কাউকে চোখে পড়ছে না?" "
"আমাদের কটেজটা কিছুদিন হল তৈরি হয়েছে, এখনও সেরকম কেউ এর সন্ধান জানেনা। তবে উইকেন্ডে ভালোই ভিড় হয়। আপনারা তো উইক ডেজে এসেছেন তাই একটু ফাঁকা ফাঁকা আর কি। তবে এই পরিবেশে খুব ভিড় হলে কি আপনাদের ভালো লাগতে স্যার?"
রুমা বলল, "হ্যাঁ সেটা অবশ্য ঠিক। আমরা শহর থেকে এত দূরে নিরিবিলিতে সময় কাটাবো বলে এসেছি, তবে আমরা ভালো সময় থেকে এসেছি বলতে হবে।"
২
তিতির এমন পরিবেশ দেখে আনন্দে আত্মহারা। সারা রিসোর্ট জুড়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে । কিন্তু এখন লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে আর অতটা জার্নি করে এসে সবাই খুব ক্লান্ত। তারা খাবার অর্ডার করে দিলো। গরম গরম মাংসের ঝোল ভাত,আর স্যালাড। লাঞ্চ শেষ করে সুবীর, রুমা এবং তিতিরও শুয়ে পড়ল। রুমা এবং সুবীর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেও তার চোখে ঘুম আসছেনা। বড় কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সে দেখল, ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাখিরা ইতিউতি ওড়াউড়ি করছে। অনেক দূরে গাছের ঝোপের মধ্যে কি একটা সরে গেল। তিতিরের এখন মোটেই ঘুমোতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে আসে। কিন্তু মা বাবাকে ছাড়া একা একা যেতেও তার ভয় লাগে। তাই দরজা খুলে সে বারান্দায় এসে বসলো।তারপর সে চারপাশের সবুজের সমারোহ উপভোগ করতে লাগল। শহর থেকে বহুদূরে সবুজের এই জঙ্গলে চোখে যেন ধাঁধা লেগে যায় তার। হঠাৎ কার কণ্ঠস্বরে শুনে চমকে উঠে তিতির। সামনে নবীন নামে সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে সে বলল, "একি মামনি এখানে কি করছ? তোমার মা-বাবা কই? তুমি একা একা বারান্দায় বসে আছ?"
তিতির বলল, "আঙ্কেল আমার ঘুম আসছে না, মা-বাবা তো ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আমি এখানে বসে আছি। আচ্ছা ওই জঙ্গলের ভিতরে কি আছে? আমরা দেখতে যেতে পারবো?"
নবীন চমকে উঠে বলল, "একা একা কোথাও যেওনা। আর এই জঙ্গলটা সেরকম নিরাপদ নয়। দেখছনা ফেন্সিং করা আছে? বন্যপ্রাণীরা ভিতর চলে আসতে পারে তাই জন্যে। সামনেই প্রতাপপুর অভায়ারণ্য, সেখানে জিপে করে তোমার মা বাবা তোমায় জঙ্গল থেকে ঘুরিয়ে আনবে
পরে। এখনতো সাফারি বন্ধ হয়ে গেছে কাল সকালে যেও।"
"আমি এখন যেতে পারি না?"
"না না এখন যেও না। বরং রুমের ভেতরে গিয়ে বসো। মা বাবা জানলে চিন্তা করবে।"
সে বলল "আমি কোথাও যাবো না একটু এখানে বসে ভেতরে চলে যাব।"
নবীন একটু ভেবে বললো বলল ,"তবে বস। কিন্তু তুমি জঙ্গলের মধ্যে যাবে না ,জঙ্গলে কিন্তু অনেক রকম বিপদ আছে।"
বলে নবীন নিজের কাজে চলে যায়। বিকেল বেলা ঘুম থেকে উঠে মা-বাবা গাড়ি নিয়ে বের হল।পাশেই একটা পুরনো জাগ্রত দেবীর মন্দির আছে সেটা দেখে এবং ফটোগ্রাফি করে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরল সকলে। কাল সকালে তারা জঙ্গল সাফারি করতে যাবে।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছে তিতির। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে অদ্ভুত এক শব্দ তার কানে এল। কোন বন্যপ্রানীর গর্জন ও মেঘের ডাকার শব্দ মিশে একটা অপার্থিব শব্দ তার কানে এলো। তিতির ভাবলো হয়তো কোন প্রাণী হবে তাই জন্য তো পুরো রিসোর্টটির ফেন্সিং করা আছে। কাল সকালে তাড়াতাড়ি গেলে কত বন্যপ্রাণীর দর্শন পাবে। এত কাছ থেকে জীবজন্তু দেখতে পাবে ভেবে, উত্তেজনায় তার রাত্রে ভালো করে ঘুমই হলো না।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবাই মিলে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল জঙ্গল সাফারি উদ্দেশ্যে । হুডখোলা জিপে চড়ে তারা জঙ্গলের একটা বিশাল অংশ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। নানান রকম প্রাণীর আনাগোনা সেখানে। কোথায় হরিন ছুটে বেড়াচ্ছে, কোথাও শূকর, বন্য মহিষ, গাছে হনুমানের দল এছাড়া অসংখ্য পাখপাখালি তো আছেই। আর জঙ্গলের ভেতরে একটি বিশাল ঝিল এবং সেখানে নানা পরিযায়ী পাখির সমাবেশ। দুচোখ ভোরে দেখতে লাগল এবং মা-বাবাকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলো তিতির। এই জঙ্গলে চিতাবাঘও বাস করে কিন্তু সেগুলি থাকে কোর এরিয়াতে । তারা জনসমক্ষে সহজে আসেনা। সাফারির পর তারা রিসোর্টে ফিরে এলো। খেয়ে
সবাই দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছে ,তিতির মায়ের ফোন নিয়ে একটি কার্টুন সিরিজ দেখতে ব্যস্ত । বিকেলের সোনালী রোদ গাছগাছালির ফাঁক থেকে উঁকি মারছে। অদ্ভুত এক মন্মুগধকর পরিবেশ।। কাল রাতের সেই অদ্ভুত শব্দের কথা মনে পড়ল তার । ছোট্ট তিতিরের মনে হল আর এই জঙ্গলের মধ্যে নিশ্চয় অদ্ভুত কোনো প্রাণী আছে সেটাকে দেখতে হবে। সন্তর্পনে রুমের বাইরে আসে সে। সূর্যের সোনালী আভায় সারা আকাশ জুড়ে নানা
রঙের খেলা চলছে। লন ধরে হেটে যেতে যেতে কিচেনের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। নবীন বিকেলের স্ন্যাকসের আয়োজন করছে। তিতিরের সাথে দেখা হল, সে বলল "আঙ্কেল কাল রাতে জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ পেয়েছিলাম, সেটা কিসের বলতে পারো?" নবীনের হাসিমুখে একটু চিন্তার উদ্রেক হল, সে বলল ,"তোমায় তো বলেছি জঙ্গলের ভেতর অনেক বিপদ আছে, বন্যপ্রাণী আছে তাদের শব্দ হতে পারে।"
"আমি জঙ্গলের ভেতরে যেতে চাই। আমরা তো সাফারিতে জিপ থেকে নামতেই পারলাম না, একটু ঘুরে জঙ্গলটা দেখে চলে আসব। আর বাবা বলেছে চিতাবাঘ, হিংস্র বন্যপ্রাণী জঙ্গলের 'কোর' এরিয়াতে থাকে। নবীন একটু বিরক্ত হয়ে বলল ,"তোমায় বলেছি না জঙ্গলের ভেতরে যাবে না। তারপর ফিসফিস করে বলল ,"জঙ্গলের ভিতরে এক বিশাল তেপান্তর মাঠ আছে। একবার সেখানে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। বুঝলে? অনেক বাচ্চারা সেখান থেকে হারিয়ে গেছে। তুমি ভুলেও সেখানে যাবার চেষ্টা করবে না। এক্ষুনি রুমে যাও, মা-বাবার সাথে থাকবে সবসময়।"
বলে নিজের কাজে মন দেয় নবীন। বেড়াতে এসে কারো কাছে বকা খেতে হবে এ কথা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। খুব অভিমান হলো নবীনের ওপর। ওদিকে মা-বাবা এখনো ওঠেনি। কিন্তু তিতিরের নিজের কৌতুহল নিরসন করতে ও নিজেকে সাহসী প্রমান করার উদ্দেশ্যে একবার জঙ্গলের ভেতরে যাওয়ার খুব ইচ্ছা তার।
3
তিতির সব কিছু কে এক্সপ্লোর করতে ভালোবাসে। এই বয়স টাই এমন। তাই মনের ইচ্ছে দমন করতে না পেরে সবার অলক্ষ্যে ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা রিসোর্টের ঘেরাটোপ পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একাই হাঁটতে শুরু করে সে । মুক্তির স্বাদই আলাদা। আবছা সোনালী রঙে রাঙা বিকেলের আকাশ। জঙ্গলের মধ্যে কত নাম না জানা জংলি ফুলের সুবাস। গাছে গাছে পাখিরা বাসায় ফিরছে। আচমকা অদূরে কাল রাতের সেই কান ফাটানো আওয়াজটা শুনতে পায় তিতির। সূর্য অনেক্ষন দিগন্তের অন্তরালে চলে গেছে। হালকা এক লালিমা আকাশে বর্তমান। চারিদিক সুনসান। নির্জন জঙ্গলে সেই চিৎকার কি অদ্ভুতই না শোনালো। তিতির ভয়ে ভয়ে এগিয়ে দেখল সামনে একটি দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ। সবুজ ঘাসে ঢাকা। মাঠটি কোথায় শুরু বা শেষ কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। এটাই কি তবে তেপান্তরের মাঠ? চমকে ওঠে সে। হঠাৎ তার মনে হল দূরে কে যেন তাকে ডাকছে , "এদিকে এসো! আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম কবে থেকে! এসো এসো।"
সম্মোহিতের মত এগিয়ে যায় ছোট্ট তিতির। আধো অন্ধকারের মধ্যে ধীরে ধীরে মিশে যায় সে।
ওদিকে রুমা ও সুবীর উঠে বসে দেখে তিতির ঘরে কোথায় নেই। সমগ্র রিসোর্ট তন্নতন্ন করে খুঁজেও তিতিরকে কোথাও পাওয়া যায়না। রুমা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। সুবীর এবং রিসোর্টের বাকি লোকেরা হতবাক। পুলিশ এসে ছবি সহ বাকি সব তথ্য নিয়ে গেছে। তাকে খুঁজে বের করার জন্য তল্লাশি চলছে। তবে আসে পাশের সব জায়গায় খোঁজা হলেও তার চিহ্ন মাত্র পাওয়া যায়নি। পুলিশ রিসোর্টের লোক নিয়ে জঙ্গলের আসে পাশে খোঁজ চালাতে গিয়েছে অনেকক্ষণ। তিতিরের কোন খোঁজ নেই।
রাত্রি নটা বাজে। রুমা ও সুবীর ঘরে চুপ করে বসে আছে। এরকম আনন্দ করতে এসে যেরকম চরম বিপদের সম্মুখীন হবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। আচমকা হন্তদন্ত হয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে নবীন। বলে ,"স্যার আমি জানি দিদিমণি কোথায় আছে। আমি খুঁজতে সেখানে গিয়েছিলাম কিন্তু আর তাকে বোধ হয় আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।" সুবীর চেঁচিয়ে উঠলো,"কী বলছো কী নবীন? ও কোথায় আছে? আমাদের এই মুহূর্তে জানাও। নাহলে আমি তোমাকে পুলিশে দেব। নির্ভীক কণ্ঠে নবীন বলল "পুলিশ কিছু করতে পারবে না স্যার, আমি আপনাদের আগেই বারণ করেছিলাম ওই জঙ্গলের মধ্যে কাউকে না যেতে। আমাদের এই অঞ্চলে এই জঙ্গল পেরিয়ে এক বিশাল মাঠ আছে যাকে আমরা বলি তেপান্তরের মাঠ। সেখানে কেউ গেলে আর কোনদিন ফিরে আসে না। রুমা রেগে বলল "তুমি আমাদের সাথে পুলিশের কাছে চলো! কোথায় সেই মাঠ দেখাও আমরা খুঁজ বের করব।"
নবীন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,"ম্যাডাম বোঝার চেষ্টা করুন! আমি এবং পুলিশের টিম মিলে সমস্ত জঙ্গল খুঁজেছি। চারপাশে খুঁজে দেখা হয়েছে কিন্তু দিদিমণিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি এখন ভিনগ্রহীদের দেশে। এভাবেই আমি আমার ছোটভাই কেও হারিয়েছি। তাইতো আমি অনেকবার বারণ করলাম দিদিমণিকে ওদিকে যেতে, কিন্তু আমার কোন কথাই শুনলো না সে।"
রুমা একটু নরম হয়ে বলল ,"নবীন আমাদের একমাত্র মেয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে। আমাদেরকে নিয়ে চলো। ওকে খুঁজে না পেলে আমাদের আর বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না।আমিও জঙ্গলে চলে যাব।"
"ঠিক আছে চলুন। তবে আমি আপনাদের মেয়েকে আমি কিভাবে ফিরিয়ে দেবো জানিনা। সম্ভব হলে আমার ভাইকেও ফিরিয়ে আনতাম। পারিনি। আপনারা চলুন বুঝতে পারবেন।"
একটা টর্চ সঙ্গে নিয়ে তিনজনে মিলে গভীর জঙ্গল পেরিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এগিয়ে চলল। চারপাশে বন্যপ্রাণী এবং রাত পাখিদের ওড়াউড়ির শব্দ। তারাও যেন জঙ্গলের মধ্যে মানুষের এই অনধিকার প্রবেশে ভীষণভাবে বিরক্ত। অনেকটা পথ পেরিয়ে তারা এসে পৌছালো একটি খোলা মাঠের ভেতর। আজ পূর্ণিমা, তাই চারিদিক আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে। সেই আলোয় বোঝা গেল মাঠের মাঝখানে একটি গোল বৃত্ত সৃষ্টি হয়েছে। কোন প্রকান্ড এবং ভারী ধাতব জিনিস যেন সেখানে নেমে ছিল। তাতেই ওরকম একটি অদ্ভুত আকার সৃষ্টি হয়েছে।
নবীন অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলল,"দেখছেন ম্যাডাম ঘাসের মধ্যে যে গোলাকার বৃত্তের মত চিহ্নটি দেখা যাচ্ছে ভালো করে লক্ষ্য করুন, আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এই অঞ্চলে ভিনগ্রহীদের আনাগোনা বহু বছর ধরে চলে আসছে। জানিনা কেন তারা আমাদের এই জঙ্গল অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বেছে নিয়েছে। হয়তো নিজেদের লুকিয়ে রাখার সুবিধার্থে।
অনেক ছোটবেলায় আমার ভাই ঠিক এই অঞ্চল থেকে এক পূর্ণিমার রাত্রিতে হারিয়ে যায়। তাকে আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রত্যেকদিন রাত্রে আমি এই জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম যে ভাই ফিরে আসে কিনা। একদিন পূর্ণিমার সন্ধ্যেবেলায় আকাশের চাঁদ ওঠার পর দেখি এক অদ্ভুত শব্দ করে একটি বৃত্তাকার যন্ত্রের মতো বিশাল আকাশযান নেমে আসছে আমাদের এই মাঠের মধ্যে। আমি দূরে লুকিয়ে ছিলাম বলে তারা আমার উপস্থিতি টের পায়নি। তারপর থেকে প্রত্যেক পূর্ণিমায় এবং যখন আকাশে চাঁদ থাকে তখন ওরা এই প্রান্তরে পদার্পন করে সবার অলক্ষ্যে ।
আমি এখানে মাঝে মাঝে আসি ভাইয়ের খোঁজে, কিন্তু তাকে কোনদিনই আর দেখতে পাইনি। সে বহুকাল আগের কথা, জানিনা সে বেঁচে আছে কিনা। সেই জন্যই আমার এই রিসোর্ট কাজ নেওয়া। এখান থেকে আমি সহজেই ভিনগ্রহের প্রাণীদের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করতে পারি।একবার পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে আমি তাদের দেখেছিলাম। বিশালাকায় দেহ, অত্যন্ত লম্বা। দুটি কালো বড়ো চোখ এবং কৃশকায় দেহ। আমি বিশেষ পড়াশোনা জানিনা কিন্তু তারা যে এই গ্রহের বাসিন্দা নয় এটুকু বুঝতে আমার এক মুহূর্ত দেরি হয়নি। তারা অন্য ভাষায় কথা বলে, আমাদের দেশের ভাষা তারা বোঝে না। তবে তারা আমাদের ভাষা নকল করতে পারে। আমার ধারণা আজকে সন্ধ্যেবেলায় দিদিমণি হাঁটতে হাঁটতে মাঠে এসে পড়ে এবং কোনভাবে সেই ভিনগ্রহীদের চোখে পড়ে যায তার পর থেকেই সে নিরুদ্দেশ।"
রুমা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, "এটা হতে পারে না এ যে অসম্ভব! তুমি কি বলছ? তোমার মাথা ঠিক আছে নবীন? না মজা করছো আমাদের সাথে?" নবীন আবার বলল, "গ্রামের অনেক মানুষ এই অঞ্চল থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সত্যি কথা বলতে বিশেষ কেউ এ ব্যাপারে জানেও না। তারা একে তেপান্তরের মাঠ বলে আখ্যা দিয়েছে।
কিন্তু আসল সত্যিটা সকলেরই অজানা। তাই তারা এই জনহীন প্রান্তরে বিশেষ আসেনা। যারা হারিয়ে গেছে তাদের কেউই আর ফিরে আসেনি। এই অলৌকিক ঘটনা আমিও কাউকে বলিনি কাউকে বললে বিশ্বাসও করবে না। পুলিশ প্রশাসনও তো নয়ই ।
সুবীর এতক্ষণ ধরে সমস্ত কথা শুনছিল, সে নবীনের হাত ধরে টেনে বললো, "চলো তুমি, ও যতসব বাজে কথা বলছে, ওই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে তিতিরকে, এখন এসব বলে আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এক্ষুনি পুলিশের কাছে নিয়ে গেলে এমন মার মারবে, সব কথা বেরিয়ে যাবে।" রুমা বলল,"হ্যাঁ তাই চলো, একটা কথাও বিশ্বাসযোগ্য নয় ওর। আমাদের অসহায়তার সময় মজা করতে লজ্জা করছেনা তোমার?"
নবীন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সে বলল,"আমি জানতাম আপনারা এটাই বলবেন।"
হঠাৎ এক অপার্থিব শব্দ সবার কানে এলো। মাঠের মধ্যে বৃত্তাকার নীল আলো চোখে পড়ল সবার। আকাশের দিকে তাকাতেই তারা দেখল একটি গোলাকার বিশাল ধাতব বস্তু চক্রাকারে নেমে আসছে এবং তার থেকে এক অদ্ভুত নীলচে আলোক রশ্মি নির্গত হচ্ছে। সাথে সাথেই বইতে শুরু করে প্রবল হাওয়া। সুবীর এবং রুমা স্থানুর মতো দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখল। নিজের চোখকে যেন তারা বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। মাটিতে আস্তে আস্তে নেমে আসার পর সেই ধাতব আকাশযানের একটি অংশ শাটার এর মতন সরে গেল। সেখান থেকে অদ্ভুত দর্শন ভিনগ্রহীরা নেমে এসে আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে তাকিয়ে কিছু বলতে লাগলো। সুবীর এবং রুমা দেখে কি করবে স্থির করতে পারল না। হতভম্ভ রুমা ছুটে গেল সেই ভিনগ্রহীদের যানের দিকে। পেছন পেছন সুবীরও ছুটল। এতক্ষণ যে কথা তারা বিশ্বাস করছিল না মুহূর্তেই সেই চিন্তা ভুলে নিজের একমাত্র মেয়ের সন্ধানে দুজনে ছুটে গেল সেদিকে। দুজনেই কিছু না ভেবে উঠে পড়ল সেই স্পেসশিপে। ভিনগ্রহীরা সেই দৃশ্য দেখে দ্রুত উঠে স্পেসশিপটির দরজা বন্ধ করে দিল। মুহুর্তের মধ্যে বিকট আওয়াজ করে সেই আকাশ যান উড়ে গেল দূর কোন অজানা গ্রহের উদ্দেশ্যে। একটু পরে সেই নীল আলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল মহাশূন্যের অন্তরালে। তেপান্তরের মাঠে অশ্রুসজল চোখে নির্বাক দর্শকের মত দাঁড়িয়ে রইল নবীন ।
Comments