ছোট গল্প - হাঁস নিয়ে হইচই || লেখক - চিরঞ্জিৎ সাহা || Written by Chirenjit Saha || Short story - Hans niye khela



                   হাঁস নিয়ে হইচই

                           চিরঞ্জিৎ সাহা 



সকাল থেকেই কৈলাস জুড়ে আজ মহাকেলেঙ্কারি। স্নান সেরে নিজের বই, খাতা সযত্নে ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে স্কুলে যেতে প্রস্তুত সরস্বতী কিন্তু খোঁজ নেই তার বাহন হাঁসের। একেই আগামীকাল মাঘ-পঞ্চমী তিথিতে মামাবাড়ি যাওয়ার কথা মেয়েটার , স্কুলটা কামাই হবে দু'দিন ; তার ওপর আজও যদি স্কুলে যেতে না পারে , বড় দিদিমণি রাগ করবেন ভীষণ। মেজাজ খারাপ থাকলে গার্জেন কলও করে দিতে পারেন। সবমিলিয়ে মুখেই বীণা বাজিয়ে ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল চিন্তিত সরস্বতী। 





হাঁসের হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘন্টাদুয়েক আগে সর্বপ্রথম নজরে আসে মা দুর্গার। তিনি তখন সবে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাচ্ছিলেন। রোজকার অভ্যেসমতোই একবার উঁকি দেন পাখিদের থাকার ঘরে। সেখানে পেঁচাকে বেঘোরে ঘুমোতে দেখলেও ময়ূর কিংবা হাঁসের দেখা পাননি তিনি। অবশ্য ব্যাপারটিকে তেমন আমলও দেননি। আসলে এ ঘটনা আজ নতুন নয়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার তোয়াক্কা না করে ফিগার কনসাস ময়ূর নিয়ম করে রোজ মর্নিং ফ্লাইটে যায় ভোর পাঁচটায়। তারপর কয়েক কিলোমিটার এদিক ওদিক উড়ে ফিরতে ফিরতে বেলা আটটা। হাঁসটাও ময়ূরকে সাথ দেয় মাঝেমধ্যেই ; তবে ভারী ডানা নিয়ে বেচারি উড়তে পারে না বেশিদূর , এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসতে বাধ্য হয় মর্নিং ফ্লাইট থেকে। এসব ঊষাকালের ওড়াওড়িতে অবশ্য পেঁচা নেই কোনোকালেই ; সারারাত ধরে গোটা ভূ-কৈলাস চষে বেরিয়ে সে ঘুম থেকে ওঠে বেলা এগারোটায়। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা আজ আটটা ছুঁলেও হাঁসের দেখা নেই। ময়ূরটাও ফেরেনি এখনও। এদিকে সরস্বতীর কান্নার স্বর ডেসিবেল আইন ভাঙার মুখে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মা দুর্গাও বেজায় বিরক্ত। সোজা পাখিদের ঘরে গিয়ে ডানা ধরে টেনে তুললেন পেঁচাকে ---



--- "ওই পেঁচা! ওঠ! ওঠ! গায়ে জল ঢেলে দেব কিন্তু! দিদিমণি স্কুলে যেতে পারছে না, আর উনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। "


--- " কিঃ! কিঃ! কি হয়েছে? " --- দুড়দাড় করে ঘুম থেকে ওঠে পেঁচা। 


--- " কি হয়নি সেটা বল! বেলা বাজে আটটা। হাঁসের দেখা নেই। সরস্বতী স্কুল যাবে কি করে? ময়ূরটারও তো দেখছি আজ ফেরার নাম নেই। "


--- " সে কি! ওরা ফেরেনি এখনও? "


--- " তা কি আমি তোকে মিরাক্কেলের জোকস শোনাচ্ছি? ভোরবেলা ওরা কি তোকে কিছু বলেছিল? ঠিক করে মনে করে বল! "


--- "না কত্তামা! কোনো কথা হয়নি। কাল রাতে তো আমার নামের আগে চন্দ্রবিন্দুই পড়ে যাচ্ছিল। একটা সাপকে ধরতে গিয়ে উড়তে উড়তে ভুল করে সোজা ঢুকে পড়েছিলাম মর্ত্যে। আসলে গাছগাছালির মধ্যে ঠিক খেয়াল করে উঠতে পারিনি কিনা! হঠাৎ দেখি সামনে মর্ত্যের ওই চোরা শিকারিগুলোর জাল। অনেক কষ্টে ডানাটাকে স্টিয়ারিংয়ের মতো মোচড় মেরে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছি। উফফ! বাপ রে বাপ! "


--- " তার সাথে কথা বলার কি সম্পর্ক রে হতচ্ছাড়া? তোর ভোকাল কর্ড তো এখনও খসে যায়নি , দেখছি। "


--- "ওরে বাবা রে বাবা! তারপর ওদের পাশ কাটিয়ে ইউটার্ন নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কৈলাসে ফিরে সোজা বিছানায়। " 


---" ওরা তখন ঘরে ছিল? "


--- "হ্যাঁ। বিলক্ষণ। ময়ূরটা ভসভসিয়ে নাক ডাকছিল আর হাঁসটা বেজার মুখে পড়েছিল ঘরের এক কোণে। "


--- " হাঁস কাল রাতে ঘুমোয়নি? "


--- " তাই তো ! এটা তো আগে ভেবে দেখিনি। ঘুমকাতুরে হাঁস কাল রাতে জেগে বসেছিল কেন কত্তামা? "







ইতিমধ্যেই উড়তে উড়তে হাজির ময়ূর। তাকে দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন মা দুর্গা --- " হতভাগা! কটা বাজে? ওনার এখন ফেরার সময় হল! কোন রাজকাজে ছিলেন আপনি? "


--- " ফেরার পথে শনিদেবের বাহন শকুনের সাথে হঠাৎ দেখা । একথা সেকথায় দেরি হয়ে গেল । আর আগে ফিরেই বা করবটা কী ? আপনার হিরের টুকরো ছেলে কার্তিক বারোটার আগে কোনদিন ওঠে ঘুম থেকে ? আমার আর কাজ কী সকালে, শুনি ! কাজে ফাঁকি পেলে কৈফিয়ৎ চাইবেন, দেব । তার আগে নয় ! "


নিজের রূপের রংবাহার আর পাখিদের রাজা হওয়ার কারণে ময়ূরের ঠাঁটবাট আসলে একটু বেশিই । ইঁদুর , পেঁচা বা হাঁস দেবদেবীদের ভয়ে তটস্থ থাকলেও ময়ূর চলে তার নবাবি চালে , পক্ষীকুলের রাজা বলে কথা ! দেবী দুর্গাও তাকে ঘাটান না খুব একটা । 


" তোর ঘোরা তুই ঘোর বাবা ! আমি কি বারণ করেছি ? কিন্তু হাঁসটাকে তো আগে আগে পাঠিয়ে দিবি । সরস্বতীর মর্নিং স্কুল । হাঁসটার জন্য আজ স্কুলটা কামাই হয়ে গেল । ওকে তো তোর আটটার মধ্যে পাঠানো উচিত ছিল, নাকি ! " --- বিনয়ী শোনায় দেবী দুর্গার গলা । 


--- " সে কি ! হাঁস ঘরে নেই ? ও তো আজ বেরোয়ইনি আমার সাথে । "


-- " কি বলছিস কি তুই ? ও যায়নি ? " 


--- " না । "


--- " কাল রাতে কি ও তোকে কিছু বলেছিল ? "


--- " না । তবে মন খারাপ করে বসেছিল মাটিতে । আমাকে একবার ডেকেছিল বটে কিন্তু আমি তেমন পাত্তা দিইনি । আসলে ওর ওই এক ডিপ্রেশনের গল্প আমার আর ভালো লাগে না । হাঁসের যুক্তি --- ওর না আছে আমার মতো রূপ , না পারে পেঁচার মতো উড়তে । তাই এই পক্ষীকুলে ও নাকি অপাংক্তেয় । ওর নাকি নিজেকে শেষ করে ফেলা উচিত । ওর জন্যই নাকি এই পক্ষীকুলের শ্রী কমছে । "


--- " ও কবে থেকে এসব বলা শুরু করেছে তোকে ? "


--- " অত মনে নেই মা । তবে বলে তো প্রায়ই । বিশেষ করে যেদিন রাতে নন্দীদা ভিঙ্গিদার ছিলিমে চুপিচুপি টান দিয়ে আসে , সেদিন আরও বেশি বেশি করে বলে আর ফিচফিচ করে কাঁদে । "


--- " কিঃ ! হাঁস তামাক খায় ? " 


--- " ওই মাঝেসাঝে । বাদ দিন । আমাকে ছাড়ুন । আপনাদের ঝামেলা আপনারা বুঝুন । আপনাদের হাঁসকে খুঁজুন আপনারাই । আমি ফেদার শেভ করতে একটু সেলুনে যাব । রাতে শকুনের বাড়ি নেমন্তন্ন আছে । চললাম । "--- দম্ভের সাথে ঝাঁঝিয়ে ময়ূর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে । 





ওদিকে সরস্বতীর কান্নার বৈচিত্র্য ও বাহুল্য --- দুই-ই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পেঁয়াজের দামের চেয়েও বেড়ে চলেছে দ্রুতবেগে । উপচে পড়া বাঁধের জলের মতোই অশ্রুধারাও ছিটকে পড়ছে এদিক ওদিক । তারই ফলশ্রুতিতে মর্ত্যে সেদিন প্রবল বৃষ্টি । প্রখ্যাত শিল্পী রমেন পাল নবদ্বীপ হিন্দু স্কুলের ঠাকুর নিয়ে পড়েছেন মহাফ্যাসাদে । আজ বাদে কাল সরস্বতী পুজো কিন্তু ঠাকুরের কাঁচা রং যেন শুকোতে চাইছে না কিছুতেই । একথা তিনি নিজেও অস্বীকার করতে পারেন না যে প্রতিমা তৈরির কাজে এবার হাত দিয়েছেন খানিক দেরিতে ; কিন্তু বিগত দিনে সাতদিনের মধ্যে দুর্গামূর্তি গড়ার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে আর এ তো সামান্য স্কুলের সরস্বতী । বাইরে বৃষ্টির তোড় বেড়ে চললেও ড্রায়ার আর হিটারের নিখুঁত ব্যবহারে রমেনবাবু শুকিয়ে ফেললেন গোটা ঠাকুরের কাঁচা রং কিন্তু শাড়ি পরিয়ে শোলার গয়নায় মাকে সাজাতে গিয়েই মনটা গেল খারাপ হয়ে । মায়ের চোখের কাছের ভেজা ভাবটা কেটেও যেন কাটছে না কিছুতেই । ড্রায়ার , হিটারের পর ব্লটিং --- আস্তিনের সর্বশেষ তাসটি ব্যবহারের পরও রয়েই গেল সেই জলের ছাপ , জায়গাটা যে পুরোপুরি ভেজা --- দূর থেকে দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট । বেলা পাঁচটা নাগাদ ঢাক-ঢোলসমেত হিন্দু স্কুলের ছেলেরা নাচতে নাচতে এসে হাজির হল রমেন পালের বাড়িতে । উৎসাহের আতিশয্যে তারা খেয়ালই করল না প্রতিমার চোখের নীচের ভেজা অংশ , আসলে মৃৎশিল্পীর পর্যবেক্ষণে প্রতিমা গঠনের যে ত্রুটি ধরা পড়ে অনায়াসে , সাধারণ মানুষের চোখ তা এড়িয়ে যায় অতি সহজেই । স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে কোনোরকম অতৃপ্তি না দেখে বেশ খুশিই হলেন রমেনবাবু ; যদিও কাল সকালে রোদ উঠলেই এই খুঁতটুকু মুছে যাওয়ার ব্যাপারে একশো শতাংশ আশাবাদী তিনি । 







পাখিদের ঘর থেকে বেরিয়ে মহাদেবের কাছে যাওয়ার পথে চক্ষু চড়কগাছ মা দুর্গার । রান্নাঘরের সামনে চাপ চাপ রক্তের ছাপ ! দেখামাত্রই চন্দ্রযানের বেগে ছুটে প্রেসার কুকারের চেয়েও তারস্বরে গর্জন করে দেবী দুর্গা এসে থামলেন দেবাদিদেব মহাদেবের সামনে --- " ময়ূর , ইঁদুর , পেঁচা --- ওরা তো আর হাঁসকে মারবে না । আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি , এ কাজ সিংহেরই । তাছাড়া মর্ত্যে থাকতে ও তো মাংস খেতে অভ্যস্তই ছিল । নিরীহ হাঁসটাকে একা পেয়ে আর লোভ সামলাতে পারেনি । রান্নাঘরের সামনেই ব্যাটা দিয়েছে হাঁসের ঘাড় মটকে । " সকাল থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নিজের বরের কাছে পেশ করার পর শেষ পাঁচটি লাইন এক নিঃশ্বাসে শেষ করে থামলেন দেবী পার্বতী । পার্বতীর চিৎকারে কেঁপে উঠলেন স্বয়ং দেবাদিদেব , হাতের ছিলিম ছিটকে ভেসে গেল মহাশূন্যে । নন্দী সবেমাত্র স্পেশাল করে সেজে দিয়েছিল তামাকটা ; তামাক হাতছাড়া হওয়ার রাগে মহাদেব ত্রিশূল হাতে এলোপাথাড়িভাবে পেটাতে শুরু করলেন সিংহকে । বেচারা তখন ঘুমিয়েছিল দেবাদিদেবের হাত তিনেক দূরে । কাল রাতে ভালো ঘুম না হওয়ায় সকালের চা টা খেয়ে এসেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। পার্বতীর গর্জনে ঘুম না ভাঙলেও ধড়মড়িয়ে ওঠে সে মহাদেবের মারে --- " কিঃ ! কিঃ ! কি হয়েছে প্রভু ! অমন মারছেন কেন ? "


--- " মারবে না তো কি আদর করবে ? বল, হাঁসকে মারলি কেন ? " -- রক্তচক্ষু নিয়ে প্রবল হুংকার দেবী দুর্গার । 


--- " হাঁস ? কোন হাঁস ? কিসের হাঁস, মা ? কোন হাঁসকে মেরেছি আমি ? হ্যাঁ , মর্ত্যে থাকতে মেরেছি কয়েকটাকে । কিন্তু সে তো প্রায় বছর তিরিশ আগের কথা । স্বর্গে আসার পরীক্ষায় পাশ করার পর থেকে আমি ফুল ভেজ । " 


--- "শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করিস না সিংহ ! সত্যি করে বল , সরস্বতীর হাঁসকে মারলি কেন ? " 


--- " সে কি বলছেন মা ? সরস্বতী দিদির হাঁস বেঁচে নেই ? " --- কেঁদে ফেলে সিংহ । 


--- " স্টপ ! স্টপ ! স্টপ ! এটা যাত্রাপালার মঞ্চ নয় । গুল দিয়ে ভুল ঢাকা যায় না সিংহ । এতে শাস্তি বাড়বে বই কমবে না । " 


--- " বিশ্বাস করুন মা , আমি হাঁসকে মারিনি । হাঁস তো আমার ছোটো ভাইয়ের মতো । কেন মারব আমি হাঁসকে ? "--- কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি দেয় সিংহ । 







ইতিমধ্যেই ভুঁড়ি দোলাতে দোলাতে গণেশ হাজির সেখানে --- " কি হচ্ছে কি মা ? এত চেঁচামেচি কিসের ? বেলা বাজে বারোটা । এখনও সকালের খাবারটা অবধি পেলাম না আর তুমি এখানে দাঁড়িয়ে মাথামোটা সিংহটার সঙ্গে বকে চলেছো ? খালি পেটে কি আর ভালো কাজ হয়, মা ? মহাভারত পার্ট টু-টা সবেমাত্র লিখতে বসেছি । তার মধ্যেই যদি এমন হইচই , অনাহার , চিৎকার চলে; আগের বারের মতো হিট স্টোরি লিখব কি করে আমি ? "


--- " চুপ কর তুই । রান্নাবান্না সব বন্ধ এবার থেকে কৈলাসে । সিংহ সরস্বতীর হাঁসকে খুন করে খেয়ে ফেলেছে । " --- কড়া ধমক পার্বতীর ।


--- " কিঃ ! " -- রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ছোট্ট গণেশ ।


--- " বিশ্বাস করো গণুদাদা , আমি সরোদিদির হাঁসকে মারিনি । দাদা , তুমি তো পড়াশোনা করো ; তুমিই বলো , আমি মারলে তো আমার হাতে গন্ধ থাকত । " --- সিংহের কেশর দোলানো কান্না যেন থামছে না কিছুতেই । 


--- " হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুলে কি আর গন্ধ থাকে বাপু ! "-- সিংহের গালে সজোরে থাপ্পড় পার্বতীর ।


--- " মা , তুমি বুঝলে কি করে যে সিংহ হাঁসকে খেয়ে নিয়েছে ? হাঁস তো কোথাও বেড়াতে গিয়েও থাকতে পারে । "--- শুঁড় দুলিয়ে প্রশ্ন করে গম্ভীর গণেশ । 


--- " হাঁস ওর ভারী ডানা নিয়ে বেশিদূর উড়তে পারে না রে গণু । তাছাড়া এর আগে তো কখনও হয়নি এমন , আর ও তো তেমন বেরোয়ও না । আমি নিজের চোখে রান্নাঘরের সামনে রক্তের ছাপ দেখেছি । পেঁচা , ইঁদুর বা ময়ূর তো আর হাঁসের মাংস খায় না । এ কাজ আসলে সিংহেরই , এ বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশই নেই । "


--- " ওই সস তো আমি সকালে ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুটে মাখাতে গিয়ে ফেলেছি রান্নাঘরের সামনে আর সেটাই পরে পায়ে লেগে মেঝেতে ছড়িয়ে গেছে রক্তের মতো । " --- হো হো করে হেসে ওঠে গণেশ । 






চতুর্দিক চৌচির করা চিৎকার আর হরেনডাস হইচইয়ের চোটে কার্তিক , গণেশ , লক্ষ্মী ---- সবাই বাহন সমেত হাজির হয়েছে মহাদেবের পর্বতের সামনে । সরস্বতীও এসেছে কাঁদতে কাঁদতে । তবে ও এখন বাহনহারা । স্বর্গের সেরা রিপোর্টার নারদও মাইক হাতে উপস্থিত সেখানে ।






হঠাৎ এক প্রবল প্যাঁকপ্যাঁক শব্দে মহাদেবের হেলান দেওয়া পর্বত থেকে দুটো পাথর গেল ছিটকে আর বেরিয়ে এল একজোড়া চ্যাপ্টা ঠোঁট । দেখামাত্রই চোখের জল মোছা থামিয়ে তড়িঘড়ি ঘাড় ধরে হাঁসকে সেখান থেকে টেনে বের করে আনল সিংহ --- " আমি এখানে উনার জন্য এত অপমান সহ্য করছি আর উনি বরফে ঘাপটি মেরে বসে মজা দেখছেন । আজ তোকে আমি মেরেই ফেলব । " --- হাঁসের হার্টবিট তখন সিংহের হাতে । 






--- " ছাড় সিংহ ! ওকে ছাড়! আমি যমরাজকে ডাকছি । ওকে গরম তেলের কড়াইতে ফেলে ভাজা হোক । " --- হাঁসের ঠোঁটে ট্রিমেন্ডাস টোকা দেবী দুর্গার । 


--- " তুই এতদিন ঠিকই বলতি রে… তুই সত্যিই পক্ষীকুলের লজ্জা । "--- বলতে বলতে হাঁসের ডানার কয়েকটা পালক উপড়ে ফেলে ময়ূর । 


--- " অনুমতি দেন তো এটাকে অসুরের ডেরায় পাচার করে দিই । " --- ফিসফিসিয়ে ফোড়ন কাঁটে নারদ । 


--- " আমি কিছু বলতে চাই । "--- ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে নিচুস্বরে বলে হাঁস । 


--- " কি বলবি কি তুই ? " --- ত্রিভুবন কাঁপানো মহাদেবের তান্ডব শুরুর মুখে । 


--- " অপরাধ নেবেন না , কাল রাতে আমি ময়ূরদাকে সবটা খুলে বলতেই গেছিলাম । কিন্তু পাত্তা পাইনি । পরশু ইউটিউবে নারদ নিউজে শুনলাম যে মর্ত্যে নাকি বার্ড ফ্লু চলছে ! হাঁস-মুরগির মড়ক লেগেছে । এবার তাই আমি মাঘ পঞ্চমীতে মর্ত্যে যাব না, ঠিক করেছি । কিন্তু কাল রাতে ময়ূরদা আমার কথা না শুনেই শুয়ে পড়েছিল , শেষমেষ আর কোনো উপায় না পেয়ে মর্ত্যে যাওয়া এড়াতে আজ ভোরে চুপিসারে লুকিয়ে পড়ি বরফের মধ্যে । আরও দু'দিন লুকিয়েই থাকতাম । কিন্তু এই হাঁচিটা এসেই সব গোলমাল করে দিল । "





পিনড্রপ সাইলেন্স ভূ-কৈলাস জুড়ে । 





--- " আমি আমার দোষ মেনে নিচ্ছি । আসলে পক্ষীকুলের রাজা হিসেবে এত অন্যায় দাবিদাওয়ার মুখোমুখি রোজ হতে হয় আমাকে , দু-একটা ন্যায্য আবদারও চোখ এড়িয়ে যায় মাঝেসাঝে । হাঁস মর্ত্য থেকে ভাইরাস নিয়ে ফিরলে কেবল ও নিজেই নয় ; আমি , পেঁচা , শকুন , গরুড় --- দেবলোকের সকল পাখিই প্রাণসংশয়ে পড়ব । সুতরাং, হাঁসের দাবি ন্যায়সংগত । আমাকে ক্ষমা করিস ভাই হাঁস । আমি তোর পাশে আছি । "--- পেখম দুলিয়ে ঘোষণা করে ময়ূর । 


--- " এবার তবে তোর আর মর্ত্যে গিয়ে কাজ নেই সরস্বতী মা । " --- চিন্তান্বিত দেখায় দেবী দুর্গাকে । 


--- " ভুলেও না মা । মর্ত্যে মানুষ এমনিই এখন পড়াশোনাবিমুখ । ওখানকার নেতারা চপ, পকোড়া বেচতে বলছে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের । বাজার এখন লক্ষ্মী-গণেশের । এর মধ্যে সরস্বতী ডুব দিলে ওর ব্র্যান্ডভ্যালু পড়ে যাবে আরও ; যেমনটা হয়েছে আমার সাথে --- কার্তিকটা হ্যাংলা , একবার আসে মায়ের সাথে আর একবার একলা । যদি সসম্মানে বাঁচতে চাস , ভুলেও মামাবাড়ি যাওয়া মিস করিস না বোন । "--- মাথা নিচু করে বিবৃতি দেয় কার্তিক । 


--- " কিন্তু যাবটা কিসে ?" -- ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে সরস্বতী । 


--- " আমার ঢেঁকিটা নিয়ে যেতে পারে সরস্বতী । তবে মর্ত্যের বর্ডারেই সরস্বতীকে নামিয়ে দেবে ঢেঁকি । বাকি রাস্তাটুকু ও না হয় হেঁটেই পার হবে । অল্পই তো ! বর্ডারের পরীগুলো খুব বদমাশ । ভিসা-পাসপোর্টের চক্করে একবার ফেললে ছয়-সাত ঘন্টা কাটিয়ে দেয় অনায়াসে । কাল দুপুরে ইন্দ্রের সভায় আবার মহালুডো যজ্ঞ আছে । সরস্বতীকে নামিয়ে দিয়ে এসে ঢেঁকি আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে । " --- বীণার তারে হাত বোলাতে বোলাতে প্রস্তাব দেন নারদমুনি । দেবাদিদেব সম্মত হন তাতে । 





মর্ত্যে, 



ঘড়ির কাঁটায় সরস্বতী পুজোর সকাল সাতটা । হিন্দু স্কুলের হেডমাস্টার হরিপদ হুই স্কুলের পুজোর ঘরে ঢুকেই খেয়াল করলেন , সরস্বতীর মূর্তির পাশে হাঁস নেই । ইলেভেন সায়েন্সের সমস্ত ছাত্রকে ডেকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করলেন তিনি । তার ধারণা ছিল যে , ছেলেরা হাঁস আনতে ভুলে গেছে কুমোরবাড়ি থেকে । কিন্তু প্রতিমা টলিতে তুলতে গিয়ে হাঁস ফেলে দেওয়ার ঘটনা শুনে রাগ গেল চড়ে সপ্তমে । সবার সামনেই দুটো ছেলের গালে বসালেন চূড়ান্ত চড় । বন্ধ করে দিতে চাইলেন পুজো । অবশেষে পুজোর দায়িত্বে থাকা বিনয় বটব্যালের হস্তক্ষেপে শান্ত হন হেডমাস্টার । শেষমেষ পুজো তো বন্ধ হয়ইনি । উপরন্তু উদ্ভূত প্রতিকূল পরিস্থিতি দারুণ বুদ্ধিমত্তায় সামলে নেন বিনয়বাবু । 






হিন্দু স্কুলের পুজোর থিমের গল্প এবার এক দুপুরেই ছড়িয়ে পড়েছে গোটা শহর জুড়ে । সন্ধ্যা হতেই নেমেছে দর্শনার্থীর ঢল । আছেন প্রধানশিক্ষক হরিপদ হুই । ভিড় সামলাতে রীতিমতো হিমসিম অবস্থা বিনয় বটব্যালের নেতৃত্বে ইলেভেনের ছাত্রদের । প্রতিমা দর্শনে এসেছেন মৃৎশিল্পী রমেন পালও । মাফলার জড়িয়ে অধোবদনে লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি । একে সরস্বতীর চোখ ভেজা , তার ওপর হাঁস নেই --- নিজের কোনো দোষ না থাকলেও একটা অজানা অপরাধবোধ ভোগাচ্ছে শিল্পী রমেনবাবুকে । সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে লাইন শেষ করে পুজোর ঘরে ঢুকতেই চক্ষু ছানাবড়া তার । মায়ের মুখের সেই ভেজা ভাবটা তো আর নেই-ই , উপরন্তু ফুটে উঠছে ভুবনমোহিনী এক অদ্ভুত হাসি যা তার তুলিরও অসাধ্য । আসলে হাজার ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা পেরিয়ে মামাবাড়িতে আসার পর থেকে সরস্বতী মায়ের মনে আনন্দের যে অমরাবতী বয়ে চলেছে --- তা রমেন পালের পক্ষে অনুমান করা সত্যিই অসম্ভব । 






চমকের শেষ এখানেই নয় । ঘরের একপাশে প্রজেক্টরে চলছে বার্ড-ফ্লুর বিশ্লেষণ । ঘর জোড়া বার্ড-ফ্লুর কাট আউট আর মা সরস্বতীর প্রতিমার পায়ের কাছে লাল কালিতে বড়ো করে লেখা --- " বার্ড ফ্লুর দরুন হিন্দু স্কুলে এসে এবার পৌঁছতে পারেননি দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস । আমরা তাই একান্ত ক্ষমাপ্রার্থী সকল দর্শনার্থীর কাছে । "







                  


                  

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024