আমি পুনরায় ছিটকে পড়লাম। এইভাবে আমি প্রায় ত্রিশ মিনিট লড়াই করলাম। আমি আর পেরে উঠতে পারলাম না। জলস্রোতের মত রক্ত বয়ে যাচ্ছে শরীরে। ক্ষত- বিক্ষতের যন্ত্রণায় আমি কাহিল হয়ে পড়লাম। ভাবলাম আমার মৃত্যু অনিবাৰ্য্য, শেষ চেষ্টাতেও আমি পেরে উঠতে পারবো না। বাঘিনীর অগ্নিশর্মা চক্ষুখানি অস্পষ্টভাবে দেখছি, সে আমাকে এবার শেষ করে দেবে। সে পুনরায় আক্রমণ করতেই কোথা হতে যে একটা গুলি বাঘিনীর মাথায় লাগলো, দ্বিতীয় শব্দ শুনতেই আমি অজ্ঞান হলাম। তারপর আমার মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম এক জমিদার বাড়ীর অন্দর মহলে শিল্প কারু কার্য্যে নির্মিত পালঙ্কের উপর শুয়ে আছি। পাশে বসে আছেন তোমার বাবা সীতাংশুবাবু ও একজন কবিরাজ। তোমাদের পরিবারের সেবা যত্নে, তোমার দাদুর আশীর্বাদে ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। একমাত্র তিনিই আমাকে প্রাণ দান করেছিলেন।
সেই মুহুর্তে যদি বাঘিনীকে গুলি না ছুঁড়তেন তাহলে আমার বাঁচার কোন উপায় ছিল না। আমি যতদিন তোমাদের বাড়ীতে ছিলাম তুমি আমার মনকে জয় করেছিলে। তখন তোমার অল্প বয়স মা। ঐ বয়সে তোমার অনেকখানি আদর আপ্যায়ণ পেয়ে অতি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছিলাম।
তোমার শ্রদ্ধা-ভক্তিতে তুমি আমার মনকে জয় করেছিলে তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব করেছিলাম যাতে ভবিষ্যতে তোমাকে পুত্রবধূ রূপে পেতে পারি। সীতাংশুবাবু আমার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে ছিলেন। সেই জন্য বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করে বিদায়ের আগের দিন তোমাকে পুত্রবধূ বন্ধনে অঙ্গীকার করে বাড়ী ফিরেছিলাম। ষষ্ঠীচরণ সুস্থ অবস্থায় বাড়ীতে হাজির হয়েছিল সে খবর পেয়ে ছিলাম।
নানা ব্যাস্ততার মধ্যে দিন, মাস, বছর নদীর স্রোতের মত পেরিয়ে গেল। ব্যবসার উন্নতির জন্য শিকারী মন লুকিয়ে গেল। তোমাদের পরিবারের লোকদেরও ভুলে গেলাম। দেবীদাস বিবাহযোগ্য হলে পর তোমাদের গ্রামে অর্থাৎ চন্ডীপুরে সুশীলবাবুকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের কোন খোঁজ খবর না পাওয়ার জন্য গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলাম।
তাছাড়া দেবীদাস বেপথগামী হওয়ার জন্য আমি ধৈর্য্য হারা হয়েছিলাম মা। সুশীলবাবু তখন কুশল বাবুর মেয়ে চন্দার সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। তবে মা তুমি ও চন্দ্রা যেন একই মায়ের সন্তান, তোমরা যেন যমজ বোন। অপূর্ব মিল তোমাদের। সেই মুখ, সেই রূপ চেহেরা কোন কিছুর অমিল নেই মা।
এমন সময় কুশল বাবু বলে উঠলেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন বিয়াই মশাই। চন্দা ও রমা একই মায়ের সন্তান। ওরা যমজ বোন। তবে আমার চন্দ্রা মাকে হারিয়ে ফেললাম। কুশলবাবুর চোখ হতে জল ঝরতে শুরু করল, তিনি কেঁদে ফেললেন।
হেমন্তবাবু কুশল বাবুর হাত দুটো ধরে বললেন, আমি এর জন্য গভীরভাবে মর্মাহত। আমায় ক্ষমা করবেন, আপনার প্রতি আমার অসৎ ব্যবহারের জন্য। আপনার সম্মান আমি ক্ষুন্ন করেছি। তার জন্যও আমি অনুতপ্ত। আপনার হাতে ধরে বলছি, দেবীকেও ক্ষমা করবেন। তার শাস্তি সে হাড়ে হাড়ে পেয়েছে।
তবে আমার কৌতুহল থেকে যাচ্ছে, চন্দ্রা ও রমা যমজ সন্তান এ কি করে সম্ভব আমাকে জানতে হবে।
কুশলবাবু চোখের জল মুছে বললেন, হ্যাঁ ওরা যমজ মেয়ে। ঘটনা হলো, সীতাংশুবাবু আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন। চন্ডীপুর মাটিতে আমাদের বাস ছিল। একই সাথে স্কুলে পড়েছিলাম। বাবার চাকুরী সুত্রে আমাদের পরিবারকে কলকাতায় আসতে হয়েছিল। কলকাতায় এসেও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল বহু দিন। কলকাতায় এসে আমার বাবা এক সময় চরম নেশায় পড়লেন রেস খেলায়। যাকে বলে এক রকম জুয়ো খেলা। আমার পড়াশুনা আর হল না, মায়ের কথা মত আমাকে কাজ কর্মের চেষ্টা করতে হলো।
ছোট এক প্রাইভেট কারখানায় চাকুরী পেলাম। কিছু দিন পর বাবাও এক সময় চিরতরে বিদায় নিলেন। তখন আমার প্রথম সন্তানের বয়স মাত্র চার বৎসর। আমার পত্নী চির রুগী। যমজ কন্যার জন্ম দিতে গিয়ে সে বিদায় নিলো। তখন আমি ঘোর বিপদে পড়লাম। চার বৎসরের সন্তান এবং যমজ কন্যাকে কি করে মানুষ করবো।
দিবারাত্রি মাথার কোষে কোষে চিন্তা, কি করে ওদের মানুষ করবো। এই বিপদে কে আমাকে রক্ষা করবেন। কে এমন হৃদয়বান পুরুষ আছেন এই বিপদে রক্ষা করবেন! হঠাৎ আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুকে পত্র দিয়ে আমর বেদনার কথা জানালাম। তিনি পত্র পাওয়া মাত্র সস্ত্রীক আমার ব্যাথার ভুবনকে উপশম করতে ছুটে এলেন এবং আমার দুর্বিসহ যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিলেন রমাকে কোলে তুলে। রমাকে মানুষ করার দায়িত্ব স্কন্ধে নিয়ে চন্ডীপুরে হাজির হলেন।
চন্দা আমার বিবাহযোগ্যা কন্যা হলো। সুশীলবাবুর কথায় দেবীদাসের সাথে বিয়ে হলো কিন্তু শান্তি পেল না। তাকে একদিন মরতে হলো। কুশলবাবু কেঁদে ফেললেন। গরীব বলেই হেমন্তবাবু সম্পর্ক রাখলেন না। চন্দা যে জননী হয়ে ছিল তাও জানতাম । হেমন্ত বাবুর রুদ্ধদ্বারকে অতিক্রম করতে পারিনি।
সুশীলবাবু কুশল বাবুর হাত ধরে বললেন, অতীতকে এবার বিরতি দিন কুশলবাবু। আপনার ছোট মেয়ে রমাকে কাছে টেনে আশীর্বাদ করুন যাতে সে সুখী হয়।
কুশলবাবু পুনরায় চোখের জল মুছে বললেন, আয় মা আমার কাছে আয়। রমা কুশলবাবুর বুকে মুখ লুকালো। রমার বুকের ভেতরে থেকে যেন কান্নাকে ঠেলে নিয়ে এলো।
কুশল বাবু বললেন, আর কান্না নয় মা।
হেমন্তবাবু বললেন, অনেক কেঁদেছো মা। আজ তোমাকে কথা দিতে হবে, ময়নাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। ওকে মানুষ করার দায়িত্ব তোমার উপর দিলাম। আর আমাদেরও প্রতি একটু নজর রাখবে মা।
রমা হেমন্তবাবুকে প্রণাম করে বলল, বাবা আপনি আমায় আশীর্বাদ দিন আমার এই মরুময় জীবনে যেন কোন দিন আর মর্মর ধ্বনি না আসে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, ঝঞ্ঝা বিধস্ত হয়ে আপনার চরণে স্থান পেলাম।
হেমন্তবাবুর স্নেহ ও আশীর্বাদ কোনদিন বিফল হবে না মা। তুমি নিশ্চয় সুখী হবে। জয়ন্ত তোমার বোনকে আদর করবে না?
জয়ন্তর চোখ দুটো ছল ছল করছিলো। কোন কথা না বলে সজল চোখে বলল,
আয় বোন কাছে আয়। তুই আমার চন্দা বোনের শূন্যস্থানকে পূরণ করলি।
রমা জয় ওকে প্রজাত করতে উদ্যত হতেই জয়ন্ত বলল, ওখানে নয়, আমার বক্ষে আয়। আমার হৃদয় যন্ত্রণাকে লাঘব করি। তোর অতীতকে ভুলে যাবি বোন। তোর অদৃষ্টের নির্মম পরিঘাতকে মনে রাখবি না। নতুন জীবন শুরু কর বোন।
কুশলবাবু বললেন সান্ত্বনা দিয়ে, বিধির বিধান কেউ খন্ডন করতে পারে না মা। হঠাৎ এক সময় ময়না বেড় হতে নেমে আঁচল ধরে টান দিয়ে বলল, মা আমায় বাড়ী নিয়ে চলো, আমি এখানে থাকবো না।
রমা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, হ্যাঁ মা, এখানে তোমাকে আর রাখবো না। আজই তোমাকে বাড়ীতে নিয়ে যাবো।
হেমন্তবাবু, সুশীলবাবুকে বললেন, চলুন সুশীলবাবু, ডাকতারের অনুমতি নিয়ে আমার নাতনী ময়না, ও আমার একমাত্র বৌমাকে নিয়ে বাড়ী মুখে রওনা হবো। তবে তার সাথে আপনার উপর ভার দিলাম, আমি আমার বৌমার আগমনের আনন্দবার্তা জানিয়ে আজ রাত্রে ভোজের আয়োজন করবেন।
কুশলবাবুর হাত দুটো ধরে কাতরস্বরে বললেন, আপনি, জয়ন্ত আমার এই ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আমার হৃদয়কে আনন্দ দান করবেন এই আশা রাখি। চলুন আমরা সকলে বাড়ী মুখে রওনা হই।
দেবীদাস তুমি দেরী না করে রমা ও ময়নাকে নিয়ে এসো। আমরা তোমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছি।
সকলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। রমা তখনও ময়নাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। দেবীদাস ওর কাছে গিয়ে বলল, ময়নাকে আদর করবে, আমাকে করবে না? রমা দেবীর বুকে মুখ লাকিয়ে বলল, দেবীদাস
রমার মুখে দেবীদাস ডাক শুনে ভেতর থেকে কান্নাকে যেন ঠেলে নিয়ে এলো, কিন্তু কাঁদতে পারল না। কান্নাভেজা গলায় বলে উঠল আজ এই সুমধুর ভালোবাসায় আমার ও তোমার সমস্ত গ্লানিকে মুছে দিলাম রমা। হাজার লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা, দুঃখ, বেদনাকে অতিক্রান্ত করে আমার হৃদয় মন্দিরে স্থান পাবে আমি জানতাম। আমার ভালোবাসা ক্ষণভঙ্গুর নয়। এ ভালোবাসা শাশ্বত, চিরন্তন। সে জন্য তোমায় বলে রাখছি, তুমি আমার মানস সরোবরে পদ্ম হয়ে চিরদিন ফুটে থাকবে। আর “পদ্মাবধূ” হয়ে আমার হৃদয়ে অনন্তকাল গাঁথা থাকবে। অনন্তকাল গাঁথা থাকবে। অনন্তকাল গাঁথা থাকবে।
No comments:
Post a Comment