তেনারা তখনও ছিলেন - তপন তরফদার || Tenara tokhono chilen - Tapan Tarapdar || গল্প || Story || shorts story || ছোট গল্প

 তেনারা তখনও ছিলেন

              তপন তরফদার



অনেকেরই মনে হতে পারে হ্যাল্যুশন পার্টি সবে শুরু হয়েছে যাকে আধুনিক সভ্যতার ফল বলে মনে করেন। বিশেষ করে ম্যাককামি ম্যানর যিনি ভয়ের বাড়ি তৈরি করে ইদানিং বিখ্যাত হয়েছেন। ওই ভয়ের বাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো বাড়ির রন্ধে রন্ধে ভয় পাওয়নোর ব্যবস্থা করা আছে। মনে রাখতে হবে ওই বাড়িতে ঢুকতে গেলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিতে হবে, প্রমাণ করতে হবে যে তিনি সবদিক থেকে সুস্থ। এই বাড়িটা আমেরিকার টেনিসোতে। পৃথিবীর এখন হব থেকে ভয়ংকর ভয়ের বাড়ি বা ভুতুড়ে বাড়ি। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় “তেনারা তখনও ছিলেন “।


        মানুষ ভয় পেলেও ওই পুরোনো আমল থেকেই ভুতের গল্পগুজব বলে, শোনে। মানুষ অভ্যাসের দাস এটা পুরানো কথা। এই যুগে আমরা ভাবতেই পারিনা বেশ কিছু মানুষ একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ গোল গোল করে কান খাড়া করে ঘন্টার পর ঘন্টা শুনে যেত যা এখন বিস্ময়কর, অবিশ্বাস্য। বেশ কিছুকাল আগের কথা তখনকার দিনে গ্রামের বয়স্ক মাতব্বররা চন্ডীমন্ডপে গল্পের আসর বসাতো। সেই সময়ে আনন্দে অবসর কাটাবার সহজ সরল খরচা বিহীন মজলিস এই গল্পকথনের আসর। প্রায় সবাই ভিড় ক'রে উৎসুক হয়ে গল্প শুনতো। এই আসরে মাতব্বরি বজায় রাখতে মাতব্বররা ঘরে তৈরি বিভিন্ন পদের উপাদেয় খাবার। যেমন-চিচুয়া, ধূপি, ক্ষীর, পাকান, চাপড়া ইত্যাদি। তাল থেকে বড়া, ,তালরুটি ইত্যাদি বিতরণ করতো।


           সেদিনটা ছিল লক্ষ্মী পুজোর পরের দিন। আকাশের চাঁদ একেবারেই রুপোর থালার মতো। চাঁদের জ্যোৎস্না, চারিদিকে মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। আজকে গল্প বলতে পাশের ফুলিয়া গ্রাম থেকে একজন আসবে। সে নাকি খুব ভালো গল্প বলে সবাইকে বুঁদ করে রাখে। খবরটা গ্রামে চাওড় হয়ে যাওয়ার ফলে গ্রামে একটা হইচই পড়ে যায়। সন্ধ্যা সবে হয়েছে লোকজন আসতে শুরু করেছে। সব থেকে বড় বিস্ময়কর ব্যপার বড়দের হাত ধ'রে কয়েকজন কিশোর ছেলেরাও এসেছে। সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। মোড়ল সাহেব নিজে তদারকি করছেন। আজকের বিশেষ অনুষ্ঠানে সবাই যাতে মোড়লের নজরে আসে মড়োলগিরি বজায় রাখতে নিজেই মুড়ির সাথে তালশাঁস খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে। চন্ডীমন্ডপটা একবার ঘুরে দেখে গেলেন, সব ঠিকঠাক আছে । এই বিশেষ অনুষ্ঠানে এই গ্রামের দুজন ও গল্প বলবে। যার ফলে সবাই ধরে নিয়েছে বকলমে এটি একটি প্রতিযোগিতা হবে। যার জন্য এত আয়োজন সেই আসেনি। দর্শকদের মধ্যে একটা ফিস ফিসানি ও বেটা ভয় পেয়ে আসেনি। মোড়ল বেশ বিনীত গলায় বললেন, ফুলিয়া গ্রামের পাঁচকড়ি পায়ড়া আসলেই শুরু হবে আজকের আসর।

        অবশেষে উপস্থিত হল পাঁচকড়ি। মাথায় জটা, শনের মতো দাড়ি গোপ মেয়েদের চুলের বিনুনির মতো কায়দা করে বিনুনী করা একজন লোক। বয়স আনুমানিক কত হবে বোঝা যাচ্ছে না। লম্বাটে গড়ন। ওকে দেখেই সকলের মনে একটা অন্যরকম অনুভূতি হল। সবাই ব্যাকুল হয়ে পড়লো তাঁর মুখ থেকে গল্প শোনার জন্য। কিন্তু এখনই নয়। কারণ আজকের আসরের কেন্দ্রবিন্দু ওই পাঁচকড়ি পায়ড়া ওর গল্প আগে হয়ে গেলে আসরটা আর জমবে না। সবাই তাই এখানকার লোকেরাই প্রথমে গল্প বলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর ফিসফাস শুরু হল। তারপর কথা বলাবলি।

শ্রোতাদের গল্পমুখী করতেই পারলেন না। গল্প শেষ করার আগেই তাঁকে আসর গোটাতে হলো।


             পরের জনের জন্য মোড়ল অনেক ভালো ভালো কথা বলে এর গল্প শুনতে বলল। গ্রামের দ্বিতীয় জন শুরু করলেন গল্প। এবার মানুষ হইচই করছে না। গল্প বলিয়ে ভাবলেন মানুষ মনযোগ সহকারে শুনছে। কিন্তু না। এই গল্প আসলে ও আগেই এখানেই বলেছে। রাতও একটু হয়েছে। এক এক করে শ্রোতারা ঘুমিয়ে পড়ছিল। তাই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল আসরে। মোড়ল ব্যাপার টা বুঝতে পেরে গল্প বলিয়ের হাত চেপে ধ'রে ঈশারায় বন্ধ করার ইঙ্গিত দিলেন। মোড়লের ইশারা না মানলে পড়ে বিপদে পড়তে হবে বুঝেই ও তাড়াহুড়ো ক'রে,”আমার গল্প ফুড়ালো, নটে গাছটি মুড়ালো” বলে শেষ করল।


 


মোড়ল এবার পাঁচকড়ি পয়ড়াকে সাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার গ্রামের বসবাসকারিগন, আপনারা মন দিয়ে উনার গল্প শুনে যেন আমাদের গ্রামের সুনাম বজায় রাখবেন সবাই।


           পাঁচকড়ি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের গল্পগুজব করে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে ও বুঝে গেছে কিভাবে শুরু করতে হয়। কিভাবে কি কথা বললে লোকের আগ্রহ হবে তা রপ্ত করেছে। এখন ভয়পাওয়নার গল্প অর্থাৎ ভূত বা অশরীর গল্প সবাই শুনতে চায়।


    জটায় হাত বুলিয়ে ঝুলন্ত শনের দড়ির মতো দাড়িগুলোতে বিনুনীর মতো পাকাতে পাকাতে বলল,,' আপনারা কি জানন, আপনাদের গ্রামের আদি কথা? মোড়োল মশাই আপনি জানেন। মোড়ল ঘাবড়ে যায়। কি বললে ভালো হয় ভেবে পায়না। পাঁচকড়ি নিজেই বলে আমার দাদুর দাদুর নাম ছিল এককড়ি, তার ছেলের নাম দুকড়ি এই ভাবে কড়ি বাড়তে বাড়তে আমি পাঁচকড়ি । আমাদের প্রথম পুরুষ এককড়ি এই অঞ্চলের অনেক গ্রামের জন্মগত নাড়ি নক্ষত্র জানতেন। এই ইতিহাস আমারই বংশপরস্পরায় জানি এবং সবাইকে জানাতে চাই। সবাই মন দিয়ে শুনুন।একটা কথা, যারা ঘুমোতে চান দয়া করে বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। যারা ভয় পান তারা এই গল্প না শুনে বাড়ি চলে যান। মোক্ষম এই কথা শুনে যারা ঢুলুঢুলু করছিল তারা চোখে একটু ভাপ দিয়ে সজাগ হয়ে বসলো। আর সকলের সামনে ভীতু কেউই হতে চায়না তাই সবাই বসেই থাকলো গল্প শোনার জন্য।


            পাঁচকড়ি গলার স্বরটা জোরালো করে বলতে শুরু করলো, -এই গ্রামে একটি মাত্র পাড়া ছিল। বাকি সব রাস্তার দু-ধারে বন জঙ্গল। দিন দুপুরে খেঁকশিয়াল, হায়না চ'রে বেড়াত। সুযোগ পেলেই গরুর বাচ্চা, ছাগল মুরগি খেয়ে ফেলত। রাত্রি বেলায় বাড়ত দৌরাত্ম্য। মা'য়ের কোল থেকে শিশুকেও ছিনিয়ে নিত। গ্রামের মাঝখানে যেখানে এখন স্কুল , ওইখানেই পাশাপাশি ছিল দুটি গাছ। একটা আশ্যওড়া আর একটা বেলগাছ। দুটো গাছই চোখে পড়ার মতো। আশেপাশে বাড়ি ঘর তেমন ছিল না। তার কিছুটা দুরে সদ্য দু-একটি চালাঘর সবে গজিয়ে উঠেছে।। চালাঘরের লোকেরা দেখেছে আশওড়া গাছে পেত্নী আর বেলগাছে ব্রম্ভদত্যি বাস করতো। পেত্নি ভাব করতে চাইলেও ব্রহ্মদৈত্য বলতো বেজাতের মেয়ের সঙ্গে কখনোই ঘর বাঁধবোনা। পেত্নি মনের দুঃখে ওই বেলগাছের ডালেই গলায় দড়ি দিয়ে আবার মরে ছিল। আশেপাশের লোকেরা লাশটি দেখেছিল।


             শ্রোতাদের গা শিউরে উঠল। কথা বন্ধ সবার। কেউ কেউ তো দরদর করে ঘামছিল। ভয় পেয়েছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা। সবাই ভীতু বলবে হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেছে তাও কেওই নড়াচড়া করছেনা। 

      

         পাঁচকড়ি বুঝে গেল তার কথা লোকে গিলছে এবার ফিসফিস স্বরে ভৌতিক গলায় বলতে লাগলো একটা ঘটনা বলি যেটা আপনারা মনে রাখবেন। 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024