Sunday, July 31, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -13


 


পাঁচ 


পরদিন রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাত। আমার চোখের জল তখনও শুকায়নি । সারা রাত কেঁদে কেঁদে মুখাবয়ব বিকৃত করে তুলেছিলাম । শুষ্ক পুষ্পের ন্যায় মুখের রূপলাবণ্য নষ্ট হয়ে গেছিলো । মনে মনে বিদ্রোহী হলাম , কোন মতেই আমি দেহপসারিনী হয়ে সমস্ত নারী সত্ত্বাকে বিসর্জন দিতে পারব না। 


পুরুষের অত্যাচার কোন মতেই সহ্য করতে পারবো না । সেই সময় আমি আত্মহননের কথা চিন্তা করছিলাম । জানবো কলকাতায় চাকরী করতে এসে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছি । বাবার জন্য মনটা আরো কেঁদে উঠল ! তবুও আমি মরবো। 

ক্ষণিকের জন্য সব কিছু মায়া ত্যাগ করে লুকিয়ে গলায় ফাঁসি দিতে উদ্যত হলাম । কিন্তু আমার শুভাকাঙ্খীনী শ্যামলীদি আমাকে মৃত্যু হতে বাঁচালেন । নইলে বেশ সুযোগই পেয়েছিলাম আত্মহত্যা করার । যেই ঝুলে পড়ার চেষ্টা করেছি , কোথা হতে যে তিনি ছুটে এলেন জানতে পারিনি । ভেতরে প্রবেশ করে আমাকে ও অবস্থায় দেখে রাগে অভিমানে দারুন জোরে বাম গালে একটা চড় মেরে বললেন , মরতে চাইছিস না ? গত রাত্রে কি বললাম ? আমাদের শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তাই দেখতে হবে। 

আমি মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকি । কিছুক্ষণ পর সস্নেহে আমাকে বললেন , জানিস ? ইচ্ছে করলে আমিও মরতে পারতাম , এই বাম হাতের মধ্যমা অঙ্গুলিতে আংটিটা দেখছিস্ এটা হীরার । যখন খুশী মরতে পারতাম । কিন্তু মরব না প্রতিশোধ নেব । সেই অপেক্ষায় বেঁচে আছি । বিশ্বাসঘাতকার দন্ড পল্টু কে পেতে হবে । সহসা তার চোখ দুটো হতে যেন আগুন বেরিয়ে আসতে লাগলো। 


একটু পর নিজেকে শান্ত করে পুনরায় বলল , তুই পল্লীর মেয়ে , এতো ছলাকলা বুঝিস্ না । সকলকে বিশ্বাস করিস বলে তো রন্টুকে দাদা বলে গ্রহণ করেছিলি , আর আমি ? কলকাতা শহরের শিক্ষিতা মেয়েও পল্টুর চালাকি বুঝতে পারিনি । বুঝতে পারিনি তার বিজনেস , বুঝতে পারিনি তার শাট্য ও বিশ্বাসঘাতকতাকে । সরল অন্তঃকরণে পল্টু কে অনুসরণ করেছিলাম । এমনকি ওর জন্য দেবতুল্য বাবা ও দাদাকে ত্যাগ করতে কুণ্ঠাবোধ করিনি। 

তথাপি -শ্যামলীদিদির চোখ দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরুতে থাকল । রাগে অভিমানে ও উত্তেজনায় তার অধরকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরলো । আমি আনত মুখে স্থির হয়ে বসেছিলাম । এক সময় শান্ত হবার পর বললেন , সমস্ত ঘটনা না প্রকাশ করলে বুঝতে পারবি না । হয়তো এই কাহিনী শুনে মনকে একটু হালকা করতে পারবি । আর আমিও তোর কাছে প্রকাশ করে সাময়িকভাবে শান্তি পাবো । শ্যামলীদি বলতে শুরু করলেন।

 বি.এস.সির পরীক্ষার পর বাড়ীতে বসে আড্ডা দিত শ্যামলী । একদিন আবদার করে ওর বাবা বললেন , মিছেমিছি বাড়ীতে বসে কাজ নেই । তার চেয়ে তোর দাদার চেম্বারে যোগ দিলে ওর অনেক উপকার হবে । ওকথা শুনে তার মন আনন্দে নেচে উঠলো । কারণ শ্যামলী জনসেবায় নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে পারবে বলে। 

ধীরে ধীরে চিকিৎসা বিদ্যার বহু কাজে পারদর্শীতা অর্জন করল । দাদা সুভাষবাবু ভীষণ ভালোবাসতেন ও অহংকার করে বলতেন , শেষ পর্যন্ত শ্যামলী তার মতোই একজন ডাক্তার হয়ে উঠবে । কিন্তু শ্যামলীর এম.এস.সি. পাস করার ভীষণ ইচ্ছে। 


একদিন কথার ছলে বলল , ডাক্তার হয়ে আমার কাজ নেই । এম.এস.সি. পড়ে অধ্যাপিকা হব । কাজের মধ্যে ডুকে থেকেও ভাই বোনের তর্কবিতর্ক চলত । এভাবে কয়েকটা মাস সুন্দরভাবে কেটে গেল। 

একদিন ওর দাদার অনুপস্থিতিতে চেম্বারে একজন বলিষ্ঠবান যুবকের আবির্ভাব ঘটল । তার পরিচয় তিনি একজন Medical Representative, গৌরবর্ণ চেহারা,
মুখশ্রী বেশ সুন্দর , সুঁচালো নাক , করুণ চাহনী , ভূ - গুলো যেন কোন মৃৎশিল্পী দিয়েছেন । মুখে মিষ্টি হাসি । ওর চেহারা দেখে এক অজানা আকর্ষণে ওর প্রতি হয়ে উঠেছিলো শ্যামলীদি। মনে হয়েছিলো তার হারানো প্রেমিককে যেন ওর মধ্যে খুঁজে পেলেন। চেহারার কোন পার্থক্য নেই। মনে হলো ওর যমজ ভাই যেন ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার ডাকে চমকে উঠলো, সুভাষবাবু আছেন?

দাদা বাইরে গেছেন।

আজ ফিরবেন? 

না, কোন দরকার থাকে তো বলে যেতে পারেন।

দরকার মানে , এই মাসে এই সব ঔষধগুলো বের হয়েছে । ব্যবহার করতে বলতাম। আমাদের কাজ তো বুঝতে পারছেন। 

যদি আপত্তি না থাকে আপনার শ্যাম্পলগুলো দিয়ে যান দাদাকে দেব । ভদ্রলোক কাল বিলম্ব না করে ঔষধের উপকারিতা বুঝিয়ে বললেন । ওর মধুক্ষরা বানী আমার তৃষিত প্রাণে শান্তির বারি সিঞ্চন করল। ওর কথাগুলো শুনে ওকে বিজ্ঞ বলে মনে করল। 

তার নাম ঠিকানা জানতে চাইলে পর তিনি একটা Identity Card দিলেন । ওতে লেখা পি . বিশ্বাস ও নীচে ঠিকানা । তার কাজ শেষ হবার পর বিদায় নেবার জন্য ছা ছটপট করতেই শ্যামলীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।

যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ? তিনি বললেন।

স্বাচ্ছন্দে বলতে পারেন।

আপনার কোন যমজ ভাই আছে?

 না , আমার কোন ভাই বা বোন নেই । পিতা মাতার একমাত্র সন্তান আমি । কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন করলেন কেন বলুন তো?

একটু লজ্জায় পড়ল শ্যামলী । একটু আমতা আমতা করে বলল শ্যামলী , ঠিক আপনার মতো একজন লোককে দেখেছিলাম । তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।

আচ্ছা আজ উঠি, হাতে অনেক কাজ।

অনিচ্ছা সত্বেও তাকে বিদায় সম্বৰ্দ্ধনা জানালো শ্যামলী। তিনি অদৃশ্য হবার পর শ্যামলী বিগত জীবনের ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতি তাকে উতলা করে তুলল । বাঁধ ভাঙ্গা জলের মতো আমার অবরুদ্ধময় প্রেমের বন্যা গতিময় হয়ে উঠল।

মনে পড়ল সলিলের কথা । সলিল আমার কলেজের ক্লাসমেট , একই সাথে পড়াশুনা করতাম । ওকে দেখতে ঠিক পি . বিশ্বাসের মতই । সলিলের ভালোবাসা আমার অজ্ঞাত অন্ধকারাচ্ছন্ন পথকে যেন আলোক বর্তিকা দেখিয়ে উদ্ভাসিত করে তুলেছিল। কিন্তু বিধাতার অমোঘ বিধানে কালবৈশাখী ঝড়ে আমাদের সুখের নীড় গেল ভেঙ্গে। আমাদের রঙীন আশা ও স্বপ্ন মলিন ধূসরে পরিণত হলো। বিবর্ণ হলো আমাদের গভীর ভালবাসার কথা। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে সেিলর জীবন, সমাধিতে পরিণত হল। সলিলের কথা মনে আসতেই কিছুক্ষণের জন্য ঐ স্বপ্ন বিভোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কোন কাজেই মন বসছিল না তার। ওর সদা সর্বদা মন দৌড়াতে থাকল।




                                 ক্রমশ...

Saturday, July 30, 2022

ছোট গল্প - অবশেষ সূর্যোদয় || লেখক - রানা জামান || Short story - Obosese Suryaudai || Written by Rana Zaman


 


অবশেষ সূর্যোদয়

রানা জামান




অপেক্ষার উত্তাপে আমন্ত্রিত অতিথিদের মেজাজ এখনো তপ্ত হয়নি তেমন। দুপুর দুটো বাজলেও বরপক্ষ এখনো আসেনি। পুরুষদের ক্ষিধেয় পেট চো চো করলেও উচ্ছল মেয়েদের দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। ওরা কণেকে ঘিরে ঠাট্টা-তামাশায় মজে আছে। হাসি তামাশায় ক্ষুধা এড়ানো গেলেও তৃষ্ণা এড়ানো যায় না; বরঞ্চ গলা শুকিয়ে যায়। দু'জন তরুণী নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে পানি আনতে যাচ্ছে খাবারের কোণায়। 

কণেপক্ষের আমন্ত্রিত অতিথিদের কতক খাবার টেবিলে বসে গল্প করছে, কতক এদিকওদিক ঘুরাঘুরি করছে, কেউবা দূরে গিয়ে ধূমপান করছে। তাঁবুর বাহির থেকে দুজন যুবক ওদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। 

এক যুবক জিজ্ঞেস করলো, বাহ! খুব সুন্দর তো! খিদা লাগছে?

একটা মেয়ে জবাব দিলো, পানি আনতে যাচ্ছি। 

অপর যুবক বললো, তোমরা কষ্ট করে এদিকে আসলা কেনো! আমদের বললেই পানি আইনা দিতাম!

অপর তরুণী বললো, আপনাদের চিনি না, জানি না! আপনাদের পানি আনতে বলবো কেনো? 

তরুণী দু'জন যুবকদ্বয়কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। যুবক দুটো উড়ো চুমু ছুড়ে দিলো ওদের দিকে। তরুণী দু'জন দুই বোতল পানি সংগ্রহ করে অন্যদিক দিকে চলে গেলো কণের কাছে। মিনিট দশেক পরে আরো দুই তরুণী ঐপথে পানি আনতে গেলে সেই যুবক দুটো ওদের পথ আটকে বিভিন্ন ধরনের ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে লাগলো। এক সময় যুবক দুটো ওদের ঝাপটে ধরে চুমু খেতে চাইলো। 

অদূরে দাঁড়িয়ে জনি প্রথম থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলো। জনি প্রতিবেশি হিসেবে কণেপক্ষের আমন্ত্রিত অতিথি। সে এগিয়ে গেলো ওদিকে। পরপর দুটো ঘুষি মেরে দুষ্টু যুবক দুটোকে মাটিতে ফেলে দিলো। শুরু হলো হৈচৈ। হৈচৈ শুনে অতিথিরা এদিকে দৌড়ে এলো। ঘটনা শুনে যুবকদের জিজ্ঞেস করায় ওরা জানালো যে ওরা আমন্ত্রিত অতিথি না। কোথাও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে ওরা এভাবেই ঢুকে খেয়ে থাকে। যুবক দু'জনকে বের করে দেয়া হলো বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে। 

দুষ্টু যুবক দুটো পুলিশের সোর্স। আমাদের সমাজে পুলিশের সোর্স পুলিশের সমান বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। এরা এলাকার ভালো মন্দ সকল তথ্য পুলিশকে দিয়ে থাকে। পুলিশের ভালো মন্দ সকল কাজে এরা সহায়তা করে থাকে এবং কম বা বেশি ভাগও পেয়ে থাকে। এই দুই যুবকের নাম ধরা যাক রুবেল ও মিশা। 

রুবেল ও মিশা ধুপধাপ হেঁটে চলে এলো থানায়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার খাসকামরায় ঢুকে অলীক কান্না শুরু করে দিলো। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হায়দার কারণ জিজ্ঞেস করলে রুবেল বললো, বড় অপমান হইছি আইজকা স্যার!

সাথে সাথে মিশা বললো, জিন্দেগিতে এতোবড় অপমান হই নাই স্যার!

ওসি হায়দার মোবাইল ফোনটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ওদের জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে? আগে ঘটনা ক! পরে কান্দিস!

রুবেল মেয়েদের উত্যক্ত করার ঘটনা বাদ দিয়ে বললে ওসি হায়দার বললেন, দাওয়াত না পায়া বিয়া খাওয়া কবে বাদ দিবি তোরা?

মিশা বললো, একটা বিয়াতে কত মানুষ খায়! আমরা দুইজন খাইলে কি কম পড়ে?

এখন কী চাস তোরা?

আমগো সাথে ফোর্স দ্যান! ঐ বান্দির পুতরে ধইরা লইয়া আসি!

ঠিকাছে। ২০/২৫ জন সিপাই নিয়া যা। সাথে এসআই প্রতুল যাবে। ওকে আমি বইলা দিচ্ছি। 

পঁচিশ জনের একটি বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান থেকে জনি এবং ওর বড় ভাই রকিবকে তুলে নিয়ে এলো ওরা। 

থানায় এনেই জনিকে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকলো রুবেল ও মিশা। থানার ভেতরে টানা আড়াই ঘণ্টা চললো জনির উপর অকথ্য পুলিশি নির্যাতন। এক পর্যায়ে জনির শরীর খারাপ হতে শুরু করলে সে এক গ্লাস পানি পান করতে চাইলো, পানি, পানি, পানি!

রকিবকে ধরে রেখেছিলো দুই সিপাই। ওর অনুনয়-বিনয় কান্না কারো মনে কোনো রকম রেখাপাত করলো না। জনির কাতর কণ্ঠে পানি চাওয়া শুনে রকিব কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আমার ভাইটারে আর মাইরেন না পুলিশ ভাইরা। জনি ভুল করছে। ওর পক্ষে আমি মাফ চাইতাছি। রুবেল মিশা ওরে মাফ কইরা দেও। 

রকিবের কথা শুনে মিশা খলনায়কের মতো হাসতে থাকলো। আর রুবেল জনির পেটে কষে একটা লাথি মারলো। সাথে সাথে জনির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। 

এক সিপাই জনির বুকে বুট জুতা রেখে জনির মুখে থুতু ছিটিয়ে বললো, পানির বদ্লে থুতু খা!

ঐ থানা হাজতে জনির মৃত্যু হলো। পুলিশ রকিবকে মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখানোর ভয় দেখিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই জনির লাশটা নিতে বাধ্য করলো। ছোট ভাই-এর লাশ দাফন করার পরে পাড়ার লোকদের পরামর্শে থানায় পুলিশ হেফাজতে জনির মৃত্যু হয়েছে, এই অভিযোগে মামলা করতে এলে পুলিশ মামলা না নিয়ে উল্টো ওকে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলো থানা থেকে। তখন রকিব আদালতে চলে গেলো মামলা দায়ের করতে। আদালতের নির্দেশে থানা মামলা নিয়ে কবর থেকে জনির লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হলো। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচার করা হতে থাকলো যে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে এলে এক পর্যায়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় জনি। তদন্ত শেষে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ হেফাজতে জনির মৃত্যু হয়নি মর্মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেবার পরে রকিবের পক্ষে নারাজি দিলে অধিকতী তদন্তের জন্য মামলা সিআইডি-তে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হলো। 

শুরু হলো পুলিশের পক্ষে বিভিন্নভাবে রকিবকে হুমকি দেয়া। পুলিশের সাথে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার জন্য রকিবকে কখনো প্রলোভন কখনো বা হুমকি দিতে থাকলো পুলিশের পক্ষে ঐ দুটো সোর্স ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী বিশেষ করে সরকারপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এতেও না টললে রকিবকে গুম ও হত্যার হুমকি দেখাতে থাকলো। রকিবের মাকেও সরাসরি বাসায় গিয়ে কখনো বা মোবাইল ফোনে হুমকি দেখানো হতে থাকলো এইভাবে যে এক ছেলে মারা গেছে, তুমি কি আরেক ছেলেকে হারাতে চাও? সময়টা তখন ২০১৪ খৃষ্টাব্দ।

একদিন রকিবকে মা বললেন, কিরে রকিব, তোকে এতো বিষন্ন দেখাচ্ছে কেনো?

রকিব শুকনো কণ্ঠে বললো, পুলিশ বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নেবার জন্য।

মা বললেন, আমাকেও হুমকি দিতাছে রকিব।

কী বলছো তুমি মা!

বাসায় আসছিলো। বলছে, একটা ছেলে মরছে, মামলা না তুলে নিলে তোকেও মেরে ফেলবে, অথবা গুম করে ফেলবে।

রকিব মার কাঁধে হাত রেখে বললো, আমি মামলা তুলে নিবো না মা। তুমি মামার কাছে চলে যাও। মামল শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে আসার দরকার নাই। 

শুরু হলো মামলার তারিখ পড়া। আসামি পক্ষের আবেদন করলেই বিজ্ঞ আদালত পরবর্তী তারিখ দিয়ে দেন। বাদিপক্ষ সাক্ষী হাজির করলে আসামী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী অসুস্থ, এই অজুহাতে মামলার পরবর্তী তারিখ পড়ে যায়। মাঝেমধ্যে রকিবের উকিল মামলা চালাতে অনীহা প্রকাশ করেন। রকিব বিরক্ত হন না। তিনি প্রতিটি তারিখেই আদালতে গিয়ে হাজির দিতে থাকেন, এডভোকেটের ফি দিতে থাকেন। এভাবে দুই বছর অতিক্রান্ত হবার পরে একদিন মামলা আপোষে মীমাংসা করার জন্য কুড়ি লক্ষ টাকা প্রদানের প্রস্তাব এলো পুলিশের পক্ষ থেকে। 

রকিব বলেন, আমার আদরের ছোট ভাইকে খুন করা হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই। টাকা দিয়ে কী করবো!

রকিব আপোষ করেন না। ভাইয়ের হত্যাকারীদের সাথে কোনো আপোষ নয়। বিচারের দাবিতে রকিব থাকেন অটল। 

মামলার তারিখ পিছায়, খরচ বাড়তে থাকে, একের পর এক তারিখ পড়ে। এরই মধ্যে আসামী পক্ষ মামলা স্থগিতের আদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। মামলার দুই আসামি প্রথম থেকেই পলাতক; যদিও ওদের থানায়, কখনো পুলিশ লাইনে দেখা যায়। আরেক আসামী জামিনে মুক্তি পেয়ে মামলার প্রাক্তন তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে থানায় বসে রকিবকে দেখিয়ে দুপুরের খাবার খায়, চা পান করে, সিগারেট ফুঁকে। 


ভাই হত্যার বিচারের দাবিতে দায়ের করা মামলায় আদালত শুনানি ও অন্যান্য কাজে গত সাড়ে ছয় বছরে রকিবকে চারশ বার আদালতে আসতে হয়েছে। রকিব একটা শুনানির তারিখও অনুপস্থিত থাকেন নি। 

দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর অসংখ্য হুমকি, ভীতি, আপোষের প্রস্তাব, বিরামহীন আদালত শুনানির পর জনি হত্যার বিচার হয়। 

জনি হত্যায় জড়িত তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি দুজনকে সাত বছরের কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত। 

রায় ঘোষণার সময় জনির মা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণা শুনে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কান্না থামিয়ে বিজ্ঞ বিচারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, সন্তান হত্যার পরে বিচার পেয়ে কী হবে জজ স্যার? পুলিশের দ্বারা এমন ঘটনা যেনো আর না ঘটে তা নিশ্চিত করেন!


পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) ২০১৩ আইনে এই মামলার বিচার নিষ্পত্তি করা হয়।

(একটি সত্য ঘটনার অনুলিখন এই গল্প)

Thursday, July 28, 2022

উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -1


 


তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন 


সুদীপ ঘোষাল 



রতনেদের পাড়ার তান্ত্রিক পিসেমশায়কে দেখলে আমাদের খুব ভয় লাগে। সবসময় লাল চোখ, বাঁজখাই গলা আর কন্ঠস্বরের তীব্রতায় বুক ধরফর করে। সহজে কেউ তান্ত্রিককে ঘাঁটাতে চায় না। তবু রতন সাহস করে বলে, পিসেমশাই ভূত,পিশাচ এসব কি? পিসেমশায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে মজা করে কথা বলেন। তিনি বললেন, ক্যা হুয়া, তোমার এসব দরকার কিউ পরতা,হ্যায়?  তুমি বাচ্চালোগকা মাফিক থাক।রতন বলে, বলুন না। শুনতে ভালোলাগে। পিসেমশায় এবার সিরিয়াস হয়ে বলেন,  শরীর মন্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত করে তান্ত্রিকরা অপরের উপকার করতে যান।  ক্ষমতালাভের জন্য তন্ত্রে শবসাধন, পাদুকাসাধন, কর্ণপিশাচী সাধন, মধুমতী সাধন ইত্যাদি অনেক সাধনের কথা আছে। তাছাড়াও আছে ভূতপ্রেত পিশাচসাধনও।রতন বলে,পিশাচদেরও ভাগ আছে।পিসেমশায় বলেন, চোখপিশাচী, নাকপিশাচী, কর্ণপিশাচী সাধনাটা হল ভূত, প্রেত, পিশাচের উপদেবতা। এদের শক্তি বিপুল। কার মনের কি ধান্দা, এদের কৃপায় সহজেই বলে দেওয়া যায়। কানে শুনে প্রশ্নের উত্তর দেবে নির্ভুল।আমি বললাম, নাকপিশাচী কেমন?  পিসেমশায় বলেন, ওরা গন্ধশুঁকে বলে দেবে তোমার পকেটে কি আছে বা আশেপাশে আঁশটে গন্ধ পেলে ওরা চিনে নেয় গন্ধটা কিসের?  অপগন্ধ হলে ওরা সাবধান করে দেয়। বাড়িতে ভূত, পেত্নী থাকলে বলে দেয়।রতন বললো, তাহলে ওরা ভালোও হয়? পিসেমশায় উত্তর দিলেন, নিশ্চয়। মানুষের মধ্যে ভালো, মন্দ আছে। তাহলে ভূতেের মধ্যে থাকবে না কেন?  পিসেমশায়  একটু নড়ে চড়ে বসলেন। এতক্ষণ বসে ছিলেন একভাবে। এবার কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে উঠল। বলিষ্ঠতার সুরে বললেন, তন্ত্রের প্রত্যক্ষ ক্রিয়া দেখেছি জীবন বহুবার বহু সাধুসঙ্গে। এতে আমার যে ধারণা দৃঢ় ও বদ্ধমূল হয়েছে, তাতে এটুকু বুঝেছি তন্ত্রের মন্ত্র এবং তার নির্ভুল প্রয়োগে মানুষের অনেকরকম ক্ষতি করাটা যত সহজ, উপকার করা সবক্ষেত্রে তত সহজ নয়। যেমন ধর মারণ, উচাটন, বশীকরণ, বিদ্বেষণ, বগলামুখী, বগলা প্রত্যঙ্গিরা, শ্মশানকালীর কবচ ইত্যাদির সাহায্যে শত্রুর উপর ভয়ংকরভাবে প্রভাব সৃষ্টি করা যায়।অশেষ নির্যাতনের মাধ্যমে রোগগ্রস্ত করে যেমন পাঠানো যায় মৃত্যুর হিমঅন্ধকারে, তেমনি বাবা শান্তিস্বস্ত্যয়নের দ্বারা। পিসেমশাই বলেন, একটি জটিল বিষয়। ভারতবর্ষের আর্যকেন্দ্রিক অধ্যাত্ম ঐতিহ্যে এর স্থানটি নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণা রয়েছে। বস্তুতঃ এর উৎস ছিল অনার্য উপাসনা পদ্ধতি ও ব্যাপকভাবে বিকেন্দ্রিত লোকাচারের মধ্যে। এর উদ্ভব প্রাক বৈদিক যুগেরও আগে এবং আর্যদের পরবর্তীকালের বৈদিক আচারবিচারে, বিশেষতঃ অথর্ববেদের সময়ে, আগম ও তন্ত্রের প্রভাব চোখে পড়ে। তন্ত্রের উদ্ভব ও বিবর্তনে সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতির ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আগ্রহ পোষণ করার সূত্রে বহু ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। ভারতবর্ষের আবহমান নিম্নবর্গীয় সমাজতত্ত্ব, আর্য-অনার্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও বৌদ্ধধর্মের সম্পূর্ণ দেহ পরিবর্তনের  পরিপ্রেক্ষিতে তন্ত্রশাস্ত্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তন্ত্র সম্বন্ধে ' কিছু  বলা আমার মতো আহাম্মকের  পক্ষে সম্ভব নয়। বিশাল এর কাহিনী, বিশাল এর বিস্তৃতি। সচরাচর গোপনশাস্ত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ আগ্রহী হলেও এ বিষয়ে কৌতূহল নিবৃত্ত করার মতো বিশেষ কিছু বই পাওয়া যায় না। কারণ অসংখ্য সাধক  বহুধাবিভক্ত চর্চা ও অভ্যাসের দৌলতে সাধারণ পাঠকের উপযুক্ত সহজ আলোচনা আমাদের ভাষায় বিরল।


এখানে মনে রাখতে হবে, এই গোপনতন্ত্রসাধনা পঞ্চদশ  শতক পর্যন্ত এক বিশেষ দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে বিদেশী  রাজশক্তি যখন মূলস্রোতের  পূজা-আরাধনা প্রকাশ্যে, সমারোহ সহকারে উদযাপন করার পথে অন্তরায় দেখা দিল তখন  বিপদগ্রস্ত ধার্মিকরা শরণ নিয়েছিল অনার্য কৌম সমাজের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা দেবীর  আশ্রয়ে। এই সময় থেকেই তন্ত্রশাস্ত্র পূর্বতন অসংগঠিত থেকে মনীষার যোগদানের ফলে এক বিস্তৃত  মাত্রা পেয়ে ছিল।বৌদ্ধতন্ত্র ও সনাতনধর্মীয় তন্ত্রের মধ্যে বস্তুত কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভেদ নেই। আসলে সেভাবে দেখলে তন্ত্র কোনও ধর্মীয় মতবাদ নয়, তন্ত্র এক সাধনপদ্ধতি মাত্র। মনুষ্যদেহকে এক যন্ত্রস্বরূপ বিচার করে সেই সূত্রে এক গুহ্যসাধনপদ্ধতিকেই তন্ত্র বলে। এই সাধনপদ্ধতিতে অনুগামীদের বিভিন্ন দেবীর নামে দীক্ষা নিতে হয়। বেছে নেবার মতো অসংখ্য দেবী থাকলেও আমাদের দেশে  শাক্তরা দুর্গা মন্ত্রে শিষ্যত্ব গ্রহণি  করেন। তারা, অন্নপূর্ণা, ত্রিপুরা ও ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে দীক্ষিত শাক্তদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম।তন্ত্রসাধনার মূল স্রোতটি যে আচারপদ্ধতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তা হলো পঞ্চ ম-কার ক্রিয়া। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আবহমানকাল ধরে নানা ধরনের পরস্পর বিরূপ মতামত প্রচলিত রয়েছে। প্রায় সোয়াশো বছর আগে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবার উপক্রমনিকা হিসেবে একটি কৈফিয়ৎ যেমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, .ভারত-প্রচলিত তান্ত্রিক উপাসনার প্রকৃত মর্ম ও পঞ্চ ম-কারের মূল উদ্দেশ্য আমাদের জ্ঞানে যতদূর উদ্বোধ হইয়াছে এবং ইহার আধ্যাত্মিক-তত্ত্ব যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে,ইত্যাদি। এই ব্যাখ্যাটির প্রামাণ্যতা নির্ভর করছে দুটি বিষয়ের উপর, 'আমাদের জ্ঞান' ও 'যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে'। এ বিষয়ে সাক্ষী মানা হয়েছে 'আগমসার' নামের একটি প্রাচীন গ্রন্থের। এই গ্রন্থে প্রথম-ম, অর্থাৎ 'মদ্য' সাধন বিষয়ে বলা হয়েছে।মদ, মোহ, মাৎসর্য, কাম, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রেখে তান্ত্রিকরা বায়ু রূপ লিঙ্গকে ভূমিরূপ যোনীতে প্রতিস্থাপন করেন। এ খুব কঠিন সাধনা। শুধু মহিলা নিয়ে ঘুরে মদ খেয়ে তান্ত্রিক হওয়ার চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। সাধু আর তান্ত্রিক হতে গেলে সংযম, সাধনা আর আসনের ত্রিবেণী সংগম হতে হবে। নারীদের দেবীজ্ঞানে পূজা করতে হয়। অকালপক্ক বির্যহীন পুরুষ এ দিকে না আসাই ভাল। পিসেমশাই বললেন, গোপন কথা কোথাও বলবি না। এসব সবসময় বলতে নেই।এটা ছটেলেপেলা নয়, মনে রাখবি। 





                                         ক্রমশ...

Wednesday, July 27, 2022

ছোট গল্প - পুনর্জন্ম || লেখক - অরুণিমা দাস || Short story - Punorjonmo || Written by Arunima Das


 

পুনর্জন্ম

   অরুণিমা দাস 



সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর পাশ ফিরতেই হাতের যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে জিনিয়া। ভয় চোখে বিছানার একপাশে শুয়ে থাকা আয়ুশের দিকে তাকায়। অঘোরে ঘুমোচ্ছে আয়ুশ। কে বলবে গত রাতে এই আয়ুশই তাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করেছে আর মারধোর করেছে। জিনিয়া কিছুতেই বুঝতে পারে না তার সাজগোজে স্বামীর কেনো এত অনীহা। বিয়ের পর দুমাস হয়ে গেলো একদিনের জন্যও আয়ুশ তাকে সাজগোজের কোনো জিনিস কিনে দেয়নি,উপরন্তু বলেছে ন্যাচারাল থাকো, এটাই আমার পছন্দ। ওই রুশ পাউডার গালে লাগিয়ে আর ঠোঁট লিপস্টিকে লাল করে আমার সামনে কোনোদিন আসবে না,আমি এগুলো মেনে নিতে পারবোনা কিছুতেই। এসব ভাবতে ভাবতে জিনিয়া উঠে গিয়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে লাগলো,পিঠ ঘোরাতেই আয়নায় দেখলো সুস্পষ্ট কালসিটে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো জিনত। আয়ুশের ঘুম ভেঙে গেলো কান্নার শব্দে, উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো জিনিয়া কে। বললো কি হয়েছে কাঁদছো কেনো। জিনিয়া অবাক হয়ে তাকালো স্বামীর দিকে। কি অদ্ভুত তো, কাল রাতে যে মানুষটা এত হিংস্র হয়ে উঠেছিল সে আজ সকালে এরকম ভালোমানুষ! কি করে সম্ভব হয় এটা। আয়ুশকে বললো রাতের কিছু কথা মনে নেই তোমার। আয়ুশ বললো কিছু হয়েছিল নাকি রাতে। আমি তো নিশ্চিন্তে ঘুমোলাম। আর তুমি কাঁদছো কে? বলে জিনিয়ার হাত টা ধরে, জিনিয়া হাতটা সরিয়ে নেয়। আয়ুশ বললো আবার নিশ্চয়ই ভারী কাজ করে হাতে ব্যথা করছে তোমার। দাও মলম লাগিয়ে দিই। জিনিয়া বললো না থাক, আমি চা করি ব্রেকফাস্ট বানাই। রান্নাঘরে গিয়ে জিনিয়া ব্রেকফাস্ট রেডী করতে থাকে। কদিন সবকিছু ঠিক চললো, একদিন অফিস থেকে ফিরে আয়ুশ দেখে জিনিয়া সুন্দর করে সেজেছে আর গাঢ় করে লিপস্টিক লাগাচ্ছে ঠোঁটে। জিনিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায় আর হিসহিস করে বলে ওঠে সাজতে বারন করেছিলাম তো তোমায়, পছন্দ করি না আমি সাজগোজ করা মেয়েমানুষ দের। বলেই সব জিনিয়ার সব সাজ সরঞ্জাম ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর মাটিতে ফেলে জিনিয়ার চুল মুঠি ধরে মারতে থাকে। কোনরকমে জিনিয়া নিজেকে বাঁচিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। আয়ুশ চুপ করে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। সেদিন রাতে আর আয়ুশের সাথে এক বিছানায় শোয় না জিনিয়া। ঘুম আসে না ওর চোখে, সমস্ত শরীর জুড়ে যন্ত্রণা ওর। মানসিক শান্তি টাই চলে গেছে ওর। মনে মনে ভাবে এরকম চলতে দেওয়া যাবে না আর,ঠিক করে কালকেই মামাতো দাদা সঞ্জীবকে ফোন করে সব বলবে। জিনাতের দাদা সঞ্জীব মাইন্ড রিডিং নিয়ে  পড়াশোনা করছে। হয়তো কিছুটা হলেও হেল্প করতে পারবে। রাত কেটে সকাল হবার পর আয়ুশ আবার স্বাভাবিক মানুষ, অফিস যাওয়ার সময় জিনিয়াকে বলে যায় আজ বাইরে ডিনার করতে যাবো তোমায় নিয়ে, রেডী থেকো সিম্পল ভাবে। জিনাত কিছু বলে না,চুপ থাকে। আয়ুশ বেরিয়ে যাওয়ার পর ফোন লাগায় দাদাকে, ফোনে সব শুনে সঞ্জীব বলে তুই এতদিন বলিসনি কেনো রে পাগলী? সাজগোজ নিয়ে অনেকের সমস্যা থাকে, কিন্তু কিভাবে সেই সমস্যার উৎপত্তি তার মনে সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো কোনো সুন্দরী মেয়ে আয়ুশকে ঠকিয়েছে, তাই হয়তো সাজগোজের ব্যাপারে ওর বিতৃষ্ণা। কিন্তু তুই যা বললি শুনে বুঝলাম এখন এটা ওর মানসিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর প্রপার কাউন্সেলিং এর দরকার রে। আমার এক বন্ধু আছে, নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট ডা: শুভম ঘোষ, খুব ভালো মানুষ। তুই নিয়ে আয় আয়ুশকে,ওর মনের কথা জানার খুব দরকার রে।


জিনিয়া ভাবলো এমনিতেই অনেক টা দেরী হয়ে গেছে দাদাকে জানাতে তার ওপর আরও দেরী করলে হয়তো আয়ুশের সমস্যা আরও বাড়তে পারে। আয়ুশ অফিস থেকে ফিরলে জিনত বলে জানো আমার দাদা সঞ্জীব আজ কল করেছিল, আমাদের দুজনকে ডেকেছে একটা জায়গায় নিয়ে যাবে বলে। কোনো সন্দেহ না করে আয়ুশ রেডী হয়ে জিনিয়ার সাথে বেরিয়ে পড়ে। জিনিয়া আয়ুশ কে নিয়ে সোজা পৌঁছয় ডা: ঘোষের চেম্বারে, সঞ্জীব আগেই চলে গেছিলো। ওদের আসতে দেখে সঞ্জীব এগিয়ে গিয়ে ওদের নিয়ে আসে। আয়ুশ বলে এটা কোথায়। সঞ্জীব বলে আমার ওয়ার্ক প্লেস এটা। তোমরা এসো, আমি একটু কাজ সেরে নিয়ে তোমাদের ডিনারে নিয়ে যাবো। কথায় কথায় আয়ুশ কে ভুলিয়ে ডা: ঘোষের কেবিনে নিয়ে আসে সঞ্জীব। আগে থেকেই শুভম কে সব বলে রেখেছিলো সঞ্জীব। শুভম আয়ুশকে বলে বসুন আপনি, একটু আলাপ করা যাক আপনার সাথে। সঞ্জীব আর জিনিয়া কে পাশের একটা ঘরে বসতে বলে শুভম। আয়ুশ বসার পর শুভম এবার আসল কথায় আসে,জিজ্ঞেস করে কি করেন। বাড়ী কোথায় এবং পরিবারের কথা। আর এসব বলতে বলতে বলে ফেলে আপনার ওয়াইফ এত সাদা মাটা ভাবে কেনো থাকেন। সাজলে তো ওনাকে খুব ভালো লাগবে। শুভম লক্ষ্য করে সাজ গোজের কথা শুনে আয়ুশের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, টেবিলে সজোরে ঘুষি মেরে বলে আই হেট মেক আপ। প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন শুভম বুঝে ফেলে কিছু অতীত তো নিশ্চয় আছে আয়ুশের যার জন্য ও এতটা ঘৃনা করে সাজগোজ কে। ঘরের লাইট অফ করে দেয়, একটা হালকা মিউজিক চালিয়ে দেয়। আর ইশারায় সঞ্জীব আর জিনিয়া কে বলে কানে হেড ফোন লাগিয়ে নিতে। এরপর প্রশ্ন শুরু করে আয়ুশ কে। মনের কথা সব খুলে বলতে থাকে আয়ুশ। যখন ছোট ছিল, বয়স তখন পাঁচ ছয় হবে পড়তে যেত এক স্কুলের ম্যাডামের কাছে, একাই পড়ত। সেজে গুজে থাকতেন ম্যাডাম সব সময়। আয়ুশকে দেখেই পরম আদরে নিজের কাছে টেনে নিতেন। বাচ্চা আয়ুশ তখনো ম্যাডামের অভিসন্ধি বুঝতে পারেনি।


তারপর কিছুক্ষণ পড়াশোনা করানোর পর ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ করে লাউড স্পিকারে মিউজিক চালিয়ে দিয়ে শুরু হতো আয়ুশের ওপর অত্যাচার। আর বলা হতো মা বাবাকে জানালে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে। আয়ুশ অত্যন্ত যন্ত্রণা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। ভয়ে বাবা মাকে কিছু বলেনি। একদিন আয়ুশের প্যান্টে রক্তের দাগ দেখে ওর মা জিজ্ঞেস করে ওকে কি হয়েছে। আয়ুশ সব বলে মা কে, কিন্তু সুরাহা কিছু হয়নি কারণ ওই ম্যাডামের প্রতিপত্তি ছিল ওই এলাকায়। আয়ুশকে ওর বাবা বলেছিলেন সব চেপে যেতে।  এভাবে ক্লাস ফাইভ অবদি চলার পর আয়ুশকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ঘটনার রেশ এতটাই গভীর যে আয়ুশের অবচেতন মনে আজও দগদগে ঘা হয়ে আছে। শুভম মিউজিক অফ করে ঘরের আলো গুলো জ্বেলে দেয়। জিনিয়া ঝর ঝর করে কেঁদে শুভম কে বলে কি নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন ম্যাডাম। আয়ুশের মনে এত কষ্ট কোনোদিন ও বলেনি আমায়। শুভম বলে ওর মা বাবার যে কাজ টা করা উচিত ছিল সেটা আজ আপনি করছেন জিনিয়া। এবার বুঝলেন তো আপনার স্বামী কেনো সাজগোজ করা পছন্দ করেন না। কারণ ওনার মনে তো সেই ম্যাডামের ছবি গেঁথে আছে আর সেই ছবি ওনার মনকে ক্ষত বিক্ষত করে বারংবার। আপনার স্বামী পেডোফিলিয়ার স্বীকার ছিলেন। উনি ছিলেন প্যাসিভ ভিকটিম। আর ওই ম্যাডাম এভাবে কত বাচ্চার ক্ষতি করেছেন কে জানে। জিনিয়া বললো ও ঠিক হয়ে যাবে তো। শুভম বললো আমি কিছু মেডিসিন দিচ্ছি সময় মত খাওয়াবেন আর বেশ কিছু সিটিংয়ে আমি ওনার কাউন্সেলিং করবো। সময় লাগবে, ধৈর্য্য ধরতে হবে। জিনিয়া বললো আমি সব করবো ডা: ঘোষ। ওকে আজ তাহলে আসুন, বলে প্রেসক্রিপশনটা ধরিয়ে দেন জিনিয়ার হাতে। আয়ুশ মাথা নিচু করে বসেছিল, ডা: ঘোষ বললেন যান বাড়ী যান, আপনি একদম সুস্থ আছেন। আয়ুশকে নিয়ে জিনিয়া আর সঞ্জীব বেরিয়ে পড়ে। জিনিয়া সঞ্জীব কে বলে এই ঘটনার জন্যই হয়তো আয়ুশের বিয়েতে অনীহা ছিল। এটা আমি শুনেছিলাম কিন্তু কেনো অনীহা সেটা বুঝিনি। সঞ্জীব বললো চিন্তা করিস না, সব ঠিক হবে। শুধু ওকে ওষুধ গুলো টাইম মত খাওয়াস। ডা: ঘোষের কাউন্সেলিং আর স্ত্রী জিনিয়ার আন্তরিকতায় আয়ুশ রিকভার করছিল তাড়াতাড়ি। এরপর জিনিয়া ঠিক করে আয়ুশের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ওর মা বাবার সাথে কথা বলবে। একাই গেলো ও, আয়ুশকে নিয়ে যায়নি। গ্রামে গিয়ে ওর মা বাবার সাথে কথা বলে সবটা জানতে পারে আর ওদের বলে কেনো ওরা কোনো স্টেপ নেয়নি। জিনিয়াকে ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ি জানায় সমাজের ভয়ে ওরা কিছু করেনি। জিনিয়া বলে আপনাদের জন্য আমার বিবাহিত জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল,আমিও যদি সমাজের ভয় করতাম তাহলে আর আপনাদের ছেলেকে সুস্থ করতে পারতাম না। আর ম্যাডামের খবর জানতে চাইলে আয়ুশের বাবা বলেন তিনি এখানে থাকেন না আর। শ্বাশুড়ী মায়ের থেকে আয়ুশের ঘর কোনটা জেনে নিয়ে জিনিয়া যায় সেই ঘরে। আলমারি, পুরনো খাতা বই ঘেঁটে বের করে এক ডায়েরী যেখানে আয়ুশের কষ্টের কাহিনী লেখা ছিল। ডায়েরীটা নিয়ে নেয় জিনিয়া, এটা যে ডা: ঘোষ কে দিতে হবে। গ্রামের বাড়ী থেকে রাতে ফ্ল্যাটে ফেরে জিনিয়া। আয়ুশ এসে গেছিলো অফিস থেকে। ওকে খাবার খাইয়ে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় জিনিয়া। নিজেকে আজ বেশ হাল্কা লাগে ওর। এরপর রেগুলার কাউন্সেলিং,ওষুধ আর জিনিয়ার সেবায় একদম সুস্থ হয়ে ওঠে আয়ুশ। মনের ক্ষত গুলো সেরে উঠেছে ওর। একদিন সেই পুরোনো ডায়েরী টা আয়ুশের হাতে পড়ে যায়। আয়ুশ নিজের লেখা গুলো পড়ার পর ডায়েরীর শেষ কয়েকটা পাতায় জিনিয়ার লেখা পড়ে বুঝতে পারে কত ভুল করেছে সে, ছোটবেলার ঘটনা গুলোকে নিজের মনে লুকিয়ে রেখে শুধু নিজেকেই না স্ত্রী জিনিয়াকেও কষ্ট দিয়েছে। পাশের ঘরে গিয়ে জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে ক্ষমা করে দিতে তাকে। তার এই যে নতুন জীবন যে জিনিয়ার দেওয়া, তাই এখন থেকে তার ভালো মন্দ সব কিছুর ভার জিনিয়ার হাতে থাকবে। জিনিয়া খুব খুশি হয় স্বামীর পরিবর্তন দেখে। আয়ুশকে বলে সব ভুলে যাও, আজ থেকে আমরা নতুন করে সব শুরু করি চলো। আয়ুশ বলে আগামী রবিবার একটা পার্টির আয়োজন করি বাড়িতে, তোমার দাদা, ডা: ঘোষ আর আমাদের দুজনের বাবা মায়ের উপস্থিতি ,ব্যাস এই টুকুতেই আমি খুশি। জিনিয়া বললো একদম আর সব আয়োজন আমরা দুজনে মিলে করবো। রোববার দিন সন্ধে বেলায় ছোট্ট অনুষ্ঠানে হাজির ছিল সবাই আর সবার সামনে আয়ুশ জিনিয়াকে গিফট করে মেক আপ বক্স  আর বলে যার মন এত সুন্দর সে না সাজলেও সুন্দরই লাগবে, তাও এটা দিলাম মনের মত করে সেজো। জিনিয়া আয়ুশের কানে কানে বললো সাজিয়ে দিয়ো তুমি। সকলের হাসি আনন্দে ঘর ভরে উঠলো।

Tuesday, July 26, 2022

ছোট গল্প - রাজু কাকা || লেখক - সান্ত্বনা ব্যানার্জী || Short story - Raju Kaka || Written by Swantana Banerjee



রাজু কাকা

       সান্ত্বনা ব্যানার্জী



             "অ্যাই ! অ্যাই!সর, সর।উর ডাবায় মুক
দিচিস কেনে?তুর নিজের যাব খা কেনে!মুই কি 
কারো মুকের গেরাস কেরি খাই? তু কেনে খেছিস?"....রাজু কাকা এই রকম করেই অনর্গল
কথা বলে গরু গুলোর সঙ্গে।রাজু কাকা আসার পর থেকে সেজো কাকুর কাজ একটু কমে গেছে
আর মেজাজটা ও ভালো হয়েছে।এখন প্রায়ই 
বাঁশি বাজায় সন্ধের পর।তখন ইংরেজী টা কাকুর কাছে নিয়ে গেলে পরিয়ে দেয়।এখন অঙ্ক
কষতে কষতে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে এক মনে গোয়াল পরিষ্কার করছে রাজু কাকা।
                   প্রায় ছয় মাস হয়ে গেলো রত্নাদের
বাড়িতে এসেছে রাজু কাকা।বীরভূমের কোন এক গ্রামে বাড়ী।স্টেশনে বসেছিল আর একে তাকে কাজের জন্য অনুরোধ করছিলো।সেজো কাকুর সঙ্গে সেখানেই দেখা,আর বাড়িতে নিয়ে 
আসা।সেই থেকেই বাড়ীর বাঁধা মুনিষ রাজু কাকা। বেঁটে খাটো কালো , কিন্তু ভারি সতেজ ।
সব সময় যেন তেল মেখে আছে। তেমনি যত্ন করে গোয়ালের গরু মোষ গুলোকে।ওর নিজের মতো ই চকচকে করে ফেলেছে গরু মোষ গুলোকে।     
        বাড়িতেও যেন এক শান্তির হাওয়া। সবচেয়ে খুশি হয় রত্না ওর মায়ের জন্য।মায়ের কাজ অনেক টাই কমে গেছে।সকাল থেকে মা আর কাকীমা যেন তাঁতের মাকুর মত বাড়ীর এ প্রান্ত।থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ায়।দক্ষিণের ঘরে চালতো উত্তরের ঘরে আলু,কুমড়ো। ভোর থেকে
ছুটোছুটি, অফিস,ইস্কুলের ভাত,তারপর জন কিষেনের রান্না,তার ওপর ধান সেদ্ধ,মুরিভাজা।
এখন এই ধান সেদ্ধ শুকনো র কাজ গুলো করে রাজুকাকা,মায়ের হাতের কাছে শাক সবজির যোগান দেয়।মা এখন একটু বিশ্রাম পায়,দুপুরে
চুল মেলে দিয়ে একটু গড়িয়ে নেয় রেডিওতে
গান শুনতে শুনতে।ভারি ভালো লাগে রত্নার।কাজ সারা হলে রাজু কাকা ও গান শোনে আর
বক বক করে মায়ের সাথে।"মেজ ঠাকরুন একট
সবুজ পারান ডিংলা আনলাম,নাককেল দিয়ে রান্ধ দিকি আজ রেতে বেশ ভালো করি,গরম 
গরম রুটি দে খাতি বড্ড ভালো নাগে।".....তোমাদের বাড়ীতে কে রান্না করে রাজু?মা জিজ্ঞেস করে।"আগে মা করতো,একুন 
বৌদিদি রান্দে,মায়ের মতন লয়।তুমার রান্না আমার খুব ভালো নাগে মেজ ঠাকরুন"।মা একটু
চুপ করে যায়,তারপর বলে .....তুমি একবার বাড়ী ঘুরে এসো না রাজু, বাড়ীর সবাই চিন্তা করছে.....।না!বাড়ী যাব নেকো।....বলেই কেমন মাথা নিচু করে চুপ করে যায়,আর উঠে গোয়ালের দিকে চলে যায়।গরু গুলোকে খাবার
দিতে দিতে বকতে থাকে নিজের মনে..... তু  বড়ো বাচাল হইছিস কেলো! নাগার ধোলোর ডাবা তে মুক দিছিস।দ্যাক তো ছেমলিকে!কি নক্কি মেয়ে, কারও ডাবাতে মুক দেয় নাকো!.......
বক বক করেই যায়। 
                     দেখতে দেখতে দুর্গাপুজো চলে এলো।গ্রামে মোট এ দুটো পুজো। পাড়ার পুজো টা। রত্নার বাড়ীর কাছেই।সারাদিন নিজেরাই ঠাকুরতলা আর বাড়ী আসা যাওয়া করে                                 
 ।কিন্তু অন্য পাড়ায় একা যাওয়ার হুকুম নেই।বিশেষ করে ছোট বোন টুকটুকি,সে তো ভালো করে হাঁটতেই শেখেনি। তো বিকেলবেলা রাজু কাকা সবাইকে নিয়ে চললোঠাকুরদেখাতে,কাঁধে চরলো টুকটুকি,বাকি সবাই হেঁটে হেঁটে।কাঁধে চরা টুকটুকির সঙ্গে একভাবে বকতে বকতে চলে রাজু কাকা....... টুকি,দেখতি পাবা,কি সোন্দর দুগ্গা মা!ইয়া তাগড়া অসুর!গণেশ দাদার পেটটি নাদা, খড় খায় গাদা গাদা!আর নক্বী ঠাকুরের চরণে ঠাঁই দ্যাবরা চোকো প্যাঁচা!সব দিকাবো তোকে। ......ঠাকুর দেখার পর সবাইকে বুড়ির চুল , পাঁপড় ভাজা কিনে দেয়,বাড়ী ফিরে সবিস্তারে গল্প করে মায়ের সঙ্গে।
             একদিন সেজো কাকুর সঙ্গে কি এক কারণে ধুন্ধুমার ঝগড়া লেগে গেল।হাত মুখ নেড়ে কাকুকে বললো রাজু কাকা........আর একদিন যদি তুমার জমি পানে যেছি,তো মুই ঢোল গোবিন্দ কম্মকার এর ব্যাটা ই নই!......বলে নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিয়ে দিলে।
সবাই মিলে অনেক সাধ্য সাধনা করেও খিল খোলানও গেল না।কাকু ও খুব ভয় পেয়ে গেল।
কোথায় বাড়ী,ঠিকানা কিছুই ঠিকভাবে বলেনি রাজু কাকা।আসার পর থেকে কখন যেন বাড়ির ই একজন হয়ে গেছে। বাচ্চা বড়ো সবাই ভালোবেসে ফেলেছে ওকে।কত কাজ যে সারা দিন করে তার হিসেব নেই। প্রত্যেক দিন বিকেলে 
রত্নার দাদুকে মোজা জুতো পরিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য তৈরী করে দেয়,রান্নাঘরে বালতি ভরে জল তুলে দেয়,মাঠে কিষেন দের ভাত নিয়ে
যায়,কত কি! যাই হোক, শেষকালে মায়ের অনেক অনুনয় বিনয় ফেলতে না পেরে ঘর থেকে বেরোয় রাজু কাকা,মাকে বলে.....এই তুমি ডাকলে তাই আগোর খুল্লুম,মায়ের মত মনিষ্যই
রে অমান্যেই কর্তি নাই।দ্যাও ভাত দ্যাও!খিদে 
নেগেছে বেদম!সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো!
             এর ক' দিন পরেই ঘটলো আশ্চর্য এক 
ঘটনা!দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া সেরে মা আর কাকীমা একটু রেডিও টা নিয়ে বসেছে,। রাজু কাকা ও মাঠ থেকে ফিরে বিরাট কলাপাতায়
প্রায় এক হাঁড়ি ভাত , ডাল তরকারি, দিয়ে মেখে,একবাটি টক এর চাখনা দিয়ে খেয়ে দাওয়ায় গামছা বিছিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে,এমন সময় সদর দরজা ঠেলে উঠোনে 
এসে দাঁড়ালো আর এক রাজু কাকা! এক চেহারা,এক মুখ!কেবল পরনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি,, চুল বেশ পরিপাটি করে আঁচড়ানো, হাতে বড়ো সরো একটা মিষ্টির হাঁড়ি!সবাই তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এই নতুন রাজু কাকা তরতর করে এগিয়ে এসে বাড়ীর রাজু কাকা কে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো আর বলতে লাগলো.......তু কেনে এমন 
কল্লি রে ভাই!কি করে এদ্দিন নুকিয়ে রইলি!শেষ
কালে বংশের মুকে চুন কালি মাখালি!যাদের ঘরে রোজ দশ বিশ টা মুনিস খাটে ,গোয়াল ভরা গরু মোষ, সার সার ধানের মরাই,সে কিনা.......!
তার বিলাপের আর শেষ নেই!ইতি মধ্যে বাড়ীর
সবাই জড়ো হয়ে গেছে।নতুন আগন্তুক ,রাজু কাকার যমজ ভাই সাজু কাকা,বহু খোঁজ খবর
করে শেষ পর্যন্ত সন্ধান পেয়ে ভাই কে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। ক্রমশঃ জানা গেলো বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামের 
বর্ধিষ্ণু পরিবারের ছেলে রাজু কাকা।একটু সরল প্রকৃতির,আর বদরাগী। বাড়ীতে রাগারাগি করে চলে এসেছিল,ভাই কে দেখে সে রাগ ও পড়ে গেলো।সবার অনুরোধে সে রাতটা ওরা রত্না দের
বাড়ীতে থেকে গেলো।রাতে অনেক রকম রান্না করে মা কাকীমা যত্ন করে খাওয়ালে চোখের জল ফেলতে ফেলতে।পর দিন দুই ভায়ে যখন চলে গেলো বাড়ীর সবার চোখে জল।যাবার
সময় টুকটুকি কে কোলে তুলে আদর করে রাজু কাকা বললে.......টুকি,আমাদের ঘর যাস কেনে,
আমার ছেমলির দুধ খাওয়াবো,সরালের মাংস রান্দি খাওয়াবো! সেজো কত্তা ,মা ঠাকরুন ছেলে
পিলে দের ন্যে যেও কেনে আমাদের গেরামে!
কলিন পুর গো কলিন পুর!.....।


Monday, July 25, 2022

ছোট গল্প - মুক্তি || লেখক - অলভ্য ঘোষ || Short story - Mukti || Written by Allavya Ghosh


 

মুক্তি

অলভ্য ঘোষ


আমার লিঙ্গের ডগাটা দেখে পাকিস্তানি সৈন্য পোদে লাথি মেরে ছেড়ে দিয়েছিল ।ওটা ইনফেকশনে অমন হয়ে গেছে ছোটবেলায় ; তাই রক্ষে । আমার বোন হিন্দু না মুসলমান এ বিচারে ধরা পড়েনি মেয়ে হবার খেসারত দিয়েছে ট্রেন থামানো একদল মুসল….. না ; রেপিস্টদের হাতে ।অঙ্গে আলতা সিঁদুর কিছুই ছিল না বোরখা ঢাকা তবুও ।সবকিছু হরিয়েও বাংলা দেশের মুক্তির লড়াই লড়েছি আমি বন্দুক হাতে নিয়ে।শান্তি কমিটির ইমান সাহেব ঘোষণা করলো ইন্ডিয়ার দালাল । ভিটে মাটির

যারা সওদা করলো ; তারা রয়ে গেল আমি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এলাম ভারতে।নোংরা নালা । কলকাতার সেই গু মুত ভেসে যাওয়া নালার পাশের বসতিতে আমরা রিফিউজি নেড়িকুত্তার দল ; পিঠে তখনো লেগে রয়েছে কাঁটা তারের ঘা । বাসা নেই, চাকরি নেই, আত্মীয় বলতে শ্যামবাজারের দূর সম্পর্কের ফরিদপুরের মামা । এক বিজয়া দশমীর রাতে মনে হয়েছিল প্রতিশোধ নিই । কার ওপর জানতাম না । এখনো জানিনা । সোনাগাছির মেয়েদের লাইনে গিয়ে নাম জানতে চেয়েছি ।শ্যামলী, কাজরী, বৈশাখী । সাবিনা, রোজিনা, ফতে-মা কেউ নেই ?

এখানে তো সবারি নাম বদল হয় । অনেকটা আমার মতো গান্ডুদের দেশ বদলের মতো । এক দালাল ঠিক চটকরে বুঝেছিল, আমি বাঙ্গাল বাংলাদেশি মাগী খুঁজছি ।

– আছে; নতুন এসেছে টাটকা একটু বেশি লাগবে ।

– নাম কী ?

– বিলকিস বানু । চলবে ?

– চলবে মনে দৌড়বে ।


মনের মধ্যে একটা ছুড়ি সান দিয়ে রেখেছি ওর জন্য ।


দরজা বন্ধকরে মেয়েটার একটার পর একটা কাপড় খুলে নিচ্ছিলাম যখন শিকারি হায়েনার মতো ; তখনো আমি মেয়েটার মুখটা দেখতে পাইনি ।

 

ও দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে শুধু থরো থরো কাঁপছিল । 


ও যতো কাঁদছিল আমার শিশ্নটা ততোই মেশিন গানের মতো মুখ উঁচিয়ে নাচছিল আনন্দে ।মুখের আগে বুকটা খুলে নখ বসাতে গিয়ে একটা জড়ুল দেখলাম ।


হটাৎ থার্মোমিটারের পারদ গেল পড়ে । 


ছোটবেলায় আমার বোনকে যখন পুকুরে সাঁতার শেখাতাম কতবার ঐ জড়ুল দেখেছি ওর ছাতিতে ।জলাতঙ্ক রুগীর মতো ঘরের এক কোনে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় মেয়েটাকে আমি বলেছিলাম;

 -কে তুই ?

মুখের থেকে হাত সরিয়ে, জল ঠাসা দুটো চোখে বলেছিল :

– আমি চট্টগ্রামের ভাল ঘরের মাইয়া । পাঁকে চক্রে এইখানে এইয়ে উঠছি ।

নাম শুধলে বলল ;

– দুর্গা । এরা আমায় বিলকিস বইলে ডাকে । আমি বাইচতে চাই ।

– আমার বোনও একথা বলেছে । বাঁচা মরা কোনকিছুই তো আমাদের হাতে নেই ।

– কার হাইতে আছে ? ধম্ম ? কোন ধম্ম এমন বিধান দেয় ?

– যে ধর্মে মানুষ আর মানুষ থাকেনা ।

– ভগবান বলে কিছু নাই ?

প্রচণ্ড হাসি পেয়েছিল আমার ;

– ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা এই পাড়ারই কোন মেয়ের সায়ার তলায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে ।

আসলি ভগবান তো ইয়াইয়া খান । এত বড় খান কি পৃথিবীতে একটাই ।

বিজয়ার বিসর্জনের ঢাক বাজছিল একটার পর একটা ঠাকুর পরছিল বাবু ঘাটের

গঙ্গায় আমাদের ইছামতীর মতো নৌকাবিহার এখানে হয় না । প্রতিমা ডুবতে গিয়ে

কেউ যদি ডুবে যায় পাহারাদার নৌকো তুলে আনে । এখানে ডুবানো হয় নিষ্ঠুরভাবে

নেচে কুদে দুর্গাকে শুধু একটা কাঠামো ভাবে ভক্তি কম । কলকাতার সব খারাপ বলবো না । এর মতো উদার সস্তা বাসস্থান ভূভারতে কোথাও নেই । আমার গান্ধী কলোনির ঝুপড়িতে বিসর্জিত দুর্গার প্রতিষ্ঠা হল । কালীঘাটে পনের টাকা খরচায় বিয়ে । মুক্তি কি হয়েছে আমাদের ?


আমার মেয়ে এখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী । বাংলাদেশের শান্তি কমিটির সংস্কৃতিতে

নির্মিত রিফিউজি উন্নয়ন কমিটির দৌলতে দখলে জমিতে বানানো ছাদ ঢালা বাড়ির ছাদে একটা মোবাইল কানে বিদ্যা ছেড়ে বিদ্যাবালান হয়ে আমার মেয়ে ভাদ্র মাসের ছোঁক ছোঁকে নেড়িকুত্তাদের মত ছেলেদের পিট বুক খোলা জামা আর পাছা দেখায় জিন্সপরে মনোরঞ্জন করে । ক্লাস সেভেনেই বইয়ের ভেতর থেকে পাওয়া গিয়েছিল বি-এফ এর ডি ভি ডি । এই বয়সেই যৌন বিজ্ঞানের জ্ঞানে স্বয়ং বাৎস্যায়নকে পিছনে ফেলে দিয়েছে । সে জানে গর্ভধারণ-নিরোধের ওষুধ সাধারণত মাসিকের নির্দিষ্ট সময়ান্তে দীর্ঘ মেয়াদে মেয়েদের সেবন করতে হয়। পেট হবার তার কোন সম্ভাবনা নেই । রেপ হবার ও নয় । রেপ তো মতের বিরুদ্ধে হয় । আসলে এখানে ধরা পরলে ধনজ্ঞয় ; না পরলে গুরু এঞ্জয় ।


আমার মেয়েকে কোনদিন আমাদের ইতিহাস বলা হয়নি । যে টুকু বলেছি সব টুকু ঢেকে পরিমার্জিত করে । ভয়ে না লজ্জায় কিছুই জানানো হয়নি । কোন কোন সময় ভেবেছি আমি তোমার বাবা এটুকু বললেই যেমন সব বলা হয়ে যায় কেমন করে তার পৃথিবীতে জন্ম হল । অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করে ইন্ডিয়াতে আসা ; এ বললে কষ্টটা কী বোঝানো য়ায় না ? তারপরেই মনে হয়েছে যে কোনদিন অমৃত খায়নি তার কাছে ওটা শুধু মিষ্টি রসগোল্লার মতো । মিষ্টতা ছাড়াও অমৃতের একটা পবিত্র স্বাদ আছে যা পেলে মানুষ অমর হয় । যা আমরা কোন দিন পাবো না । তেমনি যন্ত্রণা উপোষের মতো মানুষকে সংযমী করে হিসেবী করে আবার বোধয় কিছুটা স্বার্থপর। যাই করুক ঘা খাওয়া বিবেক হয় সদা জাগ্রত । দেশ হারানোর ঘা ; জ্ঞাতি হারানোর ঘা । এই ঘা আমার মেয়ের নেই ; সে যুদ্ধ বলতে জানে বর্ডার ফিল্ম, দেশ ভাগ বলতে রিফিউজি, আর প্রেম বলতে কহনা প্যার হ্যাঁয় । হিন্দি সিনেমাতে না খেতে পাওয়া নায়িকাও ডাগর ডগর কমলা লেবুর মতো বুক আর তানপুরার মতো পাছা । বাস্তবে না খেতে পেলে সব শুকিয়ে আমসি হয়ে যাবে । এরা বাস্তবটা জানে কম । বেঁচে থাকে স্টার সোনি ম্যাক্স টিভি দেখে । যেখানে ছবিতে সিরিয়ালে শুধু দেখান হয় পরকীয়া । একাত্তরের পাকিস্তানি সৈন্যদের মতো চ্যানেল কর্তাদেরও শুধু লক্ষ মানুষের যৌন অঙ্গ ; চলছে দেদার সুড়সুড়ি । সকলেই লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে সংস্কৃতির বেতাল নাচ । অতি সংস্কৃতিবানেরা বি এফ বানাচ্ছে রিয়েলিটি তুলে ধরতে ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্র সংগীত। কোন কিছুই বলছেনা আমার মেয়েকে তার মায়ের অতীত জীবনের কথা ; তার পিসির অপর লুণ্ঠনের কথা ; তার বাবাকে রাষ্ট্রের নগ্ন করে পরীক্ষা করার কথা । আমিও কিছুই বলেনি তাকে । মুক্তিযুদ্ধ নাকি এবার পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্য পুস্তকে থাকবে । থাকলে কী আমার মেয়ে ঠিকঠাক তার ইতিহাসটা জানবে ? নাকি ক্ষতগুলো ঢেকে মজে থাকবে রাখি সাওয়ান্তের “স্বয়ংবরে ”। টিভি রোগে ভোগা ভালবাসায় গাইবে হান্ডেট পার-সেন্ট লাভ । এখানেও ধর্ম আর রাষ্ট্র শক্তির ফণা সেকুলারিজমের আড়ালে মেঘনাদের মতো সুযোগ খোঁজে । জেনারেল কাস্টে আশি শতাংশ নম্বরেও যখন সরকার মুখ ঘোরায় কার কার কম পেলেও চলে । বিভাজন চলছে চলবে অণু থেকে পরমাণু হলেও আমাদের ছাওয়ায় এটম বোমার সম্ভাবনা । আত্মা থেকে পণ্যে মনুষ্যত্বর সোপানগুলো ভেঙ্গে চুরে তচনচ করে দিলে বেঁচে থাকবে ডিজিটাল নেশাগ্রস্থ একটা জানোয়ার । যার হাত পা মাথা থাকবে শুধু থাকবে না মস্তিষ্কে মুক্তির স্বপ্ন । কয়েকটা বোতামের চাপে হোটফাদার তাকে দিয়ে দাসোচিত সব কিছু করিয়ে নেবে অনায়াসে ।


আমার কান্না পাচ্ছে; এত কথা বললেও কিছুই আমার মেয়ের কানে পৌঁছাবে না । কিছুই আমার বলা হল না । হাত পা মাথা সব কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে । পেরালাইসিস হবার আগে আর একবার শুধু আমি বলতে চাই;

” আমি মুক্তি চাই আমাকে মৃত্যু দাও। ”



Sunday, July 24, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -12


 


আমি বাবার কাছে ফিরে যাবো। এই নরক যন্ত্রণার হাত হতে আমাকে মুক্ত হতে৷ ঐ লম্পটের পৈশাচিক লালসা আমাকে তিলে তিলে দগ্ধ করছে, আর এক মুহুর্তও এখানে থাকবো না। কিন্তু গৃহ হতে বেরুবার পথ না পেয়ে দমাদম ধাক্কা মারতে শুরু করলাম। কোন ফল হলো না।


 মনে হয় আমার শব্দ শুনে সেই বর্ষীয়সী গৌরবর্ণা মহিলা চোখ রগড়াতে রগড়াতে আমার কাছে এসে রুদ্র মূর্ত্তি ধারণ করে দারুন বকাবকি শুরু করলো, কি ভেবেছিস ছুঁড়ি? কপাটে ধাক্কা মারছিস কেন? ভাবছিস বেরিয়ে চলে যাবি? খবরদার এ বাড়ীর এক পা যদি বাইরে রেখেছিস তাহলে পিঠে চাবুকের দাগ বসে যাবে। ও কথা শুনে ভয়ে শিউরে উঠলাম। আমি কি ওর বাঁদী যে ওর কথাতে উঠতে বসতে হবে? 

তাই গলা হাঁকিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, আমি কি আপনার ক্রীতদাসী যে আপনার কথা শুনতে হবে?

 হ্যাঁলো ছুঁড়ি শুনতে হবে। তোর মুখ দেখতে রোন্টার কাছে ৮০ হাজার টাকায় কিনিনি।

কি বললেন রন্টুদা আমাকে বিক্রি করেছেন? 

ভালোই তো করেছে, বাড়ীতে না খেতে পেয়ে মরতে চলেছিলি। এখানে খাবি দাবি স্ফূর্তি করবি। শোন্ আর জ্বালাস না বাপু। আজকের মতো ঐ বেঞ্চিটাতে শুয়ে পড়, কাল থেকে সব ববস্থা হবে। 

সে চলে গেলো। ওর কাছে ও কথা শুনে রন্টুদার প্রতি ঘৃণায় আমার সর্ব শরীর বিষাক্ত হয়ে উঠলো। এক অজানা আশঙ্কায় আমি দেহে ও মনে সংকুচিত হয়ে গেলাম। রাগে অভিমানে ধীরে ধীরে আমার শরীরের শিরা উপশিরাগুলো সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে থাকলো। রন্টুদা এত নীচ। এতোখানি বিশ্বাসঘাতক! সে আমাকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে এক লম্পটের হাতে! নিজের দুঃখে আক্ষেপে মনে হলো আত্মহত্যা করি। না-না এ আমি সহ্য করতে পারবো না। এর থেকে মৃত্যু অনেক ভালো। কিন্তু এই পথ তো আমি চাইনি? এভাবে নিজেকে আত্মবলি দিতে চাইনি? বিশ্বাস করে দুটো পয়সা উপার্জনের জন্য রন্টুদার সাথে-না? তাকে দাদা বলতে ঘৃণা করি। সেই বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, তার শয়তানীর মুখোস আমি খুলে ফেলেছি। জানতে পারিনি তার হৃদয়ের অন্তরালে এতোখানি নোংরামী ছিলো। সে এতোখানি নীচ মনোবৃত্তি ব্যক্তি তা বুঝতে পারিনি।

সেই সময় মনে পড়লো পাড়ার ছেলে সমীরদার কথা। তিনি রন্টুদার অধঃপতন নিয়ে ঠিকই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বরং আমি রন্টুদার উপচিকীর্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তবে কি জানিস রমা, এই বর্তমান যুগে মানুষ বড় পাশবিক স্তরে নেমে গেছে। যদি ওকে বিশ্বাস করিস, তাহলে ওর সঙ্গে যেতে পারিস! কারণ প্রতিবেশী হয়েও কখন এই অসময়ে কোন সহযোগিতা করার মত আমাদের ক্ষমতা নেই। গিয়ে দেখ কি চাকুরী তোকে দিচ্ছে সে। 

সেদিন সমীরদার কথাকে অবজ্ঞা করে রন্টুদাকে আমার মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝছি ওসব তার অন্তঃসার শূন্য ও কৃত্রিম লোক হিতৈষীতা। ভাবছি তার এই বেইমানীর প্রতিশোধ কি করে নেব। সামান্য নারী হয়ে কুখ্যাত সমাজ বিরোধীর সর্বনাশা কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো কি?

 এখন কি করবো, এই রুদ্ধ গৃহে বন্দী হয়ে পুরুষের কামাদগ্ধ হওয়ার চেয়ে আমার মৃত্যু শ্রেয়। আমি জানি একবার যে বারবনিতা, চিরকালই সে বারবনিতা। বাবার কথা মনে পড়তেই আরো মুঝড়ে পড়লাম। ঠাকুর এখন কি করি , আমাকে পথ বলে দাও, এই পথ আমার নিকট অসহ্য হয়ে উঠবে। বিবেকের তীব্র দংশনের জ্বালায় আমি ক্ষত - বিক্ষত। তুমি আমার মৃত্যু দাও ঠাকুর। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। মানুষ চেনার মনস্তাপে বার বার দেওয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলাম। 

হঠাৎ কার স্নেহ স্পর্শে ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম, আমার চেয়ে বয়সে হয়তো তিন চার বছরের বড় হবে, শ্যামল বর্ণের হলেও আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বুঝতে পারলাম দেহের কোথাও কোথাও যেন রূপলাবণ্যের ছাপ আঁকা। আয়ত নেত্র, মসৃণ গন্ড, সুতীক্ষ্ণ নাক, গ্রীবাটিও সুন্দর। তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। মনে হয়েছিলো কোন সৌন্দর্য্যে লোক হতে জ্যোতিময়ী রমনী আমাকে এ বিপদ হতে রক্ষা করতে এসেছেন।

 তিনি নম্রকণ্ঠে বললেন, তুমি যে স্বেচ্ছায় এখানে আসোনি তা বুঝতে পেরেছি তোমার কান্না শুনে। কোন মহাপুরুষের ইঙ্গিতে এই ফাঁদে পা দিয়েছো? 

কেঁদে উঠলাম তার কথা শুনে। মুখে কোন প্রকারে বাক্য বের হতে চাইলো না। ওর ধমকে অস্পষ্ট গলায় রন্টুদার ঘৃণ্য জীবনের ইতিহাস সংক্ষেপে বললাম।


তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এই ভাবেই আমাদের আসতে হয়রে, নইলে কেউ কি সাধ করে এই গরল পেয়ালা পান করতে চায়? নারীর দেহকে যারা ভোগ্য সামগ্রীর মতো মনে করে, যারা নারীত্বের চরম অবমাননা করে, তাদের সান্নিধ্যে কে আসতে। আমিও ঠিক তোর মতো এক পথভ্রষ্টা নারী। পুরুষের শাঠ্যের ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আমি এক গ্লানিময় জীবনে ফিরে এসেছি। তোকে তুই বলে ডাকার দুঃসাহসের জন্য আমাকে মার্জনা করিস। 

ঐ স্নেহময়ীর নারীর দুঃখ ভরা কথা শুনে বললাম, আপনি যখন আমাকে বোনের মতো মনেই করেছেন, তাহলে আমাকে এই অধঃপতিত ও কেদাক্ত জীবনের পঙ্কিলতার আবর্ত্ত থেকে মুক্ত করুন। আমার অন্তরে নারীত্বের শুভ্র শতদল বিকশিত করে তুলুন দিদি। 

তিনি আমার হাত দুটো ধরে অশ্রু ভরা নয়নে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, কোন উপায় নেই রে বোন। একবার যে নারী সতীত্বকে ধূলায় লুণ্ঠিত করে এই পাপ পথের যাত্রী হয়েছে তাকে কোন মতেই মুক্তির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেওয়া হয় না। এখানে বাবু গুন্ডা নামে এক কুখ্যাত ব্যক্তির কাছে ‘ শংকর মাছের চাবুক ' আছে, যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে এই পিঠটা দেখলে বুঝতে পারবি। 

বিলম্ব না করে ব্লাউজটা খুলে আমাকে পিঠটা দেখালেন, দেখলাম অজস্র চাবুকের দাগ। তোর মতো অসহায় নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে বাবু গুন্ডা আমাকে অজস্র বেত্রাঘাত করেছে। জানিস ও মানুষ নয় জানোয়ার। তাই বলছি এখান হতে কোন প্রকারে মুক্তি পাবি না। বন্দী শালায় আবদ্ধ হয়ে চিরকাল অশান্তির আগুনের দগ্ধ হতে হবে। নারীদেহ লোভী হিংস্র মানুষের সে যুগ দৃষ্টি কোন মতেই এড়াতে পারবি না। এখানে পরুষের লীলা খেলা চাপল্য খেয়াল খুশীয় সবই নির্বিবাদে সহ্য করতে হবে। প্রতিবাদের কোন পথ নেই রে বোন। 

ওর কথা শুনে পনুরায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার এই ধিকৃত জীবনের অভিশাপের জন্য ভগবানের নিকট অভিযোগ জানালাম। ঠাকুর এই পঙ্কিলময়, নর্দমার নরককুন্ডে কেন আমাকে নিক্ষেপ করলেন? আমি তো কোন অন্যায় করিনি যে, দন্ড স্বরূপ আমাকে এই আস্তাকুঁড়ে আশ্রয়। কান্না বাড়তে থাকলে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন সেই সুন্দরী নারী। ওরে পোড়া কপালী কেঁদে কেঁদে নিজেকে দূর্বল করিস না। শুধু তুই কেন, তোর মতো বহুনারীর জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে ঐ শয়তানের দল। তাই বলছি প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা কর। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন পুনরায় বলতে পারিস, আমার কিসের অভাব ছিল? আমার দাদা একজন ডাক্তার, বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ার। অঢেল সম্পত্তি আমাদের। তবুও ভাগ্যচক্রে ঐ শয়তানটার পাল্লায় পড়ে আমাকে বেশ্যা হতে হয়েছে। আমি কি এদের ষড়যন্ত্র ও ছদ্মবেশ জানতে পেরেছিলাম, আমার এই নারী দেহ নিয়ে ওরা ছিনিমিনি খেলা করবে এটা ভাবতে পারিনি বোন।

 ধীরে ধীরে ওর মুখখানি সিঁদুর রাঙ্গা হয়ে উঠলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস তার বুকটা যেন হাপরের মতো উঠানামা করতে লাগলো। তারই মধ্যে চাপা গলায় বললেন, “খবরদার কাঁদবি না, তোকে শক্ত হতে হবে, বুককে পাষাণের মতো করতে হবে। শুধু তুই কেন, বহু মেয়েরা এই পথে এসেছে। তাদের মধ্যে আমরা। প্রতিজ্ঞা কর এই ব্যভিচারী পুরুষদের মুখোস খুলে দিয়ে নারী অবমাননার চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করবি। 

কান্না থামিয়ে অতি ধীর কণ্ঠে বললাম, এতো আমি চাইনি দিদি। 

আমিও কি চেয়েছিলাম? বা অন্য মেয়েরা কি নিজেকে পাঁচের ভোগে লাগাতে চায়? এখানে যত মেয়ে আছে তাদের সকলকে তোর আমার মতো শয়তানদের ফাঁদে পড়ে আসতে হয়েছে। একবার যদি ওরা কোন প্রকারে এই দেহ বিক্রয়ের হাটে কোন নারীকে পণ্য সামগ্রীর মতো হাজির করতে পেরেছে, তাহলে আর রক্ষা নেই, মুক্তির পথ রুদ্ধ। সতীত্ব ও নারীত্ব কাঁচের জিনিষের মতো ভেঙ্গে পড়বে। অসহায় নারী করুন আর্তনাদ এই কুর্নিশ কঠোর শয়তানি কর্ণে প্রবেশ করে না। রাত অনেক হয়েছে, আমার কুঞ্জেই নিশিযাপন করবি চল।

 তিনি আমাকে ওঁর সুসজ্জিত কক্ষে নিয়ে গেলেন। বেদনার অশ্রুজলে আমি এই দয়াময়ী নারীর গৃহভ্যন্তরে বিনিদ্র রজনী যাপন করলাম।



                                 ক্রমশ...

Tuesday, July 19, 2022

ছোট গল্প - মর্যাদাহানি || লেখক - অমিত কুমার জানা || Short story - Marjadahani || Written by Amit kumar jana


 


মর্যাদাহানি

অমিত কুমার জানা 



সোমবার। প্রতিদিনের মতো আজও সৌভিক পৌনে দশটায় মেদিনীপুর স্টেশনে পুরুলিয়া-হাওড়া এক্সপ্রেসে উঠে পড়লো। তিনি পাঁশকুড়ার একটা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।বিশেষ করে সোমবার অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি ভিড় থাকে। সেপ্টেম্বর মাস,নদীকূল কাশ ফুলে ভরে উঠেছে। সৌভিক ছোট থেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পূজারী। সে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে জানালা দিয়ে নদীকূলের অপার সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করছিলেন। এতেও তাঁর মন ভরলো না। তিনি কাশফুলের সৌন্দর্যের ভিডিও রেকর্ডিং করতে লাগলেন। তিনি মোবাইলটা বুকপকেটে রেখে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে কিছুটা জলপান করলেন। ততক্ষণে ট্রেন খড়্গপুর ছাড়িয়ে বালিচকগামী হয়ে গেছে। 

ঠিক এই সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। টয়লেটের দিক থেকে বোরখা পরিহিতা এক মহিলা একজনকে চড় মারতে মারতে বলছেন, " মদ খেয়ে ট্রেনে চড়া অপরাধ আপনি জানেন না? এটা মাতলামি করার জায়গা?" সৌভিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ইনি তো রসুলপুরের একটা ব্যাঙ্কের কর্মী। রসুলপুর বালিচক এবং পাঁশকুড়ার মধ্যবর্তী স্টেশন। সৌভিকদের সাথে একই কম্পার্টমেন্টে মাঝে মধ্যেই উনার দেখা হয়। সৌভিক উনাকে 'স্যার' বলে ডাকলেন কিন্তু ততক্ষণে বেশ কয়েকজন অপরিচিত যাত্রী উক্ত ব্যাঙ্ক কর্মীর উপর চড়াও হয়েছেন। উনি চড় ঘুঁসি খেয়ে বেশ কুপোকাত হয়ে গেছেন। ট্রেন বালিচক স্টেশনে এসে থামলো। দুজন রেলপুলিশ ট্রেনে উঠে উনার সামনে গিয়ে বুঝতে পারলেন উনি মদ্য পান করেছেন। উনাকে তা জিজ্ঞেস করে রেলপুলিশ কোন সদুত্তর পেলেন না। কারণ মদের নেশায় এবং পাপলিকের প্রহারে তিনি একেবারে নাজেহাল। 

কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো যে বোরখা পরিহিতা ঐ মহিলাকে ওখানে খুঁজে পাওয়া গেল না। আর তিনি রেলপুলিশের কাছে কোন অভিযোগ ও করেন নি। সৌভিক ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন ওভারব্রিজের ওপর হেঁটে যাচ্ছেন জনা তিনেক বোরখা পরিহিতা মহিলা। এই সময় ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে রসুলপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। ট্রেন রসুলপুরে থামলে ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে তাঁর দু একজন সহযাত্রী স্থানীয় চিকিৎসালয়ে ভর্তি করলেন। 


স্কুলে পোঁছে সৌভিক কিছুক্ষণ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এটেনডেন্স খাতাটা নিয়ে তিনি ক্সাসে যাচ্ছিলেন। দোতলায় ক্লাস নাইনের ভূগোলের ক্লাস । সৌভিক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে রিসিভ করলেন। তারপর তাঁর নজরে এলো একটা ভিডিও। ট্রেনে আসার সময় ভিডিও রেকর্ডরটা চালু ছিল। তিনি ভিডিওটি দেখে অবাক হলেন। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ঐ বোরখা পরিহিতা মহিলা ইশারা করে ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে ডাকছেন। টয়লেটের সামনে যেতেই ঐ দুজনকে আর দেখা যায় নি। তারপর ঐ মহিলা চড় মারতে মারতে উনাকে টয়লেট থেকে বের করছেন। ভিডিওটা দেখে সৌভিকের কেমন যেন সন্দেহ হলো ঐ মহিলার উপর। মহিলাটি ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে টয়লেটের দিকে ডাকছিলেন কেন? আবার তিনিই বা উনাকে মারলেন কেন? ঐ ব্যক্তি কখন মদ্যপান করলেন? এইসব কথা ভাবছিলেন সৌভিক। এমন সময় তাঁর মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল সোজা গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে। তিনি নীচে নেমে এসে দেখলেন তাঁর মোবাইল ভেঙে একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। মনে মনে এটা ভেবে দুঃখিত হলেন যে তিনি ভিডিওটি রেল পুলিশকে দেখাতে পারলেন না। 


পরদিনের ঘটনা। সৌভিক প্রতিদিনের মতো একই সময়ে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে উঠে পড়লেন। ট্রেন খড়্গপুর স্টেশনগামী। এমন সময় ভিড়ের মাঝে এক যুবতী একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে কষিয়ে চড় মারলেন। যুবতী চেঁচিয়ে বলছেন, " ভিড়ের মাঝে মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া! অসভ্য কোথাকার।" সৌভিক তাকিয়ে দেখলেন ইনি তো রসুলপুরের একটা হাইস্কুলের শিক্ষক। বেশ ভদ্রলোক। উনি জোর গলায় বললেন যে উনি ঐ যুবতীকে স্পর্শ ও করেন নি। তবুও উনার কথা কেউ গ্ৰাহ্য করলেন না। সৌভিক উনাকে চেনেন।উনি মনতোষ স্যার। তিনি তৎক্ষণাৎ ঐ স্যারের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ভিড় সরিয়ে উনাকে সিটে বসালেন। 

মনতোষ স্যার সৌভিককে বললেন যে উনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। হয়তো অন্য কেউ অসভ্য লোক এই কাজটা করেছেন,যার ফল ভুগতে হলো উনাকে। 

ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে খড়্গপুর স্টৈশনে এসে থামলো।

এক অজ্ঞাত পরিচয় যুবক সৌভিক এবং মনতোষের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি হেসে স্টেশনে নেমে পড়লেন। সৌভিক উনার কাছে যেতে উদ্যত হচ্ছিলেন, কিন্তু উনি দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। সাথে সাথে খড়্গপুর থেকে ট্রেন ছেড়ে দিল। 


স্কুলে পৌঁছে সৌভিকের মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তার এটা মনে হল যে পরপর দুই দিনের এই দুর্ঘটনা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না যে এই ঘটনাগুলো কেন ঘটছে। 


পরের সপ্তাহের সোমবার এর ঘটনা। পাঁশকুড়ায় ট্রেন থেকে নেমে সৌভিক শুনতে পেলেন যে আজ অন্য একটা কম্পার্টমেন্টে একজন স্কুল শিক্ষক বোরখা পরিহিতা এক মহিলার দ্বারা প্রহৃত হয়েছেন। ওই স্কুল শিক্ষকের নাম সঞ্জয় বেরা।সঞ্জয় বেরা নামটা শুনে সৌভিক চমকে উঠলেন।

উনি বালিচক হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।


পরদিনের ঘটনাটা সৌভিককে আরো বিব্রত করে তুললো। গতকাল ট্রেনে সঞ্জয় বেরা নামক স্কুলশিক্ষককে একজন বোরখা পরিহিতা মহিলা মারধর করেছিলেন। সেই মারধরের ভিডিও আজ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটিতে কয়েক শত লাইক কমেন্ট পড়েছে। সৌভিক দেখলেন ভিডিওটি লাইক করেছে তারই এক পুলিশ বন্ধু কোতোয়ালি থানার এস.আই সমরেশ তিওয়ারি। সৌভিক তৎক্ষণাৎ সমরেশ তিওয়ারিকে ফোন করলেন। তারপর তিনি পার্সোনালি সমরেশ তার সঙ্গে দেখা করলেন। দেখা করে তিনি উনাকে বললেন যে ট্রেনে পরপর দুটো সোমবারে যে দুটো দুর্ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে তিনি কিছু বলতে চান। তিনি বললেন যে তিনি ওই ব্যাংক কর্মী এবং সঞ্জয় বেরাকে ভালোভাবে চেনেন। ওই দুইজন অতি পরিচিত এবং ভীষণ ভদ্রলোক। আজ পর্যন্ত উনারা কোন মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন নি। শুধু তাই নয় উনার আজ পর্যন্ত মদ্যপান ও করেন নি। সম্ভবত এটা ঐ বোরখাধারী মহিলার কাজ, হয়তো উনি বিগত কোন ঘটনার বদলা নিয়েছেন এইভাবে।


এরপর সমরেশ তিওয়ারি সৌভিকের কথার গুরুত্ব অনুভব করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিলেন। যে এই ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তাকে উনি মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি তাকে বললেন, " আমি ইউটিউবের একটা চ্যানেল থেকে বলছি, ঐ ভিডিওটি থেকে আপনি অনেক টাকা রোজগার করতে পারবেন। আপনার মোবাইল নাম্বার দিন।" 

সমরেশ মোবাইল নাম্বার পেয়ে গেলেন। তারপর ঐ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন যে উনার নাম সুতনু। সুতনু এই ভিডিওটি নিয়েছে তার মাসির ছেলের কাছ থেকে। তার মাসির ছেলের আপত্তি সত্ত্বেও গোপনে সুতনু এই ভিডিওটি নিয়ে নেয় এবং ফেসবুকে আপলোড করে ফেলে। 


এরপর সমরেশ আইনি ভয় দেখিয়ে সুতনুকে তার সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য করেন। সুতনু যখন জানতে পারে যে সমরেশ একজন পুলিশ অফিসার তখন সে সব কথা গড় গড় করে বলে ফেলে। সমরেশ সুতনু দেওয়া জবানবন্দি মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং করে ফেলেন। 

সুতোর দেওয়া জবানবন্দিটা ছিল এইরকম:


আজ থেকে ছয়-সাত মাস আগে মার্চ মাসের ঘটনা। সুতনুর মাসি মেসোমশাই এবং তার মাসতুতো ভাই পুরুলিয়া -হাওড়া এক্সপ্রেসে হাওড়া যাচ্ছিলেন। সুতনু মাসির নাম কল্পনা নায়েক। তার মেসোমশাই ভরপুর মদ্যপান করে ট্রেনে চড়ে ছিলেন। তিনি এতটাই মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিলেন। 

সিটে বসে থাকা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তিনি দুর্ব্যবহার শুরু করেছিলেন। একজন তরুণী তার ব্যবহারে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন। ওই কম্পার্টমেন্টে বসে থাকা অনেকেই নির্বাক দর্শক হয়ে সেই ঘটনা দেখছিলেন। সেই সময় অতিষ্ঠ হয়ে ওই ব্যাংক কর্মী এবং সঞ্জয় বেরা নামক স্কুল টিচার এর তীব্র প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। ক্রমশ উনাদের সাথে সুতনুর মেসোমশাইয়ের প্রবল বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। তখন কেউ কেউ বলেন যে ঐ মাতালটাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিন। অসভ্য,অভদ্র কোথাকার! তা সত্ত্বেও ওর মেসোমশাই অভদ্রতা করেই যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় ঐ ব্যাঙ্ককর্মী এবং সঞ্জয় স্যার ওর মেসোমশাইয়ের কলার ধরে চড় লাগিয়ে দেন। এতে সুতনুর মাসিমাও সঞ্জয় স্যার এবং ব্যাঙ্ককর্মীকে চড় লাগিয়ে দেন। আসলে সুতনুর মেসোমশাই যতই খারাপ মানুষ হোক না কেন মাসিমা উনাকে খুব সম্মান করতেন, ভালবাসতেন। 

তারপর বালিচক স্টেশনে রেলপুলিশ সুতনুর মেসোমশাইকে কড়া ভাষায় গালিগালাজ করেন,কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে ছেড়ে দেন। তখনই সুতনুর মাসিমা প্রতিজ্ঞা করছিলেন যে যাদের জন্য তার পতির এতটা মর্যাদাহানি তাদের তিনি ছাড়বেন না। এর প্রতিশোধ তিনি নেবেন। 

এরপর সুতনুর মাসিমা বোরখা পরে নিজেকে আড়াল রেখে ব্যাগে জলের বোতলে মদ রেখে পুরুলিয়া-হাওয়া এক্সপ্রেসে উঠতেন। তারপর যেদিন সুযোগ এল সেদিন ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে টয়লেটে ডেকে বোতলের মদ উনার মুখে ঢেলে দিলেন। পরের সোমবার তিনি বোতলের মদ সঞ্জয় স্যারের গায়ে ঢেলে দিলেন। এইদিন তাঁর ছেলেও সেখানে উপস্থিত ছিল। যখন ভিড়ের মাঝে অনেকে সঞ্জয় স্যারের উপর চড়াও হলেন তখন উনার ছেলে সেই দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে ফেলে। সব ঠিক ছিল কিন্তু সুতনু মাসির বাড়ি গিয়েই ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে। ভিডিওটি ফেসবুকে আপলোড করে ফেলে।


সব শুনে সমরেশ মহিলা পুলিশ নিয়ে চলে এলেন কল্পনা নায়েকের বাড়ি। কল্পনা নায়েককে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে গেলেন।

Monday, July 18, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -11


 


হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি করে একটা মোড়ে এসে নামলাম। মোড়ের চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। স্থানে স্থানে লোক জামায়েত রয়েছে। কতকগুলো মেয়ে পুরুষদের সাথে নানা ঢঙে কথা বলছে। হঠাৎ কানে একটা অশালীন কথা ভেসে এলো। কে যেন বলে উঠলো, কি লো রজনী বেশ তো সেজেগোছে রাতের নাগরদের জন্য দাঁড়িয়ে। আছিস, বলি নাগরকে কাছে পেয়েছিলি? 


আবার কে যেন বলে উঠলো, মাইরি বলছি, তোমাকে ছাড়া একদিনও থাকতে পারি না। কি যাদু জানো বলতো প্রিয়া?

 এরা যেন নারীকে বিলাসের উপকরণ ও ভোগ্য পণ্য রূপে ব্যবহার করেই কৃতার্থ। রন্টুদাকে জিজ্ঞাসা করবার আগে রন্টুদা বলে উঠলো, এ জায়গাটা ভালো নয়। কেদারদার বাড়ীর প্রবেশ পথ বড়ো নোংরা পরিবেশ। তাড়াতাড়ি পা ফেলে এগিয়ে চলো। রন্টুদা একটা গলির মধ্যে নিয়ে এলেন। কোন আলোর ব্যবস্থা নেই বলে একটা টর্চ বের করে এগিয়ে চললেন। আমি অনুসরণ করে চলেছি ওর পিছনে। ঐ অন্ধকারে মিনিট পাঁচের মধ্যে একটা বাড়ীতে প্রবেশ করলাম। বেশ বড় বাড়ীখানা। 

রন্টুদা বললেন, এটা টাইপ মাস্টার মশায়ের বাড়ী। আর স্কুল হচ্ছে অন্য জায়গায়। আমার বাড়ী হতে বিশেষ দূর হবে না। তুমি এখানে একটু বোস, আমি ভেতরে গিয়ে খবর নিয়ে আসছি মাষ্টার মশাই আছেন কি না। রন্টুদা প্রস্থান করলো।

 একটা বেঞ্চে বসে ঘরের চারিপাশটা দেখছি। দেওয়ালে টাঙানো বুদ্ধদেব মূৰ্ত্তি। মূর্ত্তির নীচে কালো রঙের লেখা রয়েছে, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি”। ভাবলাম মাষ্টার মশাই বুদ্ধদেবকে প্রচণ্ড ভক্তি করেন। হঠাৎ উদয় হলো বাবার কথা। এখন তিনি কি করছেন তা কে জানে? মনে হয় ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছেন আমাদের যাত্রা সফল হোক। বাবর জন্য চোখ দুটো ছল্‌ছল্ করে উঠলো। কোন প্রকারে নিজেকে সামলে নিলাম।

 এমন সময় কানে ভেসে এলো নারীর কণ্ঠস্বর। কি সুন্দর গান করছে মেয়েটা। মনে হয় মাষ্টার মশায়ের বৌ কিম্বা মেয়ে হতে পারে। খুব ভালো লাগছিলো। গানের অর্থ তো আমার অজানা তবুও সুরটা আমার কাছে মায়াচ্ছন্ন ছিলো। গান ভালো লাগার জন্য ক্ষণিকের জন্য সব কিছু ভুলে কান দুটোকে ওদিকে সজাগ করে রেখেছিলাম।

 হঠাৎ কপাট খোলার শব্দ পেয়ে চমকে উঠলাম। একজন মধ্য বয়সী সুঠাম পুরুষ প্রবেশ করতেই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। তিনি বসতে বললেন। বসলাম।

 তিনি একটু দূরে চেয়ারে বসে আমাকে বললেন, তোমার কথা রন্টুর মারফৎ শুনে বড় দুঃখ পেলাম। সে বড় উপকারী যুবক। তোমাদের উপকারের নিশ্চয় সে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।

 সলজ্জে আনত মুখে বললাম, রন্টুদা কোথায়?

 তিনি বললেন, রন্টু ওর বৌদির সাথে গল্প করছে। দু - দিন সে আমাদের বাড়ীতে আসতে পারেনি বলে তার কত আফশোষ। ঐ কথা শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো তাহলে বাবার সান্নিধ্যে এড়িয়ে আমিই বা কি করে এখানো থাকবো। বাবার নিয়ে চিন্তা করছি এমন সময় মাষ্টার মশায়ের জিজ্ঞাসায় আমার চিন্তা হলো। 

কতদূর পড়াশুনো করেছো? 

বললাম, মাধ্যমিক পাশ করেছি। 

তাহলে কোন চিন্তা নেই। 

আমাদের কথা চলাকালীন একজন বর্ষীয়সী গৌরবর্ণা মহিলা তাম্বুল চর্বন করতে করতে আমাদের কাছে উপস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাষ্টার মশায়কে বললেন , যাবার সময় দেখা করবে বাপু। আমি চললাম।

 মাষ্টার মশায় ঘাড় নাড়লেন। তিনি বললেন, তোমার নাম কি রমা? 

হ্যাঁ।

 টাইটেল খাসনবিশ না কি বলল যেন রন্টু... 

না আমার পুরো নাম রমা সিন্হা। 

বেশ, বেশ, তুমি কি কাল হতেই ক্লাস আরম্ভ করবে?

 রন্টুদাকে জিজ্ঞাসা করল ভালো হতো না?

 ঠিক আছে পরে জিজ্ঞাসা করে নেব। চলো আমার সাথে ফরম ফিলাম করতে হবে।

 এবার প্রতিবাদ করে বললাম, আর রন্টুদা? 

কোন ভয় নেই পাশের রুমে আমরা যাচ্ছি ওখানে রন্টু আছে। এসো আমার সাথে।

 পিছু নিলাম, একটা রুম পেরিয়ে ওর পিছনে গিয়ে একটা রুমের মধ্যে প্রবেশ করলাম। কোথায় রন্টুদা! আমি প্রবেশ করতেই মাষ্টার মশাই কপাটের খিলটা তুলে দিলেন।

 বললাম, কপাট বন্ধ করলেন কেন?

 কোন কথা নেই ওর মুখে। শুধু হিংস্ৰ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরনের জামাটা খুলে ফেললেন। লোকটার আচরণে দেখে আমি সন্দিগ্ধ হলাম। ভয়ে ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে থাকলাম। তবুও জোর করে কিছু বলার চেষ্টা করবার আগেই আমাকে। তার লৌহ কঠিন বাহু দিয়ে চেপে ধরে তক্তোপশোষে শুইয়ে পরনের পোষাক গুলো ছিন্ন ভিন্ন করার চেষ্টা করলো। লম্পটের লৌহ কঠিন বাহু জাল ছিন্ন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। অপমানে ও ক্ষোভে আমি নিজের নারী জীবনকেই ধিক্কার দিলাম। এই ধিককৃত জীবনের গ্লানি কি করে সারা জীবন বয়ে বেড়াবো!

 ধীরে ধীরে তক্তপোষ হতে উঠবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারছিলাম না। মনে হলো কেউ যেন লোহার শিকল দিয়ে আমার পা দুটোকে বেঁধে রেখেছে তক্তপোষের সাথে। বহু কষ্টে উঠে ছড়িয়ে থাকা শাড়ীটা দেহে জড়িয়ে টলতে টলতে বাইরে এসে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলাম। একি করলে ঠাকুর! আমাকে অপবিত্র করলে? না - না এর জন্য কেউ দায়ী নয়। এই দৈহিক অপবিত্রতার জন্য আমার ভাগ্য দায়ী। কিন্তু আমি যে কিছু বুঝতে পারিনি। তবে রন্টুদার সব জালিয়াতি? হ্যাঁ, হ্যাঁ, রন্টুদা ঠক প্রতারক, ওর প্রবঞ্চনা বুঝতে পারছি।



                                   ক্রমশ...

Thursday, July 14, 2022

উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -10 ||অন্তিম পর্ব


 

দশ


ঋজু বাড়ি ঢুকে দেখে বারান্দার গ্রিল ধরে ভারতী দাঁড়িয়ে আছে। এত বছর বিয়ে হয়েছে তার, ওকে কোনও দিন এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি সে। তার খাবার, টেবিলে ঢাকা দেওয়া থাকে। অফিস থেকে ফিরে ও কাউকে ডাকাডাকি করে না। হাত-মুখ ধুয়ে, চুপচাপ খেয়ে নেয়। এঠোঁ বাসন রান্নাঘরের সিঙ্কে রেখে দেয়। কিন্তু আজ হঠাৎ এমন কী হল যে, রাত পৌনে একটার সময় তার বউ এই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। জুতো খুলতে খুলতে প্রশ্ন করল ঋজু, কী হল? শোওনি?
— না।
— কেন?
— শুলে যদি ঘুমিয়ে পড়ি! তোমাকে বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
— কী?
— ও ফোন করেছিল।
— কে?
— কণিকা।
— কণিকা! আকাশ থেকে পড়ল ঋজু।

বইমেলার ইউ বি আই অডিটোরিয়ামে যে দিন দীপ প্রকাশনের অতগুলি বই আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হল, তার দু’দিন আগেই, কী কী বই বেরোচ্ছে, তার তালিকায় চোখ বোলাতে গিয়েই একটা নামে চোখ আটকে গিয়েছিল ঋজুর। এটা কী হল! ওর বইও বেরোচ্ছে নাকি!
ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল, তার দু’রবিবার আগেই সুবোধ সরকার ওর কাছে কণিকার ফোন নম্বর চেয়েছিলেন। ও ভেবেছিল, অন্যান্য বারের মতো এ বারও বুঝি হয় ল্যান্ড ফোন, নয়তো বি এস এন এলের ব্রড ব্যান্ড নিয়ে ওঁদের কোনও সমস্যা হয়েছে, তাই ওর নম্বর চাইছে। ও দিয়েছিল। সে দিনই সুবোধ ওকে বলেছিলেন, ভাষানগর তো এ বার খুব বড় আকারে বেরোচ্ছে, দেখো না, যদি দু’-একটা বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে পারো।
ভাষানগর একটি অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা। সম্পাদনা করেন সুবোধ আর মল্লিকা। কিন্তু ঋজু বিজ্ঞাপন আনবে কোথা থেকে! ও ওর অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছিল।
পরের রবিবার যখন গেল, সুবোধ বললেন, তোমার সঙ্গে কি কণিকার এখন যোগাযোগ আছে?
ও জিজ্ঞেস করেছিল, কেন সুবোধদা?
উনি বলেছিলেন, ও দুটো বিজ্ঞাপন এনে রেখেছে। যদি নিয়ে আসো। ওর অফিস তো তোমার অফিসের কাছেই। ঋজু বলেছিল, না, ওর সঙ্গে আমার এখন আর দেখাসাক্ষাৎ হয় না।

তালিকায় ওর নামটা দেখে ঋজু বুঝতে পারল, বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দিয়ে সুবোধদাকে খুশি করে, সুবোধদাকে দিয়েই এই কাজটা ও করিয়েছে।

বই প্রকাশের দিন ঋজু একটু আগেই গিয়েছিল। অনুষ্ঠান শুরুর মুখে মঞ্চের লাগোয়া গেট দিয়ে কারা যেন ঢুকল। কারা! ঋজু তাকিয়ে দেখে, কণিকা, কণিকার দুই মেয়ে, মহাদেববাবু আর একজন কে যেন!
কে উনি ! কণিকা যার সঙ্গে গড়িয়াহাটে দেখা করতে গিয়েছিল কিংবা উল্টোডাঙার গলির ভিতরের এক রেস্তোরাঁয় যার সঙ্গে পর্দা ডাকা কেবিনে দীর্ঘক্ষণ কাটিয়েছিল, এ কি সে-ই! না। এ নিশ্চয়ই সে নয়! দীপঙ্কর তার যে বর্ণনা দিয়েছিল, তার সঙ্গে তো এর কোনও মিল নেই। পরে দীপঙ্কর ফলো করে করে আরও অনেক খবর এনেছিল। বলেছিল, লোকটার নাম অভিজিৎ শেঠ। থাকে যোধপুর পার্কের কাছাকাছি, রহিম ওস্তাগার লেনে। ওর বউ স্থানীয় একটা ছোট স্কুলে পড়ায়। ওদের একটা চার-পাঁচ বছরের ছেলেও আছে। তার ডাকনাম চকাই। আর ওদের সঙ্গে থাকে ওদের কাকা। তিনি বিয়ে থা করেননি। আশপাশের লোকেরা বলে, ওই কাকার সঙ্গেই নাকি অভিজিতের বউয়ের একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে। ও কয়েক সপ্তাহ টেলিগ্রাফে ফ্রিল্যান্স করেছিল। এখন কী করে কেউ বলতে পারে না। সে যাই হোক, তা হলে এই লোকটি কে? লোকটাকে সোজা মঞ্চে নিয়ে গেল উদ্যোক্তাদের একজন। খানিক পরেই ঋজু বুঝতে পারল, লোকটার নাম আব্দুস সাত্তার।
ইনিই তিনি, যিনি কণিকার বই করে দেওয়ার জন্য শঙ্করদাকে অনুরোধ করেছিলেন!
কিন্তু কেন? অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তাঁকে ঘিরে ছোট বাবি, বড় বাবি, মহাদেববাবু আর কণিকাকে ও ভাবে আদেখলাপনা করতে দেখে, ওর কাছে পুরো ব্যাপারটাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।

হাঁটতে হাঁটতে বইমেলা প্রাঙ্গণেই দেখা হয়ে গিয়েছিল তথ্যকেন্দ্রের অরূপ সরকারের সঙ্গে। কথায় কথায় অরূপ বললেন, তোমার কণিকার খবর কী?
দু’-চার সেকেন্ড সময় নিয়ে ঋজু বলল, ভালই।
— হ্যাঁ, সে তো দেখলামই। আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে ঘুরছে। তোমার কি দু’বছর হয়ে গেছে?
— কীসের?
— ওর সঙ্গে প্রেমের?
— দু’বছর। হ্যাঁ, তা তো হবেই। তার পর কী একটু ভেবে নিয়ে বলল, দু’বছরেরও বেশি।
— তা হলে আর আফসোস করে লাভ নেই।
— মানে!
— না, ও তো দু’বছরের বেশি কারও সঙ্গে মেশে না।
— কী বলছ?
— ওকে আমি ভাল করে চিনি।
— কই, তুমি তো আগে কখনও বলোনি।
— বললে, শুনতে? উল্টে ভাবতে আমি বুঝি ভাংচি দিচ্ছি। ও কত লোকের সঙ্গে মিশেছে তুমি জানো? ওর হয়তো নিজেরও মনে নেই। তালিকা করতে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে।
— তুমি তাদের কাউকে চেনো?
— দু’-তিন জনকে তো চিনিই। ওর আবার একটা হিসেব আছে। দেখবে, ও কখনও অবিবাহিত ছেলের সঙ্গে মেশে না। ও যাদের সঙ্গে মেশে তারা সবাই বিবাহিত।
— কেন?
— কারণ, হঠাৎ করে ও যদি কোনও মালদার পার্টি পেয়ে যায়, তখন যেটা আছে, সেটাকে তো কাটাতে হবে। সে যদি অবিবাহিত হয়, সে তো ঝামেলা করতে পারে। দুম করে কোনও একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু বিবাহিত হলে? এক মিনিটও লাগবে না। তার বউকে একটা ফোন করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।
— তাই! না!
ঋজুর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ওর যত দূর মনে পড়ল, দেখল, অরূপদা খুব একটা ভুল কিছু বলেননি। সত্যিই তো, কণিকা আজ পর্যন্ত যাঁদের সঙ্গে মিশেছে, তাঁরা সবাই বিবাহিত।

সে দিনই রাত্রিবেলায় কণিকা ফোন করেছিল ঋজুর মোবাইলে, তোমার সঙ্গে একটু দরকার ছিল, সময় হবে?
— কী দরকার? বলো।
— ফোনে বলা যাবে না। এলে বলব।
— কখন যাব?
— কাল তিনটে নাগাদ এসো। আমার অফিসে।
— ঠিক আছে।

পর দিন তিনটে নাগাদ ওদের অফিসের উল্টো দিকের ফুটপাথে, চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে কণিকা যা বলল, কোনও মেয়ে যে তার পূর্ব প্রেমিককে এমন কথা বলতে পারে, ওর ধারণাই ছিল না।
কণিকা বলল, তোমাকে মিথ্যে বলব না। তুমি যার কথা বলেছিলে, ওই যে, গড়িয়াহাটে, উল্টোডাঙায়, যার সঙ্গে আমাকে দেখেছিলে, তার সঙ্গে সত্যিই আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তার নাম অভিজিত্‌ শেঠ। যোধপুর পার্কে থাকে। ও যে দিন আমাকে প্রথম প্রোপোজ করল, আমি সে দিনই ওকে বলেছিলাম, আমার একজন স্ট্যান্ডিং লাভার আছে। কিন্তু তার পর থেকেই প্রত্যেক দিন ফোন করে ও এমন ভাবে কান্নাকাটি করতে লাগল, হঠাত্‌ করে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল, আমাকে একটি বার দেখার জন্য আমার অফিসের গেটের উল্টো দিকের রাস্তায়, দিনের পর দিন ঝড়-জল-বৃষ্টির মধ্যে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে লাগল যে, আমি আর ওকে না করতে পারলাম না। ছোট বাবি বড় বাবিও বলল, উনি যখন তোমাকে এত করে চাইছে, তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া তোমার ঠিক হবে না। খাবার টেবিলে বসে মহাদেববাবুও সব শুনলেন। কিছু বললেন না। ফলে...
মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিয়ে ঋজু বলেছিল, এগুলো আমাকে বলছ কেন?
কণিকা বলেছিল, ছোট বাবি বলল, তোমাকে বলতে। তাই বলছি। আসলে হয়েছে কি, ওর একটা ছেলে আছে।
— জানি।
— বছর পাঁচেক বয়স।
— তাও জানি।
— এই কিছু দিন আগে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবে বলে আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল। বলেছিল, দু’-তিন দিন পরেই দিয়ে দেবে। অথচ দু’মাসের ওপর হয়ে গেল...
— কত টাকা?
— দশ হাজার।
— ওর ফোন নম্বর নেই? ওকে ফোন করো।
— ফোন করলে ধরছে না। আমার নম্বর তো ওর মুখস্ত।
— অন্য কোনও নম্বর থেকে করো।
— তাও করেছিলাম।
— কী হল?
— ধরেছিল। যেই আমার গলা শুনেছে, অমনি বলল, আমি একটা কনফারেন্সে আছি। পরে করছি। কিন্তু আর করেনি।
— আবার করো।
— হ্যাঁ রে বাবা, করেছি। অন্য আর একটা নম্বর থেকে। আমার গলা যেই শুনছে, বলল, রাইটার্সে আছি। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। পরে করছি।
— করেনি তো? আবার করতে।
— আমি কি করিনি? আবার দু’দিন পরে যখন করলাম, বলল, ব্যস্ত আছি।
ঋজু বলল, তা আমি কী করব?
— তুমি এক বার দেখো না... তোমার প্রেমিকাকে কেউ ঠকাবে, তুমি কি সেটা চাও?
ঋজু বলেছিল, দেখছি। আর মনে মনে বলেছিল, আমার কণিকাকে ভাগিয়ে নেওয়া, না? এ বার দেখাচ্ছি মজা।
ওর স্পষ্ট মনে আছে, অফিস থেকে নিয়ে কণিকাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিলেও, এই লোকটার ফোন না-আসা পর্যন্ত ও ফোনের কাছেই গ্যাট হয়ে বসে থাকত। হাত-মুখ পর্যন্ত ধুত না। শাড়ি পাল্টাত না। ফোন বাজলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত।
ও কেন এ রকম করছে! থাকতে না পেরে ওর এক বন্ধুর কাছে ও একদিন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। সেই বন্ধুই ওকে বলেছিল, তুই কোনও জ্যোতিষীর কাছে যা। হাতটা দেখা। দরকার হলে পাথর-টাথর পর। আমার মনে হয় তাতেই কাজ হয়ে যাবে। কিংবা কোনও তান্ত্রিকের কাছে যা। অনেক সময় তুকতাক ফুঁকফাকেও খুব ভাল কাজ হয়।
— তান্ত্রিকের কাছে! আমি তো তেমন কোনও তান্ত্রিককে চিনি না। কী করি বল তো?
ও-ই বন্ধুই তখন তার চেনা এক তান্ত্রিকের নাম ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, একটা ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে কালই গিয়ে এঁর সঙ্গে দেখা কর।
ও সেখানে গিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছিল। এবং তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল, এ রকম কেন হচ্ছে?
সেই তান্ত্রিক সঙ্গে সঙ্গে ওকে বলেছিলেন, হবে না? ছেলেটা তো ওকে বশীকরণ করেছে রে... রাজবশীকরণ। ওটা কাটাতে গেলে তোকে যজ্ঞ করতে হবে। অনেক টাকার ব্যাপার। অত খরচা করতে পারবি?
ও বলেছিল, পারব। কিন্তু ও আবার আমার কাছে ফিরে আসবে তো?
তান্ত্রিক বলেছিলেন, আসবে রে, আসবে।

সে দিনও রিং হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোন ধরতে গিয়েছিল কণিকা। কিন্তু তার আগেই প্রায় ছোঁ মেরে ফোনটা তুলে নিয়েছিল ঋজু। ‘হ্যালো’ বলতেই ও প্রান্ত থেকে একটা পুরুষ-কণ্ঠ ওর মা-বাবা, চোদ্দোপুরুষ তুলে, দু’অক্ষর, চার অক্ষর, ছ’অক্ষরের কাঁচা কাঁচা গালাগালি দিয়ে বলেছিল, ওখানে কী করছিস রে? বন্ধুর বউয়ের পেছনে ছুঁক ছুঁক করতে খুব ভাল লাগে, না? ও তোকে কাছেই ঘেঁষতে দেবে না, বুঝেছিস? অনেক দিন ধরেই তো চেষ্টা করছিস। কিছু পেয়েছিস? ও আমার।
গজগজ করতে লাগল ঋজু। আমার, না? এ বার দেখাচ্ছি মজা। তুকতাক? সব ঘুচে যাবে। জানবি, বাবারও বাবা আছে। এমনি এমনি ওই তান্ত্রিকের এত নাম হয়নি। বুঝেছিস?
অভিজিতের যে মোবাইল নম্বরটা কণিকা ওকে দিয়েছিল, সেটা সুইচ অফ। প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিন। তৃতীয় দিন। ওকে ধরা গেল না। দিনে দু’-তিন বার ঋজুকে ফোন করে কণিকা জানতে চাইল, কী হল, ওকে পেলে?
তাই বাধ্য হয়ে ও খোঁজ করতে লাগল, ওকে কে চেনে! ওর বাড়ি যোধপুর পার্কেই হোক কিংবা রহিম ওস্তাগার লেনে, শুধু নাম দিয়ে তো আর বাড়ি খুঁজে বার করা যাবে না। ও যখন এই লাইনে আছে, ওকে খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধে হবে না। ও ভাবতে লাগল, কে ওর বাড়ির ল্যান্ড ফোনের নম্বর দিতে পারে! একে ফোন করতে লাগল। তাকে ফোন করতে লাগল। ওকে ফোন করতে লাগল।
একজন বলল, অভিজিৎ শেঠ তো? খোঁচা খোঁচা চুল? তোমাদের টেলিগ্রাফে কাজ করত? ও তো রেনবো-তেও ছিল। তুমি তো অনেককেই চেনো। খাসখবরের কাউকে ফোন করে দেখো না...
ঋজু ফোন করল অমিতবিক্রম রানাকে। সেও খাসখবরে কাজ করত। ফোন করামাত্রই ঋজু বুঝতে পারল, ও ঠিক লোককেই ফোন করেছে। অমিত শুধু ওর ল্যান্ড নম্বরই দিল না, ওর বাড়িটা কোথায়, সেটাও একেবারে ছবির মতো বুঝিয়ে দিল। বলল ওর সম্পর্কে আরও অনেক কথাও।

অভিজিত্‌ বাড়িতে ছিল না। ওর বউ ফোন ধরেছিল। ঋজু তাকে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছিল, ও এলে যেন আমাকে এই নম্বরে একটা ফোন করে।
কিন্তু ও আর ফোন করেনি।
পর দিন সকালে ফের ফোন করল ঋজু। অভিজিৎই ধরল।
ঋজু বলল, আপনি কণিকার টাকাটা দিচ্ছেন না কেন?
— আপনি কে?
— আমি ওর বন্ধু, ঋজু বলছি।
— ঋজু! ও, আচ্ছা। ঢোক গিলল সে। তার পরে আমতা আমতা করে বলল, ও তো টাকাটা ফেরত চায়নি।
— ও আপনাকে বহু বার ফোন করেছে। আপনি নাকি ওর ফোন ধরছেনই না? ধরলেও ওর গলা শুনে নানা অজুহাত দেখিয়ে লাইন কেটে দিচ্ছেন?
— হ্যাঁ, দিচ্ছি। কারণ, যে মেয়ে জামাকাপড়ের মতো পুরুষ পাল্টায়, তার সঙ্গে যে-ই মিশুক, আমি মিশতে পারব না। আমার সঙ্গে ওর কী না হয়েছে। দিনের পর দিন অফিস কামাই করে ও আমার সঙ্গে আমার এক বন্ধুর ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে সারা দুপুর কাটিয়েছে। একজন স্ত্রীর সঙ্গে একজন স্বামীর যা যা হয়, ওর সঙ্গে আমার সবই হয়েছে। আর যেই একজন মন্ত্রী পেয়ে গেছে, অমনি মুখ মুছে ফেলল...
— আপনি ওর টাকাটা কবে দিচ্ছেন?
— দেখুন, ও নিজে থেকেই টাকাটা আমাকে দিয়েছিল। কথায় কথায় ওকে একদিন বলে ফেলেছিলাম, এ মাসে খুব টানাটানি চলছে। ছেলেকে ভর্তি করাতেই প্রচুর টাকা লাগবে। এখনও সব টাকা জোগাড় হয়নি। একটা বড় অ্যামাউন্টের চেক পাব কাল। কিন্তু সে তো ক্যাশ হতে হতে আরও তিন-চার দিন... তখন ও জানতে চেয়েছিল, কত টাকা লাগবে? আমি বলেছিলাম, হাজার দশেক। পর দিনই ও আমার হাতে জোর করে একটা একশো টাকার বান্ডিল গুঁজে দিয়েছিল। আমি নিচ্ছিলাম না দেখে ও বলেছিল, আচ্ছা, তোমার জায়গায় যদি আমি হতাম, তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াতে না? তা হলে? তোমার ছেলে মানে তো আমারও ছেলে, না কি? আমি ওর জন্য এটা দিলাম। আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে, নিচ্ছি। কিন্তু চেকটা ক্যাশ হলেই তোমাকে নিতে হবে। ও বলেছিল, তোমাকে ফেরত দিতে হবে না।
— এই কথা বলেছিল?
— ওকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না... যে দিন এই কথা হয়, সে দিন আমাদের সঙ্গে ছকাই মকাইও ছিল।
— ছকাই মকাই!
— ওর মেয়ে।
— ওর মেয়েদের নাম ছকাই মকাই!
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনি ঋজু। অদ্ভুত তো! অরূপদা অবশ্য এক বার বলেছিলেন, ও যখন যার সঙ্গে প্রেম করে, তার ছেলে বা মেয়ে, যে-ই থাকুক না কেন, একাধিক ছেলেমেয়ে থাকলেও, তার সব চেয়ে যে কাছের, তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে কণিকা তার মেয়েদের একটা মনগড়া নাম তৈরি করে নেয়। অভিজিতের ছেলের নাম চকাই। তাই কি ও তার সঙ্গে মিলিয়ে ওর মেয়েদের নাম করে নিয়েছিল ছকাই মকাই! এর আগে ও যাঁর সঙ্গে মিশত, চলমান শিল্প আন্দোলনের অনুষ্ঠানে অভিজিত্‌ ঘোষ যাঁর কথা বলেছিলেন, সেই অপূর্বকুমার সরকারের মেয়ের নাম ছিল বুনু। তাই কি কণিকা তার সঙ্গে মিলিয়ে ওর মেয়েদের নাম তখন করে নিয়েছিল রুনু ঝুনু। ওর ছেলের নাম ‘বাবি’ শোনার পর, তার সঙ্গে মিলিয়ে তেমন জুতসই কোনও নাম খুঁজে না পেয়ে, কণিকা সম্ভবত তার মেয়েদের নাম রেখেছিল ছোট বাবি, বড় বাবি। ওর অফিসের ইউনিয়ানের সেক্রেটারি, কাঁচরাপাড়ার অরুণকুমার পাল বলেছিলেন, কণিকার মেয়েদের নাম টিনা-মিনা। তা হলে কি তাঁর মেয়ের নাম ছিল বীনা! চিনা! তৃণা! হতে পারে! কিন্তু এটা ও কেন করে! কেন! কেন! কেন!
আর ভাবতে পারছে না ঋজু। ও প্রান্ত থেকে অভিজিত্‌ শেঠ এতক্ষণ যে কী বলে যাচ্ছে, ওর কানে কিছুই ঢোকেনি। যখন সম্বিত ফিরল, ঋজু বলল, টাকাটা কবে দিচ্ছেন?
ও বলেছিল, দু’-চার দিনের মধ্যে। যত তাড়াতাড়ি পারি দিয়ে দেবো।

কণিকার তখন বাড়িতে থাকার কথা নয়, সে সময় অভিজিৎ একদিন কণিকার বাড়ি গিয়ে খামে ভরে দশ হাজার টাকা দিয়ে এসেছিল। ছোট বাবির হাতে। ছোট বাবি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে সে কথা জানিয়েও দিয়েছিল ওর মাকে। ওর মা-ও সেই মুহূর্তে ফোন করে ঋজুকে জানিয়ে দিয়েছিল সে কথা। বলেছিল, সত্যি, তুমি না থাকলে কিন্তু এই টাকাটা পেতাম না, পুরো মার যেত।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের ওদের মধ্যে পুরনো সম্পর্কটা দানা বেঁধে ওঠে। তবে না, আগের মতো অতটা মাখোমাখো নয়, তবুও অনেকটাই। কণিকা বলেছিল, আব্দুস সাত্তারকে দিয়ে অনেক কাজ হবে, জানো তো। আমি আর একটা নতুন স্কিম জমা দিয়েছি। ও তো বলল, পাশ করে দেবে। যদি দেয়, প্রচুর টাকার কাজ। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো না...
— উনি জানেন আমার কথা?
— না।
— তবে?
— তবে কী? যদি জিজ্ঞেস করে, বলব, আমার স্বামীর বন্ধু। আনন্দবাজারে কাজ করে। প্রচুর যোগাযোগ আছে। ও থাকলে আমাদের কাজ করতে অনেক সুবিধে হবে। এ সব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এটা আমার উপরে ছেড়ে দাও। তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?
ঋজু বলেছিল, আছে। একসঙ্গে দু’জন থাকা যাবে না।
— একসঙ্গে মানে? আমি কি রোজ রোজ ওর কাছে যাই নাকি? সপ্তাহে একদিন কি দু’দিন। আমি তো তোমারই। 
— তা হয় না।
— তা হলে আমাকে বিয়ে করে নাও।
— বিয়ে! দুম করে যে এ রকম কোনও প্রোপোজাল ও দিতে পারে, ঋজু তা কল্পনাও করতে পারেনি। বলেছিল, বিয়ে!
ঋজুকে আশ্চর্য হতে দেখে কণিকা বলেছিল, এমন করে বলছ, যেন ‘বিয়ে’ শব্দটা জীবনে এই প্রথম শুনলে!
— না, তা না। আমার তো বউ আছে!
— তাতে কী হয়েছে? ডিভোর্স করা যায় না?
— ডিভোর্স!
— হ্যাঁ, আমার কাছে ভাল উকিল আছে।
— সেটা না। মহাদেববাবু?
— ডিভোর্স করে দেবো।
— উনি ডিভোর্স দেবেন?
— আঃহা, সেটা তুমি আমার উপরে ছেড়ে দাও না... আগে বলো, তুমি কি তোমার বউকে ডিভোর্স করতে পারবে?
— না, মানে, বলছিলাম কি, আসলে, কী করে এই কথা বলব... ঋজু আমতা আমতা করছে দেখে কণিকা বলল, ও, বুঝেছি। তুমি বলতে পারবে না, তাই তো? ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে মহাদেববাবুকে পাঠাচ্ছি। উনি তোমার মায়ের সঙ্গে, তোমার বউয়ের সঙ্গে, এ ছাড়াও এই ব্যাপারে আর যার যার সঙ্গে কথা বলার দরকার, উনি তাদের সবার সঙ্গেই কথা বলে আসবেন, তুমি রাজি?
— মহাদেববাবু! পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে ঋজুর। মহাদেববাবু! তা হলে কি কণিকা একা নয়! তার সঙ্গে মহাদেববাবুও আছেন! সঙ্গে দুই মেয়েও! তবে কি এটা একটা চক্র! আমি সেই চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি! ঋজু বিড়বিড় করে বলল, মহাদেববাবু!
— হ্যাঁ, মহাদেববাবু। তোমার অসুবিধে কোথায়?
— না, আসলে আমার বউকে আমি ডিভোর্স দিতে পারব না।
— কেন?
— আমার বউ ভীষণ ভাল।
— ও, তা, তোমার বউ যখন এত ভাল, তা হলে বাইরে প্রেম করতে এসেছ কেন? বউ জানে না?
— জানে, মানে আন্দাজ করে, ফিল করে...
— ও... তার মানে তোমার বউ জানে না। তাই বলো...
এর পর যে ক’বারই কথা হয়েছে, প্রতিটা কথাই ছিল কাট কাট। রসকষহীন। কেমন যেন কেঠো কেঠো। নিয়মরক্ষার। ‘কেমন আছ?’, ‘কী করছ?’, ‘ছোট বাবি কেমন আছে?’, ‘ভাল তো?’ এই রকম টুকটাক।

আজ অফিস থেকে বেরোবার সময়ও কথা হয়েছে। কিন্তু কণিকা হঠাত্‌ এত রাতে ওর বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ফোন করতে গেল কেন! ও তো ওর মোবাইল নম্বর জানে। সেখানেও করতে পারত!
ঋজু যখন খেতে বসেছে, ভারতী খাটের উপর চিত্‌ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং— ঋজু এসেছে? ওকে দাও তো।
ভারতী বলল, ও খাচ্ছে।
কণিকা বলল, ওকে বলো, আমি ফোন করেছি।
ভারতী ফোনের মুখ হাতের তালু দিয়ে চেপে ঋজুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ফোন।
— কে?
— কণিকা।
ঋজু খেতে খেতেই বাঁ হাত দিয়ে কর্ডলেস ফোনটা ধরল, কী হয়েছে?
ও প্রান্ত থেকে কণিকার কান্না-ভেজা গলা— আমার একদম ঘুম আসছে না।
— অ্যালজোলাম নেই?
— আছে। দুটো খেয়েছি। তাও ঘুম আসছে না। তুমি আমাকে ঘুম পারিয়ে দিয়ে যাও।
— এখন!
— আমি জানি না। তোমাকে আসতেই হবে।
— একটা বেজে গেছে! কোনও গাড়িটারি তো পাব না। যাব কী করে?
— আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। তোমাকে আসতেই হবে। লক্ষ্মী সোনা আমার...
ঋজু যখন ফোনে কথা বলছে, ভারতী ওর একদম পাশে এসে দাঁড়ল। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
— কণিকা ফোন করেছিল।
— সে তো জানি। কী বলছে?
— বলছে, ঘুম আসছে না। আমাকে ঘুম পারিয়ে দিয়ে যাও।
— যাও।
ঝট করে ভারতীর দিকে তাকাল ঋজু। যাব?
— বললাম তো, যাও।
— কিন্তু যাব কী করে? এত রাতে... সল্টলেকে কোনও ট্যাক্সিও যেতে চায় না।
— দশ-বিশ টাকা বেশি দিলেই যাবে।
— আরে, ট্যাক্সি পেলে তো...
— শ্মশানের কাছে চলে যাও, ওখানে সারা রাত লাইন দিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। পেয়ে যাবে।
— হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। তা হলে গিয়ে দেখি... বলেই, যে-জামাপ্যান্ট পরে ও অফিসে গিয়েছিল, সেগুলিই পরতে যাচ্ছিল, ভারতী বলল, ওগুলো তো ময়লা। থাক। আমি বার করে দিচ্ছি। বলেই, ওয়ারড্রপ থেকে চোস্তা আর পাঞ্জাবি বার করে দিল। হাতে তুলে দিল পাউডার-কেস, চিরুনি, রুমাল।
বেরোবার আগে ঋজু যখন পার্স দেখছে, ভারতী বলল, এই নাও, এটা রাখো।
ও দেখল, তিনটে একশো টাকার নোট ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে ওর বউ। ঋজু বলল, তোমার কাছে ছিল?
— আমার কাছে কোত্থেকে থাকবে?
— তা হলে এটা?
— সংসারের টাকা।
— অসুবিধে হবে না?
— ও আমি ঠিক চালিয়ে নেব।
টাকাটা নিয়ে ঋজু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটা দিল কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে।

ফাঁকা রাস্তা। ফুল স্পিডে ট্যাক্সি ছুটছে। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণের পাশ দিয়ে যাবার সময়, ঋজুর হঠাত্‌ মনে হল, আমি কি এটা ঠিক করছি! অন্য কোনও বউ হলে তো এতক্ষণে বাড়িটাকে একটা রণক্ষেত্র বানিয়ে ছাড়ত। সেখানে ভারতী! নাঃ, এটা ঠিক হচ্ছে না। এই চক্রব্যুহ থেকে আমাকে বেরোতেই হবে। হায়াতের দিকে যখন ট্যাক্সিটা টার্ন নিচ্ছে, পেছন থেকে ড্রাইভারের পিঠে টোকা মেরে ঋজু বলল, দাঁড়ান। ব্যাক করুন। আমি চেতলায় যাব।
ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, কিছু ফেলে এসেছেন?
ঋজু বলল, হ্যাঁ, আমার সব কিছু।
ট্যাক্সি যখন বিজন সেতু টপকাচ্ছে, জানালা দিয়ে আসা হুহু করা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে এল ঋজুর। আঃ, কী শান্তি! কী শান্তি!  হঠাৎ বিড়বিড় করে ও বলে উঠল, এ আমি কোথায় যাচ্ছিলাম! কোথায়! ছিঃ। আমার বাড়ি তো সাতাশের এ, আলিপুর রোডে।
গাড়ি তখন রুদ্ধশ্বাসে রাসবিহারী ছাড়িয়ে, কেওড়াতলা ব্রিজ টপকে চেতলার দিকে ছুটছে।