পরদিন রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাত। আমার চোখের জল তখনও শুকায়নি । সারা রাত কেঁদে কেঁদে মুখাবয়ব বিকৃত করে তুলেছিলাম । শুষ্ক পুষ্পের ন্যায় মুখের রূপলাবণ্য নষ্ট হয়ে গেছিলো । মনে মনে বিদ্রোহী হলাম , কোন মতেই আমি দেহপসারিনী হয়ে সমস্ত নারী সত্ত্বাকে বিসর্জন দিতে পারব না।
Sunday, July 31, 2022
উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -13
Saturday, July 30, 2022
ছোট গল্প - অবশেষ সূর্যোদয় || লেখক - রানা জামান || Short story - Obosese Suryaudai || Written by Rana Zaman
অবশেষ সূর্যোদয়
রানা জামান
অপেক্ষার উত্তাপে আমন্ত্রিত অতিথিদের মেজাজ এখনো তপ্ত হয়নি তেমন। দুপুর দুটো বাজলেও বরপক্ষ এখনো আসেনি। পুরুষদের ক্ষিধেয় পেট চো চো করলেও উচ্ছল মেয়েদের দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। ওরা কণেকে ঘিরে ঠাট্টা-তামাশায় মজে আছে। হাসি তামাশায় ক্ষুধা এড়ানো গেলেও তৃষ্ণা এড়ানো যায় না; বরঞ্চ গলা শুকিয়ে যায়। দু'জন তরুণী নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে পানি আনতে যাচ্ছে খাবারের কোণায়।
কণেপক্ষের আমন্ত্রিত অতিথিদের কতক খাবার টেবিলে বসে গল্প করছে, কতক এদিকওদিক ঘুরাঘুরি করছে, কেউবা দূরে গিয়ে ধূমপান করছে। তাঁবুর বাহির থেকে দুজন যুবক ওদের পথরোধ করে দাঁড়ালো।
এক যুবক জিজ্ঞেস করলো, বাহ! খুব সুন্দর তো! খিদা লাগছে?
একটা মেয়ে জবাব দিলো, পানি আনতে যাচ্ছি।
অপর যুবক বললো, তোমরা কষ্ট করে এদিকে আসলা কেনো! আমদের বললেই পানি আইনা দিতাম!
অপর তরুণী বললো, আপনাদের চিনি না, জানি না! আপনাদের পানি আনতে বলবো কেনো?
তরুণী দু'জন যুবকদ্বয়কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। যুবক দুটো উড়ো চুমু ছুড়ে দিলো ওদের দিকে। তরুণী দু'জন দুই বোতল পানি সংগ্রহ করে অন্যদিক দিকে চলে গেলো কণের কাছে। মিনিট দশেক পরে আরো দুই তরুণী ঐপথে পানি আনতে গেলে সেই যুবক দুটো ওদের পথ আটকে বিভিন্ন ধরনের ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে লাগলো। এক সময় যুবক দুটো ওদের ঝাপটে ধরে চুমু খেতে চাইলো।
অদূরে দাঁড়িয়ে জনি প্রথম থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলো। জনি প্রতিবেশি হিসেবে কণেপক্ষের আমন্ত্রিত অতিথি। সে এগিয়ে গেলো ওদিকে। পরপর দুটো ঘুষি মেরে দুষ্টু যুবক দুটোকে মাটিতে ফেলে দিলো। শুরু হলো হৈচৈ। হৈচৈ শুনে অতিথিরা এদিকে দৌড়ে এলো। ঘটনা শুনে যুবকদের জিজ্ঞেস করায় ওরা জানালো যে ওরা আমন্ত্রিত অতিথি না। কোথাও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে ওরা এভাবেই ঢুকে খেয়ে থাকে। যুবক দু'জনকে বের করে দেয়া হলো বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে।
দুষ্টু যুবক দুটো পুলিশের সোর্স। আমাদের সমাজে পুলিশের সোর্স পুলিশের সমান বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। এরা এলাকার ভালো মন্দ সকল তথ্য পুলিশকে দিয়ে থাকে। পুলিশের ভালো মন্দ সকল কাজে এরা সহায়তা করে থাকে এবং কম বা বেশি ভাগও পেয়ে থাকে। এই দুই যুবকের নাম ধরা যাক রুবেল ও মিশা।
রুবেল ও মিশা ধুপধাপ হেঁটে চলে এলো থানায়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার খাসকামরায় ঢুকে অলীক কান্না শুরু করে দিলো। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হায়দার কারণ জিজ্ঞেস করলে রুবেল বললো, বড় অপমান হইছি আইজকা স্যার!
সাথে সাথে মিশা বললো, জিন্দেগিতে এতোবড় অপমান হই নাই স্যার!
ওসি হায়দার মোবাইল ফোনটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ওদের জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে? আগে ঘটনা ক! পরে কান্দিস!
রুবেল মেয়েদের উত্যক্ত করার ঘটনা বাদ দিয়ে বললে ওসি হায়দার বললেন, দাওয়াত না পায়া বিয়া খাওয়া কবে বাদ দিবি তোরা?
মিশা বললো, একটা বিয়াতে কত মানুষ খায়! আমরা দুইজন খাইলে কি কম পড়ে?
এখন কী চাস তোরা?
আমগো সাথে ফোর্স দ্যান! ঐ বান্দির পুতরে ধইরা লইয়া আসি!
ঠিকাছে। ২০/২৫ জন সিপাই নিয়া যা। সাথে এসআই প্রতুল যাবে। ওকে আমি বইলা দিচ্ছি।
পঁচিশ জনের একটি বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান থেকে জনি এবং ওর বড় ভাই রকিবকে তুলে নিয়ে এলো ওরা।
থানায় এনেই জনিকে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকলো রুবেল ও মিশা। থানার ভেতরে টানা আড়াই ঘণ্টা চললো জনির উপর অকথ্য পুলিশি নির্যাতন। এক পর্যায়ে জনির শরীর খারাপ হতে শুরু করলে সে এক গ্লাস পানি পান করতে চাইলো, পানি, পানি, পানি!
রকিবকে ধরে রেখেছিলো দুই সিপাই। ওর অনুনয়-বিনয় কান্না কারো মনে কোনো রকম রেখাপাত করলো না। জনির কাতর কণ্ঠে পানি চাওয়া শুনে রকিব কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আমার ভাইটারে আর মাইরেন না পুলিশ ভাইরা। জনি ভুল করছে। ওর পক্ষে আমি মাফ চাইতাছি। রুবেল মিশা ওরে মাফ কইরা দেও।
রকিবের কথা শুনে মিশা খলনায়কের মতো হাসতে থাকলো। আর রুবেল জনির পেটে কষে একটা লাথি মারলো। সাথে সাথে জনির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।
এক সিপাই জনির বুকে বুট জুতা রেখে জনির মুখে থুতু ছিটিয়ে বললো, পানির বদ্লে থুতু খা!
ঐ থানা হাজতে জনির মৃত্যু হলো। পুলিশ রকিবকে মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখানোর ভয় দেখিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই জনির লাশটা নিতে বাধ্য করলো। ছোট ভাই-এর লাশ দাফন করার পরে পাড়ার লোকদের পরামর্শে থানায় পুলিশ হেফাজতে জনির মৃত্যু হয়েছে, এই অভিযোগে মামলা করতে এলে পুলিশ মামলা না নিয়ে উল্টো ওকে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলো থানা থেকে। তখন রকিব আদালতে চলে গেলো মামলা দায়ের করতে। আদালতের নির্দেশে থানা মামলা নিয়ে কবর থেকে জনির লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হলো। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচার করা হতে থাকলো যে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে এলে এক পর্যায়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় জনি। তদন্ত শেষে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ হেফাজতে জনির মৃত্যু হয়নি মর্মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেবার পরে রকিবের পক্ষে নারাজি দিলে অধিকতী তদন্তের জন্য মামলা সিআইডি-তে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হলো।
শুরু হলো পুলিশের পক্ষে বিভিন্নভাবে রকিবকে হুমকি দেয়া। পুলিশের সাথে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার জন্য রকিবকে কখনো প্রলোভন কখনো বা হুমকি দিতে থাকলো পুলিশের পক্ষে ঐ দুটো সোর্স ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী বিশেষ করে সরকারপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এতেও না টললে রকিবকে গুম ও হত্যার হুমকি দেখাতে থাকলো। রকিবের মাকেও সরাসরি বাসায় গিয়ে কখনো বা মোবাইল ফোনে হুমকি দেখানো হতে থাকলো এইভাবে যে এক ছেলে মারা গেছে, তুমি কি আরেক ছেলেকে হারাতে চাও? সময়টা তখন ২০১৪ খৃষ্টাব্দ।
একদিন রকিবকে মা বললেন, কিরে রকিব, তোকে এতো বিষন্ন দেখাচ্ছে কেনো?
রকিব শুকনো কণ্ঠে বললো, পুলিশ বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নেবার জন্য।
মা বললেন, আমাকেও হুমকি দিতাছে রকিব।
কী বলছো তুমি মা!
বাসায় আসছিলো। বলছে, একটা ছেলে মরছে, মামলা না তুলে নিলে তোকেও মেরে ফেলবে, অথবা গুম করে ফেলবে।
রকিব মার কাঁধে হাত রেখে বললো, আমি মামলা তুলে নিবো না মা। তুমি মামার কাছে চলে যাও। মামল শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে আসার দরকার নাই।
শুরু হলো মামলার তারিখ পড়া। আসামি পক্ষের আবেদন করলেই বিজ্ঞ আদালত পরবর্তী তারিখ দিয়ে দেন। বাদিপক্ষ সাক্ষী হাজির করলে আসামী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী অসুস্থ, এই অজুহাতে মামলার পরবর্তী তারিখ পড়ে যায়। মাঝেমধ্যে রকিবের উকিল মামলা চালাতে অনীহা প্রকাশ করেন। রকিব বিরক্ত হন না। তিনি প্রতিটি তারিখেই আদালতে গিয়ে হাজির দিতে থাকেন, এডভোকেটের ফি দিতে থাকেন। এভাবে দুই বছর অতিক্রান্ত হবার পরে একদিন মামলা আপোষে মীমাংসা করার জন্য কুড়ি লক্ষ টাকা প্রদানের প্রস্তাব এলো পুলিশের পক্ষ থেকে।
রকিব বলেন, আমার আদরের ছোট ভাইকে খুন করা হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই। টাকা দিয়ে কী করবো!
রকিব আপোষ করেন না। ভাইয়ের হত্যাকারীদের সাথে কোনো আপোষ নয়। বিচারের দাবিতে রকিব থাকেন অটল।
মামলার তারিখ পিছায়, খরচ বাড়তে থাকে, একের পর এক তারিখ পড়ে। এরই মধ্যে আসামী পক্ষ মামলা স্থগিতের আদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। মামলার দুই আসামি প্রথম থেকেই পলাতক; যদিও ওদের থানায়, কখনো পুলিশ লাইনে দেখা যায়। আরেক আসামী জামিনে মুক্তি পেয়ে মামলার প্রাক্তন তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে থানায় বসে রকিবকে দেখিয়ে দুপুরের খাবার খায়, চা পান করে, সিগারেট ফুঁকে।
ভাই হত্যার বিচারের দাবিতে দায়ের করা মামলায় আদালত শুনানি ও অন্যান্য কাজে গত সাড়ে ছয় বছরে রকিবকে চারশ বার আদালতে আসতে হয়েছে। রকিব একটা শুনানির তারিখও অনুপস্থিত থাকেন নি।
দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর অসংখ্য হুমকি, ভীতি, আপোষের প্রস্তাব, বিরামহীন আদালত শুনানির পর জনি হত্যার বিচার হয়।
জনি হত্যায় জড়িত তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি দুজনকে সাত বছরের কারাদণ্ডের আদেশ প্রদান করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত।
রায় ঘোষণার সময় জনির মা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণা শুনে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কান্না থামিয়ে বিজ্ঞ বিচারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, সন্তান হত্যার পরে বিচার পেয়ে কী হবে জজ স্যার? পুলিশের দ্বারা এমন ঘটনা যেনো আর না ঘটে তা নিশ্চিত করেন!
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) ২০১৩ আইনে এই মামলার বিচার নিষ্পত্তি করা হয়।
(একটি সত্য ঘটনার অনুলিখন এই গল্প)
Thursday, July 28, 2022
উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -1
তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন
সুদীপ ঘোষাল
১
রতনেদের পাড়ার তান্ত্রিক পিসেমশায়কে দেখলে আমাদের খুব ভয় লাগে। সবসময় লাল চোখ, বাঁজখাই গলা আর কন্ঠস্বরের তীব্রতায় বুক ধরফর করে। সহজে কেউ তান্ত্রিককে ঘাঁটাতে চায় না। তবু রতন সাহস করে বলে, পিসেমশাই ভূত,পিশাচ এসব কি? পিসেমশায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে মজা করে কথা বলেন। তিনি বললেন, ক্যা হুয়া, তোমার এসব দরকার কিউ পরতা,হ্যায়? তুমি বাচ্চালোগকা মাফিক থাক।রতন বলে, বলুন না। শুনতে ভালোলাগে। পিসেমশায় এবার সিরিয়াস হয়ে বলেন, শরীর মন্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত করে তান্ত্রিকরা অপরের উপকার করতে যান। ক্ষমতালাভের জন্য তন্ত্রে শবসাধন, পাদুকাসাধন, কর্ণপিশাচী সাধন, মধুমতী সাধন ইত্যাদি অনেক সাধনের কথা আছে। তাছাড়াও আছে ভূতপ্রেত পিশাচসাধনও।রতন বলে,পিশাচদেরও ভাগ আছে।পিসেমশায় বলেন, চোখপিশাচী, নাকপিশাচী, কর্ণপিশাচী সাধনাটা হল ভূত, প্রেত, পিশাচের উপদেবতা। এদের শক্তি বিপুল। কার মনের কি ধান্দা, এদের কৃপায় সহজেই বলে দেওয়া যায়। কানে শুনে প্রশ্নের উত্তর দেবে নির্ভুল।আমি বললাম, নাকপিশাচী কেমন? পিসেমশায় বলেন, ওরা গন্ধশুঁকে বলে দেবে তোমার পকেটে কি আছে বা আশেপাশে আঁশটে গন্ধ পেলে ওরা চিনে নেয় গন্ধটা কিসের? অপগন্ধ হলে ওরা সাবধান করে দেয়। বাড়িতে ভূত, পেত্নী থাকলে বলে দেয়।রতন বললো, তাহলে ওরা ভালোও হয়? পিসেমশায় উত্তর দিলেন, নিশ্চয়। মানুষের মধ্যে ভালো, মন্দ আছে। তাহলে ভূতেের মধ্যে থাকবে না কেন? পিসেমশায় একটু নড়ে চড়ে বসলেন। এতক্ষণ বসে ছিলেন একভাবে। এবার কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে উঠল। বলিষ্ঠতার সুরে বললেন, তন্ত্রের প্রত্যক্ষ ক্রিয়া দেখেছি জীবন বহুবার বহু সাধুসঙ্গে। এতে আমার যে ধারণা দৃঢ় ও বদ্ধমূল হয়েছে, তাতে এটুকু বুঝেছি তন্ত্রের মন্ত্র এবং তার নির্ভুল প্রয়োগে মানুষের অনেকরকম ক্ষতি করাটা যত সহজ, উপকার করা সবক্ষেত্রে তত সহজ নয়। যেমন ধর মারণ, উচাটন, বশীকরণ, বিদ্বেষণ, বগলামুখী, বগলা প্রত্যঙ্গিরা, শ্মশানকালীর কবচ ইত্যাদির সাহায্যে শত্রুর উপর ভয়ংকরভাবে প্রভাব সৃষ্টি করা যায়।অশেষ নির্যাতনের মাধ্যমে রোগগ্রস্ত করে যেমন পাঠানো যায় মৃত্যুর হিমঅন্ধকারে, তেমনি বাবা শান্তিস্বস্ত্যয়নের দ্বারা। পিসেমশাই বলেন, একটি জটিল বিষয়। ভারতবর্ষের আর্যকেন্দ্রিক অধ্যাত্ম ঐতিহ্যে এর স্থানটি নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণা রয়েছে। বস্তুতঃ এর উৎস ছিল অনার্য উপাসনা পদ্ধতি ও ব্যাপকভাবে বিকেন্দ্রিত লোকাচারের মধ্যে। এর উদ্ভব প্রাক বৈদিক যুগেরও আগে এবং আর্যদের পরবর্তীকালের বৈদিক আচারবিচারে, বিশেষতঃ অথর্ববেদের সময়ে, আগম ও তন্ত্রের প্রভাব চোখে পড়ে। তন্ত্রের উদ্ভব ও বিবর্তনে সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতির ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আগ্রহ পোষণ করার সূত্রে বহু ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। ভারতবর্ষের আবহমান নিম্নবর্গীয় সমাজতত্ত্ব, আর্য-অনার্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও বৌদ্ধধর্মের সম্পূর্ণ দেহ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে তন্ত্রশাস্ত্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তন্ত্র সম্বন্ধে ' কিছু বলা আমার মতো আহাম্মকের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশাল এর কাহিনী, বিশাল এর বিস্তৃতি। সচরাচর গোপনশাস্ত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ আগ্রহী হলেও এ বিষয়ে কৌতূহল নিবৃত্ত করার মতো বিশেষ কিছু বই পাওয়া যায় না। কারণ অসংখ্য সাধক বহুধাবিভক্ত চর্চা ও অভ্যাসের দৌলতে সাধারণ পাঠকের উপযুক্ত সহজ আলোচনা আমাদের ভাষায় বিরল।
এখানে মনে রাখতে হবে, এই গোপনতন্ত্রসাধনা পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত এক বিশেষ দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে বিদেশী রাজশক্তি যখন মূলস্রোতের পূজা-আরাধনা প্রকাশ্যে, সমারোহ সহকারে উদযাপন করার পথে অন্তরায় দেখা দিল তখন বিপদগ্রস্ত ধার্মিকরা শরণ নিয়েছিল অনার্য কৌম সমাজের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা দেবীর আশ্রয়ে। এই সময় থেকেই তন্ত্রশাস্ত্র পূর্বতন অসংগঠিত থেকে মনীষার যোগদানের ফলে এক বিস্তৃত মাত্রা পেয়ে ছিল।বৌদ্ধতন্ত্র ও সনাতনধর্মীয় তন্ত্রের মধ্যে বস্তুত কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভেদ নেই। আসলে সেভাবে দেখলে তন্ত্র কোনও ধর্মীয় মতবাদ নয়, তন্ত্র এক সাধনপদ্ধতি মাত্র। মনুষ্যদেহকে এক যন্ত্রস্বরূপ বিচার করে সেই সূত্রে এক গুহ্যসাধনপদ্ধতিকেই তন্ত্র বলে। এই সাধনপদ্ধতিতে অনুগামীদের বিভিন্ন দেবীর নামে দীক্ষা নিতে হয়। বেছে নেবার মতো অসংখ্য দেবী থাকলেও আমাদের দেশে শাক্তরা দুর্গা মন্ত্রে শিষ্যত্ব গ্রহণি করেন। তারা, অন্নপূর্ণা, ত্রিপুরা ও ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে দীক্ষিত শাক্তদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম।তন্ত্রসাধনার মূল স্রোতটি যে আচারপদ্ধতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তা হলো পঞ্চ ম-কার ক্রিয়া। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আবহমানকাল ধরে নানা ধরনের পরস্পর বিরূপ মতামত প্রচলিত রয়েছে। প্রায় সোয়াশো বছর আগে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবার উপক্রমনিকা হিসেবে একটি কৈফিয়ৎ যেমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, .ভারত-প্রচলিত তান্ত্রিক উপাসনার প্রকৃত মর্ম ও পঞ্চ ম-কারের মূল উদ্দেশ্য আমাদের জ্ঞানে যতদূর উদ্বোধ হইয়াছে এবং ইহার আধ্যাত্মিক-তত্ত্ব যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে,ইত্যাদি। এই ব্যাখ্যাটির প্রামাণ্যতা নির্ভর করছে দুটি বিষয়ের উপর, 'আমাদের জ্ঞান' ও 'যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে'। এ বিষয়ে সাক্ষী মানা হয়েছে 'আগমসার' নামের একটি প্রাচীন গ্রন্থের। এই গ্রন্থে প্রথম-ম, অর্থাৎ 'মদ্য' সাধন বিষয়ে বলা হয়েছে।মদ, মোহ, মাৎসর্য, কাম, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রেখে তান্ত্রিকরা বায়ু রূপ লিঙ্গকে ভূমিরূপ যোনীতে প্রতিস্থাপন করেন। এ খুব কঠিন সাধনা। শুধু মহিলা নিয়ে ঘুরে মদ খেয়ে তান্ত্রিক হওয়ার চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। সাধু আর তান্ত্রিক হতে গেলে সংযম, সাধনা আর আসনের ত্রিবেণী সংগম হতে হবে। নারীদের দেবীজ্ঞানে পূজা করতে হয়। অকালপক্ক বির্যহীন পুরুষ এ দিকে না আসাই ভাল। পিসেমশাই বললেন, গোপন কথা কোথাও বলবি না। এসব সবসময় বলতে নেই।এটা ছটেলেপেলা নয়, মনে রাখবি।
Wednesday, July 27, 2022
ছোট গল্প - পুনর্জন্ম || লেখক - অরুণিমা দাস || Short story - Punorjonmo || Written by Arunima Das
পুনর্জন্ম
অরুণিমা দাস
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর পাশ ফিরতেই হাতের যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে জিনিয়া। ভয় চোখে বিছানার একপাশে শুয়ে থাকা আয়ুশের দিকে তাকায়। অঘোরে ঘুমোচ্ছে আয়ুশ। কে বলবে গত রাতে এই আয়ুশই তাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করেছে আর মারধোর করেছে। জিনিয়া কিছুতেই বুঝতে পারে না তার সাজগোজে স্বামীর কেনো এত অনীহা। বিয়ের পর দুমাস হয়ে গেলো একদিনের জন্যও আয়ুশ তাকে সাজগোজের কোনো জিনিস কিনে দেয়নি,উপরন্তু বলেছে ন্যাচারাল থাকো, এটাই আমার পছন্দ। ওই রুশ পাউডার গালে লাগিয়ে আর ঠোঁট লিপস্টিকে লাল করে আমার সামনে কোনোদিন আসবে না,আমি এগুলো মেনে নিতে পারবোনা কিছুতেই। এসব ভাবতে ভাবতে জিনিয়া উঠে গিয়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে লাগলো,পিঠ ঘোরাতেই আয়নায় দেখলো সুস্পষ্ট কালসিটে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো জিনত। আয়ুশের ঘুম ভেঙে গেলো কান্নার শব্দে, উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো জিনিয়া কে। বললো কি হয়েছে কাঁদছো কেনো। জিনিয়া অবাক হয়ে তাকালো স্বামীর দিকে। কি অদ্ভুত তো, কাল রাতে যে মানুষটা এত হিংস্র হয়ে উঠেছিল সে আজ সকালে এরকম ভালোমানুষ! কি করে সম্ভব হয় এটা। আয়ুশকে বললো রাতের কিছু কথা মনে নেই তোমার। আয়ুশ বললো কিছু হয়েছিল নাকি রাতে। আমি তো নিশ্চিন্তে ঘুমোলাম। আর তুমি কাঁদছো কে? বলে জিনিয়ার হাত টা ধরে, জিনিয়া হাতটা সরিয়ে নেয়। আয়ুশ বললো আবার নিশ্চয়ই ভারী কাজ করে হাতে ব্যথা করছে তোমার। দাও মলম লাগিয়ে দিই। জিনিয়া বললো না থাক, আমি চা করি ব্রেকফাস্ট বানাই। রান্নাঘরে গিয়ে জিনিয়া ব্রেকফাস্ট রেডী করতে থাকে। কদিন সবকিছু ঠিক চললো, একদিন অফিস থেকে ফিরে আয়ুশ দেখে জিনিয়া সুন্দর করে সেজেছে আর গাঢ় করে লিপস্টিক লাগাচ্ছে ঠোঁটে। জিনিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায় আর হিসহিস করে বলে ওঠে সাজতে বারন করেছিলাম তো তোমায়, পছন্দ করি না আমি সাজগোজ করা মেয়েমানুষ দের। বলেই সব জিনিয়ার সব সাজ সরঞ্জাম ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর মাটিতে ফেলে জিনিয়ার চুল মুঠি ধরে মারতে থাকে। কোনরকমে জিনিয়া নিজেকে বাঁচিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। আয়ুশ চুপ করে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। সেদিন রাতে আর আয়ুশের সাথে এক বিছানায় শোয় না জিনিয়া। ঘুম আসে না ওর চোখে, সমস্ত শরীর জুড়ে যন্ত্রণা ওর। মানসিক শান্তি টাই চলে গেছে ওর। মনে মনে ভাবে এরকম চলতে দেওয়া যাবে না আর,ঠিক করে কালকেই মামাতো দাদা সঞ্জীবকে ফোন করে সব বলবে। জিনাতের দাদা সঞ্জীব মাইন্ড রিডিং নিয়ে পড়াশোনা করছে। হয়তো কিছুটা হলেও হেল্প করতে পারবে। রাত কেটে সকাল হবার পর আয়ুশ আবার স্বাভাবিক মানুষ, অফিস যাওয়ার সময় জিনিয়াকে বলে যায় আজ বাইরে ডিনার করতে যাবো তোমায় নিয়ে, রেডী থেকো সিম্পল ভাবে। জিনাত কিছু বলে না,চুপ থাকে। আয়ুশ বেরিয়ে যাওয়ার পর ফোন লাগায় দাদাকে, ফোনে সব শুনে সঞ্জীব বলে তুই এতদিন বলিসনি কেনো রে পাগলী? সাজগোজ নিয়ে অনেকের সমস্যা থাকে, কিন্তু কিভাবে সেই সমস্যার উৎপত্তি তার মনে সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো কোনো সুন্দরী মেয়ে আয়ুশকে ঠকিয়েছে, তাই হয়তো সাজগোজের ব্যাপারে ওর বিতৃষ্ণা। কিন্তু তুই যা বললি শুনে বুঝলাম এখন এটা ওর মানসিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর প্রপার কাউন্সেলিং এর দরকার রে। আমার এক বন্ধু আছে, নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট ডা: শুভম ঘোষ, খুব ভালো মানুষ। তুই নিয়ে আয় আয়ুশকে,ওর মনের কথা জানার খুব দরকার রে।
জিনিয়া ভাবলো এমনিতেই অনেক টা দেরী হয়ে গেছে দাদাকে জানাতে তার ওপর আরও দেরী করলে হয়তো আয়ুশের সমস্যা আরও বাড়তে পারে। আয়ুশ অফিস থেকে ফিরলে জিনত বলে জানো আমার দাদা সঞ্জীব আজ কল করেছিল, আমাদের দুজনকে ডেকেছে একটা জায়গায় নিয়ে যাবে বলে। কোনো সন্দেহ না করে আয়ুশ রেডী হয়ে জিনিয়ার সাথে বেরিয়ে পড়ে। জিনিয়া আয়ুশ কে নিয়ে সোজা পৌঁছয় ডা: ঘোষের চেম্বারে, সঞ্জীব আগেই চলে গেছিলো। ওদের আসতে দেখে সঞ্জীব এগিয়ে গিয়ে ওদের নিয়ে আসে। আয়ুশ বলে এটা কোথায়। সঞ্জীব বলে আমার ওয়ার্ক প্লেস এটা। তোমরা এসো, আমি একটু কাজ সেরে নিয়ে তোমাদের ডিনারে নিয়ে যাবো। কথায় কথায় আয়ুশ কে ভুলিয়ে ডা: ঘোষের কেবিনে নিয়ে আসে সঞ্জীব। আগে থেকেই শুভম কে সব বলে রেখেছিলো সঞ্জীব। শুভম আয়ুশকে বলে বসুন আপনি, একটু আলাপ করা যাক আপনার সাথে। সঞ্জীব আর জিনিয়া কে পাশের একটা ঘরে বসতে বলে শুভম। আয়ুশ বসার পর শুভম এবার আসল কথায় আসে,জিজ্ঞেস করে কি করেন। বাড়ী কোথায় এবং পরিবারের কথা। আর এসব বলতে বলতে বলে ফেলে আপনার ওয়াইফ এত সাদা মাটা ভাবে কেনো থাকেন। সাজলে তো ওনাকে খুব ভালো লাগবে। শুভম লক্ষ্য করে সাজ গোজের কথা শুনে আয়ুশের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, টেবিলে সজোরে ঘুষি মেরে বলে আই হেট মেক আপ। প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন শুভম বুঝে ফেলে কিছু অতীত তো নিশ্চয় আছে আয়ুশের যার জন্য ও এতটা ঘৃনা করে সাজগোজ কে। ঘরের লাইট অফ করে দেয়, একটা হালকা মিউজিক চালিয়ে দেয়। আর ইশারায় সঞ্জীব আর জিনিয়া কে বলে কানে হেড ফোন লাগিয়ে নিতে। এরপর প্রশ্ন শুরু করে আয়ুশ কে। মনের কথা সব খুলে বলতে থাকে আয়ুশ। যখন ছোট ছিল, বয়স তখন পাঁচ ছয় হবে পড়তে যেত এক স্কুলের ম্যাডামের কাছে, একাই পড়ত। সেজে গুজে থাকতেন ম্যাডাম সব সময়। আয়ুশকে দেখেই পরম আদরে নিজের কাছে টেনে নিতেন। বাচ্চা আয়ুশ তখনো ম্যাডামের অভিসন্ধি বুঝতে পারেনি।
তারপর কিছুক্ষণ পড়াশোনা করানোর পর ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ করে লাউড স্পিকারে মিউজিক চালিয়ে দিয়ে শুরু হতো আয়ুশের ওপর অত্যাচার। আর বলা হতো মা বাবাকে জানালে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে। আয়ুশ অত্যন্ত যন্ত্রণা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। ভয়ে বাবা মাকে কিছু বলেনি। একদিন আয়ুশের প্যান্টে রক্তের দাগ দেখে ওর মা জিজ্ঞেস করে ওকে কি হয়েছে। আয়ুশ সব বলে মা কে, কিন্তু সুরাহা কিছু হয়নি কারণ ওই ম্যাডামের প্রতিপত্তি ছিল ওই এলাকায়। আয়ুশকে ওর বাবা বলেছিলেন সব চেপে যেতে। এভাবে ক্লাস ফাইভ অবদি চলার পর আয়ুশকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ঘটনার রেশ এতটাই গভীর যে আয়ুশের অবচেতন মনে আজও দগদগে ঘা হয়ে আছে। শুভম মিউজিক অফ করে ঘরের আলো গুলো জ্বেলে দেয়। জিনিয়া ঝর ঝর করে কেঁদে শুভম কে বলে কি নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন ম্যাডাম। আয়ুশের মনে এত কষ্ট কোনোদিন ও বলেনি আমায়। শুভম বলে ওর মা বাবার যে কাজ টা করা উচিত ছিল সেটা আজ আপনি করছেন জিনিয়া। এবার বুঝলেন তো আপনার স্বামী কেনো সাজগোজ করা পছন্দ করেন না। কারণ ওনার মনে তো সেই ম্যাডামের ছবি গেঁথে আছে আর সেই ছবি ওনার মনকে ক্ষত বিক্ষত করে বারংবার। আপনার স্বামী পেডোফিলিয়ার স্বীকার ছিলেন। উনি ছিলেন প্যাসিভ ভিকটিম। আর ওই ম্যাডাম এভাবে কত বাচ্চার ক্ষতি করেছেন কে জানে। জিনিয়া বললো ও ঠিক হয়ে যাবে তো। শুভম বললো আমি কিছু মেডিসিন দিচ্ছি সময় মত খাওয়াবেন আর বেশ কিছু সিটিংয়ে আমি ওনার কাউন্সেলিং করবো। সময় লাগবে, ধৈর্য্য ধরতে হবে। জিনিয়া বললো আমি সব করবো ডা: ঘোষ। ওকে আজ তাহলে আসুন, বলে প্রেসক্রিপশনটা ধরিয়ে দেন জিনিয়ার হাতে। আয়ুশ মাথা নিচু করে বসেছিল, ডা: ঘোষ বললেন যান বাড়ী যান, আপনি একদম সুস্থ আছেন। আয়ুশকে নিয়ে জিনিয়া আর সঞ্জীব বেরিয়ে পড়ে। জিনিয়া সঞ্জীব কে বলে এই ঘটনার জন্যই হয়তো আয়ুশের বিয়েতে অনীহা ছিল। এটা আমি শুনেছিলাম কিন্তু কেনো অনীহা সেটা বুঝিনি। সঞ্জীব বললো চিন্তা করিস না, সব ঠিক হবে। শুধু ওকে ওষুধ গুলো টাইম মত খাওয়াস। ডা: ঘোষের কাউন্সেলিং আর স্ত্রী জিনিয়ার আন্তরিকতায় আয়ুশ রিকভার করছিল তাড়াতাড়ি। এরপর জিনিয়া ঠিক করে আয়ুশের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ওর মা বাবার সাথে কথা বলবে। একাই গেলো ও, আয়ুশকে নিয়ে যায়নি। গ্রামে গিয়ে ওর মা বাবার সাথে কথা বলে সবটা জানতে পারে আর ওদের বলে কেনো ওরা কোনো স্টেপ নেয়নি। জিনিয়াকে ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ি জানায় সমাজের ভয়ে ওরা কিছু করেনি। জিনিয়া বলে আপনাদের জন্য আমার বিবাহিত জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল,আমিও যদি সমাজের ভয় করতাম তাহলে আর আপনাদের ছেলেকে সুস্থ করতে পারতাম না। আর ম্যাডামের খবর জানতে চাইলে আয়ুশের বাবা বলেন তিনি এখানে থাকেন না আর। শ্বাশুড়ী মায়ের থেকে আয়ুশের ঘর কোনটা জেনে নিয়ে জিনিয়া যায় সেই ঘরে। আলমারি, পুরনো খাতা বই ঘেঁটে বের করে এক ডায়েরী যেখানে আয়ুশের কষ্টের কাহিনী লেখা ছিল। ডায়েরীটা নিয়ে নেয় জিনিয়া, এটা যে ডা: ঘোষ কে দিতে হবে। গ্রামের বাড়ী থেকে রাতে ফ্ল্যাটে ফেরে জিনিয়া। আয়ুশ এসে গেছিলো অফিস থেকে। ওকে খাবার খাইয়ে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় জিনিয়া। নিজেকে আজ বেশ হাল্কা লাগে ওর। এরপর রেগুলার কাউন্সেলিং,ওষুধ আর জিনিয়ার সেবায় একদম সুস্থ হয়ে ওঠে আয়ুশ। মনের ক্ষত গুলো সেরে উঠেছে ওর। একদিন সেই পুরোনো ডায়েরী টা আয়ুশের হাতে পড়ে যায়। আয়ুশ নিজের লেখা গুলো পড়ার পর ডায়েরীর শেষ কয়েকটা পাতায় জিনিয়ার লেখা পড়ে বুঝতে পারে কত ভুল করেছে সে, ছোটবেলার ঘটনা গুলোকে নিজের মনে লুকিয়ে রেখে শুধু নিজেকেই না স্ত্রী জিনিয়াকেও কষ্ট দিয়েছে। পাশের ঘরে গিয়ে জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে ক্ষমা করে দিতে তাকে। তার এই যে নতুন জীবন যে জিনিয়ার দেওয়া, তাই এখন থেকে তার ভালো মন্দ সব কিছুর ভার জিনিয়ার হাতে থাকবে। জিনিয়া খুব খুশি হয় স্বামীর পরিবর্তন দেখে। আয়ুশকে বলে সব ভুলে যাও, আজ থেকে আমরা নতুন করে সব শুরু করি চলো। আয়ুশ বলে আগামী রবিবার একটা পার্টির আয়োজন করি বাড়িতে, তোমার দাদা, ডা: ঘোষ আর আমাদের দুজনের বাবা মায়ের উপস্থিতি ,ব্যাস এই টুকুতেই আমি খুশি। জিনিয়া বললো একদম আর সব আয়োজন আমরা দুজনে মিলে করবো। রোববার দিন সন্ধে বেলায় ছোট্ট অনুষ্ঠানে হাজির ছিল সবাই আর সবার সামনে আয়ুশ জিনিয়াকে গিফট করে মেক আপ বক্স আর বলে যার মন এত সুন্দর সে না সাজলেও সুন্দরই লাগবে, তাও এটা দিলাম মনের মত করে সেজো। জিনিয়া আয়ুশের কানে কানে বললো সাজিয়ে দিয়ো তুমি। সকলের হাসি আনন্দে ঘর ভরে উঠলো।
Tuesday, July 26, 2022
ছোট গল্প - রাজু কাকা || লেখক - সান্ত্বনা ব্যানার্জী || Short story - Raju Kaka || Written by Swantana Banerjee
Monday, July 25, 2022
ছোট গল্প - মুক্তি || লেখক - অলভ্য ঘোষ || Short story - Mukti || Written by Allavya Ghosh
মুক্তি
অলভ্য ঘোষ
আমার লিঙ্গের ডগাটা দেখে পাকিস্তানি সৈন্য পোদে লাথি মেরে ছেড়ে দিয়েছিল ।ওটা ইনফেকশনে অমন হয়ে গেছে ছোটবেলায় ; তাই রক্ষে । আমার বোন হিন্দু না মুসলমান এ বিচারে ধরা পড়েনি মেয়ে হবার খেসারত দিয়েছে ট্রেন থামানো একদল মুসল….. না ; রেপিস্টদের হাতে ।অঙ্গে আলতা সিঁদুর কিছুই ছিল না বোরখা ঢাকা তবুও ।সবকিছু হরিয়েও বাংলা দেশের মুক্তির লড়াই লড়েছি আমি বন্দুক হাতে নিয়ে।শান্তি কমিটির ইমান সাহেব ঘোষণা করলো ইন্ডিয়ার দালাল । ভিটে মাটির
যারা সওদা করলো ; তারা রয়ে গেল আমি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এলাম ভারতে।নোংরা নালা । কলকাতার সেই গু মুত ভেসে যাওয়া নালার পাশের বসতিতে আমরা রিফিউজি নেড়িকুত্তার দল ; পিঠে তখনো লেগে রয়েছে কাঁটা তারের ঘা । বাসা নেই, চাকরি নেই, আত্মীয় বলতে শ্যামবাজারের দূর সম্পর্কের ফরিদপুরের মামা । এক বিজয়া দশমীর রাতে মনে হয়েছিল প্রতিশোধ নিই । কার ওপর জানতাম না । এখনো জানিনা । সোনাগাছির মেয়েদের লাইনে গিয়ে নাম জানতে চেয়েছি ।শ্যামলী, কাজরী, বৈশাখী । সাবিনা, রোজিনা, ফতে-মা কেউ নেই ?
এখানে তো সবারি নাম বদল হয় । অনেকটা আমার মতো গান্ডুদের দেশ বদলের মতো । এক দালাল ঠিক চটকরে বুঝেছিল, আমি বাঙ্গাল বাংলাদেশি মাগী খুঁজছি ।
– আছে; নতুন এসেছে টাটকা একটু বেশি লাগবে ।
– নাম কী ?
– বিলকিস বানু । চলবে ?
– চলবে মনে দৌড়বে ।
মনের মধ্যে একটা ছুড়ি সান দিয়ে রেখেছি ওর জন্য ।
দরজা বন্ধকরে মেয়েটার একটার পর একটা কাপড় খুলে নিচ্ছিলাম যখন শিকারি হায়েনার মতো ; তখনো আমি মেয়েটার মুখটা দেখতে পাইনি ।
ও দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে শুধু থরো থরো কাঁপছিল ।
ও যতো কাঁদছিল আমার শিশ্নটা ততোই মেশিন গানের মতো মুখ উঁচিয়ে নাচছিল আনন্দে ।মুখের আগে বুকটা খুলে নখ বসাতে গিয়ে একটা জড়ুল দেখলাম ।
হটাৎ থার্মোমিটারের পারদ গেল পড়ে ।
ছোটবেলায় আমার বোনকে যখন পুকুরে সাঁতার শেখাতাম কতবার ঐ জড়ুল দেখেছি ওর ছাতিতে ।জলাতঙ্ক রুগীর মতো ঘরের এক কোনে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় মেয়েটাকে আমি বলেছিলাম;
-কে তুই ?
মুখের থেকে হাত সরিয়ে, জল ঠাসা দুটো চোখে বলেছিল :
– আমি চট্টগ্রামের ভাল ঘরের মাইয়া । পাঁকে চক্রে এইখানে এইয়ে উঠছি ।
নাম শুধলে বলল ;
– দুর্গা । এরা আমায় বিলকিস বইলে ডাকে । আমি বাইচতে চাই ।
– আমার বোনও একথা বলেছে । বাঁচা মরা কোনকিছুই তো আমাদের হাতে নেই ।
– কার হাইতে আছে ? ধম্ম ? কোন ধম্ম এমন বিধান দেয় ?
– যে ধর্মে মানুষ আর মানুষ থাকেনা ।
– ভগবান বলে কিছু নাই ?
প্রচণ্ড হাসি পেয়েছিল আমার ;
– ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা এই পাড়ারই কোন মেয়ের সায়ার তলায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে ।
আসলি ভগবান তো ইয়াইয়া খান । এত বড় খান কি পৃথিবীতে একটাই ।
বিজয়ার বিসর্জনের ঢাক বাজছিল একটার পর একটা ঠাকুর পরছিল বাবু ঘাটের
গঙ্গায় আমাদের ইছামতীর মতো নৌকাবিহার এখানে হয় না । প্রতিমা ডুবতে গিয়ে
কেউ যদি ডুবে যায় পাহারাদার নৌকো তুলে আনে । এখানে ডুবানো হয় নিষ্ঠুরভাবে
নেচে কুদে দুর্গাকে শুধু একটা কাঠামো ভাবে ভক্তি কম । কলকাতার সব খারাপ বলবো না । এর মতো উদার সস্তা বাসস্থান ভূভারতে কোথাও নেই । আমার গান্ধী কলোনির ঝুপড়িতে বিসর্জিত দুর্গার প্রতিষ্ঠা হল । কালীঘাটে পনের টাকা খরচায় বিয়ে । মুক্তি কি হয়েছে আমাদের ?
আমার মেয়ে এখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী । বাংলাদেশের শান্তি কমিটির সংস্কৃতিতে
নির্মিত রিফিউজি উন্নয়ন কমিটির দৌলতে দখলে জমিতে বানানো ছাদ ঢালা বাড়ির ছাদে একটা মোবাইল কানে বিদ্যা ছেড়ে বিদ্যাবালান হয়ে আমার মেয়ে ভাদ্র মাসের ছোঁক ছোঁকে নেড়িকুত্তাদের মত ছেলেদের পিট বুক খোলা জামা আর পাছা দেখায় জিন্সপরে মনোরঞ্জন করে । ক্লাস সেভেনেই বইয়ের ভেতর থেকে পাওয়া গিয়েছিল বি-এফ এর ডি ভি ডি । এই বয়সেই যৌন বিজ্ঞানের জ্ঞানে স্বয়ং বাৎস্যায়নকে পিছনে ফেলে দিয়েছে । সে জানে গর্ভধারণ-নিরোধের ওষুধ সাধারণত মাসিকের নির্দিষ্ট সময়ান্তে দীর্ঘ মেয়াদে মেয়েদের সেবন করতে হয়। পেট হবার তার কোন সম্ভাবনা নেই । রেপ হবার ও নয় । রেপ তো মতের বিরুদ্ধে হয় । আসলে এখানে ধরা পরলে ধনজ্ঞয় ; না পরলে গুরু এঞ্জয় ।
আমার মেয়েকে কোনদিন আমাদের ইতিহাস বলা হয়নি । যে টুকু বলেছি সব টুকু ঢেকে পরিমার্জিত করে । ভয়ে না লজ্জায় কিছুই জানানো হয়নি । কোন কোন সময় ভেবেছি আমি তোমার বাবা এটুকু বললেই যেমন সব বলা হয়ে যায় কেমন করে তার পৃথিবীতে জন্ম হল । অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করে ইন্ডিয়াতে আসা ; এ বললে কষ্টটা কী বোঝানো য়ায় না ? তারপরেই মনে হয়েছে যে কোনদিন অমৃত খায়নি তার কাছে ওটা শুধু মিষ্টি রসগোল্লার মতো । মিষ্টতা ছাড়াও অমৃতের একটা পবিত্র স্বাদ আছে যা পেলে মানুষ অমর হয় । যা আমরা কোন দিন পাবো না । তেমনি যন্ত্রণা উপোষের মতো মানুষকে সংযমী করে হিসেবী করে আবার বোধয় কিছুটা স্বার্থপর। যাই করুক ঘা খাওয়া বিবেক হয় সদা জাগ্রত । দেশ হারানোর ঘা ; জ্ঞাতি হারানোর ঘা । এই ঘা আমার মেয়ের নেই ; সে যুদ্ধ বলতে জানে বর্ডার ফিল্ম, দেশ ভাগ বলতে রিফিউজি, আর প্রেম বলতে কহনা প্যার হ্যাঁয় । হিন্দি সিনেমাতে না খেতে পাওয়া নায়িকাও ডাগর ডগর কমলা লেবুর মতো বুক আর তানপুরার মতো পাছা । বাস্তবে না খেতে পেলে সব শুকিয়ে আমসি হয়ে যাবে । এরা বাস্তবটা জানে কম । বেঁচে থাকে স্টার সোনি ম্যাক্স টিভি দেখে । যেখানে ছবিতে সিরিয়ালে শুধু দেখান হয় পরকীয়া । একাত্তরের পাকিস্তানি সৈন্যদের মতো চ্যানেল কর্তাদেরও শুধু লক্ষ মানুষের যৌন অঙ্গ ; চলছে দেদার সুড়সুড়ি । সকলেই লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে সংস্কৃতির বেতাল নাচ । অতি সংস্কৃতিবানেরা বি এফ বানাচ্ছে রিয়েলিটি তুলে ধরতে ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্র সংগীত। কোন কিছুই বলছেনা আমার মেয়েকে তার মায়ের অতীত জীবনের কথা ; তার পিসির অপর লুণ্ঠনের কথা ; তার বাবাকে রাষ্ট্রের নগ্ন করে পরীক্ষা করার কথা । আমিও কিছুই বলেনি তাকে । মুক্তিযুদ্ধ নাকি এবার পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্য পুস্তকে থাকবে । থাকলে কী আমার মেয়ে ঠিকঠাক তার ইতিহাসটা জানবে ? নাকি ক্ষতগুলো ঢেকে মজে থাকবে রাখি সাওয়ান্তের “স্বয়ংবরে ”। টিভি রোগে ভোগা ভালবাসায় গাইবে হান্ডেট পার-সেন্ট লাভ । এখানেও ধর্ম আর রাষ্ট্র শক্তির ফণা সেকুলারিজমের আড়ালে মেঘনাদের মতো সুযোগ খোঁজে । জেনারেল কাস্টে আশি শতাংশ নম্বরেও যখন সরকার মুখ ঘোরায় কার কার কম পেলেও চলে । বিভাজন চলছে চলবে অণু থেকে পরমাণু হলেও আমাদের ছাওয়ায় এটম বোমার সম্ভাবনা । আত্মা থেকে পণ্যে মনুষ্যত্বর সোপানগুলো ভেঙ্গে চুরে তচনচ করে দিলে বেঁচে থাকবে ডিজিটাল নেশাগ্রস্থ একটা জানোয়ার । যার হাত পা মাথা থাকবে শুধু থাকবে না মস্তিষ্কে মুক্তির স্বপ্ন । কয়েকটা বোতামের চাপে হোটফাদার তাকে দিয়ে দাসোচিত সব কিছু করিয়ে নেবে অনায়াসে ।
আমার কান্না পাচ্ছে; এত কথা বললেও কিছুই আমার মেয়ের কানে পৌঁছাবে না । কিছুই আমার বলা হল না । হাত পা মাথা সব কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে । পেরালাইসিস হবার আগে আর একবার শুধু আমি বলতে চাই;
” আমি মুক্তি চাই আমাকে মৃত্যু দাও। ”
Sunday, July 24, 2022
উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -12
আমি বাবার কাছে ফিরে যাবো। এই নরক যন্ত্রণার হাত হতে আমাকে মুক্ত হতে৷ ঐ লম্পটের পৈশাচিক লালসা আমাকে তিলে তিলে দগ্ধ করছে, আর এক মুহুর্তও এখানে থাকবো না। কিন্তু গৃহ হতে বেরুবার পথ না পেয়ে দমাদম ধাক্কা মারতে শুরু করলাম। কোন ফল হলো না।
ক্রমশ...
Tuesday, July 19, 2022
ছোট গল্প - মর্যাদাহানি || লেখক - অমিত কুমার জানা || Short story - Marjadahani || Written by Amit kumar jana
মর্যাদাহানি
অমিত কুমার জানা
সোমবার। প্রতিদিনের মতো আজও সৌভিক পৌনে দশটায় মেদিনীপুর স্টেশনে পুরুলিয়া-হাওড়া এক্সপ্রেসে উঠে পড়লো। তিনি পাঁশকুড়ার একটা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।বিশেষ করে সোমবার অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি ভিড় থাকে। সেপ্টেম্বর মাস,নদীকূল কাশ ফুলে ভরে উঠেছে। সৌভিক ছোট থেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পূজারী। সে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে জানালা দিয়ে নদীকূলের অপার সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করছিলেন। এতেও তাঁর মন ভরলো না। তিনি কাশফুলের সৌন্দর্যের ভিডিও রেকর্ডিং করতে লাগলেন। তিনি মোবাইলটা বুকপকেটে রেখে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে কিছুটা জলপান করলেন। ততক্ষণে ট্রেন খড়্গপুর ছাড়িয়ে বালিচকগামী হয়ে গেছে।
ঠিক এই সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। টয়লেটের দিক থেকে বোরখা পরিহিতা এক মহিলা একজনকে চড় মারতে মারতে বলছেন, " মদ খেয়ে ট্রেনে চড়া অপরাধ আপনি জানেন না? এটা মাতলামি করার জায়গা?" সৌভিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ইনি তো রসুলপুরের একটা ব্যাঙ্কের কর্মী। রসুলপুর বালিচক এবং পাঁশকুড়ার মধ্যবর্তী স্টেশন। সৌভিকদের সাথে একই কম্পার্টমেন্টে মাঝে মধ্যেই উনার দেখা হয়। সৌভিক উনাকে 'স্যার' বলে ডাকলেন কিন্তু ততক্ষণে বেশ কয়েকজন অপরিচিত যাত্রী উক্ত ব্যাঙ্ক কর্মীর উপর চড়াও হয়েছেন। উনি চড় ঘুঁসি খেয়ে বেশ কুপোকাত হয়ে গেছেন। ট্রেন বালিচক স্টেশনে এসে থামলো। দুজন রেলপুলিশ ট্রেনে উঠে উনার সামনে গিয়ে বুঝতে পারলেন উনি মদ্য পান করেছেন। উনাকে তা জিজ্ঞেস করে রেলপুলিশ কোন সদুত্তর পেলেন না। কারণ মদের নেশায় এবং পাপলিকের প্রহারে তিনি একেবারে নাজেহাল।
কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো যে বোরখা পরিহিতা ঐ মহিলাকে ওখানে খুঁজে পাওয়া গেল না। আর তিনি রেলপুলিশের কাছে কোন অভিযোগ ও করেন নি। সৌভিক ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন ওভারব্রিজের ওপর হেঁটে যাচ্ছেন জনা তিনেক বোরখা পরিহিতা মহিলা। এই সময় ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে রসুলপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। ট্রেন রসুলপুরে থামলে ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে তাঁর দু একজন সহযাত্রী স্থানীয় চিকিৎসালয়ে ভর্তি করলেন।
স্কুলে পোঁছে সৌভিক কিছুক্ষণ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এটেনডেন্স খাতাটা নিয়ে তিনি ক্সাসে যাচ্ছিলেন। দোতলায় ক্লাস নাইনের ভূগোলের ক্লাস । সৌভিক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে রিসিভ করলেন। তারপর তাঁর নজরে এলো একটা ভিডিও। ট্রেনে আসার সময় ভিডিও রেকর্ডরটা চালু ছিল। তিনি ভিডিওটি দেখে অবাক হলেন। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ঐ বোরখা পরিহিতা মহিলা ইশারা করে ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে ডাকছেন। টয়লেটের সামনে যেতেই ঐ দুজনকে আর দেখা যায় নি। তারপর ঐ মহিলা চড় মারতে মারতে উনাকে টয়লেট থেকে বের করছেন। ভিডিওটা দেখে সৌভিকের কেমন যেন সন্দেহ হলো ঐ মহিলার উপর। মহিলাটি ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে টয়লেটের দিকে ডাকছিলেন কেন? আবার তিনিই বা উনাকে মারলেন কেন? ঐ ব্যক্তি কখন মদ্যপান করলেন? এইসব কথা ভাবছিলেন সৌভিক। এমন সময় তাঁর মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল সোজা গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে। তিনি নীচে নেমে এসে দেখলেন তাঁর মোবাইল ভেঙে একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। মনে মনে এটা ভেবে দুঃখিত হলেন যে তিনি ভিডিওটি রেল পুলিশকে দেখাতে পারলেন না।
পরদিনের ঘটনা। সৌভিক প্রতিদিনের মতো একই সময়ে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে উঠে পড়লেন। ট্রেন খড়্গপুর স্টেশনগামী। এমন সময় ভিড়ের মাঝে এক যুবতী একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে কষিয়ে চড় মারলেন। যুবতী চেঁচিয়ে বলছেন, " ভিড়ের মাঝে মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া! অসভ্য কোথাকার।" সৌভিক তাকিয়ে দেখলেন ইনি তো রসুলপুরের একটা হাইস্কুলের শিক্ষক। বেশ ভদ্রলোক। উনি জোর গলায় বললেন যে উনি ঐ যুবতীকে স্পর্শ ও করেন নি। তবুও উনার কথা কেউ গ্ৰাহ্য করলেন না। সৌভিক উনাকে চেনেন।উনি মনতোষ স্যার। তিনি তৎক্ষণাৎ ঐ স্যারের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ভিড় সরিয়ে উনাকে সিটে বসালেন।
মনতোষ স্যার সৌভিককে বললেন যে উনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। হয়তো অন্য কেউ অসভ্য লোক এই কাজটা করেছেন,যার ফল ভুগতে হলো উনাকে।
ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে খড়্গপুর স্টৈশনে এসে থামলো।
এক অজ্ঞাত পরিচয় যুবক সৌভিক এবং মনতোষের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি হেসে স্টেশনে নেমে পড়লেন। সৌভিক উনার কাছে যেতে উদ্যত হচ্ছিলেন, কিন্তু উনি দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। সাথে সাথে খড়্গপুর থেকে ট্রেন ছেড়ে দিল।
স্কুলে পৌঁছে সৌভিকের মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তার এটা মনে হল যে পরপর দুই দিনের এই দুর্ঘটনা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না যে এই ঘটনাগুলো কেন ঘটছে।
পরের সপ্তাহের সোমবার এর ঘটনা। পাঁশকুড়ায় ট্রেন থেকে নেমে সৌভিক শুনতে পেলেন যে আজ অন্য একটা কম্পার্টমেন্টে একজন স্কুল শিক্ষক বোরখা পরিহিতা এক মহিলার দ্বারা প্রহৃত হয়েছেন। ওই স্কুল শিক্ষকের নাম সঞ্জয় বেরা।সঞ্জয় বেরা নামটা শুনে সৌভিক চমকে উঠলেন।
উনি বালিচক হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
পরদিনের ঘটনাটা সৌভিককে আরো বিব্রত করে তুললো। গতকাল ট্রেনে সঞ্জয় বেরা নামক স্কুলশিক্ষককে একজন বোরখা পরিহিতা মহিলা মারধর করেছিলেন। সেই মারধরের ভিডিও আজ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটিতে কয়েক শত লাইক কমেন্ট পড়েছে। সৌভিক দেখলেন ভিডিওটি লাইক করেছে তারই এক পুলিশ বন্ধু কোতোয়ালি থানার এস.আই সমরেশ তিওয়ারি। সৌভিক তৎক্ষণাৎ সমরেশ তিওয়ারিকে ফোন করলেন। তারপর তিনি পার্সোনালি সমরেশ তার সঙ্গে দেখা করলেন। দেখা করে তিনি উনাকে বললেন যে ট্রেনে পরপর দুটো সোমবারে যে দুটো দুর্ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে তিনি কিছু বলতে চান। তিনি বললেন যে তিনি ওই ব্যাংক কর্মী এবং সঞ্জয় বেরাকে ভালোভাবে চেনেন। ওই দুইজন অতি পরিচিত এবং ভীষণ ভদ্রলোক। আজ পর্যন্ত উনারা কোন মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন নি। শুধু তাই নয় উনার আজ পর্যন্ত মদ্যপান ও করেন নি। সম্ভবত এটা ঐ বোরখাধারী মহিলার কাজ, হয়তো উনি বিগত কোন ঘটনার বদলা নিয়েছেন এইভাবে।
এরপর সমরেশ তিওয়ারি সৌভিকের কথার গুরুত্ব অনুভব করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিলেন। যে এই ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তাকে উনি মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি তাকে বললেন, " আমি ইউটিউবের একটা চ্যানেল থেকে বলছি, ঐ ভিডিওটি থেকে আপনি অনেক টাকা রোজগার করতে পারবেন। আপনার মোবাইল নাম্বার দিন।"
সমরেশ মোবাইল নাম্বার পেয়ে গেলেন। তারপর ঐ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন যে উনার নাম সুতনু। সুতনু এই ভিডিওটি নিয়েছে তার মাসির ছেলের কাছ থেকে। তার মাসির ছেলের আপত্তি সত্ত্বেও গোপনে সুতনু এই ভিডিওটি নিয়ে নেয় এবং ফেসবুকে আপলোড করে ফেলে।
এরপর সমরেশ আইনি ভয় দেখিয়ে সুতনুকে তার সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য করেন। সুতনু যখন জানতে পারে যে সমরেশ একজন পুলিশ অফিসার তখন সে সব কথা গড় গড় করে বলে ফেলে। সমরেশ সুতনু দেওয়া জবানবন্দি মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং করে ফেলেন।
সুতোর দেওয়া জবানবন্দিটা ছিল এইরকম:
আজ থেকে ছয়-সাত মাস আগে মার্চ মাসের ঘটনা। সুতনুর মাসি মেসোমশাই এবং তার মাসতুতো ভাই পুরুলিয়া -হাওড়া এক্সপ্রেসে হাওড়া যাচ্ছিলেন। সুতনু মাসির নাম কল্পনা নায়েক। তার মেসোমশাই ভরপুর মদ্যপান করে ট্রেনে চড়ে ছিলেন। তিনি এতটাই মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিলেন।
সিটে বসে থাকা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তিনি দুর্ব্যবহার শুরু করেছিলেন। একজন তরুণী তার ব্যবহারে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন। ওই কম্পার্টমেন্টে বসে থাকা অনেকেই নির্বাক দর্শক হয়ে সেই ঘটনা দেখছিলেন। সেই সময় অতিষ্ঠ হয়ে ওই ব্যাংক কর্মী এবং সঞ্জয় বেরা নামক স্কুল টিচার এর তীব্র প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। ক্রমশ উনাদের সাথে সুতনুর মেসোমশাইয়ের প্রবল বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। তখন কেউ কেউ বলেন যে ঐ মাতালটাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিন। অসভ্য,অভদ্র কোথাকার! তা সত্ত্বেও ওর মেসোমশাই অভদ্রতা করেই যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় ঐ ব্যাঙ্ককর্মী এবং সঞ্জয় স্যার ওর মেসোমশাইয়ের কলার ধরে চড় লাগিয়ে দেন। এতে সুতনুর মাসিমাও সঞ্জয় স্যার এবং ব্যাঙ্ককর্মীকে চড় লাগিয়ে দেন। আসলে সুতনুর মেসোমশাই যতই খারাপ মানুষ হোক না কেন মাসিমা উনাকে খুব সম্মান করতেন, ভালবাসতেন।
তারপর বালিচক স্টেশনে রেলপুলিশ সুতনুর মেসোমশাইকে কড়া ভাষায় গালিগালাজ করেন,কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে ছেড়ে দেন। তখনই সুতনুর মাসিমা প্রতিজ্ঞা করছিলেন যে যাদের জন্য তার পতির এতটা মর্যাদাহানি তাদের তিনি ছাড়বেন না। এর প্রতিশোধ তিনি নেবেন।
এরপর সুতনুর মাসিমা বোরখা পরে নিজেকে আড়াল রেখে ব্যাগে জলের বোতলে মদ রেখে পুরুলিয়া-হাওয়া এক্সপ্রেসে উঠতেন। তারপর যেদিন সুযোগ এল সেদিন ঐ ব্যাঙ্ককর্মীকে টয়লেটে ডেকে বোতলের মদ উনার মুখে ঢেলে দিলেন। পরের সোমবার তিনি বোতলের মদ সঞ্জয় স্যারের গায়ে ঢেলে দিলেন। এইদিন তাঁর ছেলেও সেখানে উপস্থিত ছিল। যখন ভিড়ের মাঝে অনেকে সঞ্জয় স্যারের উপর চড়াও হলেন তখন উনার ছেলে সেই দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে ফেলে। সব ঠিক ছিল কিন্তু সুতনু মাসির বাড়ি গিয়েই ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে। ভিডিওটি ফেসবুকে আপলোড করে ফেলে।
সব শুনে সমরেশ মহিলা পুলিশ নিয়ে চলে এলেন কল্পনা নায়েকের বাড়ি। কল্পনা নায়েককে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে গেলেন।
Monday, July 18, 2022
উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -11
হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি করে একটা মোড়ে এসে নামলাম। মোড়ের চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। স্থানে স্থানে লোক জামায়েত রয়েছে। কতকগুলো মেয়ে পুরুষদের সাথে নানা ঢঙে কথা বলছে। হঠাৎ কানে একটা অশালীন কথা ভেসে এলো। কে যেন বলে উঠলো, কি লো রজনী বেশ তো সেজেগোছে রাতের নাগরদের জন্য দাঁড়িয়ে। আছিস, বলি নাগরকে কাছে পেয়েছিলি?