উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -15


 


ব্যাস আর যায় কোথা , আমার মুখ দিয়ে বাবা উচ্চারণ হতেই মনটাকে আর স্থির রাখতে পারলাম না । বাবার স্মৃতি আমাকে উতলা করে তুলল । এতদিন ভুলেছিলাম । বাবাকে , ভুলেছিলাম অতীতকে । কোন দিন আমর মনকে জিজ্ঞাসা করিনি , আমার অসহায় , দৈন্য পীড়িত বাবা কেমন আছেন । আমি বড় স্বার্থপর হয়ে গেছি । এ পথের যাত্রী হয়ে বাবার কথা প্রায় ভুলতে চলেছিলাম । আজ বাবার কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই মনটা বড় কেঁদে উঠল ।


 তাই আদরী মাসীকে তাচ্ছিল্য করে শ্যামলীদি আমার মুখপানে তাকিয়ে বলল , আয় বোস এই কাজটা শেষ করে তোর সাথে কথা বলছি ।

 দেখলাম শ্যামলীদি ওর ডায়েরীতে লিখছে , অদ্যাবধি দুটো বছর কেটে গেলো , তবুও আমার হিতৈষী বন্ধুকে পেলাম না । তবে তুমি ভেবো না বন্ধু , যেখানে যেভাবে নিজেকে আত্মগোপন করে থাক না কেন , একদিন তোমার দেখা পাবই । তোমার অন্বেষণে সর্বদাই সজাগ আছি । তোমার প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত আমার তৃষ্ণা কোনদিনই মিটবে না । আমার ক্লেদাক্ত জীবনে আমি শান্তি পাবো না । 

লেখা শেষ হতেই বলল , এই ডায়েরী লেখা দ্যাখ , আমার জীবনের জ্যোতির্ময় দেবতার অদৃশ্য সংকেত দেখতে পাবি । যার সঙ্গে আমার জীবন ছিলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত । যাকে নিয়ে আমি জীবনে একটা সুখের নীড় বাঁধতে চেয়েছিলাম । 

শ্যামলীদি আমার হাতে একটা ছবি দিলো । ওতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমার চোখ দুটো পদ্মফুলে আবদ্ধ ভ্রমরের মতো হয়ে গেল । ততক্ষণাৎ বলে উঠলাম , একি ! এযে আমার পূজনীয় রন্টুদা ? 

কি বললি ? শ্যামলীদি বিদ্যুৎ বেগে উত্তর দিলো ও কৌতুহলী হয়ে বলল , এই জানোয়ারটাই তোকে এই পথে নামিয়েছে ? 

আমি সম্মতি জানালাম । দন্তে দন্ত চেপে শ্যামলীদি হিংস্র পশুর মতো গর্জন করতে লাগলো । 

ওর অবস্থা দেখে মনে হল , রন্টুকে সম্মুখে পেলে সে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে ।

 খোলা জানালা পানে তাকিয়ে শ্যামলীদি দৃঢ় কণ্ঠে বলল , প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে পদ্মা । এই সব উন্মার্গগামী অধঃপতিত লোকটাকে চরম শিক্ষা দিতে হবে । নতুবা আরো বহু নারীর ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের কালো মেঘ নেমে আসবে ।

 শ্যামলীদির মুখপানে তাকিয়ে বললাম , কিন্তু ওর নাম তো পল্টু নয় দিদি ?

 সব অভিনয় ওরা নানান নামে মিশতে পারে । নানান ছদ্মবেশ ধরতে পারে । তবে বড় আফশোষ , এতো কাছে পেয়ে ওকে ধরতে পারলাম না । আফশোষে মাথার চুলগুলো ছিঁড়তে থাকল । শ্যামলীদি সখেদে বলল , ওকে কাছে পেতে আর বেশী বিলম্ব হবে নারে । সে আমার হাতের নাগালের মধ্যে আছে । তারপর - তারপর হবে আমার প্রতিশোধের পালা । শ্যামলীদি এবার শান্ত হল । ধীর ধীরে আমার কাছে এগিয়ে এসে ছবিটা ছিনিয়ে নিয়ে ডারৌতে আঁঠা দিয়ে চিটিয়ে রাখলো । শ্যামলীদির রুদ্রমূর্তি দেখে কোন কথা বলার সাহস পেলাম না । 

মনের কথা চাপা রেখে বাইরে বেরুতেই আমাকে বলল , চলে যাচ্ছিস কেন , কি প্রয়োজনে এসেছিলি বল ।

 ধীরে ধীরে শান্ত কণ্ঠে বাবার কথা বললাম । বাবার কাছে যেতে মন চাইছে দিদি।তার কতদিন বাবাকে দেখিনি । তাই চঞ্চল মনকে কোন প্রকারে শান্ত রাখতে পারছি না । আমার কথা শুনে শ্যামলীদি স্থানুর মতো হয়ে গেল । অবোধ বোনকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে তার ভাষা পাচ্ছে না ।

 ওকে নীরব থাকতে দেখে পুনরায় বললাম , আমার বাবাকে শুধু একটি বারের মতোও দেখতে পাবো না শ্যামলীদি ? বেদনা বিদ্ধ হয়ে হেঁট মুখে তক্তাপোষে বসে রইলাম । ক্রমশঃ চোখ ফেটে দরদর ধারায় জল বেরুতে শুরু করল । তবুও নিজেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে বললাম , দিদি একটিবার বাবাকে দেখার সুযোগ করে দাও । 

শ্যামলীদি বলল , সে সুযোগ হবে না পদ্মা । ক্রীতদাসের প্রথা এখানে । শুধু এইটুকু পার্থক্য ওদের মতো অনাহারে , অনিদ্রায় মরতে হয় না । কোন প্রকারে এই পিঞ্জর হতে মুক্ত বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারবি না । যেখানে যাবি ছায়ার মতো অনুসরণ করবে এখানকার পোষাগুন্ডারা । বললাম , তবে কি একটি বারও বাবাকে দেখবার সুযোগ পাবে না ? 

না । 

একি হল দিদি । এই মরুময় জীবনে কি কোনদিন শান্তির বারিধারা বইবে না ? বাবাকে এতোদিন ভুলেই ছিলাম । বাবার কথা যদি না মনে পড়তো , তার করুণ মুখখানি আয়নার মতো ভেসে না উঠতো , তাহলে তোমার কাছে ছুটে আসতাম না শ্যামলীদি । আর আর দাঁড়াইনি এখানে । বুকে পুঞ্জীভূত বেদনা নিয়ে দ্রুত গতিবেগে বাসার দিকে এগিয়ে গেলাম এবং রুদ্ধদ্বার গৃহাভ্যন্তরে বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম । কতক্ষণ যে তপ্ত অশ্রু নির্ঝরের মতো চক্ষু দিয়ে বয়ে গেছিল তা আমি নিজেই বুঝতে পারিনি ।

 হঠাৎ শ্যামলীদির কণ্ঠস্বরে নিজের সম্বিৎকে ফিরে পেলাম । শ্যামলীদি বলল , তোর বাবার ব্যবস্থা করলাম পদ্মা । তবে এক শর্তে দুদিনের মধ্যে এখানে হাজির হতে হবে । ধড়মড় করে উঠে শ্যামলীদিকে জাপটে ধরে বললাম , এই পঙ্কিলময় ভোগসুখাসক্ত জীবন আকাশে তুমি আমার ধ্রুবতারা । তোমাকে লক্ষ্য করেই আমি আমার জীবনের চলার পথ বেছে দেব দিদি । তার কাঁধে বারবার মুখ ঘষতে থাকলাম ।

 একটু পর ধীরে ধীরে ওর কাঁধ হতে মুখ তুলে কথা দিলাম , যদি মরে না যাই


তাহলে এখানে এসে আমার যৌবন গাঙে আবার তরণী ভাসাবো দিদি এখানে ফিরে না এলে তোমার প্রতি কি অত্যাচার হবে তা আমার অজনা নয় । আমি অবশ্যই আসবো । এই তীর্থ স্থানই সে আমার যৌবনের উপবন আর বার্দ্ধক্যের বারানসী । চোখ দুটো ছল ছল্ করে উঠলো । 

পরদিন সকালে শ্যামলীদিকে প্রণাম করে বদ্ধ পিঞ্জর হতে মুক্ত পক্ষী বিহঙ্গমের মতো অসীম নীলাকাশে পাখা মেলে দিলাম । পুতিগন্ধময় নরকের কলুষিত পরিবেশ হতে মুক্তি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম । আজ বড় সৌভাগ্য যে আমার বাবুকে একটিবার দেখার সুযোগ পাব । আকাশের শ্যামলীমা , পাতার মর্মর ধ্বনি , বাতাসের স্নিগ্ধতা , বিহঙ্গের কলগীতি - এতদিন আমার প্রাণে স্বর্গীয় আনন্দেয় শিহরণ আনতে পারিনি । আর আজ আমি মুক্ত প্রাণের নির্ঝর যেন এক সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ হতে বেরিয়ে ছুটে চলেছি অসীম বারিধিপানে । মোড়ে এসে ট্রাম ধরে হাওড়া ষ্টেশনে এসে হাজির হলাম।

যখন চণ্ডীপুরে পৌঁছলাম , অনেকখানি বেলা গড়িয়ে গেছে । গ্রীষ্মের দাবাদাহে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে গেলাম । কিন্তু পল্লী পরিবেশে সোনালী রোদ্দুরকে স্নেহ পূর্ণ বক্ষে আলিঙ্গন করলাম । গ্রামের মোড়ে আসতেই কৌতুহলী নরনারী অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাতে লাগলো । বিশেষ করে আমার জমকালো সাজসজ্জা ও সারা শরীরের আভিজাত্যের ছাপ দেখে ওরা আমাকে ধনাঢ্য রমনী বলে ভেবেছিলেন । সীমন্তে সিঁদুর যদি থাকতো , ভাবতো আমি কোন ধনী ব্যক্তির গৃহনী । ওদের ওভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল । 

তবে ওরা আমার রহস্যাবৃত জীবনের ইতিবৃত্ত জানলে কি দৃষ্টিতে দেখতো তা ভালো ভাবেই জানি । ওসব ভাবনাকে উপেক্ষা করে দ্রুতপদে বাড়ীর দিকে এগিয়ে চললাম । সহসা তার কণ্ঠস্বরে যেন চমকে উঠলাম । পিছু ফিরতেই দেখলাম দেবাশীষদা ডাকছেন , এতোদিন কোথায় ছিলে রমা ?

 রমা নামে আমাকে ডাকতেই আমার বলতে ইচ্ছে হলো তোমার রমার অপমৃত্যু ঘটেছে , আমি সেই রমার প্রেতাত্মা । মুহুর্তে নিজেকে বদলে গিয়ে বললাম , কেমন আছো দেবাশীষ দা ?

 দেবাশীষদা বললেন , ভালো ।

 বাবা কেমন আছেন ? 

সেই জন্যইতো তোমার খোঁজে কলকাতা গিয়েছিলাম।

 উৎকণ্ঠার সহিত জিজ্ঞাসা করলাম , বাবার কিছু হয়েছে নাকি ? 

দিন দশ বারো হলো কাকাবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না ।

একথা শুনে আমি যেন ব্রজাহত হয়ে পড়লাম ।

 হ্যাঁ রমা , বিশেষ করে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন বলে আমরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছি । তুমি কলকাতা যাবার কয়েক মাস পরেই তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললেন।

 ধীরে ধীরে আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো , মনে হলো আমি আর সেস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না ।

 দেবাশীষদা বলে চলেছেন , আমরা তাকে সুস্থ করবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম , কিন্তু কোন ফল হয়নি । কেবল তোমার কথাই বারবার বলছিলেন । তোমাকে দেখার জন্য বড় ছটপট করছিলেন , তাই কাকাবাবুর বিচলিত মন দেখে তোমার খোঁজে কলকাতা গিয়েছিলাম কিন্তু পাইনি । আমরা নিরাশ হয়ে ফিরে আসার পর তার অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ল ।

 শুধু বলেছিলেন তোমরা কেউই আমার রমাকে আনতে পারবে না । আমি নিজেই ওকে খুঁজে বের করবো । আজই আমি কলকাতা যাবো । 

কোন প্রকারে সান্ত্বনা দিয়ে রেখেছিলাম । কিন্তু কখন যে বেরিয়ে গেছেন বাড়ী হতে তা বুঝতে পারিনি । মনে হয় তোমার খোঁজে কলকাতা গেছেন । রমা , বাবাকে কি একটা পত্রও দিতে নেই ? 

কোন কথা মুখ দিয়ে বের করতে পারলাম না , শুধু মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদছিলাম । একি করলে ঠাকুর , একথা শোনার আগে কেন আমার মৃত্যু দিলে না । গোপনে বারবার ডেকেও কোন ফল হল না । শুধু তীরবিদ্ধ পাখীর মতো যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকলাম।


 কি করব , কি করে বাবার দেখা পাবো । বাবার সঙ্গে দেখা করার অন্য দুস্তর বাবা ঠেলে বহু আশা নিয়ে বেে
বেড়িয়ে পড়েছিলাম । ফল যে এই হবে , আমি কল্পনা করতে পারিনি । এরপর আমার করনীয় কি – তাই ভাবছিলাম । আবার যথাস্থানে ফিরে যাবার সংকল্প নিয়ে অমাবস্যার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে পা বাড়ালাম ।


                        ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024