ছোট গল্প - সম্পর্ক || লেখক - অরুণোদয় ভট্টাচার্য || Short story - Somporko || Written by Arunodoy Bhattacharya


 

সম্পর্ক

                     অরুণোদয় ভট্টাচার্য


সুরঞ্জনের অতটা বিহ্বল হবার কথা নয় ।হোতও না যদি খানিকটা কাকতালীয় বা ইংরিজিতে যাকে স্ট্রেঞ্জ কোয়েনসিডেন্স বলে, সেরকম একটা না ঘটত ।নিজের ছাত্রজীবনে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ চৌকস যুবকদের সারিতেই সে ছিল ।মাঝে মাঝে নাটক আবৃত্তিতে অংশ নিয়ে প্রশংসা পেয়েছে ।অধ্যাপক-জীবনে নবীনবরণ ও শিক্ষক বিশেষের বিদায় সম্বর্ধনা সভায় অনেক বক্তৃতা দিয়েছে ।সহকর্মী ও কর্মিনীরা তাকে যথেষ্ট স্মার্টই ভাবে ।এমন কি ইতিহাসের কাকলী দত্ত একদিন বলেছিল, প্রফেসর মুখার্জী, আপনি কিন্তু ভারি ঠোঁঠকাটা ।

আসল ব্যাপারটা হল, প্রচুর উপন্যাস ও প্রেমের কবিতা পড়লেও মেয়ে-ঘটিত দুর্বলতা সুরঞ্জন কখনো অনুভব করে নি ।অনেক অল্প বয়সেই মেয়েদের কলেজে অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছে ।প্রথম প্রথম অনেক মেয়েই ওকে যাচাই করতে চেয়েছে ক্লাসে ও ক্লাসের বাইরে ।চিঠি দিয়ে, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে, এমন কি ‘স্যার, আই লাভ ইউ!’ বলে ।কিন্তু সুরঞ্জন মোটামুটি নির্বিকার ভাব বজায় রাখতে পেরেছে ।অথচ আজ, পনের বছর অধ্যাপনার পর, ঘরে বৌ ও তার বন্ধুনিদের দল এবং কলেজে সহকর্মিনী ও অজস্র ছাত্র্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করার পরও, সে কিনা হঠাৎ একটি ছাত্রীর একটি কথায় এমন বিস্ময়-বিহ্বল হয়ে গেল!

আর কথাটাই বা কি?অতি সাধারণ ভদ্রতা-সূচক একটা প্রশ্ন ।কিন্তু ঠিক তার আধ ঘন্টা আগে কলেজের টিচার্স রুমে যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিল সুরঞ্জন নিজেই, সেই প্রেক্ষিতে এই সামান্য কথাটা অসামান্য, প্রায় অলৌকিক হয়ে উঠল ।

থার্ড ইয়ার অনার্স ক্লাসে একটা দুরূহ টপিক ডায়াগ্রাম এঁকে মেহনত করে বুঝিয়ে আসার পর ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নিজের চেয়ারটায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল সুরঞ্জন ।বাংলার তরুণ অধ্যাপক অনিকেত লাগোয়া টয়লেট থেকে হাল্কা হয়ে বেরল; ধীরে-সুস্থে এসে বসল পাশের চেয়ারটায় ।এদিক-ওদিক আরো দু’চার জন ছিল ইংরিজি, বটানি, কমার্শিয়াল ল’য়ের ।

সুরঞ্জন বলল, ‘দেখ,অনিকেত, তুমি তো নামকরা কাগজের নামকরা কবি ।ব্যথা বোঝ? ছোটখাট আক্ষেপ?’

অনিকেত বলল, ‘দেখুন আপনি এত হেঁয়ালি করছেন, তবু আধুনিক কবিতাকে দুর্বোধ্য বলেন!’ তারপর সুরঞ্জনের দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে যোগ করল, ‘কি হয়েছে দাদা? আপনাকে আবার কে দাগা দিল?’

সুরঞ্জন বলল, আচ্ছা প্রাঞ্জল করেই বলি ।আমার একটা বিশেষ আক্ষেপ আছে ।বিষয়টা সামান্য, কিন্তু প্রায়ই খোঁচা দেয় ।এত বছর কাজ করছি এই মেয়ে-কলেজে, এতো গাড়িবতীর ভিড় এখানে ।কিন্তু কেউ একদিনও লিফ্ট অফার করল না!

বিমল ভঞ্জ তার স্বভাবসিদ্ধ চ্যাংড়ামির ভঙ্গিতে লিফ্ট কথাটার কু-অর্থ করে এক চোখ বুজিয়ে বলল, এই বয়সে কলেজের মেয়েদের কাছে লিফ্ট চাও?শুনলে ঘরওয়ালি ক্যা কহেঙ্গি? মেয়েদের আজকাল দাবায়ে রাখতে পারবা না!

তন্বী পূরবী সেন এডুকেশানের অধ্যাপিকা ।ঠোঁঠে আঙুল ঠেকিয়ে বলল-সসস্!ভবানী দি শুনতে পাবে!ভবানী দি মানে ভবানী বটব্যাল, ভাইস-প্রিন্সিপাল ।চিরকুমারী ।

বিমলের মন্তব্যটাকে অগ্রাহ্য করে সুরঞ্জন তার খেদের কথাটা সম্পূর্ণ করে –‘অথচ প্রচুর পয়সাঅলা লোকের মেয়ে এখানেপড়ে ।আমার বাড়ি থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বাড়ি যাতায়াতের পথে অন্তত ডজন খানেক ডিফারেন্ট মডেলের গাড়ি এখানকার মেয়েদের নিয়ে রোজ আনাগোনা করছে ।কলেজের সামনে এসে তারা হর্ন দিয়ে চমকে দিচ্ছে ।ধুলো উড়িয়ে পোড়া পেট্রলের ধোঁয়া নাকেমুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ।অথচ মিনিমাম ভদ্রতা করে কেউ একদিন লিফ্ট দেয় না!’

‘আমার অবস্থায় পড়লে আপনি আর লিফ্ট চাইতেন না’-পূরবী সচেতন ন্যাকামিতে চোখ বিস্ফারিত করে- ‘সেদিন এক সফিস্টিকেটেড ছাত্রী তার আদুরে ডোবারম্যানের পাশে বসিয়ে দিয়েছিল আমায় ।উঃ মা!লয়েডস্ ব্যাঙ্ক পর্যন্ত সারা রাস্তা ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি কুকুরটার গায়ে গা ঠেকিয়ে!’

বিমলের আগের কথায় পাত্তা দেয়া হয় নি বলে এবার সে সুরঞ্জনের কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে বলে, ‘ব্রাদার, কেন বুঝতে পারছ না, মেয়েরা তোমার রাশভারি ভাব পছন্দ করে না?’

তার খানিক পরেই, একটা সিগারেটের আধখানা শেষ করে সুরঞ্জন পথে পা বাড়িয়েছিল ।বাসস্টপে এসে হাত থেকে সিগারেটের অংশটা ফেলে দিয়ে ঠাহর করতে চেষ্টা করছিল আগতপ্রায় মিনিটা ঢাকুরিয়া-র কিনা...এমন সময় হঠাৎ শুনল-

‘প্লীজ, মে আই গিভ ইউ আ লিফ্ট,স্যার?’

হাঁ, সুরঞ্জনকেই বলছে ।তার সামনেই গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে!যেমন তেমন গাড়ি নয়, একেবারে ঝকঝকে জাপানি টয়োটা!

মেয়েটা নিশ্চয়ই তার কলেজের;কিন্তু ইকনমিক্সের নয়, তাহলে একটু চেনা লাগত ।

ওকে নীরব এবং কিঞ্চিৎ বিমূঢ় দেখে মেয়েটি এবার বলল, ‘আপনি বাড়ি যাবেন তো? আমি ঐ দিকেই যাব...’

ঘটনার অদ্ভুত যোগাযোগ সুরঞ্জনকে হতচকিত করে ফেলেছিল ।কিন্তু সে অনুভব করল অনেক জোড়া ছাত্রী ও পথচারীর চোখ বাসস্টপ ও ফুটপাত থেকে গাড়ির দিকে নিবদ্ধ হয়েছে কৌতূহলী হয়ে ।বিব্রত মুখে সে উঠে বসল মেয়েটির পাশে ।গাড়ি ছেড়ে দিল ।

গলা ঝেড়ে অস্বস্তি কাটিয়ে সহজ হতে চাইল সুরঞ্জন ।বলল, তুমি কোন্ ইয়ারে পড়?অনার্স আছে?

-‘ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি এ বছর ।আমরা আগে দিল্লি ছিলাম ।ড্যাডি এক ইন্দোজাপানিজ্ কোম্পানির ডিরেক্টর ।আমি ভেবেছিলাম ইকনমিকস্ অনার্স করব ।কিন্তু এ্যাডমিশনের সময় এখানকার প্রফেসররা বললেন হিস্ট্রিতে লেটার মার্কস্ পেয়েছ,ঐটাতেই অনার্স নাও ।সো...’

মেয়েটির গলা বেশ মিষ্টি ।কথার ভঙ্গিতে অনায়াস অন্তরঙ্গতা ।সুরঞ্জন ভাবছিল কি বলবে ।মেয়েটিই আবার কথা বলল-

আপনি আমাদের ফ্রেশার্স ওয়েলকামে এ্যাড্রেস করেছিলেন ।আমি ভীষণ ইমপ্রেসড্ হয়েছিলাম...আই মীন্ অল অব আস্...

মেয়েটির সারল্যে খুশি হল সুরঞ্জন ।নিজের প্রশংসা শুনে আত্মবিশ্বাসওএকটু বাড়ল ।পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির মুখ নিরীক্ষণ করে বলল, তোমার নাম কি?

-‘শম্পা বসু ।রোল নাম্বার সেভেন্টি-নাইন ।’

ওর ফর্সা বাঁ গাল, ঈষৎ চাপা নাক, আর রক্তিম ঠোঁঠের ফাঁকে ঝকঝকে দাঁতের ঝিলিক লক্ষ করল সুরঞ্জন ।আপন মনেই ভাবল,কোঁকড়া চুলটা এই মুখশ্রীর সঙ্গে একটু বেমানান...কিন্তু ভাসাভাসা চোখ দুটো সহজেই অচেনাকে আপন করে নিতে পারে...

শম্পা বলল, স্যর, আপনি কি কোন ব্যাপারে ওরিড্?...আই মীন্ কেমন যেন এ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড্...

-‘না,না, ও কিছু নয় ।ইটস্ অলরাইট ।আমি জাস্ট ভাবছিলাম হাউ গুড ইউ আর!তোমাদের বাড়ি কোথায়,শম্পা?’

‘যোধপুর পার্ক ।আপনাকে দু’তিন দিন মিনি থেকে নামতে দেখেছি ।’

‘তাই নাকি? হ্যাঁ আমি ভবানীপুরে বিজলি সিনেমা হাউসের কাছে থাকি ।’

‘রফিক, ভবানীপুর চলো!’

সুরঞ্জন একবার ভাবল, শিখা আবার যদি কিছু মনে করে বসে এ নতুন ঘটনায় ।মজাও লাগল,ভাবে তো ভাবুক!জীবনটা বড্ড স্তিমিত, একঘেঁয়ে, ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে ।ক্লাস,টুইশান, লাইব্রেরি, খাতা দেখা আর টিভি দেখা ।ভেবেই আবার হাসি পেল ।একটা কার-লিফ্ট তার নিস্তরঙ্গ জীবনে কি ঢেউ তুলবে!...বাচ্চা মেয়ে, টিপিক্যাল বাঙালি মেয়েদের মত প্যাঁচ নেই মনে...বোধ হয় বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান...তাছাড়া শম্পা থোড়াই রোজ লিফ্ট দেবে ।ওর ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব নয় ।কারণ ওর আর এস.এম.-এর রুটিনের মধ্যে অনেক ফারাক আছে ।...

বিজলি সিনেমা এসে গেল ।সুরঞ্জনের নির্দেশ অনুসারে বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল ।সুরঞ্জন নামল ।শম্পাকে বলল, টপ ফ্লোরে ডান দিকের ফ্ল্যাটটা আমার ।কোন ছুটির দিনে চলে এসো, ভাল করে দিল্লির গল্প শুনব ।সো সুইট অব ইউ টু অফার মী দ্য লিফ্ট!

শম্পাও নেমে পড়েছিল গাড়ি থেকে ।বলল, ‘আসব স্যার, অব কোর্স!আয়্যাম সো হ্যাপি টুডে ।আজ আমার বার্থ ডে ।মা বলে, আজ তেমন কাজ করা উচিত, যা করলে মন ভাল থাকে ।’

হঠাৎ নীচু হয়ে সে প্রণাম করল সুরঞ্জনকে ।সুরঞ্জনও স্বতস্ফূর্ত ভাবে তাকে তুলে ধরল ।

শম্পা ওর চোখেমুখ তুলে বলল, ব্লেস্ মী স্যার!

-হ্যাঁ, আশীর্বাদ করি জীবনে সব বিষয়ে সফল হও!...তুমি এস কিন্তু ঠিক সানডে বা যে কোন হলিডেতে ।আমি বাড়িতেই থাকি ।

                        (২)

তারপর শম্পা সত্যিই এসেছে সুরঞ্জনের ফ্ল্যাটে ।একবার নয়, বারবার ।শিখাকে অসংকোচে আন্টি ডেকে ঘনিষ্ঠ আলাপ জমিয়ে নিয়েছে ।সঙ্গে নিয়ে এসেছে কখনো মিষ্টির বাক্স, কখনো নামী রেস্তোরাঁর ফিশফ্রাই, কখনো বা চকোলেট-কেক ।সুরঞ্জন বিব্রত হয়ে বলেছে, ‘তুমি সবসময়খাবার আন কেন? আমাদের কি লৌকিকতার সম্পর্ক? তাছাড়া আমরা বুড়োবুড়ি কি এত খেতে পারি? দেখছ তো বাচ্চাকাচ্চার পাট নেই, আমাদের বাড়ি বড্ড শুকনো!’

শম্পা প্রথমটা থতমত খেলেও নিরস্ত হয়নি ।বলেছে ‘আপনারা মোটেই বুড়ো নন ।তবু যদি আমার আনা খাবার খেতে আপনার আপত্তি থাকে, আমিই এখানে বসে খাব ।নাকি, আপনি আমায় খাবার জন্য দোকানে পাঠাবেন?’

প্রথম দর্শনেই মেয়েটার ওপর শিখারও বেশ মায়া পড়ে গেছে ।সেও একদিন সুরঞ্জনকে ঠেস দিয়ে বলল, ‘আমরা মা-মেয়ে ভালমন্দ খাই বলে তোমার হিংসে হচ্ছে বুঝি?’ উল্টে কাজের মেয়েটাকে দিয়ে ‘শ্রীহরি’ থেকে গরম সিঙ্গাড়া আর সন্দেশ আনিয়ে বসল শিখা ।আর শম্পা নিজের হাতে সুরঞ্জনের মুখে পুরে দিল একটা দেলখোস!

খেতে খেতে সুরঞ্জন ভাবতে লাগল...মা-মেয়ে...কথাটা তার মনের তারে অনুরণিত হতে থাকল ।

সত্যি!যে জিনিসটা ফোটার আগেই জীবন থেকে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত বলে ভাবা গিয়েছিল, শম্পাকে কাছ থেকে দেখে সেই অপত্য স্নেহ স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ঝরে পড়ল মনের শুষ্ক কন্দরে ।ঠিক শম্পার বয়সী হোত না তাদের মেয়ে থাকলে, কারণ সুরঞ্জন-শিখার দাম্পত্য জীবনের আয়ু এখনো ষোল বছর পেরোয় নি ।কিন্তু শিখা ঠিকই বলেছে, মেয়ে মনে করতে কোন অসুবিধে নেই ।ওর সঙ্গে যোগাযোগটা যেন বিধাতার তরফ থেকে খানিকটা ক্ষতিপূরণ বা সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো!***

তাদের বিবাহিত জীবন তিন বছর নিঃসন্তান কাটার পর দুপক্ষের আত্মীয় আর বন্ধুদের অনুরোধ ও গঞ্জনায় পিষ্ট হয়ে সুরঞ্জন ও শিখা দুজনেই যথারীতি ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েছিল ।তাতে জানা গিয়েছিল দুর্বলতাটা সুরঞ্জনেরই ।তার শুক্রকীটগুলো প্রজননে অক্ষম ।অথচ সুরঞ্জনের আকৃতি ও অন্যান্য স্বাস্থ্যলক্ষণ অনেকেরই ঈর্ষার বস্তু ।

সুরঞ্জন বলেছিল, ‘তোমার দুর্ভাগ্য, শিখা, আমার সঙ্গে গাঁটছড় বেঁধেছ ।কিন্তু আমি তোমাকে বেঁধে রাখব না ।...এ আঘাতের ক্ষতিপূরণ হয় না, তবু তোমার জীবন তুমি নতুন সঙ্গী নিয়ে সুরু করতে পার। সারা জীবন মাতৃত্বের স্বাদ থেকে কেন বঞ্চিত থাকবে?’

শিখা ওর কপালে বুকে হাত বুলিয়েছে ।ইতিহাস প্রসিদ্ধ অনেক বীরপুরুষও যে পিতৃত্বের অধিকারী ছিলেন না, এ কথা উল্লেখ করেছে সান্ত্বনা হিসাবে ।শেষে বলেছে ‘তুমি তো আমায় ঠকাও নি, ভগবানই তোমায় ঠকিয়েছেন ।তোমার সমস্ত ভালবাসা প্রতিনিয়ত উজাড় করে দিয়েছ আমাকে ।এতো নিয়েছি, আর এই দুঃখটুকু ভাগ করে নিতে পারব না?’বন্ধু আর আত্মীয়দের বাচ্চা সম্পর্কে ওদের দুজনেরই হীনমন্যতা 

ছিল ।শিখা বড্ড বেশি আদর নিয়ে হামলে পড়ত; নিজের সন্তানের অভাবজনিত শূন্যতা লোকের চোখে পরিস্কার ধরা পড়ত ।তারা ভাবত করুণার পাত্রী ।ওদিকে সুরঞ্জন একটা আক্রোশ পোষন করত বাচ্চা-সমাজের প্রতি ।কেউ এসে তার ঘর নোংরা অগোছালো করলে তার বাপ-মা’র সামনেই ঝাঁঝিয়ে উঠত । একটা নার্সারি রাইম বলার জন্য সবাই যখন কোন বাচ্চাকে তোষামোদ করত, ওর গা জ্বলে যেত বিরক্তিতে ।নিজেকে বোঝাতে চেষটা করত এটা এক ধরণের বিকৃতি ।কিন্তু মানসিক ক্ষোভ তাতে শান্ত হোত না!

ক্রমে বহতা সময়ের প্রভাবে সে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে প্রায় মিলিয়ে গেছে ।অবসর সময়টা বেহালা বাজিয়ে কেটে গেছে একরকম ।শিখারও অন্যের বাচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা ক্রমে নিবৃত্ত হয়েছে ।সে আছে একটা গানের স্কুল নিয়ে ।কিন্তু দুজনের মন হয়ে গেছে দ্বিধাবিভক্ত স্রোতের মত ।মাঝে বালির চড়া পড়েছে ।

                        (৩)

দু’বছরের ঘনিষ্ঠতায় শম্পা এখন সুরঞ্জনদের বাড়ি-তথা-জীবনের মূল কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে নিজেকে ।ওকে ঘিরে দু’জনের ব্যর্থ সন্তানাকাঙ্ক্ষার ফল্গুধারা প্রকাশ্য স্রোতের আকার ধারণ করেছে ।

ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে শম্পা ইকনমিকস্ নিয়েছে ।প্রায়ই সুরঞ্জনের কাছে বসে বইখাতা নিয়ে ।দাবিটা আগেই জানিয়ে দেয়—সিম্পল এ্যাণ্ড ক্লিয়ার করে বুঝিয়ে দিতে হবে ।

এখন শিখার শপিংয়েরও নিয়মিত সঙ্গিনী সে ।তার কাছে দু’এক পদ রান্নাও শিখেছে ।সিনেমা দেখতেও যায়, কখনো দুজনে, কখনো তিন জনে ।কোন কোন দিন হয়তো বা রবীন্দ্র সঙ্গীতের মহলা বসল।বেহালায় সঙ্গত করল সুরঞ্জন ।

গত পুজোর ছুটিতে শম্পার বাবা-মা-ভাই, অর্থাৎ, পুরো পরিবারের সঙ্গে সুরঞ্জনরা হাজারিবাগ কাটিয়ে এলো চার দিন ।ফটো তোলা হয়েছে অনেক ।গ্রুপ ফটো, একক ফটো, সুরঞ্জন আর শিখার সঙ্গে শম্পা ।এরকম একটা ফটো বাঁধিয়ে শিখা রেখে দিয়েছে ড্রইংরুমে ।

সপ্তাহে দু’দিন অন্তত কলেজ যাতায়াত শম্পাদের গাড়িতে করতে হয় সুরঞ্জনকে ।এ ছাড়াও মাঝেমধ্যে লিফ্ট জুটে যায় ।হয়তো আমেরিকান লাইব্রেরি থেকে জওহরলাল নেহরু রোডে পড়তেই চৌরঙ্গীর কোন সিনেমা হল থেকে ম্যাটিনি শো ফেরৎ শম্পা ওকে দেখতে পেয়ে থামল এসে পায়ের কাছে ।বলে উঠল,কাম ইন, কাকু, ইউ আর আণ্ডার এ্যারেস্ট!ইদানিং ‘কাকু’ই বলে সে ।সুরঞ্জন হাসিমুখে বলে, ‘এ যে দেখছি এস্ ফোর্টিনের বদলে এস শম্পা ।সকালে উঠে কার মুখ দেখেছিলাম!’ শম্পা জবাব দেয় ‘মনে হচ্ছে আমারই।’ দুজনেই হেসে ওঠে ।***

ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের সরোদ ।কলামন্দির বেসমেন্ট হলে ।সুরঞ্জন দুটো টিকিট পেয়েছে ।শম্পাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে ।বাজনা শুনতে শুনতে রাগটার আরোহ-অবরোহ জানতে চায় শম্পা ।সুরঞ্জন নীচু স্বরে বলে দেয় ।অনেকক্ষণ রেষারেষির পর সরোদী আর তবলচি যখন একই সঙ্গে সম-এ পড়ে সন্ধি করল,শম্পা জিগ্যেস করল, ‘তাল ঠিক আছে? না, তুমি যেমন আমার সাথে এ্যাডজাস্ট করে নাও, ওরাও তেমনি শো-টা ঠিক রাখছে?’ সুরঞ্জন চাপা গলায় বলে, ‘চুপ,চুপ!আমজাদ শুনতে পেলে ঘাড় ধরে বসিয়ে হাতে কাউন্ট করাবে!’...ঠুংরি স্টাইলে পেশ-করাখাম্বাজ একেবারে বিভোর হয়ে উপভোগ করছিল সুরঞ্জন ।প্রতিটি মীড়ের কাকুতি যেন খানিকটা করে অনুরাগ চলকে তুলে প্রিয়র উদ্দেশে নিবেদন...।হঠাৎ তাকে পাশ ফিরে তাকাতে হোল ।তন্ময় হয়ে সরোদ শুনতে শুনতে নিজের অজান্তে শম্পা একহাতে খামছে ধরেছে তার পাঞ্জাবির কাঁধ!...

মাঝে মাঝে শব্দ-জব্দও এনে হাজির করে শম্পা ।সমাধানের জন্য সুরঞ্জনের সাহায্য চায় ।একদিন মেলাতে গিয়ে একটা গোলমেলে কথা এসে পড়েছিল ।শম্পা পরম সারল্যভরে জিগ্যস করেছিল, ‘আসঙ্গ’ কথাটার মানে কি?সুরঞ্জন এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বলল,এটা তোমার আন্টি ভাল বলতে পারবে!

আজকাল প্রায়ই সুরঞ্জন অবাক হয়ে ভাবে, শম্পাকে একদিন না দেখলে কেন মনে হয়,মনের মুখশুদ্ধি হয় নি?...লোকের বাৎসল্য কি এই জিনিস?...অবশ্য নিজের সন্তান হলে যে অধিকার-জাত নিস্পৃহতা থাকে, পরের মেয়ে, পরের বোন ইত্যাদিকে আপন করে নেওয়ার মধ্য তার বদলে একটা আকর্ষক অনুভূতি থাকে ।টমাস হার্ডির নভেল ‘দ্য মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ’-এ হেনচার্ড ও এলিজাবেথ-জেন-এর কথা মনে হল সুরঞ্জনের ।সেই পেয়ে হারানোর ভয়...

তারপর সেদিনের ছাত্র-ধর্মঘট...কিছু উটকো ছেলে কলেজের গেট টপকে ভিতরে ঢুকেছিল ।সুরঞ্জন স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে এসেচড়া গলায় প্রতিবাদ করেছিল ।অতর্কিতে একটা ইট এসে লাগল তার কপালে।...শম্পার গাড়িতেই সেদিন স্টিচ করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল ।অনেক রাত পর্যন্ত তার ব্যাণ্ডেজ-করা মাথায় হাত বুলিয়ে তবে বাড়ি গিয়েছিল মেয়েটা ।বলে গিয়েছিল, ‘কাকু, সাতদিন কমপ্লিট রেস্ট ।খবরদার কলেজ যাবে না!’

                         (৪)

শম্পার কথা রেখেছে সুরঞ্জন ।সাত দিন ছুটির পর আজ তার কলেজ জয়েন করার কথা ।গেলেই এরিয়ার ডি.এ. বেশ কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যাবে ।সুরঞ্জন ভেবেই রেখেছে শম্পাকে লেটেস্ট টেকনোলজি-যুক্ত দামি একটা মোবাইল ফোন দেবে আজ ।সেই সঙ্গে ওর পছন্দমত কিছু ফিল্মের ডিভিডি-ও ।

শম্পাদের মোটর এসে থামল সুরঞ্জনের বাড়ির সামনে ।কিন্তু গাড়ি থেকে বরলেন শুধু শম্পার বাবা । সুরঞ্জন আপ্যায়ন করে বসাতেই তার হাতে তুলে দিলেন একটা জমকালো বিয়ের কার্ড ।সুরঞ্জন সবিস্ময়ে তাকাতে বললেন, ‘যোগাযোগ অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎই হয়েছে ।আপনাদের আগে কিছু জানাতে পারিনি... ছেলেটি রিয়েল জেম্ ।সাতাশ বছর বয়সেই বিরাট বিজনেস এক্সিকিউটিভ ।ওরা থাকে বেঙ্গালুরু ।’

সুরঞ্জন চুপ করে রইল ।মিঃ বাসু আবার বললেন, ‘শম্পা আপনার কথা খুব শোনে ।কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে বলে কান্নাকাটি করছে ।আজ নাকি ওদের পার্ট টু-এর রেজাল্ট বেরবে? কিছুতেই কলেজ যাবে না বলছে ।ওকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, কেমন?...আমি চলি, অফিসের দেরি হচ্ছে...আপনি কি এখন কলেজ যাবেন? তাহলে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যেতে পারি...’

সুরঞ্জনের কানে আর শেষ কথাগুলো ঢুকল না ।সে শুধু ভাবতে লাগল, আমি বুঝিয়ে বলব শম্পাকে,,, আমি?...আমাকে কে বোঝাবে?...

কোন জবাব না পেয়ে মিঃ বাসু কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন অধ্যাপকের দিকে । তারপর আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগলেন ।

শিখা ধীর পায়ে ঘরে এসে ‘শুভ বিবাহ’ লেখা খামটা খুলে পড়ল । তারপর সুরঞ্জনের কাঁধে আলতো হাত রাখল ।

একটু চমকে উঠল সুরঞ্জন ।মুখ তুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল । মুখ দিয়ে বেরল, ‘হঠাৎ এসেছিল, হঠাৎই চলে যাচ্ছে!’

শিখা বলল, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি ।আমাদের শম্পি নিশ্চয়ই সুখী হবে!’

সুরঞ্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর চোখ দুটো লক্ষ্য করল ।হাঁ, সে দুটো রীতিমত সজল ।

তবে কিনা, মানুষ সুখ-দুঃখ দুটোতেই চোখের জল ফেলে!


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024