ছোট গল্প - কবিতার দেশে || লেখক - বৈদূর্য্য সরকার || Short story - Kobitar dese || Written by Boidurya Sarkar


 


কবিতার দেশে

বৈদূর্য্য সরকার



মেট্রো স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল নীলাঞ্জন । শুক্রবার সন্ধে সাড়ে সাতটা । এই সময় রিয়া ফিরবে গানের ক্লাস থাকে । এখনও রিয়া যে নিয়ম করে গানের ক্লাসে যায় সেটাই আশ্চর্য ।  নীলাঞ্জন নিজে তো পারেনি ।  স্বীকৃতি নেই, কতদিন শিল্পচর্চার উৎসাহ ধরে রাখা যায় !

নীলাঞ্জন খেয়াল করেনি – আশপাশ কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেছে । অসময়ের বৃষ্টিতে এমন হয়। সবকিছু থম মেরে থাকে । লোকজন নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলেও একজন অশক্ত চেহারার লোক সামনে এসে পড়েছে । আশ্রয় পাওয়ার ভঙ্গিতে ওর বাঁ হাতের কবজি চেপে ধরল । মুখটা চেনা ঠেকছে বলেই বিরক্তি প্রকাশ করল না নীলাঞ্জন। লক্ষ্য করল, লোকটার বুড়ো আঙুলটা কেমন যেন বিকৃত । হাতুড়ে চিকিৎসকের অস্ত্রোপচারের ফল বলে মনে হয়।

লোকটার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি কাঁধে ঝোলা । কোথায় যাবে ? বুঝতে পারল না নীলাঞ্জন । তবে তার পক্ষে হাত ছাড়িয়ে নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না এই মুহূর্তে । ভাবল, কাছেই হয়ত বাড়ি । একটু এগিয়ে দিলে ক্ষতি কি ! রিয়ার আসতে এখনও খানিকটা দেরি আছে । অফিস থেকে বাড়ি না ফিরে একেবারে রিয়ার সাথে ফিরবে বলে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকে । দেখে সন্দেহ করার কিছু নেই, মধ্যত্রিশের ছাপোষা একটা লোকের জীবনে আর কোন গল্প বাকি থাকতে পারে ! সেই একইভাবে অফিসের কাজ, ঘর সংসার বাজার দোকান । উন্নতির আশা নেই। দেশবিদেশের গপ্পো নেই, কবিতার খাতা ফুরিয়ে গেছে । দু’চারটে বইপত্র বেরিয়েছিল বটে, তা কে আর মনে রেখেছে ! বড় প্রকাশনার দরজা খোলেনি তার জন্যে, উৎসবেও কেউ কবিতা পড়তে ডাকেনি । বিশ তিরিশ হাজার খরচ করে বই ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠিতদের অনুচর হয়নি সে । আজকাল দেখছে শিল্পসাহিত্যের জগতে পয়সাওলা লোকেদেরই কদর । অবশ্য মহিলাদের খানিক সুযোগসুবিধে আছে ।

নীলাঞ্জনের খেয়াল পড়ল, কতদূর হাঁটছে তারা ! কোথাকার রাস্তা ? ভাল ঠাওর করতে পারছে না ।  রাস্তাঘাট বেশ শুনশান । যেন ছবির মতো শহর একটা । বাড়িঘরের চেহারাও পালটেছে । তাকে দাঁড় করিয়ে বুড়ো লোকটা কোথায় যে গেল !

নীলাঞ্জন দেখল, একটা বড় নীল দরজা । এগোতে কোথা থেকে ভেসে এল – পাসওয়ার্ড ? ঘাবড়ে গিয়ে ফেসবুকের পাসওয়ার্ড বলতেই হড়াস করে খুলে গেল দরজা । 

প্যারালাল দুনিয়া । অনেকটা উন্নত । বেশ এডিট করা সব চেহারা । রাস্তাঘাট বাড়িঘরে বেশ ছিরিছাঁদ আছে । তবে খেয়াল করলে বোঝা যায়, সব একরকম । অনুকরণের দুনিয়া যেন । এখানে বেশ একটা হেমন্তের আবহাওয়া । নীলাঞ্জন বেশ খুশি মনেই ঘোরাঘুরি করছিল । লোকজন, চায়ের দোকান নেই বলে যে বিরক্ত লাগছিল না তা নয় ।  রাস্তায় সব গাড়িগুলো সটাসট চলে যাচ্ছে । বাসের দেখা পায়নি । কিন্তু যাবে কোথায় ! বের করে দেখল ফোনটাও বিগড়েছে । টাওয়ার নেই ।

একজনকে দেখে চমকে উঠল নীলাঞ্জন । কলেজের একটা ছেলে। আজকাল খুব মাতব্বর হয়েছে দেখতে পায়। সবটাই যে জনসংযোগ, ওকে দেখেই বুঝে গেছে নীলাঞ্জন । এখানে কোথায় যাচ্ছে ? ওর যাওয়ার ভঙ্গিটায় যে বেশ একটা গোপনীয়তা আছে, ভালই বুঝেছে নীলাঞ্জন । কিছু না ভেবেই ওকে ফলো করতে লাগল নীলাঞ্জন । খানিকটা গিয়ে একটা বড় সাদা বাড়ির সামনে এসে থামল । কায়দা করে ‘কবিতার দেশ’ লেখা আছে দরজার মাথায় । খানিকটা কৌতূহলবশত ঢুকে পড়ল বাড়িটায় । বোঝা যাচ্ছে, এখানে অনেক লোকের জমায়েত।

একটা মিশ্র ধ্বনির মধ্যে ঢুকে পড়েছে নীলাঞ্জন । বহু ছেলে বহু মেয়ে । যদিও অনেকের ভালই বয়স হয়েছে । তবে সবার ভাবভঙ্গিতে কচি সাজার চেষ্টা । সাজপোশাক দেখেই বোঝা যায়, সবাই বেশ বড়লোক । আড়ালে বসে সব লক্ষ্য করছিল নীলাঞ্জন । বুঝতে পারলো এ সভার আরাধ্য সরকারি কবি । সবাই তার অনুসারী । ভিড়ের মধ্যে পরিচিত মেয়েদের চোখে পড়ল । তারা এখন ওকে পাত্তা দেয় না । সবাই পুরস্কার পেয়েছে গুরুঠাকুর ধরে। শোনা যায়, আগের শাসকের হয়ে কবি লড়াই শুরু করেছিলেন । তারপর এই শাসকের জন্যে ব্যবহার করছেন তার দলবল । শেষপর্যন্ত উপহার পেয়েছেন এই কবিতার দেশ ।

তাকে সর্বদা ঘিরে থাকে একদঙ্গল মেয়ে । তাদের টানে আসে একদল ছেলে । আবার তাদের পেছনে অনেক ছেলেমেয়ে। নরক গুলজার একবারে । দেওয়ালে টাঙানো আছে বিখ্যাত সব ছবি ।

এখানে এসে নীলাঞ্জন বুঝতে পারছে, ওর দেখা সভাগুলোর মতো এখানেও যারা কবিতা পড়ার তারা পড়ছে আর বাকিরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব খুনসুটি করছে । সে স্বগতোক্তি করল- সব জায়গায় একই অবস্থা ।

ওর পাশের ছেলেটার সাথে টুকরোটাকরা কথাবার্তা হচ্ছিল নীলাঞ্জনের । ছেলেটাকে অবশ্য একটু বিক্ষুব্ধ বলে মনে হল । কচি অবোধদের পেয়ে এখন তাদের আলো খেতে দিচ্ছে না দাদা। সে ফিসফিস করে নীলাঞ্জনকে জানালো, তারাও দলবদল করতে জানে... শিখেছে কবিবরের থেকেই ।

হঠাৎ দেখা গেল, সভা একদম শান্ত হয়ে এল । কবি স্বয়ং পড়বেন । তার আগে বেশ খানিক প্রশস্তি । পড়াটুকুর অপেক্ষা, তারপর আবার সমস্বরে উচ্ছ্বাস । যদিও নীলাঞ্জনের মনে হল – এ যেন কবিতা নয় বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া । কিন্তু সেসব ভাবার অবসর নেই । নানারকম হইচইয়ের মধ্যে ছেলেটির সাথে উঠে পড়ল নীলাঞ্জন। ছেলেটা বেশ ঘোড়েল, এবার উল্টোদিকের আসরে যাবে । নীলাঞ্জনের আপত্তি নেই কিছু । তার তো যাওয়ার কোনও জায়গা নেই ।

বুঝতে পারল, একই বিল্ডিংয়ের দু’টো দিকে দু’দলের আস্তানা । নীলাঞ্জনের মনে হল, সব বিরোধিতাই প্রতিষ্ঠানের গায়ে গায়ে থাকে ।  তবে এখানে ভিড় অপেক্ষকৃত কম । কোথাও যেন একটা অশ্রুত সঙ্গীত বাজছে বলে মনে হল নীলাঞ্জনের । লোকজনের কথাবার্তায় সের’ম একটা ভঙ্গি । সমে এসে সব থমকে যাচ্ছে । ছেলেটাকে বেশ হেঁহেঁ করতে দেখল নীলাঞ্জন । 

এ হচ্ছে গোঁসাইয়ের আখড়া । কোমলরসের কারবার সব । শোনা গেল, নতুন রানি আর পুরনো রাজার বিরহকাব্য লিখে কবি নাম করেছিলেন । এখন হয়েছে সমস্যা । দুই কবি অনুগতদের নিয়ে এমন প্রশস্তি শুরু করেছে, দু’জনকেই সৌখিন দু’টো পদে বসিয়েছেন রানি। একই জায়গায় পাশাপাশি দু’টো আখড়া ।  

তবে একটা ভাল ব্যাপার, নীলাঞ্জনকে কেউ খেয়াল করেনি । এক অর্থে ভালই হয়েছে । খানিকটা আশাহত ভঙ্গিতে মন্থর পায়ে একা নীলাঞ্জন বেরিয়ে এল বাড়িটা থেকে । রাস্তায় নেমে এলোমেলো একা হাঁটতে লাগল । 

হঠাৎ ওর মনে হল, এতক্ষণ হয়ে গেছে তবু তো খিদে তেষ্টায় অনুভূতি হচ্ছে না বিশেষ । এ আবার কীর’ম জায়গা রে বাবা ! একটু পরে খেয়াল করে দেখল, শীত গরমের বিশেষ কোনও তফাত নেই এখানে । এতক্ষনে বেশ ঘাবড়ে গেছে নীলাঞ্জন । সত্যিই তো, এ কোন দুনিয়ায় এসে পড়ল ? এসে পড়লই বা কি করে ! সবই তার চেনা দুনিয়ার মতোই কিন্তু যেন একটু আলাদা । 

এখানে সবাই কি এসব নিয়েই মেতে থাকে সর্বদা ? অন্য কাজকর্ম না করে পেট চলে কেমন করে ! বাজারের অবস্থা তো এমনিতে তো ভাল নয় । চাকরিবাকরি করেই নুন আনতে পান্তা ফোরায়... না করলে কী হবে তা কল্পনা করার চেষ্টা করে দেখেনি নীলাঞ্জন । 

-চলো, আর কতক্ষণ তোমার জন্যে দাঁড়াবো !

একটা বেশ আরামদায়ক আবহাওয়ায় পার্কের বেঞ্চিতে বসে নীলাঞ্জনের একটু তন্দ্রা মতো চলে এসেছিল । ঠিক তখনই চোখ রগড়ে উঠে বসে দেখল, সেই বুড়ো কোথা থেকে হাজির হয়েছে । নীলাঞ্জন খানিকটা অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেছিলেন আমাকে ফেলে ! লোকটা বৃদ্ধ ঠাকুরদার মতো মমতায় বলে উঠল, তোমার মতো ছেলেছোকরাদের জড়ো করে এনে সব জোগাড়যন্ত্র করতে দেরি হয়ে গেল । আমি একা আর কতদিক সামলাবো ! তারপরেই কথা থামিয়ে উনি তাড়া দিয়ে নীলাঞ্জনকে নিয়ে চললেন । সামনের একটা ভাঙাচোরা দরজা দিয়ে ঢুকতে যেন বদলে গেল সবকিছু ।

আকাশে মেঘ করেছে । গুমোট একটা অবস্থা । এতক্ষণের অনাহারের পর এবার শরীর যেন কিছু চাইছে । ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, বুড়ো মানুষটা । বলল, একটু জিরিয়ে কিছু মুখে দেবে চল । ওরা গিয়ে পৌঁছোল, একটা পুরনো সরাইখানার মতো একটা জায়গায় । সেখানে বেশ ভিড় । হৈহল্লা করছে লোকজন । অনেক বেঞ্চ পাতা, সামনে লম্বা টেবিল । মাথার ওপর বিরাট একটা টিনের শেড । আবছা অন্ধকার ।

খিদের মুখে ভাত ডাল পোস্ত দিয়ে দিব্যি কাজ চলে যায় । টিনের শেডে ততক্ষণে জলতরঙ্গ বাজছে । চারদিকে গান পান মিলিয়ে যেন একটা উৎসব । নীলাঞ্জনের মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল, অনেকদিন পর । অন্ধকার চোখ সয়ে এলে নীলাঞ্জন দেখল, পরমপিতার একটা ধূসর ছবি । একদিকে নিঃশব্দে বসে আছে বাবরি বাগিয়ে একজন, একজন তিমিরে । একজন ফরসা চেহারার লোক তার দিকে হেসে বলল, আমাকে লতিয়ে ধরবে না ! আরও কত ভাঙাচোরা চেহারার লোক কত কী বলছিল, তাদের গুঞ্জন থামল যখন প্রবল দাপট নিয়ে এসে দাঁড়ালেন টলটলায়মান প্রধান কবি... বাকি সব ৎ। তার পাশে সেই বুড়ো লোকটা । আরও অনেক লোকজন । একজন আন্তর্জাতিক, একজন দার্শনিক, একজন রঘু ডাকাত, আরেকজন বসন্ত মস্তান । সবাই বেশ রোগাভোগা হলেও একরোখা চোখমুখ ।

বোঝা গেল, প্রধান খুব রেগেছে নকল কবিতার দেশের ওপর । পাশের লোকটাকে বলছে, তোমার জন্যেই আজ এতো কবি ! সেজন্যেই এতো দলাদলি গলাগলি । সবাই সমস্বরে সমর্থন করল । বুড়ো লোকটা বিড়বিড় করে বলছিল, আমার মতোই সব গরীব ঘরের ছেলে, তাই জায়গা করে দিয়েছিলাম । লিখছে, খারাপ কাজ তো কিছু করছে না ! তাতে প্রধান ধমক দিল । সেই তিমিরে বসা লোকটা বলে উঠল, কাপালিকের মতো জীবন না কাটালে লেখা হয় না । কাব্যের দাবানলে আহুতি দিতে হয় সবকিছু, সুন্দর দেখতে বাবরি বলে উঠল ।

নীলাঞ্জনের মনে হল, সে অনেকদিনের পুরনো হারানো সভায় এসে পড়েছে । এবার দল বেঁধে যাওয়া হবে রাত্রি শাসন করতে । নেতৃত্ব দিলেন প্রধান কবি । সবাই উচ্চারণ করছে বীজমন্ত্র, আমি স্বেচ্ছাচারী !

সাজানো রাজপথ দিয়ে সদর্পে যেতে লাগল উলোঝুলো দলটা । ক্রমে সেই দল কিছুটা পথ পেরিয়ে এসে থমকালো সেই সাদা বাড়ির সামনে । দৃশ্য দেখে ভেতরের লোকজনের ভয়ার্ত চিৎকার বেশ শোনা যাচ্ছে । একদল ভাঙাচোরা লোকের কলমের জোর এতদিনে বুঝেছে তারা । নীলাঞ্জনের বুকের ভেতরটা যেন বেশ শান্ত হয়ে এসেছে, ধনুকের ছিলা শেষবারের জন্যে যেমন থমকে যায় ।

তারপর উড়তে লাগল শব্দবাণ । শুরু করলেন প্রধান স্বয়ং । একে একে সবাই । তীব্র শব্দের আঘাতে কাঁপতে লাগল সাদা প্রাসাদ । চারিদিকে যেন আগুনের হলকা । সেখান থেকে নীলাঞ্জন কুড়িয়ে পেল, আধপোড়া একটা পাণ্ডুলিপি – তাতে তার নাম লেখা ।

 


ঠিক তখনই নীলাঞ্জনের ফোনটা বেজে উঠল । নীলাঞ্জন চমকে উঠে ফোনটা ধরতে একটা রিনরিনে মহিলা কণ্ঠ । তিনি জানাচ্ছেন, তেরো বছর সাত মাস ন’দিন আগে জমা দেওয়া তার পাণ্ডুলিপিটি মনোনীত হয়েছে । প্রকাশ পাবে মেলায় । তখনই নীলাঞ্জন দেখতে পেল রিয়া আসছে রাস্তা পেরিয়ে ।

তাকে কাছে আসতে দেখে দীর্ঘদিন বাদে নীলাঞ্জনের মুখে সম্মতিসূচক হাসি ফুটে উঠল । রিয়া নিশ্চিন্ত হল। ভাবল, নতুন ওষুধটা তাহলে কাজ করছে ।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024