ছোট গল্প - সুজাতা ম্যাম || লেখক - আভা সরকার মন্ডল || Short story - Sujata mam || Written by Ava sarkar mandal


 

সুজাতা ম্যাম

    আভা সরকার মন্ডল

 

 

                আমেরিকা থেকে পাঁচ বছর  পর দেশে ফিরল তিতলি। এয়ারপোর্টে পা রেখেই বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আপন মনে বলল ---- আহ্ শান্তি !

নিলয় হাসছে--

 ----শান্তির হাওয়া বেশি করে খাও ।দু 'সপ্তাহ মাত্র ।এবার গেলে পাঁচ বছরের আগে আর আসা হবে না ।

--- তিতলির মুখ কালো হয়ে যায়।ভালো লাগে না তার আমেরিকা। নেহায়েত নিলয় তার প্রেমে হাবুডুবু আর সেও ভালবাসে নিলয় কে তাই ....

         গাড়ি থেকে বড় রাস্তায় নেমে সরু গলির ভেতর তাদের বাড়ি ।গাড়ি ভেতরে ঢুকবে না। বড়ো বড়ো দুটো ট্রলি ব্যাগ এবং হাতেও ছোটো বড়ো চারখানা ব্যাগ সহ গাড়ি থেকে নামল তারা।সবার জন্য টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতে কিনতে বোঝাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। তবু তিতলির মন ভরেনি । প্লেনে উঠতে দেবে না বলে,নিলয় ভয় না দেখালে সে আরও একটু কেনাকাটা করত!

বাবা আর ভাই গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা একহাতে নিলয় অন্য হাতে তিতলিকে জড়িয়ে নিলেন।

... রাস্তায় কষ্ট হয়নি তো মা তোদের?

----একদমই না তিতলি বলল।

... এমা! দিদি,তুই কত রোগা হয়ে গেছিস ।ভিডিও কলে তো এতটা রোগা মনে হয় না।

..... আর তুইও তো ফুটবল হয়ে গেছিস । তোকেও তো এত মোটা মনে হয় না--- তিতলি ভাইয়ের কথার জবাবে তার চুল টেনে আদর করে বলল।

ভাই আর বাবার হাতে ব্যাগগুলো ছেড়ে দিয়ে সে এগিয়ে গেল তাড়াতাড়ি । দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে মাকে।সবাইকে ফেলে ছুটে গেল সে মায়ের দিকে।  জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। কারো মুখে কথা নেই ।দুজনের চোখেই জল। মা, বাবা, ভাইকে ছেড়ে থাকতে হয় বলেই বিদেশ তিতলির একদম ভালো লাগে না।

 

          তিতলির শ্বশুরমশাই বেঁচে নেই। শাশুড়ি মা আমেরিকায় তাদের সঙ্গেই থাকেন।তিনিই তিতলি আর নিলয় কে পাঠিয়েছেন বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। নিলয় তাঁর একমাত্র সন্তান।দেশে তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই তাঁর ।সর্বোপরি দেশের প্রতি তেমন কোনো মোহও কেন যেন তাঁর নেই । তিতলি অনেক বলাতেও তিনি রাজি হয়নি, তাদের সঙ্গে আসতে।

              একটু বিশ্রাম নিয়ে তিতলি ছুটল টিনার বাড়ি ।পাশের গলিতেই। সে আসছে জেনে টিনা শ্বশুর বাড়ি বর্ধমান থেকে ছুটে দমদম এসেছে প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কালকেই চলে যাবে সে।তাই আজকেই তার সঙ্গে দেখা করা জরুরি।

টিনাদের বাড়ি ঢুকতেই ডান হাতে একটা বিশাল বটগাছ।তার চারিদিকে বাঁধানো বেদী।পাড়ার ছেলে ,মেয়ে, বউ এমনকি বুড়ো-বুড়িরাও এই বেদিতে বসে আড্ডা দিত এক সময়।বউমারা বেশিরভাগ সময় দুপুরবেলাটাকেই বেছে নিত গল্প করার জন্য।  সকালটা থাকত বয়োজ্যেষ্ঠ দের দখলে। বাজার বা মর্নিং ওয়াক সেরে থলে হাতে দু'দন্ড বসে  রাজনীতি বিষয়ক আলাপ-আলোচনা চলত তখন। বিকেল বেলায় থাকত উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের ভীড় । বিশাল গাছের চারদিকটা বাঁধানো। সবসময় সরগরম থাকত জায়গাটা। তিতলি আর টিনার কত গোপন কথার সাক্ষী এই বটগাছ !

--এখন কেউ আর সেভাবে গল্প গুজব করে বলে মনে হচ্ছে ‌ না---- শূন্য বটতলা দেখে তিতলি ভাবল।

 

             সে বটগাছটা পার হতে গিয়ে দেখলো মাঝ বয়সী একজন মহিলা দু পায়ে জলের বোতল আঁকড়ে, হাত দিয়ে টেনে ছিপি খোলার চেষ্টা করছে নোংরা কাপড় চোপড় চুলগুলো জটপাকানো ।সে এগিয়ে গেল। বোতলটা খুলে দেবে বলে হাত বাড়াতেই জ্বলজ্বলে চোখে তাকালেন সেই মহিলা । তাঁকে ঠিক সুস্থ বলে মনে হচ্ছে না। কি গভীর দৃষ্টি !কোথায় যেন দেখেছে একে, ভাবছিল তিতলি---- ঠিক তখনই হঠাৎ উঠে তিনি টেনে এক থাপ্পর কষালেন  তিতলির গালে।

টিনা ছুটতে ছুটতে এসেও রক্ষা করতে পারলো না তিতলি কে। সে বারান্দা থেকেই দেখেছিল তিতলি রাস্তা ছেড়ে গাছতলার দিকে এগোচ্ছে। তখনি ছুট লাগিয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ভ্যাবাচাকা মুখে দাঁড়িয়ে আছে তিতলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই টিনা তাকে হাত ধরে টানতে টানতে  নিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। ঘরে ঢুকে এসি চালিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল তিতলির দিকে ।বিনা বাক্যব্যয়ে তিতলি ঢকঢক করে জল খেতে লাগলো।.

----- চিনতে পারলি ?.... সুজাতা ম্যামকে?

টিয়ার প্রশ্নে তিতলি বিষম খেলো জোরে। ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল মুখ থেকে ছিটকে পড়া জল।

..... সরি!সরি!সরি! কি যে বলি তোকে? ঠান্ডা হয়ে বসতো আগে----

টিনা তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ।

ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল তার । টিনার মা বাবা ভাই সবাই অফিসে। ফাঁকা বাড়ি কতদিন পরে দেখা দুই বন্ধুর। কত গল্প করবে বলে ছুটে এসেছে দুজন দুদিক থেকে।কিন্তু হাওয়া অন্য পথে বইছে। সুজাতা ম্যামের কাহিনী দিয়েই শুরু হল কথা, যিনি বদ্ধ উন্মাদ এখন।

       তিতলির মনে পরল সুজাতা ম্যামের ক্লাসে পিন পতনের শব্দ ও শোনা যেত।তার ব্যক্তিত্ব আর অন্তরভেদী দৃষ্টির গভীরতা কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে ক্লাসে অমনোযোগী হতে দিত না। আর সঙ্গে ছিল তাঁর অতুলনীয় সৌন্দর্য ।তা যেন বশ করে রাখত সবাইকে । সুজাতা ম্যামকে ভালোবেসেই অংক ভালোবাসা তিতলির। ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি, তিতলি ও টিনাকে।পাশের বাড়িতে থাকার সুবাদে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছিল সেই সম্পর্ক। কোন প্রবলেম সলভ করতে না পারলে তিতলি যখন-তখন পাশের গলি থেকে ছুটে যেত সুজাতা ম্যাম এর কাছে। বাড়িতে গেলে তিনি শুধুই মা। মায়ের মতই ছিল তাঁর আদর যত্ন ভালোবাসা। তাঁর হাতে তৈরি নাড়ু খেতে পুজোর সময় গুলোতে প্রায় রোজই তারা ম্যামের বাড়ি হানা দিত। সাত বছরের ছোট্ট একটা ফুটফুটে ছেলে ছিল ম্যামের।তার গাল টিপে আদর করে তাকে মাঝে মাঝে মাঠে ঘোরাতেও নিয়ে যেত দুজনে । দুটো সিনেমার পার্শ্বচরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন ম্যাম।সেজন্য আশে পাশের লোকে তাঁকে আরও বেশি ভালো ভাবে চিনতো। এবং সবাই বিশ্বাস করত অভিনয়ের লাইনে গেলে সুজাতা ম্যাম এর নায়িকা হওয়া কেউ আটকাতে পারত না।

           ওই বটতলাতে কতদিন অংক খাতা মিলিয়েছে তিতলি আর টিনা।তিতলির চোখ ফেটে জল এল ! সেটা থাপ্পড়ের ব্যথা, না সুজাতা ম্যামের দুর্দশা--- কি কারণে,  সে নিজেও বুঝতে পারল না। সে টিনা কে বলল সব ঘটনা খুলে বলতে।

           সুজাতা ম্যাম ছিলে তাদের স্কুলের অংকের শিক্ষিকা। ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত উকিলকে,দুই বাড়ির মত নিয়েই।ফুটফুটে একটা বাচ্চাও আছে তাদের ।সুন্দর সাজানো সুখের সংসার । জিতেন বাবু প্রচন্ড ভালবাসতেন সুজাতা ম্যাম কে --- এই পর্যন্তই তিতলি জানত ।       


            পরের ঘটনা ঘটেছে তিতলি যখন আমেরিকায় ছিল। স্বামী-স্ত্রী দুজনই যেহেতু চাকরি করেন, ছেলেকে ভালো ভাবে মানুষ করার ইচ্ছেতে পাহাড়ের একটা কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করে দেন সুজাতা ম্যাম। একমাত্র ছেলে--- প্রচন্ড আদুরে ।বাবা মা দুজনেই পালা করে প্রতিমাসে তাকে দেখতে যান ।তার যেন কোনোরকম অসুবিধা না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি তাঁদের। সেবার গরমের ছুটি পড়তেই সুজাতা ম্যাম ছুটলেন ছেলের কাছে । শিলিগুড়িতে পৌঁছে গিয়ে ফোন করেছিলেন ম্যাম।পাহাড়ের পথে যেতে যেতে জানিয়েছিলেন ধ্বস নেমেছে, সেখানে দুর্যোগ চলছে। তারপর থেকেই বন্ধ তাঁর ফোন। জিতেন বাবু খবর না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। কিছু সময় পর যদিও রাস্তা খুলে গেছে কিন্তু ফোনে আর স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন নি তিনি ।   


 


          পরদিনই তিনি রওনা হয়েছিলেন পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন হাদিস করতে পারেন নি সুজাতা ম্যামের। ছেলের হোস্টেলেও পৌঁছাননি তিনি ।থানা পুলিশ সব হলো কিন্তু সুজাতা ম্যামের কোন খবর পাওয়া গেল না। কলকাতায় ফিরে এসে জিতেন বাবু সেখানেও খোঁজাখুঁজি করলেন কিন্তু কোনো খবর পেলেন না। ছেলেকে প্রথমে কিছুই জানানো হয়নি । থানা পুলিশ আত্মীয়-স্বজন কেউ কোনো রকম খবর দিতে পারল না। উদভ্রান্তের মতন ছুটে বেড়ালেন জিতেন বাবু এদিক থেকে ওদিক। কোথা দিয়ে যেন দশ দিন কেটে গেল।


 


ঘটনার দিন সন্ধ্যায় পুলিশের কাছ থেকে একটা ফোন এলো-- ভিআইপি রোডে অচৈতন্য অবস্থায় একজন ভদ্রমহিলাকে কে বা কারা গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে গেছে জানিয়ে । পুলিশ তুলে নিয়ে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। তাঁর চেহারার সাথে সুজাতা ম্যামের নাকি মিল পাওয়া গেছে । জিতেন বাবু ছুটে গেলেন ।হাসপাতালের বিছানায় সারা শরীরে ক্ষত নিয়ে বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলেন সুজাতাকে । ডাক্তারবাবু বললেন অন্তত সাত দিন ধরে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছে তাঁর ওপর। গ্যাং রেপ। জিতেন বাবু ভেঙে পড়লেন। বোবা হয়ে বসে রইলেন বহুক্ষণ। চিকিৎসা চলতে থাকলো। তিন মাস কোমা তে থেকে সুজাতা ম্যাম এর হুশ ফিরল। তিনি বাড়ি এলেন জ্যান্ত লাশ হয়ে ।কাউকে চিনতেও পারেন না ।মাঝে মাঝে চিৎকার করেন। মুখের সামনে মিছিমিছি হাতটাকে ফোন বানিয়ে হ্যালো হ্যালো করতে থাকেন। যাকে সামনে পান চড় থাপ্পড় মারেন ।ইতিমধ্যে ছেলেকেও জানানো হয়েছে সবকিছু। তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে । পাহাড়ের স্কুল ছাড়িয়ে কলকাতাতেই ভর্তি করে দেয়া হয়েছে আবার। জিতেন বাবু ভাবলেন ---- ছেলেকে দেখে যদি একটু সুস্থ হয়ে ওঠে সুজাতা, কিন্তু হলো না । এক বছরে এ ভাবেই কাটল ।


ছেলেটাও মায়ের এই অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ল। সুজাতা ম্যাম ছেলেকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে শেকল টেনে দিয়ে একা একা ঘুরে বেড়ান রাস্তায় রাস্তায়। যখন খুশি ঘরে ফেরেন । কখনো কখনো ধরে আনতে হয় তাঁকে, বাইরে থেকে! দুর্বিষহ সে অবস্থা !


 


        এই ঘটনার আগে, সুজাতা ম্যামের একতলা বাড়িটা,দোতলা করার কাজ চলছিল। ছাদের ওপর আধা দেয়াল তোলা। পিলারের উপর আধা আধা রডগুলো বেরিয়ে আছে। ছাদে ছড়িয়ে আছে ইট, বালি, সিমেন্ট। প্রচন্ড রকম পরিপাটি এবং গোছানো ছিলেন সুজাতা ম্যাম। তাঁরই বাড়ির ছাদের অর্ধেক তোলা দেয়ালগুলোতে আগাছায় ভরে গেছে এখন। শ্যাওলা ধরা দেয়াল ফেটে গজিয়েছে বটের চারা-- তার শেকড় দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে শক্ত জালের মত। মাঝে মাঝেই সাপ খোপ দেখা যায়।তবে সেগুলো জিতেন বাবুর মতো বিষধর নয়। তারা মিলেমিশেই থাকে সুজাতা ম্যামের সঙ্গে ! জিতেন বাবুকে মানুষ যা ভাবত তিনি আদৌ সে রকম ছিলেন না ! দুঃসময়ে তাঁকে নতুন করে চিনেছিল সকলে।


মানুষের চরিত্র বোঝা বড়ই কঠিন।এই বিপদের সময়েই জিতেন বাবু বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এলেন নতুন বৌ।ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন হোস্টেলে।তিনিও নিজের বাড়ি ফেলে, পাড়া ছেড়ে অন্য জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিলেন,সুজাতা ম্যাম কে অসহায় অবস্থার মধ্যে একা ছেড়ে ।বাড়িতে কাজের লোক অবশ্য একটা রেখে দিলেন । সে-ই সুজাতা ম্যামের দেখাশুনা করত। জিতেন বাবু মাঝে মাঝে এসে খোঁজ খবর নিতেন কিছুদিন পরে সেটাও বন্ধ করে দিলেন..


 


বাড়িটাও আর কমপ্লিট করা হয়ে ওঠেনি। ঝকঝকে বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন।সামনের অত সূন্দর ফুল বাগানে একটাও ফুল নেই, শুধুই জঙ্গল। কোনদিন যে এ বাড়িতে মানুষ থাকত সেটা ভেবেই এখন বিস্মিত হয় মানুষ।


সুজাতা ম্যাম থাকেন বটে,তবে তিনি তো আর মানুষ নন---পাগলী ! অদ্ভুত ভাবে সমাজ সংসার থেকে কবে যেন তিনি ঝরে পড়েছেন। কেউ খোঁজ রাখে না তাঁর।


         সুজাতা ম্যাম এর মুখে অকাল বলিরেখা। খুব কাছের মানুষ তাকে দেখলে শুধু চিনবে তার ঐ গভীর দৃষ্টি দেখে। বাকিদের কাছে সে ভবঘুরের এক পাগলী! মাঝে মাঝে বাড়িতে ঢোকেন,না হলে এই বট তলাই তাঁর আস্তানা।


           টিনা আরও বলল,তার বাবা সেই সময়ে জিতেন বাবুর সঙ্গে হাসপাতালে দিনের পর দিন রাতের পর রাত থেকেছেন। জিতেন বাবুর চোখ ভরা ভালোবাসা নয়, ঘৃনা দেখেছেন তিনি। নিজের হাতটাও ভালোবেসে তিনি কখনও রাখেনি স্ত্রীর কপালে ।বাবাকে তিনি একবার বলেছিলেন, সুজাতা ম্যামকে ছোঁয়া তাঁর পক্ষে নাকি আর সম্ভব নয় ।বাবা অনেক বুঝিয়েছিল তাঁকে কিন্তু কিছুতেই পথে আনতে পারেন নি। ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন ভালোবাসা, পেলে আদর ,যত্ন আর চিকিৎসায় সেরে উঠবেন সুজাতা ম্যাম।যার ভালোবাসা পেলে হয়ত চিকিৎসারও প্রয়োজন হত না--- তার ভালোবাসা পাননি তিনি।


কাজেই ওষুধ পত্রে কোন কাজ হয়নি।




 ম্যামের বাবার বাড়ির দিকেও এমন কেউ ছিল না যে তাঁর দায়িত্ব নেবে। জিতেন বাবুর ঘৃণা আর অবহেলা সয়ে শুধু একফোঁটা ভালোবাসা আর যত্নের অভাবে শেষ হয়ে গেল একটা জীবন! পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলেন সুজাতা ম্যাম।


টিনার কথা শুনে থ হয়ে বসে রইল তিতলি ।


সে শুনেছিল বেশিরভাগ পুরুষই নাকি জন্মগতভাবে বহুগামী।সবকিছু জেনে-শুনেও তাদের নিয়েই ঘর করে অনেক মেয়েরা--- নিরুপায় হয়েই। যাতে ঘর ভেঙে না যায়, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে তাঁরা---


নিজের জীবনের জটিলতা ছেড়ে ভাবে সন্তান দের কথা‌।


শুধু মেয়েরাই কি ঘরলোভী ? তা নিশ্চয়ই নয়।অনেক পুরুষমানুষ ও আছেন যারা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সহ্য করেন স্ত্রীদের অনৈতিক কার্যকলাপ।


কিন্তু ধর্ষণের মত ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর উল্টে ধর্ষিতার প্রতিই যে সমস্ত পুরুষের মনে সহমর্মিতার বদলে ঘৃণার উদ্রেক হয় জিতেন বাবু সেই ধরনের অমানুষ পুরুষ ছিলেন।


তিতলি অবাক হয়ে ভাবছে এই ধরনের পুরুষদের কাছে সংসারের মানে কি? তাদের ভালোবাসা কি শুধু শরীর? একদিন যাকে ভালোবেসেই ঘরে এনেছিল, সেটা তবে কি ধরনের ভালোবাসা ছিল? কিছু দুর্বৃত্ত তার, যে ভালোবাসার মানুষকে পাশবিক অত্যাচারে এভাবে ক্ষত-বিক্ষত করল, তাতে মেয়েটির কি দোষ ছিল ? স্ত্রীর প্রতি তাঁর কোন মায়া জন্মালো না ! ঘৃণা জন্মালো? সে অশুচি হয়ে গেল?


তিতলি নিজের মনকেই প্রশ্ন করল--- যে মেয়েটা অমানুষিকভাবে নির্যাতিত হলো তার সেই মুহূর্তের ভয়ংকর অবস্থার কথা স্বামী নামক পুরুষটি ভাবলো না একবার ? সাত দিন ধরে একটা মেয়ে কিভাবে ওই কুকুর গুলোর অত্যাচার সহ্য করে বেঁচে ছিল সেটা ভেবে তার চোখে এক ফোঁটা জলও এলো না ? এই বুঝি ভালোবাসা?একটা পরিপূর্ণ সংসার টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে গেল, তার হৃদয়ে একটা আঁচড় না কেটেই ? ছেলেটার ভবিষ্যতের কথাও ভাবলো না আর !


        পুরুষের কাছে নারী শুধুই ভোগের বস্তু !জিতেন বাবুর হাতের স্পর্শে আবেগ থাকলে, ভালোবাসা থাকলে সুজাতা ম্যাম পাগল হয়ে যেতেন না। তাঁর দৃষ্টির গভীরতা দেখেছে,জিতেন বাবুর দূরে সরে যাওয়া । চার দেয়ালের ভেতর জিতেন বাবু কি আচরণ করতেন স্ত্রীর সঙ্গে সে কথা বাড়ির কাজের লোকেরাও বাইরে আলোচনা করত। দিনের পর দিন কাজের লোকেরাই তাঁকে খেতে দিত তাঁর সঙ্গে বসে একটা দুটো কথা বলার চেষ্টা করত।জিতেন বাবুকে ওই দুর্ঘটনার পরে কখনও তারা সুজাতা ম্যাম এর ধারে-কাছে যেতে দেখেন নি , গল্প করা তো দূরের কথা ! সে কথাও জানাল টিনা ।


তিতলি বুঝল ,বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পাননি সুজাতা ম্যাম।বাঁচার জন্য ভরসার একটা কাঁধ প্রয়োজন ছিল , ছিল শক্ত করে জড়িয়ে রাখার জন্য সবল দুটো বাহু। বিনা দোষে একটা জীবন শেষ হয়ে গেল! এই পৃথিবীর পুরুষ মানুষগুলো এতটাই স্বার্থপর? ছিঃ !


            তিতলি টিনাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছে। সুজাতা ম্যাম বড় প্রিয় ছিল তার ।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024