চন্দন গড় - দেবাংশু সরকার || Chandan Gar - Debanshu sarkar || Short story || ছোট গল্প || গল্প || অনুগল্প || Story || Bengali Story

                    চন্দন গড়

                             দেবাংশু সরকার


   

       পুরানো গাড়ীটা বিক্রী করে, নতুন গাড়ীটা কেনার পর তাপসের ইচ্ছা একটা লং ড্রাইভে যাওয়ার। তবে এবার বকখালি বা দীঘা নয়। সে ভাবছে এবার দুরে কোথাও যাবে। নিজের গাড়ী তাপস নিজেই চালায়। ড্রাইভিংয়ের হাতটা তাপসের বেশ ভালো। এক্সপ্রেস ওয়েতে তাপস সাবলীল ভাবেই গাড়ি চালাতে পারে। ঘন্টার পর ঘন্টা সে গাড়ী চালায় ক্লান্তিহীন, বিরক্তিহীন ভাবে।


      যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কয়েক দিনের মধ্যেই সে সস্ত্রীক বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাদের স্ত্রীরাও রয়েছে। তাপসের নতুন গাড়ীটা বেশ বড়, সাত আটজন অনায়াসে বসতে পারে। 


      এবার তাদের লক্ষ্য গোয়ালিয়র এবং সেইসঙ্গে ওরছা এবং খাজুরাহো। গোয়ালিয়র দুর্গ এবং আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা, তারপর আরো উত্তর দিকে যাওয়া। পথের মাঝে হয়তো দেখা যাবে নাম না জানা অখ্যাত কোনো দুর্গ বা রাজপ্রাসাদ।


      তাপসের সঙ্গে রয়েছে তার স্ত্রী ইরা। বাল্যবন্ধু রমেন, তার স্ত্রী শম্পা, আর এক বন্ধু বাপী, তার স্ত্রী সোমা। আরো একজন আছে তাদের সঙ্গে। অরূপ, তাপসের কলিগ।


      রমেন, বাপী, অরূপ তিনজনেই গাড়ী চালাতে পারে। কলকাতা থেকে দুরত্ব কম নয়। প্রায় বারোশো কিলোমিটারের পথ। তাপস যত ভালো, যত এনার্জেটিক ড্রাইভার হোক না কেন, এতটা রাস্তা তারপক্ষে একা গাড়ী চালানো সহজ নয়।.তাই সবাইকে পালা করে স্টিয়ারিং ধরতে হচ্ছে।


      লম্বা রাস্তা অতিক্রম করে তারা পৌছালো গোয়ালিয়র সহরে। শরীরে লম্বা জার্নির ক্লান্তি। তড়ি ঘড়ি একটা হোটেলে ঢুকে লম্বা ঘুম দিল সকলে। পরিকল্পনা মত পরের দিন বেশ সকালে গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। গোয়ালিয়র সহরটা একদিনেই ঘুরে দেখতে হবে। প্রধান আকর্ষণ গোয়ালিয়র দুর্গ।


      গোয়ালিয়র সহরটাকে দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এলো। আর দেরি করা যাবে না। এবারে লক্ষ্য ওরছা। অজানা পথে পাড়ি দিতে হবে। গাড়ীতে স্টার্ট দিল তাপস।


      অনেকটা পথ তারা পেরিয়ে এসেছে। আর কিছুটা গেলে পড়বে বিখ্যাত বা কুখ্যাত বেহড়ের রুক্ষ, শুষ্ক ভুমি। কাঁটা ঝোপে ভর্তি শক্ত পাথুরে লাল মাটির বেহড়। প্রাকৃতিক ক্ষয়ে কোথাও জন্মেছে টিলা, কোথাও আবার তৈরী হয়েছে ছোট খাদ।


      কিন্তু একি হলো! চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো তাপসের গাড়ী। কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না! গাড়ী মেরামতির প্রাথমিক পাঠটা তাপসের জানা। অন্ধকার রাস্তায় টর্চ জ্বেলে গাড়ী পরীক্ষা করলো সে। কিন্তু না কোথাও কোনো গড়বড় নেই। অথচ গাড়ী কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না! মনে হচ্ছে ইঞ্জিন ডেড হয়ে গেছে! কোথায় এসেছে তারা, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। অজ্ঞাত কারণে কারো ফোনে লোকেশন দেখাচ্ছে না! এখন কি করবে তারা? পথের ধারে গাড়ীতে বসে কি রাত কাটাবে? অপেক্ষা করবে কখন সকাল হবে!


      ভরা আষাঢ়। কলকাতাকে এখন ভাসিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। কিন্তু গোয়ালিয়রের আসে পাশে গত দুসপ্তাহ কোনো বৃষ্টি নেই। আজ হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। বৃষ্টি নামলো সঙ্গে বিদ্যুতের চমকানি। বিদ্যুতের আলোতে তাপসরা দেখতে পেল কিছু দুরে পাহাড় প্রমাণ বিশাল বড় একটা বাড়ি। বাড়িটাকে দেখতে পেয়ে যেন ধড়ে প্রাণ এলো তাপসদের। অতবড় বাড়িটা কি রাজ প্রাসাদ? নাকি কোনো প্রাচীন দুর্গ? নাকি হোটেল? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! তবে একটা আশ্রয় পাওয়া গেল। বৃষ্টি এতক্ষণে থেমে গেছে। টর্চের আলোতে রাস্তা দেখতে দেখতে তারা এগিয়ে চললো বাড়িটার দিকে। যত তারা কাছে আসছে তত যেন বিশালাকার ধারণ করছে বাড়িটা! খুব কাছে এসে তারা বুঝতে পারলো এটা কোনো রাজ প্রাসাদ নয়, কোনো হোটেল নয়, এটা একটা সুবিশাল, সুউচ্চ প্রাচীন দুর্গ। টর্চ হাতে সবার আগে চলেছে অরূপ। পঁচিশ বছরের অবিবাহিত যুবক অরূপ, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। মনে ভয় ডর বলে কিছু নেই। পথের ধারে কয়েকটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কুকুরগুলো অরূপদের দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ অজানা অচেনা এতজন মানুষকে দেখেও চিৎকার করছে না! বেশ অবাক হয় অরূপরা।


      দুর্গের মুল ফটকের কাছে এসে গেছে তারা। খোলা ফটকের সামনে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনের পোযাকটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের! গাঢ় লাল রঙের, কিছুটা চাপকান, কিছুটা পাঞ্জাবির মত। কোমরে কোমরবন্ধ। সঙ্গে সাদা ধুতি। মাথায় লাল রঙের এক ঢাউস পাগড়ি। পায়ে নাগরা। সবার আগে আছে অরূপ, লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বললো, "প্রণাম মহারাজ। পদার্পণ করুন।"


      বাপি অবাক হয়ে ফিসফিস করে তাপসকে প্রশ্ন করে, "কি ব্যাপার বলতো, লোকটা অরূপকে মহারাজ বলছে কেন?"


       - "মনে হয় দুর্গের মধ্যে হোটেলের ব্যাবসা চলে। হয়তো এভাবেই ওরা গেষ্টদের আপ্যায়ণ করে।"


      এরমধ্যে অরূপ বেশ জমিয়ে নিয়েছে পাগড়ি পরা লোকটার সঙ্গে। সে পাগড়ি পরা লোকটাকে বলছে - "সারাদিন ঘুরে আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি মহারাজ। আমাদের একটু থাকার জায়গা দিন। একতলায় ঘর খালি আছে?"


      - "আপনি আমাকে মহারাজ বলছেন হুজুর! আমার নাম শের সিং। আমিতো আপনার সেবক। আপনার দুর্গ, আপনি যেখানে ইচ্ছা থাকবেন। হুকুম করুন মহারাজ।"


      - "আগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি, তারপর রেজিস্ট্রারে সই হবে।"


      শের সিং অবশ্য ততক্ষণে হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছে, "যোগীন্দার মহারাজের জন্য খাবার নিয়ে এসো। ঠান্ডা সরবত নিয়ে এসো। ভজ্জু জলদি পাংখা নিয়ে এসো।"


      রাজকীয় আপ্যায়ণ পেল অরূপরা।


      আবার শের সিং অরূপকে বললো, "মহারাজের জন্য খাস মহল অপেক্ষা করছে।"


      - "আজ আর পারছি না শের সিং। আজ রাতে আমরা এই ঘরে থাকবো। কি বড় ঘর! কুড়ি পঁচিশ জন এক সঙ্গে থাকতে পারবে, আমরাতো মাত্র সাতজন।"


      বাপী আবার ফিসফিস করে তাপসকে বললো, "পরিবেশটা গোলমেলে মনে হচ্ছে। সবাই একঘরে থাকাই ভালো।"


      তাপস মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।


      আবার বাপীর প্রশ্ন, "খাস মহলটা কি বলতো?"


      - "মনে হচ্ছে কষ্টলি রুম। হয়তো ডিলাক্স রুম। মনে হয় ধান্দা করছে আমাদের ঢোকানোর। সকালে বড়সড় বিল ধরাবে।"


      খাওয়া দাওয়া সেরে দরজা বন্ধ করে, আলাদা করে পেতে দেওয়া বিছানায় শুয়ে পড়লো তাপসরা।


      মধ্যরাত, মৃদু সারেঙ্গীর সুর ভেসে আসছে! আসছে তবলার সঙ্গতের শব্দ। ভেসে আসছে সুরেলা কন্ঠের ঠুমরি। কে গান গাইছে এতো রাতে? কে সঙ্গত করছে? ঘুম ভেঙে যায় সকলের। কেবল অরূপ অঘোরে ঘুমোচ্ছে।


      একটা প্রাচীন দুর্গের অলিন্দে অলিন্দে অনেক রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে। ঘটতে পারে অনেক অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য ঘটনা। এত কাছে এসেও, সেই রহস্যের, সেই রোমাঞ্চের স্বাদ না নিয়ে কি ফেরা যায়? তাছাড়া কৌতুহল, অপার কৌতুহল জেগে উঠেছে তাপসদের মনে। এতক্ষণতো শুনশান ছিল। মনে হচ্ছিল জনমানবহীন এক শূণ্যপুরী। মাঝে মাঝে শের সিংদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল। সেটাও আর নেই।


      বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো তাপসরা। বিরাট বড় দরজাটা খুললো। প্রবেশ করলো দুর্গের আরো ভেতরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে উঠলো বাপীর হাতে ধরা টর্চ। চওড়া দালানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে অগুন্তি ঘর। তার উল্টো দিকে দালানের ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি থাম। বেশ কিছুটা এগোনোর পর বাপীরা একটা সিঁড়ি দেখতে পেল। পায়ে পায়ে তারা উঠতে লাগলো উপরের দিকে। উঠে পড়লো দোতলায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার, বাপীর হাতের টর্চ জ্বলছে না। সম্ভবত ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে, অথবা...।


       পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে ছজনে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বারে বারে হোঁচট খাচ্ছে। ইরা একবার ফিরে যাওয়ার কথা বলে। সোমা, শম্পা দুজনেই তাকে বাধা দেয়। সোমা, শম্পা দুজনেই এই ভয় মেশানো রোমাঞ্চটাকে উপভোগ করছে। ভেসে আসা গান আর শোনা যাচ্ছে না।


      অজানা অন্ধকার পথে চলতে চলতে আচমকাই রমেনের মাথা বেশ জোরে ঠুকে যায় একটা থামে। অনেকটা কেটে যায়। টপ টপ করে রক্ত পড়তে থাকে। দু এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ার পর যেন কেঁপে ওঠে দুর্গটা। শোনা যেতে থাকে পায়ের শব্দ। এক নয়, দুই নয় শত শত পায়ের শব্দ। যেন কারা দুর থেকে এগিয়ে আসছে রমেনদের দিকে। অন্ধকারের মধ্যে পিছু হটতে থাকে রমেনরা। বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে পদশব্দ। মনে হচ্ছে অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। কারা এগিয়ে আসছে? মানুষ? নাকি প্রেত? অশরীরীদের পদশব্দ কি শুনতে পাওয়া যায়? জানা নেই তাপসদের।


      অন্ধকারের মধ্যেই তাদের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে তাপসরা। এগিয়ে আসছে অসংখ্য অবয়ব। রক্ত জবার মত রক্ত বর্ণ এবং বিস্ফারিত তাদের চোখ। কাঠিণ্যে ভরা মুখ। কারো জিব কিছুটা বেরিয়ে আছে মুখ থেকে। অধিকাংশের গলায় গভীর ক্ষতচিহ্ন।


      পিছু হটতে থাকে তাপসরা। ক্রমশ পিছু হটতে থাকে। কারণ তারা যে এগিয়ে আসছে। ক্রমশ এগিয়ে আসছে। পিছু হটতে হটতে এক সময়ে ছুটতে শুরু করে তাপসরা। কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। অন্ধের মত ছুটে চলেছে। বারে বারে হোঁচট খাচ্ছে, ছিটকে পড়ছে, আঘাত পাচ্ছে, উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটছে। ছুটতে ছুটতে অনেকটা দুরে চলে এসেছে। নিচে নামার সিঁড়িটা ঠিক কোন দিকে কেউ বুঝতে পারছে না! ছুটতে ছুটতে ওদের থেকে অনেক দুরে চলে এসেছে তাপসরা। কিন্তু একি!


      আবার অন্য দিক থেকে আসছে পদশব্দ! তবে কি তাপসদের ঘিরে ফেলছে অজানা শত্রুরা? দুদিক থেকে পায়ের শব্দ আসছে। ভয়ে আতঙ্কে নির্বাক হয়ে গেছে তাপসরা। তারা বুঝতে পারছে না এবার কি করবে? কোন দিকে যাবে? আবার ভাবছে কি চায় এই অশরীরীরা? তাদের সঙ্গেতো তাপসদের কোনো শত্রুতা নেই। তাহলে তারা কেন তাপসদের ক্ষতি করতে চাইছে? নাকি অন্য কোনো বার্তা দিতে চাইছে?


      - "বাবুজী আপনারা উপরে উঠে এসেছেন! মহারাজ কোথায়?" শের সিংয়ের গলা পেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো ছয়জনের।


      রমেন প্রশ্ন করলো - "মহারাজ কে?"


      - "মহারাজ দামোদর সিং।"


     তাপসদের মনে পড়ে শের সিং অরূপকে প্রথম থেকেই 'মহারাজ' বলে ডাকছে। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে অরূপ যে তাদের সঙ্গে নেই সেটা শের সিং বুঝতে পারলো কি করে সেটা তাপসদের বোধগম্য হচ্ছে না! অবশ্য অনেক অস্বাভাবিক ঘটনাই ঘটে চলেছে, যেগুলো তাপসদের ধারনার বাইরে! 


      কিছুটা আন্দাজ করে তাপস বললো, "মহারাজতো ঘুমোচ্ছে।"


     - "আবার রক্ত দেখে রাণী মেঘনা, রাণী যমুনার সেনারা জেগে উঠেছে। পরস্পরের দিকে এগোতে শুরু করেছে। একমাত্র মহারাজ দামোদর সিংয়ের বর্শা ওদের থামাতে পারে। আপনারা সরে আসুন। এই কক্ষের মধ্যে আশ্রয় নিন। এখানে আপনারা সম্পুর্ন নিরাপদ।" তাপসদের একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে শের সিং, "মহারাজ মহারাজ" বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়তে লাগলো।


পরদিন সকালে সূর্যের আলো মুখে পড়তে ঘুম ভাঙলো সাতজনোর। কোথায় দুর্গ? কোথায় শের সিং? আর কোথায় রাণী মেঘনা, রাণী যমুনার সেনাদল? মাটিতে শুয়ে আছে সাতজন। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে স্থানীয় মানুষজন। কিছুদুরে দাঁড়িয়ে আছে তাপসের গাড়ীটা।


      তাপসের মুখে সব কথা শুনে চোখ কপালে ওঠে স্থানীয় বাসিন্দাদের। অবাক বিস্ময়ে তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, "তারমানে আপনারা চন্দন গড়ে রাত কাটিয়েছেন!"


      - "চন্দন গড়?' পাল্টা প্রশ্ন করে বাপী।


      - "হ্যাঁ বাবু মশাই এ এক রহস্যময় দুর্গ। সাতশো বছর আগে এই দুর্গ ধ্বংস হয়ে গেছে। পুরোপুরি মাটিতে মিশে গেছে। তবে কখনো কখনো রাতে জেগে ওঠে। ঐ রাতে কোনো মানুষ চন্দন গড়ে ঢুকলে আর বেঁচে ফেরে না। আপনারা কি করে বেঁচে আছেন ভেবে অবাক হচ্ছি!" বললো একজন স্থানীয় মানুষ।


     - "শের সিং নামের একজন আমাদের খুব সাহায্য করেছে।" বাপী আবার বলতে থাকে, "আমরা ভেবেছিলাম পুরানো দুর্গের ভেতর এখন হোটেল ব্যবসা চলছে। শাহী পোষাক পরা শের সিংকে আমরা হোটেলের রিসেপশনিষ্ট ভেবেছিলাম। তবে লোকটা অরূপকে বারে বারে 'মহারাজ' বলে ডাকছিল। পরে একবার বলেছিল 'মহারাজ দামোদর সিং'।"


      - "দামোদর সিং! প্রবল প্রতাপশালী মহারাজ দামোদর সিং!" বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় স্থানীয় মানুষজন।


      স্থানীয়দের মধ্যে একজন বললো, "এটা কি করে সম্ভব! মহারাজ দামোদর সিংয়ের একটা তসবির গোয়ালিয়র মিউজিয়ামে আছে। আমি দেখেছি।" অরূপের দিকে আঙুল দেখিয়ে সে বললো, "এই বাবুজীকে অবিকল দামোদর সিংয়ের মত দেখতে! দুই যুগের দূই মানুষের মধ্যে এত মিল!"  


      - "তার মানে এই বাবুজীর জন্যই আপনারা এখনও বেঁচে আছেন!" বললো আর একজন।


                              দুই 


      মালব মালভুমি, রেওয়া মালভুমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে মহারাজ কুন্দন সিংয়ের রাজত্ব। অত্যন্ত শক্তিশালী এবং রণ কুশলী মহারাজ কুন্দন সিং। পরিস্থিতি তাকে এমন রণ কুশলী করে তুলেছে। রাজ্যের তিন দিক থেকে ধেয়ে আসা বহিঃশত্রুর আক্রমণ সামলাতে সামলাতে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়েন কুন্দন সিং। কখনো দাক্ষিনাত্য থেকে ধেয়ে আসে বারগিররা। কখনো হামলা চালায় বেহড়ের লুঠেরারা। কখনো আবার উত্তর থেকে আসে ম্লেচ্ছরা। তবে প্রতিবেশী পারমার, চান্দেলা বা কলচুরিদেব সঙ্গে বেশ মৈত্রীর সম্পর্ক কুন্দন সিংয়ের। পারমার, চান্দেলারা নিয়মিত নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে জড়িয়ে থাকে। কলচুরিরাও মাঝে মাঝে ঝামেলায় জড়ায়। কিন্তু কুন্দন সিংকে কেউ ঘাঁটায় না। তবে বহিঃশত্রুদের প্রতিরোধ করতে নিয়মিত অস্ত্র ধরতে হয় কুন্দন সিংকে। অহরহ লড়াই করতে করতে কুন্দন সিংয়ের ক্লান্ত শরীর আর তলোয়ার ধরতে চায় না। চায় বিশ্রাম। কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ নেই! দক্ষিণ থেকে উত্তর তাকে ছুটে বেড়াতে হয়। রাতের পর রাত কেটে যায় ঘোড়ার পিঠে।


      শিব ভক্ত কুন্দন সিংয়ের রাজত্বের মধ্যেই রয়েছে এক বহু বছরের পুরাতন শিব মন্দির। বড় অদ্ভুত, বড় রহস্যময়, বড় জাগ্রত সেই মন্দিরের অধিষ্ঠিত দেবতা। বিরাট বড় এক শিব লিঙ্গ রয়েছে সেই মন্দিরে। হাজার বছরের পুরাতন সেই মন্দিরের বিগ্রহ থেকে সদা নির্গত হয় চন্দনের সুগন্ধ। কেউ কোনোদিন কাউকে সেই শিব লিঙ্গে চন্দনের প্রলেপ লাগাতে দেখেনি। অথচ তার উপরে রয়েছে চন্দনের গাঢ় প্রলেপ। দীর্ঘ দিন ধরে শিব লিঙ্গের উপর হাজার হাজার কলস দুধ ঢালার পরেও সেই প্রলেপ অটুট রয়েছে! একটুও ধুয়ে যায় নি! এবং ছড়িয়ে চলেছে চন্দনের সুবাস। হয়তো সেই জন্যই এই শিব লিঙ্গের নাম চন্দনেশ্বর।


      মহারাজ কুন্দন সিং নিয়মিত চন্দনেশ্বরের মন্দিরে যান। আরাধনা করেন। পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখারীদের দান করেন। একরাতে মহারাজ স্বপ্নে দেখলেন এক জটাজুটধারী বিশালদেহী পুরুষ ত্রিশূল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বলছেন, "কেবল এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত তলোয়ার হাতে দৌড়ে বেড়ালে রাজ্য রক্ষা হবে না। নিজ রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য অবিলম্বে এক দুর্গ তৈরি কর। আমার এই অমোঘ ত্রিশূল তোকে দিলাম। এই ত্রিশূল অস্ত্রাগারে রেখে দেওয়ার জন্য নয়। সব সময়ে এই ত্রিশূল সঙ্গে রাখবি। এই ত্রিশূল তোর রাজ্যকে রক্ষা করবে। তবে তোর কোনো বংশধর, এই ত্রিশূল দিয়ে তোর রাজ্য, তোর দুর্গকে ধ্বংস করবে।"


      পরের দিন ভোরেই মহারাজ কুন্দন সিং পুজো দিতে গেলেন চন্দনেশ্বর মন্দিরে। মন্দিরের চত্বরেই পেলেন ঐশ্বরিক ত্রিশূলকে। নিজ হস্তে নয়, নিজ শরীরে ধারণ করলেন অমোঘ অস্ত্রকে। কুন্দন সিংয়ের শরীরে অবস্থান করতে লাগলো ত্রিশূল। প্রয়োজনের সময়ে, যুদ্ধের সময়ে ত্রিশূলের অমোঘ শক্তি সংকর্ষিত হতে থাকে কুন্দন সিংয়ের হাতে ধরা বর্শাতে। যুদ্ধের সময়ে কুন্দন সিংয়ের নিক্ষেপ করা বর্শা শত্রু পক্ষের হাজার হাজার সেনাকে ধ্বংস করে আবার তার কাছে ফিরে আসে।


      বেশ কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় কুন্দন সিং গড়ে তোলেন এক বিশালাকার দুর্গ। প্রায় সম্পূর্ণ রাজধানীটাই ঢুকে যায় দুর্গের মধ্যে। কুন্দন সিংয়ের আরাধ্য দেবতা চন্দনেশ্বরের নামানুসারে দুর্গের নামকরণ হয় চন্দন গড়। দীর্ঘ দিন রাজত্ব করার পর কুন্দন সিং তার রাজত্ব এবং ত্রিশূলকে পুত্র শক্তি সিংয়ের হাতে অর্পণ করে, রাজ্যভার হতে অব্যাহতি নেন। মহারাজ শক্তি সিং তার বাবার মত পরাক্রমী যোদ্ধা হলেও, যুদ্ধ বিগ্রহ করে অন্য রাজ্য জয় করার বাসনা তার নেই। প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করাতেই তার আগ্রহ বেশি। মহারাজ শক্তি সিংও দীর্ঘদিন রাজত্ব করার পর তার পুত্র দামোদর সিং সিংহাসনে বসেন।


      ছেলে দামোদরকে নিজের মত করে গড়ে তুলেছেন শক্তি সিং। দামোদর যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হলেও, মিত্রতা, সখ্যতাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দামোদর দুর্গের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চান না। মাঝে মাঝেই ঘোড়ার পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়েন। তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতে চান। প্রজাদের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। আবার কখনো চলে যান দুর দুরান্তরে। রুক্ষ ধুসর কাঁটা ঝোপে ভরা পথ ধরে ছুটতে থাকে ঘোড়া। নিজ রাজ্যের সীমা পেরিয়ে পৌছে যান দুর দেশে।


      এমনই এক দিন ঘোড়ায় চেপে ছুটে চলেছেন দামোদর। আচমকাই পথ আটকে দাঁড়ায় একদল সেনা। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা, মাথায় কালো পাগড়ি পরা সেনারা কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দামোদরের উপর। কুশলী যোদ্ধা দামোদরের তলোয়ারের আঘাতে সেনাদের হাত থেকে খসে পড়ে অস্ত্র। দামোদরের তলোয়ারের ঘায়ে উড়ে যায় এক সেনার পাগড়ি। হাওয়ায় উড়তে থাকে লম্বা চুল। শারীরিক গঠন এবং অপটু তলোয়ার চালনা দেখে দামোদর আগেই বুঝে গিয়েছিলেন যে এরা কেউ পুরুষ নয়। এরা সকলেই নারী। তাই খুব সাবধানে তলোয়ার চালনা করছিলেন।


      হাওয়ায় উড়তে থাকা লম্বা চুল দেখে দামোদর হাসতে হাসতে বললেন, "কি দরকার লড়াই করার। চোট আঘাত লাগতে পারে। ব্যাথা যন্ত্রণা হতে পারে। তখন আবার কান্নাকাটি শুরু হবে!"


      - "এই বিদেশী, কি বলতে চাইছো? আমরা দুর্বল? আমরা আঘাত লাগলে কান্নাকাটি করি? মানে আমরা ছিঁচকাদুনে?" প্রশ্ন করেন পাগড়িহীন এলোকেশী।


      - "না না, সেকথা নয়। আমি বলছি শত্রুতা ছেড়ে আমরা যদি সখ্যতা করি, মন্দ কি?"


      - "মহাশয়ের নিবাস কোথায় জানতে পারি?" আবার প্রশ্ন এলোকেশীর।


     - "আজ্ঞে, মহারাজ শক্তি সিংয়ের রাজ্যে আমার বাস।"


      - "মহারাজ শক্তি সিং! শুনেছি খুব ভালো মানুষ। যুদ্ধ বিগ্রহ একদম পছন্দ করেন না। প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর প্রতি কত ভালোবাসা তার মনে। তুমিও দেখছি তোমার রাজার মত। লড়াই ঝগড়া পছন্দ করো না। তোমার সঙ্গে সখ্যতা করা যেতে পারে।"


      - "না না, মহারাজের সঙ্গে আমার কোনো তুলনা চলে না। আমি খুব সাধারণ মানুষ। দেওয়ার মত তেমন কোনও পরিচয় আমার নেই। দেবীজীর পরিচয় কি জানতে পারি?"


      এলোকেশী বাকরুদ্ধ অবস্থায় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কন্দর্পকান্তি দামোদরের দিকে। হয়তো শুনতেই পাচ্ছেন না দামোদর কি বলছেন! তার এক সহচরী উত্তর দিলেন, "ইনি চান্দেলা রাজকন্যা মেঘনা।"


      রাজকুমার দামোদরও তখন উত্তর শোনার অবস্থায় ছিলেন না। তারও চোখ নিবদ্ধ ছিল রাজকন্যার চোখে। একেই কি বলে প্রথম দর্শনে প্রেম? ফিরে আসার আগে রাজকন্যাকে নিজের পরিচয় দিলেন রাজকুমার দামোদর। দামোদর, মহারাজ শক্তি সিংয়ের ছেলে শুনে রাজকন্যা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।


      নিয়মিত দেখা হতে থাকে। কখনো তারা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যান বেতোয়া নদীর তীরে। কখনো আবার লাল মাটির ধুলো উড়িয়ে চলে যান বেহড়ের দিকে। নাম না জানা কোনো টিলায় বসে চলে মন দেওয়া নেওয়া।


      মহারাজ শক্তি সিং ভাবছেন রাজকুমার দামোদরের উনিশ বছর বয়স হলো। এবার বিয়ে দেওয়ার দরকার। মালব রাজ্যের, পারমার বংশীয়, পরমা সুন্দরী রাজকন্যা যমুনার সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। অনিচ্ছা সত্বেও, কেবল রাজ আজ্ঞা পালনের জন্য বিয়ে করতে বাধ্য হন দামোদর। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে বুন্দেলখন্ডের চান্দেল বংশীয় রাজকন্যা মেঘনার কাছে। কিছুদিনের মধ্যেই দামোদর বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসেন মেঘনাকে।


      মালবের পারমারদের সঙ্গে বুন্দেলখন্ডের চান্দেলাদের সর্বদা লড়াই লেগে থাকে। চরম শত্রুতা দুই রাজ্যের মধ্যে। মহারাজ শক্তি সিংয়ের মধ্যস্থতায় প্রকাশ্যে হানাহানি কিছুটা কমলেও, চোরা গোপ্তা হামলা দুদিক থেকেই চলছে।


      দুই চরম শত্রু রাজ বংশের দুই রাজকন্যা একই রাজ প্রাসাদে! যার পরিনতি খুব ভালো বা খুব খারাপ দুই হতে পারে। শক্তি সিংয়ের সতর্ক নজর দুই রাজ কন্যার উপর।

 

      দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। শক্তি সিংয়ের ঐশ্বরিক শক্তি এবং সিংহাসন যায় মহারাজ দামোদর সিংয়ের অধীনে। ক্ষমতা বাড়ে রাণী যমুনা এবং রাণী মেঘনার। একেতো বড় রাণী, সম্মান অনেক বেশি। সেই সঙ্গে জাতশত্রু পারমার বংশজাত কন্যা। রাণী মেঘনা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না রাণী যমুনাকে। যতদিন শক্তি সিং রাজা ছিলেন ততদিন মেঘনা চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু শক্তি সিং সিংহাসন ত্যাগ করার পর রাণী মেঘনা চেষ্টা করতে থাকেন রাণী যমুনার ক্ষতি করার। বুন্দেলখন্ড থেকে আসা দাসী এবং অন্যান্য অনুচরদের সঙ্গে চক্রান্তের জাল বুনতে থাকেন রাণী মেঘনা। কিন্তু রাণী যমুনা যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রাখেন রাণী মেঘনার থেকে। নিজের মহল থেকে খুব একটা বের হন না সঙ্গীত প্রিয় রাণী যমুনা। তার মহলের এক কক্ষে গানের আসরের ব্যবস্থা করা রয়েছে। সেই কক্ষ থেকে কখনো ভেসে আসে ঠুমরি। কখনো আবার সরোদ সারেঙ্গীর যুগলবন্দি। ফলে রাণী যমুনার ক্ষতি করার কোনো সুযোগ পান না রাণী মেঘনা।


      রনথম্ভোর, ঝালর, মালব, হিলসা, উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়র এবং বিহার, উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করে দিল্লী ফিরে গেছেন ইলতুতমিস। কেবল চান্দেলাদের সঙ্গে লড়াইতে জিততে পারেন নি। হারতে হয়েছে বুন্দেলখন্ডের শক্তিশালী চান্দেলাদের কাছে। ফিরে যাওয়ার আগে জয় করা কোনো কোনো অঞ্চলের শাসনভার দিয়ে গেছেন তার অন্যতম সেনাপতি শওকতের হাতে। বিচক্ষন শওকত অবশ্য বরাবর চান্দেলাদের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। মেঘনার সঙ্গেও শওকতের বেশ ভালো আলাপ পরিচয় আছে।


      সখি, পরিচারিকা, অনুচরদের সঙ্গে যুক্তি করে এক মারাত্মক, প্রাণঘাতী, পরিকল্পনা করলেন রাণী মেঘনা। পরিকল্পনা সফল করার জন্য মহারাজকে কিছু দিনের জন্য দুর্গ থেকে দুরে রাখতে হবে। সেজন্য চান্দেলাদের সাহায্য প্রয়োজন। দুত পাঠালেন বুন্দেলখন্ডে। নিজে গোপনে দেখা করলেন শওকতের সঙ্গে। কথায় কথায় রাণী যমুনার রূপের বর্ননা করলেন শওকতের কাছে। বেশ বাড়িয়ে, রং চড়িয়ে রাণী যমুনার রূপের বর্ননা করলেন। রাণী যমুনার রূপের বর্ননা শুনে কামুক শওকত কামাতুর হয়ে ওঠে।


      বুন্দেলখন্ড সামিল হলো এই চক্রান্তে। বেহড়ের লুঠেরাদের ছদ্মবেশে দামোদর সিংয়ের রাজত্বের সীমান্তে হানা দিতে শুরু করলো চান্দেল রাজ্যের সেনারা। বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে, জমির ফসল লুঠ করে, গনহত্যা চালিয়ে অস্থির করে তোলে সীমান্তের জনগনকে।


      সীমান্তের অস্থিরতা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন মহারাজ দামোদর। হাতে তুলে নেন অস্ত্র। সেনা নিয়ে কুচ করেন। একই সঙ্গে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চেপে রাণী মেঘনার দুত যায় শওকতের কাছে। তৈরি ছিল শওকত। সে বেশ কিছু বাছাই করা অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ছুটে এলো অরক্ষিত চন্দনগড়ে। উদ্দেশ্য রূপবতী রাণী যমুনাকে দখল করা।


      দুর্গের খোলা দরজা দিয়ে বিনা বাধায় শওকত ঢুকে পড়ে অরক্ষিত দুর্গে। এগোতে থাকে রাণী যমুনার মহলের দিকে। রাণী যমুনার মহলে তখন বসেছে গানের আসর। ভেসে আসছে ঠুমরির সুর। সঙ্গে তবলা, সারেঙ্গীর সঙ্গত। সামান্য কিছু সেনা উপস্থিত রয়েছে দুর্গে। তারা অর্ধেক রাণী যমুনার অধীনে, অর্ধেক রাণী মেঘনার অধীনে। রাণী যমুনার অধীনে থাকা সেনারা প্রাণপণে শওকতের সেনাদের আটকানোর চেষ্টা করলেও, রাণী মেঘনার অধীনে থাকা সেনারা লড়াই থেকে বিরত থাকে। এক অসম লড়াই হচ্ছে। হতাহত, ছত্রভঙ্গ হচ্ছে লড়তে থাকা রাণী যমুনার সেনারা। প্রায় রাণী যমুনার মহলের কাছে এসে গেছে শওকত। পরাজয় অবসম্ভাবী। আর বাঁচা সম্ভব নয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন রাণী যমুনা। যেটা রাজপুতানীরা নিজেদের সম্মান বাঁচাতে নিয়ে থাকেন। কলুষিত হওয়ার আগে অগ্নি সমাধি নিলেন। জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিজের শরীরটাকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেললেন। খবর পেয়ে উন্মত্ত শওকত তার সেনাদের মুখ ঘোরায় রাণী মেঘনার মহলের দিকে। আজ রাতে তার কোনো না কোনো রাণীকে চাই সজ্জা সঙ্গিনী হিসেবে। প্রতিরোধে বিরত থাকা সৈন্যরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই ধর্ষিতা এবং খুব হলেন রাণী মেঘনা।


      রাণী যমুনার মহলের বেঁচে থাকা কিছু আহত সেনা নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে পাল্টা হামলার জন্য প্রস্তুত হলো। এবার তাদের লক্ষ্য শওকত নয়। কারণ মহারাজ দামোদর সিং ফিরে আসছেন শুনে অনেক আগেই শওকত দুর্গ ছেড়ে চলে গেছে। রাণী যমুনার সেনাদের লক্ষ্য দুর্গের মধ্যে থাকা বিশ্বাস ঘাতক, বেইমান সেনারা। যারা রাণী মেঘনার অঙ্গুলী হেলনে শওকতের সঙ্গে লড়াই থেকে বিরত ছিল। রাণী মেঘনার সেনারাও অস্ত্র হাতে মুখোমুখি হলো রাণী যমুনার সেনাদের। একই দুর্গের মধ্যে একই রাজার অধীনে থাকা সৈন্যরা দুভাগে ভাগ হয়ে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চলেছে!


      বহিঃশত্রুদের বিতাড়িত করে ফিরে আসছেন মহারাজ দামোদর সিং। মাঝ পথে ভগ্নদুতের মুখে দুর্গের দুরাবস্থার খবর পেলেন। রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে হাতে তুলে নিলেন ঐশ্বরিক বর্শাকে। নিক্ষেপ করলেন দুর্গ লক্ষ্য করে। অমোঘ শক্তির অধিকারী ঐ বর্শা নিমেষের মধ্যে ধ্বংস করে দিল দুর্গকে। সব কিছু হারানোর শোকে ঘোড়ার পিঠেই প্রাণ ত্যাগ করলেন মহারাজ দামোদর সিং।


      তারপর কেটে গেছে কত শত বছর। ধ্বংস হয়েও পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি চন্দন গড়। মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে জেগে ওঠে। শোনা যায় সারেঙ্গীর সুর, তবলার ঠেকা, সুরেলা কন্ঠের ঠুমরি।


      ভুমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়ালো তাপস। এগিয়ে গেল তার গাড়ীর দিকে। ড্রাইভিং সীটে বসে চাবি লাগালো। কি আশ্চর্য প্রথম চেষ্টাতেই গাড়ির ইঞ্জিন পর্জন করতে লাগলো!



                         

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024