উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -3
প্রেমাংশু ধীরে ধীরে কাছে এসে দাদুর বক্তব্য জানলেন! ঠাকুর্দার ইচ্ছে, ভুলবশতঃ হোক আর অন্য কোন কারনেই হোক বাগদীর মেয়ের যখন সর্বনাশ করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। তবে শুধু আমার স্বার্থের জন্য নয় বাবা গ্রামবাসীদের কথা চিন্তা করে আমার অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে বাবা।
প্রেমাংশু বললেন, বলুন আপনার কি অনুরোধ রাখতে হবে।
পুষ্পকে কোন নার্সিংহোমে ভর্তি করে তার গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করলে কোন ক্ষতি হবে না। তারপর পুষ্পর বিয়ের ব্যাপারে যত টাকা খরচ হবে আমি যতীনকে দেব।
প্রেমাংশু বলল, ছিঃ বাবা, নব আগত একজন অতিথিকে কোন মতে বিনাশ করতে পারব না। এজন্য যদি আমাকে গৃহত্যাগ করতে হয় আমি রাজী।
ঠাকুর্দা প্রেমাংশুকে দ্বিতীয়বার বুঝিয়ে বলার জন্য মুখ ফাঁক করতেই মেজকাকা কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন, প্রেমাংশু তুমি একজন সদ্বংশের সন্তান হয়ে শেষ পর্যন্ত একটা বাগদীর মেয়েকে উৎকৃষ্ট বলে মনে করলে? তোমার লজ্জা নেই বলে এখানে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। এই মুহুর্তে বাবার কাছ হতে দূরে সরে যাও। মনে রাখবে চিরদিনের জন্য তোমার এই দরজা বন্ধ। কোনদিন এখানে পা দেবে না।
মেজকাকার রাগন্বিত ভাব দেখে শান্তস্বরে বলেছিলেন ঠাকুর্দা, প্রেমাংশু তোমার ছোট ভাই , হয়তো কোন রূপ ভুল করেছে, ঠাকুর্দার কথা লুফে নিয়ে আরো ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন মেজকাকা , ওকে ক্ষমা করতে বলছেন এইতো? না বাবা না, এ ক্ষমার অযোগ্য। আমাদের বংশের মান - মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে হলে ওকে গৃহত্যাগ করতেই হবে। এ আমার শেষ কথা।
ঠাকুর্দার কথা শুনলেন না মেজকাকা । অবশ্য ষড়যন্ত্র করে তাড়ানোর চেষ্টা যখন করেছেন, তখন কি সহজে রাজী হবেন ? ছোটকাকা আর দাঁড়াননি সেখানে। দ্রুতগতিতে বেরিয়ে কোথায় যে গিয়েছিলেন বুঝতে পারিনি বা জানতে পারিনি। পুষ্পকে নিয়ে কোন গ্রামে বা শহরে বাসা বেঁধেছিলেন। দাদুর অনুনয় উপেক্ষিত হওয়ায় অন্তরে অনুশোচনার তীব্র দহন জ্বালা ঠাকুরদাকে শয্যাশায়ী করে তুলেছিল।
সেই সময় বাবা আরন্যক জীবনকে শিকারীর প্রধান অবলম্বন মনে করে বেশ কয়েক দিন ধরে ছুটেছেন শিকারের পিছনে। বাড়ীতে এসে ঠাকুরদাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দেখে উদিদ্ধ হলেন। বাবার ইচ্ছা ছিল মেজকাকার নিকট হতে ঠাকুরদার স্বাস্থ্য
সম্পর্কে পরামর্শ নেওয়া। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি শুনে বাবাকে আরো চিন্তাকূল করে তুলেছিল। স্বার্থপর মেজকাকা ঠাকুরদার অসুস্থতা উপেক্ষা করে সবান্ধব দীঘা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। পুত্রের উপযুক্ত কাজই করেছেন।
নিরুপায় হয়ে বাবা গ্রামবাসীদের সাহায্য নিয়ে শহরের অভিমুখে যাত্রা করলেন রুগ্ন পিতাকে নিয়ে। ছোটকাকাকে খোঁজ করার জন্য লোক পাঠালেন। গ্রাম হতে শহর অনেক দূর। জমিদার ব্রজকিশোর সিংহকে সুস্থ করার জন্য যে শহরে পাড়ি দিতে হবে, বাবা কোন দিন ভাবতে পারেননি । তবু তাঁকে বাঁচাতে পারলেন না। মৃত্যু যখন কোন মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, তখন মৃত্যুর হাতছানিকে কোন পরাক্রমশালী ব্যক্তিও এড়িয়ে যেতে পারে না।
পথিমধ্যে চন্ডীপুরের ধনবান প্রভাবশালী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ততক্ষণাৎ সারা চন্ডীপুরে শোকের ছায়া নেমে এল। কেউ কি কল্পনা করেছিলেন ঠাকুরদা এভাবে মারা যাবেন ? বয়স যে হয়নি তা নয়, তবুও মানুষটাকে দেখলে মনে মনে অঙ্ক কষতো কতই বা বয়স হবে। হয়তো সত্তরের কাছাকাছি হবে। ঐ বয়স হলেও তখনও ইস্পাতের মত শক্ত ছিলেন।
গ্রামবাসীদের কর্ণে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছতেই দলবদ্ধ হয়ে জমিদারের প্রাসাদে ছুটে এলেন। সকলেই পরস্পরের মুখপানে তাকিয়ে আলোচনা করতে থাকলেন।
মৃত্যু নিয়ে নানা লোকের মুখে নানা কথা। কেউ কেউ যাত্রা দলের পাট আওড়ানোর মতো বলতে শুরু করল , প্রেমাংশুর কলঙ্কিত জীবনের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ছেলেটা যে শিক্ষিত হয়ে রাজপরিবারের আভিজাত্যকে এইরূপ হীনভাবে ধুলায় লুণ্ঠিত করে দেবে তা কেউ বুঝতে পারেনি।
পুষ্পের সঙ্গে ছোট কাকার গৃহত্যাগের সংবাদ এই অঞ্চলের জনগণের নিকট অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। ঠাকুরদার শবদেহ শ্মশানে নিয়ে আসা হল গ্রামবাসীদের সহযোগীতায়। দাহনের কাজ শেষ হলে পর বাবা বাড়ীতে এসে দেখলেন কাকা ছোট ছেলের মতো মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছেন। মেজকাকার শোকাতুর ভাব দেখে প্রতিটি মানুষের ধারণা হয়েছিল তাঁর পিতৃভক্তি প্রগাঢ় ছিল।
ঠাকুরদার মৃত্যুর পর বেশ সুখ - দুঃখের মধ্য দিয়ে মাসখানেক কেটে যাবার পর আমাদের সংসারে অন্ধকার নেমে এলো। নেমে এলো অভাব অনটনের দুঃখ জ্বালা। ছোট কাকা ও বাবার প্রতি মেজকাকার বিশ্বাসঘাতকতা বাবা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি। বাবা ও মেজকাকা দুই বৎসরের ছোট। সেই জন্য বাবার ধারণা ছিল মেজকাকা তার সঙ্গে আগের মতো রহস্যলাপ করছে। কিন্তু যখন সমস্ত সম্পত্তির একটি উইল বাবার হাতে দিলেন, তখন তিনি বজ্রাহত হলেন। মনে করেছিলেন, মাটি যেন তার পায়ের কাছ হতে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। তবু দুই হাতে উইলকে চেপে ধরে
নির্দ্বিধায় বলেছিলেন মেজকাকাকে, ঠাকুরদা যখন নিজ হস্তে এই উইল করে গেছেন, মেনে নেবেন। কিন্তু ছোট ভাইকে তিনি কি দিয়েছেন?
মেজকাকা সানন্দে জানালেন, সে আমাদের বংশের অমর্যাদা করেছে বলে তাকে তাজ্যপুত্র করেছেন। তিনি আমার উপর বিশ্বাস রাখতেন বলে বাকী সম্পত্তি আমার নামে লিখে গেছেন। বাবার বিশ্বাস ছিল আমি সমস্ত সম্পত্তি আগলে রাখতে পারব। তিনি তোমাকেও বিশ্বাস করতেন না। হয়তো তোমার নৈতিক অধঃপতনের কথা স্মরণ করে এই রকম অংশ দিয়ে গেছেন। এই বলে তিনি গম্ভীর মুখে চলে গেলেন।
ওকথা শুনে বাবা বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। মাথার কোষে কোষে চিন্তা এসে উপস্থিত হল। সেই সময় বাবার স্মরণে এলো ভারতের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি । যা আজও পর্যন্ত ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষণে লেখা আছে। ভাই হয়ে ভাই এর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা। পুত্র হয়ে পিতার আসনে বসার জন্য পিতাকে খুন করা। সবই তো সম্পত্তির জনাই। মেজকাকাকে এত দিনে চিনতে পারলেন ও বুঝতে পারলেন তার নিষ্ঠুরতাকে।
গ্রামের লোকেদের ধারণা ছিল, প্রেমাংশুর নির্বাসনের পশ্চাতে একমাত্র কারণ ছিল মেজকাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ - এর জঘন্য ষড়যন্ত্র। কিন্তু সবচেয়ে বড় আশ্চর্য হচ্ছেন মেজকাকা কি করে ভিলেন হলেন। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে তিনি আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন। এই পৃথিবীতে এমন কতকগুলো মানুষ আছে, যারা আপন স্বার্থ চরিতার্থ করা সবচেয়ে বড় মনে করে। নিজেকে বড় করার জন্য মানবিকতাকে, পৌরষত্বকে নৃশংসভাবে হত্যা করে নিঃসংকোচে আত্মসুখ অনুভব করে। প্রয়োজনবোধে আপনজনকে বঞ্চিত করতে দ্বিধাবোধ করে না।
এই উইলের পরেও বাবা শত দুঃখের মাঝে স্থির করেছিলেন তিনি ঘরবাড়ী পর্যন্ত ভাগ নেবেন না। কারণ মেজাকার শতা ও বিশ্বাসঘাতকতা একদিন জমিদার পরিবারের উপর একটি নিষ্ঠুর অভিশাপ রূপে নেমে আসবে। তাই মেজকাকার কাছ হতে বাবা সরে পড়লেন। গ্রামের শেষে কুঁড়ে ঘরে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন।
মেজকাকা কোন রূপ বাধা দিলেন না। বরং অতিশয় আনন্দিত হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় আশ্চর্য গ্রামবাসীদের এবং এমনকি বাবারও যে, একজন জমিদারের বড় পুত্র সাধারণ মানুষের মত কুঁড়ে ঘরে বাস করতেন। বিশেষ করে গ্রামের লোকেরা যখন বাবার কানে তুলে ছিলেন ঠাকুরদার প্রচন্ড ইচ্ছে ছিল ছোটকাকাকে ডাক্তারী পড়িয়ে গ্রামবাসীদের আশা - আকাঙ্খাকে সার্থক করে তুলবেন।
বাবা গ্রামবাসীদের হতাশা অনুভব করে কথা দিলেন যে গ্রামবাসীদের এই আশা আকাঙ্খা তার ছেলে সুমন্তকে দিয় পূরণ করবেন। পরদিনই ডাকা হল গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার মশাই সুরজিত বাবুকে। তার কাছে পরামর্শ নিলেন ডাক্তারী পড়াতে হলে কত টাকা খরচ হবে। কুড়ি একর জমি বিক্রি করলে পর ডাক্তারী পড়ানো যাবে কি না।
ক্রমশ...
দ্বিতীয় পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-
চতুর্থ পর্ব টি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-
Comments