উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -1


 

পদ্মাবধূ

    --বিশ্বনাথ দাস.                  পর্ব - ১



            এক



শুভাশিষদার কথায় রমা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। আপনাকে দাদার মতো মানি, আমার পঙ্কিলময় জীবনের ইতিহাস শুনে কি করবেন? তাছাড়া আপনি কার । কাছে অবগত হলেন যে , আমি একজন নরকের কীট নীতি ভ্রষ্টা । সমাজের কাছে ঘৃণ্য , বারবণিতা । নিত্য নতুন পুরুষের সাথে সঙ্গ দিতে হত । ঐ দিনগুলো মনে পড়লে শোকে , অভিমানে আমার দেহমন খন্ড - বিখন্ড হয়ে যেত । যন্ত্রণায় আমি কাতরাতাম । সেই সময় এক মুহুর্তের জন্য আমি স্থির থাকতে পারতাম না । যে দিন গুলো মন থেকে মুছে দিয়েছি , সে স্মৃতিকে আমার চোখের সামনে হতে আড়াল করেছি , তা নতুন করে চোখের সামনে উদ্ভাসিত করতে চাই না । আমার ঐ মৰ্ম্মস্পর্শী দিনগুলো আপনার সামনে প্রকাশ করতে পারলাম না বলে আপনি আমায় ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন এই আশা রাখি । রমার চোখ দুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁট অশ্রু ঝরতে থাকলো।

 রমা এক রকম দৌড়ে ঘর হতে প্রস্থান করতে দেবীদাস প্রবেশ করে ওকে আটকে বললো, পালিয়ে যাচ্ছো কেন? আমি শুভাশিষকে আসতে বলেছিলাম । শুভাশিষ আমার ভালো বন্ধু , তোমার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন কাহিনী শুনে সমাজের হয়তো চক্ষু খুলতে পারে । আমি তোমার স্বামী আমি যখন অনুমতি দিচ্ছি তবে তোমার দ্বিধা কেন?
   
      রমা বলল , আমি তোমার করুণাত্মক কাহিনী মুখে প্রকাশ করতে পারব না । আমি ডায়েরী খাতায় লিখে রাখবো শুভাশিষদা সুন্দর করে সাজিয়ে জন সমুদ্রে ভাসিয়ে যদি সমাজের চক্ষু খুলতে পারেন ও পাঠক / পাঠিকাদের মানস সরোবরে এই “ পদ্মাবধু ” কে ক্ষণিকের জন্য ভাসিয়ে রাখিতে পারেন তাহলে জানবো তার লেখা সার্থকতা পেয়েছে । শত অনিহা থাকতেও দেবী দাসের গভীর চাপের জন্য আমাকে কলম ধরতে হলো। 

   আমি একজন পতিতা ছিলাম । এবার বুঝতে পারছেন আমার জীবন কি ভাবে কাটতো । তবে আমি পাঠক / পাঠিকাদের জানাচ্ছি , আমি একজন উচ্চ পরিবারের সম্ভ্রান্ত বংশের বধূ ও সংসারী হয়েছি।
  
      যে অতীতকে আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি নতুন করে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতে কষ্টতো হবেই। জানি না ঠিক মতো লিখতে পারবো কিনা।

 মানুষের জীবনের প্রতি মুহুর্ত নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায় । কখনো আসে অপরিসীম আনন্দ , উদ্দাম , কল্লোল , আবার কখনও আসে রোদন ভরা বসন্ত। সেই রূপ আমর জীবনে অধিকাংশ দিনগুলো রোদনের মধ্যে কেটে গেছে । ঘরের নিভৃত এক কোণে মুখে কাপড় গুজে ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম । সেই সময় অতীত মনে পড়লে মনে হত শানিত অস্ত্র হয়ে বুকে বিঁধতো। বেদনায় বুকটা টন - টন করত। চোখ দিয়ে দরদর করে জল বেরিয়ে আসতো সমস্ত বেদনা, যন্ত্রণাকে আঁকড়ে ধরে বিছানায় লুটিয়ে পড়তাম।  

       ধীরে ধীরে সব বেদনা, যন্ত্রণা সহ্য হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু সহ্য হত না বাবুগুন্ডার চাবুকের ঘা। ওদের কথা না শুনলে চলত বাবু গুন্ডার চাবুকের মার । অকথ্য অত্যাচার , আমার পাশে থাকুন সব জানতে পারবেন । যতখানি এগোবেন ততখানি এই উপন্যাসে ভয়ানক রূপ নেবে । তাহলে বাগদেবীর আশীর্বাদে গৌরচন্দ্রিকা না করে প্রথম অংকে প্রবেশ করলাম।

    যখন পতিতা ছিলাম , তখন নিত্য নতুন পুরুষরা বিভিন্ন নামে ডাকতো , কেউ বলতো পাপিয়া , কেউ চন্দনা , কেউ চামেলী , কেউ শিউলী ইত্যাদি। আমাদের বস্তীর সখীরা আমাকে পদ্মাকুমারী বলে ডাকতে আমি খিল খিল করে হেসে উঠতাম । আমার আবার কুমারীত্ব । সর্বস্ব আমার মুছে গেছে , সতীত্ব , কুমারীত্ব , কোনটাই আমার নেই । তাহলে কুমারী বলে ডাকা কেন? 

     পতিতা খাতায় যখন আমর নাম নথীভুক্ত হয়ে গেছে, তখন সমাজে আমি কলঙ্কিতা , ভ্রষ্টা , নষ্টা মেয়ে তা অস্বীকার করব না । সমাজ আমাকে ঘৃণা করবে । দূর থেকে ইঙ্গিত করবে ঐ দেখ মেয়েটা সেজে গুজে যাচ্ছে ওদের আমার সাজ - সজ্জা!

    অনেকেরই কাছে একথা শুনেছি । কিন্তু যারা আমাকে দিনের আলোয় ভর্ৎসনা করেছে তারাই আবার অনেকে রাতের আলোতে কামনার জ্বালা মেটাবার জন্য লজ্জা মান বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে এসেছে । সেই জন্য অনেক সময় ভাবতাম যদি আমরা না থাকতাম তাহলে ওরা কি করতো?


    আমি সমাজের কাছে রাজহংসের মতো মুখকে উঁচু করে জোর গলাতে বলতে পারি পতিতাদের জন্য সমাজের সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকে। অবশ্য ও কথা বেশী রঞ্জিত করতে চাই না । আমার লেখনীতে ফিরে আসি।

      লোকে বলে আমি অপূর্ব সুন্দরী, নন্দন কাননের পারিজাত ফুল , ডানা কাটা পরী , অনুপম সৌন্দর্য্য। সুতরাং সহজেই আমি ছিলাম পুরুষের কামনার বস্তু ও লালসার ধন। তাই স্তাবকের আমার অভাব ছিল না।
 
      পোষাক ছিল আমার অতি সাধা - সিধে। সেই সময় প্রচুর রোজগার করতাম । কোন কিছুর অভাব ছিল না । অভাব ছিল শুধু ভালোবাসার , পুরুষের প্রেমের। কোন পুরুষের কাছে প্রেম পাইনি । শুধু পুরুষের নিকট থেকে কৃত্রিম ভালোবাসা । আমাকে শুধু ব্যবহার করতো ওদের কামনার আগুন নেভাবার জন্য। 

    অবশ্য সে সময় কোন পুরুষ যদি প্রেম নিবেদন করতো, সে হতাশ হয়ে ফিরে যেতো। কারণ পুরুষের ভালোবাসার মধ্যে কোন আন্তরিকতা দেখিনি। তখন চোখের সামনে ভেসে উঠতো আমার পরম পূজনীয়, পর উপকারী রন্টুদার মুখচ্ছবি।


   ঐ লোকটাই আমাকে নীতি ভ্রষ্ট করেছিল এবং এই পথে আমাকে নামিয়ে ছিল। কিন্তু যখন অন্য পুরুষের কাছে আদর - আবদার ভালোবাসা পেলাম , তখন চিন্তা করেছিলাম এই পুরুষ জাতের মধ্যে কত পার্থক্য । কেউ মানব, কেউ দানব।

     যেদিন দেবী দাসের কাছে আশ্রয় পেয়েছিলাম পদ্মাকে বধূ বলে স্বীকার করেছিলো, সেদিন গলবস্ত্রে সৃষ্টি কর্তাকে আমি প্রণাম জানিয়ে ছিলাম। তারই অনুপ্রেরণায় এক জমিদারের নাতনী অর্থাৎ প্রভাবশালীর ব্যক্তির কন্যা রমা সমাজের কাছে ও সমাজের খ্যাতনামা বংশধরের বধূ হয়েছি।  

    সেই জন্য এই উপন্যাসের নাম ‘পদ্মাবধূ’ হওয়া উচিত। যদিও আমার কলঙ্কিত জীবনের রেশ তখনও ছিল। আমার এই কাহিনী লিখতে লিখতে সহস্ৰ অশ্রুবিন্দ একত্রিত হয়ে এক জলাশয়ের সৃষ্টি করলেও লিখে চলেছি আমার সেই অতীত যা এখনো জাজ্বল্যমান। 

   আমি কে, কি আমার পরিচয় কোন বংশের দুহিতা , প্রকাশ না করলে এই উপন্যাসের অঙ্গহানী হতে পারে। তাই প্রথমেই পরিচয় দিই , আমার ঠাকুরদার নাম , ব্রজকিশোর সিংহ । তিনি জমিদার বা প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন । যার দাপটে একসময় বাঘে বলদে এক ঘাটে জল খেত। ঠাকুরদার ব্রজের মতো হুঙ্কার এখনো আমার স্মৃতিহতে মুছে যায়নি । তিনি কঠোরভাবে শাসন করতেন, কিন্তু গ্রামবাসীদের প্রতি কোন মুহুর্তের জন্য অন্যায় আচরণ করতেন না। তার কাছে ছিল দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন । অন্যায়কে কোন প্রকারে প্রশ্রয় দিতেন না । যদি দিতেন , তাহলে মনে হয় আমার জীবনে এই রূপ করুন পরিণতি নেমে আসতো না। এমন কি আমার বাবার শেষ জীবনে ফুটপাতই একমাত্র আশ্রয় স্থল হত না।  

    আমার ঠাকুরদার তিন ছেলে । বড় ছেলের নাম সীতাংশু শেখর সিংহ , মেজছেলের নাম হিমাংশুশেখর সিংহ , ছোট ছেলের নাম প্রেমাংশুশেখর সিংহ । বড় পুত্র সীতাংশুবাবু সর্বদাই শিকারে মত্ত থাকতেন । সম্পত্তির দিকে কোন নজরই ছিল না । দেখাশুনাতো দূরের কথা। ‌‌

    মেজভাই হিমাংশ গোপনে সমস্ত সম্পত্তিটুকু আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। হিমাংশুবাবু ছিলেন মীরজাফর । কি করে সম্পত্তি নিজের নামে করা যায় তারই প্রচেষ্টা ছিল বেশী।

    একদিন তার চেষ্টা সফল হয়েছিল। একদিকে ছোট ছেলে প্রেমাংশু শহর হতে কলেজ জীবন শেষ করে বাড়ীতে এসে ছোটজাতদের জ্ঞান - বুদ্ধি দিয়ে অন্ধকার হতে আলোতে আনার চেষ্টা করছে, সেই জন্য সর্বদা বাগদী পাড়ায় পড়ে থাকতো । কোন কোন দিন ওদের পাড়াতে রাত কাটাতো। সেই সময় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যতীন বাগদীর মেয়ে পুষ্প সর্বস্ব খুইয়ে নিজের গর্ভে ধারণ করেছিল ছোট কাকার ঔরসজাত সন্তান। ধীরে ধীরে সব জানতে পারবেন কিভাবে আমাদের জীবনে অন্ধকার বিভীষিকা নেমে এসেছিলো। কি করে হয়ে ছিলাম দেহ বিতরিনী নিশিকন্যা।

         


                                                     ক্রমশ...



দ্বিতীয় পর্বটি পড়তে নীচে দেওয়া লিংক টি ক্লিক করুন-

 

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024