উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -27


 


দেবীবাবু ধীর কণ্ঠে বললেন, আমার সাথে আসুন। তিনি পাশের রুমে গিয়ে একটা বড় আয়নার কাছে গিয়ে নিজের চেহারাকে দেখিয়ে বললেন, ঐ লোকটাই আপনার দাদাকে খুন করেছেন।

 দেবীবাবু - । আপনি আমার দাদাকে খুন করেছেন? হ্যাঁ।

 আপনাকে ছাড়বো না দেবীবাবু। আজ হত্যাকারীর রক্ত দিয়ে ভ্রাতৃহত্যার তর্পণ করবো। ছুরিখানা উপরে তুলে দেবীবাবুর বক্ষে বিদ্ধ করতে যাবো এমন সময় দৈববাণীর মত ময়নার কণ্ঠস্বর আমায় ওপথ থেকে বিরত করলো। মনে হল ময়না যেন বলছে, মা, বাবাকে হত্যা করছ - মা, বাবাকে খুন করছ - মা তুমি ;

ওকথা শুনে ছুরি হাতে নিয়ে নিথর হয়ে স্টাচু হয়ে পড়লাম। পারলাম না। দেবীবাবুর বুকে ছুরিখানা বসিয়ে দিতে। আমার সমস্ত প্রতিহিংসা ক্রোধ এ মুহুর্তে অগ্নিতে জল ঢালায় শীতল হয়ে গেল। কে যেন জোর করে আমার হাত হতে ছুরিটা ছিনয়ে নিলো। পিছন হতে ময়নার ঐ কণ্ঠস্বর আবার যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ‘মা বাবাকে মেরো না

ওখানে না দাঁড়িয়ে টলতে টলতে বারান্দয় এসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলাম। দাদাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আমি পারলাম না দাদা, তোমার শত্রুকে শেষ করতে পারলাম না। আমার এই সাময়িক হৃদয় দৌর্বল্যের জন্য তোমার আত্মার নিকট আমি ক্ষমাপ্রার্থী দাদা। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

কোন সময় যে দেবীবাবু পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আমি জানি না। আমায় কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমায় ক্ষমা কর পদ্মা। অজ্ঞানে অনেক পাপ করেছি, সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও একটা গরীব পরিবারকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছি এবং নিজের জীবনেও চরম অধঃপতন নিয়ে এসেছি। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তোমার দাদা আমার শত্রু হয়েছিল। কিন্তু সেই সুমন্ত আমার তমসাচ্ছন্ন জীবনের ঘন কৃষ্ণ মেঘরাশি সরিয়ে দিয়ে আমার জীবনে নব প্রভাতের অরুণ উদয় ঘটিয়েছে। সেই সূর্যশান্তি আলো ঝলমল জীবনে আমি শান্তির বিহগগীতি শুনতে পেয়ে নিজের জীবনকে ধন্য বলে মনে করেছি। আমার অতীত জীবনের ব্যাভিচার, উদগ্র লালসা শুধু আমার জীবনকে ধ্বংস করেনি, আমার সহধর্মিনীকেও এই দুষ্কর্মের জন্য আমিই দায়ী পদ্মা। তাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমি সদা প্রস্তুত আছি। কেন তুমি আমায় শাস্তি দিচ্ছ না।

একটু পর নিজেকে শান্ত করে বললাম, শাক্তি আপনাকে দিতাম দেবীবাবু, কিন্তু এক নিষ্পাপ, সরল শিশুর মুখ স্মরণ কর ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। ঐ অবোধ শিশু আমাকে বার বার এই হত্যাকান্ডের হাত থেকে বিরত হবার ইঙ্গিত দিয়েছে।

পদ্মা, ময়নাকে অপার মাতৃস্নেহে তুমি মৃত্যুর কবল হতে বাঁচিয়েছো, সে তোমার মাতৃ হৃদয়ে তোমার অলক্ষ্যে কন্যার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে, সেই স্থান হতে তুমি তাকে কিছুতেই সরাতে পারবে না। তোমার দাদা আমার ক্রোধবহ্নির শিকার হয়েছে ফলে দেখা দিয়েছে পিতা ও পুত্রীর জীবনে ভাগ্য বিড়ম্বনা। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তোমার জীবনের দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম। এবার তোমার সম্মতি আমাদের মিলন পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করে তুলুক। - তোমার নিকট এই আশাই রাখছি।

দেবীবাবু -

হ্যাঁ, পদ্মা, আমি এক চক্রান্তের বশে নিজের পুরুষত্ব হারিয়ে তোমার দাদাকে খুন করেছি। বিশ্বাস করো এক মুহুর্তের জন্য ভাবিনি কত বড় সর্বনাশ আমি করেছি। আমি তোমার ভ্রাতৃঘাতক হলেও তুমি আমায় ক্ষমা করো। সেদিন কনক নার্সিংহোমে বলেছিলাম সময় হলে বলব আমার অতীত। যে অতীত নোংরা, আবর্জনায় পরিপূর্ণ কেন আমার স্ত্রী চন্দ্রাকে হারিয়েছি, কেন এই সসাগরা পৃথিবী হতে নিরপরাধ গরীব সন্তানকে চিরদিনের ঘুম পাড়িয়েছি। দেবীবাবু চোখের সামনে অতীত ইতিহাস অস্পষ্টভাবে ভেসে উঠল এবং তখনই তিনি তার স্মৃতি চারণ করতে শুরু করলেন। যে ইতিহাসের কাহিনী সেদিন পর্যন্ত তার অন্তরের অস্তঃস্থলে বিদ্ধ হয়েছিল। তা মোটামুটি হল এরকম।



মাঘের শেষাশেষি। শীত তেমন নেই, বসন্ত দেখা দিয়েছে ফাল্গুনের আগে। এলোমেলো ভাবে বাতাস বইছে। ওতে ভেসে আসছে যেন ফুলের গন্ধ। ধরণীর বুকে রক্তিম আভা ম্লান হতে চলেছে। একটু পরে শহরের কালো অন্ধকার নেমে আসবে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী বলে। একাকী ফুটপাতে দেবীদাস দাঁড়িয়ে আছে যানবাহনের অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ব্যাকুল হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে।

হঠাৎ একটা কালো রঙের ট্যাক্সি কাছে এসে এমনভাবে ব্রেক কষল যে দেহের গ্রন্থিগুলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন অবশ হয়ে গেলো। ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে পড়ল। কোন প্রকারে সামলে ড্রাইভারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল গম্ভীর মুখ তার। চোখ দুটো যেন লাল মার্বেল। স্টীলের ফ্রেমের চশমা চোখে আটকানো। ভূগুলো বেশ মোটা। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। জুলফি কানের পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা নেমে গেছে চোয়ালে।; গোঁফটাও মোটাসোটা। গাল ভর্তি দাড়ি তবে মসৃণ। মাথায় একটা কালো টুপি। দেহের দিকে তাকিয়ে দেখল, কালো রঙের ওভারকোর্টে ঢাকা।

ওভাবে তার চেহারার খুঁটিনাটি দিক লক্ষ্য করে চলেছে, ঠিক সেসময় ভদ্রলোক বললেন, কোথায় যাবেন, আসুন না আমার ট্যাক্সিতে?

কেমন হকচকিয়ে গেলো ওর কথা শুনে। বিশেষ করে এক অচেনা অজানা মানুষের সহানুভূতি আশ্চর্য্য করল দেবীদাসকে। কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সময় অনেক পেরিয়ে গেছে, তাছাড়া বাড়ীতে বিশেষ কাজ আছে অতএব সুযোগ যখন পাচ্ছে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা উচিত নয়।

ট্যাক্সিতে চড়ে বসতেই ষ্টার্ট দিলো ভদ্রলোক। ওর পাশে বসেছিলেন, ফুটখানেক মাত্র ছাড়াছাড়ি। দেবীদাস ও ড্রাইভার ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি ছিলো না। ট্যাক্সি দ্রুত গতিতে চলছে। পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকান্ড বাড়ীগুলো পলক না ফেলতে ফেলতে সোঁ সোঁ শব্দে পেরিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে হিন্দী গানের সুর ভাঁজছে। বেশ ভালোই লাগছিল। একটু পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,

কোথায় যাবেন?

শ্যামবাজার।

তারপর চুপচাপ হিন্দী গানের পুনরাবৃত্তি করতে একটু পর ভদ্রলোক পুনরায় বললেন, আপনি বিখ্যাত শিল্পপতি মিঃ হেমন্ত রায়ের ছেলে নন ?

 ও কথা শুনে হিন্দী গানের সুর ভুলে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ওকে তো কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024