ছোট গল্প - যমজ || লেখক - অমিত কুমার জানা || Written by Amit Kumar jana || Short story - Jomoj
যমজ
অমিত কুমার জানা
অনুপ এবং অজিত দুই যমজ ভাই। দুজনকে দেখতে হুবহু একই রকম এবং হাঁটা চলার ধরনও প্রায়ই একই। তবে ছোটবেলা থেকে পাঁচ মিনিটের ছোট অজিত অনুপের চেয়ে বেশ দুষ্টু। অজিতের এই দুষ্টুমি বড় হওয়ার সাথে সাথে কমলো না,বরং বদমায়েশিতে পরিণত হলো। সে বিভিন্ন ধরনের অকাজ কুকাজ করে আনন্দ পেতে শুরু করলো। এদিকে অনুপ কলেজের পড়াশোনা শেষ করে পুলিশের চাকরি পেল। অবশ্য এর জন্য তাকে নিয়মিত অনেক পরিশ্রম এবং পড়াশোনা করতে হয়েছে।
অজিত কলকাতার একটা কলসেন্টারে কাজ করতো। এতেও তার ধৈর্য্য ছিল না। মাঝেমধ্যেই কারণে অকারণে বাড়ি চলে আসতো। ইতিমধ্যে কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সংকট রেখা অতিক্রম করলো। কলকাতায় শয়ে শয়ে মানুষ সংক্রামিত হলো এবং মারা যেতে লাগলো। করোনার ভয়ে অজিত বাড়ি ফিরে এলো, মেদিনীপুর শহরে। এদিকে অনুপ করোনা আক্রান্ত হয়ে নিজ গৃহে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছে। সে বাড়ির বাইরে সচরাচর বেরোয় না। অনেক দিন পর অজিতকে দেখে মা উলপীদেবী ভালো মন্দ রান্না করে খাওলেন এবং তাকে সাবধানে থাকতে বললেন। কারণ ভাইরাসের সংক্রমণ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার না করলে নির্ঘাত করোনা আক্রান্ত হতে হবে। কিন্তু অজিতের অনুপকে দেখেও শিক্ষা হলো না,সে ইচ্ছাখুশি এদিক ওদিক বেড়াতে লাগলো। অজিতের বেপরোয়া ব্যবহার ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। পাড়ার অনেকেই তার দিকে আঙুল তুলে অভিযোগ করলো যে সে কলকাতা থেকে এসে টেস্ট, আইসোলেশন এইসব কিছু না মেনে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? অজিত এসব কথায় তোয়াক্কা না করেই বললো যে তার যা মন চায় তাই করবে। শুধু তাই নয় সে এই ভয় দেখায় যে তার দাদা অনুপ পুলিশ, বেশি ঝামেলা করলে দাদাকে দিয়ে লক্ আপে ঢুকিয়ে দেবে।
এদিকে অসুস্থ অনুপ বাড়িতে আইসোলেশনে সময় কাটাচ্ছে। যদিও সে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। বাড়িতে সব্জি ছিল না। মা অজিতকে বাজার যেতে বলে বাথরুমে চলে গেলেন। অজিতের মাথায় একটা বদমায়েশি বুদ্ধি খেলে গেল। সে তার দাদার পুলিশ ইউনিফর্ম এবং ক্যাপটা পরে নিল। তারপর মুখে মাস্কটা লাগিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাজার করতে। শহরেরের প্রান্তের হাইরোডে যেখানে তুলনামূলক জনসমাগম বেশ সেখানে দাঁড়িয়ে রুললাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপর সে ঘুষখোর পুলিশি স্টাইলে তোলাবাজি শুরু করলো। বাইক আরোহী যারা যারা হেলমেট এবং মাস্ক পরেনি তাদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা নিতে লাগলো। মাস্কহীন ফোরহুইলারের ড্রাইভারও রেহাই পেলো না। এক দু ঘন্টায় অজিতের দু পকেট টাকায় ভরে গেল। এরপর অজিত মহানন্দে বাজারে গিয়ে বাজার সেরে পান সিগারেট খেয়ে বাড়িতে ফিরে এলো।
এর পরদিনের ঘটনা। অজিত মাস্ক পরে বাইক নিয়ে দিব্যি বাজারে বেরিয়ে পড়ল। পঞ্চুর চকে চায়ের দোকানে বেশ ভিড়। যদিও এই সংক্রমনের সময়ে চা পানের দোকান খোলা সরকার কার্যত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু শোনে আর কয়জন?
এক যুবক চা পান খেয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ।দোকানি তাকে বললেন যে এই সাতসকালে খুচরো নেই তাই বাকি দুশো টাকা একটু পরে এসে যেন সে নিয়ে যায়। যুবকটি মাথা নেড়ে বাইক নিয়ে অন্যত্র চলে গেল। ঠিক এই সময়ে চায়ের দোকানের দিকে বাইক নিয়ে এলো অজিত। উক্ত যুবকের জামা প্যান্টের কালার হুবহু অজিতের মতোই ছিল। এবার অজিতের মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল। সে বাইক নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। দশ পনের মিনিট পর অজিত মাস্ক পরে আবার ওই চায়ের দোকানে ফিরে এলো। ফিরে এসে চা দোকানীকে বলল যে আমার পাওনা দুশো টাকা দিন। দোকানদার অজিতকে উক্ত যুবক ভেবে অজিতকে দুশো টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন।
এর কিছুক্ষণ পর উক্ত যুবকটি চায়ের দোকানে ফিরে এলো। ফিরে এসে দোকানীকে বললো, " আমার পাওনা দুশো টাকা দিন।"
দোকানী অবাক হয়ে বললো, "তুমি তো এখনই দুশো টাকা নিয়ে গেলে! মাস্ক পরে টাকা মারার ভালোই সুযোগ পেয়েছো।"
যুবকটি রেগে ফেটে পড়লো এবং বললো, " এখনই আমার টাকা দিন নইলে পুলিশ ডাকবো। আমার পাওনা আমি নিয়েই ছাড়বো। ভালো চান তো দিয়ে দিন।"
এইভাবে তর্কাতর্কি হতে হতে দোকানদারের সাথে যুবকটির তুমুল বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। অনেক লোক জড়ো হলো। খানিকক্ষণের মধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ হাজির হলো।
পুলিশের এসেই প্রথমে চায়ের দোকানিকে গালিগালাজ শুরু করলো। পুলিশ বলল যে আপনি কি জানেন না এই লকডাউনে চা পানের দোকান খোলা নিষিদ্ধ। দোকানদার কাঁচুমাচু হয়ে হাত জোড় করে পুলিশের কাছে ক্ষমা চাইলেন। এরপর পুলিশ এই ঝামেলার কারণ শুনে হেসে ফেলল। ঠিক এই সময় উপস্থিত একজন ছেলে পুলিশকে বলল, "যে দুশো টাকা যে নিয়ে গেছে তাকে দেখতে অনেকাংশে অনুপদার মতো।"
পুলিশ ঐ ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে অনুপের বাড়িতে চললো। অনুপের মা উলপীদেবী দরজা খুললেন। পুলিশ দেখতে পেল অনুপ একটা আলাদা রুমে কোয়ারেন্টাইনে আছে, সে করোনা আক্রান্ত। উলপীদেবী বললেন যে অনুপ দশ বারো দিন বাড়ি থেকেই বেরোয় নি। ঠিক এইসময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো অজিত। পুলিশ একবার অনুপ একবার অজিতের দিকে তাকিয়ে উলপীদেবীর দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালো। দুজনকে একেবারে একইরকম দেখতে। উলপীদেবী বললেন, "এ হলো অজিত,অনুপের যমজ ভাই। এবার পুলিশের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে চায়ের দোকানীকে বোকা বানিয়ে এই অজিতই দুশো টাকা নিয়ে পালিয়েছে।
পুলিশ এবার ডাইরেক্ট অজিতকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি তোমার দোষ এখানেই স্বীকার করবে নাকি থানায় নিয়ে গিয়ে বাধ্য করাবো।" পুলিশের চোখরাঙানিতে অজিত থতমত খেয়ে গেল এবং শেষমেশ নিজের দোষ স্বীকার করলো। উলপীদেবী বললেন, "ছেলেটার জন্য আর কত নীচে নামতে হবে আমাদের কে জানে!" অনুপ করজোড়ে বললো বললো, "স্যার ভাইকে এবারের মতো মাপ করে দিন। আমিও একজন পুলিশ, আমি নতমস্তকে ওর দোষ স্বীকার করছি।"
অনুপের বিনম্র ব্যবহার দেখে পুলিশ মোহিত হয়ে অজিতকে মাপ করলো এবং বললো যে এবারের মতো ছাড়া পেয়ে গেলে নেক্সট টাইম এরকম বেয়াদবি করলে সোজা লক্ আপে পুরে দেবো। এ যাত্রায় অজিত দাদার দৌলতে নিষ্কৃতি পেলো।
তা সত্ত্বেও অনুপের প্রতি অজিতের বিন্দুমাত্র সৌজন্য দেখা গেল না। অজিতের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো ও কিছুই করেনি। যাইহোক পুলিশের নির্দেশে অজিত চা দোকানীকে দুশো টাকা ফেরত দিলো।
এর কিছুদিন পরের ঘটনা। অজিত তার কলেজের এক বান্ধবী তনুজাকে দেখতে পেল হলুদ সালোয়ার কামিজ পরে শহরের চৌরাস্তা থেকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। অজিত খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো যে তনুজা তার মামার বাড়িতে এসেছে। কলেজে পড়াকালীন অনুপ এবং তনুজা পরস্পরকে ভালবাসতো। কিন্তু অজিতও তনুজাকে ভালবাসতো। তনুজার পক্ষে অজিতের প্রপোজাল একসেপ্ট করা সম্ভব হয় নি। সেদিন থেকে অজিতের মনে তনুজার প্রতি যে প্রতিহিংসার আগুন জমে ছিল তা আজ যেন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। অজিত তনুজাকে শায়েস্তা করতে যেন শিকারীর মতো ওত্ পেতে বসে থাকলো। মানে প্রতিদিন নিয়ম করে ঐ চৌরাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করতে থাকলো যাতে সুযোগ পেলেই কার্যসিদ্ধ করতে পারে।
পরদিন সকাল দশটার ঘটনা। মাস্ক এবং হলুদ সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে চৌরাস্তার মোড়ের ওষুধের দোকানের দিকে হেঁটে হেঁটে আসছিল। এইসময় উল্টোদিকের চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছিল অজিত। অজিত ধীরে ধীরে ওষুধ দোকানের দিকে হাঁটতে লাগলো। তার পকেটে রয়েছে সালফিউরিক এসিডের একটা ছোট বোতল। দোকানের কাউন্টারে এসে মেয়েটি ওষুধ চাইলো। অজিত তখন পকেট থেকে এসিডের বোতলটা বের করে হাতে ধরেছে। দোকানী বললো, "তুমি মিতালী তো, গতকাল আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রেকোয়েস্ট পাঠিয়েছো?"
মেয়েটি বললো , "হ্যাঁ, আমি মিতালী। এই বলে সে মাস্ক খুলে ফেলে বললো যে সে তার পিসতুতো বোন তনুজার পোশাক পরে এসেছে।"
তা শুনে আতঙ্কিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় অজিতের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং হাত থেকে এসিডের বোতল পড়ে যায়। ধোঁয়া উড়তে থাকে। ওষুধ দোকানী চিৎকার করে লোক জড়ো করে ফেলে। ততক্ষণে সাত -আট জন লোক এসে অজিতকে পাকড়াও করে। মারাত্মক এসিড ব্যবহার এবং এসিড হামলার প্রয়াসের জন্য পুলিশ এসে অজিতকে ধরে নিয়ে যায়। এবার সে আর ছাড়া পেলো না। আদালতে কেস না ওঠা পর্যন্ত অজিত আপাতত কারাবাসে দিন কাটাচ্ছে।
Comments