ছোট গল্প - দরজার পাশে || লেখক - রোহিত দাস || Written by Rohit Das || Short story - Dorjar pase


দরজার পাশে 

রোহিত দাস 



সাহিত্য বিষয়টা চিরকালই‌ আমার কাছে বিরক্তিকর। তবে আজ হঠাৎ করে এভাবে খাতা কলম নিয়ে যে আকারনে তা নয়। বিগত কয়েক মাসে আমি যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, সত্যি-মিথ্যে, ভালো-মন্দের যুদ্ধের মাঝে এসে পড়েছি তা আমকে এই কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এতদিন মনের কথা শুনে আসা আমি পড়েছি আজ মাথার কোটি কোটি প্রশ্নের জালে। এই ঘটনার শুরু প্রায় আট মাস আগে।

গত বছর বাবার আদেশে এম.এ কমপ্লিট করে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থায় চাকরির জন্য ছুটেও যখন কোন ফল হলো না, তখন বাবার অবাধ্য হয়ে নিজের গিটারিস্ট হবার লক্ষ্যে এগিয়ে গেলাম। এই নিয়ে বাবা বেশ রাগারাগি করলেও একপ্রকার জোর করেই করি। কলেজ শুরুর সময় যে দলের সঙ্গে পারফর্ম করতাম তারা এককথাতে রাজি হয়ে গেল আমায় দলে নিতে। আসলে গিটারে আমার হাত চিরকালই ভালো, এটা বাবাও অস্বীকার করতে পারবেন না। বেশ নাম করেছে এরই মধ্যে আমার দল। বছরের শেষ তখন, বেশ কিছু জায়গা থেকে শো এর ডাক পায় আমারা। কয়েক সপ্তাহে বেশ কিছু টাকা জোগাড় করে একবারে বাবার হাতে তুলে দেবো ভেবে একের পর এক জমজমাট শো‌ করতে লাগলাম। রাত করে বাড়ি ফেরা আর শো করতে একটু হলেও নেশা করা হয় বলে বাবা একেবারে কঠোর বিরোধি। মা একটু ‌রাগারাগি করেন তবে তিনি জানেন আমি ওসব খায়না বেশি। তাই তিনি বাবাকে সামাল দেন।

এভাবে একের পর এক শো করে আর একটা মোটা অঙ্কের টাকা বাবার হাতে তুলে দিতে পেরে আমি একটু নিশ্চিন্ত। তবে গত ছ মাস আগে একটা শো করতে গিয়ে সেবার হঠাৎ করেই পেটে ব্যথা ওঠে। কোন রকমে শো‌ শেষ করে দেড় ঘন্টা গাড়ি জার্নি করে যখন পৌনে একটার সময় বাড়ি ফিরলাম তখন যন্ত্রনায় আমার চোখ বুজে আসছে। কাঁধের গিটারের ব্যাগটা শ্লিপ করে পরে যাচ্ছে সেটা সামলানোর ক্ষমতাও নেই। বাবা দরজা খুলে আমাকে এঅবস্থায় দেখে তৎক্ষণাৎ আমাকে সোফায় শোয়াতে শোয়াতে চিৎকার করে মা কে ডাকলেন। আমাকে মাও নাড়াতে নাড়াতে ডাকতে লাগলেন। মা'র গলায় কান্নার স্বর।বাবার গভীর গলায় রুদ্র রুদ্র ডাকটা শুনতে শুনতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। যখন জ্ঞান ফিরলো আবছা চোখে কাঁচের ওপারে কিছু মুখ দেখলাম। একটা একটা করে চিনতে পারলাম। মা বাবা আর পাড়ার ড: অতুল কাকু। জ্ঞান এসেছে দেখে বাবা ছুটে এলেন বাবার মুখে কঠোরতার জায়গায় কষ্ট আর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কান্নার স্বরে মা বললো “ এখন আর ব্যাথা হচ্ছে না তো বাবা!!” 

দুপাশে মাথা নাড়িয়ে না বললাম। বাবা ভাঙ্গা গলায়দেখে বললেন‌ “কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, জল খাবি রুদ্র?”

কষ্ট করে হ্যা বলাতে বাবা জলের গ্লাসটা মুখের সামনে ধরলো ঢকঢক করে পূরো জলটায় খেলাম। বাবা গ্লাস রেখে বেরিয়ে গেলন। দুদিনে চার বার ব্যাথা ওঠার পরেও যখন ডাক্তাররা এর কারণ খুঁজে বের করতে পারলো না তখন বাবা আমাকে ভেলোর‌ নিয়ে যাবেন‌ বলে ঠিক করলেন। তবে ‌সেখানে গিয়েও তে খুব লাভ হলো এমনটা একেবারেই নয়। তারা ব্যাথার কারণ খুঁজে পেল না। কোনো ওষুধে‌য় আমার রোগ সারেনা। সময়ে সময়ে ব্যাথা আসে ওষুধে ব্যথা কমে কিন্তু একেবারে সেরে ওঠে না। ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এভাবে দু মাসে অনেক টাকা খরচ করেও আমার অবস্থা বিন্দুমাত্র ভালো হলো না দেখে অগত্যা বাবা আমাকে আগের হসপিটালে ফিরিয়ে আনেন। বাবার দোকান বহু দিন বন্ধ। বহু টাকা পয়সা খরচের পরও এই অবস্থা।দিন দিন ব্যাথায় ভুগে মুখের স্বাদ নেই। শরীরও ভেঙ্গে গেছে। পেটে ব্যাথা,মা'র কান্না আর বাবার ধরে আসা গলা শুনে আমার তখন বাঁচার ইচ্ছা প্রায় শেষ। উঠে বসতেও কষ্ট হয়।দলের সবাই প্রায় দেখা করে গেছে।আমার দেখাশোনার জন্য একজন নার্স আছেন। সময়ে সময়ে তিনি‌ ওষুধ দেন। একদিন সকাল থেকেই বৃষ্টিটা মুশোল‌ ধারায় শুরু হয়েছিল। সকালে সেদিন ব্যাথাটা একবারই এসেছিল। শুনলাম অনেক নার্স আসেননি। অপর্না দিদিও আসেননি বৃষ্টির জন্য।অন্য একজন ওষুধ দিয়েছিল আমাকে। রাত্রেও বৃষ্টির বেগ কোমলো না। খেয়ে নিয়ে শুয়ে ছিলাম।কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। তীব্র যন্ত্রনায় ঘুমটা ভেঙে গেল। যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে কোনরকম করে দুবার নার্স নার্স বলে ডাকলাম। কিন্তু কোন উত্তর এলো না। ব্যাথাটা ক্রমশ যেন বেরেই চলেছে। প্রান তখন ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম। ঠিক তখনই পুরোনো কাঠের দরজাটা ঠেলে কেও ভেতরে এলো। ধীর পায়ে সে আমার মাথায় কাছে এসে দাঁড়ালো। মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখার ক্ষমতাও আমি তখন হারিয়েছি। সে তার নরম হাতটা আমার একঝাকড়া চুলের ওপর বোলাতে বোলাতে বললো শান্ত হও তুমি। পাশের টেবিল থেকে একটা ওষুধ মুখে দিলো, জল খাওয়ালো। আমার দুচোখে অন্ধকার নেমে এলো। আধ বোঝা চোখেই দেখলাম সে আমার মাথার কাছে বসে।

ঘুম যখন ভাঙলো ঘড়িতে দেখলাম সারে আট্টা। নিজেই কোনোরকমে টেবিল থেকে খাবার আগের ওষুধ গুলো খেয়ে নিলাম। কাল রাতের ঘটনা কিছুটা মনে পরতেই মাথায় ঝিম ধরে এলো। খুব স্পষ্ট না হলেও মনে আছে সেই মানুষটির কথা। কে ছিলো জানিনা কিন্তু নতুন কেও। আশ্চর্য রকম ভাবে সেদিন সকাল থেকে আর ব্যথা ওঠেনি কিন্তু সন্ধ্যে হতে না হতেই অন্যদিনের তুলনায় যেন হাজার গুণ বেশি জোরে ব্যথা উঠলো পরপর দু বার।শুধু পেটে না সারা শরীর জুড়ে, চোখ-মুখ কুঁকড়ে যাচ্ছিল। জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। জ্ঞান যখন ফিরলো বাবা-মা দুজনেই বসে, মা কাঁদছে বাবা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।আমার চোখ খোলায় তারা যেন প্রাণ ফিরে পেল। বিছানা শুয়েয় মায়ের হাতে রাতের খাওয়া খেয়ে নিলাম।বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠালাম। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আগের রাতের ঘটনা। কে ছিল সে? আজ সন্ধ্যেয় কি এসেছিল, সেই কি আমার বাবা-মাকে খবর দিয়েছে? ব্যথার সময় কেন আসে? সারাদিন তো তাকে দেখলাম না! আজ রাতে কি তবে সে আসবে? জেগে বসে আছি তার অপেক্ষায়।হঠাৎ আবার ব্যথা, কিছুক্ষনে তার উপস্থিতি অনুভব করলাম।একইভাবে আমায় সান্তনা দিচ্ছ,আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আবচ্ছা চোখে দেখলাম মানুষটি একটা মেয়ে। বয়স কম হয়তো আমারই মতো। এভাবে আরও দুদিন কেটে গেছে,সে রোজ রাতে আসে আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে সান্ত্বনা দেয়, ওষুধ দেয়,আমি জ্ঞান হারায়। বলে রাখা ভালো ইদানিং আমার ব্যথাটা যেন কিছুটা কমেছে আগের তুলনায় অনেকটা কম জোরালো। বলতে গেলে এখন সারাদিনে ব্যথা হয় না খালি রাত হলেই ব্যথা আসে সাথে সেও। এভাবে চলতে চলতে একদিন ঠিক করলাম যতই ব্যথা আসুক কিছুতেই আর জ্ঞান হারালে চলবে না তার সাথে আমাকে দেখা করতেই কে সে? কেনই বা সে খালি রাতেই আসে?আমাকে জানতেই হবে।

সেদিন রাত্রে যখন ব্যথা উঠলো তখন ব্যথার কথা ভুলে আমি জ্ঞান না হারাবার চেষ্টায় মত্ত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিছুক্ষণ ব্যথায় ছটফট করার পর সে টেবিলে রাখা কোন ওষুধ দিল।না সেদিন আমি অজ্ঞান হয়নি। কিছুক্ষণ পর আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে একটা বছর বাইশের মেয়ে। তাকে দেখতে অপূর্ব সুন্দর। আমি স্কুলে-কলেজে সত্যি এত সুন্দরী আমি কাউকে দেখিনি‌।এই প্রথম দেখলাম। খুব লম্বা নয় মাঝারি লম্বায়, লম্বা চুলে তার ছোট্ট মুখখানা আমার দৃষ্টিটাকে কিভাবে যে বেঁধে রেখেছিল তা আজও আমি বলে বোঝাতে পারিনা। আমি বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে খালি চেয়েছিলাম। সে হেসে বলল আর কষ্ট হচ্ছে না তো। আমার গলা থেকে খালি না ছাড়া আর কিছু বেরোলো না। ধীর পায়ে সে দরজার পাশে গিয়ে বসল। ঘরটায় একটা নীল আলো জ্বলছে অতটা জোরালো না হলেও তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল "তোমার খুব কষ্ট হয়না যখন এই ব্যথা ওঠে" আমি বললাম তা হয়।তবে এতদিনে কষ্ট পাওয়াটা অভ্যাস হয়ে গেছে এখন অতটা কিছু মনে হয়না। মেয়েটা অবাক হয়ে বলল কিন্তু কেন হয়? আমি বললাম জানিনা এর উত্তর হয়তো স্বয়ং উপরওয়ালার কাছেও নেই। মেয়েটা তার মিষ্টি নরম গলায় কোন অচেনা গান গুন গুন করে দু'লাইন গেয়ে আমাকে প্রশ্ন করল তুমি গান গাইতে পারো। আমি হেসে বললাম একটু-আধটু পারি,তা তুমি ওরকম মনমরা হয়ে বসে আছো কেন? অসুবিধা থাকলে আমায় বলতে পারো। এই কথাটা কেন বললাম আমি জানিনা। আমি তাকে চিনিও না। এখনো পর্যন্ত নামই জানি না, আমার উঠার ক্ষমতাও নেই তবু কেন যেন ওকে খুব আপন বলে মনে হলো। সে বলল “তোমার ব্যথা দেখলে না আমারও ব্যাথার কথা মনে পড়ে।এইতো সেদিন যেন খুব ব্যথা উঠেছিল ওরা আমাকে খুব ব্যথা দিয়েছিল।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম কারা তোমাকে ব্যথা দিয়েছিল আর কেন? জবাবে সে কিছু বললো না, মাথা নামিয়ে নিলো। শুধু বলল “আজ তবে আসি”। সে নিঃশব্দে দরজাটা টেনে বেরিয়ে গেল। পরদিনও ঘুম থেকে উঠে খুব বেলা হয়ে গেল ঘুম থেকে উঠে ওষুধ খেয়ে নিলাম।অন্যদিনের তুলনায় আজ কিছুটা নিজেকে সুস্থ বলে মনে হচ্ছে। অনেকদিন হলো ফোনটা দেখিনি। ফোনে ডাটাটা অন করতে একগুচ্ছ মেসেজ এল হোয়াটসঅ্যাপে।বন্ধুদের মেসেজ, খোঁজ নিচ্ছে সকলেই আমি কেমন আছি কিন্তু কাউকেই রিপ্লাই করা হয়নি তাই সবাইকেই একসাথে গ্রুপে বলে দিলাম এখন কিছুটা সুস্থ আছি। মিনিটের মধ্যেই গ্রুপে একসাথে সকলের আড্ডা আবার জমে উঠলো। ফেসবুক টা খুলে নোটিফিকেশন গুলো চেক করতে দেখলাম প্রোফাইল পিকচারের লাইক কমেন্টের বন্যা হয়েছে।প্রোফাইল খুলে পোস্টটা দেখলাম চারশোর বেশি রিয়াক্ট পড়েছে অনেক কমেন্টও এসেছে। ছবির দিকে চোখ পড়তেই চোখটা ভারী হয়ে এলো। শেষ শো এর আগের শো তে ছবিটা তোলা। কবে যে আবার আগের জীবনে ফিরে যাব জানিনা। ফোনটা পাশে রেখে কিছুক্ষণ আগে রেখে যাওয়া খাবারটা খেয়ে নিলাম। রাত্রে বাবা-মাকে সেই মেয়েটার কথা বলতে চেয়েও বলিনি,এইসময় এ কথা শুনলে তারা হয়তো ভাববে আমার শরীর হয়তো আর বিগ্ৰেছে, তাই উল্টাপাল্টা জিনিস দেখছি। ন'টা নাগাদ ওষুধ খেয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে আমাকে নাড়িয়ে ডাকলো আমি উঠতেই সে বাধা দিয়ে বলল উঠো না! শুয়ে থাকো আমি দরজার পাশে গিয়ে বসছি। সে দরজার পাশে বসে বলল ”আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি!” হ্যাঁ দু চোখ জুড়িয়ে এসেছিল। তুমি কেমন আছো? সে বলল “আমি তো নেই বললেই চলে..। আচ্ছা আমি “তুমি অসুস্থ হওয়ার আগে কি করতে?” আমি বললাম আমি গিটার বাজাতাম আমার একটা দল আছে তাদের সাথে একসাথে গিটার বাজিয়ে প্রোগ্রাম করতাম। “জানোতো আমারোনা গান শেখার খুব ইচ্ছে ছিল। ভর্তিও হয়েছিলাম গান শেখার জন্য। অনেক কিছু শিখেছি। তারপর তারপর হঠাৎ একদিন...”‌। ওর কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎই কারেন্ট চলে গেল সারা ঘর অন্ধকার। সে সেখানেই বসে বলতে লাগলো। “বাবা রিক্সা চালায়, মা বেশকিছু ঘরে ঝিয়ের কাজ করে, বড় অভাব ঘরে। পড়াশোনা শেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি কোনদিনও কিন্তু গান শেখার ইচ্ছা ছিল। কোনদিনও বলিনি বাবাকে। ভয় লাগতো। সারাদিন তো বাবাকে দেখতে পায়না আর রাত্রে বাবা নেশা করে বাড়ি ফেরে। মাকে মারে, কখনো কখনো আমাকেও..তাই বলতে পারিনি। আমি যখন 18 বছরের হয় তখন মা আমাকে একটা ঘরে কাজ খুঁজে দিলো,বেশ কিছু বছর টাকা জমিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির পেছনদিকে অনেকটা গিয়ে মোরের বাঁকে একজন গান শেখায় তার কাছে গান শিখতে শুরু করেছিলাম।” এতটা বলেই সে থামল। পরিবেশ টা কেমন যেন‌ হয়ে গেছে, তখনই কারেন্ট ‌চলে এলো।ওই আলোতেই দেখলাম মেয়েটির চোখে জল। “আমি কিছু বলতেই যাচ্ছিলাম সে বলে উঠলো আলো এসে গেছে আজ আসি তবে”। সে উঠে চলে গেল। 

আরও দু দিন কেটে গেলো একই ভাবে।এখন আমার শরীর বেশ সুস্থ বলে মনে হচ্ছে। শরীরে বেশ বল ফিরে পেয়েছি। সে রোজ রাতে আমার সাথে অনেক ক্ষন গল্প করে। দুদিনে তার নাম জানতে পেরেছি, ইন্দিরা...।

আশ্চর্য রকম ভাবে সেদিন সকাল থেকে একবারও ব্যাথা এলোনা, সন্ধ্যেতেয় না, এমনকি রাত দশটার আগে পর্যন্ত না। শুয়ে শুয়ে তার আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম।কিন্তু আজ যেন আমার অপেক্ষার শেষ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একঘন্টা.. দুঘন্টা.. কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি জানি না। একসময় অধৈর্য হয়ে যখন সে আসবে না মনস্থ করেছি ঠিক সেই সময় খুব জোরে ব্যথা উঠলো। এত জোরে ব্যথা এই দীর্ঘ কয়েক মাসে কখনো উঠেনি। কষ্টে মরেই যাচ্ছিলাম।ব্যথায় গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না যে চিৎকার করে কাউকে ডাকবো। ব্যথায় ছটফট করতে করতে যখন বিছানা থেকে পড়েই যাচ্ছি তখন সে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল “কিচ্ছু হবে না তোমার একটু শান্ত হও আমি এক্ষুনি ওষুধ দিচ্ছি।” পাশের টেবিলে হাতরে কোন ওষুধ না পেয়ে সে ছুটে বাইরে গিয়ে কোন একটা ওষুধের বাক্স হাতে করে নিয়ে এল।বাক্সের একটা প্যাকেট থেকে একটা ওষুধ আমার মুখে দিয়ে কিছুটা জল খাইয়ে আমার মাথাটা বালিশের উপর রেখে দিল।এরপর কি হয়েছে আমি আর জানি না।

আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেছি। মা বাবা অতুল কাকু সবাই এসেছিলো।

বিগত কয়েক মাসের তুলনায় আজ নিজেকে অনেক বেশি অসুস্থ বলে মনে করছি। বিছানা ছেড়ে উঠার ক্ষমতা হয়েছে। অবস্থার উন্নতি দেখে মা-বাবা অতুল কাকু সবার মনে আশার আলো দেখা দিয়েছে,আমারও নিজেকে অনেক বেশি সুস্থ বলে মনে হচ্ছে। আর ব্যথা ওঠেনি। এই নিয়ে পাঁচ দিন হল। চলাফেরার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছি মুখে খাবারের স্বাদ এসেছে। বলতে গেলে কিছুটা আগের জীবনে আবার ফিরে এসেছি। আরো দু-তিন দিন আমাকে অবজারভেশনে রেখে তারপর রিলিজ করে দেবে বলে ঠিক করেছেন অতুল কাকু। সকালের ওষুধ দিয়ে তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন হঠাৎই আমি তাকে ডেকে বসলাম। অতুল কাকু বলল “হ্যাঁ কিছু বলবি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা তোমাদের এখানে কি আমার বয়সে বেটে সুন্দর দেখতে কোন নার্স আছে? অতুল কাকু কিছুটা অবাক হয়ে বলল “কেন তুই জেনে কি করবি?” আমি বললাম না আসলে কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাত্রিবেলা যখন আমার ব্যথা হতে তখন একজন অল্প বয়সী মেয়ে আমাকে ওষুধ দিত আর আমার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করতো। দিনের বেলা কোন দিনও আসেনি তো তাই ভাবলাম হয়তো রাতে ডিউটি পরে খালি।

“রাত্রে! কিন্তু বিগত কয়েকদিন ধরে তো রাত্রে সন্ধ্যা দিদি আর তুলসী ছাড়া বাকি তো সব ছেলে নার্স ডিউটিতে আছে। তুই কাকে দেখেছিস? ঠিক দেখেছিস তুই ওটা মেয়ে ছিল?” আমি গলার স্বর দৃঢ় করে বললাম আমি ঠিকই বলছি অতুল কাকু আমি ঠিকই শুনেছি ও মেয়ে ছিল। আমি দেখেছি ওকে। “না সেটা তো হতে পারে না তবে.....” তবে কি অতুল কাকু? পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে একটা ছবি বার করে আমার চোখের সামনে ধরে বলল “দেখতো এই মেয়েটা কি না?” আমি দেখলাম ছবিটা একটা খবরের কাগজের। তাতে একটা রঙিন ছবি একটা মেয়ের বছর বাইশের। হ্যাঁ..হ্যাঁ..হ্যাঁ.কিন্তু মেয়েটা...। মেয়েটির ছবির মাথার ওপরে বড় বড় করে যা লিখা আছে সেটা দেখে আমার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। অতুল কাকু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল “জানিনা তুই সত্যি বলছিস কিনা তবে তুই যদি সত্যিই একে দেখে থাকিস তবে এটা অলৌকিকে থেকে কম কিছু নয়।” কিন্তু এটা কি করে সম্ভব কাকু। মারা যাবার পর কাওকে কিভাবে দেখতে পাওয়া যায়? অতুল কাকু বলল “জানি না রে... কিচ্ছু বছরে পরছি না।” খবরের কাগজে ছবিটা উপরে লেখা ছিল...“২২ বছর বয়সী এক যুবতী ধর্ষিত”। অতুল কাকু বলল “সপ্তাহ খানেক আগেই কয়েকজন মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে। যখন নিয়ে এসেছিল তখন ওর অবস্থা খুব খারাপ ছিল।‌ দুদিন আমাদের এখানে ট্রিটমেন্টে ছিল। হঠাৎ হঠাৎ করেই তোর মতই পেটে যন্ত্রণা উঠত। তারপর মেয়েটির মৃত্যু হয়। পুলিশ খোঁজখবর করে জানতে পারে মেয়েটি গান শিখতে গিয়েছিলো, বাড়ি ফেরার পথে কেউবা কারা তার সাথে এই দুষ্কর্ম টি করে। অনেকক্ষণ যন্ত্রণায় ছটফট করে আশেপাশে কেউ ছিল না,অন্ধকার গলি তার পাশেই ফাঁকা মাঠ সেখানেই। মেয়েটির বাবা রিক্সা চালায় এবং জুয়া এবং মাদে সব টাকা ওড়াতো। মেয়েটি‌ একটা বাড়িতে কাজের লোকের কাজ করতো। পুলিশ বাড়ির লোকের খবর দেয়।”

আরো দুই দিন আমাকে অবজারভেশনে রাখার পরও আমার ব্যথা উঠেনি। জানি না কি বলবো? কিভাবে আমার এই অজানা রোগ সেরে উঠলো? শুধু এটুকু জানি হয়তো সেই মেয়েটির জন্যই আজ আমি আমার সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পেরেছি কষ্ট শুধু একটাই তাকে ধন্যবাদ টুকু জানানোর উপায় আমার কাছে নেই। শুধু তার নান আর অপূর্ব সুন্দর মুখখানা আমার কাছে তার স্মৃতি হিসেবে থেকে গেল। অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েও এখনো পর্যন্ত তার কথা ভুলে উঠতে পারিনি। নিজের শেষ রক্ষা না করতে পারলেও আমাকে দিয়ে গেল একটা উপহার।


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024