উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -28
দেবীদাসের সাক্ষাৎ ডায়েরীতে ভদ্রলোকের নামতো নেই-ই, এই প্রথম দেখল ভদ্রলোককে। তবে কি তার বাবার সাথে পরিচয় আছে! হতে পারে, বাবার সাথে বহুজনের পরিচয় আছে যেহেতু তিনি একজন বিগ ইন্ডাষ্ট্রিয়ালিষ্ট।
ওর পরিচয় জানতে চাইলে পর প্রথম প্রশ্নের উত্তর চাইলেন ড্রাইভার। উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলে দেবী রায়, বাবাকে আপনি চেনেন? না। কিন্তু আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি।
ব্যাকগ্রাউন্ডের তথ্য? চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। দেবীদাসের অতীত নোংরামীতে পরিপূর্ণ তার অজানা নয় ।
মুকুলকে জানতেন ?
মুকুল অর্থাৎ মুকুল বক্সী এই শহরের খ্যাতনামা এ্যাডভোকেট তারাপদ বক্সীর একমাত্র আদুরে কন্যা। কি মনে পড়েছে?
ট্যারা চোখে তাকিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করলেন, গভীর ভালোবেসে কেনই বা আপনাকে ত্যাগ করল।
অন্তর্যামী ভদ্রলোকের কথা গুলো শুনেই ঘামতে শুরু করলো। ও মনে মনে চিন্তা করতে থাকলো মুকুলের কথা কোন দিন কোন মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারেনি সে। ওর সাথে কি করে ভালোবাসা হয়েছিলো তা আজ অবধি মনে আছে। সে একজন এমন স্মার্ট মেয়ে ছিলো যে কোন ইয়ং ছেলে ওর কাছে ঘেঁসতে পারতো না। মেলামেশা তো দূরের কথা, ওর সংস্পর্শে আসা ছিলো অত্যন্ত দুঃসাধ্য। বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী রতন মজুমদারের একমাত্র ছেলে স্বপন তাদের পাঁচ বন্ধুর সাথে চ্যালেঞ্জ করেছিলো, যদি মুকুলকে কেউ নিজেদের আয়ত্বে অর্থাৎ ওর সাথে প্রণয় লীলা শুরু করতে পারে, তাকে পরীক্ষার পর পুরী নিয়ে যাবে। যাতায়াতের ভাড়া ও অন্যান্য যাবতীয় খরচা সে বহন করবে।
ধীরে ধীরে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। কেউ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে পারল না। এবার দেবীর পালা। একে যে জয়ী হতে পারবে এর কোন গ্যারেন্টি নেই। তবুও প্রতিযোগিতায় সামিল হতে হলো কারণ ওদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হবে।
কিন্তু প্রতিযোগিতায় সে যখন সামিল হচ্ছে তাকে পরাজিত হলে চলবে না। তিন দিন পর পাড়ারই এক মস্তান বাচ্চুদার কাছে শলা পরামর্শ করে তাকে পথ বাতলে দিলো। অবশ্য কার্য হাসিল হলে পর সেলামী স্বরূপ কিছু টাকা ওকে বকশিশ দিতে হবে।
সেদিন বিকেল। সূর্যের রক্তিম আভা ম্লান হতে চলেছে। শহরের এক কোণে থালার মতো সূর্যটা সারাদিন ক্লান্তির অবসাদে তাড়াতাড়ি বিদায় নেবার জন্য ব্যস্ত। মুকুল তার প্রিয় আদুরে সাদা ধবধবে এ্যালসিসিয়ান ডগটা নিয়ে নিজের বাড়ীর অভিমুখে দ্রুত পা বাড়িয়েছে। প্রতিদিন স্কুল হতে বাড়ীতে ফেরার কিছু পরেই নিকট পার্কে। বেড়াতে আসে। ওর নিত্য অভ্যাস বেড়ানো। আজকের মতো অন্য দিন এতো লেট করে না বাড়ী ফিরতে। একটু পরে শহরের বুকে অন্ধকার নেমে আসবে। তাই দ্রুত গতিতে পা দুটো চালাচ্ছিল। পথি মধ্যে দুর্ধর্ষ বেশ লম্বা চওড়া লোকটা আটক করবে কল্পনা করেনি। একটু দূরে একটা কালো রঙের এ্যামবাসাডার দাঁড়িয়ে ছিল।
লোকটা মুকুলের পথ রোধ করে বলল, এই রকম মেয়েটিকেই নিশিবন্ধু করতে চাইছিলাম। কোন ভয় নেই ডারলিং, মাত্র কয়েক ঘন্টা থাকবে কাছে, তারপর এইখানেই পৌঁছে দেবো। ফুটফুটে জ্যোৎস্নার ন্যায় এক সুন্দরী রাজকন্যাকে কি সহজে কেউ ছাড়তে চায় ? হাতে বেশী সময় নেই, ভদ্রমেয়ের মতো চটপট ট্যাক্সিতে উঠে পড়ো, নতুবা -
মুকুল ভয়ে কাঁপতে থাকল। মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারল না। চোখের সামনে ভেসে উঠল গতকাল পেপারের মধ্যখানের পৃষ্ঠা। বড় বড় হরফে লেখা ছিল, “এই বর্তমান যুগে কি নারী ধর্ষণের পালা কমবে না? গতকাল অমুক জায়গায় অমুক এক গলির মধ্যে এক আঠার / উনিশ বৎসরের অবিবাহিত মেয়েকে একা পেয়ে তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে, ফলে সেই মেয়েটির অবস্থা এমন শোচনীয় যে,...
মুকুল চিৎকার করে উঠে। মুকুল চিৎকার করে উঠতেই লোকটা মুকুলের মুখটাতে রূমাল চাপা দিয়ে ট্যাক্সির ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল, ঠিক সেই সময় মটর সাইকেলে চড়ে বীর পুরুষের মতো ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো দেবীদাস। হাতে রিভলভার, অবশ্য ওটা নকল। রিভলভারটা হাতে শক্ত করে ধরে নবাবী কায়দায় বেশ গম্ভীর গলায় বলল, ওকে ছেড়ে দিন বন্ধু, নতুবা ছয়টা গুলি বুকের মধ্যে ভেদ করবে। আমার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট কোনদিন হয়নি।
লোকটা ভদ্র সন্তানের মতো ছেড়ে দিল। মুকুল মুক্তি পেয়ে দেবীর কাছে এসে হাঁপাতে শুরু করল। সত্যিই একটা রোমান্টিক ঘটনা ঘটে গেল যেন। লোকটা ভয় পেয়ে নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। অর্থাৎ দেবীদাসের কথা মত কাজ করল। এবার না জানার কোন প্রশ্নই উঠে না। বন্ধুদের কাছে প্রতিযোগিতায় জিততে গিয়ে সে সত্যিই মুকুলের প্রেমে পড়বে দেবী, মনে হয় জীবন অভিধানে কোন জায়গাতে লেখাছিল বলে মনে হয় না। ভালোবাসা যে কি জিনিষ জানতো না অনেক সাহিত্যিকের প্রেমের গল্প / উপন্যাস পড়েছে সে, তখন হয়তো বই এর মধ্যে নায়ক / নায়িকার প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুভূতি বা শিহরণ জানত না সত্য কিন্তু বাস্তবে যে এর মূল্য বা তাৎপর্য কতখানি তা প্রেমে না পড়লে বোঝা যায় না। বিশেষ করে ঐ ঘটনা ঘটে যাওয়ার কয়েকদিন পরে যখন দেবীদাসের জন্ম দিনে মুকুলের বাবা নিমন্ত্রিত হয়ে এসে ছিলেন তাদের বাড়ী, সাথে মুকুল ও ছিল। সে কখনো জানতো না মুকুলের বাবা ছিলেন তার বাবার হিতৈষী বন্ধু।
দিন কয়েক পর বন্ধু মহলে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হলো। তার বলার প্রয়োজন হলো না মুকুল তার আয়ত্বে এসেছে কিনা। তার সাফল্যের পুরস্কার স্বরূপ চাইল সকলে মিলে একদিন পিকনিকে যাবে এবং মুকুলও তাদের সাথে যোগ দেবে। পিকনিক হতে ফেরার সময় তারা তার বুদ্ধির তারিফ করল এবং দেবীকে বিজয়ী সম্মানে ভূষিত করল।
এরপর তাদের প্রণয়লীলা বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল। তাদের ভাব ভালোবাসার লীলা কিভাবে নিজেদের মধ্যে বিস্তার করতে হয় কেউ জানিয়ে দিলো না। তারা দুই লীলা সহচরী যত্র তত্র একই সঙ্গে যাওয়া আসা ও প্রকাশ্যে দিবালোকে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতো। এমন কি উভয়ে স্থির করেছিলো, পড়াশেষে হলে তারা দুজনে কপোত কপোতীর ন্যায় সুখের নীড় বাঁধবে।
অবশ্য বন্ধু মহলে এই গুঞ্জন অনেক আগেই উঠেছিল। এইভাবে আননন্দ উল্লাসে পর পর তিন বছর কেটে গেলো। কখন যে দিন গুলো নদীর স্রোতের মত পেরিয়ে যাচ্ছিল জানতেই পারল না। বন্ধুদের মধ্যে অনেককে ত্যাগ করতে হল দেবীদাসকে। নিজের জীবনের লক্ষ্যকে অনুসরণ করে ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। সে ও মুকুল একই পথের যাত্রী, ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলেছে তাদের জীবন সঙ্গী নির্বাচনের অন্তিম লগ্নের দিকে।
কিন্তু কোনদিন কল্পনা করেনি দেবী, তারা দুজনে যে প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিল। তা ঝটিকাঘাতে শেষ স্নিগ্ধ দীপশিখা একদিন হঠাৎ নিভে যাবে। কোন দিন বন্ধু মহলে। কেউ কল্পনা করতে পারেনি মুকুল ও দেবীর মধ্যে প্রেমের বন্ধন রজ্জু একদিন ছিন্ন হয়ে যাবে। শুধু ওরা কেন, যে কেউ তাদের প্রণয় ইতিহাস শুনে থাকলে বিশ্বাস করবে না। তাদের বিচ্ছেদকে। কারণ অবশ্য ছিল একথা অস্বীকার করা যায় না। প্রেমের খেলায় পরাজিত তো হল, কিন্তু পরাজিতের যে এতো জ্বালা তা তার জানা ছিল না।
বানবিদ্ধ পক্ষীর ন্যায় ছটপট করতে থাকল মুকুলের সাথে বিচ্ছেদের পর। সমস্ত শরীরের দংশনের জ্বালা অনুভব করতে লাগলো। অতীত কাহিনী তার স্মৃতিপটে ভেসে যেতে লাগলো। সেই বিকাল, সেই পার্ক, সিনেমা ও পাশাপাশি বসে গল্প করা। কিন্তু কেন এমন হলো ?
তবে কি দেবীদাস বন্ধুর সাথে হাত মিলিয়ে বারাঙ্গনালয়ে হাজির হয়েছিল বলে ? তাই যদি হয় ও জন্য মুকুলই দায়ী, হ্যাঁ-হ্যাঁ দেবী কর্কশ কণ্ঠে বলবে, এর জন্য মুকুলই দায়ী। কেন সে তার প্রতি অবিচার করল। সে তো তার কাছে স্বীকারই করেছিল ভুলবশতঃ এক চরিত্রহীন লম্পট বন্ধুর পাল্লায় পড়ে পতিতালয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু ওর পরে দ্বিতীয় বার সে স্থানে যাবার চেষ্টা করেনি। তবে কি সুমন্তই তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়াল ?
দেবী সেদিন মুকুলের কাছে অপমানিত হয়ে ফিরে আসছিল, সেদিন সুমন্তকে দেখেছিল ওদের বাড়ীতে। না-না সে অত্যন্ত ভালো ছেলে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। এ ভুল ধারণা। দেবীদাসের ও মুকুলের বিচ্ছেদের জন্য কেউ দায়ী নয়। এমন কি তার লম্পট বন্ধু রন্টুকেও দায়ী করে না। দায়ী তার ভাগ্য। নইলে কেনই বা রন্টুর সাথে পতিতালয়ে হাজির হবে সে। সেদিনের ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
Comments