Sunday, August 28, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -17


 


শ্যামলীদির মুখপানে তাকাতে তাকাতে এক সময় ওর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলাম। মনে তবুও ভয়, জানিনা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়। শ্যামলীদিকে

বার বার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পাইনি শুধু ওর মুখ দিয়ে একথা শুনতে পেয়েছিলাম ওখানে গিয়ে দেখতে পাবো ।


 দেবীবাবু নিজে ড্রাইভ করছেন । সোঁ সোঁ শব্দে পাশের বড় বড় মাথা উঁচু করে প্রতিযোগিতায় সামিল হওয়া বাড়ীগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে । হাজার হাজার মানুষের মিছিলকে দুফাক করে তীরের মতো চলে যাচ্ছে গাড়ীখানা । বড্ড পাকা হাত দেবীবাবুর । ভয় যে পাচ্ছিলাম না তা নয় । ধীরে ড্রাইভ করতে বললাম । হয়তো আমার কথা তিনি শুনতে পেলেন না । 


দেখতে দেখতে একসময়ে একটা প্রকাণ্ড বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ীখানা । দেবীবাবু আমাকে নেমে আসতে বললেন । আমি গাড়ী হতে মাটিতে নেমে প্রকাণ্ড বাড়ীটার পানে তাকিয়ে ভাবতে থাকি এখানে কিসের জন্য এলাম । ওর কথায় ভাবনাকে দূরে সরিয়ে ওকে অনুসরণ করতে করতে হাজির হলাম ঐ প্রকাণ্ড বাড়ীটার তিন তলার উপরে । আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে , কি কারণে , তা জানার জন্য মনে কোন স্পৃহা জাগেনি । ওকে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মনে করে ওকে অনুসরণ করে যাচ্ছি । 


দেখলাম তিন তলার উপরে বহু নরনারীর সমাবেশ । কিন্তু সকলে কাজে ব্যস্ত । মাঝে মাঝে অড় চোখে তাকাচ্ছিলাম । কেউ কেউ আমার পানে তাকিয়ে পুনরায় মুখ নামিয়ে নিচ্ছিলো । হঠাৎ দুটো নার্স এর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠলাম । তবে কি এটা কোন ডাক্তারখানা বা নার্সিহোম ? কিন্তু ডাক্তারখানার কোন নিদর্শন দেখছি না ।


 নার্স দুজন এগিয়ে এসে দেবীবাবুকে কিছু বলার চেষ্টা করলেন , কিন্তু দেবীবাবু বাধা দিতেই মুখ বন্ধ করল । আমার মনটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল । মনে হচ্ছে আমি যেন কোন ইন্দ্রজালে আবদ্ধ হয়েছি যার ফলে কিছু করতে পারছি না । 


এক সময় দেবীবাবু বলে উঠলেন , ঐ রুমটার ভেতরে যান আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি । 


ওকথা শুনে আমি কোন এক অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলাম । আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল । 


দেবীবাবু বললেন , কোন ভয় নেই , এটা নার্সিংহোম , কেউ আপনার ক্ষতি করবে না।


 আমি জেদ নিলাম আমি একা যাবো না । দেবীবাবু কথা না বাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন , আমিও করলাম ।


 আমি যেই মাত্র প্রবেশ করেছি , একটা ছোট মেয়ে বয়স বছর পাঁচ ছয়ের কাছাকাছি , ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মতো পরিস্কার গায়ের রঙ তার , আমার চোখ ওর চোখ এক হতেই মেয়েটা বিছানা হতে নেমে আমার আঁচল ধরে টানতে লাগলো ও কাঁদতে কাঁদতে বলল , মামনি , কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে মামনি , কেন আমাকে সাথে নিয়ে যাওনি মামনি , মামনি কথা বল মামনি ।


কি করব ভাবছি। ওর কথা শুনে শরীরটা তো শীতল হয়ে গেলো । সহজ , সরল শিশুর কোমল স্পর্শে আমার হৃদয়ে মাতৃত্ব জেগে উঠলো অনাস্বাদিত পূর্ণ মাতৃত্বের কোমল স্পর্শ আমার অন্তরকে স্বর্গীয় আনন্দে অভিভূত করে তুলল । ভুলে গেলাম আমি বারবণিতা রমা । 


মা তুমি কথা বলছ না কেন ? মেয়েটি কথা বলতে বলতে ওর ফুলের কুঁড়ির মতো ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকল ।


 বিলম্ব না করে মেয়েটিকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরলাম । বার বার ওর ঠোঁটে চুমু খেতে থাকলাম । আমি তোকে ছেড়ে আর যাবো না মামনি । আর কোন দিন তোকে কষ্ট দেব নারে । গভীর অপত্য স্নেহে কচি শিশুটির মুখে আমার মুখ ঘষতে থাকলাম । ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমি দারুন অন্তর্বেদনায় চিন্তা করতে লাগলাম । মা হতে তো জীবনে পারব না । মা হবার আশা অনেক আগে মুছে ফেলেছি কিন্তু একে কি মেয়ে বলে বুকে টানতে পারব না ? বারবনিতা বলে কি মাতৃত্বের সুকুমার প্রবৃত্তি কোন অংশ আমার দেহে নেই ?


 মেয়েটি কে- তা একটু পরেই জানতে পারবো । তার আগে আমার হৃদয় মরুভূমিতে মরুদ্যানের সজীবতা নিয়ে আসি । দেবীবাবু দূরে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন । জানি না তার অন্তরে কিরূপ প্রবাহ চলছিল । 


ধীরে ধীরে মেয়েটিকে কোলে তুলে ওর বিছানায় নিয়ে গিয়ে ওকে আদর করতে থাকলাম । এমন সময় একজন নার্স প্রবেশ করে বললেন , এবার তোমার মাকে ফিরে পেয়েছো ময়না , এই দুধটুকু খেয়ে নাও ।


 ময়না যে মেয়েটির নাম তা জানতে পারলাম । ময়না বলল , সে আমার হাতে দুধ খাবে । নার্স স্বপ্নাদেবী আমাকে দুধের গ্লাসটা ধরিয়ে বেশ সুমিষ্টি কণ্ঠে বললেন , আপনি ওকে খাইয়ে দিন । বেচারা কোন দিন আমার হাতে কোন খাবার খেতে চায় না । এখন আসি ময়না , তোমার মা তোমাকে অনেক আদর করবে । স্বপ্নাদেবী অপেক্ষা না করে দেবীবাবুকে কি যেন বলে বাইরে বেরিয়ে গেল । 


যত্ন সহকারে ময়নাকে দুধ খাইয়ে ওকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করলাম । ঘুমপাড়ানির গান আমার জানা নেই , তাহলে উপায় । ময়নার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে তার অবসন্ন দেহটা এক সময় ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে গেল । ধীরে ধীরে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেবীবাবুর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম মেয়েটি কে ? আর কেনই বা আমাকে ওর মা মনে করল । 


দেবীবাবু অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোকে রুমাল দিয়ে মুছে নম্র কণ্ঠে বললেন , বাইরে আসুন বলছি । ওর পিছনে গিয়ে একটা রুমের মধ্যে প্রবেশ করলাম । বললেন , ময়না আমার মেয়ে । নিজের অন্যায় অত্যাচারের জন্য সব কিছু হারিয়েছি । ময়নার মাঝে হারিয়েছি , বাবাকেও হারাতে বসেছি , জানি না ভাগ্য এরপর কতখানি সুপ্রসন্ন । যদি আপনার সাথে সাক্ষাৎ না হতো তাহলে মনে হয় অবলা সরল এক নিষ্পাপ শিশুকে হারাতে বসেছিলাম । আমার অন্যায় অত্যাচারের কথা সময় হলে একদিন বলবো । ময়নার মা যেদিন আত্মহত্যা করল , পরদিন হতে মাতৃস্নেহে বঞ্চিত অবোধ শিশুটি অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো । যাকে বলে সাইকিয়াট্রিক ভিস ওর্ডার । মায়ের আদর আবদারে সে পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কোন আপনজনকে চিনতো না , আমার সংস্পর্শেও থাকতো না । কারো সাথে কথা বলতো না । যদি জোরপূৰ্ব্বক কথা বলতে চেষ্টা করতাম , তাহলে শ্রাবণের বর্ষণের মতো চোখ ফেটে দরদর ধারে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।



                            ক্রমশ...

Saturday, August 27, 2022

ছোট গল্প - উপলব্ধি || লেখক - সিঞ্চিতা বসু || Short story - Upolobdhi || Written by Sinjita basu


 

উপলব্ধি

সিঞ্চিতা বসু 



রান্নাবান্না শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা চোখে পড়লো l দুর্গন্ধটা সকাল থেকেই নাকে লেগে আছে,কিন্তু এখন চোখে দেখে গা গুলিয়ে উঠলো পরমারl সমীর কর্মচারীদের তোয়াক্কা না করেই কাজে হাত,লাগিয়েছে l সামনে স্তূপীকৃত শুকনো গোবর,পাতা পচানো সার,ডিমের খোসা l দুজন লেবার ডিমের খোসাগুলোকে গুঁড়ো করছে l এছাড়া একটা বড়ো ড্রামে জমা আছে ফল সব্জির খোসা,মাছের আঁশ ইত্যাদি রান্নাঘরের ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে তৈরি কম্পোস্ট l ড্রামটা ঢেলে ফেলা হয়েছে উঠোনের মাঝখানে l বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে গেল পরমার- এতো বার বলা সত্ত্বেও সমীর গ্লাভস পড়েনি l দুহাতে গোবর মাখা,গামছা পরা সমীরকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না যে এই লোকটা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা l পাঁশকুড়া তে তাদের এই ফুল ফলের নার্সারী জন্ম সমীরের দাদুর হাতে l দুই পুরুষ ধরে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা  'মহামায়া নার্সারি'র খ্যাতি অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে সমীরের হাত ধরে l শ্বশুর মশাই অবশ্য এটাই চেয়েছিলেন, আর সেজন্যই বিজ্ঞানসম্মতভাবে শিখে আসার জন্য ছেলেকে প্রায় জোর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য l নার্সারি টা সমীরের এখন শুধু পেশা নয় নেশাতেও পরিণত হয়েছে l নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ফুল ফলের আকার আয়তন বৃদ্ধি, গ্রাফটিং করে একটি জবা কাছে আরো তিন চার রকম রং এর জবাগাছের ডাল প্রতিস্থাপন করাতে মজে থাকে সমীর l সন্ধ্যের পর দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত হওয়া গাছপালা সংক্রান্ত বিভিন্ন জার্নালে ডুবে থাকে l শাশুড়ি মা গত হওয়ার পর থেকে পরমা প্রায় বোবা হয়ে গেছেl টিভিতে সিরিয়াল দেখতে ওর কোন কালেই ভালো লাগেনা, গান শুনেই বা কতটা সময় কাটানো যায়? মরীয়া হয়ে সমীরের সাথে এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে চায় পরমা,কিন্তু ' হুঁ 'বা 'না 'এর বাইরে কোন শব্দই বেরোয় না তার মুখ থেকে l অথচ এই মানুষই যখন তার কাজকর্ম নিয়ে,হরমোনের প্রয়োগ,ছত্রাকের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করে, তখন কথার কোনো

অভাব হয় না l চেন্নাই, পুনে,ব্যাঙ্গালোরের কৃষিবিজ্ঞানীদের সাথেই বেশি আলোচনা হয় ওর l সমীরকে তো প্রায়ই ভিডিও কলিং করতে দেখা যায় ডক্টর মহেশ মঞ্জরেকার বা প্রফেসর নাইডুর সাথে l প্রথম প্রথম পরমার ও খুব আকর্ষণ জন্মেছিল বিভিন্ন ধরনের ফুল ফলের গাছপালা ও অর্কিডে l সময় পেলেই সে সমীরের কাছে শুনতে চাইত বিভিন্ন গাছের পরিচর্যা,শিখে নিতে চাইতো নানা ধরনের ফুল ফলের নাম ও প্রজাতি l রান্নাঘরের সবজি ফলের খোসা,ডিমের খোলা যত্ন করে একটা মুখ ঢাকা ড্রামে জমা করে  রেখে দিতো l

    ছোট থেকে শহরে মানুষ হওয়া,আশুতোষ কলেজে পড়া পরমার গ্রামে মানিয়ে নিতে যে খুব অসুবিধা হবে একথা বিয়ের আগের আত্মীয়-স্বজনের মুখে বহুবার শুনেছি সে l খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রীর কলামে বাবা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল,সেই বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরেই যোগাযোগ l বেশিরভাগ বাবাদের যেমন চাহিদা থাকে মানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার,সরকারি চাকুরীজীবি অগ্রগণ্য, বাবার দেওয়া বিজ্ঞাপনে কিন্তু তেমন কিছু লেখা ছিল না l শিক্ষিত,ভদ্র মোটামুটি রোজগেরে হলেই চলবে এমনই ছিল বিজ্ঞাপনের বয়ান l তাই শিক্ষিত,মার্জিত কথা বলা সমীরকে বাবার খুব পছন্দ হয়েছিল l

        গ্রাম্য জীবনযাত্রা সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল পরমা  l নিজেকে চেনে পরমা- বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ সে l সেই আবেগের বশেই বিবাহিত জীবন সম্পর্কে ও শান্ত আপাত গম্ভীর মানুষটার সম্বন্ধে অনেক আকাশকুসুম কল্পনা করে ফেলেছিল l বছর দুয়েকের মধ্যেই সেই মিথ্যে কল্পনার জাল ছিঁড়ে গিয়েছিল l কোন মানুষ তার নতুন বিবাহিত জীবন সম্পর্কে যে এত নিস্পৃহ থাকতে পারে তা সমীরকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না l কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পরমা নিজের বাবা দাদাকেও দেখেছে l কিন্তু কাজের সমুদ্রে শুধু অবগাহন করাই নয়,অন্তহীনভাবে এমন করে নিমজ্জিত থাকা হয়তো সমীরের পক্ষেই সম্ভব  l অদ্ভুত অদ্ভুত উদ্ভিদের ও ফুলের ছবি কালেক্ট করে, তার বিজ্ঞানসম্মত নামসহ ডায়রির পাতায় আটকানোর আগ্রহ সর্বদাই পরমার সাথে দুটো কথা বলার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় সমীরের কাছে l সমীরের দুনিয়ায় পরমার কোন স্থান নেই,ইদানিং সে সমীরের জীবনে একেবারে অনাহুত হয়ে গেছে l শারীরিক আকর্ষণ ও এখন তলানিতে l আজকাল বেশিরভাগ রাতেই সমীর বেডরুমে আসে না,লাগোয়া স্টাডিরুমের ক্যাম্প খাটেই শুয়ে  পড়ে l আগে পরমা এসব নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছে চোখের জল বাঁধ মানতো না,রাতে ঘুম আসত না l পরে ধীরে ধীরে রাগ দুঃখ যন্ত্রণা সব স্তিমিত হয়ে এসেছে l দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনকে বুঝিয়েছে, নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে এই বলে যে এই অনাসক্তির পিছনে অপর কোন নারীসঙ্গ নেই l এ ব্যাপারে পরমা একশো ভাগ নিশ্চিত l শাশুড়ি মা গত হওয়ার পর দুটি প্রাণীর জীবন পাশাপাশি সমান্তরালে বয়ে যাওয়া নদীর মত গতিময়,কিন্তু কখনো তাদের জলরাশি মেলে না l পরমার মাঝেমধ্যে সমীরের এই নির্লিপ্ততা দেখে মনে হয় ও বুঝি এক ছদ্মবেশী সন্ন্যাসী,জাগতিকতাকে দূরে ঠেলে সাধনায় মগ্ন l দিনের বেলা তবুও বাগানে প্রচুর লোকজন কাজ করে, কিন্তু যেই নিঝুম রাত্রি নামে পরমাকে একাকীত্ব গিলতে আসে l তখন নিজেকে পৃথিবীতে ভীষণ অপ্রয়োজনীয় মনে হয় l বিয়ে ঠিক চার মাস পরে শাশুড়ি মার জেদাজেদি তে সমীর তার নিজস্ব গণ্ডী ছেড়ে বেরিয়ে ছিল l সেই প্রথম দুজনের ঘুরতে যাওয়া,সেটাই শেষ l কালিম্পং এর কাছে ছোটা মাংবার পাহাড়ে সেদিন সন্ধ্যে থেকেই অঝোরে বৃষ্টি ঝরছিল ,সাথে মুহুর্মুহু বজ্রপাত l হোমস্টের বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ছিল পরমা l হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি তে আশপাশের পরিমণ্ডল, তিস্তা কিছুটা নজরে আসছিল,আবার পরক্ষনেই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল lসেই নৈঃশব্দের মাঝে অবিরাম বৃষ্টির শব্দ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কেমন যেন সম্মোহিত করে ফেলেছিলো  তাকে l তখন সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে l একটা বলিষ্ঠ হাত তাকে নিজের দিকে টেনে এনেছিল l  কথা বলার অবকাশ পায় নি পরমা,মনে হয়েছিল সেই চুম্বন বুঝি শেষ হবে না,তা বুঝি এই অবিরাম বারিধারার মত সারারাত চলবে l পরমার শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল l  দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডিনারের জন্য ডেকে ফিরে গিয়েছিল হোমস্টের কেয়ারটেকার l রাত গভীর হল,জেগে রইল শুধু আলিঙ্গনাবদ্ধ দুটো শরীর l পরমার মনে,চেতনায় সেই স্মৃতি স্পষ্ট ও অমলিন l আসলে যে স্মৃতি বারবার রোমন্থিত হয় তা যে কিছুতেই  ফিকে হয় না,ভিজে আঙুলে জড়িয়ে থাকা চুলের মতো মেখে থাকে l তারপর থেকে সমীরকে আর এমন করে ফিরে পায়নি পরমা lসেই কটা দিনের জন্য একান্ত নিজস্ব পরিসরে নতুন করে পাওয়া মানুষটা ফিরে এসে আবার নিজের চারপাশে গণ্ডী টেনে নিয়েছে lসেই গণ্ডী পার হওয়ার ক্ষমতা বা যোগ্যতা নেই পরমার l

      আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না, সেই উদ্দাম যৌনতার স্মৃতি আজ বড্ড জ্বালাচ্ছে l মনে পড়লো - "আ লাইফ মেজার্ড ইন মেমোরিস " l

       ধীর পায়ে উঠে এলো সে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল নিজের আটত্রিশ বছরের শরীরটাকে l  চামড়া নিভাঁজ,আলগা করে বাঁধা খোঁপা ভেঙ্গে এলিয়ে পড়া একঢাল চুল l না জানিয়েই সে ইতিমধ্যে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা  বা ডিপ্রেশন থেকে দূরে রাখার জন্য l অনেক ভেবেচিন্তে নাম দিয়েছে 'রাতজাগা তারা ' l সেই জেগে থাকা তারা কখনো তার নিজের মুখ দেখায় না  l স্ক্রিনে বইতে থাকে উত্তরবঙ্গের তিস্তা  তোর্সা,দাঁড়িয়ে থাকে পাইনের সারি,ফুটে থাকে রডোডেনড্রন এর গুচ্ছ,পেছনে থাকে নিশ্চল নিশ্চুপ মৈনাক lজেগে থাকা তারা তখন কখনো আবৃত্তি করে সুনীল গাঙ্গুলীর নীরা,কখনো বা পাঠ করে  'শেষের কবিতা 'থেকে l কোন কোন মন খারাপের রাতে সে বলে যায় কাদম্বরীদেবীর একাকিত্বের কথা l কেউ কেউ বাচিকশিল্পীকে চাক্ষুষ দেখারও ইচ্ছা প্রকাশ করে l 

        পরমা দমবন্ধ করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে অবদমিত করে শরীর মনের তৃষ্ণা l দাঁতের প্রবল চাপে পাতলা ঠোঁটে রক্তবিন্দু ফুটে ওঠে,হালকা হয়ে আসে শরীরের শিহরণ,মনের আলোড়ণ l মুখে ঘাড়ে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিতে হবে,তাই চান ঘরের দিকে এগোলো পরমা l নভেম্বরের মাঝামাঝি, বাতাসে একটা শিরশিরে ভাব -তবুও পরমার কপালে নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম l বাথরুম থেকে ফেরার সময় প্যাসেজ এর জানালার গ্রিলে নাক ঠেকিয়ে বাইরেটা দেখলো পরমা l কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারের নিস্তব্ধতা কে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা আওয়াজ, বাতাস মাতোয়ারা উঠোনের লেবু ফুলের গন্ধে l আনমনেই দাঁড়ালো সে সমীরের ঘরের সামনে, দরজাটা সামান্য ফাঁক করা,ভেতরের আলোর ভগ্নাংশ পরিমাণ বাইরে এসে পড়েছে l তবে কি সমীর এখনো কাজে ব্যস্ত বা পড়ছে কিছু?দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই হোঁচট খেতে হল l  স্তূপীকৃত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের কৌটো এলোমেলোভাবে রাখা আছে  l কি ভীষণ অগোছালো হয়ে আছে ঘরটাl একটা ছোট গোলটেবিলে স্তুপিকৃত কাগজপত্র পাশেই ইলেকট্রিক কেটলি, চায়ের দাগ লাগা খান চারেক কাপ l প্রায় চারমাস সে এ ঘরে ঢোকে নি,ঘর মোছার জন্য রানীদিকেও ঢোকানো যায়নি,কারণ সমীরের একেবারে অপছন্দ তার জিনিসপত্রে কেউ হাত দিক l পরমা দেখল বড় টেবিলটাতে হাতের উপর মাথা দিয়ে সমীর ঘুমাচ্ছে l টেবিল ল্যাম্প এর আলো তার মুখে পড়েছে l কম্পিউটারের স্ক্রিন তখনও জ্বলজ্বল করছে l  সেখানে একটা অসাধারণ একটা জবা গাছের ছবিl   গাছটির পাঁচটি ডালে পাঁচ রঙের ফুল ফুটে আছে l নিচে তার বর্ণনা -গ্রাফটিং করার জন্য মাদার প্লান্টের নাম, গ্রাফটিং এর পদ্ধতি, হরমোনের নাম ও সংকেত ইত্যাদি তালিকাবদ্ধ করা l একদম নিচে হাইলাইট করা আছে সমীরের দেওয়া গাছটির নাম  -'রাত জাগা তারা'l

Friday, August 26, 2022

ছোট গল্প - রূপনারায়ণের ঘাট || লেখক - দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায় || Short story - Rupnarayaner Ghat || Written by Dorpona Gongopadhay


 


রূপনারায়ণের ঘাট

   দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়



নবগ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বাড়ি শুভদীপের পুরনো আমলের সাবেকি বাড়ি। রাম বিলাস বাবু শুভদীপের বাবা ।একদিক সারিয়ে দোতলার চারটি ঘরে বসবাস করেন।  শুভদীপ তার একমাত্র পুত্র ।

বাড়ির পশ্চিমে পুকুর ,পূর্বে বড় উঠোন ,দক্ষিণে ক্ষেত,

উত্তর দিকে রাস্তা ,-রাস্তার ওপারে আবার ক্ষেত সবুজে সবুজ।

রাম বিলাস বাবুর দাদুর আমল থেকেই বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। তাই দেশভাগের পর নিচের ঘর গুলো বাংলাদেশ থেকে আসা পরিবারগুলোকে ভাড়া দিয়ে দেন।

 শুভদীপ দের নিচের ঘরেও বিগত পাঁচ বছর আগেও চারটি ঘরে চারটি ভাড়াটে ছিল।

অনেক কষ্ট করে উহাদের তুলে নিচের ঘর চারটে  সারানো হয়েছিল। প্রতিটি ঘরের কোলে বড় দালান যে যার ঘরের দালানে তারা রান্না করত, বাইরে পুকুর উঠোনে কুয়ো,এই ছিল জলের ব্যবস্থা। আজ থেকে 35 বছর আগে বাঁশ বাগানেই অপকর্ম চলত। দিন বদলালো সবাই বাথরুমের অভাব অনুভব করতে লাগলো। বিশেষ করে শহুরে নতুন বউ শুভদীপের  মায়ের, তাই ওপরের একটি ঘরে আলাদা করে প্যান বসিয়ে পাইপ নামে নিচে পাৎকো সিস্টেম করে পায়খানা ও জল জমার জন্য একটা গর্ত খুঁড়ে ড্রেনিং সিস্টেম এবং কূয়ো থেকে ছাদের উপরে জল তুলে ওপরে কলের বিশেষ ব্যবস্থা,

যখন শুভদীপের বাবা এসব করছিল তখন  ভাড়াটিয়ারা এসব পছন্দ করছিল না, ওরা সবাই মিলে যৌথভাবে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে শুভদীপের বাবার নামে নালিশ দিল। তাতে গ্রাম প্রধান ভাড়াটিয়াদের পক্ষ অবলম্বন করল ,শুভদীপের দাদু তখন কোর্টের দ্বারস্থ হলো সেই থেকে মামলা এত বছর বাদে মিটলো তাও কি ভাড়াটেদের এক ঘরের তিন কন্যার বিবাহ হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে এবং কর্তা অসুস্থ হয়ে মারা গেছে গিন্নি ও অসুস্থ তাই তার বড় মেয়ে এসে তাকে নিয়ে গেল যখন চাবি এমনি দিয়ে গেল,শুভদীপের মাকে,কারন বড়ো মেয়ে শুভদীপের মায়ের বন্ধু ছিল।

দ্বিতীয়জন সরকারি চাকুরে ছিল সে বুঝতো যে আইন ওদের দিকেই তাই জিতবে না মামলা জেনে অন্যত্র বাড়ি করে এই ঘরে তালা দিয়ে চলে গিয়েছিল। অবশেষে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে কেস ডিসমিস হয়ে যায় তৃতীয়জন স্বামী-স্ত্রী থাকতো তাদের দুই পুত্র পুত্রবধূ কেউই কখনো খোঁজ নিতে আসতো না আলাদা কোথাও থাকতো তাই তাদের এই অসহায় অবস্থা দেখে শুভদীপ ওদের বাঁধের পাড়ের বাড়িতে ওদের ব্যবস্থা করে দিল থাকার, আরেকটি ঘর চতুর্থ ঘর বিবাহ হবার পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরত মেয়ে এবং বিধবা মা থাকতো তাও তার বয়স ৪০ ঊর্ধ্ব এরাও অসহায়। তাই শুভদীপ এদেরও বাঁধের পাড়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে থাকতে অনুরোধ করে এইভাবে নিচেটা খালি করে ওরা নিচেটা সারিয়ে নেয়। আর ওই বাঁধের পাড়ের বাড়িটার পাশে মন্দির আছে মন্দিরের পুরোহিত এবং দারোয়ান এই বাড়িটায় থাকতো বাঁধের পাড়ে বাড়িটায়, এখন অন্য টুরিস্টরা আসলেও থাকে। ফলে এই বাড়ি থেকে আয়ও হয় এইসব আয়ের টাকা দিয়ে এই নিচের তলাটা পুরোই সারিয়ে নেয় শুভদীপের বাবা। উঠোনের দক্ষিণ দিকে ঠাকুরদালান এবং ভোগ রান্নার ঘর সবটাই সারিয়ে নেয় আর উত্তর দিকে ঘর গুলোর অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় ও দুটো ভেঙে পাঁচিল দিয়ে বড় গেট লাগিয়ে দেয়। বাকি পড়ে থাকে পূর্ব দিকে চারটি ঘর ,একতলা চারটি, দোতলায় চারটি। ঘর গুলো পিসিমার ভাগের ছিল, আগে পিসীমার ছেলে আসত ঘর পরিষ্কার করত ফসলের ভাগও নিয়ে যেত ইদানিং বছর দশেক আর আসেনা অনেক খোঁজ করে জানতে পারলো যে উনার মেয়ে এখনো বেঁচে আছে এবং শ্বশুর বাড়িতে আছে, শুভদীপ খোঁজ করে সেই পিসীমার ছেলের মেয়ে অর্থাৎ পিসিমার নাতনি শুভদীপের পিসি ঠাকুমা হয় তার বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। গিয়ে দেখল খুব বড় কোলকাতা শহরে বাড়ি কোন জিনিস নেই, নেই--- সব জিনিসে ভর্তি কোন অভাবের চিহ্ন নেই। জিজ্ঞাসা করল। আপনার এসব মেন্টেন হয় কি করে আপনি খাওয়া-দাওয়া করেন কিভাবে আপনার চলে কিভাবে? --- উত্তরে একটু হেসে পিসি ঠাকুমা বললেন টাকার কোন অভাব নেই, তবুও আমার ছেলে মেয়ের অযথা টাকা রোজগারের নেশা ।ছেলে থাকে আমেরিকা তার বাবা মারা যেতেই সে আসেনি,--- বসে আছে মা ! মরে গেলেও সে আসবে না! আর মেয়ে থাকে বম্বেতে, মাঝে মাঝে ঘুরতে আসে ---!

 তোমাদের ওই জঙ্গলে বাড়ি। আমি নিয়ে কি করব আমার ছেলে মেয়েও কখনো যাবে না। ওরা তো কখনো দেখেইনি,--- আমি তবু বাবা-মায়ের হাত ধরে গেছি; চিনি, তোমার ঠাকুমা আমার বৌদি হন। বৌদির সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল আমার একবার যাওয়ার ইচ্ছা হয়। তো চলনা পিসি ঠাকুমা আজই চলো আমি তোমায় গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছি আবার গাড়ি করে ফেরত দিয়ে যাব। যেমনি বলা তেমনি কাজ। একটা ওলা ডেকে শুভদীপের সঙ্গে বাড়িতে তালা দিয়ে পাশের বাড়িতে বলে পিসি ঠাকুমা নবগ্রামে এসে হাজির। তারপর যেন মনে হলো দুই কিশোরী মেয়ে নতুন দেখা হয়েছে। দুই ঠাকুমা শুভদীপের,--- গল্পে মেতেছে রান্নাবান্না শুভদীপের মা করছে, যথাসময়ে খেতে দিল এত আদর আর আপ্যায়ন দেখে বেশ আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ল,  পরের দিন দুজনে সারারাত জেগে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করল। দশটার সময় শুভদীপের দাদু পিসি মাকে ডাকিয়ে তালা ভেঙে দোতলার চারটে ঘর খোলালো তারপর ওরা পরিষ্কার করতে লাগলো মিস্ত্রি ডেকে। মিস্ত্রিরা দুটোর সময় গেল। তখন এসে পিসি মাকে বলে গেল যে বাড়ির অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে, দেয়াল ফুটো হয়ে গেছে জানলা দরজা নষ্ট হয়ে গেছে, খাট বিছানা ঠিক নেই, দেখো কি নেবে আর কি ফেলবে, পিসেমা বলল পুরনো কিছুই আর নেব না সব নতুন করে সাজাবো তিনটে নাগাদ সবাই মিলে ওই চারটি ঘর পরিদর্শনে যাওয়া হলো। একে একে সব ঘরই ঘুরে দেখা হল। প্রতি ঘরেই অনেক আসবাবপত্র খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল দেরাজ টেবিল চেয়ার একটা ঘরে আগেকার পুরনো একটা কলের গানের মেশিন পিসি ঠাকুরমা বলল ওটা চালিয়ে দিতে। মিস্ত্রি চালিয়ে দিল। চলতে শুরু করল রবীন্দ্র সংগীত বাজতে লাগলো, বাড়ি গমগম করে উঠলো, শুভদীপের ঠাকুমা আষাঢ় ধানতোলার টাকায় এবার দুর্গা পুজো হবে ,অনেক লোক বলা হবে। তুমিও থেকে যাও। শুভদীপের ঠাকুরমা বলল যে দুর্গা পুজো কাটিয়ে যাবে। খুব আনন্দ হবে আগেকার মত। ঠিক এমন সময় একটি কবিতা আরম্ভ হলো কলের গানে --- "আমি গোপি বালা এইবারই ছোট বউ ছোট কথা ভীষণ অসুস্থ সবে ছয় মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে সবাই আমাকে ছোটকর্তার অসুখের জন্য দায়ী করছে। আমাকে অপয়া বলছে অথচ উনি নিশ্চিত আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন না হলে এই ছয় মাসের মধ্যে এত বড় অসুখ কি করে বাঁধে, আর ওনার অসুস্থতার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না! সকলেই বললে ছোটকর্তা মারা গেলে আমাকে সহমরণে যেতে হবে। অযথা যুবতীকে ঘরে রেখে কলঙ্কের দায় পরিবার নেবেনা!

মাছ ভেঙে পড়ল মাকে চিঠি পাঠালাম কিন্তু মায়ের থেকে কোন উত্তর এলো না। রাতদিন খাওয়া বন্ধ করে সকলের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগলাম। স্বামীর জন্য হিন্দু ছেলে মুসলিম ফকির এবং মসজিদে গিয়ে মৌলভীর কাছে নানা ওষুধের খোঁজ করতে লাগলাম। একদিন মৌলবী বললে মা, যে কদিন উনি আছেন উনার সঙ্গে থাকো এভাবে রাস্তায় ছুটে কোন লাভ হবে না কিন্তু ওনার কাছে যাওয়ার অধিকার তো আমার ছিল না। সবাই উনাকে ঘিরে রাখত। কারণ ওনার অনেক টাকা পয়সা গয়না গাটি অবশেষে একদিন ওনার কাছে পৌঁছে গেলাম সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার কি দোষ উনি আমার দিকে চাইলেন বললেন পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তোমাকে আমি রাজরানী করে রাখবো এ জন্মে তুমি আমায় ক্ষমা করো বলেই তিনি চোখ বুঝলেন। সকলের রেড়ে করে উঠল। এই অপয়া মেয়েকে কে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে আমাদের ছেলের প্রাণ নিয়ে নিল কি অপরাধ কি অপয়া বাপু!

সকলেই বিকট চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে লাগলো, বাড়ি মাথায় করে তুলল তারপর শোভাযাত্রা সাজিয়ে আমাকেও সাজগোজ করিয়ে সহমরণে নিয়ে গেল ঢাকঢোল খুব আস্তে লাগলো। কি সুন্দর ঘাঁট রূপনারায়ণ ঘাট। নিচে নেমে গেছে। চওড়া সিঁড়ি। জল টলটল করছে---

তারি  পাড়ে উঁচু চিতা সাজানো

সেই চিতার ওপর ধীরে ধীরে ছোট কর্তাকে শুইয়ে দেয়া হলো । তারপর নিয়মকানুন শেষ করে আমাকেও হাত-পা বেঁধে ওই জলন্ত চিতার উপর বসিয়ে দিল আমি খুব চিৎকার করতে লাগলাম সবাইকে বারে বারে বলতে লাগলাম আমি এখান থেকে চলে যাব, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করব না, কখনো আসবো না; আমাকে ছেড়ে দাও! জোরে জোরে ঢাক বাজতে লাগলো আমিও চিৎকার করতে লাগলাম জ্বলন্ত শরীরের জ্বালাপোড়া নিয়ে! হঠাৎ হাতের বাঁধন খুলে গেল তখন পায়ের বাঁধন খুলে রূপনারানের জলে ডুব দিলাম ভাবলাম বেঁচে গেছি কিন্তু না ওরা আমাকে তুলে আনলো তারপর টানতে টানতে নিয়ে আসছিল। হঠাৎ মাথায় একবাড়ি মারল,--- রক্ত ছিটকে গিয়ে লাগলো রূপনারায়ণের ঘাটের পাঁচিলে, 

তারপর সব চুপ! 

আজও তুমি পাবে ওই ধ্যাবড়ানো রক্তের দাগ যারা আমার গল্প শোনাবে। রূপনারায়নে কান পাতবে, ও তোমাদের আমার গল্প বলে দেবে। 

এখনো আমি এই ঘাটে অপেক্ষায়। 

তুমি আসবে তো!

ছোট বাবু!

Thursday, August 25, 2022

উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -5


 


দাদু বললে, কি করে মাঠে এত জল  এল  আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। শরীরটা ছিল।সে সম্ভোগে ব্যস্ত।দেহের অণু পরমাণু  অংশ ভিজে।কিন্তু মন যে শুষ্ক।মনের শূণ্য অংশও অধিকারে নেই তার।সে ছুটেছে পদ্মবনে। সেখানে তার রূপ দর্শনে মোহিত তার মন। এদিকে শরীরলোভি সে খবর রাখে না। ভিজে ভিজে ভালোলাগা শেষে বিরক্তির বিশ্রাম।আর মনলোভি নাগর দখল করে নেয় প্রিয়ার মন। শরীরে তার আসক্তি নেই।ক্ষণিকের আনন্দ নয়, অসীম আনন্দের অনুসন্ধানী তার মন। 

মনোজকে চিনু একটা রাজার গল্প বলেছিল। চিনু বলেছিলো,

এক ছিলো রাজা।সে প্রজাদের রক্ত খেতো।তাদের পরিশ্রমের ফসলের সবটুকু হরণ করে নিত।প্রজারা বেঁচে থাকার জন্য পালিয়ে যেতে  শুরু করলো।শয়তান, রাজাকে অন্ধকার জগতে নিয়ে যেত।সে ঝগড়া কলহ নিয়েই ভালো থাকত।প্রজারা তার অন্ধকারের দাসত্ব স্বীকার না করলেই তাকে সুস্থভাবে বাঁচতে দিত না।আলোর পরশ সহ্য করার ক্ষমতা রাজার ছিলো না।অত্যাচারী,ভন্ড ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠলো। একদিন প্রজাদের প্রার্থনায়  এলো আলোর ফেরিওয়ালা।তার আলোতে আলোকিত প্রজারা তার কাছে ভালো পরামর্শ পেতো।মানুষকে শান্তিতে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতো সে।  একদিন আলোর ফেরিওয়ালাও বন্দি হলো রাজার কারাগারে,নিষ্ঠুর অন্ধকারের অন্তরালে। রাজার কর্মচারিরাও আলোর ফেরিওয়ালার প্রেম পরশে চেতনা ফিরে পেলো।তারা প্রতিজ্ঞা করলো,আমরা বাঁচার মত বাঁচবো।শয়তানকে বন্দি করবো।রাজা একা হয়ে পড়লো।কারণ আলোর পরশ পেয়ে সকলের মনের অন্ধকার দূর হয়েছে।তারা ভালো মন্দের পার্থক্য বুঝতে পেরেছে।সুস্থ জীবনের সন্ধান পেয়েছে।অবশেষে অত্যাচারী রাজা আলোর কাছে পরাজিত হলো।আলোর প্রাচুর্যে অন্ধকারের রাজার অন্তর আলোকিত হলো।

রাজা বুঝতে পারলেন,শান্তিতে বেঁচে থাকার  জন্য  পৃথিবীতে আলোর বিশেষ প্রয়োজন। সরল দে একজন সরল মানুষ। সে সস্তায় জীবন ধারণ করার জন্য ফুটপাতের সস্তা পোশাক ব্যবহার করেন। বাড়িতে এসে জামা পরতে গিয়ে দেখে সাইজে অনেক বড় হয়ে গেছে। আবার সস্তায় দর্জির দোকানে সেলাই করে ঠিক করে জামা। আবার জামা কাচাকাচি করার পরে ছোটো হয়ে যায়।  সরল সস্তায় খাবার খোঁজে। মুরগীর রোগ হলে সস্তায় কিনে খায়।   সস্তার শরীর সরলের, জোর কিন্তু বাড়ে। জমিতে ফসল ফলায়। খোলা আকাশের নিচে আনন্দে থাকে।    সস্তায় তার জীবন চলে বলে সকলে তাকে সস্তা সরল বলেই ডাকে। সরল এতে রাগ করে না। কারণ লোকে ঠিকই বলে। সস্তায় কোনো কিছু পেলে সে বাড়ি নিয়ে যায়। তারপর বকুনি খায়। সস্তায় একবার একটা প্যান্ট কিনে সে বাড়ি গিয়ে কাচার পরে দেখে সেটা আর পরণের উপযুক্ত নয়। তবু সে পরে। সে বলে, যতই হোক টাকা দিয়ে কেনা। একবার সরল রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনায় একটি ছেলে রাস্তায় পড়ে রইলো সস্তা মুরগীর মত রক্তাক্ত অবস্থায়। দামি কেউ নেই। তারা তাদের দামি জীবন নিয়েই ব্যস্ত। সস্তা জীবনের জন্য তাদের সময় নেই। 

কিন্তু সস্তা সরল রাস্তায় পড়ে থাকা  সস্তা রক্তাক্ত ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। চিনু নানারকম গল্প শোনাত। ভাল মানুষের, শিল্পী মানুষের। চিনু বলেছিল, ডাক্তারবাবু বললেন, রক্ত লাগবে। কিন্তু আমাদের স্টকে রক্ত নেই। সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ পরীক্ষায় সস্তা রক্তের সাথে সস্তা রক্ত মিলে গেলো। সরল তার সস্তা  রক্ত দিলো  । ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। সরল রাস্তায় নেমে আবার একটা সস্তা মূল্যে পাঁউরুটি কিনে   খেতে শুরু করলো। দুপাশের মূল্যবান জীবন প্রবাহ,  সরলকে দেখে হাসতে থাকলো পোকা লাগা দেঁতো হাসির মত নিয়মিত সুরে। 


চিনুর বোন সীমার ইচ্ছে ছিলো নদী হবে। কুলু কুলু বয়ে যাবে নিরন্তর। পাড় উপচে ভাসানো ঢেউ মনে রোমাঞ্চ জাগাবে। কিন্তু কিছু লোকের বদখেয়ালে আর অর্থের লালসায় সব ইতিহাস চাপা পড়ে যায়।মিতা তার বাল্যবন্ধু। সে বলে, চাপা ইতিহাস ফুঁড়ে বেরোয় বটগাছের রূপ নিয়ে। একদিন রোদ ছিলো, সবুজ গাছ ছিলো। কিছু কাঁটাঝোপ থাকা স্বাভাবিক। সেই বাধা পেরিয়ে অনেকটা পথ একা হেঁটেছে সীমা। সঙ্গে ছিলো অদম্য ইচ্ছে। আজ সত্তরের তরুণী সীমা সফল। ইতিহাস কথা বলে মৃদুস্বরে। বেশ    কিছু  প্রকাশিত গ্রন্থে তার সমস্ত ইচ্ছে, সাধনা নিঙড়ে দিয়েছে মন। আজ সকালেই সে পেয়ে গেলো জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার পাওয়ার সংবাদ। সত্য, সুন্দর । চিনুর বয়স হল পঁচাত্তর। কুষ্ঠিতে আছে চিনু উনআশি বয়সে মরে স্বর্গে যাবে। চিনু মনোজকে খুব ভালবাসত। সে তাকে দেখলেই পুরোনো দিনের গল্প শোনাত। চিনু বলত, ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেন ধরে চলে গেলাম কুমোরপুর হাটতলা হল্ট। মনে করলাম, তাড়াতাড়ি চলে আসব, দুপুরের আগে। পরীক্ষা হয়ে গেছে। বাড়িতে শাসনের দড়িটা একটু ঢিলে হয়েছে। মা বলেছেন, খাওয়ার সময় যেন ডাকাডাকি করতে হয় না। আর সবসময় স্বাধীন এই কটা দিন। বন্ধুরা ডাকল ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য। আমাদের ফুল টিম খেলা দেখতে চলে এলাম কুমোরপুর হল্টে বিনা টিকিটে। ভাবলাম খাওয়ার সময়ের আগে বেলা দুটোর সময় হাজির হয়ে যাব মায়ের কাছে। কিন্তু সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।একটা টিম খেলতে আসে নি। এত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে ভেবে আমরা কমিটির কাছে একশ টাকা দিয়ে আবেদন করলাম। কমিটি রাজি হল। আমরা মাঠে নামলাম ফুল টিম নিয়ে। পরপর অনেক টিমকে হারিয়ে আমরা ফাইনালে উঠলাম।  ফাইনাল খেলা শুরু হবে বিকেল তিনটের সময়। এখন দুটো বাজে। মায়ের মুখটা মনে পরছে। ভাতের থালা সাজিয়ে বসে আছেন নিজে না খেয়ে। যেতে পারলাম না বাড়ি। খিদে লেগেছে খুব । পাশের বাড়ির কাকিমা মাঠের ধারেই বাড়ি। কাকু, কাকিমা দুজনে এসে বললেন, তোমাদের খেলা দেখে ভাল লেগেছে আমাদের। আমরা তোমাদের সাপোর্টারস। এই নাও এক থালা পিঠে তোমরা খাও। আমরা ভালোবেসে বানিয়েছি। আহা খিদে পেটে  অই পিঠে একদম অমৃত। পেট ভরে খেলাম। আমার ভাই বাবু বলল, দাদা আজ বাবা চামড়া তুলবে পিটিয়ে। আমি বললাম, কি আর করা যাবে। অন্যায় করলে তো কেউ ছাড়বে না।তারপর ফাইনালে জিতে শিল্ড নিয়ে আমরা ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরলাম। আমাদের বিজয় নাচ দেখতে হাজির হল গ্রামের লোকজন। বাবাকেও ভিড়ে দেখলাম। লাঠি হাতে চিৎকার করছিলেন। শিল্ড দেখে চুপ করে গেলেন। মাকে ডেকে দিয়ে নিজে চলে গেলেন ছাদে।তারপর বাড়ি ঢুকলাম সন্ধ্যাবেলায়। মা তখনও উপোসি। একসঙ্গে খেলাম পিঠে আর খেজুর গুড়। মা পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, তোদের বাবা খুব খুশি। আমাকে ডেকে দিয়ে বললেন, যাও দেখ গিয়ে গ্রামের ছেলেরা খেলে শিল্ড এনেছে। গর্বের খবর গো।তারপর থেকে বাবা আমাদের আর কোনদিন গায়ে হাত দেন নি। চিনু ভাদু জেলের কথা বলত, মাটির মানুষের কথা, ভাদু জেলে মাছ ধরে। তার আগে তার দাদুও মাছ ধরে সংসার চালাতেন। বাড়ির পাশেই কাঁদর। অনেকে বলেন ঈশানী নদী। ভাদু অত কিছু জানে না। কাঁদরে চান, কাঁদরে টান তার। একটা তালগাছের গোড়া ফাঁপা করে ডোঙা বানানো হয়েছে কাঁদর এপার ওপার করার জন্য। ডোঙার তলাটা মাঝে মাঝে রঙ করা হয়। ডোঙায় চেপে কাঁদরে জাল ফেলা শিখেছে তার দাদুর কাছে ভাদু। তারপর মাছ ধরে বাঁশের কঞ্চির তৈরি ঝাঁপিতে ভ'রে মাছ বিক্রি   করত গ্রামে গ্রামে। ছেলে ভোলাকে গাঁয়ের স্কুলে ভরতি করেছিল সাত বছর বয়সে। এখন সে হাই স্কুলে পড়ে। কিন্তু মাষ্টারমশাইরা বলেন ভাদুকে, তোর ছেলেকে বাড়িতে পড়তে বলিস। খুব ফাঁকিবাজ। এবার নম্বর খুব কম পেয়েছে। ভাদু রাতে ছেলের কাছে বসতে পারে না। সন্ধ্যা হলেই সে চলে যায় হরিনামের আখরায়। সেখানে হরিনাম হয়। ভাদু হারমনিয়াম     বাজায়। বড় সুন্দর তার হাত, সবাই বলে। এদিকে ছেলে ভোলা বই গুটিয়ে অন্ধকারে বসে থাকে কাঁদরের ধারে। পড়াশোনা তার ভাল লাগে না। কাঁদরের ধারে অনিলের সঙ্গে বসে বাঁশি বাজায়। অনিল বলে, তোর বাবা শুনলে মারবে ভোলা, সাবধানে থাকিস। ভোলা বলে, এই সবুজ আমাকে বড় টানে। এই জল আমাকে শান্তি দেয়। চান করার সময় এক ডুবে সে কাঁদর পেরিয়ে যায়। অনিল ভোলার খুব ভাল বন্ধু। সে সবসময় ভোলার সঙ্গে থাকে, থাকতে ভালবাসে। ভোলা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করল। ভাদু বলল, আর স্কুলে যেয়ে লাভ নাই রে ভোলা। রোজগারের ধান্দা কর। ভোলা তাই চাইছিল। সে বলল,বাবা আমি জাল ফেলা শিখব। তার বাবা ভাদু বলল,তা শেখ। কিন্তু তুই তো ভালই জাল ফেলিস। আমি চাইছিলাম রামের সঙ্গে তু কেরালা যা। সোনার দোকানে কাজ শিখে লেগা। তারপর এখানে এসে একটা দোকান খুলবি। কত নাম হবে তখন তোর দেখবি। ভোলা বলল,না বাবা আমি কেরালা যাব না। বাবা ভাদু বলল,আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। তু আর অনিল কাল কেরালা চলে যা। মেলা পয়সা হবে, নামডাক হবে। তা না হলে জলে পচে মরবি। বাবার ভয়ে তারা কেরালায় চলে এল। দোকানে কাজ করে, কাজ শেখে। তাদের দোকান বাজার, কেনাকাটা সব কাজ করতে হয় ভোলাকে। বাঁশি বাজাতে দেয় না। তার মনে পড়ে কাঁদরের ধারে গেলেই মনটা ঘাসের গন্ধে ভুরভুর করে উঠত। একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা তুলে দিত। বাঁশির সুরে কাঁদরের জল নেচে উঠত। ভোলার বাবা, মার কথা মনে পড়ত। কিছু ভাল লাগত না। তার বন্ধু অনিল কাজ করে অনেক দূরে আর একটা দোকানে। সন্ধ্যা হলে দুজনের কথা হত। অনিল বলত, ভাল করে থাক। অনেক পয়সা নিয়ে বাড়ি যাব। কত খাতির হবে, দেখবি, অনিলের বাবা, মা নেই। সে ছোট থেকে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। তাই তার পিছুটান কম। সে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করে। কিন্তু ভোলার কিচ্ছু ভাল লাগে না। প্রায় দুমাস পরে সে জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হল। মালিক বেগতিক বুঝে অনিলকে সঙ্গে করে ভোলাকে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বাড়িতে এসে ভোলা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। অনিল মামার বাড়ি গেল একটা বড় ব্যাগ নিয়ে। ভোলা কিছুই আনতে পারে নি। সে রোগে ভুগে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। মা তার বাবার ওপর রেগে গিয়ে বললেন, আবার যদি তুমি ওকে কেরালা পাঠাও তো আমার দিব্যি রইল। বাবা ভাদু আর ভোলাকে কেরালা যেতে বলেনি। শুধু বলেছিল, এখানে ও খাবে কি?  আমি তো আর বেশিদিন বাঁচব না। তার মা বলেছিল, আমাদের একমুঠো জুটলে ওরও জুটবে। তারপর অনিল আবার কেরালা চলে গেল। ভোলা দুমাস বিছানায় পড়ে রইল। তারপর মায়ের সেবাযত্নে সে সুস্থ হয়ে উঠল। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল। ভাদু জেলে মরে গেল। তার হরিনামের দল তাকে উদ্ধারণপুর নিয়ে গেল ট্রাকটরে চাপিয়ে। ভোলা সেই হরিনামের দলে ভাল বাঁশি বাজিয়েছিল। সবাই বলল, সন্দেবেলায় পেত্যেকদিন হরিনামের আসরে যাবি। বাঁশি বাজাবি। আজ অনিল এসেছে পাঁচবছর পরে। গ্রামের মোহিনী ঠাকরুণ বলল, মামার একটু জায়গা নিয়ে গ্রামে সোনারূপোর দোকান কর। আমরা তোর খদ্দের হব। অনিল এইরকম    কিছু একটা করার কথা ভাবছিল। মামাকে বলে একটা ঘর করল রাস্তার ধারে। তারপর অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে দোকানের শুভ উদ্বোধন হল। খুব ধূমধাম করে দোকান শুরু হল। এদিকে ভোলা কাঁদরে জাল ফেলে মাছ ধরছে ডোঙায় চেপে। পাশ দিয়ে কাঠগোলার বড়বাবু যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ও জেলে ভাই মাছ পেলে?  ভোলা মাথাটা উঁচু করে বলল, পেয়েছি বাবু একটা কাতলা। তা কেজি খানেক হবে। বড়বাবু একটা দুশ টাকার নোট বার করে মাছটা নিলেন। তারপর চলে গেলেন। ভোলা টাকাটা কোঁচরে গুঁজে বাঁশি বের করে বাজাতে শুরু করল। সুরে সুরে আকাশ ভরে গেল



।১০


চন্ডীদাসের মত ছিপ ফেলে বিপিন মাছ ধরা দেখছে ফাতনার কথা ভুলে। বাউরি বৌ গুগুলি আর  ঝিনুক ধরছ জলের তলা থেকে। তার সুডৌল স্তন ঝুঁকে পরেছে জল ছুঁয়ে। জল কখনও সখনও রসে ডুবিয়ে দিচ্ছে যুবতী হৃদয়। বিপিন দেখছে ভিজে নিতম্ব ফুটে উঠেছে  খাজুরাহের ছবির মত। বিপিন ভাবছে ঝিনুক, গুগুলির জীবন বাউরি বৌকে স্বামী সোহাগী করে তুলেছে কোমল দেহসৌষ্ঠবের মাধ্যমে। পুকুরের পাড়ে গাছ গাছালির স্নেহচ্ছায়া। এই দুপুর হয়ে উঠেছে বসন্তমায়া। কোন এক অদৃশ্য মায়ায় বৌ মাঝে মাঝে তাকায় বিপিনের দিকে। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের অবসর বাউরি বৌ ধরে শামুক, ঝিনুক। অলস স্বামীর খপ্পরে পরে জীবনে তার লড়াই প্রকট হয়ে উঠেছে। বিপিন বেকার যুবক। তাই ছিপ নিয়ে বসে এই সময়ে বাউরিবৌকে দেখার লোভে। সুন্দরী বাউরি বৌ ভোলে না এই বসন্তসময়। কি বর্ষা, কি শীত বা গ্রীষ্ম দুজনের বসন্তসময় কেড়ে নিতে পারে না। আজ বিপিন জলে নেমেছে। বাউরিবৌ কাপড় ঝেড়ে জলে ধুয়ে নিচ্ছে। দুজনেই ডুবে আছে আকন্ঠ শীতল জলিয় আবরণে। জলের নিচে চলে জলকেলি। একটা পানকৌড়ি ডুবে ডুবে   মাছ ধরার কৌশল দেখায় দুজন প্রেমিক প্রেমিকাকে। ছিপ ডাঙায় তুলে দেখল বিপিন একটা বড় রুই ধরা পড়েছে বড়শিতে। বাউরিবৌ সোহাগী আঁচলে তুলে নেয় বিপিনের প্রেম।      যে ছেলেটা পূর্ণিমা পুকুরের জ্যোৎস্না ভিজে চাঁদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সে চাঁদ ছুঁতে পারেনি।সমস্ত যোগ্যতার ফানুস সে উড়িয়ে দিয়েছিলো ঘাসের শিশিরে,বাতসের খেলায়।হেলায় সে হয়েছিলো ফাঁকা মাঠের রাজা।আলপথের মাটির গন্ধে তার যোগ্য সম্মানের ঘ্রাণ নিতো প্রাণভরে।সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বাইরে অনুভূতির জগতে তার আসা যাওয়া।বন্ধু বলতো,তোর ধনী হতে ইচ্ছে হয় না?ছেলেটিসে বলে, তার আপন জগতে সে শুধু রাজা নয়, সম্রাট।তাই সে অবহেলায় যাপন করতো সাধারণ জীবন।সে জানে তার মত ধনী কমই আছে।বাতাসের রেণু,আকাশের হৃদয় আর সবুজের হাতছানিতে সে ছুটে চলে যেতো।সেখানে গিয়ে সে কথা বলতো আপন মগ্নতায়।তার কথাগুলো হয়ে যেতো কবিতার পান্ডুলিপি..কাটোয়া থেকে ট্রেনে চেপে নবদ্বীপ যেতে গিয়ে ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম। ইন্টারসিটি ধরে যাচ্ছিলাম।    একবার প্রয়োজনে বাথরুমে  ঢুকলাম। ঢুকেই চোখ দুটি স্থির হয়ে গেলো আমার। পা নাড়াতে পারছি না। দেখলাম একটা ছোটো ভূতের বড় মানুষের মত বড় বড় দাঁত। দাঁত কেলিয়ে হাঁসছে। ভয়ে বুকের লাবডুব  এত জোরে হচ্ছে যে নিজেই শুনতে পাচ্ছি।কোনোরকমে বাইরে এলাম। অন্যান্য যাত্রীদের বললাম। তিনজন বাথরুমে ঢুকলো।কিছু দেখতে না পেয়ে রেগে গিয়ে বললো,রাতে কি খেয়েছিলেন?  গ্যাস হয়েছে।যত পাগল, ছাগল নিয়ে কারবার।যান নিজের কাজে যান।  আমি আবার একবার ঢুকলাম ভিতরে। দেখলাম  ভূতটি সেইরকমই হাঁসছে। দেখে আমার পিত্তি জ্বলে গেলো। রাগে বলে বসলাম,এত ভিতু কেন?পালিয়েছিলি কেন? ভূতটা সঙ্গে সঙ্গে আমার গালে এক চড় মেরে জানালার ফাঁক গলে লাফিয়ে পড়লো।ভূতের কি অপরিসীম ক্ষমতা।   পরে জেনেছি আমি অজ্ঞান হয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। ফলে গন্তব্যে না গিয়ে হাওড়া চলে গেছিলাম । আমার ঘুম ভাঙলো হাওড়া স্টেশনে। বাথরুমে নোংরা পরিবেশে শুয়ে থাকতে দেখে অনেকে বাথরুমে ঢোকে নি। হয়ত লাশ মনে করেছে। একটা ঝাড়ুদার বললো,পাগল কাঁহিকা। নিকালো শালা। বাথরুমমে শোতা হ্যায় চুতিয়া। তখন থেকেই আমাকে ভুতে ধরেছিল তারপর এই লাইনে কাটা পড়লাম ভুতের জন্য। চিনু বলেছিল মধু বা স কন্ডাকটার। খড়ের চাল ফুটো। মাটির ঘর। মাটির মানুষ। তবু তার অবসর সময়ে সে পড়ে। তার আশা পড়াশোনা করে সে বড় হবে। কালো কালো অক্ষরগুলো তার চোখে আলো জ্বালে। সে চলে যায় অন্য এক জগতে। আশায় আশায় বাড়ে তার বয়স। বাড়ি থেকে বলে, এবার বিয়ে থা করে নে। ভালো আয় করিস। তোর আর চিন্তা কিসের?  মধু বলে, না বিয়ে করলেই সব শেষ। পড়াশোনা, আশা সব শেষ হয়ে যায় সংসারের জালে। সে জাল কেটে বের হওয়া কঠিন ব্যাপার। কোনোকালে কেউ পারে নি। মহাপুরুষ হলে আলাদা ব্যাপার।মধু ভাবে অবসর সময়ে, সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে  কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার ।নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন । জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে । আমার টোনা মাসিকে  টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে । আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন । কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না । তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে  শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে । সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা । ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ ।শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি ।নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়।শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে  । সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়।  মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। । শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়।   বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে।  কত বসন্ত এল গেল। মধুর এখনও শীতসময়। ঝরা পাতার সময়ে সে মগ্ন হত  সরব পাঠে। পাড়ার বন্ধুরা বলত, বুড়ো বয়সে পাঠশালায় পড়াশোনার ভিমরতি। এ ঘোড়া ঘুরে ঘাস খাবে না। মধুর মন খারাপ হত। বই গুটিয়ে বসে পড়ুত মাটির বারান্দায়। একটা পায়রা দেখত সে। একটা একটা করে কাঠি সংগ্রহ করে বাসা বুনত। প্রথমে কাঠিগুলো ঠোঁট থেকে পড়ে যেত। আবার সে চেষ্টা করত। এইভাবে পায়রাটি সফল হত তার কাজে। মধু ভাবত, সে মানুষ। প্রাণীজগতের শ্রেষ্ঠ জীব। তাহলে, একটা পাখি যদি পারে সে পারবে না কেন?  সে শক্ত দড়িতে হৃদয় বেঁধে লেগে পড়ত কাজে। পড়াশুনা করত মনযোগ দিয়ে।সকাল হলেই বেড়িয়ে পড়ত কাজে। কাঁধে বাস কন্ডাকটারের ব্যাগ। বাসে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হত। কেউ কেউ অসম্মানও করত। ভাড়া না দিয়ে নেমে পড়ত। বলতে গেলে ভয় দেখাত। মধু মনে মনে পড়ার বিষয়গুলো মনে মনে আউড়াত। অনেকে বলত, ছেলেটা পাগল নাকি?  একমাত্র গাড়ির খালাসি জানত তার বিষয়টি। সে মধুর বন্ধু। সে বলত, তোর কাজের চাপ হলে আমাকে বলবি। আমি তোকে সাহায্য করব। বাসের ভিতরে বাসস্টপে সে পড়ত মাঝে মাঝে। মধু পড়াশোনা করে যখন, সে শুনতে পায় আলোর আগমনী সংগীত। আর কেউ শুনতে পায় না। আলোময় চোখে আশার আলো দেখতে দেখতেই সে বিভিন্ন পরীক্ষায় বসে। হয় না। বিফলতাগুলো তার আশার আলো নেভাতে পারে না। বিফল হতে হতে সেএকদিন আই এ এস পরীক্ষায় সফল হল। চারিদিকে ঢাকের কাঠি পড়তে লাগল। শুধু প্রশংসার বন্যা। কিন্তু মধুএ বন্যায় হারিয়ে যাওয়ার ছেলে নয়। বিফলতাগুলো তার মনের তার শক্ত করে বেঁধেছে। সহজে তা ছেঁড়া যাবে না।



                                     ক্রমশ...

Wednesday, August 24, 2022

ছোট গল্প - লক ডাউন || লেখক - অমিতাভ ভট্টাচার্য্য || Short story - Lockdown || Written by Amitabh Bhattacharya


 

লক ডাউন

অমিতাভ ভট্টাচার্য্য


সকালবেলা চা খেতে খেতে প্রণবেশ ওর ফোনে পর পর দু’টো মিস কল দেখতে পেল। দেবাশিষ ফোন করেছিল ভোর পাঁচটার সময়। এতো সকালে ফোন করল কেন? কোন খারাপ খবর নয়তো? প্রণবেশ বরাবরই ভীতু স্বভাবের। খুব ঘাবড়ে গেল। কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। মৈণাক আর বিদীপ্তা এই সময় ঘুম থেকে ওঠেনা। অনেক রাত পর্য্যন্ত জেগে ওরা কাজ করে। আজকাল বাড়িতে বসে কাজ করার একটা সুন্দর নাম হয়েছে; ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। ওরা দুজনেই আইটি সেক্টরে কাজ করে। বিশ্ব জুড়ে অতিমারির প্রকোপে অফিসগুলো সব বন্ধ রয়েছে। আইটি সেক্টরে কাজ করে বলে ওদের দুজনের চাকরিটা এখনও টিঁকে আছে। দেবাশিষের একমাত্র মেয়ে সুদেষ্ণার চাকরিটা আর নেই। ও একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে এইচ আর ম্যানেজারের পোষ্টে চাকরি করত। লক ডাউনের জন্য বেশ কিছুদিন অফিস বন্ধ ছিল। তারপর কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই শুরু করে। যাদের ছাঁটাই করল, তাদের যে ক’মাস বসিয়ে রেখেছিল সেই মাসগুলোর মাইনেও দিলো না। দেবাশিষের মেয়ে সুদেষ্ণা ছিল ঐ ছাঁটাইয়ের দলে। একমাত্র দেবাশিষের পেনশন এখন ওদের ভরসা। ওর কি টাকার দরকার পড়ল? 



প্রণবেশের সাথে দেবাশিষের পরিচয় হয় মর্নিং ওয়াক করার সময়। প্রণবেশ ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন। স্কুল জীবন থেকে ওর খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে ঘণ্টা খানেক ঢাকুরিয়া লেকে অনেকদিন পর্য‍্যন্ত দৌড়েছে। ভোরবেলা দৌড়নোর ফলে ওর সারাদিন মনটাও খুব ভালো থাকতো। এক সময় ভোরবেলা দৌড়নো বন্ধ করে হাঁটা শুরু করে। একদিন সকালবেলা দেবাশিষ হাঁটতে হাঁটতে এসে প্রণবেশের সাথে আলাপ করে। তখন থেকে ওরা দুজনে দুজনের বন্ধু হয়ে গেছে। 


 


ওরা মর্নিং ওয়াক শেষ করে বাজারের কাছে একটা চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। বিশ্রাম নেওয়া মানে চায়ের দোকানে বসে সকালবেলার প্রথম চা খাওয়া। চা খেতে খেতে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আলোচনা তুমুল বিতর্কে পরিণত হয়। রোজ একই রকম ঘটনা ঘটত। বিতর্ক যখন উচ্চগ্রামে তখন হঠাৎ চুপ করে যেত। তারপর যে যার বাজারের থলে দোকানের এক কোণে রাখা চেয়ারের ওপর থেকে তুলে নিয়ে, নিজের নিজের চায়ের দাম মিটিয়ে তারাতারি বাড়ির দিকে পা বাড়াত। প্রত্যেকদিন সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে এটা ঘটত। একদিন ওরা চাকরি থেকে অবসর নেয়। মর্নিং ওয়াক সেরে তারাতারি বাজার করে বাড়ি ফেরার তাড়া ওদের আর নেই। চায়ের কাপে তুফান তুলে কখনো ওরা কোনো নেতার বক্তব্যের বিপক্ষ্যে যুক্তি খাড়া করে; কখনো বা কুড়িটা সেঞ্চুরি করা খেলোয়াড়ের কি ভাবে খেলা উচিৎ সেটা দেখিয়ে দেয়। ফুটবল খেলায় ডিফেন্সকে কাটিয়ে গোল দেওয়া যে কত সহজ তা খেলার মাঠে যারা খেলে তাদের থেকে ওরা ভালো জানে। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি থেকে ফোন না আসা পর্য্যন্ত ওদের আলোচনা চলতে থাকতো।   



কিছুদিন হল প্রণবেশ আর ওর বন্ধু দেবাশিষ বাড়ির বাইরে বেরনো একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। ভোরবেলা মুখে মাস্ক লাগিয়ে নিজেদের বাড়ির ছাদে ওরা মর্নিং ওয়াক করে। এমন একটা রোগ সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে গেছে যে, তার জেরে প্রায় সবার মনের মধ্যে একটা ভীতি বাসা বেঁধেছে। এই মারণ ভাইরাসকে ঠেকাতে সব দেশ কিছুদিনের জন্যে তাদের অফিস-কাছারি, দোকান-পাট, বাজার-হাট সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এতে এই নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ আটকানো যাবে। কারোর সাথেই আজকাল আর দেখা হয় না। প্রথম দিকে ফোন করে সকলের খোঁজ খবর নিত প্রণবেশ। আজকাল আর ফোন করা হয়ে ওঠেনা। কেমন একটা আলস্য ছেয়ে গেছে ওর মনের মধ্যে। প্রতিদিন টিভি খুললে আর খবরের কাগজের পাতা ওলটালে ‘আক্রান্ত’ আর ‘মৃত্যু’র খবর। ডাক্তাররা বলছে ষাটের বেশী যাদের বয়স, তারা যেন বেশী সতর্ক থাকে। প্রণবেশের তেষট্টি চলছে। দেবাশিষের নিজের বা ওর বাড়ির কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো? ওর বয়সও তো ষাট পেরিয়েছে।   



লক ডাউনের জন্যে বাজার বন্ধ। সব্জিওয়ালা, মাছওয়ালারা পাড়ায় পাড়ায় বেরিয়ে পড়েছে সকাল থেকে। ‘সব্জি’‘সব্জি’ বলে সুর করে ডাকে ওরা। তাই শুনে প্রণবেশ ছাদ থেকে নীচে নেমে আসে মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে। অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে সব্জিওয়ালাকে বলে দেয় কোনটা ওর চাই। সতর্কতার সাথে সব্জিওয়ালার কাছ থেকে জিনিস নিয়ে দাম মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। তারপর সোজা রান্না ঘরের সিঙ্কে থলেটা উল্টে খালি করে দেয়। প্রথমে থলেটা ধুয়ে বারান্দায় মেলে দেয়। তারপর সব্জিগুলোকে ভালো করে ধুয়ে একটা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রেখে দেয় জল ঝরানোর জন্য। প্রণবেশ যার কাছ থেকে সব্জি কেনে, সে গত পড়শুর আগের দিন থেকে গতকাল পর্য্যন্ত আসেনি। প্রণবেশ তাকে বলল, তিনদিন ধরে আসছ না। শরীর খারাপ নাকি?  সব্জিওয়ালা বলল, আমার কথা আর বলবেন না কাকা। সবই আমার কপাল। 

কেন? কপালের আবার কি হল ? 

আমিতো রাত থাকতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সকাল ন’টা নাগাদ ওরা আমার পথ আটকালো। লক ডাউনে ‘মাক্স’ না পরে বাইরে বেরিয়েছিস? বলে ওরা সবাই মিলে আমার এই ভ্যানটাকে উলটে চাকাগুলোর হাওয়া খুলে দিল। আমার সব সব্জি রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। ওরা পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট কোরে চলে গেল।

কারা এইসব করল?

ভোটের বাবুরা। 

ওরা সবাই মাস্ক পরেছিল? 

‘মাক্স’ ওদের গলায় আর দাড়িতে ঝুলছিল। 

তুমি একটা মাস্ক ওদের মতন ঝুলিয়ে রাখলে তো পারতে। তাহলে আর এত ঝামেলা পোহাতে হতনা।

আমি ‘মাক্স’ কিনব কি দিয়ে? সারাদিনে যা রোজগার হয় তার থেকে বাজে খরচ করতে মন চায় না। ওরা কোন কথাই তো শুনলো না।

প্রণবেশের খুব মন খারাপ হয়ে গেল সব্জিওয়ালার কথা শুনে। মাস্ক পরার দরকার অবশ্যই আছে। কিন্তু মাস্ক পরেনি বলে এমন সাজা না দিয়ে একটা মাস্ক তো কিনেও দেওয়া যেত। 


ওর কাছ থেকে সব্জি নিয়ে সেগুলো ধুয়ে জায়গা মত রাখতে গিয়ে খেয়াল হল নীলিমা এখনও রান্না ঘরে আসেনি। এত দেরিতো করে না ঘুম থেকে উঠতে। সবার আগে ঘুম থেকে উঠে সাতটার মধ্যে সকলের জন্য জলখাবার তৈরি করে ফেলে। প্রণবেশ শোবার ঘরে গেল। নীলিমাকে শুয়ে থাকতে দেখে প্রণবেশ ভয় হল। করোনা আক্রান্ত হল না কি? তাহলে তো মৃত্যু অনিবার্য। প্রণবেশের আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে বেশী বয়স্ক যারা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছে, তারা আর ফেরেনি। নীলিমার কপালে হাত দিয়ে দেখল তাপমাত্রা স্বাভাবিক। নীলিমা বলল, আমার কিছু হয়নি। প্রণবেশ অবাক হয়ে বলল, তাহলে শুয়ে আছো কেন? আলস্য ভরে পাশ ফিরে শুতে শুতে নীলিমা উত্তর দিল, আমার মনটা আজ ভাল নেই। সেজ বৌদিকে ওরা বাঁচাতে পারলনা।

কি বলছ কি?

হ্যাঁ। কদিন ধরে জ্বর আর শ্বাস কষ্ট দেখে সেজদা আরটি পিসিআর টেষ্ট করাল। রিপোর্ট পজিটিভ। ওর যা অবস্থা ছিল, তাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা। করোনা হয়েছে বলে কোন গাড়ি পাচ্ছিলনা প্রথমে। একটা এ্যাম্বুলেন্স যাও বা যোগাড় হল, অনেক টাকা চেয়ে বসল ড্রাইভার। শেষে একটা রিক্সা পেল হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে। 

তারপর?

হাসপাতালে পৌঁছলে হাসপাতাল থেকে জানাল ‘বেঁচে নেই’। 

প্রণবেশ এই খবরে খুব ভয় পেয়ে গেল। ওদেরও যদি এই রকম পরিস্থিতি হয় তখন কি করবে?   

 

প্রণবেশ ভোরবেলা ছাদে হাঁটতে যাবার পর নীলিমা প্রতিদিনের মতো আজও বিছানা থেকে উঠে চোখমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেল। প্রথমে ঋকের খাবারটা তৈরী করল। ঘুম থেকে উঠে ঋক প্রথমে রান্নাঘরে ঠামীর কাছে যায়। নীলিমা ওর চোখমুখ ধুইয়ে গল্প বলতে বলতে খাইয়ে দিত। তখন ঋককে ছোট্ট মৈণাকের মত লাগতো। অতিমারির কারণে বেশ কিছুদিন হল ওর স্কুল বন্ধ রয়েছে। কাল থেকে আর স্কুলে যেতে হবে না, এই খবরটা পেয়ে ঋকের খুব ভালো লেগেছিলো। ভোরবেলা ঘুম ঘুম চোখে বাবার হাত ধরে স্কুল বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে ওর ভালো লাগতো না। ছুটির দিনে বাবা-মাকে কাছে পাওয়া যায়। বাবার সাথে খেলা করা যায়। প্রথম প্রথম বাবার কাজের ঘরে গেলে বাবা কোলে তুলে নিত; কত গল্প করতো। আজকাল কথাই বলতে চায় না। মার কাছে যেতেই পারে না। ঘরে ঢুকলেই মা চোখ বড়ো বড়ো করে এমন ভাবে তাকায়, ঋকের ভালো লাগেনা। ঘুম থেকে উঠে নীলিমার কাছে গিয়ে বলল, ‘ঠামী, আমি ইস্কুলে যাব।’ নীলিমা ওকে খাওয়াতে খাওয়াতে অনেক গল্প শোনাল। কিন্তু ঋকের গল্প শোনার দিকে মন নেই। সে বারবার তার ঠামীকে ইস্কুলে যাবে বলে বায়না করতে লাগল। খাওয়ানো শেষ হয়ে গেলে নীলিমা ঋককে বলল, তোমার চোখে এখনও ঘুম রয়েছে, দাদুভাই। যাও, মার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। নাতিকে তার মায়ের কাছে শুতে পাঠানোর সময় ঐ খারাপ খবরটা এলো নীলিমার ফোনে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। সেজ বৌদির সঙ্গে নীলিমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। রান্নাঘর থেকে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল নীলিমা।



ঠামীর কথামত ঋক মার পাশে গিয়ে শুয়ে বাঁ পাটা মায়ের গায়ে তুলে দিয়ে বাঁ হাত দিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। বিদীপ্তা তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঋক চোখ বন্ধ করতেই ইস্কুলের বন্ধুদের সাথে খেলার দৃশ্যগুলো ছবির মতো ওর মনে ভেসে বেড়াতে লাগলো। চোখ বন্ধ করলে ও ইস্কুলের বন্ধুদের দেখতে পায়। তখন ওর মনটা খুশীতে নেচে ওঠে। বাড়িতে ওর খেলার সাথী তেমন করে কেউ নেই। সবাই ব্যস্ত। দাদুর কাছে গিয়ে কিছু বলতে গেলে দাদু বলে, এখন যাও, এখন যাও। পরে তোমার সাথে খেলবো। ঠামী প্রায় সারাদিন রান্না ঘরে থাকে। ঠামীর কাছে মাঝে মাঝে ও গল্প শোনার জন্য যায়। ঠামী কাজ সারতে সারতে রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শোনায় ওকে। ওর ভালো লাগেনা রাক্ষস-খোক্কসদের গল্প শুনতে। ঋক ঠামীকে বলে, তুমি ডাইনোসরাসের গল্প, রোবটের গল্প জানো না? নীলিমা ঐসব গল্প জানে না। নাতিকে তার পছন্দের গল্প শোনাতে না পেরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, সারাদিন দস্যিপণা করে চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। একটু দুধ খেয়ে নাও তো তারাতারি। এই কথা বলে এক গ্লাস দুধ ওর মুখের কাছে ধরে। ঠাকুমার কথায় এক গ্লাস দুধ খেতে হয় ওকে। দুধ খেতে ওর একদম ভালো লাগে না। তবুও ঠাকুমার কাছে যেতে ওর আপত্তি নেই।



ঋকের মধ্যে একটা পরিবর্তন কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে মৈণাক। আগের মত চনমনে ভাব ওর মধ্যে নেই। কেমন যেন মন মরা হয়ে থাকে সব সময়। বিদীপ্তা এসে মৈণাককে বলল, আজ আমি ছুটি নিচ্ছি।


কেন?


তোমার মা’র শরীর খারাপ।


আমিও ছুটি নিয়ে নিই তাহলে।


মা কেমন আছে জানতে মা’র ঘরে গেল মৈণাক। অনেকদিন পরে ছেলে সকাল বেলা মা’র কাছে এসেছে। নীলিমা মৈণাকের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে আদর করল। তাই দেখে ঋক ঠামীর দিকে নিজের কপালটা এগিয়ে দেয়।



মৈণাক ঋককে বাইরে বেরোবার জামাপ্যান্ট পরাতে পরাতে বলল, চল আমরা পার্কে গিয়ে খেলা করি। বাবার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে ঋকের খুব ভালো লাগল। বড় রাস্তার ওপারেই একটা পার্ক আছে। দোলনা আছে ঐ পার্কে। ঋক দোলনা চড়তে খুব ভালবাসে। রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা ডান দিকে গেলে পার্কে ঢোকার মেইন গেট। ঋককে নিয়ে মৈণাক মেইন গেটে পৌঁছে দেখতে পেল তালা ঝুলছে। দুজন পুলিশ হাতে লাঠি নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। মৈণাক তাদের কাছে গিয়ে বলল, পার্ক বন্ধ কেন?


করোনার জন্য পার্ক এখন বন্ধ রাখা হয়েছে।


বাচ্ছাগুলো খেলবে কোথায়?


এখন কিছুদিন বাড়িতেই খেলাধুলা করুক।


ছোটদের জন্য স্কুলও বন্ধ, পার্কও বন্ধ। ওরা কোথায় যাবে?


কি করবেন বলুন? পরিস্থিতি যা পড়েছে, কিচ্ছু করার নেই। লক ডাউন সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।


শুধু ভোটের মিছিলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তাই না?


কি বলতে চাইছেন আপনি?


আমি বলতে চাইছি, স্কুলও বন্ধ পার্কও বন্ধ। কিন্তু গত তিন মাস ধরে মিটিং মিছিল তো বন্ধ হতে দেখলাম না?


এই ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারবো না।


মৈণাক ছেলেকে নিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তা পার হয়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকল।



প্রণবেশের ফোনটা আবার বেজে উঠল। দেবাশিষ ফোন করেছে। কোন এক অজানা আশঙ্কায় ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ফোনটা অন করতেই দেবাশিষের গলা শুনতে পেল, হ্যালো, সেই সকালবেলা দু’তিনবার ফোন করলাম। ধরলেও না, রিং ব্যাকও করলে না।


সকাল সকাল একটা খারাপ খবর পেয়ে মনটা ভাল নেই। তোমরা ভাল আছ তো?


এখনও পর্য্যন্ত তো আছি। পরে কি হবে জানি না।


ও কথা বোলোনা। কেন ফোন করেছিলে বল।


আরে ভাই, আজকে ভোট দেবার ব্যাপার আছে, ভুলে গেছ? সকাল সকাল এক সাথে ভোট দিতে যাবো বলে ফোন করেছিলাম।


গতকাল রাতেও মনে ছিল। সকালে খারাপ খবরটা পাবার পর নীলিমা অসুস্থ বোধ করে। তাই একদম ভুলে গেছি ভোট দেবার কথা।


তাই নাকি? এখন কেমন আছেন তোমার গিন্নী? সুস্থ থাকলে যাবে নাকি ভোট দিতে?


আমরা যে কি করব বুঝতে পারছি না। তোমরা বরং দিয়েই এসো। পরে যদি সম্ভব হয় আমরা যাবো।


না, না, ‘যদি সম্ভব হয়’ বোলোনা। কষ্ট কোরে হলেও, ভোটটা দিয়েই এসো। ভোট দেওয়া তোমার সাংবিধানিক অধিকার প্রণবেশ। এটাকে নষ্ট কোরোনা।


আচ্ছা। বলছ যখন, আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। এখন রাখি, কেমন?



ঋককে নিয়ে মৈণাক বাড়িতে ঢুকে মা’র বিছানার কাছে এসে বসল। প্রণবেশ মৈণাককে বলল একটা রিক্সা ডেকে আনতে।


এখন রিক্সা করে কোথায় যাবে, বাবা?


তোর মা’কে নিয়ে যাবো ভোট দেবার জন্যে।


মা’র শরীর, মন ভালো নেই। এই অবস্থায় ভোট দিতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে ?


কিন্তু দেবাশিষ যে বলল, ভোট দেওয়া আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার নষ্ট করা উচিৎ নয়।


সেজোমামা সারা জীবন তার সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করে নিজের স্ত্রীকে বেঘোরে হারালো।


মৃত্যু কি আর আমাদের হাতে? যা হবার তা তো হবেই।


তোমার ঐ সব্জিওয়ালাকে মার খেতে হল। তার কি মার খাবার কথা ?


তোর কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছিনা। কিন্তু সাংবিধানিক অধিকারের ব্যাপারটাও উপেক্ষা করা যায় না।


আমাদের পাশের এই হাউসিং কমপ্লেক্সের এক ভদ্রমহিলা হাসপাতালের নার্স। গতকাল মাঝরাতে তিনি ডিউটি থেকে ফিরলে তাকে ঢুকতে দেয়নি ঐ কমপ্লেক্সের লোকেরা। তাঁর অপরাধ তিনি কোভিড রোগীদের শুশ্রূষা করেন। দশ দিন পরে বাড়ি ফিরছেন একটু বিশ্রামের জন্যে। ঘরে তাঁর একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে। সে দশদিন ধরে মা’কে কাছে পায়নি। আবাসিকদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার কি তাঁর পাওয়ার কথা?



ছেলের কাছ থেকে এইসব কথা শুনে প্রণবেশের অবাক হবার পালা। কী হচ্ছে চারদিকে? মনুষ্যত্বটাই চলে গেছে মানুষের মধ্যে থেকে। রইলটা কি তাহলে? এখন কি করণীয় আমাদের? প্রণবেশ ছেলের কাছে জানতে চাইল। ওরাই ঠিক করুক আগামী দিনে্র জন্যে কি ভাবে সাজাবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই পৃথিবীকে।

Monday, August 22, 2022

ছোট গল্প - তৃতীয় কৌরব || লেখক - দীপক কুমার মাইতি || Short story - Tritiyo Kourav || Written by Dipak Kumar Mayti

 




 তৃতীয় কৌরব

দীপক কুমার মাইতি 

 


সভাকক্ষ


তখনও তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে রয়েছে কর্ণ ,দুর্যোধন প্রভৃতির মুখে। একটু আগে দুঃশাসন রজস্বলা, একটি মাত্র বস্ত্র পরিহিতা দ্রৌপদীর কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশ মুঠিতে ধরে টানতে টানতে ‘এই দাসী, দাসী’ বলতে বলতে সভায় নিয়ে এসেছে। দ্রৌপদী চিৎকার করে তাঁকে হেনস্থার বিচার চাইছিলেন। তখন দুর্যোধন অট্টহাসি হাসছেন – তোমার স্বামী তোমাকে পাশায় পণ রেখে হেরে গিয়েছেন। এখন আমি তোমার প্রভু। সভাসদের কী বলবেন?


      দ্রৌপদী পুনরায় বলেন – সভায় উপস্থিত কুরুরাজ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, পিতামহ ভীষ্ম, মহামন্ত্রী বিদুর, মহাগুরু দ্রোণ, পুজ্যপাদ কৃপাচার্য প্রভৃতির কাছে প্রশ্ন, এই কপটচারী,ধূর্ত-পাপাত্মারা ভাবে ছলে-কৌশলে ধর্মরাজকে পাশা খেলতে রাজি করিয়েছে। কপটভাবে তাঁর সর্বস্ব জিতে নিয়েছে। তিনি প্রথমে ভাইদের, পরে নিজেকে বাজি রেখে হেরে গিয়েছেন। তারপর আমাকে বাজি রেখে হেরেছেন। আমি জানতে চাই, নিজে হেরে যাওয়ার পর মহারাজ যুধিষ্ঠিরের আমাকে পণ রাখার অধিকার কী তাঁর ছিল? এই পণ রাখা ধর্মানুসারে কী অনুমোদিত?


      সবাই চিন্তিত। মহামতী ভীষ্ম বললেন – ধর্মের গতি অতি দুর্বোধ্য। তাই এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।”


      অন্যরা নীরব। সেই মুহূর্তে কৌরবদের বিরুদ্ধাচর্ণ করার মতো কোন সাহসী সভায় ছিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন ধৃতরাষ্ট্র নন্দন তৃতীয় কৌরব বিকর্ণ – সভাসদগণ! আমাদের সকলের বিচার বিবেচনা করে পূন্যাত্মা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত। কুরুকুল রক্ষাকারী পিতামহ ভীষ্ম আপনি দায় এড়াতে পারেন না। পিতা, কুরু-মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও মহামন্ত্রী বিদুর আপনারা কেন কোন উত্তর দিচ্ছেন না? মহাগুরু দ্রোণ ও কুরু বংশের প্রধান উপদেষ্টা কৃপাচার্য আপনারাও চুপ কেন? উপস্থিত রাজন্যরা আসক্তি পরিত্যাগ করে এই প্রশ্নের বিচার করুণ। পতিব্রতা রমণী দ্রৌপদীর প্রশ্নের পৃথকভাবে যথাযথ উত্তর দিন। আপনাদের সুচিন্তিত উত্তরই একমাত্র কুরুবংশকে তার পতনের হাত থেকে রক্ষা করবে।”


      বিকর্ণ বারবার আবেদন করলেও সবাই মাথা নিচু করে বসে রইলেন। বিকর্ণ ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। রাগে হাতে হাত ঘসতে থাকেন – হে কৌরব সভাসদগণ আমি এ ব্যাপারে যা ন্যায়সঙ্গত মনে করি, তা না বলে থাকতে পারছি না। মৃগয়া, মদ্যপান, পাশাখেলা ও স্ত্রীসংসর্গ এই চারটেই রাজাদের কামজ বাসনা। এগুলিতে আসক্ত হলে মানুষের নীতি-ধর্মের সমস্ত চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়। এই অবস্থায় মত্ত মানুষেরা যে কাজ করে বা যে কথা বলে সেই সব কাজ বা কথা অকৃত বলেই ধরে নেন বুদ্ধিমান ও ধীমান ব্যক্তিরা। মহামতি যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় আসক্ত। তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধূর্ত পাশাড়েরা তাঁকে খেলায় প্রবৃত্ত করেছে। যুধিষ্ঠির পণ ধরেছিলেন প্রমত্ত অবস্থায়। তাই তিনি যে সমস্ত পণ ধরেছেন তা ধর্মানুসারে গণ্য না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই তিনি বা তাঁর ভ্রাতারা বা পতিব্রতা দ্রৌপদী কারো বিজিত সম্পদ হতে পারেন না।


      তবুও সভাসদেরা চুপ। বিকর্ণ প্রশ্ন তুললেন – মহারানী দ্রৌপদী কেবল মাত্র মহারাজ যুধিষ্ঠিরের পত্নী নন। তাঁর অন্য চার পাণ্ডবভ্রাতাও দ্রৌপদীর স্বামী। তাঁদেরও দ্রৌপদীর উপর সমান অধিকার। তাঁদের অনুমতি ছাড়া দ্রৌপদীকে পণ রাখা যায়? এছাড়া মনে রাখবেন যুধিষ্ঠির স্বেচ্ছায় নয়, কপট শকুনির প্ররোচনায় দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছিলেন। তাই এই ঘটনা কী ধর্মসম্মত? দ্রৌপদী জুয়াতে হারেননি। তিনি দাসী নন। রজস্বলা একবস্ত্রা মহান সতী দ্রৌপদীকে সভায় অপমান করা ধর্ম বিরোধী, অন্যায়, পাপকর্ম। সভায় উপস্থিত যাঁরা এই পাপকর্মকে সমর্থন করেন তাঁরা ক্ষত্রধর্ম বিরোধী। সকলেই মহাপাতকী হবেন।


      সভায় আলোড়ন শুরু হল। সকলে বিকর্ণের কথা সমর্থন করে তাঁর প্রসংশা করতে লাগলেন। দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি সহ সকলের নিন্দা করতেও লাগলেন। নিজের অনুগত সভাসদের আচরণে হতবাক হলেন দুর্যোধন। কর্ণ বুঝলেন হাওয়া বেগতিক। দ্রৌপদী তাঁকে সুতপুত্র বলে স্বয়ংবর সভায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দ্রৌপদীকে হেনস্থা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। কর্ণ ক্রোধ ভরে বিকর্ণের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলেন — সভায় তোমার অনেক গুরুজন রয়েছেন। ধর্ম ও অধর্ম ব্যাপারে তাঁরা তোমার থেকেও বিজ্ঞ। তাঁদের নীরবতার অর্থ, যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি ধরে কোন ভুল করেননি। তুমি নিতান্ত বালক। সভায় তোমার কথা বলার কোন অধিকার নেই। তুমি চুপকর। নীরব থাক।


      বিকর্ণ কর্ণের থেকে হাত মুক্ত করলেন। তাঁর কন্ঠস্বর শান্ত ও ধীর – ধিক আপনাকে অঙ্গরাজ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বা অধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বয়সের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় সাহসের। সেই সাহস আপনাদের নেই। আপনারা রাজানুগ্রহের আশায় অধর্মের কাছে বিক্রিত। আপনাদের হত বুদ্ধির জন্য কৌরব বংশ ধ্বংস হবে। আপনি পরম ধার্মিক ও দাতা কর্ণ বলে পরিচিত। আপনি কী এই নীতিশিক্ষা আমাকে দিতে চান যে অধর্ম জেনেও চুপ থাকব?


কর্ণের ধমকে ওঠেন – তুমি ধর্মের কী বোঝ? যুধিষ্ঠির সর্বস্ব পণ করে হেরেছেন। পত্নী স্বামীর সম্পদ, তাহলে দ্রৌপদীকে পণ রাখা অন্যায় কেন? যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন তখন অন্য পাণ্ডবেরা নীরব ছিলেন কেন? তাদের নীরবতাই সম্মতির লক্ষ্মণ। শাস্ত্রে পাঁচ পতির বিধান নেই। পাঁচপতির স্ত্রী দ্রৌপদী বহুগামী। দ্রৌপদী একজন বেশ্যা। বেশ্যা রজস্বলা না একবস্ত্রা তার গুরুত্ব নেই সমাজে। তোমার এতই যদি দরদ তবে অন্দরে গিয়ে রোদন কর।   


বিকর্ণকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে – কী হল দুঃসাশন! যাও দাস পাণ্ডবদের ও দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ


      থাকতে পারলেন না বিকর্ণ। মুহূর্তে সভাকক্ষ ত্যাগ করে ছুটে গেলেন মাতা গান্ধারীর কাছে। তাঁর পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। বিকর্ণকে বক্ষে তুলে বললেন – কী হয়েছে পুত্র! বিচলিত কেন?”


      বিকর্ণ মাতাকে পাশা খেলার সভাগৃহে যা ঘটেছে তার বর্ণনা দেন – মাতা আপনার মতে মহারানি দ্রৌপদী মাতালক্ষ্মীর অংশজাত । যেদিন পাণ্ডব ভ্রাতারা দ্রৌপদীকে বিয়ে করে ফিরেছিলেন, সেদিন আপনার নির্দ্দেশে আমি ও চিত্রসেনা তাঁদের সসম্মানে বরণ করে রাজপুরীতে নিয়ে এসেছিলাম। শুধু তাই নয় আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘দ্রৌপদী যেন কোনদিন অসম্মানিত না হোন তার দিকে লক্ষ্য রাখবে।’ কিন্তু মাতা আজ কৌরবভ্রাতাদের হাতে কুরু-কুললক্ষ্মীর সম্মান লুন্ঠিত। মাতা ঘোর অমঙ্গল নিশ্চিত। কৌরব বংশের ধ্বংস অনিবার্য।


      ঠিক সেই সময় চারিদিকে নানা কুলক্ষণ দেখা দিল। গান্ধারী ভীত হয়ে পড়লেন। এমন সময় বিদুর গান্ধারীর কাছে ছুটে আসেন। দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে গিয়ে দুঃসাশন ব্যর্থতার কথা জানান। ভীমসেন ও দ্রৌপদী কি কি ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছেন তা নিবেদন করেন। তিনি গান্ধারীকে বলেন – এই মুহূর্তে পাণ্ডবদের ও দ্রৌপদীকে তুষ্ট না করলে কৌরব বংশের বিনাশ অনিবার্য।


সব শুনে বিচলিত গান্ধারী বিদুরকে আজ্ঞা করেন— মহামন্ত্রী , আপনি মহারাজকে গিয়ে আমার বিনীত নিবেদন জানান। পাণ্ডবদের সমস্ত কিছু ফিরিয়ে তাদের ইন্দ্রপ্রস্থে সসম্মানে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করেন।


      বিকর্ণ মাতাকে নতজানু হয়ে প্রণাম করে। কিছুপরেই উদ্বিগ্ন বিদুর ফিরে আসেন। চিন্তিত বিদুরের দিকে তাকান গান্ধারী।


      বিদুর বলেন – মহারানি, পাণ্ডবদের সমস্ত কিছু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মহারাজ। তাঁরাও হস্তিনাপুরের পথে রওনা দিয়েছেন। পুনরায় অনর্থ ঘটেছে। মন্ত্রণাদাতা শকুনি ও কর্ণ দুর্যোধনকে বুঝিয়েছে যে সুযোগের অপব্যবহার করা উচিত নয়। পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানাতে। দুর্যোধন পিতাকে সেই অনুরোধ জানায়। পুত্রস্নেহে অন্ধ মহারাজ পিতামহ ভীষ্ম, অস্ত্রগুরু দ্রোণ, কৃপাচার্য প্রভৃতির পরামর্শ অগ্রাহ্য করে, পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনতে প্রতিহারী পাঠিয়েছেন।


      গান্ধারী হাতে হাত ঘষতে ঘষতে পায়চারি করতে লাগলেন। বিকর্ণ মাতার অনুমতি নিয়ে রথ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পাণ্ডবদের গতি রোধ করে পুনরায় পাশা না খেলে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বিকর্ণ জানান এটাই মাতা গান্ধারীরও আদেশ। পাণ্ডবভ্রাতারা রাজি হলেও রাজি হলেন না যুধিষ্ঠির — আবার যদি পাশা খেলতে হয়, তাই খেলব। জানি, এতে বংশনাশ হবে। কিন্তু ভ্রাতা, মাতা গান্ধারীকে জানিও, বৃদ্ধ জ্যেষ্ঠতাত ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ উলঙ্ঘন করে অধর্ম করতে পারি না। মাতা যেন আমাকে ক্ষমা করেন।


 মহাবীর ভ্রাতাদের ও লক্ষ্মীস্বরূপা পত্নী দ্রৌপদীকে নিয়ে যুধিষ্ঠীর চলেছেন। হতাশ বিকর্ণ দাঁড়িয়ে শুনছেন কুরুবংশের ধ্বংসের পদধ্বনি। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে তাঁর।


 


 


মন্ত্রণাকক্ষ


     


কুরক্ষেত্র মহাযুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধের শেষ। অভিমন্যু নিহত। পাণ্ডব শিবির শোকে মুহ্যমান। কৌরব শিবিরে উল্লাস। কর্ণ, শকুনি, জয়দ্রথ, দ্রোণ ও দুর্যোধন বসেছেন গোপন শলাপরামর্শে। চতুর্দশ দিনে শোকাকুল পাণ্ডবদের পরাভূত করার ব্যূহ রচনার কৌশল নিয়ে আলোচনা চলছে। গুপ্তচর নীলভদ্র মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করে। নীলভদ্রকে দেখে দুর্যোধন বলেন – কী খবর নীলভদ্র? পাণ্ডবরা কী সন্ধির প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবছে?


      মাথা নিচু করে নীলভদ্র – না যুবরাজ, শোক কাটিয়ে পাণ্ডবেরা ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছেন। অভিমন্যুর হত্যার জন্য সৌবীরাজ জয়দ্রথকেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছেন, কাল সূর্যাস্তের পূর্বে মহাবীর জয়দ্রথকে হত্যা করবেন। ব্যর্থ হলে তিনি অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণ বিসর্জন দেবেন।


      মন্ত্রণা কক্ষে নীরবতা নেমে আসে। সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। জয়দ্রথের ভীত কন্ঠস্বর – কুন্তীর গর্ভে কামুক ইন্দ্রের ঔরষে জন্ম অর্জুনের। অর্জুন আমাকে যমালয়ে পাঠাতে চায়! তোমাদের মঙ্গল হোক। আমি ফিরে যাচ্ছি নিজ রাজ্যে। সেখানেই আত্মগোপন করব। যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলে আমাকে অর্জুন বধ করতে পারবে না। তাছাড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা কাউকে হত্যা করার অধর্ম পান্ডবেরা করবে না। যুবরাজ ও সেনাপতি মহাগুরু দ্রোণের কাছে আমার আবেদন আপনারা আমাকে অনুমতি দিন। আমি নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে চাই।”


      দুর্যোধন বলেন — তুমি ক্ষত্রিয় নরব্যাঘ্র। ভয় পেয়ে ক্ষত্রধর্ম ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে চাও?”


      না ভ্রাতাশ্রী, আমি কোন হটকারিতা করতে রাজি নই। কৃষ্ণসখা অর্জুন। কৃষ্ণের সহায়তায় ছলে বলে কৌশলে আমাকে হত্যা করবেই। তোমরা অনুমতি দাও। আমি আত্মগোপন করি।


      তুমি আমাদের একমাত্র ভগ্নীর স্বামী। ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ বীরগণের মাঝে তুমি থাকবে। কে তোমাকে আক্রমণ করবে? আমরা সসৈন্যে তোমাকে রক্ষা করব। আমি স্বয়ং রথীশ্রেষ্ঠ মহাবীর, তবুও তুমি পাণ্ডবদের ভয় করছো?


      শকুনি পুলকিত হন – এত আনন্দের সংবাদ। আমাদের যুদ্ধ জয় নিশ্চিত। কাল আমরা সর্বশক্তি দিয়ে জামাতা জয়দ্রথকে রক্ষা করব সূর্যাস্ত পর্যন্ত। ব্যস তারপরই অর্জুন প্রাণ বিসর্জন দেবে। তোমাদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণও তাকে রক্ষা করতে পারবে না। অর্জুনহীন পাণ্ডবেরা এক লহমায় পরাজিত হবে বা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।”


      উরুতে হাত চাপড়ে অট্টহাসি হাসেন দুর্যোধন — মামাশ্রী আপনি ঠিক বলেছেন। সেনাপতি মহাগুরু দ্রোণাচার্য আপনার অভিমত কী?”


দ্রোণ বলেন – আমি তোমাদের সমভাবেই শিক্ষা দিয়েছি। যোগাভ্যাসে ও কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অর্জুন আধিকতর শক্তিশালী। তবুও আমি কথা দিচ্ছি আমি জয়দ্রথকে রক্ষা করবই। আমার সৃষ্ট অনেক ব্যূহ ভেদ করার কৌশল এখনও অর্জুন জানে না। আমি চক্রশকট ব্যূহ রচনা করব। ব্যূহের মুখ থেকে দুই ক্রোশ দূর পশ্চাতে পদ্মনাভ নামের এক গর্ভব্যূহ রচনা করা হবে। পদ্মনাভের মধ্যে থাকবে এক সূচিব্যূহ। যার মধ্যে জয়দ্রথ অবস্থান করবেন। পদ্মনাভের মুখে পাণ্ডবদের আক্রমণ প্রতিহত করবেন কর্ণ, শল্য, বৃষসেন ও কৃপাচার্য। দুঃশাসনসহ অন্য কৌরবভ্রাতারা সূচিব্যূহের মুখে থেকে সৌবীরাজ জয়দ্রথকে রক্ষা করবেন। আমি নিজে শকটব্যূহের মুখে থাকব। অর্জুন এই ব্যূহ কিছুতেই ভেদ করতে পারবে না।


      দুর্যোধন বলেন — সৌবীরাজ তুমি এবার তো নিশ্চিন্ত? সেনাপতি দ্রোণাচার্যের কৌশলে তুমি নিরাপদ।


     


  দ্রোণের চিন্তিত কন্ঠস্বর – আমার ভয় শুধু একজনকেই। তিনি হলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন। একদিনের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবের বরে জয়দ্রথ অর্জুন ভিন্ন অন্য পাণ্ডবদের জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জয়দ্রথের এখন সে ক্ষমতা নেই। মায়াসুর প্রদত্ত বৃগোধন গদাধারী ভীমের কাছে সমস্ত ব্যূহ প্রাচীর নিমেষে ধ্বংস হয়ে যাবে। সমস্ত মহারথেরা অর্জুনকে রুখতে ব্যস্ত থাকলে ভীমসেনকে প্রতিহত করবেন কে?”


      কর্ণ বলেন – আছেন একজন মহারথ। তিনি ভীমের ন্যায় গদা যুদ্ধে সমান পারদর্শী। তিনি তৃতীয় কৌরব, মহারথ বিকর্ণ। তিনি পারবেন ভীমকে সহজে প্রতিহত করতে।


      হেসে ওঠেন দুর্যোধন – তুমি হাসালে সখা। বিকর্ণ প্রতিহত করবে ভীমসেনকে! যে কিনা চিরকাল পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট। ভীমের কাছেই গদা যুদ্ধের কৌশলের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছে। মাতা গান্ধারীর নির্দেশে বিকর্ণ কৌরব পক্ষে অস্ত্র ধারণ করেছে। বিকর্ণ করবে দ্বিতীয় পাণ্ডবকে প্রতিহত!


      কর্ণ বলেন – একথা ঠিক। এই ত্রয়োদশ দিন যুদ্ধ হয়েছে। দুই যোদ্ধা পরস্পরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। মনে করে দেখুন, পঞ্চম দিনে ভয়ঙ্কর ভীমকে বাণে বিধ্বস্ত করে বিকর্ণ আপনার পাঁচ ভ্রাতাকে রক্ষা করেছিলেন। দশম দিনে পিতামহ ভীষ্মকে অর্জুন ও শিখণ্ডীর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করছিলেন। কৃষ্ণের নির্দেশে দ্রুপদ বিকর্ণকে আক্রমণ করে অন্য দিকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, তাই আমরা পিতামহকে হারিয়েছি। সেদিন বিকর্ণের হাতে পাণ্ডব পক্ষের এক অক্ষৌহিনী সেনাসহ বহু বীরের পতন হয়েছিল। মাতা গান্ধারীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বিকর্ণ আপনার আদেশ অমান্য করতে পারবে না।     


শকুনি বলেন – ভাগ্নে তোমার ভ্রাতাদের মধ্যে একমাত্র বিকর্ণকেই ভীমসেন বেশি স্নেহ করেন। তিনি ভীমের কাছে গদা যুদ্ধের কৌশল শিখেছিলেন। গুরু শিষ্যের পরস্পরের দুর্বলতার জন্য কেউ কাউকে হত্যা করবেন না ঠিক। সেটাই আমাদের লাভ। বিকর্ণ ভীমকে অন্যত্র সরিয়ে রাখলে অর্জুন একা ব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হবে না। কী মহাগুরু দ্রোণাচার্য আমি কী ভুল বললাম?


       দ্রোণ বললেন – আমরা বিকর্ণের উপর আস্থা রাখতে পারি।


 


দুর্যোধনের আহ্বানে বিকর্ণ মন্ত্রণা কক্ষে আসেন। যথাযথ সম্মান জানিয়ে তাঁকে বসতে দেওয়া হয়। বিকর্ণ জানতে চান তাঁকে কেন তলব করা হয়েছে। দুর্যোধন যুদ্ধের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলেন – বীরশ্রেষ্ঠ মহারথ বিকর্ণ আমরা কালকের যুদ্ধে তোমার শক্তির উপর নির্ভরশীল । কালকের যুদ্ধে তুমি আমাদের সবার প্রিয় একমাত্র ভগ্নী দুঃশলাকে চরম দুঃখের হাত থেকে বাঁচাতে পার। আমরা সবাই সৌবীরাজ জয়দ্রথকে রক্ষা করব। কিন্তু তোমাকে কালকের যুদ্ধে ভীমসেনকে প্রতিহত করার দায়িত্ব দিতে চাই। তোমার রণকৌশল আমাদের কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দিতে পারে। তোমার মতামত জানতে চাই।


বিকর্ণ একবার সভা কক্ষের সকলকে দেখলেন। কোনদিন তাঁকে কোন মন্ত্রণা সভায় ডাকা হয়নি। প্রতিহারি মারফত তাঁকে যুদ্ধের ভূমিকা জানান হত। এতক্ষণে তাঁকে ডাকার কারণ অনুধাবন করতে পারলেন। মুখে তাঁর তাচ্ছিল্যের হাসি – অগ্রজ, আপনার আদেশ বিনা তর্কে পালন করার জন্য আমি প্রতিজ্ঞা বদ্ধ। তবু আপনি আমার মত যখন জানতে চেয়েছেন, অনুরোধ করব জ্ঞাতিবিদ্বেষী এই অধর্ম যুদ্ধ আপনি বন্ধ করুন। এতে কৌরব-পাণ্ডব বংশের লাভ হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডব পক্ষে। তিনি ধর্মের পক্ষে। তাঁর স্মরণ নিলে কৌরব বংশ বিনাশের হাত থেকে রক্ষা পাবে।


অট্টহাসি হেসে ওঠেন কর্ণ – তৃতীয় কৌরব কোনটিকে তুমি অধর্ম বলছ? নিজ বিজিত রাজ্য রক্ষা করাই ক্ষত্রধর্ম। পাণ্ডবেরা পাশা খেলায় হেরে গিয়ে রাজত্ব হারিয়েছিল। এখন তারা রাজ্যের দাবী করছে? ওরাই তো হানাদার। মহারাজ দুর্যোধন জয় করা রাজত্ব রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছেন। একে তুমি অধর্ম বলতে চাও?


বিদ্রুপের হাসি হাসেন বিকর্ণ – কপট পাশা খেলা, ভরা রাজসভায় কুলবধূকে বস্ত্রহরণের চেষ্টা অধর্ম নয়! শর্ত ছিল বনবাস ও অজ্ঞাতবাস সঠিক পালন করে ফিরে এলে পাণ্ডবদের রাজত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। শর্ত লঙ্ঘন করা কী অধর্ম নয়?


শকুনি বলেন – প্রিয় ভাগিনেয়, বলবন, সুশাসক ও যে কোন যোদ্ধার থেকে ক্ষমতাবান তোমার পিতাকে কেবলমাত্র অন্ধত্বের কারণে সিংহাসন চ্যূত করা হয়েছিল, আমার ভগ্নী তোমাদের মাতা গান্ধারী কুন্তীর আগে গর্ভবতী হয়েও দৈব চক্রান্তে কুন্তীর আগে সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। শুধু তাই নয় পিতামহ ভীষ্মকে অর্জুন কোন ধর্ম পালন করে পরাজিত করেছিলেন?


তাই কী আপনারা সপ্তরথী ঘিরে নিরস্ত্র অভিমন্যুকে বধ করেছিলেন?


কর্ণ বলে ওঠেন – তুমি ক্লীবের মত কথা বলছ তৃতীয় কৌরব। কোন যুক্তিতে কপট পাশা খেলা বলছো? সেদিন দক্ষ দ্যূতক্রীড়ক মামা শকুনির হাতে পরাজিত হয়েছিল অদক্ষ দ্যূতক্রীড়াপ্রিয় যুধিষ্ঠির। তুমি পাণ্ডব প্রীতিতে অন্ধ, তাই তুমি তেমনভাবে পাণ্ডবদেরকে আক্রমণ করনি। ভীমকে এড়িয়ে গেছ। ইতিমধ্যে তোমার বারজন ভ্রাতা ভীমের হাতে নিহত হয়েছে। ভ্রাতৃঘাতককে হত্যা করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ভীমসেনকে আক্রমণ করছো না, এটা কোন ক্ষত্রধর্মের নিদর্শন?


দুর্যোধন বলেন – বৃথা তর্ক করে কালক্ষেপের কারণ দেখছি না। এক রাজা তার সমকক্ষ শত্রুকে পরাজিত করার কৌশল করবে, এটাই রাজধর্ম। আমি তাই করে চলেছি। এখন তোমার ধর্ম তুমি রাজাদেশ মান্য করবে কিনা জানাও।


সভাকক্ষ নিস্তব্ধ। সকলের দৃষ্টি বিকর্ণের উপর। উঠে দাঁড়ান বিকর্ণ। দুর্যোধনের চোখে চোখ রেখেন – রাজাদেশ পালন করা ক্ষত্রধর্ম। ধর্ম ও অধর্ম এক সুক্ষ্ম ভেদের উপর দাঁড়িয়ে। তাই আমিও তর্ক করতে চাই না। শুধু আমার উপলব্ধি আপনাকে জানিয়েছি। যুদ্ধের পূর্বে মাতার কাছে আমরা সকল ভাই শপথ করেছিলাম, আপনার আদেশ বিনা তর্কে পালন করব। তাই মাতার নামে প্রতিজ্ঞা করছি, কালকের রণের শেষে আমার ও ভীমসেনের মধ্যে একজন জীবিত থাকবেন। দ্বিতীয় পাণ্ডবকে হত্যা না করে জীবিত অবস্থা শিবিরে ফিরব না।”


 সবাইকে অভিবাদন করে বীরদর্পে বিকর্ণ সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মন্ত্রণা কক্ষের সকলে বিকর্ণের প্রতিজ্ঞা শুনে উল্লসিত হয়ে পড়েন।


 


গান্ধারী সমীপে


রাজমাতা গান্ধারী একা অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। বিকর্ণ কক্ষে প্রবেশ করে মাতার পদস্পর্শ করে প্রণাম করেন। গান্ধারী তাঁকে দুহাতে তুলে আলিঙ্গন বিকর্ণকে পাশে বসালেন – পুত্র তুমি কী কোন ব্যপারে চিন্তিত? কোন অশুভ সংবাদ আছে?


না মাতা, শেষবারের মত আপনার চরণ স্পর্শ করে বিদায় নিতে এলাম।


অজানা আশঙ্কায় চমকে ওঠেন গান্ধারী – কেন পুত্র, এমন আশঙ্কা করছো কেন?


যুবরাজের আদেশে কাল আমাকে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেনকে প্রতিহত করতে হবে। এ যাবত বারজন কৌরব ভ্রাতা তাঁর হাতে নিহত হয়েছেন। তিনি তো শত কৌরব বধের প্রতিজ্ঞা করেছেন। তাঁর ক্ষমতার কথা আপনার জানা। তাই কালকের মহারণের ফলাফল নিয়ে কোন চিন্তার অবকাশ আছে কী মাতা?


পুত্র তুমি একজন মহারথ। আমার কথা নয়। স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম কর্ণকে অধিরথ বলেছিলেন। কিন্তু তোমায় মহারথ বলেছিলেন, তুমি ক্ষত্রিয়, মহান কুরুবংশের রাজপুত্র। তোমার মুখে হতাশা মানায় না। তুমি কী ভীত পুত্র?


আমি মহারাজ শান্তনু ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বংশধর। আমি ভীত নই মাতা। শেষবারের মতো আপনাকে অনুরোধ জানাতে এসেছি, অগ্রজ দুর্যোধনকে সংযত করুন। তাঁকে অধর্মের পথ থেকে সরে আসতে বলুন।


পুত্র ধনুক থেকে তীর নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাকে কী তূণে ফিরিয়ে আনা যায়? আমার গর্ব ছিল আমি শতপুত্রের জননী। আমি পুত্র স্নেহে অন্ধ ছিলাম।কুন্তীকে হিংসে করতাম। পাণ্ডবদের শক্তিকে হেয় করেছি। ভাবতাম, আমার শতপুত্র মাত্র পঞ্চপাণ্ডবকে পরাজিত করবেই। মহারাজকে যেমন বোঝাতে পারিনি তেমনি দুর্যোধনকে নিবৃত্ত করার কোন চেষ্টা করিনি।


পাণ্ডবদের বারাণবতে পাঠানোর উদ্দেশ্য আপনাকে জানিয়েছিলাম। দ্যূতক্রীড়া কক্ষে সতী দ্রৌপদীরর হেনস্থা রুখতে না পেরে আপনার কাছে ছুটে এসেছিলাম। আপনি চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। মাতা, শ্রীকৃষ্ণ সহায় পাণ্ডবরা অপরাজেয়। মাতা, ধর্মের পথে সকলকে ফিরাতে বাধ্য করুন।


তুমি তো ন্যায় ও ধর্মের পথে রয়েছো। তোমার তো ভয় পাওয়ার কথা নয়।


ম্লান হাসেন বিকর্ণ – ন্যায়ের পথে আছি। অন্যায় বা অধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। আবার অধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করছি। তাই জয় সম্ভব নয়।


গান্ধারীর দৃঢ় কন্ঠস্বর – সম্ভব পুত্র। আঠারো বার জরাসন্ধ শ্রীকৃষ্ণকে পরাজিত করেছিলেন। ভীষ্ম তো চিরকাল ন্যায় বা ধর্মের পথে ছিলেন। তাঁদের দুজনকেই অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত করা হয়েছে। তোমাকেও অন্যায় যুদ্ধে যাতে পরাজিত করতে পারে কৃষ্ণ ও তার সহায় পাণ্ডবরা। শুধু এই ভয় করছি। নয়ত তুমি বিজয়ী হবেই।


সে ভয় করি না। ভীমসেন কোন অধর্ম করবেন না। রণক্ষেত্রে ভীম-অর্জুন ছাড়া আমায় পরাজিত করার ক্ষমতাধারী কেউ নেই। নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবি না। চিন্তা কৌরব বংশের বিনাশ নিয়ে। চিন্তা যুদ্ধ শেষে স্বজনহারা পৃথিবীতে আপনার ও পিতার জীবনের দুর্দশাকে নিয়ে।


বিকর্ণের মাথায় সস্নেহে হাত রাখেন গান্ধারী – যাও পুত্র ক্ষত্রধর্ম পালন কর। আশীর্বাদ করি কালকের রণে তোমার বীরগাথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।


বিকর্ণ মায়ের পদধূলি নিয়ে বীরদর্পে কক্ষ ত্যাগ করেন।


 


যুদ্ধক্ষেত্র


 


শকট ব্যূহ রচনা করে এগিয়ে চলেছে কৌরব সেনা। ব্যূহ মুখে রয়েছেন স্বয়ং দ্রোণাচার্য। পাণ্ডব সেনাকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে চলেছেন অর্জুন। ব্যূহ মুখে দুই মহারথের সাক্ষাত হয়। গুরু-শিষ্যের তুমুল যুদ্ধ হতে লাগল। বৃথা কালক্ষেপ হচ্ছে দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দেন— সখা, ব্যূহের দক্ষিণ পার্শ্বে গজ সৈন্য নিয়ে কৌরব ভ্রাতা দুর্মর্ষন রয়েছেন। আমরা ঐ দিক দিয়ে ব্যূহ আক্রমণ করলে দ্রুত সফল হব।


তাঁরা দুর্মর্ষনকে পরাজিত করে এগোতে গেলে দুঃশাসনের মুখোমুখি হন। কিন্তু সহজে দুঃশাসন পরাজিত ও আহত হয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেন। মহাদেবকে তুষ্ট করে দুর্যোধন পেয়েছিলেন কাঞ্চনময় কবজ। এই কবজ ধারন করলে তিনি একদিনের জন্য একজন পাণ্ডবকে সহজে প্রতিহত করতে পারবেন। তাই দুর্যোধন কবজ ধারণ করে অর্জুনকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন। দুজনের প্রবল যুদ্ধ চলতে থাকে। কৃষ্ণ কবজের গুণ বুঝতে পেরে, অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য ভীমকে আহ্বান করেন। অর্জুন ও ভীম একযোগে যুদ্ধ করে ব্যূহ ভেদ করে এগোতে চেষ্টা করেন। ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে কৌরব ভ্রাতা বিন্দ, অনুবিন্দ,সুবর্মা ও সুদর্শন নিহত হন। ভীম ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে অর্জুনের সাথে এগোতে লাগলেন। কর্ণ উপলব্ধি করেন দুজনকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। না করলে সহজে অর্জুন জয়দ্রথের সম্মুখীন হয়ে যাবেন। তাই তিনি অর্জুনকে আক্রমণ করেন। তাঁর নির্দেশে বিকর্ণ ভীমকে আক্রমণ করেন। বিকর্ণ ভীমের মুখোমুখি হয়ে প্রবল শর নিক্ষেপ করে তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলেন। ভীম চিৎকার করেন – প্রিয় বিকর্ণ ! আমার সম্মুখ থেকে সরে যাও। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই না। তুমি ধার্মিক, তুমি চিরকাল তোমার অধার্মিক অগ্রজকে ধিক্কার দিয়েছো। দ্যূতক্রীড়া কক্ষে একমাত্র তুমি আমাদের সমর্থন করেছিলে। সেই তুমি ধর্মের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে পাপাত্মা দুর্যোধনের হাত শক্ত করছো?


হে দ্বিতীয় পাণ্ডব, আমি ধর্ম অধর্ম বুঝি না। সেদিন যা করেছিলাম আমার কর্তব্য ভেবে করেছিলাম। আজ়ও কৌরব পক্ষে অস্ত্রধারণ করে আমার কর্তব্য পালন করছি।


নীতিহীনতার পক্ষে অস্ত্র ধারণ করা তোমার কর্তব্য!


হাসেন বিকর্ণ – আপনিও তো সব বিষয়ে আপনার অগ্রজের সাথে সহমত ছিলেন না। তবুও আপনি তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেননি। কারণ সেটাই আপনার কর্তব্য ছিল, তাই না?


বিকর্ণ আমি তোমায় মিনতি করছি তুমি আমার পথ থেকে সরে যাও। আমি তোমাকে বধ করতে চাই না।


হে দ্বিতীয় পাণ্ডব, ক্ষত্রিয় কখনও রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে না। আমাকে যদি এতই ভয়, তবে অস্ত্র ত্যাগ করে পরাজয় মেনে নেন। আজকের যুদ্ধে আমাদের একজন জীবিত থাকবে। হয় আমাকে পরাজিত করুন নয় নিজে পরাজয় বরণ করুন।


বলেই বিকর্ণ বাণ নিক্ষেপ করে ভীমের বাম হাতে আঘাত করেন। ভীমের রথ ভেঙে পড়ে ও অশ্বসকল নিহত হয়। ভীম গদা হাতে ‘তবে তাই হোক’ বলে বিকর্ণকে আক্রমণ করেন। দুই মহা যোদ্ধার ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হতে থাকে। একসময় ভীমের গদার আঘাতে বিকর্ণের গদা ছিটকে পড়ে। ভীম বিকর্ণের মাথায় সজোরে আঘাত করেন। বিকর্ণ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ভীমের হাত থেকে গদা খসে পড়ে। তিনি ছুটে চলে যান বিকর্ণের পাশে। কোলে তুলে নেন বিকর্ণের মাথা। পরম স্নেহে তাঁকে আদর করতে থাকেন। তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে অশ্রু।


বিকর্ণ চোখ খোলেন – ক্ষত্রিয়ের চোখে অশ্রু মানায় না অগ্রজ। এখন শোকের সময় নয়। এগিয়ে যান ভ্রাতা। মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন বিপদে। তাঁকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আপনি।


কাঁদতে কাঁদতে ভীম বলেন – হায় রে বিকর্ণ, তুমি ঠিক জানো ধর্ম কি। আনুগত্য ও মাতৃ-আজ্ঞায় বিবশ হয়ে আমরা লড়াই করছি। এই যুদ্ধ আমাদের জন্য অভিশাপ। যেখানে তোমার মত ধার্মিক এক পুরুষকে বধ করতে হল। হে আমার প্রিয় অনুজ আমাকে ক্ষমা করে দিও।


মৃদু হাসেন বিকর্ণ – হে আমার প্রিয় পুরুষ, এখন শোকের সময় নয়। আমরা মাতৃ আদেশে বিবশ। আমার কাজ শেষ। আপনি এগিয়ে যান। প্রিয় অনুজ অর্জুন বিপদগ্রস্থ। তাকে যে রক্ষা করতে হবে আপনাকে। মৃত্যুর পূর্বে আপনার স্নেহের স্পর্শ আমার সব কষ্ট লাঘব করেছে। আমার শেষ ইচ্ছে – আমার মৃত দেহের সৎকার যেন আপনার হাতে হয়।


ভীমের পদস্পর্শ করেই একট রুধির বমন করে মহাবীর ধার্মিক বিকর্ণ ঢলে পড়েন ভীমের কোলে। বুকফাটা আর্তনাদে চিৎকার করে ওঠেন ভীম। দুহাতে জড়িয়ে ধরেন বিকর্ণের দেহ।


সহসা পাঞ্চজন্যের আওয়াজ ও কৌরবদের সিংহনাদ শুনে ভীম বুঝতে পারেন অর্জুন বিপদগ্রস্থ। ধীরে ধীরে বিকর্ণের দেহ মাটিতে নামিয়ে ওঠে দাঁড়ান ভীমসেন। বাম হাতে চোখের অশ্রু মোছেন ও ডান হাতে গদা ধারণ করে এগিয়ে চলেন রণক্ষেত্রের দিকে। শেষবারের মত একবার ফিরে তাকান বিকর্ণের দেহের দিকে। দেখেন রণক্ষেত্রে পরম শান্তিতে শায়িত মহাবীর তৃতীয় কৌরব বিকর্ণ। ভীমসেনের বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, কৌরবপক্ষের এক ধার্মিক, সত্যাশ্রয়ী পরম প্রিয় অনুজ ভ্রাতা তৃতীয় কৌরব – বিকর্ণের জন্য।