উপন্যাস - লাস্যময়ীর ছোবল || সিদ্ধার্থ সিংহ || Lashamayir Chobol by Sidhartha Singha || Fiction - Lashamayir Chobol part -1


 

      লাস্যময়ীর ছোবল

                --সিদ্ধার্থ সিংহ


                         এক


হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সামনে ঋজু আর পরমার্থ অপেক্ষা করছিল। ওরা একটু আগেই এসেছে। গত কাল রাত সাড়ে বারোটায় অফিস থেকে বেরিয়ে নীচে যখন ড্রপ কারের জন্য অপেক্ষা করছে ঋজু, তখন হঠাত্‌ই পরমার্থ ওর কাছে এসে বলল, এই রে, আশিস তোমাকে বলতে বলেছিল। একদম ভুলে গেছি। কাল দাঁতনে একটা উত্‌সব আছে। সেখানে কবিতা পাঠেরও ব্যবস্থা আছে। ও তোমাকে বারবার করে যেতে বলেছে। তুমি যাবে?
ঋজু কী ভাবছিল। ও কিছু বলছে না দেখে পরমার্থ ফের বলল, কাল তো তোমার অফ ডে। চলো না।
— কখন?
— কাল সকালে। সাতটার সময়। হাওড়া থেকে।

হাওড়া থেকে ঋজুর বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, চেতলায়। ওখান থেকে একটাই বাস। সতেরো নম্বর। কখন আসে কোনও ঠিক নেই। তাই হাতে একটু সময় নিয়েই ও বেরিয়েছিল। কিন্তু রাস্তা পার হওয়ার আগেই দেখে বাস আসছে। ফলে সাতটা নয়, তার অনেক আগেই ও চলে এসেছে। এসে দেখে, অফিস থেকে অত রাতে বাড়ি গিয়েও এই সাতসকালেই সেই বিরাটি থেকে পরমার্থও এসে হাজির। ঘড়িতে তখনও সাতটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি।
ও সামনে আসতেই পরমার্থ বলল, চা খাবে?
— ওরা আসুক না। একসঙ্গে খাব। ট্রেন ক’টায়?
— তা তো জানি না। আশিস তো বলল, সাতটার সময় এখানে দাঁড়াতে।
— এখানেই বলেছে তো?
— হ্যাঁ রে বাবা...
— সাতটা তো প্রায় বাজে।
— এখনও বাজেনি। আসবে তো সেই সল্টলেক থেকে। সবার বাড়ি তো আর তোমার মতো হাওড়া স্টেশনের পাশে নয়, যে বাসে উঠলাম আর হাওড়ায় পৌঁছে গেলাম। চা খাবে? ওই তো আশিস...
ঋজু দেখল, শুধু আশিস নয়, ট্যাক্সি থেকে একে একে নামছে আরও তিন জন। তার মধ্যে দু’জন মহিলা।
আশিস কাজ করে আকাশবাণীতে। পরের সপ্তাহে রেডিওতে কী কী অনুষ্ঠান হবে, সেই অনুষ্ঠান-সূচি আনতে প্রত্যেক সপ্তাহে পরমার্থকে যেতে হয় ওর কাছে। আনন্দবাজারের যে দফতরে ও কাজ করে, সেখানে প্রুফ দেখা ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে ওই অনুষ্ঠান-সূচি এনে কম্পোজ করে দেওয়া ওর কাজ।
এই কাজ করতে করতেই আশিসের সঙ্গে ওর বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রেই পরমার্থ যেমন জেনেছে, ও লোকসঙ্গীত গায়। কবিতা লেখে। দুটো কবিতার বইও বেরিয়েছে। শুধু ও একাই নয়, ওর বউ রিনাও কবিতা লেখে। তেমনি আশিসও জেনেছে, পরমার্থও ইদানিং কবিতা লিখতে শুরু করেছে। অনেক কবির সঙ্গেই ওর আলাপ আছে। ওর মুখেই ঋজুর নাম শুনে আশিস বলেছিল, উনি কি আপনাদের অফিসে কাজ করেন নাকি?
— কেন, আপনি চেনেন?
আশিস বলেছিল, না, আলাপ নেই। তবে ওর অনেক কবিতা পড়েছি। উনি তো প্রচুর লেখেন। এত লেখেন কী করে? আপনার সঙ্গে ওনার কী রকম সম্পর্ক?
পরমার্থ বলেছিল, ভালই। ও তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই আছে।
— তাই নাকি? পারলে এক দিন নিয়ে আসুন না, জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।

ঋজুকে সে কথা বলতেই ঋজু বলেছিল, ঠিক আছে এক দিন যাবখ’ন। কিন্তু আজ নয়, কাল নয়, করে আর যাওয়া হচ্ছিল না। তাই পরমার্থ এক দিন ওকে বলল, আরে বাবা চলো না, গেলে তোমার লাভই হবে। ও এখন অভিজ্ঞানটা দেখে। কবিতা পড়ার জন্য ওর পেছনে কত লোক ঘুরঘুর করে, জানো? আর ও নিজে থেকে তোমাকে ডাকছে, তুমি যাবে না? ওখানে কবিতা পড়লে পাঁচশো টাকা দেয়।
তাতেও খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না দেখে ঋজুকে প্রায় জোর করেই ও একদিন নিয়ে গিয়েছিল আকাশবাণীতে। সেই আলাপ। তার পর এই।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে সামলাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের সামনে দিয়ে যেতে যেতেই আশিস বলল, চলে আসুন, চলে আসুন। দেরি হয়ে গেছে।
ও আগে আগে। পেছনে ঋজুরা। তারও পেছনে ট্যাক্সি থেকে নামা বাকি তিন জন।
কাউন্টারে তেমন ভিড় ছিল না। টিকিট-ফিকিট কেটে ওরা ট্রেনে উঠে পড়ল। না। ট্রেনেও খুব একটা ভিড় নেই। ছুটির দিন। তাই ফাঁকা ফাঁকা। একটা খোপেই ওরা সবাই বসার জায়গা পেয়ে গেল। এ দিকের সিটে ঋজু, পরমার্থ আর ট্যাক্সি থেকে নামা কোর্ট-প্যান্ট পরা ওই ভদ্রলোক। বাকিরা উল্টো দিকের সিটে। ট্রেন ছাড়ার আগেই আশিস সবার সঙ্গে সবার আলাপ করিয়ে দিল। কোর্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকটাকে দেখিয়ে বলল, ইনি মহাদেব মোশেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। বিবাহের ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক একটা বই লিখেছেন। এ ছাড়া ছড়া-টাড়াও লেখেন। আর ইনি হচ্ছেন কণিকা রায়। কলকাতা টেলিফোন্‌সে কাজ করেন। এখন টেলিফোন ভবনে, না? কণিকার দিকে তাকিয়ে নিজেই যেন তার কাছে জানতে চাইল। তার পরে বলল, ক’দিন আগে ওর একটা সুন্দর কবিতার বই বেরিয়েছে। আর এর পরিচয় কী দেব, ইনি আমার গিন্নি, রিনা গিরি।
ঋজু মহাদেববাবুর দিকে তাকাল। মহাদেববাবু আর কণিকার কথাবার্তা দেখে হঠাৎ কেন জানি ঋজুর মনে হল, ওদের মধ্যে কোনও একটা সম্পর্ক আছে।
বেশ কিছু দিন আগে স্কটিশ চার্চ কলেজের সামনে জটলা দেখে ও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জটলার মধ্যমণি মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রমহিলা। তাঁর অভিযোগ, তাঁর স্বামী এই কলেজে পড়ান। তাঁরই এক ছাত্রীর সঙ্গে তিনি প্রেম করেন। তাঁকে বহু বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তাঁর বড় বড় ছেলেমেয়ে আছে। তারা স্কুলে পড়ে। স্কুলের মাইনে পর্যন্ত উনি দিচ্ছেন না। সংসার খরচা তো নয়ই। সব ওই মেয়েটার পেছনে ঢালছেন। তাই শেষ পর্যন্ত উনি নাকি থানায় গিয়েছিলেন। থানা থেকেও ভদ্রলোককে ডেকে বলে দিয়েছে, যাতে তিনি ঠিকঠাক মতো সংসার করেন। বউয়ের গায়ে যেন হাত না তোলেন। অথচ তার পর থেকেই তিনি আর বাড়ি ফিরছেন না। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য উনি কলেজে এসেছিলেন। কিন্তু টিচার্স রুমের সামনে যেতেই উনি তাঁকে দেখতে পেয়ে যান। অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁকে ধাক্কা মেরে এক দৌড়। ভদ্রমহিলা এখন বলছেন, উনি এ দিকেই এসেছেন, আপনারা কেউ কি দেখেছেন? ঘিয়ে রঙের জামা পরা। কালো প্যান্ট। চোখে চশমা। মাথায় পাতলা-পাতলা চুল...
ওই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল ঋজুর। মহাদেববাবু আবার সে রকম নন তো! ঘরে বউ-ছেলেমেয়ে সব আছে। আর বাইরে এর সঙ্গে... এরা নিশ্চয়ই স্বামী স্ত্রী নন। ওঁর পদবি তো রায়। আর এঁর মোশেল।
টুকটাক কথা হচ্ছিল। ঋজু কথায় কথায় মহাদেববাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় থাকেন?
উনি বললেন, সল্টলেকে।
— সল্টলেকে কোথায়?
— তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে।
— আর আপনি? কণিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ঋজু।
— আমিও সল্টলেকে।
— সল্টলেকে কোথায়?
— তেরো নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে।
— ও। দু’জনেই কাছাকাছি থাকেন?
হঠাত্‌ মহাদেববাবু বলে উঠলেন, কাছাকাছি নয়, খুব কাছাকাছি। একই বাড়িতে। একই ঘরে। আসলে আমি ওর বাড়িতে থাকি।
কথাটা শুনে একটু থতমত খেল ঋজু। এত দিন ও শুনেছে, ছেলেরা মেয়েদের রক্ষিতা রাখে। এ তো উল্টো কেস। মেয়েটা এঁকে রেখেছে! নাকি মেয়েটা তাঁর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট চালায়! ঋজু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা কী? ও তখন মনে মনে ওর মতো করে দুই আর দুইয়ে চার করার চেষ্টা করছে।
তখন আশিসই বলল, এখনও বুঝতে পারলেন না, ওরা কর্তা-গিন্নি। ওদের আনতে গিয়েই তো এত দেরি হয়ে গেল।
কণিকা বলল, আমার কোনও দোষ নেই। আমি তো আসব না বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু রিনা গত কাল রাতে এত বার করে বলল যে, না এসে থাকতে পারলাম না। আর তা ছাড়া ছুটির দিনে এত তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যাস নেই তো...
ওকে মাঝপথে থামিয়ে মহাদেববাবু বললেন, আমি কিন্তু তোমাকে সাড়ে পাঁচটায় ডেকে দিয়েছিলাম।

ট্রেন চলছিল। কথা হচ্ছিল। জানালা দিয়ে হুহু করে হাওয়া আসছে। কণিকার কপালের দু’দিক দিয়ে নামানো দুটো লকস বারবার ওর চোখের উপরে এসে পড়ছে। হঠাৎ মহাদেববাবু তাঁর কোর্টের ভিতর পকেট থেকে একটা ছোট্ট পকেট-বুক বার করে ঋজুর দিকে এগিয়ে দিলেন— এটা বহু দিন আগে বেরিয়েছিল। তখন ছড়াই লিখতাম। এখন আর সময় পাই না।
ঋজু উল্টেপাল্টে দেখছে। একটা পড়তে গিয়েই হুচোট খেল। প্রচ্ছদ দেখে মনে হয়েছিল ছোটদের বই। কিন্তু এ কী! বইটা বন্ধ করে আশিসের দিকে এগিয়ে দিল। আশিস বলল, এটা আমি আগেই দেখেছি।
শব্দ ক’টার মধ্যে বইটা হাতে নেবার সামান্যতম সম্ভাবনা না দেখে রিনার দিকে বাড়িয়ে দিল ঋজু। বইটা হাতে নিয়ে রিনা বলল, এটা আমার পড়া। যখন বেরিয়েছিল, তখনই উনি দিয়েছিলেন। এখনও বোধহয় বাড়িতে আছে।
পরমার্থ বলল, ঋজুর কিন্তু অনেকগুলো বই আছে। তার পর ঋজুর দিকে তাকিয়ে বলল, সঙ্গে আছে নাকি?
— হ্যাঁ, আছে বোধহয়। বলেই, কাঁধের ব্যাগ থেকে দুটো বই বার করল ঋজু। একটা গল্পের আর একটা কবিতার।
পরমার্থ গল্পের বইটা নিয়ে আশিসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, জানো তো, এই গল্পটা যখন সানন্দায় বেরোয়, তখন বিশাল হইচই হয়েছিল। ওর বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার মামলা হয়েছিল।
ঋজু একটু লজ্জার ভান করে বলল, না না। আমার একার নামে নয়। আমাদের পাঁচ জনের নামে পাঁচ কোটি। আমার নামে শুধু এক কোটি।
— তাই নাকি? কী হয়েছিল? মহাদেববাবু জানার জন্য উত্‌সুক হয়ে উঠলেন।
পরমার্থ বলল, সে সময় তো সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এটা বেরিয়েছিল...
— তাই নাকি? ঋজুর দিকে তাকিয়ে মহাদেববাবু বললেন, কী হয়েছিল?
ঋজু বলল, আসলে আমি তখন সানন্দায় ফ্রিল্যান্স করি। মানে, লেখা ছাপা হলে টাকা পাই। না হলে, নয়। তো, সানন্দায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সিদ্ধার্থ সরকার আর অনিরুদ্ধ ধর ছিলেন আমার খুব কাছের মানুষ। তা, ওঁরা ঠিক করলেন, উত্তমকুমারকে নিয়ে একটা টিভি সিরিয়াল বানাবেন। তো, আমিও ভিড়ে গেলাম ওঁদের সঙ্গে। লেখালিখি তখন মাথায় উঠেছে। কিন্তু না লিখলে আমার চলবে কী করে? অনিরুদ্ধদাকে সে কথা বলতেই উনি বললেন, গল্প লিখতে পারবি? আমি তখন কবিতা ছড়া লিখি। তবু বললাম, পারব। উনি বললেন, তা হলে আজকে রাতের মধ্যেই একটা গল্প লিখে ফেল। কাল বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে পিটিএসে ধরিয়ে দিস। পিটিএস মানে, যেখানে কম্পোজ হয়। আমি বললাম, তুমি দেখবে না? উনি বললেন, তোর লেখা আবার দেখার কী আছে? ঠিক আছে, প্রুফে দেখে নেব। তার পর যখন লেখাটা ছেপে বেরোল, স্টলে খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, আশপাশের কোনও স্টলে সানন্দা নেই। সে দিনই বেলার দিকে লোকাল কাউন্সিলারের সঙ্গে আমার বাড়িতে এসে হাজির সৌগত রায়।
— কোন সৌগত রায়? আমাদের সৌগত রায়? অধ্যাপক?
পরমার্থ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, কংগ্রেসের এমএলএ।
— তার পর? বলেই, সামনের দিকে আর একটু ঝুঁকে এলেন মহাদেববাবু।
— তার পর আর কী? আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে চড়চাপড়, ঘুষি।
— সোজা কথায় বলো না, উত্তম মধ্যম। পরমার্থ ফোড়ং কাটল।
— হ্যাঁ, তার পর? নড়েচড়ে বসলেন তিনি।
— আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল লোকাল কাউন্সিলারের ডেরায়।
— কোন কাউন্সিলার?
— আমাদের ওখানকার।
— কী নাম?
— দেবু ঘোষ।
— ও। তার পর?
— আবার চড়চাপড়। সিগারেটের ছ্যাঁকাট্যাকা। তার পর হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে আমাকে ওরা নিয়ে গেল তিন তলায়। চিলেকোঠার ঘরে আমাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিল।
— তার পর?
দম নিয়ে ঋজু বলল, আমার বাড়িতে তখন রাজু ছিল। রাজুকে মনে আছে? সুদীপার সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছিল। সেই সুদীপা পাল, যে মা-বাবা-ঠাকুমাকে কালোজামের সঙ্গে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছিল। পরে রাজসাক্ষী হয়ে রেহাই পায়। যার জন্য ওর মাস্টার মশাইয়ের যাবজ্জীবন জেল হয়েছিল। মনে আছে?
— আপনি ওকে চিনলেন কী করে? উল্টো দিকের সিটে বসে প্রশ্ন ছুড়ে দিল আশিস।
— আসলে বারুইপুরে আমাদের একটা বাগানবাড়ি আছে। তার পাশেই থাকত রাজু। ছেলেটা এমনি কাজটাজ কিছু করত না। মাঝেমধ্যে ডাকাতি-টাকাতি করত। ধরাও পড়ত। ও তখন জেলে। সুদীপাও জেলে। একই দিনে ওদের ডেট পড়ত। জেল থেকে একই ভ্যানে করে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হত ওদের। ওই যাতায়াতের পথেই ওদের আলাপ। তা থেকে প্রেম। এবং বিয়ে। বিয়ে করে থাকবে কোথায়? রাজুর মা অমন একটা খুনি মেয়েকে কিছুতেই বউ হিসেবে মেনে নেবে না। ওরা তখন আমার মাকে এসে ধরল। আমাদের ওই বাড়িতে অনেকগুলো ঘর তালা বন্ধ হয়ে পড়ে ছিল। মা ওদের থাকার জন্য একটা ঘর খুলে দিল। এমনিতে আমরা ওখানে খুব একটা যেতে-টেতে পারি না। ফাঁকা ঘর পড়ে থাকলে কে কখন কোথা থেকে দখল করে নেবে, তার কোনও ঠিক আছে? তাই কয়েকটা ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। রাজুকে বলা হল, বাড়ি ভাড়ার টাকা কেউ দিলে, তুই তোর কাছে রেখে দিবি। যখন সময় পাবি, ওই বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসবি।
যে দিন এই ঘটনা ঘটে, তার আগের দিনই বাড়ি ভাড়ার টাকা দেওয়ার জন্য ও আর ওর বউ আমাদের আলিপুরের বাড়িতে এসেছিল। গল্পে গল্পে রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই মা ওদের বলেছিল থেকে যেতে।
তা, ওই লোকগুলো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দেখে রাজু নাকি পেছন পেছন এসেছিল। আমাকে যে ওই বাড়িতে জোর করে ঢুকিয়েছে, সেটা ও দেখেছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও আমি বেরোচ্ছি না দেখে ওর কেমন সন্দেহ হয়। হাঁটতে হাঁটতে ও সেই বাড়িটার পেছন দিকে চলে যায়। ওকে কেউ চেনে না। ফলে কেউ কোনও সন্দেহও করেনি। ওই বাড়িটার পেছনেই ছিল একটা পরিত্যাক্ত পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি। গাছগাছালিতে ভর্তি। কেমন যেন জঙ্গল জঙ্গল। কোনও লোকজন নেই। ওখানে সাপখোপ থাকতে পারে জেনেও ও কিন্তু এতটুকু ভয় পায়নি। আমাকে যে বাড়িতে ঢুকিয়েছিল, সেই বাড়ির জলের পাইপ বেয়ে তরতর করে ও ছাদে উঠে গিয়েছিল। সেখানেও নাকি কেউ ছিল না। চিলেকোঠার ঘরে তখন আমি একা। দুমদাম করে দরজা ধাক্কাচ্ছি। সেই আওয়াজ শুনেই ও ছিটকিনি খুলে দেয়। আমি বেরিয়ে এসে ওর সঙ্গেই পাইপ বেয়ে নীচে নেমে আসি। প্রথমেই ফোন করি সুদেষ্ণাদিকে। সুদেষ্ণাদি তখন সানন্দায় কাজ করেন। উনি বললেন, লোকাল থানায় একটা ডায়রি করে এখানে চলে আয়। কিন্তু লোকাল থানা আমার ডায়রি নিলে তো। অগত্যা সুদেষ্ণাদির কথা মতো সানন্দার অফিসে চলে যাই। আমাদের মতোই ওখানে লেখালিখি করত, আমাদেরই বন্ধু গৌতম চক্রবর্তী। ও তখন ওখানে ছিল। সুদেষ্ণাদি ওকে নিয়ে ফের থানায় যেতে বলল।
আমরা গেলাম। এবং অবাক কাণ্ড, ও.সির ঘরে ঢোকার পরে আমার নাম শুনেই ও.সি বললেন, আপনি তো আমাকে নিয়েও লিখেছেন। আমি তো অবাক। কিছুতেই মনে করতে পারছি না, ওঁকে নিয়ে আমি আবার কী লিখলাম! তখন উনি তাঁর টেবিল থেকে কালো ফোনটা সরিয়ে বললেন, দেখুন, ফোনের নীচে লোকনাথ বাবার ছবি। মনে পড়ে গেল, গল্পের এক জায়গায় ছিল, লোকাল থানার ওসি লোকনাথ বাবার খুব ভক্ত। কিন্তু সেটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে, সে জন্য উনি টেবিলের কাচের তলায় লোকনাথ বাবার ছবি রেখে ফোন দিয়ে ঢেকে রাখেন। বুঝতে পারলাম, আমার অবস্থা শোচনীয়। যতই বানিয়ে বানিয়ে লিখে থাকি না কেন, সব কিছুই কেমন যেন কাকতালীয় ভাবে মিলে যাচ্ছে।
— তার পর কী হল? আশিসের পাশে বসে ছিল রিনা। সে উদগ্রীব হয়ে উঠল।
— তখন লালবাজারের ডিসিডিডি ওয়ান ছিলেন গৌতমমোহন চক্রবর্তী। তাঁর সঙ্গে দীপান্বিতাদির খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। দীপান্বিতাদি কাজ করতেন সানন্দায়। ফাটাফাটি দেখতে ছিলেন। যেমনি লম্বা, তেমনি ফর্সা। টানা-টানা নাক-চোখ। যে কোনও পুরুষকে ঘায়েল করার পক্ষে যথেষ্ট। তখন সানন্দার সম্পাদক ছিলেন অপর্ণা সেন। প্রথম প্রথম তো অপর্ণা সেনের সঙ্গে আমি ওনাকে গুলিয়ে ফেলতাম। উনি আগে ছিলেন ভট্টাচার্য। পরে আনন্দবাজারের ফোটোগ্রাফার অশোক মজুমদারকে বিয়ে করে হন মজুমদার। সেই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। পরে আরও অনেকের সঙ্গেই ওঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। শোনা যায়, সমরেশ বসুর সঙ্গেও নাকি ওঁর একটা সম্পর্ক ছিল। সেটা এত দূর গড়িয়েছিল যে, বিয়ে হয়-হয় আর কী। তখন তো মোবাইল ছিল না। চিঠি আর হাত-চিঠিই ছিল সম্বল। কত চিঠি যে সমরেশবাবু ওঁকে লিখেছিলেন! অনিরুদ্ধদার সঙ্গেও ওঁর যথেষ্ট মাখামাখি ছিল। ওঁদের প্রেম যখন তুঙ্গে, তখন নাকি দীপান্বিতাদি একদিন সোজা গিয়ে হাজির হয়েছিলেন অনিরুদ্ধদার বাড়িতে। অনিরুদ্ধদার বউ মিতা বউদিতে বলেছিলেন, তুমি ওকে ছেড়ে দাও। আমরা বিয়ে করব।
না। সে কথা শুনে মিতা বউদি এতটুকুও বিস্মিত হননি। বরং খুব ঠান্ডা মাথায় ওঁর কানের দুলটা দেখিয়ে বলেছিলেন, কোথা থেকে কিনেছ গো? দারুণ তো ডিজাইনটা...
তো, অনিরুদ্ধদার সঙ্গে ওঁর যেমন প্রেম ছিল, তেমনি ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ঝগড়াও হত খুব। এক বার সমরেশ বসুকে নিয়ে ওঁদের মধ্যে খুব ঝামেলা হয়। দীপান্বিতাদি এত রেগে যান যে, তক্ষুনি বাড়ি গিয়ে আলমারির গোপন দেরাজ থেকে তাঁকে লেখা সমরেশবাবুর সব চিঠি বার করে এনে, সোজা হাওড়া ব্রিজের ওপর থেকে গঙ্গায় ফেলে দেন। ওগুলো থাকলে তরুণ গবেষকেরা নিশ্চয়ই সমরেশ বসুর পত্রসাহিত্যের উপরে ডক্টরেট করতে পারতেন! অনিরুদ্ধদার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে উনি ফের আর একজনকে বিয়ে করেন। তখন হন নায়ার।
— তার পর কী হল? মহাদেববাবু প্রশ্ন করতেই ঋজু বুঝতে পারল, কথা বলতে বলতে ওর যেটা হয়, সেটাই হয়েছে। মূল বিষয় থেকে সরে গেছে ও। তাই তড়িঘড়ি নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তো, সেই দীপান্বিতা ফোন করে দিলেন গৌতমবাবুকে। সঙ্গে সঙ্গে উনি স্টেপ নিলেন। পর দিন খুব ভোরে, পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমাদের বাড়িতে এসে হাজির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে আমাদের এলাকার আর এক কংগ্রেস নেতা বাবলা আইচ। তখনও তৃণমূল হয়নি। উনি বললেন, তুমি আমার ভাইয়ের মতো। একদম ভয় পাবে না। আমি যা বলার দেবুদাকে বলে দিয়েছি। উনি আর তোমাকে ডিসটার্ব করবে না। তোমার যদি কোনও দরকার হয়, আমাকে বলবে। যদি চাও, আমার ছেলেরা তোমার বাড়ি গার্ড দেবে।
কিন্তু তার আর দরকার হয়নি। সে দিনই আনন্দবাজার আর টেলিগ্রাফের প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছাপা হয় সেই খবর। তার পর থেকে লোকাল কাউন্সিলার, তাঁর চেলাচামুণ্ডা, এমনকী সেই এম এল একেও আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে আর কখনও দেখা যায়নি।
ঋজু থামতেই পরমার্থ বলল, ওই গল্পের জন্যই তো ওর চাকরি হল।
কণিকা এতক্ষণ গোগ্রাসে ওর কথা শুনছিল। হঠাৎ বলল, তাই নাকি?
পরমার্থ ফের বলল, তার পর কত কাণ্ড, তার দিন কতক পরেই ছিল ফাইফোঁটা। আমি নিজে দেখেছি, অফিসে এসে মমতা ওকে রাখী পরিয়ে গেছে। শুধু ওকে নয়, ওর আশপাশে যারা ছিল, তাদেরও।
কণিকা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। শুধু বিড়বিড় করে বলল, তাই?
কথা বলতে বলতে কখন ট্রেন ঢুকে পড়েছে খড়্গপুরে, ওরা বুঝতে পারেনি। সেখানে অপেক্ষা করছিল উৎসব কমিটির দুটি গাড়ি। তাতে উঠে ওরা রওনা হয়ে গেল দাঁতনের দিকে।


                                               ক্রমশ...


দ্বিতীয় পর্ব টি পড়তে ক্লিক করুন নীচে দেওয়া লিংক টি---

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024