নয়
Wednesday, November 30, 2022
উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -29
Tuesday, November 29, 2022
ছোট গল্প - ভুতুড়ে ট্যাভার্ন || লেখক - বৈদূর্য্য সরকার || Written by Boidurjya Sarkar || Short story - Vuture tavarn
ভুতুড়ে ট্যাভার্ন
বৈদূর্য্য সরকার
'ঋতুপর্নের ফিল্মের ইন্টিরিয়ার কৈশোরে কল্পনা করে , মধ্যতিরিশে যাদের ঘরদোর জীবন হয়ে যায় স্বপন সাহা মার্কা... তারা সব এসে জোটে বন্দুক গলিতে ।'
শুনে রে রে করে ওঠে পিনাকি । সে এখনও বুঝতে চায় না, আমাদের মতো এখানকার সবার জীবনের চিত্রনাট্য লেখা শেষ হয়ে গেছে এবং তা চূড়ান্ত ফ্লপ । আমি হেসে বলি, আর তো ক’টা দিন... তারপর তাড়াতাড়ি বুঝে যাবি নিয়তির মানে কী ! আজ পিনাকির জন্মদিন । সব বড় বড় লোকের মতো সে গ্রীষ্মের জাতক । এক আধুনিক জ্যোতিষের কাছে শুনেছি, গরমকালে জন্মানো লোকেদের তাকদ অন্যদের থেকে বেশি হয় । সূর্যের তাপ ওরা ধারণ করতে পারে । সত্যি মিথ্যে জানি না, তবে এটা ঠিক পিনাকির উত্তাপ উদ্দীপনা খানিক বেশি । বড় একটা আলসেমি তাকে মানায় না, বিস্তর দৌড়ঝাঁপের কাজ । সেজন্যে দরকার যথেষ্ট ফুয়েল ফর ইন্টারন্যাল সিস্টেম। আমি অবশ্য ইদানিং ওর সাথে পাল্লা দেওয়ার অবস্থায় থাকি না মধ্যতিরিশে এসে। তাছাড়া বসারও সুযোগ হয় না বিশেষ ।
দু'বছর অবশ্য লকডাউন আর করোনাতেই কেটে যাচ্ছে । নয়তো ট্যাভার্ণে দু’পাত্তরের ব্যবস্থা হতো ।
এখন সবার অবস্থা হয়েছে আত্মহত্যাপ্রবন । আগে এ কথা পদ্যেই ব্যবহার করেছি, এখন জীবনে উঠে এসেছে । মাসের পর মাস কাজ নেই, মাইনে অনিয়মিত । তার মধ্যে নানারকম রোগ ব্যাধি আর মিডিয়ার ভীতিসঞ্চার করা খবর । রোজই নতুন নতুন তরিকায় সেই এক ভয়ের খবর তুলে ধরা । এই করেই যে কত কোটি লোকের কাজ গেছে, আরও কত যাবে... তার ঠিক নেই ।
ভোম্বলদা আড্ডায় এসে মিডিয়ার লোকেদের একহাত নেয় । তার ট্যুরিজিমের অবস্থা সঙ্কটজনক, আর প্রাইভেট টিউশান তো উঠে যাওয়ার পরিস্থিতি । পরীক্ষার ঠিক নেই যেখানে, কে পয়সা দিয়ে পড়তে আসবে । শুনলাম, ছাত্রদের বাঁশ দেওয়ার ভরপুর ঐতিহ্য ভুলে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বাড়িতে বই দেখে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে ।
এই দু'টো বছর যা চলছে মাথাখারাপ অবস্থা হয়েছে সবারই । তবে ভোম্বলদার একটা ব্যাপারে জ্ঞান বেশ টনটনে, ঘরে আসর বসানোর ব্যাপারে। বাইরে গিয়ে খরচ করা পোষায় না তার । জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি টানাটানির এই গল্প বাপমায়ের মুখে শুনতে শুনতে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আজকাল আর আলাদা করে বিশেষ দুঃখবোধ হয় না । বাপমা তাদের পঞ্চাশ বছরের পুরনো ভ্যালুজ আর সর্বদা এই টানাটানির কীর্তন শুনিয়ে জীবনের প্রথম তিরিশ বছরের দফারফা করে ছেড়েছে । পরের তিরিশ বছরের দায়িত্ব নিয়েছে বৌ । সেই প্রাচীন কাহিনী আর সেসবের বাইরে না যাওয়া মন । দোষ দিয়েই বা কী লাভ ! অধিকাংশ মেয়েকেই দেখি – ডিজিট্যাল গ্যাজেটে অভ্যস্ত, ইউটিউব দেখে রান্না থেকে চুল বাঁধা শিখে ফেসবুক লাইভ, ফেমিনিজম চটকে তামাম ছেলেপুলের মাথা খারাপ করে... অথচ মনের মধ্যে দু’শো বছরের অন্ধকার । যদিও সেসব সরাসরি বলার উপায় নেই । বাপের পয়সায় ফুটানি করে সব হয়েছে বিপ্লবী । আর পরবর্তী জীবনে বর নামক একটি দুর্লভ গর্দভ তৈরি আছে যাবতীয় জিনিসের বোঝা বওয়ার জন্যে ।
এক সহকর্মী বলে- দ্যাখো ভাই, এসব বলে তো লাভ নেই... আমাদের কামের তাড়নাও তো আছে । মানি, তা অন্যান্য প্রবৃত্তিগুলোর থেকে অবশ্যই গুরুতর হয়ে ওঠে একটা বয়সের পর । এর টানেই জীবনের যাবতীয় আহ্লাদ আকাঙ্ক্ষা আশাকে জলাঞ্জলি দিতে হয় । ঢুকতে হয় দাম্পত্য নামক এমন একটা ব্যাপারে – যেটা দুনিয়ার কেউ খুব ভাল না বুঝলেও সবাইকেই পালন করে যেতে হয় নিয়মমাফিক । তাই পিনাকির যাবতীয় আত্মবিশ্বাসী কথার একটাই উত্তর দিই , বিয়ে থা হোক... তারপর দেখবো । তাতে পিনাকির মতো তর্করত্ন পর্যন্ত ব্যাকফুটে গিয়ে বলে, হ্যাঁ... তখন পরিস্থিতির বিচারে কথা তো বদলে যেতেও পারে ।
২
আমরা লক্ষ্য করছিলাম, চারদিক কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আসছে । আশপাশের সব জায়গায় খাঁখাঁ শূন্যতা । থেকে গেছে আমাদের মতো কিছু ব্যর্থ লোকজন । সব বাড়িতেই সিনিয়ার লেভেলে মৃত্যুমিছিল । থাকার মধ্যে অশক্ত বৃদ্ধা আর আমরা । যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের বউ । তবে এটা বোঝা যাচ্ছিল, বাড়িতে ছেলেবেলায় দেখা স্থানাভাব ব্যাপারটার উল্টোদিকটাও খুব একটা স্বস্তির নয় ।
বন্দুক গলিতে যাওয়া আমাদের সাবেক দলেও ভাঁটার টান । একসময় ছ’আটজন মিলে যাওয়া হয়েছে । এপাড়া সেপাড়া, কাবাব পরোটা, খালাসিটোলা অশোকা সব ফুরিয়ে শেষে এই বন্দুক গলি । নাম বাহারি হলেও ক্রমশ ম্রিয়মাণ এসব অঞ্চল । সব বুড়োঝুরো লোকেরা আসে। যারা খুঁজেপেতে এখানে আসে, একটাই কারণ – শহরে সবথেকে সস্তা । একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম – আমাদের যতো বয়স বাড়ছে, কথাবার্তাও যেন ফুরিয়ে আসছে । ‘যা হওয়ার তাই হবে’, এর’ম একটা ভাব দিনকে দিন বাসা বাঁধছে ।
বন্ধু তার বন্ধু আবার তার বন্ধু... এভাবে জড়ো হতো লোক । যেমন আমাদের পাড়ার বন্ধু পটলা, তার সংগঠনের বন্ধু বোধি, তার ইউনিভার্সিটির বন্ধু ইসমাইল । পটলা ও বোধি আবার থার্ড স্ট্রিম পলিটিক্সে ভিড়েছিল । এখন অবশ্য সেসব ফরসা। পিনাকি আবার এখনকার শাসকের এককাট্টা সমর্থক, আমি বিরোধি । মুছে যাওয়া আগের শাসক দলের নেতার দৌহিত্র ইসমাইল । সে আবার ইংরিজিতে নভেল লেখে । শুনলে কেমন আশ্চর্য লাগে । তবে ছেলেটা একেবারে মাটির মানুষ । তবে ওইটাই যা বেশি শক্ত । সে শিলঙের স্কুলে পড়ত, সেখানে শ’খানেক অ্যাফেয়ার । এখানেও কয়েকটা কেঁচেগণ্ডূষ সম্পর্ক । সেসব নিয়ে আমাদের কারোর মাথাব্যাথা নেই অবশ্য । বরং তার পড়াশোনার রেঞ্জ দেখে হীনমন্যতায় ভুগতে হয় । তবে পানশালায় কোনও কথাই দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না ।
‘সমবেত হাসিঠাট্টায় দিন কাটে’ – এমনটা বলতে পারলে ভাল হতো । ইদানিং পিনাকির সাথে পটলা বা ইসমাইল ছাড়া বড় একটা কেউ আসে না । ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই । ব্যস্ততার ভাণ করতে হয় ।
পিনাকি রোজগার যাই করুক না কেন, পানশালায় সে কার্পণ্য করে না। তার চোখেমুখে তখন যাবতীয় দৈন্যকে কিনে নেওয়ার স্পর্ধা ফুটে ওঠে । খানিকটা অকাতরেই টাকাপয়সা ছড়ায় বেয়ারা দারোয়ানদের মধ্যে । ফলে খাতির পায় নিঃসন্দেহে । কিছু বলতে গেলে বলে, এতে তার মেজাজ শরিফ থাকে ।
মেজাজ নিয়েই তো হয়েছে ঝামেলা । বাল্যে সেসব নিয়ে বোধ থাকে না । কৈশোর থেকে আমরা বোধহয় নানারকমে হেজে গেছিলাম । বেশ মনে পড়ে, একটা সময় পর্যন্ত মুখে একটা অমলিন হাসি লেগে থাকতো - যা অকাতরে দেওয়া যায় । কিন্তু আজকাল খেয়াল করে দেখেছি, রেজাল্ট চাকরি মাইনে সংসার সব মিলিয়ে কপালে একটা স্থায়ী ভুরু কোঁচকানো ভাব চলে এসেছে । পিনাকির ক্ষেত্রে দেখেছি, অদ্ভুত একটা আক্রোশ জন্মেছে জগৎ সংসারের প্রতি। সেটা অবশ্য অকারণে নয়, যে কিশোরীকে সে টিনএজ থেকে স্বপ্নে দেখেছে... সেই মেয়েটি এখন জননী হলেও যোগাযোগ করে মাঝেমাঝে । তাতেই বাবুর ঘুম উড়ে যায় ।
আমাদের কৈশোরে ক্রিকেটে বেটিং জিনিসটা নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়েছিল । তারপর নানা কাণ্ডকারখানার পর এখন দেখি বেটিং সাইট খেলার উদ্যোক্তা হয়ে বসেছে । আমরাও ড্রিম ইলেভেন খেলি পাঁচ দশ টাকার । খেলা দেখলে মনে হয় – সব স্ক্রিপ্টেড । তবু দেখি, সন্ধেবেলায় বিনোদন তো বটে । শিল্প সাহিত্য খেলাধুলা সবই আসলে বিনোদন, অন্তত তাই ভাবলেই সুবিধা । অনেক লোকে হাহুতাশ করে – বই না পড়ে ঘরের বউরা মেগাসিরিয়াল বা চ্যাট করে কেন ! মনে হয়, তার আগে গৃহকর্মের ভেতরে বিনোদন ঢোকানো ছিল । কিন্তু বিনোদনের নিয়মে যেটা কম পরিশ্রমে বেশি মজা দেয়, সেটাতেই তো মানুষ মজবে ।
‘সব জায়গাতেই অপ্রাপ্তি থেকেই আমাদের যাবতীয় পণ্ডশ্রম’... বোঝার বয়স হয়ে গেলেও আমরা বন্দুক গলিতে এসে সে কথা ভুলে যাই । সেই থেকে যাবতীয় তর্কাতর্কি রাগ মনখারাপ । ফেরার পথে আগে সামনের একটা দোকানে বিফ কাবাব খাওয়ার অভ্যেস ছিল । এখন সবাই অম্বলজনিত কারণেই হয়তো খালি পেটেই থাকতে পছন্দ করে । তাতে খরচ কমল আবার বাড়ি ফিরে কুমড়োর ঘ্যাঁট সাগ্রহে খাওয়ার মতো একটা পরিস্থিতিও তৈরি হল । মনে হয়, আমাদের আগের প্রজন্মের বাইরে খাওয়া বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেস ছিল না বলে টাকাপয়সা খানিকটা জমেছিল। সুবিধে ছিল, তাদের নাকের ডগায় এর’ম বিপুল বিজ্ঞাপন ও ইএমআইয়ের সুবিধের কথা ঝোলানো থাকতো না।
একদিন যেমন ইসমাইল বলল, ওর একটা এক লাখের চাকরি চাই । জানি, এসব কথা দু’পাত্তরের পরেই চলে । সেজন্যে পিনাকি বলে উঠল, ওর দরকার দু’লাখ । একলাখ তো ওড়াতেই চলে যাবে । মোদ্দা কথা হল, এর’ম অনেককিছুই আমরা প্রত্যেকে চাই । কেউ কেউ পায়, বাকিদের মার্কেটের নিয়মে স্বাভাবিকভাবে হয় না । কিন্তু যখন দেখা যায়, বিরাট চাকরি করা লোকেরা এমন কিছু নিউটন আইনস্টাইন নয়... সেখান থেকেই শুরু হয় যাবতীয় অশান্তি ।
৩
বাল্যের রেডিওতে ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’ শুনে আমি দিব্যি কাঁদতাম । স্পষ্ট মনে আছে । পরে ভেবে দেখেছি, স্মৃতি জিনিসটা বড় বেআক্কেলে । আর আমি যে যুগের লোকে যেখানে এই গানের পৌঁছনোর কথা নয় । তবু মিস্তিরিদের নিত্য ঠোকাঠুকির ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি কিংবা মহালয়ায় জেগে ওঠা রেডিও তখনও আমাদের অবলম্বন । সেই থেকে মনের মধ্যে একটা বদ্ধমূল হীনমন্যতা চেপে বসে আছে । মনে হয়, অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা তখন বড় হয়েছি । এর থেকে ভাল অবস্থায় অনেকে ছিল নিশ্চিত, কম্পিউটার না হলেও ছোটবড় নানারকমের ভিডিও গেম অনেকের হাতে । এয়ারগান নামের অতি উত্তেজক জিনিস দেখে থাকলেও কেনা যায় বলে জানতাম না । দৌড় ছিল চার’ছ টাকার ক্যাপ বন্দুক ।
পরে ভেবে দেখেছি, চারপাশের লোকজনের উপহার দেওয়ার প্রবণতা বড় একটা ছিল না । অন্তত আমার ক্ষেত্রে । আসলে এদিক থেকে যের’ম, উল্টোদিক থেকেও একই রিঅ্যাকশান । পুরোটাই একটা সিস্টেম । পুজোয় সংখ্যায় বেশ কিছু জামাকাপড় হলেও অধিকাংশ এলেবেলে ধরণের । ফলে কলেজে ভর্তির পর টিউশানি ইত্যাদি করে পুজোর খরচ তোলাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল । বাড়ির লোকের ধারণা ছিল, পুজোর দিনে ঘরে বসে থাকলে ছেলের মন খারাপ । তাকে সেজন্যে বাইরে যেতে উৎসাহিত করো । কিন্তু বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে যে টাকাপয়সা লাগে এবং সবার অবস্থা একরকম হয় না...। সেটা বাড়ির গোদাগুলোর না বোঝার মতো কি ছিল, কে জানে !
এখন ভোম্বলদাকে দেখে মনে হয়, সবার আজকাল গরীব থেকে হঠাৎ বেমক্কা বড়লোক হওয়ার নেশা । তখন তার উল্টো মতটা চালু ছিল । যদিও জীবন সংগ্রামের নানা গালভরা নাম শুনে আজকাল সেগুলোকে প্রলাপ বলেই মনে হয় । ভোম্বলদা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন করে কিছু লোক জোগাড় করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে । মন্দ হয় না, নিজের ঘোরাটা উপরি । এমনিতে একা মানুষ, সময় কাটাতে কিছু একটা করতে হবে তো !
ভোম্বলদা আগের বামপন্থী সরকারের ছাত্র শাখার জেলাস্তর পর্যন্ত উঠেছিল । দু’চারটে বইপত্র পড়ে স্টিরিওটাইপ বিপ্লবী বক্তৃতা করতেও শিখেছিল । যদিও ক্যাবলা বলে তেমন কিছু বাগাতে পারেনি । ইসমাইলকে দেখার পর বুঝেছি, এই না বাগাতে পাড়া লোক দলটার সব স্তরেই ছিল । সেজন্যে তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে । এখনকার সরকার এক অর্থে বেশ এফিসিয়েন্ট – ফেলো কড়ি মাখো তেল ।
আমার অবশ্য কোনও কিছুতেই আজকাল তেমন ইন্টারেস্ট নেই । দুর্গাপুজো থেকে ভোট... সব ইভেন্ট তুলে দিলেই বা ক্ষতি কী – এর’ম একটা ভাব। পিনাকি বলে, তুমি কি নিহিলিস্ট হয়ে গেলে নাকি ! আমি উত্তরে বলি, আমার আর কিছুই হওয়ার নেই । সব চুকেবুকে গেছে ।
এখন সব কিছুকেই মনে হয় – নিয়তি নির্দিষ্ট । কোথাও আলাদা কিছু হওয়ার জো নেই । বললে, অনেকেই রেগে ওঠে । তাহলে পক্ষে ভোট দিলেও যা বিপক্ষেও তাই ! আমার মনে হয়, একজনের সামান্য ভোটে কি সত্যিই কিছু বদলায় ? পিনাকি যুক্তি দেয়, তোমার মতো ভাবলে কোনও দেশে কোনও কালে কোনও পরিবর্তন আসতো না । ভাবি, সেও ঠিক । বন্দুক গলিতে এসব আলোচনা করে বাড়ি ফেরার পথে বিশেষ কিছু মনে থাকে না । ইসমাইল কীসব কঠিন থিয়োরি আলোচনা করে, নানারকম বইয়ের রেফারেন্স দেয়... ভাল বুঝতে পারি না । তার দল এই দশ পনেরো বছরে একেবারে এভারেস্টের চূড়া থেকে পাতালের গভীরে গিয়ে হারিয়ে গেছে, মনে থাকে না বোধহয় নেশার ঝোঁকে।
একদিন সে বলল, গ্রাফিক নভেল লিখবে তার জন্যে ছবি আঁকার লোকের ব্যাপারে নানা সমস্যা । তার সাথে বলল, কোন একটা বইয়ে কী পড়েছে যা পড়ার পর আর বিয়ে করা যায় না । দু’টো মিলেমিশে আমার মনে রয়ে গেল – বিয়ের কার্টুন আঁকার জন্যে লোক দরকার । মনেই শুধু থাকলো না, ফেসবুকে আপডেট দিয়ে ইসমাইলকে ট্যাগ করে টাকাপয়সার সুবন্দোবস্ত আছে... সেটা জানাতেও ভুললাম না । তারপর জানি না কী ঘটেছিল । আর আমাদের দেখা হয় না অনেকদিন ।
পিনাকির মুখে খবর পাই, সে বাড়িতে নানারকম এক্সপেরিমেন্টাল জিনিস রেঁধে খাওয়ায় । তার সাইক্লিক দাম্পত্য কলহের কাহিনী শুনি । বুঝতে পারি, নানা তত্ত্ব পড়া নভেল লেখা লোকের দাম্পত্য তো আর সাধারণ চারটে লোকের মতো হবে না । দাম্পত্য জিনিসটা এখন শুধুমাত্র সরকারি চাকরিতে বিপুল ঘুষ পাওয়া কিংবা কর্পোরেটে উন্নতি করা লোকেদের ক্ষেত্রেই সুখকর ।
কেন্দ্রীয় সরকার কেন যে একটা কঠিন নিয়ম আনছে না, কে জানে ! 'এক লাখের নীচের লোকেদের সংসার করার অধিকার কেড়ে নেওয়াই সুবিধেজনক...' আড্ডায় এসব বললে ওরা বেশ মজা পায় । যদিও সবাই জানে, সামাজিক নিয়মগুলো বড় নাছোড়বান্দা । একদম সোজা নয় । যে ব্যর্থ, কম রোজগেরে – তাকে বাতিল করে দেওয়া নয়। বরং প্রতিমুহূর্তে দগ্ধে মারা হয় । চোখের সামনে নানা উদাহরণ দেখিয়ে প্রতিদিন জীবন সম্বন্ধে একটু একটু করে বীতশ্রদ্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া ।
‘আমি সর্বোতভাবে বুঝতে পেরে গেছি – সংসার নামক প্রতিষ্ঠানটি জীবনের যাবতীয় সুখ ব্লটিং পেপার হয়ে শুষে নিচ্ছে’ । ব্লটিং পেপার কখনও না দেখলেও উপমাটা লাগাই নিয়মমাফিক । পিনাকি খানিকটা রেগে বলে, সে তোমার ম্যানেজেরিয়াল স্কিলের অভাব... নয়তো তুমি যা বলছ সেতো চরম নারীবিদ্বেষী কথা । জানি সে লিব্যারাল, তার ব্যাপার আলাদা । বাড়িতে বৃদ্ধ বাপমা, শ্বশুরবাড়িতেও তাই...চাকরির হ্যাপা তার ওপর বউবাচ্চার দায়দায়িত্ব নিয়ে লোকজন কী করে নেচে বেড়ায়, আমি সে কথা বুঝে উঠতে পারিনি । ব্যক্তিগত বলে যেখানে কিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। সেটাও কি পুরুষ মানুষের একটা আক্ষেপ নয় ? শুনে অনেকে বলে, কী একেবারে কেজিবির চর হে তুমি ! যেন ব্যক্তিগত ব্যাপারটা ওদের ইন্সটিটিউশানাল নিয়মে চলবে ।
আমি শেষপর্যন্ত বুঝে গেছি, প্রতিটি চরিত্রের জন্যে দুটো করে লোক দরকার । একজন কাজকর্মের শেষে পানশালায় বসে হৃদয় জোড়াবে, আরেকজন ঘরসংসার ও সামাজিক ব্যাপারে ব্যস্ত থাকবে । এই দু’জনের দেখা হয়ে গেলে কী হবে, কেউ বলতে পারে না । তখন হয়তো শুরু হবে নতুন কোনও কাহিনী ।
পিনাকি যেমন তার যাবতীয় চমকপ্রদ কথাবার্তা পজ করে ঢুকতে চলেছে জীবনের পরবর্তী দৃশ্যে - গার্হস্থ্য পর্যায়ে। ওর ব্যাচেলারস’ পার্টির পরে বন্দুক গলিতে আনাগোনার পাট চুকলো । শুনছি, এখানে সব ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি হবে ।
ব্যবস্থাটা বেশ অদ্ভুত ছিল – একতলায় দিশি, দোতলায় বিলিতি । আর তিনতলায় যা ইচ্ছে। বেয়ারাদের মুখে শুনেছি, মাঝরাতে একতলা থেকে মাতাল ভূত তিনতলায় উঠতে চায় । দোতলায় ততক্ষণে কারা সব মান্না দে’র গান ধরে । সেই প্রজন্মের শেষটা আমরা দেখেছিলাম । জীবনের প্রান্তে পৌঁছনো লোকেরা, যৌবনে শোনা গানগুলো বেসুরো গায় । গল্প বলে, কোথায় যেন নাচতে যেতো। এরা খানিকটা আয়নার মতো ছিল, যাদের কথা শুনে পিনাকি আমাদের ভবিষ্যৎ কল্পনা করতো এবং সেসব ভারি দুঃখিত মুখে বলতো ।
যদিও সেসব কথা পিনাকিকে এখন মনে করিয়ে লাভ নেই, তার চোখে মায়া অঞ্জন লেগে আছে – স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
ছোট গল্প - লোনাজলে হাবুডুবু || লেখক - রানা জামান || Written by Rana Zaman || Short story - Lonajole Habudubu
লোনাজলে হাবুডুবু
রানা জামান
ফিরে যাচ্ছে দুই ছেলে রবিউল আহমেদ ও সায়মন আহমেদ। সাথে বিদেশি স্ত্রী ও সন্তানগণ। নায়লা আহমেদ ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেন নি। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দুই ছেলের কেউ আসে নি জানাজায় অংশ নিতে। এক বছর পরে এসেছে বেড়ানোর মনোভাব নিয়ে বাবার কবর জিয়ারত করতে।
মা নায়লা আহমেদ ওদের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে বললেন, আহমেদ বাড়ি এখন আর কারো বাড়ি নেই। এই বাড়ি এখন জামশেদ বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রমে কোনো জোয়ান ছেলেমেয়ের স্থান হয় না! ওরা বৃদ্ধ হবার পর সন্তান কর্তৃক অবহেলিত হয়ে এখানে এলে আশ্রয় মিলতে পারে!
বিদেশি দুই স্ত্রী নায়লা আহমেদের কথা না বুঝে তাকিয়ে থাকলো নিজ নিজ স্বামীর দিকে; আর রবিউল আহমেদ ও সায়মন আহমেদ বিস্মিত হয়ে মার দিকে তাকিয়ে নিস্প্রাণ হাসার চেষ্টা করছে। দুই ছেলের দুই সন্তান মার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
রবিউল বললো, মা, তুমি ঠাট্টা করছো আমাদের সাথে।
নায়লা আহমেদ বেশ রুক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, তোদের সাথে কি আমার ঠাট্টার সম্পর্ক?
খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন ছুটে এসেছে জামশেদ বৃদ্ধাশ্রমের সামনে। এ বিষয়ে গ্রামের কেহই নায়লা আহমেদের সাথে কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না।
সায়মন আহমেদ এগিয়ে এসে বললো, তখন আমরা কাজ থাকায় আসতে পারি নি মা। আমাদের ক্ষমা করে দাও!
নায়লা আহমেদ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে বললেন, তোরা যেদিন তোদের বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েও আসতে অস্বীকার করলি, সেদিনই তোদেরকে আমি মনে মনে ত্যাজ্য করে দিয়েছি। আজ আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাজ্য করলাম। তোদের সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক রইলো না! তোরা যা!
রবিউল আহমেদ ও সায়মন আহমেদ ধীর পায়ে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে মাইক্রোবাসে উঠলো। মাইক্রোবাস চলে যেতে থাকলে নায়লা আহমেদ তাকিয়ে থাকলেন ওদিকে। ওঁর চোখের কোলে চলে এলে এক ফোঁটা অশ্রু।তিনি চলে গেলেন এক বছর আগের অতীতে-
তখন নায়লা আহমেদ স্বামী জামশেদ আহমেদ সহ বড় ছেলে রবিউল আহমেদের সাথে অস্ট্রেলিয়া ছিলেন। পুত্র ও অস্ট্রেলিয়ান পুত্রবধূ সারাদিন বাইরে থাকে চাকরির সুবাদে। বাসায় তিন বছরের ছেলে ডেভিড দাদির কাছে থাকে; অর্থাৎ নাতি লালন-পালনের দায়িত্ব দাদা-দাদির। কোনো কাজ নেই, কথা বলার কেউ নেই,সারাদিন বাসায় থেকে হাঁপিয়ে উঠতে থাকেন জামশেদ আহমেদ। এর উপর সারা বছর পরে থাকতে হয় শীতের কাপড়।
জামশদে আহমেদ ও নায়লা আহমেদ উভয়ই সরকারি চাকরি করতেন। ছয় মাসের ব্যবধানে দু’জনই সরকারি থেকে অবসরে আসেন। জামশেদ আহমেদ অতিরিক্ত সচিব এবং নায়লা আহমেদ অধ্যাপক পদে অবসরে যান। নায়লা আহমেদর ছেলেদের কাছে গিয়ে থাকার ইচ্ছা থাকলেও জামশেদ আহমেদের ছিলো না। স্ত্রীর পীড়াপিড়িতে যেতে বাধ্য হলেন অস্ট্রেলিয়া।
তিন মাস পেরোবার পরে একদিন জামশেদ আহমেদ স্ত্রীকে বললেন, আমি ক্রমেই হাঁপিয়ে উঠছি এখানে থেকে। দেশে ফিরে যেতে চাই।
নায়লা আহমেদ বিস্মিত হয়ে বললেন, কী বলছো তুমি! আমার ভালোই লাগছে। নাতির সাথে খেলা করে দিন চলে যাচ্ছে বেশ।
তাহলে তুমি থাকো। আমি চলে যাই।
তা কী করে হয়! তুমি চলে যেতে চাইলে আমাকেও যেতে হবে তোমার সাথে। বুড়ো বয়সে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না!
রবিউল আহমেদ বাবাকে মানাতে ব্যর্থ হয়ে কানাডাবাসী ছোটভাই সায়মন আহমেদকে জানালে সে ভিডিও কলে বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করে; ও বাবা ও মাকে অস্ট্রেলিয়া ভালো না লাগলে কানাডা চলে আসতে বলে। সেও ব্যর্থ হয়।
মাতৃভূমি টানতে থাকায় জামশেদ আহমেদ নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এক সপ্তাহ পরে চলে আসেন বাংলাদেশে।
খবরটা শুনে গ্রামের সবাই অবাক হলেও তৎক্ষণাৎ কেউ এলো না এবাড়িতে। কারঙ্কা গ্রামে এখন ওরকম চাকুরিজীবির সংখ্যা অনেক। আহমেদ বাড়ির সাথে পার্থক্য হলো: জামশেদ আহমেদের দুই ছেলে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় চাকরি করে ওখানকার সভ্যকে বিয়ে করেছে- ওরা ঐ দেশের নাগরিক হবার প্রচেষ্টায় আছে। পেয়ে যাবে অচিরেই। এই প্রবনতাই চলছে এখন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত পরিবারে। গ্রামের লোকজন যতদূর জানে: জামশেদ আহমেদ স্ত্রীসহ ঢাকার এপার্টমেন্টে থাকেন; মাঝে মাঝে ছেলেদের কাছে যান। এখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন; ক’দিন থেকে ফের চলে যাবেন ঢাকায়।
প্রায় কুড়ি বছর পরে নিজ গ্রামে এসেছেন জামশেদ আহমেদ। মা-বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন প্রতিবছর আসতেন মা-বাবার সাথে একটা ঈদ করতে। বাবা মারা যাবার পরে মা যতদিন বেঁচে ছিলেন এসেছেন। বাবা মারা যাবার পরে মা জামশেদ আহমেদের সাথেই থাকতেন; তবে একটা ঈদের উছিলায় স্বামীর কবর জিয়ারত করতে মা চলে আসতেন গ্রামের বাড়িতে। এক সময় মা ইন্তেকাল করলে জামশেদ আহমেদ গ্রামে আসা বন্ধ করে দিলেন।
ঢাকার জীবন আর অস্ট্রেলিয়ার জীবনের মাঝে পার্থক্য খোঁজে না পেয়ে বাকি জীবন গ্রামে থাকার প্রত্যাশা নিয়ে এবার গ্রামে চলে এসেছেন জামশেদ আহমেদ। কুড়ি বছরে গ্রামে অনেক পরিবর্তন হয়েছে- অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে অনেক; সব রাস্তা পাকা হয়ে গেছে এবং অধিকাংশ বাড়ি পাকা হয়েছে; ঘরে ঘরে বিদ্যুৎও চলে এসেছে, যদিও সন্ধ্যার পরে লোডশেডিং হয় প্রায় দিনই।
দু'দিন হলো জামশেদ আহমেদ এসেছেন গ্রামে। জমিজমা সব পত্তন দেয়া আছে; তাই চাষাবাদের চিন্তা আপাততঃ নেই। তিনি ভাবছেন আঙ্গিনায় শাকসব্জির আবাদ শুরু করবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ফতুয়া গায়ে চলে এলেন পুকুরঘাটে। পুকুরঘাটটা ওঁর অনেক প্রিয়। শানবাঁধানো ঘাট। উপরের পাকা বেঞ্চে বসলেন। মার্চ মাসেই বেশ গরম পড়তে শুরু করেছে। ঘামছেন জামশেদ আহমেদ। পুকুরঘাটে এসি থাকলে বেশ হতো! নিজের রসিকতায় মুচকি হাসলেন জামশেদ আহমেদ। গায়ের সুবাসে বুঝতে পারলেন নায়লা আসছেন। প্রথম জীবনের মতো রোমাঞ্চ না থাকলেও নির্ভরতা বেড়েছে অনেক।
নায়লা আহমেদ উল্টোদিকের বেঞ্চে মুখোমুখি বসে ওড়নায় মুখের ঘাম মুছে বললেন, এতো গরম! দুই দিনেই হাপিয়ে উঠেছি! এর চেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ভালো ছিলাম!
জামশেদ আহমেদ বললেন, কী যে বলো না! এরকম পরিবশে ওখানে আছে? এভাবে নিজের পুকুড়পাড়ে বসতে পারতে? ভাবছি আমি নিজ হাতে কিচেন গার্ডেন করবো। তাতে সময় কেটে যাবে বিন্দাস।
নায়লা আহমেদ বললেন, আমি কী করবো? কিভাবে আমার সময় কাটবে? ওখানে নাতিদের সাথে হৈচৈ করে দিন কেটে যেতো।
সত্যটা হলো নাতিদের গভর্নেসগিরি করে সময় কাটতো। ছেলে ছেলের-বৌ তোমার কাছে সন্তান রেখে নিশ্চিন্তে চাকরি করতে পারতো!
হয়তোবা প্রকারান্তরে তোমার কথাই সত্য। আমার খারাপ লাগতো না। সময় কেটে যেতো। এখানে কিভাবে সময় কাটবে আমার?
তুমি রান্না শুরু করে দাও। শখের রান্না। দৈনিক নতুন রেসিপি। দুই বুড়োবুড়ি খাবো কব্জি ডুবিয়ে।
ঐদিন রাত এগারোটায় বড় রবিউল আহমেদ ভিডিও কলে এলে কান্না গিলে নায়লা আহমেদ বললেন, গ্রামে এসে বেশ ভালো লাগছে। আমি ফের রান্না শুরু করবো।...
তখন জামশেদ আহমেদ বসা ছিলেন পাশেই। জামশেদ আহমেদ দুই ছেলেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন বেশ উচ্ছসিত কণ্ঠে।
গ্রামের ওঁর সমবয়সী গোলাম আলীকে ডেকে এনে নিজের পরিকল্পনার কথা আলোচনা করতে লাগলেন এবং পরামর্শও চাইলেন।
গোলাম আলী বললেন, গ্রামে এখন কৃষি শ্রমিকের সংকট চলছে। শ্রমিকদের প্রায় সবাই চলে গেছে ঢাকা। ঢাকায় গিয়ে পুরুষরা রিক্সা চালাচ্ছে বা অন্য কাজ করেছে; আর মহিলারা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে বা কারো বাসায় ঠিকা ঝি-এর কাজ করছে।
জামশেদ আহমেদ বিস্মিত হয়ে বললেন, তাহলে কৃষি কাজ চলছে কিভাবে?
চাষাবাদ মেকানাইজড হয়ে গেছে। পাওয়ার টিলারে চাষ হচ্ছে, হার্ভেস্টিং মেশিনে ধান কাটা ও মাড়াই হচ্ছে।
তাহলে আর সমস্যা কী! সবাই যেভাবে চাষাবাদ করছে আমিও সেভাবে করবো! আমি তো আর ধান আবাদ করতে যাচ্ছি না! শখের সব্জি আবাদ করবো।
দু'দিন পরে জামশেদ আহমেদ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন তখন মসজিদ থেকে মাইকে একটা ঘোষণা এলো। ঘোষণাটি এমন:
পুব পাড়ার মরহুম আব্দুল মতিনের জানানা মায়মুনা বেওয়া কিছুক্ষণ আগে ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। আজ বাদ মাগরেব ঈদগাহ মাঠে মাইয়াতের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।...
জামশেদ আহমেদ অস্ফুট স্বরে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন বলে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন মায়মুনা বেওয়া কে। আব্দুল মতিনের চেহারা ঝাপসা মনে করতে পারলেও মায়মুনা বেগমের চেহারা মনে করতে পারলেন না। তখন ফজরের আযান শুরু হলো।
নায়লা আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, কে মারা গেলো গো?
জামশেদ আহমেদ বললেন, পূর্ব পাড়ার আব্দুল মতিন ভাই-এর ওয়াইফ মায়মুনা বেগম। ফজরের নামাজ আদায় করে দেখতে যেতে হবে।
আমিও যাবো তোমার সাথে।
জামশেদ আহমেদ ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে যান না; বাড়িতেই স্ত্রীর সাথে নামাজ আদায় করেন। তিনি ইমামতি করেন। আজকেও একইভাবে ফজরের নামাজ আদায় করে দু’জন বের হলেন মরহুম আব্দুল মতিনের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
আব্দুল মতিনের বাড়ি লোকে লোকারণ্য। জামশেদ দম্পতিকে দেখে ভেতরে যাবার পথ করে দিলো উপস্থিত লোকজন। লোকদের জিজ্ঞেস করে মায়মুনা বেগম সম্পর্কে জামশেদ দম্পতি যা জানতে পারলেন তা এরকম:
মায়মুনা বেওয়া একাই থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। ছেলে দুটো বিয়ে করার পরে মা-বাবার ভরনপোষণ করতে পারে নি; গ্রামের কৃষিকাজে না পোষানোয় একসময় ওরা মা-বাবাকে গ্রামে রেখেই চলে গেলো ঢাকা। ছেলেরা ঢাকায় হকারি করে এবং ওদের স্ত্রীগণ পোশাক কারখানায় কাজ করে। মেয়ে দুটোর বিয়ের পরে স্বামীর অলক্ষ্যে বাবা-মাকে সাহায্যের চেষ্টা করতো। আব্দুল মতিন মারা যাবার পরে বৃদ্ধা মায়মুনা বেওয়ার শরীর সায় দিলে মাঝে মাঝে ভিক্ষায় বের হতেন। কিছুদিন যাবৎ মায়মুনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার দেখাতে না পারায় কেউ জানতে পারে নি কী অসুখ হয়েছিলো ওঁর। ছেলেরা কখনো মাকে দেখতে আসে নি, চিকিৎসা করা দূরের কথা!
হাঁ, মার মৃত্যু সংবাদ ওঁর সন্তানদের জানানো হয়েছে। সবাই আসছে। সেকারণে বাদ মাগরেব মাইয়াতের জানাজা রাখা হয়েছে।
দুপুরের পরে ছেলে দুটো এসে মায়ের মৃতদেহ রাখা খাটিয়া ধরে ডুকরে কাঁদতে থাকায় জামশেদ আহমেদের খুব রাগ হলো। নায়লা আহমেদ ওঁর হাত ধরে টেনে রাখায় ওদের কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে বললেন: এরকম কুলাঙ্গার পুত্র না থাকাই ভালো!
রাতে জামশেদ দম্পতির মাঝে এ নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো দ্বিমতের সৃষ্টি হয়নি।
নায়লা আহমেদ: এই শ্রেনীতে আজো ছেলেগুলো মা-বাবার মর্যাদা বুঝলো না! মা-বাবার ভরণপোষণ করে না। এ নিয়ে কাউন্সেলিং করা দরকার। তাতে হয়তোবা পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি হতো।
জামশেদ আহমেদ: এটার কারণ আর্থিক। কিন্তু অমানবিক না। দেখলে না মার লাশের উপর কিভাবে কাঁদলো ওরা।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে জামশেদ আহমেদ তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে না উঠায় নায়লা আহমেদ ভাবলেন জামশেদ আহমেদ সপ্তাহের একদিন তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন না; তবে ইশরাকের নামাজ আদায় করেন। হয়তোবা আজ সেই দিন। কিন্তু ফজরের নামাজ আদায়ে জামশেদ আহমেদ না উঠায় ভ্রু কুচকে নিজেই ওঁকে জাগানোর জন্য গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন।
আলো জ্বেলে ফুপিয়ে উঠলেন নায়লা আহমেদ। হঠাৎ এ কী হয়ে গেলো? তিনি শেষ ঘুমে থাকা স্বামীর গায়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত হাত বুলাতে থাকলেন। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরছে মৃত জামশেদ আহমেদের গায়ে। যেনো কিছুই হয়নি এমনভাবে স্বর সংযত করে আস্তে আস্তে মৃত জামশেদ আহমেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এভাবে হঠাৎ চলে গেলে কেনো? এখন আমি কী করবো? বড্ড স্বার্থপরের মতো কাজটা করলে তুমি জামশেদ!
প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ফোন করে বাবার মৃত্যু সংবাদ জানালেন নায়লা আহমেদ। রবিউল আহমেদের কথা শুনে বিস্মিত হবার সাথে সাথে সেদিনের ঘটনা মনে পড়লো ওঁর: মায়মুনা বেগমকে আর্থিক কারণে ভরণপোষণ করতে না পারলেও মার মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে গ্রামে এসে ছেলেগুলো মার শবের উপর আছড়ে পড়ে কী কান্নাটাই কাঁদলো। আর নিজের পেটকাটা ছেলেটা কী বললো এখন? সায়মন আহমেদকে ফোন করে একই রকম কথা শুনে আর বিস্মিত হলেন না নায়লা আহমেদ।
জামশেদ আহমেদের মৃত্যু সংবাদ শুনে সকালে গ্রামের লোকজন ছুটে এলো এই বাড়িতে। সমবেদনা প্রকাশের পরে ছেলেদের জন্য লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে চাইলে নায়লা আহমেদ আজই জানাজা শেষে জামশেদ আহমেদের মরদেহ কবরস্থ করার অনুরোধ জানালেন।
Sunday, November 27, 2022
ছোট গল্প - অভদ্র || লেখক - সান্ত্বনা ব্যানার্জী || Written by Sawntana Banerjee || Short story - Aovdro
ছোট গল্প - রিকভারি স্টেজ || লেখক - ডা: অরুণিমা দাস || Written by Arunima Das || Short story - Recovery stage
রিকভারি স্টেজ
ডা: অরুণিমা দাস
ডা: রায় নিজের চেম্বারে বসে পেশেন্ট প্রোফাইল গুলো চেক করছিলেন। পেশায় একজন বড়ো সাইকিয়াট্রিস্ট ডা: সুশান্ত রায়। রোগীদের মানসিক স্বাস্থের প্রতি খুবই যত্নবান তিনি।খুব মন দিয়েই ফাইল গুলো দেখছিলেন।
হঠাৎ দরজায় কেউ নক করলো,
মে আই কাম ইন ডক্টর।
ফাইল থেকে মুখ তুলে দেখলেন সিস্টার অহনা চেম্বারে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইছেন। একগাল হেসে ডা: রায় বললেন ইয়েস,প্লীজ কাম ইন অহনা।
অহনা এগিয়ে গিয়ে একটা ফাইল তুলে দেয় ডা: রায়ের হাতে, আর বলে স্যার এটা মোনালিসার ফাইল, ও এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ আছে। মেডিসিন গুলোও সময় মত খাওয়াচ্ছি। স্যার ওকে কবে নিয়ে যেতে পারবো বাড়ী, সময় এলেই নিয়ে যেতে পারবেন,বললেন ডা: রায়। বলেই চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ফাইলটাতে। হেসে বললেন অহনা ইট ওয়াস নট পসিবল উইদাউট ইউ। অহনা বলল স্যার আমি তো শুধু কেয়ার নিয়েছি ওর, আর আপনি তো ওকে অ্যাসাইলামে আনা থেকে শুরু করে প্রপার মেডিসিন আর রেগুলার কাউন্সেলিং করে রিকভারি স্টেজে নিয়ে এসেছেন। ডা: রায় হেসে বললেন এটাই তো আমার কাজ সিস্টার। আর এই কাজের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি খুঁজে পাই আমি। একগাল হেসে অহনা বলে জানিতো স্যার,আপনি রোগীদের কতো টা ভালোবাসেন। আপনি তাহলে ফাইলটা চেক করুন স্যার, আমি একটু পরে আসছি। মোনালিসার লাঞ্চের টাইম হয়ে গেছে, বললো অহনা।
ও শিওর, প্লীজ গো। অহনা বেরিয়ে গেলো।
মোনালিসার ফাইলটা দেখতে দেখতে ডা: রায় ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে লাগলেন অতীতের দিনে,মনে পড়ে গেলো বছর দুই আগেকার কথা। এক ঝড় বৃষ্টির দিন হসপিটাল থেকে রাউন্ড দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ গাড়ীর সামনে এসে পড়ে একটি মেয়ে। গাড়ির ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। অত রাতে কোনো উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন উনি। জ্ঞান ফিরলেও নিজের নাম বলতে পারেনি সেই মেয়েটি। কেমন একটা শূন্য দৃষ্টি আর এলোমেলো চুলে তাকিয়েছিল সে। সেই রাতে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি ডা: রায়। পরদিন সকালে অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় গিয়ে ডা: রায় কিছু লোকজনকে মেয়েটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন মেয়েটি মানসিক ভারাম্যহীন,নাম মোনালিসা,থাকে রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের এক ঝুপড়িতে। ওর বাড়ি কোথায় আর কেনোই বা ও এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকে এসব জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে ডা: রায় অনেক কিছু জানতে পারেন। একটি ছেলেকে ভালোবাসতো মোনালিসা, কিন্তু বাড়ির কেউ সেটা মেনে নেয়নি। পালাবার প্ল্যান করেছিল ছেলেটির সাথে। ধরা পড়ে যায় দাদার হাতে আর বেধড়ক মার খেয়ে ছেলেটির মৃত্যু হয় সেদিন। এই নৃশংস দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে মোনালিসা পাগলের মত হয়ে যায়, নিজের চুল ছিঁড়তে থাকে। দাদারা ওকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে আটকে রাখে। চেঁচামেচি করলেই জুটতো মারধর আর অকথ্য গালাগাল। খেতেও দিতো না ঠিক করে। একদিন দাদারাই বোনের পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসে। ওখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাবের ছেলেরা ওকে রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের কুঁড়েতে রেখে আসে। খাওয়াদাওয়া কিছু করেনা, সারাদিন রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। শুনতে শুনতে ডা: রায়ের মনটা ভার হয়ে ওঠে। উনি বলেন আজ থেকে ওর চিকিৎসার দায়িত্ত্ব আমার। ওকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে রাখবো,দেখি কতটা সুস্থ করে তুলতে পারি ওকে। সবাই বললো, চেষ্টা করে দেখুন স্যার। সেইদিন থেকে মোনালিসা কে সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লড়াই শুরু করেন ডা: রায়।
প্রথম প্রথম একটা ঘরে বেঁধে রাখা হতো মোনালিসা কে। ইলেকট্রিক শক থেরাপি থেকে শুরু করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি সব কিছু চলতো। আর সাথে অ্যান্টি সাইকিয়াট্রিক মেডিসিন এবং সিস্টার অহনার রুটিন কেয়ার। এই সব কিছুর সম্মিলিত প্রয়াসে আজ মোনালিসার হাত পায়ের বাঁধন খুলে গেছে, মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে সক্ষম। সময় ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। কঠিন বাস্তবের প্রেক্ষাপট তার মানসিক কাঠিন্য আরো সুদৃঢ় করে তুলেছে। আত্মনির্ভর হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় সে। আর যাইহোক,বাড়িতে কোনোভাবেই ফিরতে রাজি নয় মোনালিসা। বাড়ির লোকেদের নির্মম অত্যাচার কিছুতেই ভোলেনি সে। সিস্টার অহনা ঠিক করেছে মোনালিসা কে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে,অনাথ জীবনে বোনের অভাব দূর হবে। ডা: রায় ও পারমিশন দিয়েছেন। মোনালিসাও অহনাকে দিদির মতোই ভালোবাসে।
স্মৃতির পাতা থেকে চোখ তুলে মোনালিসার ফাইলে নতুন মেডিসিন গুলো লিখতে লাগলেন ডা: রায়। কল করে অহনাকে ডাকলেন তিনি। অহনা এলে বললেন জাস্ট দুটো মেডিসিন দেওয়া আছে, লো ডোজ, উদ্বেগ কমাবে আর মন শান্ত রাখবে। এগুলোই এখন থেকে খাবে মোনালিসা। আর ওষুধের থেকেও ওর দরকার এখন ভালোবাসা,সহমর্মিতা যেটা ওকে রিকভারি স্টেজ থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেবে। অহনা বলল আমি সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো স্যার। ডা: রায় বললেন আমি জানি আপনিই পারবেন একমাত্র,তাই আপনাকে পারমিশন দিয়েছি। ফর্মালিটি গুলো পূরণ করে আপনি আগামী সপ্তাহেই আপনার নতুন বোনকে নিজের বাড়ী নিয়ে যেতে পারবেন। অহনা ধন্যবাদ জানিয়ে একছুটে মোনালিসার কেবিনে গিয়ে বললো আমার সাথে যাবি তো নাকি। ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে মোনালিসা বললো হ্যা দিদি, তোমার আর ডা: রায়ের হাতেই আমার পুনর্জন্ম হয়েছে, নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছি আমি। তোমাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সাথেই থাকবো আমি। কোথাও যাবো না তোমায় ছেড়ে।কেবিনে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলেন না ডা: রায়। দিদি আর বোনের ভালোবাসার কথোপকথন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলেন ও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন এই বন্ধন যেনো অটুট থাকে চিরকাল আর মোনালিসার নতুন জীবন যেনো সবসময় খুশি আর আনন্দে ভরপুর থাকে। কোনো দুঃখ যেনো ওর মনকে ছুঁতে না পারে কোনোদিন। কেবিনের দরজা বন্ধ করে ডা: রায় হাঁটা দিলেন অন্য পেশেন্ট গুলো দেখবেন বলে। আরও কেউ হয়তো রিকভারি স্টেজ থেকে সুস্থ জীবনে পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষা করছে যে দুটোর মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন গড়ে দিতেই তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকেন।
Friday, November 25, 2022
উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -28
দেবীদাসের সাক্ষাৎ ডায়েরীতে ভদ্রলোকের নামতো নেই-ই, এই প্রথম দেখল ভদ্রলোককে। তবে কি তার বাবার সাথে পরিচয় আছে! হতে পারে, বাবার সাথে বহুজনের পরিচয় আছে যেহেতু তিনি একজন বিগ ইন্ডাষ্ট্রিয়ালিষ্ট।
Thursday, November 17, 2022
ছোট গল্প - বদ || লেখক - অলভ্য ঘোষ || Written by Alabhya Ghosh || Short story - Bod
বদ
অলভ্য ঘোষ
আমি তখন স্কুলে পড়ি একটি ছেলে বখে গিয়েছিল।লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি সিগারেট খেত কেবল না গঞ্জিকা সেবন ও করতো।আমাকে অনেকে বারণ করতো ও খারাপ ছেলে তুই ভালো ছেলে ওর সাথে মিশিস কেনো।খারাপ হয়ে যাবি।আমার ভালো ভালো ছেলে গুলোর চাইতে খারাপ ছেলেটাকেই বেশি ভালো মনে হতো।কারণ তার ভালো সাজার কোন দায় ছিলনা।কে তাকে খারাপ বলবে তাতে তার কিছুই যেত আসতো না।আর আতু আতু পাতু পাতু ভালো ছেলে গুলোর ছিল সর্বদা লোকের কাছে ভালো হবার চেষ্টা।গজ-দম্ভ মিনারে বাস!আমার মনে হত একটা খারাপ ছেলে যদি একটা ভালো ছেলেকে খারাপ করেদিতে পারে তবে একটা ভালো ছেলে একটা খারাপ ছেলেকে কেন ভালো করতে পারবে না।যদি সে সত্যিই ভালো হয়।যদি ভালো ছেলেটা খারাপ ছেলেটার ভালো না করতে পারে তবে ভালো ছেলেটার ভালো গুণে খামতি আছে।অমন ভালো হওয়ার চাইতে না হওয়া ভালো। আমি ছেলেটার সাথে স্কুলে যেতাম।ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী ,নেতাজি সুভাষ-চন্দ্র বসু,মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,মাতঙ্গিনী হাজরা, রবিনহুড প্রতিদিনই এক একটা গল্প শোনাতাম।
"উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে !"
ছেলেটা আমাকে একদিন একটা মাঠের মাঝে নিয়ে গিয়ে বলল;
-তুই তোর জ্ঞানের কথা রাখ।কত বড় হিম্মত আছে বিড়ি খেয়ে দেখা।
আমি বললাম;
- বিড়ি খেতে আবার হিম্মত লাগে নাকি।
ছেলেটা বলল;
-মুখে বললে হবে কেন খেয়ে দেখা।
ওর হাত থেকে একটা বিড়ি নিয়ে মুখে ধরলাম।দেশলাই কাঠি জ্বেলে ও আমার মুখাগ্নি করার সাথে সাথে ওর মুখটা যেন প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো আনন্দে। বিড়িটা ঠিকমতো জ্বলেনি তখনো ফিরিয়ে দিতেই সে ফুরফুর টান দিতে লাগলো আমার মুখের বিড়িটা আনন্দের চোটে।এ আনন্দ কিসের আনন্দ আমি আন্দাজ করেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তার প্রকাশও পেলাম।ছেলেটা জনে জনে স্কুলে সকলকে বলে বেড়াতে লাগলো আমাকে সে বিড়ি খাওয়াতে পেরেছে।কেউ কেউ বিশ্বাস করলো ছিঃ ছিঃ করে বলল আমি উচ্ছন্নে গেলাম।কেউ কেউ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না।আমার মত ভালো ছেলে তেমন কোন কাজ কখনোই করতে পারে না।বরং ছেলেটার ওপর তাদের বিশ্বাস ছিল না।
আমি ছেলেটার সাথে পরের দিনও প্রস্তুত হলাম স্কুলে আসতে নতুন একটা গল্প শোনাতে।ছেলেটা তখন আমায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে ভাবটা এমন তার আর আমার মধ্যে এখন কোন ফারাক নেই।তবে কেন বাপু জ্ঞানের কথা অতো।
আমার খুব হাসি পেয়েছিল।আমি বিড়িটা মুখে ধরেছিলাম কিন্তু ধোঁয়াটা কখনোই মুখের ভিতর টানিনি।ছেলেটাকে বলেছিলাম শোন কে আমাকে ভাল-বলবে তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি নিজের কাছে নিজে কতটা ভাল।আমার পথ যদি তোর পথের থেকে উৎকৃষ্ট হয় তোকে আমার পথে আসতেই হবে। তোর পথ যদি আমার পথের থেকে ভালো হয় আমি তোকে কথা-দিলাম নির্দ্বিধায় তোর পথে হাঁটব।
ছেলেটাকে আমি সেদিন বুদ্ধদেবের গল্প বলেছিলাম পথ হাঁটতে হাঁটতে।
সময় টা বর্ষাকাল জঙ্গলের মধ্যে সিক্ত বুদ্ধদেব তখন ধ্যানে মগ্ন থাকেন সারাদিন।কর্দমাক্ত পথে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয় না জঙ্গল সন্নিকট নগর থেকে ভিক্ষানুসন্ধানে বেড়য় শিষ্যগণ।কোনদিন ভিক্ষা জোটে কোনদিন ভিক্ষা জোটে না।যেদিন জোটে সেদিন আহার্য গ্রহণ করে।যেদিন জোটে না খেতে পায় না।খাদ্যের চেয়েও অন্তরায় প্রকৃতি বর্ষা মুখর দিনে জঙ্গলে থাকা দুরূহ।একটা ছাউনি খুব প্রয়োজন।
বুদ্ধ শিষ্যদের বলেন;
- যাও দেখো নগরে একটি ছাউনি মেলে নাকি।
কিন্তু নগরে কিছু লোক তাদের ভিক্ষা দিতে সম্মত হলেও ছাউনি দিতে কেউয়ই চায় না।অবশেষে এক পতিতা তাদের ভিক্ষা ও ছাউনি উভয় দিতে সম্মত হয়।
শিষ্যরা ফিরে এসে গুরুকে জানাল;
- ছাউনি পাওয়া গিয়েছে গুরুদেব। কিন্তু......
বুদ্ধ বলেন;
-কিন্তু কি?
শিষ্যরা সংশয়ের সাথে বলেন;
-কিন্তু গুরুদেব তা বেশ্যালয়।
বুদ্ধ বললেন;
-আমরা সন্ন্যাসী ভিক্ষুক।আমাদের কাছে বেশ্যালয় আর দেবালয়ের মধ্যে কোন ফারাক নেই।চলো সেই উত্তম স্থানে আমাকে নিয়ে চলো।
শিষ্যরা বুদ্ধকে সেই বেশ্যালয়ে আতিথেয়তার জন্য নিয়ে গেলত বটে কিন্তু মনের মধ্যে সংশয়ে দোদুল্যমান রইলো এই ভেবে যে তাদের সন্ন্যাস ব্রত থেকে স্খলন ঘটতে আর বেশি দেরি নেই।এদিকে বুদ্ধকে অতিথি হিসেবে পেয়ে লাস্যময়ী বারবনিতা টি কি করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না।কিভাবে কতটা সেবা করলে প্রভু পরিতৃপ্ত হবেন।বুদ্ধের সিক্ত বস্ত্রের বদলে তিনি তাকে রেশমের কোমল গরম কাপড় পরিধান করতে দিলেন।সুগন্ধি খাদ্য পানীয় আহার করতে দিলেন; এমনকি তার মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্যও পরিবেশন করতে লাগলেন।আর এই প্রতিটি পদক্ষেপে শিষ্যরা আঁতকে উঠতে লাগলেন তবেকি তাদের গুরুদেব বশীভূত হয়েছেন এই সামান্য কয়েক কড়ির বেশ্যার!
বুদ্ধ শিষ্যদের ডেকে বলেন;
-শোন বাইরের কোন কিছুতেই মানুষের স্খলন ঘটে না।মানুষের স্খলন ঘটে ভেতরের দ্বিচারিতায়!
আমি থেমে বলেছিলাম;
- তারপর কি হয়েছিল জানিস?
ছেলেটা বোকার মত বলেছিল;
-কি?
আমি বলে ছিলাম;
-বুদ্ধদেব যখন সেই বেশ্যাখানা ছেড়ে চলে গেলেন।সেই বেশ্যাও তার পিছু নেয় সন্ন্যাস গ্রহণ করে।
ছেলেটা তীব্র প্রতিবাদ করেছিল।
-এসব ঢপের গল্প।শোন নগরের পথে ওই ভিখারি আর খানকি টা যদি এক সাথে বেড়য় লোকে ভিখারি কে ছেড়ে খানকির পেছনে ছুটবে কারণ সে বেশি আকর্ষণীয়।
কয়েক দিনের মধ্যেই আমি স্কুলে পেট ধরে বাবাগো মাগো করে উঠলাম।সর্বাগ্রে যে এগিয়ে এল সে ওই বিড়ি খাওয়া ছেলে টা।ওই টিচার্স রুমে গিয়ে শিক্ষকদের খবর দিল কেবল নয়।রিকশা ডেকে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো।শিক্ষক মহাশয় রা জরুরি অবস্থার জন্য স্কুলে সংরক্ষিত সাধারণ পেট ব্যথার ট্যাবলেট দিয়ে ছেলেটাকে আমার বাড়িতে পাঠাল খবর দিতে।
মায়ের কাছে কোন কিছু লুকানোর সাধ্য আমার নেই।তড়িঘড়ি আমার মা খবর পেয়ে ছুটে গেল স্কুলে এবং আমাকে বাড়ি নিয়ে এসে প্রথম যে কথাটি বলেছিল সেটি হল;
- তোমার কিছুই হয় নি।
আমি মায়ের মুখের দিকে চেয়ে হেসেছিলাম।
মা কেবল বলেছিল;
- আর যেন এমন করোনা।
মা আমাকে জানতে চায়নি কেন আমি পেট ব্যাথার অভিনয় করেছিলাম।আমার স্কুল কখনো কামাই হতো না স্কুল থেকে পালিয়ে আসাত দূর।মা ভালকরেই জানতো এর পেছনে আমার কোন স্কুলের চাইতেও বড় কোন জীবন পাঠ লুকিয়ে রয়েছে।পাঠটি ছিল; আমি কি ঠিক না ভুল?Am I right or wrong?সমগ্র জীবনটা তো একটা পাঠশালা।
বহুদিন বাদে সেই ছেলেটি পথে আমায় ধরে বলল গল্প বলেবলে তুই আমার মাথাটা বিগরেদিলিরে।
আমি বললাম;
-যে মানুষ তার বদ বুদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারে সেই বুদ্ধ।আর যে মানুষ তার বদ বুদ্ধির নিচে চাপা পড়ে থাকে তারা বুদ্ধু।