Wednesday, November 30, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -29


 

নয়


 বিকেল বাড়ীর জানালার পাশে বসেছিল দেবীদাস। ছুটির দিন। মুকুলের সাথে সিনেমা যাবে। বাড়ী হতে ফোন করল মুকুলকে। সে সিনেমা যাবে না কারণ ওর মা অসুস্থ। তাহলে বিকেলটা কাটাবে কেমন করে চিন্তা করছিল। হঠাৎ রন্টু উপস্থিত হয়ে, দেবীকে বেরুতে বলল, দেবী রাজী।

 দুই বন্ধুতে ট্যাক্সির মধ্যে আলোচনা হলো তাদের গন্তব্য স্থান কোথায়। রন্টুর মনের অভিপ্রায় তার জানা ছিল না। তারা উপস্থিত হলো এক নিষিদ্ধ পল্লীতে, সেখানে দেহের কারবার নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা চলছে। দেবীদাসের জানায় বাইরে ছিল রন্টু এই নোংরা পরিবেশে এনে উপস্থিত করবে।

 দেবীদাস ভীষণ অপমান করল রন্টুকে। ঐ পল্লীতে কোন প্রকারে থাকতে মন চাইল না তার। সেই মাত্র ওখান হতে বেরুবার চেষ্টা করল, কোথা হতে এক ডানা কাটা পরী অর্থাৎ অপূর্ব সুন্দরী রমনী তার পথকে অবরোধ করে বলল, আমাদের কুঞ্জে যখন এসেছেন তখন ভেতরে প্রবেশ না করে চলে যাচ্ছেন কেন?

 মেয়েটির কোন কথা ভ্রূক্ষেপ না করে আগের মতো পা বাড়াতেই সে তার হাত দুটো ধরে ফেলল, এক কাপ কফি না খাইয়ে কোন মতেই যেতে দেবো না।

কোন প্রকারে সুন্দরীর কাছে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না দেবী। বুঝতেও পারলো নন্সা কোন যাদু মন্ত্রের ক্রিয়ায় ওর কাছে বন্দী হলো। তার সাথে বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করল। কি সুন্দরভাবে পরিপাটী করে সাজানো তার কুঞ্জখানি । মধ্যিখানে বেশ বড় সড় গ্যালিচা পাতা ও তার চারিপাশে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। সেতার, তানপুরা, এসরাজ, হারমোনিয়াম, বাওয়া ও তবলা ইত্যাদি।

মেয়েটি যে একজন গায়িকা এ দৃশ্য দেখার আগে পর্যন্ত তার জানা ছিল না। বাড়ীর মধ্যে একপাশে একটা তক্তাপোষের উপর বিছানো আরামদায়ক গদি ও দুটো বালিশ। সেই তক্তাপোষে বসার জন্য অনুরোধ করল। বসে পড়ল দেবী।

মেয়েটি কলিং বেল চাপ দিতেই মাঝারি বয়েসের এক মেয়ে উপস্থিত হতেই মেয়টি তাকে বলল কফি আনতে।

দেবীদাস কোনরূপ বাধা দিতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যে কফি এসে হাজির হলো। মেয়েটি তৎক্ষণাৎ তার অ্যাপায়ণের জন্য তার লোকদের নির্দেশ পাঠালো। ওর কার্যকলাপে কোনরূপ বাধা দিতে পারল না দেবী।

জানে না সে কি বশীকরণে বশীভূত হয়ে গেছে। কফির কাপে চুমু দিতেই লোকগুলো এসে হাজির হলো। সঙ্গীত চর্চার কাজে যথারীতি মনোনিবেশ করল। ওরা সকলে রেডি হয়ে মেয়েটিকে ইশারা করতেই গান শুরু হলো।

কি সুন্দর মেয়েটির কণ্ঠ, কি সুন্দর মায়া জড়ানো তার সুর, দেবীদাস ওর সুমিষ্ট কণ্ঠে অভিভূত হয়ে কতখানি যে মোহিত হয়েছিলেন তা বলতে পারব না। পরপর তিনখানি গান করলো মেয়েটি। গানকে ছোট হতেই ভালোবাসতো। তাই ভীষণ ভালো লাগলো তার।

গান চলাকালীন কত গ্লাস যে সরবৎ খেয়েছিল দেবী, তার হিসেব নেই। কিন্তু সরবতের মধ্যে যে দামী মদ ছিল তা জানতো না। গানের শেষে মেয়েটির প্রতি দেবীদাস গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিল। সেদিন ঐ মেয়েটির কাছে কতক্ষণ ছিল মনে নেই। মনে হয় রন্টুই তাকে বাড়ীতে পৌঁছে দিয়েছিল।

তবে ঐ পতিতালয়ে যাওয়ার কথা গোপন রাখতে পারেনি। অতি সহজেই মুকুলের কাছে ধরা পড়েছিল, বিশেষ করে ধরিয়ে দিয়েছিল - মুখে মদের গন্ধ ও লিপষ্টিকের দাগ। অবশ্য পরে জেনেছিল রন্টুই মুকুলকে বলেছিল গত রাত্রের কথা। তাই তাকে পরীক্ষা করার জন্য পরদিন সকালেই দেবীর বিছানার পাশে এসে হাজির হয়েছিল।

ঘুম হতে ঠিক সময়ে উঠতে পারল না দেবী। গত রাত্রের আমেজ বা কিসের নেশার ঘোরে বিছানা হতে অবসাদ ক্লান্তিতে বিছানা ত্যাগ করতে ইচ্ছে করছিল না। তার। মুকুল তাকে ঘুম হতে তুলতেই দেবীর মুখে মদের গন্ধ পেয়ে সে আকাশ থেকে পড়লো। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, তুমি মদ খেয়েছ?

বিষ্ময়াপন্ন হয়ে বলল, কি বলছো মুকুল? তুমি পাগল হলে না কি? মুকুল তখন গম্ভীর। হ্যাঁ আমি পাগল হয়েছি।

 ঠিক বুঝতে পারছি না।

 সব পারবে। জামায় কিসের দাগ?

 জামায় দাগ? কিসের? জামার দিকে তাকিয়ে দেখল, সে মিথ্যা বলেনি। কাল রাত্রে কোথায় ছিলে?

 বাড়ীতে ছিলাম।

 মিথ্যে কথা। কাল তুমি কোথায় গিয়েছিলে তার প্রমাণ তোমার ঐ মুখের গন্ধ? জামায় লিপস্টিকের দাগ। দেবীদাস তুমি এতো নীচে নেবে যাবে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি উপরে মানুষের মুখোশ পরে আছো, তোমার অন্তর পাশব প্রবৃত্তিতে ভরা।

 মুকুল কথা শোন, আমি কোন অন্যায় করেছি বলে মনে হয় না। বিশ্বাস করো। আমি বুঝতে পারিনি গত রাত্রে কোন অন্যায় করেছি কি না। তুমি আমার ভালবাসার পাত্রী কোন দিন মিথ্যা বলিনি তোমায়, গত রাত্রে বন্ধুর কুপরামর্শে আমি পতিতলালয়ে গিয়ে ছিলাম। তা এখন অকপটে স্বীকার করছি। কিন্তু কোন অন্যায় -

 চুপ করো? দেবীদাস বড় ভুল করেছি একজন বিখ্যাত শিল্পপতির ছেলেকে ভালোবেসে। কারণ তোমাদের মতো সৎ আভিজাত্যে পূর্ণ ব্যক্তিদের চরিত্রের অন্তরালে যে নোংরা, আবর্জনায় পরিপূর্ণ থাকে তা তোমাকে দেখেই বুঝতে পারলাম। কি প্রয়োজন ছিলো আমার প্রতি ভালোবাসার ছলনা করে নিত্য নতুন সহচরী করতে? ছিঃ ছিঃ দেবীদাস তুমি এইভাবে ভদ্র সন্তানের পরিচয় দেবে?

 মুকুল, এতোখানি হীন মনোবৃত্তি নিয়ে আমার চরিত্রের বিচার করো না। হয়তো কোন কারণবশতঃ পদঙ্খলন হয়েছে। নিজের নীতিবোধে মানবতাকে অবমূল্যায়ণ করেছি। কিন্তু তুমি আমার অপমান করো না, ভগবানকে ভুল বুঝ না ।

 ভুল, অপমান? দেবীদাস, তোমাকে অপমান করার যোগ্যতা অর্জন করিনি। তবে আগে হতে সতর্ক হলাম একজন ঠক্, প্রতারক এবং চরিত্রহীনের সঙ্গে চিরদিনের সম্পর্ক পাতাবার আগে ঈশ্বর যে সতর্কের ইঙ্গিত দিলেন, এজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। আমি চললাম, আশা করি কোন দিন আর দেখা করার চেষ্টা করবে না।

Tuesday, November 29, 2022

ছোট গল্প - ভুতুড়ে ট্যাভার্ন || লেখক - বৈদূর্য্য সরকার || Written by Boidurjya Sarkar || Short story - Vuture tavarn


 


ভুতুড়ে ট্যাভার্ন

বৈদূর্য্য সরকার




'ঋতুপর্নের ফিল্মের ইন্টিরিয়ার কৈশোরে কল্পনা করে , মধ্যতিরিশে যাদের ঘরদোর জীবন হয়ে যায় স্বপন সাহা মার্কা... তারা সব এসে জোটে বন্দুক গলিতে ।'

শুনে রে রে করে ওঠে পিনাকি । সে এখনও বুঝতে চায় না, আমাদের মতো এখানকার সবার জীবনের চিত্রনাট্য লেখা শেষ হয়ে গেছে এবং তা চূড়ান্ত ফ্লপ । আমি হেসে বলি, আর তো ক’টা দিন... তারপর তাড়াতাড়ি বুঝে যাবি নিয়তির মানে কী ! আজ পিনাকির জন্মদিন । সব বড় বড় লোকের মতো সে গ্রীষ্মের জাতক । এক আধুনিক জ্যোতিষের কাছে শুনেছি, গরমকালে জন্মানো লোকেদের তাকদ অন্যদের থেকে বেশি হয় । সূর্যের তাপ ওরা ধারণ করতে পারে । সত্যি মিথ্যে জানি না, তবে এটা ঠিক পিনাকির উত্তাপ উদ্দীপনা খানিক বেশি । বড় একটা আলসেমি তাকে মানায় না, বিস্তর দৌড়ঝাঁপের কাজ । সেজন্যে দরকার যথেষ্ট ফুয়েল ফর ইন্টারন্যাল সিস্টেম। আমি অবশ্য ইদানিং ওর সাথে পাল্লা দেওয়ার অবস্থায় থাকি না মধ্যতিরিশে এসে। তাছাড়া বসারও সুযোগ হয় না বিশেষ ।

দু'বছর অবশ্য লকডাউন আর করোনাতেই কেটে যাচ্ছে । নয়তো ট্যাভার্ণে দু’পাত্তরের ব্যবস্থা হতো ।

এখন সবার অবস্থা হয়েছে আত্মহত্যাপ্রবন । আগে এ কথা পদ্যেই ব্যবহার করেছি, এখন জীবনে উঠে এসেছে । মাসের পর মাস কাজ নেই, মাইনে অনিয়মিত । তার মধ্যে নানারকম রোগ ব্যাধি আর মিডিয়ার ভীতিসঞ্চার করা খবর । রোজই নতুন নতুন তরিকায় সেই এক ভয়ের খবর তুলে ধরা । এই করেই যে কত কোটি লোকের কাজ গেছে, আরও কত যাবে... তার ঠিক নেই ।

ভোম্বলদা আড্ডায় এসে মিডিয়ার লোকেদের একহাত নেয় । তার ট্যুরিজিমের অবস্থা সঙ্কটজনক, আর প্রাইভেট টিউশান তো উঠে যাওয়ার পরিস্থিতি । পরীক্ষার ঠিক নেই যেখানে, কে পয়সা দিয়ে পড়তে আসবে । শুনলাম, ছাত্রদের বাঁশ দেওয়ার ভরপুর ঐতিহ্য ভুলে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বাড়িতে বই দেখে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে ।    

এই দু'টো বছর যা চলছে মাথাখারাপ অবস্থা হয়েছে সবারই । তবে ভোম্বলদার একটা ব্যাপারে জ্ঞান বেশ টনটনে, ঘরে আসর বসানোর ব্যাপারে। বাইরে গিয়ে খরচ করা পোষায় না তার । জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি টানাটানির এই গল্প বাপমায়ের মুখে শুনতে শুনতে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আজকাল আর আলাদা করে বিশেষ দুঃখবোধ হয় না । বাপমা তাদের পঞ্চাশ বছরের পুরনো ভ্যালুজ আর সর্বদা এই টানাটানির কীর্তন শুনিয়ে জীবনের প্রথম তিরিশ বছরের দফারফা করে ছেড়েছে । পরের তিরিশ বছরের দায়িত্ব নিয়েছে বৌ । সেই প্রাচীন কাহিনী আর সেসবের বাইরে না যাওয়া মন । দোষ দিয়েই বা কী লাভ ! অধিকাংশ মেয়েকেই দেখি – ডিজিট্যাল গ্যাজেটে অভ্যস্ত, ইউটিউব দেখে রান্না থেকে চুল বাঁধা শিখে ফেসবুক লাইভ, ফেমিনিজম চটকে তামাম ছেলেপুলের মাথা খারাপ করে... অথচ মনের মধ্যে দু’শো বছরের অন্ধকার । যদিও সেসব সরাসরি বলার উপায় নেই । বাপের পয়সায় ফুটানি করে সব হয়েছে বিপ্লবী । আর পরবর্তী জীবনে বর নামক একটি দুর্লভ গর্দভ তৈরি আছে যাবতীয় জিনিসের বোঝা বওয়ার জন্যে ।

এক সহকর্মী বলে- দ্যাখো ভাই, এসব বলে তো লাভ নেই... আমাদের কামের তাড়নাও তো আছে । মানি, তা অন্যান্য প্রবৃত্তিগুলোর থেকে অবশ্যই গুরুতর হয়ে ওঠে একটা বয়সের পর । এর টানেই জীবনের যাবতীয় আহ্লাদ আকাঙ্ক্ষা আশাকে জলাঞ্জলি দিতে হয় । ঢুকতে হয় দাম্পত্য নামক এমন একটা ব্যাপারে – যেটা দুনিয়ার কেউ খুব ভাল না বুঝলেও সবাইকেই পালন করে যেতে হয় নিয়মমাফিক ।  তাই পিনাকির যাবতীয় আত্মবিশ্বাসী কথার  একটাই উত্তর দিই , বিয়ে থা হোক... তারপর দেখবো ।  তাতে পিনাকির মতো তর্করত্ন পর্যন্ত ব্যাকফুটে গিয়ে বলে, হ্যাঁ... তখন পরিস্থিতির বিচারে কথা তো বদলে যেতেও পারে ।

আমরা লক্ষ্য করছিলাম, চারদিক কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আসছে । আশপাশের সব জায়গায় খাঁখাঁ শূন্যতা । থেকে গেছে আমাদের মতো কিছু ব্যর্থ লোকজন । সব বাড়িতেই সিনিয়ার লেভেলে মৃত্যুমিছিল । থাকার মধ্যে অশক্ত বৃদ্ধা আর আমরা । যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের বউ । তবে এটা বোঝা যাচ্ছিল, বাড়িতে ছেলেবেলায় দেখা স্থানাভাব ব্যাপারটার উল্টোদিকটাও খুব একটা স্বস্তির নয় ।

বন্দুক গলিতে যাওয়া আমাদের সাবেক দলেও ভাঁটার টান । একসময় ছ’আটজন মিলে যাওয়া হয়েছে । এপাড়া সেপাড়া, কাবাব পরোটা, খালাসিটোলা অশোকা সব ফুরিয়ে শেষে এই বন্দুক গলি । নাম বাহারি হলেও ক্রমশ ম্রিয়মাণ এসব অঞ্চল । সব বুড়োঝুরো লোকেরা আসে। যারা খুঁজেপেতে এখানে আসে, একটাই কারণ – শহরে সবথেকে সস্তা । একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম – আমাদের যতো বয়স বাড়ছে, কথাবার্তাও যেন ফুরিয়ে আসছে । ‘যা হওয়ার তাই হবে’, এর’ম একটা ভাব দিনকে দিন বাসা বাঁধছে ।

বন্ধু তার বন্ধু আবার তার বন্ধু... এভাবে জড়ো হতো লোক । যেমন আমাদের পাড়ার বন্ধু পটলা, তার সংগঠনের বন্ধু  বোধি, তার ইউনিভার্সিটির বন্ধু ইসমাইল । পটলা ও বোধি আবার থার্ড স্ট্রিম পলিটিক্সে ভিড়েছিল । এখন অবশ্য সেসব ফরসা। পিনাকি আবার এখনকার শাসকের এককাট্টা সমর্থক, আমি বিরোধি । মুছে  যাওয়া আগের শাসক দলের নেতার দৌহিত্র ইসমাইল । সে আবার ইংরিজিতে নভেল লেখে । শুনলে কেমন আশ্চর্য লাগে । তবে ছেলেটা একেবারে মাটির মানুষ । তবে ওইটাই যা বেশি শক্ত । সে শিলঙের স্কুলে পড়ত, সেখানে শ’খানেক অ্যাফেয়ার । এখানেও কয়েকটা কেঁচেগণ্ডূষ সম্পর্ক । সেসব নিয়ে আমাদের কারোর মাথাব্যাথা নেই অবশ্য । বরং তার পড়াশোনার রেঞ্জ দেখে হীনমন্যতায় ভুগতে হয় । তবে পানশালায় কোনও কথাই দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না ।

‘সমবেত হাসিঠাট্টায় দিন কাটে’ – এমনটা বলতে পারলে ভাল হতো । ইদানিং পিনাকির সাথে পটলা বা ইসমাইল ছাড়া বড় একটা কেউ আসে না । ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই ।  ব্যস্ততার ভাণ করতে হয় ।

পিনাকি রোজগার যাই করুক  না কেন, পানশালায় সে কার্পণ্য করে না। তার চোখেমুখে তখন যাবতীয় দৈন্যকে কিনে নেওয়ার স্পর্ধা ফুটে ওঠে । খানিকটা অকাতরেই টাকাপয়সা ছড়ায় বেয়ারা দারোয়ানদের মধ্যে । ফলে খাতির পায় নিঃসন্দেহে । কিছু বলতে গেলে বলে, এতে তার মেজাজ শরিফ থাকে ।

মেজাজ নিয়েই তো হয়েছে ঝামেলা । বাল্যে সেসব নিয়ে বোধ থাকে না । কৈশোর থেকে আমরা বোধহয় নানারকমে হেজে গেছিলাম । বেশ মনে পড়ে, একটা সময় পর্যন্ত মুখে একটা অমলিন হাসি লেগে থাকতো - যা অকাতরে দেওয়া যায় । কিন্তু আজকাল খেয়াল করে দেখেছি, রেজাল্ট চাকরি মাইনে সংসার সব মিলিয়ে কপালে একটা স্থায়ী ভুরু কোঁচকানো ভাব চলে এসেছে । পিনাকির ক্ষেত্রে দেখেছি, অদ্ভুত একটা আক্রোশ জন্মেছে জগৎ সংসারের প্রতি। সেটা অবশ্য অকারণে নয়, যে কিশোরীকে সে টিনএজ থেকে স্বপ্নে দেখেছে... সেই মেয়েটি এখন জননী হলেও যোগাযোগ করে মাঝেমাঝে । তাতেই বাবুর ঘুম উড়ে যায় ।


আমাদের কৈশোরে ক্রিকেটে বেটিং জিনিসটা নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়েছিল । তারপর নানা কাণ্ডকারখানার পর এখন দেখি বেটিং সাইট খেলার উদ্যোক্তা হয়ে বসেছে । আমরাও ড্রিম ইলেভেন খেলি পাঁচ দশ টাকার । খেলা দেখলে মনে হয় – সব স্ক্রিপ্টেড । তবু দেখি, সন্ধেবেলায় বিনোদন তো বটে । শিল্প সাহিত্য খেলাধুলা সবই আসলে বিনোদন, অন্তত তাই ভাবলেই সুবিধা । অনেক লোকে হাহুতাশ করে – বই না পড়ে ঘরের বউরা মেগাসিরিয়াল বা চ্যাট করে কেন ! মনে হয়, তার আগে গৃহকর্মের ভেতরে বিনোদন ঢোকানো ছিল । কিন্তু বিনোদনের নিয়মে যেটা কম পরিশ্রমে বেশি মজা দেয়, সেটাতেই তো মানুষ মজবে ।

‘সব জায়গাতেই অপ্রাপ্তি থেকেই আমাদের যাবতীয় পণ্ডশ্রম’... বোঝার বয়স হয়ে গেলেও আমরা বন্দুক গলিতে এসে সে কথা ভুলে যাই । সেই থেকে যাবতীয় তর্কাতর্কি রাগ মনখারাপ । ফেরার পথে আগে সামনের একটা দোকানে বিফ কাবাব খাওয়ার অভ্যেস ছিল । এখন সবাই অম্বলজনিত কারণেই হয়তো খালি পেটেই থাকতে পছন্দ করে । তাতে খরচ কমল আবার বাড়ি ফিরে কুমড়োর ঘ্যাঁট সাগ্রহে খাওয়ার মতো একটা পরিস্থিতিও তৈরি হল । মনে হয়, আমাদের আগের প্রজন্মের বাইরে খাওয়া বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেস ছিল না বলে টাকাপয়সা খানিকটা জমেছিল। সুবিধে ছিল, তাদের নাকের ডগায় এর’ম বিপুল বিজ্ঞাপন ও ইএমআইয়ের সুবিধের কথা ঝোলানো থাকতো না।

একদিন যেমন ইসমাইল বলল, ওর একটা এক লাখের চাকরি চাই । জানি, এসব কথা দু’পাত্তরের পরেই চলে । সেজন্যে পিনাকি বলে উঠল, ওর দরকার দু’লাখ । একলাখ তো ওড়াতেই চলে যাবে । মোদ্দা কথা হল, এর’ম অনেককিছুই আমরা প্রত্যেকে চাই । কেউ কেউ পায়, বাকিদের মার্কেটের নিয়মে স্বাভাবিকভাবে হয় না । কিন্তু যখন দেখা যায়, বিরাট চাকরি করা লোকেরা এমন কিছু নিউটন আইনস্টাইন নয়... সেখান থেকেই শুরু হয় যাবতীয় অশান্তি ।

বাল্যের রেডিওতে ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’ শুনে আমি দিব্যি কাঁদতাম । স্পষ্ট মনে আছে । পরে ভেবে দেখেছি, স্মৃতি জিনিসটা বড় বেআক্কেলে । আর আমি যে যুগের লোকে যেখানে এই গানের পৌঁছনোর কথা নয় । তবু মিস্তিরিদের নিত্য ঠোকাঠুকির ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি কিংবা মহালয়ায় জেগে ওঠা রেডিও তখনও আমাদের অবলম্বন । সেই থেকে মনের মধ্যে একটা বদ্ধমূল হীনমন্যতা চেপে বসে আছে । মনে হয়, অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা তখন বড় হয়েছি । এর থেকে ভাল অবস্থায় অনেকে ছিল নিশ্চিত, কম্পিউটার না হলেও ছোটবড় নানারকমের ভিডিও গেম অনেকের হাতে । এয়ারগান নামের অতি উত্তেজক জিনিস দেখে থাকলেও কেনা যায় বলে জানতাম না । দৌড় ছিল চার’ছ টাকার ক্যাপ বন্দুক ।

পরে ভেবে দেখেছি, চারপাশের লোকজনের উপহার দেওয়ার প্রবণতা বড় একটা ছিল না । অন্তত আমার ক্ষেত্রে । আসলে এদিক থেকে যের’ম, উল্টোদিক থেকেও একই রিঅ্যাকশান । পুরোটাই একটা সিস্টেম । পুজোয় সংখ্যায় বেশ কিছু জামাকাপড় হলেও অধিকাংশ এলেবেলে ধরণের । ফলে কলেজে ভর্তির পর টিউশানি ইত্যাদি করে পুজোর খরচ তোলাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল । বাড়ির লোকের ধারণা ছিল, পুজোর দিনে ঘরে বসে থাকলে ছেলের মন খারাপ । তাকে সেজন্যে বাইরে যেতে উৎসাহিত করো । কিন্তু বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে যে টাকাপয়সা লাগে এবং সবার অবস্থা একরকম হয় না...। সেটা বাড়ির গোদাগুলোর না বোঝার মতো কি ছিল, কে জানে ! 

এখন ভোম্বলদাকে দেখে মনে হয়, সবার আজকাল গরীব থেকে হঠাৎ বেমক্কা বড়লোক হওয়ার নেশা । তখন তার উল্টো মতটা চালু ছিল । যদিও জীবন সংগ্রামের নানা গালভরা নাম শুনে আজকাল সেগুলোকে প্রলাপ বলেই মনে হয় । ভোম্বলদা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন করে কিছু লোক জোগাড় করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে । মন্দ হয় না, নিজের ঘোরাটা উপরি । এমনিতে একা মানুষ, সময় কাটাতে কিছু একটা করতে হবে তো !

ভোম্বলদা আগের বামপন্থী সরকারের ছাত্র শাখার জেলাস্তর পর্যন্ত উঠেছিল । দু’চারটে বইপত্র পড়ে স্টিরিওটাইপ বিপ্লবী বক্তৃতা করতেও শিখেছিল । যদিও ক্যাবলা বলে তেমন কিছু বাগাতে পারেনি । ইসমাইলকে দেখার পর বুঝেছি, এই না বাগাতে পাড়া লোক দলটার সব স্তরেই ছিল । সেজন্যে তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে । এখনকার সরকার এক অর্থে বেশ এফিসিয়েন্ট – ফেলো কড়ি মাখো তেল ।

আমার অবশ্য কোনও কিছুতেই আজকাল তেমন ইন্টারেস্ট নেই । দুর্গাপুজো থেকে ভোট... সব ইভেন্ট তুলে দিলেই বা ক্ষতি কী – এর’ম একটা ভাব। পিনাকি বলে, তুমি কি নিহিলিস্ট হয়ে গেলে নাকি ! আমি উত্তরে বলি, আমার আর কিছুই হওয়ার নেই । সব চুকেবুকে গেছে ।

এখন সব কিছুকেই মনে হয় – নিয়তি নির্দিষ্ট । কোথাও আলাদা কিছু হওয়ার জো নেই । বললে, অনেকেই রেগে ওঠে । তাহলে পক্ষে ভোট দিলেও যা বিপক্ষেও তাই ! আমার মনে হয়, একজনের সামান্য ভোটে কি সত্যিই কিছু বদলায় ? পিনাকি যুক্তি দেয়, তোমার মতো ভাবলে কোনও দেশে কোনও কালে কোনও পরিবর্তন আসতো না । ভাবি, সেও ঠিক । বন্দুক গলিতে এসব আলোচনা করে বাড়ি ফেরার পথে বিশেষ কিছু মনে থাকে না । ইসমাইল কীসব কঠিন থিয়োরি আলোচনা করে, নানারকম বইয়ের রেফারেন্স দেয়... ভাল বুঝতে পারি না । তার দল এই দশ পনেরো বছরে একেবারে এভারেস্টের চূড়া থেকে পাতালের গভীরে গিয়ে হারিয়ে গেছে, মনে থাকে না বোধহয় নেশার ঝোঁকে। 

একদিন সে বলল, গ্রাফিক নভেল লিখবে তার জন্যে ছবি আঁকার লোকের ব্যাপারে নানা সমস্যা । তার সাথে বলল, কোন একটা বইয়ে কী পড়েছে যা পড়ার পর আর বিয়ে করা যায় না । দু’টো মিলেমিশে আমার মনে রয়ে গেল – বিয়ের কার্টুন আঁকার জন্যে লোক দরকার । মনেই শুধু থাকলো না, ফেসবুকে আপডেট দিয়ে ইসমাইলকে ট্যাগ করে টাকাপয়সার সুবন্দোবস্ত আছে... সেটা জানাতেও ভুললাম না । তারপর জানি না কী ঘটেছিল । আর আমাদের দেখা হয় না অনেকদিন ।

পিনাকির মুখে খবর পাই, সে বাড়িতে নানারকম এক্সপেরিমেন্টাল জিনিস রেঁধে খাওয়ায় । তার সাইক্লিক দাম্পত্য কলহের কাহিনী শুনি । বুঝতে পারি, নানা তত্ত্ব পড়া নভেল লেখা লোকের দাম্পত্য তো আর সাধারণ চারটে লোকের মতো হবে না । দাম্পত্য জিনিসটা এখন শুধুমাত্র সরকারি চাকরিতে বিপুল ঘুষ পাওয়া কিংবা কর্পোরেটে উন্নতি করা লোকেদের ক্ষেত্রেই সুখকর ।

কেন্দ্রীয় সরকার কেন যে একটা কঠিন নিয়ম আনছে না, কে জানে ! 'এক লাখের নীচের লোকেদের সংসার করার অধিকার কেড়ে নেওয়াই সুবিধেজনক...' আড্ডায় এসব বললে ওরা বেশ মজা পায় । যদিও সবাই জানে, সামাজিক নিয়মগুলো বড় নাছোড়বান্দা । একদম সোজা নয় । যে ব্যর্থ, কম রোজগেরে – তাকে বাতিল করে দেওয়া নয়। বরং প্রতিমুহূর্তে দগ্ধে মারা হয় । চোখের সামনে নানা উদাহরণ দেখিয়ে প্রতিদিন জীবন সম্বন্ধে একটু একটু করে বীতশ্রদ্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া ।

‘আমি সর্বোতভাবে বুঝতে পেরে গেছি – সংসার নামক প্রতিষ্ঠানটি জীবনের যাবতীয় সুখ ব্লটিং পেপার হয়ে শুষে নিচ্ছে’ । ব্লটিং পেপার কখনও না দেখলেও উপমাটা লাগাই নিয়মমাফিক । পিনাকি খানিকটা রেগে বলে, সে তোমার ম্যানেজেরিয়াল স্কিলের অভাব... নয়তো তুমি যা বলছ সেতো চরম নারীবিদ্বেষী কথা । জানি সে  লিব্যারাল, তার ব্যাপার আলাদা । বাড়িতে বৃদ্ধ বাপমা, শ্বশুরবাড়িতেও তাই...চাকরির হ্যাপা তার ওপর বউবাচ্চার দায়দায়িত্ব নিয়ে লোকজন কী করে নেচে বেড়ায়, আমি সে কথা বুঝে উঠতে পারিনি । ব্যক্তিগত বলে যেখানে কিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। সেটাও কি পুরুষ মানুষের একটা আক্ষেপ নয় ? শুনে অনেকে বলে, কী একেবারে কেজিবির চর হে তুমি ! যেন ব্যক্তিগত ব্যাপারটা ওদের ইন্সটিটিউশানাল নিয়মে চলবে ।

আমি শেষপর্যন্ত বুঝে গেছি, প্রতিটি চরিত্রের জন্যে দুটো করে লোক দরকার । একজন কাজকর্মের শেষে পানশালায় বসে হৃদয় জোড়াবে, আরেকজন ঘরসংসার ও সামাজিক ব্যাপারে ব্যস্ত থাকবে । এই দু’জনের দেখা হয়ে গেলে কী হবে, কেউ বলতে পারে না । তখন হয়তো শুরু হবে নতুন কোনও কাহিনী ।

পিনাকি যেমন তার যাবতীয় চমকপ্রদ কথাবার্তা পজ করে ঢুকতে চলেছে জীবনের পরবর্তী দৃশ্যে - গার্হস্থ্য পর্যায়ে। ওর ব্যাচেলারস’ পার্টির পরে বন্দুক গলিতে আনাগোনার পাট চুকলো । শুনছি, এখানে সব ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি হবে ।

ব্যবস্থাটা বেশ অদ্ভুত ছিল – একতলায় দিশি, দোতলায় বিলিতি । আর তিনতলায় যা ইচ্ছে। বেয়ারাদের মুখে শুনেছি, মাঝরাতে একতলা থেকে মাতাল ভূত তিনতলায় উঠতে চায় । দোতলায় ততক্ষণে কারা সব মান্না দে’র গান ধরে । সেই প্রজন্মের শেষটা আমরা দেখেছিলাম । জীবনের প্রান্তে পৌঁছনো লোকেরা, যৌবনে শোনা গানগুলো বেসুরো গায় । গল্প বলে, কোথায় যেন নাচতে যেতো। এরা খানিকটা আয়নার মতো ছিল, যাদের কথা শুনে পিনাকি আমাদের ভবিষ্যৎ কল্পনা করতো এবং সেসব ভারি দুঃখিত মুখে বলতো ।

যদিও সেসব কথা পিনাকিকে এখন মনে করিয়ে লাভ নেই, তার চোখে মায়া অঞ্জন লেগে আছে – স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

ছোট গল্প - লোনাজলে হাবুডুবু || লেখক - রানা জামান || Written by Rana Zaman || Short story - Lonajole Habudubu


 


লোনাজলে হাবুডুবু 

রানা জামান




ফিরে যাচ্ছে দুই ছেলে রবিউল আহমেদ ও সায়মন আহমেদ। সাথে বিদেশি স্ত্রী ও সন্তানগণ। নায়লা আহমেদ ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেন নি। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দুই ছেলের কেউ আসে নি জানাজায় অংশ নিতে। এক বছর পরে এসেছে বেড়ানোর মনোভাব নিয়ে বাবার কবর জিয়ারত করতে। 

মা নায়লা আহমেদ ওদের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে বললেন, আহমেদ বাড়ি এখন আর কারো বাড়ি নেই। এই বাড়ি এখন জামশেদ বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রমে কোনো জোয়ান ছেলেমেয়ের স্থান হয় না! ওরা বৃদ্ধ হবার পর সন্তান কর্তৃক অবহেলিত হয়ে এখানে এলে আশ্রয় মিলতে পারে!

বিদেশি দুই স্ত্রী নায়লা আহমেদের কথা না বুঝে তাকিয়ে থাকলো নিজ নিজ স্বামীর দিকে; আর রবিউল আহমেদ ও সায়মন আহমেদ বিস্মিত হয়ে মার দিকে তাকিয়ে নিস্প্রাণ হাসার চেষ্টা করছে। দুই ছেলের দুই সন্তান মার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। 

রবিউল বললো, মা, তুমি ঠাট্টা করছো আমাদের সাথে।

নায়লা আহমেদ বেশ রুক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, তোদের সাথে কি আমার ঠাট্টার সম্পর্ক? 

খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন ছুটে এসেছে জামশেদ বৃদ্ধাশ্রমের সামনে। এ বিষয়ে গ্রামের কেহই নায়লা আহমেদের সাথে কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। 

সায়মন আহমেদ এগিয়ে এসে বললো, তখন আমরা কাজ থাকায় আসতে পারি নি মা। আমাদের ক্ষমা করে দাও!

নায়লা আহমেদ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে বললেন, তোরা যেদিন তোদের বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েও আসতে অস্বীকার করলি, সেদিনই তোদেরকে আমি মনে মনে ত্যাজ্য করে দিয়েছি। আজ আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাজ্য করলাম। তোদের সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক রইলো না! তোরা যা!

রবিউল আহমেদ ও সায়মন আহমেদ ধীর পায়ে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে মাইক্রোবাসে উঠলো। মাইক্রোবাস চলে যেতে থাকলে নায়লা আহমেদ তাকিয়ে থাকলেন ওদিকে। ওঁর চোখের কোলে চলে এলে এক ফোঁটা অশ্রু।তিনি চলে গেলেন এক বছর আগের অতীতে-


তখন নায়লা আহমেদ স্বামী জামশেদ আহমেদ সহ বড় ছেলে রবিউল আহমেদের সাথে অস্ট্রেলিয়া ছিলেন। পুত্র ও অস্ট্রেলিয়ান পুত্রবধূ সারাদিন বাইরে থাকে চাকরির সুবাদে। বাসায় তিন বছরের ছেলে ডেভিড দাদির কাছে থাকে; অর্থাৎ নাতি লালন-পালনের দায়িত্ব দাদা-দাদির। কোনো কাজ নেই, কথা বলার কেউ নেই,সারাদিন বাসায় থেকে হাঁপিয়ে উঠতে থাকেন জামশেদ আহমেদ। এর উপর সারা বছর পরে থাকতে হয় শীতের কাপড়।

জামশদে আহমেদ ও নায়লা আহমেদ উভয়ই সরকারি চাকরি করতেন। ছয় মাসের ব্যবধানে দু’জনই সরকারি থেকে অবসরে আসেন। জামশেদ আহমেদ অতিরিক্ত সচিব এবং নায়লা আহমেদ অধ্যাপক পদে অবসরে যান। নায়লা আহমেদর ছেলেদের কাছে গিয়ে থাকার ইচ্ছা থাকলেও জামশেদ আহমেদের ছিলো না। স্ত্রীর পীড়াপিড়িতে যেতে বাধ্য হলেন অস্ট্রেলিয়া। 

তিন মাস পেরোবার পরে একদিন জামশেদ আহমেদ স্ত্রীকে বললেন, আমি ক্রমেই হাঁপিয়ে উঠছি এখানে থেকে। দেশে ফিরে যেতে চাই। 

নায়লা আহমেদ বিস্মিত হয়ে বললেন, কী বলছো তুমি! আমার ভালোই লাগছে। নাতির সাথে খেলা করে দিন চলে যাচ্ছে বেশ।

তাহলে তুমি থাকো। আমি চলে যাই।

তা কী করে হয়! তুমি চলে যেতে চাইলে আমাকেও যেতে হবে তোমার সাথে। বুড়ো বয়সে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না!

রবিউল আহমেদ বাবাকে মানাতে ব্যর্থ হয়ে কানাডাবাসী ছোটভাই সায়মন আহমেদকে জানালে সে ভিডিও কলে বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করে; ও বাবা ও মাকে অস্ট্রেলিয়া ভালো না লাগলে কানাডা চলে আসতে বলে। সেও ব্যর্থ হয়।

মাতৃভূমি টানতে থাকায় জামশেদ আহমেদ নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এক সপ্তাহ পরে চলে আসেন বাংলাদেশে।


খবরটা শুনে গ্রামের সবাই অবাক হলেও তৎক্ষণাৎ কেউ এলো না এবাড়িতে। কারঙ্কা গ্রামে এখন ওরকম চাকুরিজীবির সংখ্যা অনেক। আহমেদ বাড়ির সাথে পার্থক্য হলো: জামশেদ আহমেদের দুই ছেলে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় চাকরি করে ওখানকার সভ্যকে বিয়ে করেছে- ওরা ঐ দেশের নাগরিক হবার প্রচেষ্টায় আছে। পেয়ে যাবে অচিরেই। এই প্রবনতাই চলছে এখন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত পরিবারে। গ্রামের লোকজন যতদূর জানে: জামশেদ আহমেদ স্ত্রীসহ ঢাকার এপার্টমেন্টে থাকেন; মাঝে মাঝে ছেলেদের কাছে যান। এখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন; ক’দিন থেকে ফের চলে যাবেন ঢাকায়।

প্রায় কুড়ি বছর পরে নিজ গ্রামে এসেছেন জামশেদ আহমেদ। মা-বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন প্রতিবছর আসতেন মা-বাবার সাথে একটা ঈদ করতে। বাবা মারা যাবার পরে মা যতদিন বেঁচে ছিলেন এসেছেন। বাবা মারা যাবার পরে মা জামশেদ আহমেদের সাথেই থাকতেন; তবে একটা ঈদের উছিলায় স্বামীর কবর জিয়ারত করতে মা চলে আসতেন গ্রামের বাড়িতে। এক সময় মা ইন্তেকাল করলে জামশেদ আহমেদ গ্রামে আসা বন্ধ করে দিলেন।

ঢাকার জীবন আর অস্ট্রেলিয়ার জীবনের মাঝে পার্থক্য খোঁজে না পেয়ে বাকি জীবন গ্রামে থাকার প্রত্যাশা নিয়ে এবার গ্রামে চলে এসেছেন জামশেদ আহমেদ। কুড়ি বছরে গ্রামে অনেক পরিবর্তন হয়েছে- অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে অনেক; সব রাস্তা পাকা হয়ে গেছে এবং অধিকাংশ বাড়ি পাকা হয়েছে; ঘরে ঘরে বিদ্যুৎও চলে এসেছে, যদিও সন্ধ্যার পরে লোডশেডিং হয় প্রায় দিনই। 

দু'দিন হলো জামশেদ আহমেদ এসেছেন গ্রামে। জমিজমা সব পত্তন দেয়া আছে; তাই চাষাবাদের চিন্তা আপাততঃ নেই। তিনি ভাবছেন আঙ্গিনায় শাকসব্জির আবাদ শুরু করবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ফতুয়া গায়ে চলে এলেন পুকুরঘাটে। পুকুরঘাটটা ওঁর অনেক প্রিয়। শানবাঁধানো ঘাট। উপরের পাকা বেঞ্চে বসলেন। মার্চ মাসেই বেশ গরম পড়তে শুরু করেছে। ঘামছেন জামশেদ আহমেদ। পুকুরঘাটে এসি থাকলে বেশ হতো! নিজের রসিকতায় মুচকি হাসলেন জামশেদ আহমেদ। গায়ের সুবাসে বুঝতে পারলেন নায়লা আসছেন। প্রথম জীবনের মতো রোমাঞ্চ না থাকলেও নির্ভরতা বেড়েছে অনেক।

নায়লা আহমেদ উল্টোদিকের বেঞ্চে মুখোমুখি বসে ওড়নায় মুখের ঘাম মুছে বললেন, এতো গরম! দুই দিনেই হাপিয়ে উঠেছি! এর চেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ভালো ছিলাম!

জামশেদ আহমেদ বললেন, কী যে বলো না! এরকম পরিবশে ওখানে আছে? এভাবে নিজের পুকুড়পাড়ে বসতে পারতে? ভাবছি আমি নিজ হাতে কিচেন গার্ডেন করবো। তাতে সময় কেটে যাবে বিন্দাস।

নায়লা আহমেদ বললেন, আমি কী করবো? কিভাবে আমার সময় কাটবে? ওখানে নাতিদের সাথে হৈচৈ করে দিন কেটে যেতো।

সত্যটা হলো নাতিদের গভর্নেসগিরি করে সময় কাটতো। ছেলে ছেলের-বৌ তোমার কাছে সন্তান রেখে নিশ্চিন্তে চাকরি করতে পারতো!

হয়তোবা প্রকারান্তরে তোমার কথাই সত্য। আমার খারাপ লাগতো না। সময় কেটে যেতো। এখানে কিভাবে সময় কাটবে আমার?

তুমি রান্না শুরু করে দাও। শখের রান্না। দৈনিক নতুন রেসিপি। দুই বুড়োবুড়ি খাবো কব্জি ডুবিয়ে। 


ঐদিন রাত এগারোটায় বড় রবিউল আহমেদ ভিডিও কলে এলে কান্না গিলে নায়লা আহমেদ বললেন, গ্রামে এসে বেশ ভালো লাগছে। আমি ফের রান্না শুরু করবো।...

তখন জামশেদ আহমেদ বসা ছিলেন পাশেই। জামশেদ আহমেদ দুই ছেলেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন বেশ উচ্ছসিত কণ্ঠে।

গ্রামের ওঁর সমবয়সী গোলাম আলীকে ডেকে এনে নিজের পরিকল্পনার কথা আলোচনা করতে লাগলেন এবং পরামর্শও চাইলেন। 

গোলাম আলী বললেন, গ্রামে এখন কৃষি শ্রমিকের সংকট চলছে। শ্রমিকদের প্রায় সবাই চলে গেছে ঢাকা। ঢাকায় গিয়ে পুরুষরা রিক্সা চালাচ্ছে বা অন্য কাজ করেছে; আর মহিলারা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে বা কারো বাসায় ঠিকা ঝি-এর কাজ করছে।

জামশেদ আহমেদ বিস্মিত হয়ে বললেন, তাহলে কৃষি কাজ চলছে কিভাবে?

চাষাবাদ মেকানাইজড হয়ে গেছে। পাওয়ার টিলারে চাষ হচ্ছে, হার্ভেস্টিং মেশিনে ধান কাটা ও মাড়াই হচ্ছে।

তাহলে আর সমস্যা কী! সবাই যেভাবে চাষাবাদ করছে আমিও সেভাবে করবো! আমি তো আর ধান আবাদ করতে যাচ্ছি না! শখের সব্জি আবাদ করবো।

দু'দিন পরে জামশেদ আহমেদ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন তখন মসজিদ থেকে মাইকে একটা ঘোষণা এলো। ঘোষণাটি এমন:

পুব পাড়ার মরহুম আব্দুল মতিনের জানানা মায়মুনা বেওয়া কিছুক্ষণ আগে ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। আজ বাদ মাগরেব ঈদগাহ মাঠে মাইয়াতের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।...

জামশেদ আহমেদ অস্ফুট স্বরে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন বলে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন মায়মুনা বেওয়া কে। আব্দুল মতিনের চেহারা ঝাপসা মনে করতে পারলেও মায়মুনা বেগমের চেহারা মনে করতে পারলেন না। তখন ফজরের আযান শুরু হলো। 

নায়লা আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, কে মারা গেলো গো?

জামশেদ আহমেদ বললেন, পূর্ব পাড়ার আব্দুল মতিন ভাই-এর ওয়াইফ মায়মুনা বেগম। ফজরের নামাজ আদায় করে দেখতে যেতে হবে।

আমিও যাবো তোমার সাথে। 

জামশেদ আহমেদ ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে যান না; বাড়িতেই স্ত্রীর সাথে নামাজ আদায় করেন। তিনি ইমামতি করেন। আজকেও একইভাবে ফজরের নামাজ আদায় করে দু’জন বের হলেন মরহুম আব্দুল মতিনের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

আব্দুল মতিনের বাড়ি লোকে লোকারণ্য। জামশেদ দম্পতিকে দেখে ভেতরে যাবার পথ করে দিলো উপস্থিত লোকজন। লোকদের জিজ্ঞেস করে মায়মুনা বেগম সম্পর্কে জামশেদ দম্পতি যা জানতে পারলেন তা এরকম:

মায়মুনা বেওয়া একাই থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। ছেলে দুটো বিয়ে করার পরে মা-বাবার ভরনপোষণ করতে পারে নি; গ্রামের কৃষিকাজে না পোষানোয় একসময় ওরা মা-বাবাকে গ্রামে রেখেই চলে গেলো ঢাকা। ছেলেরা ঢাকায় হকারি করে এবং ওদের স্ত্রীগণ পোশাক কারখানায় কাজ করে। মেয়ে দুটোর বিয়ের পরে স্বামীর অলক্ষ্যে বাবা-মাকে সাহায্যের চেষ্টা করতো। আব্দুল মতিন মারা যাবার পরে বৃদ্ধা মায়মুনা বেওয়ার শরীর সায় দিলে মাঝে মাঝে ভিক্ষায় বের হতেন। কিছুদিন যাবৎ মায়মুনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার দেখাতে না পারায় কেউ জানতে পারে নি কী অসুখ হয়েছিলো ওঁর। ছেলেরা কখনো মাকে দেখতে আসে নি, চিকিৎসা করা দূরের কথা! 

হাঁ, মার মৃত্যু সংবাদ ওঁর সন্তানদের জানানো হয়েছে। সবাই আসছে। সেকারণে বাদ মাগরেব মাইয়াতের জানাজা রাখা হয়েছে। 

দুপুরের পরে ছেলে দুটো এসে মায়ের মৃতদেহ রাখা খাটিয়া ধরে ডুকরে কাঁদতে থাকায় জামশেদ আহমেদের খুব রাগ হলো। নায়লা আহমেদ ওঁর হাত ধরে টেনে রাখায় ওদের কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে বললেন: এরকম কুলাঙ্গার পুত্র না থাকাই ভালো! 

রাতে জামশেদ দম্পতির মাঝে এ নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো দ্বিমতের সৃষ্টি হয়নি।

নায়লা আহমেদ: এই শ্রেনীতে আজো ছেলেগুলো মা-বাবার মর্যাদা বুঝলো না! মা-বাবার ভরণপোষণ করে না। এ নিয়ে কাউন্সেলিং করা দরকার। তাতে হয়তোবা পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি হতো। 

জামশেদ আহমেদ: এটার কারণ আর্থিক। কিন্তু অমানবিক না। দেখলে না মার লাশের উপর কিভাবে কাঁদলো ওরা। 

এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে জামশেদ আহমেদ তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে না উঠায় নায়লা আহমেদ ভাবলেন জামশেদ আহমেদ সপ্তাহের একদিন তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন না; তবে ইশরাকের নামাজ আদায় করেন। হয়তোবা আজ সেই দিন। কিন্তু ফজরের নামাজ আদায়ে জামশেদ আহমেদ না উঠায় ভ্রু কুচকে নিজেই ওঁকে জাগানোর জন্য গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন। 

আলো জ্বেলে ফুপিয়ে উঠলেন নায়লা আহমেদ। হঠাৎ এ কী হয়ে গেলো? তিনি শেষ ঘুমে থাকা স্বামীর গায়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত হাত বুলাতে থাকলেন। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরছে মৃত জামশেদ আহমেদের গায়ে। যেনো কিছুই হয়নি এমনভাবে স্বর সংযত করে আস্তে আস্তে মৃত জামশেদ আহমেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এভাবে হঠাৎ চলে গেলে কেনো? এখন আমি কী করবো? বড্ড স্বার্থপরের মতো কাজটা করলে তুমি জামশেদ!

প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ফোন করে বাবার মৃত্যু সংবাদ জানালেন নায়লা আহমেদ। রবিউল আহমেদের কথা শুনে বিস্মিত হবার সাথে সাথে সেদিনের ঘটনা মনে পড়লো ওঁর: মায়মুনা বেগমকে আর্থিক কারণে ভরণপোষণ করতে না পারলেও মার মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে গ্রামে এসে ছেলেগুলো মার শবের উপর আছড়ে পড়ে কী কান্নাটাই কাঁদলো। আর নিজের পেটকাটা ছেলেটা কী বললো এখন? সায়মন আহমেদকে ফোন করে একই রকম কথা শুনে আর বিস্মিত হলেন না নায়লা আহমেদ।

জামশেদ আহমেদের মৃত্যু সংবাদ শুনে সকালে গ্রামের লোকজন ছুটে এলো এই বাড়িতে। সমবেদনা প্রকাশের পরে ছেলেদের জন্য লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে চাইলে নায়লা আহমেদ আজই জানাজা শেষে জামশেদ আহমেদের মরদেহ কবরস্থ করার অনুরোধ জানালেন।

Sunday, November 27, 2022

ছোট গল্প - অভদ্র || লেখক - সান্ত্বনা ব্যানার্জী || Written by Sawntana Banerjee || Short story - Aovdro


 

অভদ্র
 সান্ত্বনা ব্যানার্জী


      
              কি বাজে জায়গায় বাড়িটা নেওয়া হয়েছে বাবা! ঘরে বসে থেকেই যত সব বাজে
লোকের মুখ খারাপ শুনতে হয়!.....খুব বিরক্ত
গলায় বলে রিমি।অফিস যাওয়া আসার পথে
বাবা মাকে দেখাশোনার সুবিধের জন্যই এখানে
বাড়িটা নেওয়া হয়েছে সেটা ভুলে যায়।আর অবাক হয়ে দেখে যে লোকটার বিরুদ্ধে ওর এতো অভিযোগ সেই লোকটাই তরতর করে
বাবার ঘরে ঢুকে এলো!.....এই জাম কয়টা রাখেন কাকা, এই মাত্র বাজারে দেখতি পেয়ে
কিনে নিলাম।সেদিন খুঁজছিলেন না!বহুত ভালো
জেতের জাম গুলো,খুব মিষ্টি!....বলেই জামের
ঠোঙা টা বাবার সামনে নামিয়ে দিয়ে আবার তেমনই তরবর করে চলে গেলো। রাস্তার উল্টো
দিকেই ওর মনোহারী জিনিসের দোকান।বাবা
আমতা আমতা করে বলে......নারে,একটু মুখ
খারাপ করে বটে,তবে মনটা ভালো,খুব উপকার
করে,খোঁজ খবর নেয়।এটা ওটা বাজার থেকে
এনে দেয়।.....আরও রেগে যায় রিমি......তবু একটা ক্লাস নেই!ওই ধরনের লোক যখন তখন
বাড়ির মধ্যে চলে আসবে!..... গজ গজ করতে
থাকে রিমি।বাবা ওকে থামানোর চেষ্টা করে.....যাক গে, ছাড়, চা খাবি তো?তোর মা চা করছে। বিস্কুটের কৌটো টা বাড়িয়ে ধরে সামনে।
আপাতত থেমে যায় রিমি,কিন্তু মন থেকে সরাতে
পারেনা একটা চাপা অস্বস্তি।তারা শিক্ষিত পরিবার,এখানে সবাই তাদের চেনে,কত নামী দামী মানুষ বাবার কাছে আসে,গল্প করে,গান শোনে।মাঝে মাঝেই গানের আসর বসে বাড়ীতে।
এর মাঝে ওই লোকটা বড়ো বেমানান! কথায় কথায় ব কারান্ত, শ কারান্ত ওর চলতেই থাকে।
  কোনদিন বাড়ীর মধ্যেই বলে দেবে তার ঠিক নেই।না,না,একটু আধটু উপকার করে বলে এই সব লোককে বাড়ীতে আসতে দেওয়া মোটেই 
ঠিক নয়।....নে চা খা,কি।ভাবছিস এত?.....মায়ের কথায় চমক ভাঙে রিমির।চা খেতে খেতে বলে.....না গো,ওই দোকানের লোকটা ,কি মুখ খারাপ করে কথা বলে,তাকে
তোমরা এত পাত্তা দাও কেন বুঝিনা!মা বলে.....
ও অজিত? তা কি করবো বল,সামনেই থাকে,দোকান ফাঁকা থাকলে আসে,একটু চা খায়,তোর বাবার কিছু দরকার পড়লে এনে দেয়,বাড়ী থেকেও এটা ওটা এনে খাওয়ায়।এখানে কোনো খারাপ কথা বলেনা,তবে দোকানে বলে, শুনতে পাওয়া যায়।......তবে আর কি!শোনো বসে বসে।....গজ গজ করতে করতে ব্যাগ কাঁধে তুলে  বেরিয়ে পড়ে রিমি।স্টেশনের পথে হাঁটতে থাকে। বড়ো অসহায় লাগে। নিজের বাড়িতে এনে রাখার উপায় নেই,
একখানা ঘর,আর এক চিলতে বারান্দা ঘিরে ওদের দুজনের মত ছোটো করে সাজানো সংসার ওখানে......।আবার ওই পরিবেশে বাবা
মাকে রাখতেও বড়ো খারাপ লাগে,অকালে চলে যাওয়া ভাইয়ের কথা বড্ড মনে পড়ে! ও বেঁচে থাকলে বাবা মা কে এভাবে ভেসে ভেসে বেড়াতে
হতো না।তবুও এই ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।বাড়িটার পজিশন খুব ভাল,স্টেশন, ব্যাংক,পোস্ট অফিস ডাক্তার ,সব কাছাকাছি।
আর অফিস যাতায়াতের পথে দেখাশোনা ও
করা যায় সাধ্য মত।ওদের বাড়ির পজিশন
সে দিক থেকে মোটেও সুবিধের নয়।সব কিছুই
দূরে দূরে,মোটর সাইকেলে যেতে হয়।তাই বাইরের সব কাজই করতে হয় অনিন্দ্য কে।এমন
কি রিমিকে স্টেশনে দিয়ে আসা,নিয়ে আসা পর্য্যন্ত।আজ অনিন্দ্য না থাকায় ওকে স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে ই আসতে হলো।ঘরে ঢুকে টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে অনেক টা জল খেয়ে ফেলে রিমি। তার পরই শুরু হয়ে যায় কাজ।ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটো নামিয়ে রাখে সিংকে,এখুনি বন্দনা এসে
পড়বে আর ঝড় এর বেগে কাজ শুরু করে দেবে।কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে টিভিটা খুলে একটু
গা এলিয়ে দিয়ে বসে ডিভান টায়।অনিন্দ্য ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে বসে ওর পাশে।দুজনকে দু কাপ
চা দিয়ে যায় বন্দনা।এই সময় টুকু বিশ্রাম নিতে নিতে একটু টিভি দেখে দুজনে।কিন্তু দেখবেই
বা কি!একটা ভালো কোনো প্রোগ্রাম আছে! সিরিয়াল গুলো তো.... শুধু দল বাঁধা বাঁধি,চক্রান্ত,সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ,বিষ খাওয়ানো,
এই সব। একটু যা ভালো লাগে রাসমণি ,বড়ো
ভালো করছে রাসমণি আর রামকৃষ্ণ!  আর সকালের গানের অনুষ্ঠান।তাও বিজ্ঞাপনের ঘটা!ক,টা গান ই বা শোনা হয়!আট টা তেই রান্নাঘরে
ঢুকে পড়ে রিমি। রাতের রুটি আর তরকারি করে
নেয়।তারপর সকালের রান্নার যোগাড় করে রাখে।ক,দিন থেকেই বাবা মায়ের জন্য একটু
রাইস আর পনীর করে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে, হয়ে আর উটছে না।কালকে সকাল সকাল উঠে করতেই হবে।কিচেনে দেরাদুন রাইস, কাজু,কিসমিস, ঘী,গরম মশলা সব গুছিয়ে রাখে। বিনস,গাজর সরু সরু করে কেটে
ট্যাপার এ ভরে ফ্রিজে ভরে রাখে। পনীর সবজি
হালকা করে ভেজে রেখে দেয়,সকালে সুবিধে হবে।রাতের খাবার টেবিলে নিয়ে খেতে বসে দুজনে।আরও সব টুকি টাকি কাজ সেরে হাত মুখ ধুয়ে টানটান করে চুল বেঁধে মুখে ক্রিম ঘষতে থাকে রিমি।এই টুকু বিলাসিতা না করে
ও ঘুমোতে পারে না।আর সারাদিনের পর নরম
পাফ দিয়ে ওর পিঠে পাউডার মাখিয়ে দেয় অনিন্দ্য।এই আদর টুকু বড়ো উপভোগ করে
রিমি,সারাদিনের সব ক্লান্তি যেন.......,ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় নিশ্চিন্তে!
            সকালেই আবার কাজ শুরু। নিজেদের
জন্য মাছের ঝোল ভাত করে নিয়ে বাবা মায়ের জন্য রান্না করতে লেগে যায় দ্রুত হাতে। হট পটে
ভরে নেয়,রাইস,পনীর। আগের দিন করে রাখা পায়েস আর চাটনী টাও ভরে নেয় ব্যাগে।.....
কি গো তাড়া তাড়াতাড়ি করো, ট্রেন পাবে না কিন্তু।.....মোটর সাইকেল বার করতে করতে
বলে অনিন্দ্য। সব গুছিয়ে গেট এ চাবি দিয়ে
বেরিয়ে আসে রিমি,মোটর সাইকেলের পিছনে
বসতে বসতে বলে...... দেখো,আবার সে বারের
মত আমাকে না নিয়েই স্টেশনে চলে যেও না।....
মুচকি হেসে গাড়িতে স্টার্ট দেয় অনিন্দ্য।বাড়তি
ব্যাগটা নিয়ে ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে
রিমি,দুটো তো মাত্র স্টেশন।প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে
পাশের সরু গলি পথ টা ধরে হাঁটতে শুরু করে ও।গরম গরম রাইস আর পনীর পেয়ে বাবার
মুখটা কেমন খুশিতে ভরে উঠবে এটা ভেবেই
বড়ো আনন্দ হয় রিমির।গলির শেষ প্রান্তে এসে
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রিমি!ওকি!বাবার বাড়ির
সামনে অত চিৎকার করছে কে!দ্রুত পা চালিয়ে
এগিয়ে যায় রিমি। দেখে পাশের বাড়ির অরুণ
বাবু চিৎকার করে বাবাকে কি যেন বলছে!
বাবা কেমন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।মা 
ভয়ে ভয়ে বলল....দেখনা,ওই ডাবের খোলা গুলো কারা অরুণ দের নাচে ফেলে গেছে আর
ও তোর বাবাকে দোষারোপ করে শুধু শুধু অপমান করছে। চারি দিকে তাকিয়ে কেমন
হতবাক হয়ে যায় রিমি!রাস্তার দু ধারে মানুষ জন
দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের মত!একজন প্রবীণ মানুষকে এভাবে অপমান করছে কারও কোনো
প্রতিবাদ নেই!হটাৎ সবাই অবাক হয়ে দেখে
মনোহারী দোকানের সেই মুখ খারাপ করা অজিত বীর বিক্রমে এগিয়ে আসছে!কিছু বুঝে
ওঠার আগেই বাবাকে ঘরে ঢুকিয়ে খাটের ওপর
বসিয়ে দিয়ে তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিমায় অরুনের ঘাড় ধরে ওরই দরজায় চেপে ধরে আর চিৎকার
করতে থাকে......আর একবার ওই বুড়ো মানুষটার ওপর হম্বি তম্বী করে দেখ,তোকে কি
করি আমি!ভেবেছিস পিতিবাদ করার কেউ নেই!শা.........।কোনো কথা না বলেই ঘরে ঢুকে
যায় অরুণ।আর হতবাক রিমিকে হাত নেড়ে
বলে অজিত......আপনি যান দিদি অপিস পানে,
নিছিন্তে,আমি আচি,কুনো ভয় নাইকো। ও কাকীমা দুকাপ চা করি দ্যান দিকি,আমি আর
কাকা খাই।......আবার গলা উচিয়ে বলে.....আর
এদিক পানে এলি ঠ্যাং খোঁড়া করি দিবো!ভেবেছো বুড়ো মানুষ কে যা খুশি বলা যায় লয়!
.....এতক্ষনে সম্বিত ফিরল রিমির। মায়ের হাতে 
খাবার দাবারের ব্যাগটা দিয়ে অস্ফুটে বলে....
সব গরম আছে,এখনই খেয়ে নাও,আর অজিত
দাদাকে দিও!

ছোট গল্প - রিকভারি স্টেজ || লেখক - ডা: অরুণিমা দাস || Written by Arunima Das || Short story - Recovery stage


 

রিকভারি স্টেজ

ডা: অরুণিমা দাস



ডা: রায় নিজের চেম্বারে বসে পেশেন্ট প্রোফাইল গুলো চেক করছিলেন। পেশায় একজন বড়ো সাইকিয়াট্রিস্ট ডা: সুশান্ত রায়। রোগীদের মানসিক স্বাস্থের প্রতি খুবই যত্নবান তিনি।খুব মন দিয়েই ফাইল গুলো দেখছিলেন।


হঠাৎ দরজায় কেউ নক করলো,


মে আই কাম ইন ডক্টর।


ফাইল থেকে মুখ তুলে দেখলেন সিস্টার অহনা চেম্বারে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইছেন। একগাল হেসে ডা: রায় বললেন ইয়েস,প্লীজ কাম ইন অহনা।


অহনা এগিয়ে গিয়ে একটা ফাইল তুলে দেয় ডা: রায়ের হাতে, আর বলে স্যার এটা মোনালিসার ফাইল, ও এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ আছে। মেডিসিন গুলোও সময় মত খাওয়াচ্ছি। স্যার ওকে কবে নিয়ে যেতে পারবো বাড়ী, সময় এলেই নিয়ে যেতে পারবেন,বললেন ডা: রায়। বলেই চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ফাইলটাতে। হেসে বললেন অহনা ইট ওয়াস নট পসিবল উইদাউট ইউ। অহনা বলল স্যার আমি তো শুধু কেয়ার নিয়েছি ওর, আর আপনি তো ওকে অ্যাসাইলামে আনা থেকে শুরু করে প্রপার মেডিসিন আর রেগুলার কাউন্সেলিং করে রিকভারি স্টেজে নিয়ে এসেছেন। ডা: রায় হেসে বললেন এটাই তো আমার কাজ সিস্টার। আর এই কাজের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি খুঁজে পাই আমি। একগাল হেসে অহনা বলে জানিতো স্যার,আপনি রোগীদের কতো টা ভালোবাসেন। আপনি তাহলে ফাইলটা চেক করুন স্যার, আমি একটু পরে আসছি। মোনালিসার লাঞ্চের টাইম হয়ে গেছে, বললো অহনা।


ও শিওর, প্লীজ গো। অহনা বেরিয়ে গেলো।


মোনালিসার ফাইলটা দেখতে দেখতে ডা: রায় ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে লাগলেন অতীতের দিনে,মনে পড়ে গেলো বছর দুই আগেকার কথা। এক ঝড় বৃষ্টির দিন হসপিটাল থেকে রাউন্ড দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ গাড়ীর সামনে এসে পড়ে একটি মেয়ে। গাড়ির ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। অত রাতে কোনো উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন উনি। জ্ঞান ফিরলেও নিজের নাম বলতে পারেনি সেই মেয়েটি। কেমন একটা শূন্য দৃষ্টি আর এলোমেলো চুলে তাকিয়েছিল সে। সেই রাতে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি ডা: রায়। পরদিন সকালে অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় গিয়ে ডা: রায় কিছু লোকজনকে মেয়েটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন মেয়েটি মানসিক ভারাম্যহীন,নাম মোনালিসা,থাকে রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের এক ঝুপড়িতে। ওর বাড়ি কোথায় আর কেনোই বা ও এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকে এসব জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে ডা: রায় অনেক কিছু জানতে পারেন। একটি ছেলেকে ভালোবাসতো মোনালিসা, কিন্তু বাড়ির কেউ সেটা মেনে নেয়নি। পালাবার প্ল্যান করেছিল ছেলেটির সাথে। ধরা পড়ে যায় দাদার হাতে আর বেধড়ক মার খেয়ে ছেলেটির মৃত্যু হয় সেদিন। এই নৃশংস দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে মোনালিসা পাগলের মত হয়ে যায়, নিজের চুল ছিঁড়তে থাকে। দাদারা ওকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে আটকে রাখে। চেঁচামেচি করলেই জুটতো মারধর আর অকথ্য গালাগাল। খেতেও দিতো না ঠিক করে। একদিন দাদারাই বোনের পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসে। ওখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাবের ছেলেরা ওকে রিকশা স্ট্যান্ডের পাশের কুঁড়েতে রেখে আসে। খাওয়াদাওয়া কিছু করেনা, সারাদিন রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। শুনতে শুনতে ডা: রায়ের মনটা ভার হয়ে ওঠে। উনি বলেন আজ থেকে ওর চিকিৎসার দায়িত্ত্ব আমার। ওকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে রাখবো,দেখি কতটা সুস্থ করে তুলতে পারি ওকে। সবাই বললো, চেষ্টা করে দেখুন স্যার। সেইদিন থেকে মোনালিসা কে সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লড়াই শুরু করেন ডা: রায়।


প্রথম প্রথম একটা ঘরে বেঁধে রাখা হতো মোনালিসা কে। ইলেকট্রিক শক থেরাপি থেকে শুরু করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি সব কিছু চলতো। আর সাথে অ্যান্টি সাইকিয়াট্রিক মেডিসিন এবং সিস্টার অহনার রুটিন কেয়ার। এই সব কিছুর সম্মিলিত প্রয়াসে আজ মোনালিসার হাত পায়ের বাঁধন খুলে গেছে, মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে সক্ষম। সময় ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। কঠিন বাস্তবের প্রেক্ষাপট তার মানসিক কাঠিন্য আরো সুদৃঢ় করে তুলেছে। আত্মনির্ভর হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় সে। আর যাইহোক,বাড়িতে কোনোভাবেই ফিরতে রাজি নয় মোনালিসা। বাড়ির লোকেদের নির্মম অত্যাচার কিছুতেই ভোলেনি সে। সিস্টার অহনা ঠিক করেছে মোনালিসা কে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে,অনাথ জীবনে বোনের অভাব দূর হবে। ডা: রায় ও পারমিশন দিয়েছেন। মোনালিসাও অহনাকে দিদির মতোই ভালোবাসে।

স্মৃতির পাতা থেকে চোখ তুলে মোনালিসার ফাইলে নতুন মেডিসিন গুলো লিখতে লাগলেন ডা: রায়। কল করে অহনাকে ডাকলেন তিনি। অহনা এলে বললেন জাস্ট দুটো মেডিসিন দেওয়া আছে, লো ডোজ, উদ্বেগ কমাবে আর মন শান্ত রাখবে। এগুলোই এখন থেকে খাবে মোনালিসা। আর ওষুধের থেকেও ওর দরকার এখন ভালোবাসা,সহমর্মিতা যেটা ওকে রিকভারি স্টেজ থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেবে। অহনা বলল আমি সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো স্যার। ডা: রায় বললেন আমি জানি আপনিই পারবেন একমাত্র,তাই আপনাকে পারমিশন দিয়েছি। ফর্মালিটি গুলো পূরণ করে আপনি আগামী সপ্তাহেই আপনার নতুন বোনকে নিজের বাড়ী নিয়ে যেতে পারবেন। অহনা ধন্যবাদ জানিয়ে একছুটে মোনালিসার কেবিনে গিয়ে বললো আমার সাথে যাবি তো নাকি। ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে মোনালিসা বললো হ্যা দিদি, তোমার আর ডা: রায়ের হাতেই আমার পুনর্জন্ম হয়েছে, নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছি আমি। তোমাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সাথেই থাকবো আমি। কোথাও যাবো না তোমায় ছেড়ে।কেবিনে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলেন না ডা: রায়। দিদি আর বোনের ভালোবাসার কথোপকথন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলেন ও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন এই বন্ধন যেনো অটুট থাকে চিরকাল আর মোনালিসার নতুন জীবন যেনো সবসময় খুশি আর আনন্দে ভরপুর থাকে। কোনো দুঃখ যেনো ওর মনকে ছুঁতে না পারে কোনোদিন। কেবিনের দরজা বন্ধ করে ডা: রায় হাঁটা দিলেন অন্য পেশেন্ট গুলো দেখবেন বলে। আরও কেউ হয়তো রিকভারি স্টেজ থেকে সুস্থ জীবনে পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষা করছে যে দুটোর মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন গড়ে দিতেই তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকেন।



Friday, November 25, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -28


 


দেবীদাসের সাক্ষাৎ ডায়েরীতে ভদ্রলোকের নামতো নেই-ই, এই প্রথম দেখল ভদ্রলোককে। তবে কি তার বাবার সাথে পরিচয় আছে! হতে পারে, বাবার সাথে বহুজনের পরিচয় আছে যেহেতু তিনি একজন বিগ ইন্ডাষ্ট্রিয়ালিষ্ট।


 ওর পরিচয় জানতে চাইলে পর প্রথম প্রশ্নের উত্তর চাইলেন ড্রাইভার। উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলে দেবী রায়, বাবাকে আপনি চেনেন? না। কিন্তু আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি।

 ব্যাকগ্রাউন্ডের তথ্য? চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। দেবীদাসের অতীত নোংরামীতে পরিপূর্ণ তার অজানা নয় ।

 মুকুলকে জানতেন ?

 মুকুল অর্থাৎ মুকুল বক্সী এই শহরের খ্যাতনামা এ্যাডভোকেট তারাপদ বক্সীর একমাত্র আদুরে কন্যা। কি মনে পড়েছে?

 ট্যারা চোখে তাকিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করলেন, গভীর ভালোবেসে কেনই বা আপনাকে ত্যাগ করল।

 অন্তর্যামী ভদ্রলোকের কথা গুলো শুনেই ঘামতে শুরু করলো। ও মনে মনে চিন্তা করতে থাকলো মুকুলের কথা কোন দিন কোন মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারেনি সে। ওর সাথে কি করে ভালোবাসা হয়েছিলো তা আজ অবধি মনে আছে। সে একজন এমন স্মার্ট মেয়ে ছিলো যে কোন ইয়ং ছেলে ওর কাছে ঘেঁসতে পারতো না। মেলামেশা তো দূরের কথা, ওর সংস্পর্শে আসা ছিলো অত্যন্ত দুঃসাধ্য। বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী রতন মজুমদারের একমাত্র ছেলে স্বপন তাদের পাঁচ বন্ধুর সাথে চ্যালেঞ্জ করেছিলো, যদি মুকুলকে কেউ নিজেদের আয়ত্বে অর্থাৎ ওর সাথে প্রণয় লীলা শুরু করতে পারে, তাকে পরীক্ষার পর পুরী নিয়ে যাবে। যাতায়াতের ভাড়া ও অন্যান্য যাবতীয় খরচা সে বহন করবে।

 ধীরে ধীরে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। কেউ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে পারল না। এবার দেবীর পালা। একে যে জয়ী হতে পারবে এর কোন গ্যারেন্টি নেই। তবুও প্রতিযোগিতায় সামিল হতে হলো কারণ ওদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হবে।

 কিন্তু প্রতিযোগিতায় সে যখন সামিল হচ্ছে তাকে পরাজিত হলে চলবে না। তিন দিন পর পাড়ারই এক মস্তান বাচ্চুদার কাছে শলা পরামর্শ করে তাকে পথ বাতলে দিলো। অবশ্য কার্য হাসিল হলে পর সেলামী স্বরূপ কিছু টাকা ওকে বকশিশ দিতে হবে।

সেদিন বিকেল। সূর্যের রক্তিম আভা ম্লান হতে চলেছে। শহরের এক কোণে থালার মতো সূর্যটা সারাদিন ক্লান্তির অবসাদে তাড়াতাড়ি বিদায় নেবার জন্য ব্যস্ত। মুকুল তার প্রিয় আদুরে সাদা ধবধবে এ্যালসিসিয়ান ডগটা নিয়ে নিজের বাড়ীর অভিমুখে দ্রুত পা বাড়িয়েছে। প্রতিদিন স্কুল হতে বাড়ীতে ফেরার কিছু পরেই নিকট পার্কে। বেড়াতে আসে। ওর নিত্য অভ্যাস বেড়ানো। আজকের মতো অন্য দিন এতো লেট করে না বাড়ী ফিরতে। একটু পরে শহরের বুকে অন্ধকার নেমে আসবে। তাই দ্রুত গতিতে পা দুটো চালাচ্ছিল। পথি মধ্যে দুর্ধর্ষ বেশ লম্বা চওড়া লোকটা আটক করবে কল্পনা করেনি। একটু দূরে একটা কালো রঙের এ্যামবাসাডার দাঁড়িয়ে ছিল।

লোকটা মুকুলের পথ রোধ করে বলল, এই রকম মেয়েটিকেই নিশিবন্ধু করতে চাইছিলাম। কোন ভয় নেই ডারলিং, মাত্র কয়েক ঘন্টা থাকবে কাছে, তারপর এইখানেই পৌঁছে দেবো। ফুটফুটে জ্যোৎস্নার ন্যায় এক সুন্দরী রাজকন্যাকে কি সহজে কেউ ছাড়তে চায় ? হাতে বেশী সময় নেই, ভদ্রমেয়ের মতো চটপট ট্যাক্সিতে উঠে পড়ো, নতুবা -

মুকুল ভয়ে কাঁপতে থাকল। মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারল না। চোখের সামনে ভেসে উঠল গতকাল পেপারের মধ্যখানের পৃষ্ঠা। বড় বড় হরফে লেখা ছিল, “এই বর্তমান যুগে কি নারী ধর্ষণের পালা কমবে না? গতকাল অমুক জায়গায় অমুক এক গলির মধ্যে এক আঠার / উনিশ বৎসরের অবিবাহিত মেয়েকে একা পেয়ে তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে, ফলে সেই মেয়েটির অবস্থা এমন শোচনীয় যে,...

মুকুল চিৎকার করে উঠে। মুকুল চিৎকার করে উঠতেই লোকটা মুকুলের মুখটাতে রূমাল চাপা দিয়ে ট্যাক্সির ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল, ঠিক সেই সময় মটর সাইকেলে চড়ে বীর পুরুষের মতো ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো দেবীদাস। হাতে রিভলভার, অবশ্য ওটা নকল। রিভলভারটা হাতে শক্ত করে ধরে নবাবী কায়দায় বেশ গম্ভীর গলায় বলল, ওকে ছেড়ে দিন বন্ধু, নতুবা ছয়টা গুলি বুকের মধ্যে ভেদ করবে। আমার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট কোনদিন হয়নি।

লোকটা ভদ্র সন্তানের মতো ছেড়ে দিল। মুকুল মুক্তি পেয়ে দেবীর কাছে এসে হাঁপাতে শুরু করল। সত্যিই একটা রোমান্টিক ঘটনা ঘটে গেল যেন। লোকটা ভয় পেয়ে নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। অর্থাৎ দেবীদাসের কথা মত কাজ করল। এবার না জানার কোন প্রশ্নই উঠে না। বন্ধুদের কাছে প্রতিযোগিতায় জিততে গিয়ে সে সত্যিই মুকুলের প্রেমে পড়বে দেবী, মনে হয় জীবন অভিধানে কোন জায়গাতে লেখাছিল বলে মনে হয় না। ভালোবাসা যে কি জিনিষ জানতো না অনেক সাহিত্যিকের প্রেমের গল্প / উপন্যাস পড়েছে সে, তখন হয়তো বই এর মধ্যে নায়ক / নায়িকার প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুভূতি বা শিহরণ জানত না সত্য কিন্তু বাস্তবে যে এর মূল্য বা তাৎপর্য কতখানি তা প্রেমে না পড়লে বোঝা যায় না। বিশেষ করে ঐ ঘটনা ঘটে যাওয়ার কয়েকদিন পরে যখন দেবীদাসের জন্ম দিনে মুকুলের বাবা নিমন্ত্রিত হয়ে এসে ছিলেন তাদের বাড়ী, সাথে মুকুল ও ছিল। সে কখনো জানতো না মুকুলের বাবা ছিলেন তার বাবার হিতৈষী বন্ধু।

দিন কয়েক পর বন্ধু মহলে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হলো। তার বলার প্রয়োজন হলো না মুকুল তার আয়ত্বে এসেছে কিনা। তার সাফল্যের পুরস্কার স্বরূপ চাইল সকলে মিলে একদিন পিকনিকে যাবে এবং মুকুলও তাদের সাথে যোগ দেবে। পিকনিক হতে ফেরার সময় তারা তার বুদ্ধির তারিফ করল এবং দেবীকে বিজয়ী সম্মানে ভূষিত করল।

এরপর তাদের প্রণয়লীলা বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল। তাদের ভাব ভালোবাসার লীলা কিভাবে নিজেদের মধ্যে বিস্তার করতে হয় কেউ জানিয়ে দিলো না। তারা দুই লীলা সহচরী যত্র তত্র একই সঙ্গে যাওয়া আসা ও প্রকাশ্যে দিবালোকে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতো। এমন কি উভয়ে স্থির করেছিলো, পড়াশেষে হলে তারা দুজনে কপোত কপোতীর ন্যায় সুখের নীড় বাঁধবে।

অবশ্য বন্ধু মহলে এই গুঞ্জন অনেক আগেই উঠেছিল। এইভাবে আননন্দ উল্লাসে পর পর তিন বছর কেটে গেলো। কখন যে দিন গুলো নদীর স্রোতের মত পেরিয়ে যাচ্ছিল জানতেই পারল না। বন্ধুদের মধ্যে অনেককে ত্যাগ করতে হল দেবীদাসকে। নিজের জীবনের লক্ষ্যকে অনুসরণ করে ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে। সে ও মুকুল একই পথের যাত্রী, ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলেছে তাদের জীবন সঙ্গী নির্বাচনের অন্তিম লগ্নের দিকে।

কিন্তু কোনদিন কল্পনা করেনি দেবী, তারা দুজনে যে প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিল। তা ঝটিকাঘাতে শেষ স্নিগ্ধ দীপশিখা একদিন হঠাৎ নিভে যাবে। কোন দিন বন্ধু মহলে। কেউ কল্পনা করতে পারেনি মুকুল ও দেবীর মধ্যে প্রেমের বন্ধন রজ্জু একদিন ছিন্ন হয়ে যাবে। শুধু ওরা কেন, যে কেউ তাদের প্রণয় ইতিহাস শুনে থাকলে বিশ্বাস করবে না। তাদের বিচ্ছেদকে। কারণ অবশ্য ছিল একথা অস্বীকার করা যায় না। প্রেমের খেলায় পরাজিত তো হল, কিন্তু পরাজিতের যে এতো জ্বালা তা তার জানা ছিল না।

বানবিদ্ধ পক্ষীর ন্যায় ছটপট করতে থাকল মুকুলের সাথে বিচ্ছেদের পর। সমস্ত শরীরের দংশনের জ্বালা অনুভব করতে লাগলো। অতীত কাহিনী তার স্মৃতিপটে ভেসে যেতে লাগলো। সেই বিকাল, সেই পার্ক, সিনেমা ও পাশাপাশি বসে গল্প করা। কিন্তু কেন এমন হলো ?

 তবে কি দেবীদাস বন্ধুর সাথে হাত মিলিয়ে বারাঙ্গনালয়ে হাজির হয়েছিল বলে ? তাই যদি হয় ও জন্য মুকুলই দায়ী, হ্যাঁ-হ্যাঁ দেবী কর্কশ কণ্ঠে বলবে, এর জন্য মুকুলই দায়ী। কেন সে তার প্রতি অবিচার করল। সে তো তার কাছে স্বীকারই করেছিল ভুলবশতঃ এক চরিত্রহীন লম্পট বন্ধুর পাল্লায় পড়ে পতিতালয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু ওর পরে দ্বিতীয় বার সে স্থানে যাবার চেষ্টা করেনি। তবে কি সুমন্তই তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়াল ?

 দেবী সেদিন মুকুলের কাছে অপমানিত হয়ে ফিরে আসছিল, সেদিন সুমন্তকে দেখেছিল ওদের বাড়ীতে। না-না সে অত্যন্ত ভালো ছেলে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। এ ভুল ধারণা। দেবীদাসের ও মুকুলের বিচ্ছেদের জন্য কেউ দায়ী নয়। এমন কি তার লম্পট বন্ধু রন্টুকেও দায়ী করে না। দায়ী তার ভাগ্য। নইলে কেনই বা রন্টুর সাথে পতিতালয়ে হাজির হবে সে। সেদিনের ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল।

Thursday, November 17, 2022

ছোট গল্প - বদ || লেখক - অলভ্য ঘোষ || Written by Alabhya Ghosh || Short story - Bod


 

    বদ 

অলভ্য ঘোষ 


আমি তখন স্কুলে পড়ি একটি ছেলে বখে গিয়েছিল।লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি সিগারেট খেত কেবল না গঞ্জিকা সেবন ও করতো।আমাকে অনেকে বারণ করতো ও খারাপ ছেলে তুই ভালো ছেলে ওর সাথে মিশিস কেনো।খারাপ হয়ে যাবি।আমার ভালো ভালো ছেলে গুলোর চাইতে খারাপ ছেলেটাকেই বেশি ভালো মনে হতো।কারণ তার ভালো সাজার কোন দায় ছিলনা।কে তাকে খারাপ বলবে তাতে তার কিছুই যেত আসতো না।আর আতু আতু পাতু পাতু ভালো ছেলে গুলোর ছিল সর্বদা লোকের কাছে ভালো হবার চেষ্টা।গজ-দম্ভ মিনারে বাস!আমার মনে হত একটা খারাপ ছেলে যদি একটা ভালো ছেলেকে খারাপ করেদিতে পারে তবে একটা ভালো ছেলে একটা খারাপ ছেলেকে কেন ভালো করতে পারবে না।যদি সে সত্যিই ভালো হয়।যদি ভালো ছেলেটা খারাপ ছেলেটার ভালো না করতে পারে তবে ভালো ছেলেটার ভালো গুণে খামতি আছে।অমন ভালো হওয়ার চাইতে না হওয়া ভালো। আমি ছেলেটার সাথে স্কুলে যেতাম।ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী ,নেতাজি সুভাষ-চন্দ্র বসু,মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,মাতঙ্গিনী হাজরা, রবিনহুড প্রতিদিনই এক একটা গল্প শোনাতাম।


"উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, 

তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে !"


ছেলেটা আমাকে একদিন একটা মাঠের মাঝে নিয়ে গিয়ে বলল;

-তুই তোর জ্ঞানের কথা রাখ।কত বড় হিম্মত আছে বিড়ি খেয়ে দেখা।


আমি বললাম;

- বিড়ি খেতে আবার হিম্মত লাগে নাকি।


ছেলেটা বলল;

-মুখে বললে হবে কেন খেয়ে দেখা।


ওর হাত থেকে একটা বিড়ি নিয়ে মুখে ধরলাম।দেশলাই কাঠি জ্বেলে ও আমার মুখাগ্নি করার সাথে সাথে ওর মুখটা যেন প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো আনন্দে। বিড়িটা ঠিকমতো জ্বলেনি তখনো ফিরিয়ে দিতেই সে ফুরফুর টান দিতে লাগলো আমার মুখের বিড়িটা আনন্দের চোটে।এ আনন্দ কিসের আনন্দ আমি আন্দাজ করেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তার প্রকাশও পেলাম।ছেলেটা জনে জনে স্কুলে সকলকে বলে বেড়াতে লাগলো আমাকে সে বিড়ি খাওয়াতে পেরেছে।কেউ কেউ বিশ্বাস করলো ছিঃ ছিঃ করে বলল আমি উচ্ছন্নে গেলাম।কেউ কেউ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না।আমার মত ভালো ছেলে তেমন কোন কাজ কখনোই করতে পারে না।বরং ছেলেটার ওপর তাদের বিশ্বাস ছিল না।


আমি ছেলেটার সাথে পরের দিনও প্রস্তুত হলাম স্কুলে আসতে নতুন একটা গল্প শোনাতে।ছেলেটা তখন আমায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে ভাবটা এমন তার আর আমার মধ্যে এখন কোন ফারাক নেই।তবে কেন বাপু জ্ঞানের কথা অতো।


আমার খুব হাসি পেয়েছিল।আমি বিড়িটা মুখে ধরেছিলাম কিন্তু ধোঁয়াটা কখনোই মুখের ভিতর টানিনি।ছেলেটাকে বলেছিলাম শোন কে আমাকে ভাল-বলবে তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি নিজের কাছে নিজে কতটা ভাল।আমার পথ যদি তোর পথের থেকে উৎকৃষ্ট হয় তোকে আমার পথে আসতেই হবে। তোর পথ যদি আমার পথের থেকে ভালো হয় আমি তোকে কথা-দিলাম নির্দ্বিধায় তোর পথে হাঁটব।


ছেলেটাকে আমি সেদিন বুদ্ধদেবের গল্প বলেছিলাম পথ হাঁটতে হাঁটতে।


সময় টা বর্ষাকাল জঙ্গলের মধ্যে সিক্ত বুদ্ধদেব তখন ধ্যানে মগ্ন থাকেন সারাদিন।কর্দমাক্ত পথে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয় না জঙ্গল সন্নিকট নগর থেকে ভিক্ষানুসন্ধানে বেড়য় শিষ্যগণ।কোনদিন ভিক্ষা জোটে কোনদিন ভিক্ষা জোটে না।যেদিন জোটে সেদিন আহার্য গ্রহণ করে।যেদিন জোটে না খেতে পায় না।খাদ্যের চেয়েও অন্তরায় প্রকৃতি বর্ষা মুখর দিনে জঙ্গলে থাকা দুরূহ।একটা ছাউনি খুব প্রয়োজন।


বুদ্ধ শিষ্যদের বলেন;

- যাও দেখো নগরে একটি ছাউনি মেলে নাকি।


কিন্তু নগরে কিছু লোক তাদের ভিক্ষা দিতে সম্মত হলেও ছাউনি দিতে কেউয়ই চায় না।অবশেষে এক পতিতা তাদের ভিক্ষা ও ছাউনি উভয় দিতে সম্মত হয়।


শিষ্যরা ফিরে এসে গুরুকে জানাল;

- ছাউনি পাওয়া গিয়েছে গুরুদেব। কিন্তু......


বুদ্ধ বলেন;

-কিন্তু কি?


শিষ্যরা সংশয়ের সাথে বলেন;

-কিন্তু গুরুদেব তা বেশ্যালয়।


বুদ্ধ বললেন;

-আমরা সন্ন্যাসী ভিক্ষুক।আমাদের কাছে বেশ্যালয় আর দেবালয়ের মধ্যে কোন ফারাক নেই।চলো সেই উত্তম স্থানে আমাকে নিয়ে চলো।


শিষ্যরা বুদ্ধকে সেই বেশ্যালয়ে আতিথেয়তার জন্য নিয়ে গেলত বটে কিন্তু মনের মধ্যে সংশয়ে দোদুল্যমান রইলো এই ভেবে যে তাদের সন্ন্যাস ব্রত থেকে স্খলন ঘটতে আর বেশি দেরি নেই।এদিকে বুদ্ধকে অতিথি হিসেবে পেয়ে লাস্যময়ী বারবনিতা টি কি করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না।কিভাবে কতটা সেবা করলে প্রভু পরিতৃপ্ত হবেন।বুদ্ধের সিক্ত বস্ত্রের বদলে তিনি তাকে রেশমের কোমল গরম কাপড় পরিধান করতে দিলেন।সুগন্ধি খাদ্য পানীয় আহার করতে দিলেন; এমনকি তার মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্যও পরিবেশন করতে লাগলেন।আর এই প্রতিটি পদক্ষেপে শিষ্যরা আঁতকে উঠতে লাগলেন তবেকি তাদের গুরুদেব বশীভূত হয়েছেন এই সামান্য কয়েক কড়ির বেশ্যার!


বুদ্ধ শিষ্যদের ডেকে বলেন;

-শোন বাইরের কোন কিছুতেই মানুষের স্খলন ঘটে না।মানুষের স্খলন ঘটে ভেতরের দ্বিচারিতায়!


আমি থেমে বলেছিলাম;

- তারপর কি হয়েছিল জানিস?


ছেলেটা বোকার মত বলেছিল;

-কি?


আমি বলে ছিলাম;

-বুদ্ধদেব যখন সেই বেশ্যাখানা ছেড়ে চলে গেলেন।সেই বেশ্যাও তার পিছু নেয় সন্ন্যাস গ্রহণ করে।


ছেলেটা তীব্র প্রতিবাদ করেছিল।

-এসব ঢপের গল্প।শোন নগরের পথে ওই ভিখারি আর খানকি টা যদি এক সাথে বেড়য় লোকে ভিখারি কে ছেড়ে খানকির পেছনে ছুটবে কারণ সে বেশি আকর্ষণীয়।


কয়েক দিনের মধ্যেই আমি স্কুলে পেট ধরে বাবাগো মাগো করে উঠলাম।সর্বাগ্রে যে এগিয়ে এল সে ওই বিড়ি খাওয়া ছেলে টা।ওই টিচার্স রুমে গিয়ে শিক্ষকদের খবর দিল কেবল নয়।রিকশা ডেকে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো।শিক্ষক মহাশয় রা জরুরি অবস্থার জন্য স্কুলে সংরক্ষিত সাধারণ পেট ব্যথার ট্যাবলেট দিয়ে ছেলেটাকে আমার বাড়িতে পাঠাল খবর দিতে।


মায়ের কাছে কোন কিছু লুকানোর সাধ্য আমার নেই।তড়িঘড়ি আমার মা খবর পেয়ে ছুটে গেল স্কুলে এবং আমাকে বাড়ি নিয়ে এসে প্রথম যে কথাটি বলেছিল সেটি হল;

- তোমার কিছুই হয় নি।


আমি মায়ের মুখের দিকে চেয়ে হেসেছিলাম।


মা কেবল বলেছিল;

- আর যেন এমন করোনা।


মা আমাকে জানতে চায়নি কেন আমি পেট ব্যাথার অভিনয় করেছিলাম।আমার স্কুল কখনো কামাই হতো না স্কুল থেকে পালিয়ে আসাত দূর।মা ভালকরেই জানতো এর পেছনে আমার কোন স্কুলের চাইতেও বড় কোন জীবন পাঠ লুকিয়ে রয়েছে।পাঠটি ছিল; আমি কি ঠিক না ভুল?Am I right or wrong?সমগ্র জীবনটা তো একটা পাঠশালা।


বহুদিন বাদে সেই ছেলেটি পথে আমায় ধরে বলল গল্প বলেবলে তুই আমার মাথাটা বিগরেদিলিরে।


আমি বললাম;

-যে মানুষ তার বদ বুদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারে সেই বুদ্ধ।আর যে মানুষ তার বদ বুদ্ধির নিচে চাপা পড়ে থাকে তারা বুদ্ধু।


Wednesday, November 16, 2022

ছোট গল্প - যমজ || লেখক - অমিত কুমার জানা || Written by Amit Kumar jana || Short story - Jomoj


 


  যমজ
অমিত কুমার জানা


অনুপ এবং অজিত দুই যমজ ভাই। দুজনকে দেখতে হুবহু একই রকম এবং হাঁটা চলার ধরনও প্রায়ই একই। তবে ছোটবেলা থেকে পাঁচ মিনিটের ছোট  অজিত অনুপের চেয়ে বেশ দুষ্টু। অজিতের এই দুষ্টুমি বড় হওয়ার সাথে সাথে কমলো না,বরং বদমায়েশিতে পরিণত হলো। সে বিভিন্ন ধরনের অকাজ কুকাজ করে আনন্দ পেতে শুরু করলো। এদিকে অনুপ কলেজের পড়াশোনা শেষ করে পুলিশের চাকরি পেল। অবশ্য এর জন্য তাকে নিয়মিত অনেক পরিশ্রম এবং পড়াশোনা করতে হয়েছে। 
অজিত কলকাতার একটা কলসেন্টারে কাজ করতো। এতেও তার ধৈর্য্য ছিল না। মাঝেমধ্যেই কারণে অকারণে বাড়ি চলে আসতো। ইতিমধ্যে কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সংকট রেখা অতিক্রম করলো। কলকাতায় শয়ে শয়ে মানুষ সংক্রামিত হলো এবং মারা যেতে লাগলো। করোনার ভয়ে অজিত বাড়ি ফিরে এলো, মেদিনীপুর শহরে। এদিকে অনুপ করোনা আক্রান্ত হয়ে নিজ গৃহে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছে। সে বাড়ির বাইরে সচরাচর বেরোয় না। অনেক দিন পর অজিতকে দেখে মা উলপীদেবী ভালো মন্দ রান্না করে খাওলেন এবং তাকে সাবধানে থাকতে বললেন। কারণ ভাইরাসের সংক্রমণ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার না করলে নির্ঘাত করোনা আক্রান্ত হতে হবে। কিন্তু অজিতের অনুপকে দেখেও শিক্ষা হলো না,সে ইচ্ছাখুশি এদিক ওদিক বেড়াতে লাগলো।  অজিতের বেপরোয়া ব্যবহার ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। পাড়ার অনেকেই তার দিকে আঙুল তুলে অভিযোগ করলো যে সে কলকাতা থেকে এসে টেস্ট, আইসোলেশন এইসব কিছু না মেনে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? অজিত এসব কথায় তোয়াক্কা না করেই বললো যে তার যা মন চায় তাই করবে। শুধু তাই নয় সে এই ভয় দেখায় যে তার দাদা অনুপ পুলিশ, বেশি ঝামেলা করলে দাদাকে দিয়ে লক্ আপে ঢুকিয়ে দেবে।

এদিকে অসুস্থ অনুপ বাড়িতে আইসোলেশনে সময় কাটাচ্ছে। যদিও সে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। বাড়িতে সব্জি ছিল না। মা অজিতকে বাজার যেতে বলে বাথরুমে চলে গেলেন। অজিতের মাথায় একটা বদমায়েশি বুদ্ধি খেলে গেল। সে তার দাদার পুলিশ ইউনিফর্ম এবং ক্যাপটা পরে নিল। তারপর মুখে মাস্কটা লাগিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাজার করতে। শহরেরের প্রান্তের হাইরোডে যেখানে তুলনামূলক জনসমাগম বেশ সেখানে দাঁড়িয়ে রুললাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপর সে ঘুষখোর পুলিশি স্টাইলে তোলাবাজি শুরু করলো।  বাইক আরোহী যারা যারা হেলমেট এবং মাস্ক পরেনি তাদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা নিতে লাগলো। মাস্কহীন ফোরহুইলারের ড্রাইভারও রেহাই পেলো না। এক দু ঘন্টায় অজিতের দু পকেট টাকায় ভরে গেল। এরপর অজিত মহানন্দে বাজারে গিয়ে বাজার সেরে পান সিগারেট খেয়ে বাড়িতে ফিরে এলো।

এর পরদিনের ঘটনা। অজিত মাস্ক পরে বাইক নিয়ে দিব্যি বাজারে বেরিয়ে পড়ল। পঞ্চুর চকে চায়ের দোকানে বেশ ভিড়। যদিও এই সংক্রমনের সময়ে চা পানের দোকান খোলা সরকার কার্যত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু শোনে আর কয়জন?
এক যুবক চা পান খেয়ে  দোকান থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ।দোকানি তাকে বললেন যে এই সাতসকালে খুচরো নেই তাই বাকি দুশো  টাকা একটু পরে এসে যেন সে নিয়ে যায়। যুবকটি মাথা নেড়ে বাইক নিয়ে অন্যত্র চলে গেল। ঠিক এই সময়ে চায়ের দোকানের দিকে বাইক নিয়ে এলো অজিত। উক্ত যুবকের জামা প্যান্টের কালার হুবহু অজিতের মতোই ছিল। এবার অজিতের মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল। সে বাইক নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। দশ পনের মিনিট পর অজিত মাস্ক পরে আবার ওই চায়ের দোকানে ফিরে এলো। ফিরে এসে চা দোকানীকে বলল যে আমার পাওনা দুশো টাকা দিন। দোকানদার অজিতকে উক্ত যুবক ভেবে অজিতকে দুশো টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন।

এর কিছুক্ষণ পর উক্ত যুবকটি চায়ের দোকানে ফিরে এলো। ফিরে এসে দোকানীকে বললো, " আমার পাওনা দুশো টাকা দিন।"
দোকানী অবাক হয়ে বললো, "তুমি তো এখনই দুশো টাকা নিয়ে গেলে! মাস্ক পরে টাকা মারার ভালোই সুযোগ পেয়েছো।"
যুবকটি রেগে ফেটে পড়লো এবং বললো, " এখনই আমার টাকা দিন নইলে পুলিশ ডাকবো। আমার পাওনা আমি নিয়েই ছাড়বো। ভালো চান তো দিয়ে দিন।"
এইভাবে তর্কাতর্কি হতে হতে দোকানদারের সাথে যুবকটির তুমুল বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। অনেক লোক জড়ো হলো। খানিকক্ষণের মধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ হাজির হলো।
পুলিশের এসেই প্রথমে চায়ের দোকানিকে গালিগালাজ শুরু করলো। পুলিশ বলল যে আপনি কি জানেন না এই লকডাউনে চা পানের দোকান খোলা নিষিদ্ধ। দোকানদার কাঁচুমাচু হয়ে হাত জোড় করে পুলিশের কাছে ক্ষমা চাইলেন। এরপর পুলিশ এই ঝামেলার কারণ শুনে হেসে ফেলল। ঠিক এই সময় উপস্থিত একজন ছেলে পুলিশকে বলল, "যে দুশো টাকা যে নিয়ে গেছে তাকে দেখতে অনেকাংশে অনুপদার মতো।"

পুলিশ ঐ ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে অনুপের বাড়িতে চললো। অনুপের মা উলপীদেবী দরজা খুললেন। পুলিশ দেখতে পেল অনুপ একটা আলাদা রুমে কোয়ারেন্টাইনে আছে, সে করোনা আক্রান্ত। উলপীদেবী বললেন যে অনুপ দশ বারো দিন বাড়ি থেকেই বেরোয় নি।  ঠিক এইসময় বাথ‍রুম থেকে বেরিয়ে এলো অজিত। পুলিশ একবার অনুপ একবার অজিতের দিকে তাকিয়ে উলপীদেবীর দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালো। দুজনকে একেবারে একইরকম দেখতে। উলপীদেবী বললেন, "এ হলো অজিত,অনুপের যমজ ভাই। এবার পুলিশের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে চায়ের দোকানীকে বোকা বানিয়ে এই অজিতই দুশো টাকা নিয়ে পালিয়েছে।
পুলিশ এবার ডাইরেক্ট অজিতকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি তোমার দোষ এখানেই স্বীকার করবে নাকি থানায় নিয়ে গিয়ে বাধ্য করাবো।" পুলিশের চোখরাঙানিতে অজিত থতমত খেয়ে গেল এবং শেষমেশ নিজের দোষ স্বীকার করলো। উলপীদেবী বললেন, "ছেলেটার জন্য আর কত নীচে নামতে হবে আমাদের কে জানে!" অনুপ করজোড়ে বললো বললো,  "স্যার ভাইকে এবারের মতো মাপ করে দিন। আমিও একজন পুলিশ, আমি নতমস্তকে ওর দোষ স্বীকার করছি।"
অনুপের বিনম্র ব্যবহার দেখে পুলিশ মোহিত হয়ে অজিতকে মাপ করলো এবং বললো যে এবারের মতো ছাড়া পেয়ে গেলে নেক্সট টাইম এরকম বেয়াদবি করলে সোজা লক্ আপে পুরে দেবো। এ যাত্রায় অজিত দাদার দৌলতে নিষ্কৃতি পেলো।
তা সত্ত্বেও অনুপের প্রতি অজিতের বিন্দুমাত্র সৌজন্য দেখা গেল না। অজিতের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো ও কিছুই করেনি। যাইহোক পুলিশের নির্দেশে অজিত চা দোকানীকে দুশো টাকা ফেরত দিলো।

এর কিছুদিন পরের ঘটনা। অজিত তার কলেজের এক বান্ধবী তনুজাকে দেখতে পেল হলুদ সালোয়ার কামিজ পরে শহরের চৌরাস্তা থেকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। অজিত খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো যে তনুজা তার মামার বাড়িতে এসেছে। কলেজে পড়াকালীন অনুপ এবং তনুজা পরস্পরকে ভালবাসতো। কিন্তু অজিতও তনুজাকে ভালবাসতো। তনুজার পক্ষে অজিতের প্রপোজাল একসেপ্ট করা সম্ভব হয় নি। সেদিন থেকে অজিতের মনে তনুজার প্রতি যে প্রতিহিংসার আগুন জমে ছিল তা আজ যেন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। অজিত তনুজাকে শায়েস্তা করতে যেন শিকারীর মতো ওত্ পেতে বসে থাকলো। মানে প্রতিদিন নিয়ম করে ঐ চৌরাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করতে থাকলো যাতে সুযোগ পেলেই কার্যসিদ্ধ করতে পারে।

পরদিন সকাল দশটার ঘটনা। মাস্ক এবং হলুদ সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে চৌরাস্তার মোড়ের ওষুধের দোকানের দিকে হেঁটে হেঁটে আসছিল। এইসময় উল্টোদিকের চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছিল অজিত। অজিত ধীরে ধীরে ওষুধ দোকানের দিকে হাঁটতে লাগলো। তার পকেটে রয়েছে সালফিউরিক এসিডের একটা ছোট বোতল। দোকানের কাউন্টারে এসে মেয়েটি ওষুধ চাইলো। অজিত তখন পকেট থেকে এসিডের বোতলটা বের করে হাতে ধরেছে। দোকানী বললো, "তুমি মিতালী তো, গতকাল আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রেকোয়েস্ট পাঠিয়েছো?"
মেয়েটি বললো , "হ্যাঁ, আমি মিতালী। এই বলে সে মাস্ক খুলে ফেলে বললো যে সে তার পিসতুতো বোন তনুজার পোশাক পরে এসেছে।"
তা শুনে আতঙ্কিত কিংকর্তব্যবিমূঢ় অজিতের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং হাত থেকে এসিডের বোতল পড়ে যায়। ধোঁয়া উড়তে থাকে। ওষুধ দোকানী চিৎকার করে লোক জড়ো করে ফেলে। ততক্ষণে সাত -আট জন লোক এসে অজিতকে পাকড়াও করে। মারাত্মক এসিড ব্যবহার এবং এসিড হামলার প্রয়াসের জন্য পুলিশ এসে অজিতকে ধরে নিয়ে যায়। এবার সে আর ছাড়া পেলো না। আদালতে কেস না ওঠা পর্যন্ত অজিত আপাতত কারাবাসে দিন কাটাচ্ছে।

Tuesday, November 15, 2022

উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -27


 


দেবীবাবু ধীর কণ্ঠে বললেন, আমার সাথে আসুন। তিনি পাশের রুমে গিয়ে একটা বড় আয়নার কাছে গিয়ে নিজের চেহারাকে দেখিয়ে বললেন, ঐ লোকটাই আপনার দাদাকে খুন করেছেন।

 দেবীবাবু - । আপনি আমার দাদাকে খুন করেছেন? হ্যাঁ।

 আপনাকে ছাড়বো না দেবীবাবু। আজ হত্যাকারীর রক্ত দিয়ে ভ্রাতৃহত্যার তর্পণ করবো। ছুরিখানা উপরে তুলে দেবীবাবুর বক্ষে বিদ্ধ করতে যাবো এমন সময় দৈববাণীর মত ময়নার কণ্ঠস্বর আমায় ওপথ থেকে বিরত করলো। মনে হল ময়না যেন বলছে, মা, বাবাকে হত্যা করছ - মা, বাবাকে খুন করছ - মা তুমি ;

ওকথা শুনে ছুরি হাতে নিয়ে নিথর হয়ে স্টাচু হয়ে পড়লাম। পারলাম না। দেবীবাবুর বুকে ছুরিখানা বসিয়ে দিতে। আমার সমস্ত প্রতিহিংসা ক্রোধ এ মুহুর্তে অগ্নিতে জল ঢালায় শীতল হয়ে গেল। কে যেন জোর করে আমার হাত হতে ছুরিটা ছিনয়ে নিলো। পিছন হতে ময়নার ঐ কণ্ঠস্বর আবার যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ‘মা বাবাকে মেরো না

ওখানে না দাঁড়িয়ে টলতে টলতে বারান্দয় এসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলাম। দাদাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আমি পারলাম না দাদা, তোমার শত্রুকে শেষ করতে পারলাম না। আমার এই সাময়িক হৃদয় দৌর্বল্যের জন্য তোমার আত্মার নিকট আমি ক্ষমাপ্রার্থী দাদা। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

কোন সময় যে দেবীবাবু পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আমি জানি না। আমায় কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমায় ক্ষমা কর পদ্মা। অজ্ঞানে অনেক পাপ করেছি, সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও একটা গরীব পরিবারকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছি এবং নিজের জীবনেও চরম অধঃপতন নিয়ে এসেছি। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তোমার দাদা আমার শত্রু হয়েছিল। কিন্তু সেই সুমন্ত আমার তমসাচ্ছন্ন জীবনের ঘন কৃষ্ণ মেঘরাশি সরিয়ে দিয়ে আমার জীবনে নব প্রভাতের অরুণ উদয় ঘটিয়েছে। সেই সূর্যশান্তি আলো ঝলমল জীবনে আমি শান্তির বিহগগীতি শুনতে পেয়ে নিজের জীবনকে ধন্য বলে মনে করেছি। আমার অতীত জীবনের ব্যাভিচার, উদগ্র লালসা শুধু আমার জীবনকে ধ্বংস করেনি, আমার সহধর্মিনীকেও এই দুষ্কর্মের জন্য আমিই দায়ী পদ্মা। তাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমি সদা প্রস্তুত আছি। কেন তুমি আমায় শাস্তি দিচ্ছ না।

একটু পর নিজেকে শান্ত করে বললাম, শাক্তি আপনাকে দিতাম দেবীবাবু, কিন্তু এক নিষ্পাপ, সরল শিশুর মুখ স্মরণ কর ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। ঐ অবোধ শিশু আমাকে বার বার এই হত্যাকান্ডের হাত থেকে বিরত হবার ইঙ্গিত দিয়েছে।

পদ্মা, ময়নাকে অপার মাতৃস্নেহে তুমি মৃত্যুর কবল হতে বাঁচিয়েছো, সে তোমার মাতৃ হৃদয়ে তোমার অলক্ষ্যে কন্যার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে, সেই স্থান হতে তুমি তাকে কিছুতেই সরাতে পারবে না। তোমার দাদা আমার ক্রোধবহ্নির শিকার হয়েছে ফলে দেখা দিয়েছে পিতা ও পুত্রীর জীবনে ভাগ্য বিড়ম্বনা। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তোমার জীবনের দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম। এবার তোমার সম্মতি আমাদের মিলন পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করে তুলুক। - তোমার নিকট এই আশাই রাখছি।

দেবীবাবু -

হ্যাঁ, পদ্মা, আমি এক চক্রান্তের বশে নিজের পুরুষত্ব হারিয়ে তোমার দাদাকে খুন করেছি। বিশ্বাস করো এক মুহুর্তের জন্য ভাবিনি কত বড় সর্বনাশ আমি করেছি। আমি তোমার ভ্রাতৃঘাতক হলেও তুমি আমায় ক্ষমা করো। সেদিন কনক নার্সিংহোমে বলেছিলাম সময় হলে বলব আমার অতীত। যে অতীত নোংরা, আবর্জনায় পরিপূর্ণ কেন আমার স্ত্রী চন্দ্রাকে হারিয়েছি, কেন এই সসাগরা পৃথিবী হতে নিরপরাধ গরীব সন্তানকে চিরদিনের ঘুম পাড়িয়েছি। দেবীবাবু চোখের সামনে অতীত ইতিহাস অস্পষ্টভাবে ভেসে উঠল এবং তখনই তিনি তার স্মৃতি চারণ করতে শুরু করলেন। যে ইতিহাসের কাহিনী সেদিন পর্যন্ত তার অন্তরের অস্তঃস্থলে বিদ্ধ হয়েছিল। তা মোটামুটি হল এরকম।



মাঘের শেষাশেষি। শীত তেমন নেই, বসন্ত দেখা দিয়েছে ফাল্গুনের আগে। এলোমেলো ভাবে বাতাস বইছে। ওতে ভেসে আসছে যেন ফুলের গন্ধ। ধরণীর বুকে রক্তিম আভা ম্লান হতে চলেছে। একটু পরে শহরের কালো অন্ধকার নেমে আসবে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী বলে। একাকী ফুটপাতে দেবীদাস দাঁড়িয়ে আছে যানবাহনের অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ব্যাকুল হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে।

হঠাৎ একটা কালো রঙের ট্যাক্সি কাছে এসে এমনভাবে ব্রেক কষল যে দেহের গ্রন্থিগুলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন অবশ হয়ে গেলো। ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে পড়ল। কোন প্রকারে সামলে ড্রাইভারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল গম্ভীর মুখ তার। চোখ দুটো যেন লাল মার্বেল। স্টীলের ফ্রেমের চশমা চোখে আটকানো। ভূগুলো বেশ মোটা। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। জুলফি কানের পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা নেমে গেছে চোয়ালে।; গোঁফটাও মোটাসোটা। গাল ভর্তি দাড়ি তবে মসৃণ। মাথায় একটা কালো টুপি। দেহের দিকে তাকিয়ে দেখল, কালো রঙের ওভারকোর্টে ঢাকা।

ওভাবে তার চেহারার খুঁটিনাটি দিক লক্ষ্য করে চলেছে, ঠিক সেসময় ভদ্রলোক বললেন, কোথায় যাবেন, আসুন না আমার ট্যাক্সিতে?

কেমন হকচকিয়ে গেলো ওর কথা শুনে। বিশেষ করে এক অচেনা অজানা মানুষের সহানুভূতি আশ্চর্য্য করল দেবীদাসকে। কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সময় অনেক পেরিয়ে গেছে, তাছাড়া বাড়ীতে বিশেষ কাজ আছে অতএব সুযোগ যখন পাচ্ছে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা উচিত নয়।

ট্যাক্সিতে চড়ে বসতেই ষ্টার্ট দিলো ভদ্রলোক। ওর পাশে বসেছিলেন, ফুটখানেক মাত্র ছাড়াছাড়ি। দেবীদাস ও ড্রাইভার ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি ছিলো না। ট্যাক্সি দ্রুত গতিতে চলছে। পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকান্ড বাড়ীগুলো পলক না ফেলতে ফেলতে সোঁ সোঁ শব্দে পেরিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে হিন্দী গানের সুর ভাঁজছে। বেশ ভালোই লাগছিল। একটু পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,

কোথায় যাবেন?

শ্যামবাজার।

তারপর চুপচাপ হিন্দী গানের পুনরাবৃত্তি করতে একটু পর ভদ্রলোক পুনরায় বললেন, আপনি বিখ্যাত শিল্পপতি মিঃ হেমন্ত রায়ের ছেলে নন ?

 ও কথা শুনে হিন্দী গানের সুর ভুলে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ওকে তো কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।