ব্যাচেলার্স পার্টি - দেবাংশু সরকার || Bachelor party - Devanshu sarkar || ছোট গল্প ||Shorts story || Story || Bengali story || Bengali Short story

              ব্যাচেলার্স পার্টি

                      দেবাংশু সরকার



                            এক

      - "আমার নাম রিমি। আমি ফার্স্ট সেমিস্টারের ছাত্রী। তুমিও কি নিউ কামার?"


      - "হ্যাঁ। আমার নাম সুদীপা। আমারও আজ কলেজে প্রথম দিন। কলেজে এসে আমার কোনো পুরানো বন্ধুকে দেখতে পাচ্ছি না। যারা আমার সঙ্গে স্কুলে পড়তো, মনে হয় তাদের কেউ এই কলেজে ভর্তি হয় নি।"


      - "আমারও একই সমস্যা। চেনা শোনা কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালোই হলো। আর একা মনে হবে না। আমার বাংলা অনার্স। তোমার সাবজেক্ট কি?"


       - "আমারও বাংলা অনার্স।"


      - "বাঃ খুব ভালো। আমরা তাহলে একসঙ্গে ক্লাসে গিয়ে পাশাপাশি বসবো। তোমার মোবাইল নাম্বারটা দাওতো।"


      - "তোমার নাম্বারটা বলো, কল করছি।"


      - "ওফ, এই 'তুমি' 'তুমি' আর নিতে পারছি না! বিয়ের পর তোর হাজব্যান্ভকে যত খুশি 'ওগো', 'হ্যাঁগো', 'তুমিগো' বলিস। আমাকে ছাড়। দয়া করে তুমি ছেড়ে তুইতে নেমে আয়।" হেসে ওঠে দুজনেই। 


       রিমি, সুদীপা দুজনেই এবছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। দুজনেরই স্কুলের কোনো বন্ধু এই কলেজে ভর্তি না হওয়াতে প্রথম দিন কিছুক্ষণের জন্য একাকীত্ব বোধ করলেও, অচিরেই নিজেদের সঙ্গীকে খুঁজে নেয় তারা।


      সুদীপার তুলনায় রিমি কিছুটা ছটফটে, চঞ্চল। কিছুটা প্রগলভ। সারাক্ষণ সে কিচির মিচির করেই চলেছে। কোনো কথা সে চেপে রাখতে পারে না। অন্য দিকে সুদীপা বেশ চাপা স্বভাবের। মুখ দেখে বোঝা যায় না তার মনে কি আছে। বন্ধুদের সঙ্গে হেসে কথা বললেও, মনের দরজা পুরোপুরি খুলে দেয় না। দুজনের মধ্যে কিছুটা অমিল থাকলেও, খুব তাড়াতাড়ি তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিনত হয়। কলকাতার দুই প্রান্তে দুই বন্ধুর বাড়ি। বেহালা থেকে কলেজে আসতে সুদীপার মাঝে মাঝে দেরি হলেও, দমদম থেকে রিমি যথা সময়ে পৌঁছে যায়। কখনো কিছুটা আগে পৌছে কলেজের সামনের বাস স্ট্যান্ডে সে অপেক্ষা করে সুদীপার জন্য। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে রিমি লক্ষ্য করে সুদীপা বাস থেকে নেমে, বাসের দিকে হাত নাড়ে। কার উদ্দেশ্যে সুদীপা হাত নাড়ে? রিমি জানতে চাইলে সুদীপা এড়িয়ে যায়। আবার কখনো কলেজ ছুটির পর দুই বন্ধু যখন কলেজের গেট থেকে বের হয়, রিমির মনে হয় কেউ যেন অপেক্ষা করছিল, তাদের দেখতে পেয়েই গা ঢাকা দিল! রিমি বারে বারে সুদীপার কাছে জানতে চায়। সুদীপা হেসে উড়িয়ে দেয়, বলে রিমির চোখের ভুল। রিমি কথা বাড়ায় না। কিন্তু অবাক হয়ে ভাবে, বারে বারে তার এক ভুল হচ্ছে!


      এভাবে কেটে যায় কয়েক মাস, এসে যায় দুর্গা পুজো। পুজোর ছুটির জন্য কলেজ বন্ধ হয়। সুদীপারা পুজোর কয়েক দিনের জন্য মেদিনীপুরে তাদের গ্রামের বাড়িতে যায়। বনেদী বাড়ির দুর্গাপুজো। এই চারটে দিন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় স্বজনরা এসে জড়ো হয় পৈতৃক ভিটেতে। বছরের এই কয়েকটা দিন দেখা হওয়া আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে মহানন্দে পুজোয় মেতে ওঠে সুদীপা।


      রিমিও পুজোর কয়েকটা দিন কাটাবে কলকাতার বাইরে। সে তার বাবা মায়ের সঙ্গে পুরী যাচ্ছে পুজোর দিনগুলো ছুটি কাটাতে। যথা সময়ে রিমিরা পৌছে গেছে হাওড়া স্টেশনে। তেইশ নম্বর প্লাটফর্মে ট্রেন এসে গেছে। প্লাটফর্ম জুড়ে বেশ ভিড়। নিজেদের কামরা খুঁজে ট্রেনে উঠলো রিমিরা। রিমির মা রাতের খাবার বের করছেন ব্যাগ থেকে। রিমি লক্ষ্য করছে বিপরীত দিকের সিটে বসা এক মাঝবয়সী মহিলা হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।


     - "রমা চিনতে পারছিস?"


      ঘুরে তাকান রমা, অর্থাৎ রিমির মা। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে চিনতে। তার পরেই উচ্চসিত হয়ে ওঠেন।


      - "অপর্ণা! কতদিন পরে দেখা! স্কুলে পড়তে পড়তে তোর বাবা তোর বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ে করে সেই যে দিল্লি চলে গেলি, তারপর আর পাত্তা নেই!"


      - "হ্যাঁ, প্রায় সাতাশ বছর পর তোর সঙ্গে দেখা। আমার হাজব্যান্ড দিল্লিতে চাকরি করে। কিন্তু আমার ছেলে অনীক দুবছর হলো কলকাতায় চাকরি পেয়েছে। মামার বাড়িতে থাকে। আর আমি এখন শাটল কক্ হয়ে একবার দিল্লি একবার কলকাতা করছি। পুজোর ছুটিতে সোমনাথ, মানে আমার হাজব্যান্ড কলকাতায় এসেছে। অনীকের নতুন চাকরি। একদম ছুটি পায় না, অনেক দিন একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। তাই চার দিনের জন্য দুরে কোথাও না গিয়ে পুরী যাচ্ছি।"


      সোমনাথ, অনীকের সঙ্গে অপর্ণা পরিচয় করিয়ে দেন রমার পরিবারের সদস্য রিমি এবং রিমির বাবা অরূপের সঙ্গে।


      সামান্য লেট করে প্রায় এগারোটা নাগাদ ছাড়লো পুরী এক্সপ্রেস। রাতের খাবার ব্যাগে পড়ে আছে। রমা আর অপর্ণা জমিয়ে গল্প করছেন। সাতাশ বছরের জমে থাকা কথা যেন এক নিঃশ্বাসে বেরিয়ে আসতে চাইছে দুজনের মুখ থেকে। পাশে বসা সোমনাথও জমিয়ে নিয়েছেন অরূপের সঙ্গে, বাংলা দিল্লির দুর্গাপুজো থেকে রাজনীতি সব কিছুই উঠে আসছে তাদের আলোচনায়। অনীক আর রিমি অবশ্য চুপচাপ নিজেদের মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। অনীক মাঝে মাঝে আড় চোখে রিমিকে দেখছে। রিমিও সেটা টের পেয়েছে। ব্যাপারটা সে উপভোগ করছে।


      পুর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। দিনের আলো ফুটতে এখনও কিছুটা দেরি আছে। রাতে ঠিকঠাক ঘুম না হলেও, ভোরের দিকে অনেকেই ঘুমোচ্ছে। রিমির চোখে ঘুম নেই। সে নিজের জায়গা থেকে নেমে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনীকের চোখেও ঘুম নেই। তবে সে তার জায়গাতেই শুয়ে আছে।


      চাওয়ালাদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। একজন চাওয়ালা রিমিকে জিজ্ঞাসা করলো, "মেম সাহেব চা খাবেন?" উত্তর রিমি "না" বললো।


      নিজের জায়গা থেকে অনীক ফোড়ন কাটলো, "দাদা আপনি জানেন না, মেম সাহেবরা সকালে চা খায় না। হুইস্কি খায়। আপনি এই নেটিভ আদমিকে চা দিন। ঠিক আছে আপনি দু কাপ চা দিন। মেম সাহেব না হয় হুইস্কি মনে করে খেয়ে নেবে।"


      মৃদু হাসি খেলে যায় রিমির মুখে। সে বলে, "আমি মোটেই মেম সাহেব নই। হুইস্কিও খাই না। সবাই ঘুমোচ্ছে। একা চা খেতে ভালো লাগে না। তুমি খেলে আমিও খাবো।"


      রাতে হালকা বৃষ্টির পর চকচকে রোদ উঠেছে। থিকথিকে ভিড় পুরী স্টেশন জুড়ে। ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ট্যুরিস্টরা বেরিয়ে আসছে স্টেশন থেকে। চলছে অটো, ম্যাজিক গাড়ির ড্রাইভারদের সঙ্গে দরাদরি। স্বর্গদ্বারের কাছে দুটো হোটেল বুক করে রেখেছে দুটো পরিবার। দুটো হোটেলের মধ্যে দুরত্ব খুব বেশি নয়। দরাদরি করে একটা বড় ম্যাজিক গাড়িতে উঠলো দুই পরিবার।


      রাতে ট্রেনে ভালো ঘুম হয়নি তাই হোটেলে ঢুকেই অপর্ণা, সোমনাথ বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। অনীক টিভি চালিয়ে পছন্দের চ্যানেল খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে রমা, অরূপেরও চোখ জুড়িয়ে আসে। হোটেলের ঘরে বোর হতে থাকা রিমি ফোন করে অনীককে, "কি করছো?"


      - "বাবা মা ঘুমোচ্ছে। আমার এখন কিছু করার নেই, তাই টিভি চালিয়ে উড়িয়া ভাষা বোঝার চেষ্টা করছি।"


      - "আমারও একই অবস্থা। বাবা মা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুরতে এসে মানুষ যে কি করে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করে বুঝতে পারি না! আমি এখন বের হবো। সমুদ্র দেখবো। তুমি আসবে?"


      - "ঠিক আছে যাচ্ছি। তুমি চৈতন্য দেবের সামনে দাঁড়াও।"


      হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ে রিমি। চড়া রোদ উঠেছে। চৈতন্য দেবের মুর্তির সামনে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। সে একটু সরে এসে একটা কাপড়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যে অনীকও চলে আসে। কিন্তু রিমিকে দেখতে পায় না। এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে সে রিমিকে ফোন করে, "মেম সাহেব তুমি কোথায়? বেরিয়ে পড়েছো, নাকি এখনো হোটেলে সাজুগুজু করছো?" 


      - "পেছন দিকে তাকাও, আমাকে দেখতে পাবে।"


      ঘুরে তাকায় অনীক। রিমিকে দেখে হাত নাড়ে। এগিয়ে যায় রিমির দিকে।


      - "নেটিভ আদমি, তুমি কি ছাতা এনেছো? খুব চড়া রোদ উঠেছে। খালি মাথায় হাঁটা যাবে না"


      - "নাতো, ছাতা আনিনি। রোদে আমার কোনো অসুবিধে হবে না। কিন্তু তুমি এভাবে হাঁটতে পারবে না।"


      - "এখনো ট্রলি খোলা হয়নি। ছাতা ট্রলিতে আছে। তাই আনা হয়নি।"


      - "ডোন্ট ওরি মেম সাহেব। ঐ দেখো তোমার সমস্যার সমাধান।"


      রিমি দেখে একটা কম বয়সী ছেলে বেতের টুপি বিক্রি করছে। অনীক দুটো টুপি কিনে একটা নিজে পরে, অন্যটা রিমির মাথায় পরিয়ে দেয়।


      - "কাম অন নেটিভ আদমি। চলো আমরা বালির ওপর দিয়ে হাঁটি।"


      রাস্তা পেরিয়ে দুজনে নেমে পড়ে বেলাভুমিতে। হাজারো মানুষের ভিড় বেলাভুমি জুড়ে। বিরাট বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বেলাভুমিতে। মানুষ সমুদ্রের জলে ভিজছে। মানুষ হাসছে, মজা করছে। আনন্দের বাঁধ ভেঙেছে তাদের মনে। বলতে গেলে অশান্ত সমুদ্রের উন্মাদনাকে চেটে পুটে খাচ্ছে।


      - "অনীক, দেখো কত লোক সমুদ্রে স্নান করছে, মজা করছে। চলো না আমরাও স্নান করি।"


      - "এতো সকালে ভিজতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া তোয়ালে আনা হয়নি। আর একটু বেলা হলে স্নান করতে আসবো।"


      - "ঠিক আছে স্নান না করো, চলো অন্তত সমুদ্রের জলে পা ভেজাই"


      রিনি অনীক পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সমুদ্রের দিকে। হাতে হাত ধরে তারা দাঁড়িয়ে আছে। লোনা জল এসে পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। দুর থেকে সাদা মুকুট পরা ছোটো ছোটো ঢেউগুলো বিশালাকার ধারণ করে আছড়ে পড়ছে বালির ওপরে। জলের সঙ্গে সরে যাচ্ছে পায়ের তলার বালি। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে রিমি জাপটে ধরেছে অনীককে। অনীক শক্ত হাতে ধরে আছে রিমিকে। দুজনে দুজনের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ। হয়তো দুজনেই উপভোগ করছে এই ঘনিষ্ঠতা।


      - "অনীক আমার পায়ের তলার বালি সরে যাচ্ছে। আমি পড়ে যাবো।"


      - "কেন পড়ে যাবে? আমিতো তোমাকে ধরে আছি। ভরসা নেই আমার ওপর?"


      - "আমাকে এভাবে চিরকাল ধরে রাখবেতো অনীক? বলো ছেড়ে দেবে নাতো?"


      - "আমিতো ধরে রাখতে চাই। তুমি আমার হাত ছেড়ে চলে যাবে নাতো মেম সাহেব?"


      - "একবার যখন ধরেছি, আর ছাড়বো না এ হাত।"


      ওরা সমুদ্র দেখছে। অপলক দৃষ্টিতে সমুদ্র দেখছে। বিভোর হয়ে সমুদ্র দেখছে। দেখতে দেখতে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। হয়তো মনের ভেলায় চড়ে ভেসে চলেছে অকুল সাগরে।


      কতক্ষণ এভাবে কেটে গেছে কারো খেয়াল নেই। এক সময়ে অনীক বলে ওঠে, "এবার হোটেলে ফিরতে হবে মেম সাহেব। এতক্ষণে বাবা মায়ের হয়তো ঘুম ভেঙে গেছে।"


      হাত ধরাধরি করে বেলাভুমি ছেড়ে রাস্তা পার হয়ে দুজনে এসে দাঁড়িয়েছে চৈতন্য দেবের মুর্তির সামনে। এখান থেকে দুজনের রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। এবারে হাত ছাড়ার পালা। অনীকের হাত ছেড়ে আবার আঁকড়ে ধরে রিমি। অবাক হয়ে অনীক প্রশ্ন করে, "কি হলো মেম সাহেব, আবার ধরলে কেন?"


      - "ছাড়তে ইচ্ছা করছে নাতো।"


      - "ঠিক আছে এখনতো ছাড়ো। ঘন্টা খানেক পরে আবার ম্যানেজ করে চলে আসবো।"


      শ্রী মন্দিরে পুজো দেওয়া, সকালে বিকালে সমুদ্র তীরে রুটিন ভিজিট, টুকটাক কেনাকাটা, চোখের পলকে কেটে যায় দিনগুলো। এবার ফেরার পালা। আজ রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরবে রিমিরা। আগামীকাল অনীকরা। দুপুরে খাওয়ার পর রিমি ভাবে আরতো মাত্র কয়েক ঘন্টা তারা পুরীতে আছে, তাই বিছানায় শুয়ে না থেকে আর একবার সমুদ্র দেখে আসবে। হোটেল থেকে একা বেরিয়ে পড়ে রিমি। একবার ভাবে অনীককে ডাকবে। আবার ভাবে এইতো ঘন্টা দুয়েক ধরে দুজনে সমুদ্রের হাওয়া খেলো। হয়তো খাওয়া সেরে অনীক এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। তাই অনীককে না ডেকে সে একাই চলে যায় সমুদ্রের ধারে।


      সমুদ্রের এক অন্য রূপ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় রিমির। আগে সে কালচে ঘোলাটে বা হালকা নীল রঙের সমুদ্র দেখেছে। আজকে সমুদ্রের রঙ ঘন নীল। কখনো সেই রঙ বদলে ঘন সবুজে পরিনত হচ্ছে। সত্যিই কি সমুদ্রের রঙ পরিবর্তিত হচ্ছে? নাকি চোখ ভুল? আর অপেক্ষা করে না রিমি। তড়িঘড়ি ফোন করে অনীককে ডেকে নেয়।


      - "দেখো অনীক দেখো, চোখ ভরে দেখো সমুদ্রের এই অপরূপ সৌন্দর্যকে।"


      - "দেখছি রিমি দেখছি। সমুদ্রের এই রূপ, এই রঙ শুধু দেখছি না সাজিয়ে রাখছি মনের মনিকোঠায় চিরকালের স্মৃতি হিসেবে। কি অপূর্ব উপহার তুমি আমাকে দিলে! সমুদ্রের ঘন নীল, ঘন সবুজ রঙ দিয়ে তুমি আমাকে, আমার মনকে,আমার চিত্তকে চির রঙিন করে দিলে। বিনিময়ে তোমাকে আমি কি দেবো রিমি? সমুদ্রের এই শোভার অনুরূপ কিছুই যে নেই আমার কাছে! আমি যে নিঃস্ব।" কথা বলতে বলতে অনীক হাঁটু গেড়ে বালিতে বসে পড়ে বলতে থাকে, " না রিমি আছে। অন্তত একটা শব্দ আছে আমার কাছে। সেটা এই সমুদ্রের থেকে বড়, এই সমুদ্রের থেকে গভীর, এই সমুদ্রের থেকে মহোময়। কথা থামিয়ে সে বালিতে আঙুল দিয়ে লেখে - 'ভালোবাসি'।


      একটা ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যায় সেই লেখা। আঁতকে ওঠে রিমি। সে বলে, "আমাদের ভালোবাসা এভাবে ধুয়ে মুছে যাবেনাতো অনীক?"


      - "বালিতে লেখা ধুয়ে মুছে যেতে পারে। কিন্তু আমিতো কেবল বালিতে লিখিনি। লিখেছি তোমার আমার মনের মাঝে। কোনো ঢেউয়ের ক্ষমতা নেই সেই লেখাকে মুছে দেবে।"



                              দুই 



      একরাশ সুখস্মৃতি নিয়ে কলকাতায় ফিরে রিমি ফোন করে সুদীপাকে, "কোথায় আছিস?"


      - "মেদিনীপুরের বাড়িতে। লক্ষ্মী পুজোর পরে ফিরবো।"


      - "তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। ফোনে বলা যাবে না।"


      - "ঠিক আছে। বাড়ি ফিরি। পড়তে গিয়ে কথা হবে।"


      - " প্রথম দিন তাড়াতাড়ি আসবি। অনেক কথা আছে। ইন্টারেস্টিং কথা।"


      পুজোর পর প্রাইভেট টিউশনের প্রথম দিন নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই স্যারের বাড়ি পৌছে যায় রিমি। কিছুক্ষণের মধ্যে সুদীপাও চলে আসে।


      - "বল, তোদের পুরী ট্যুর কেমন হলো? আর কি যেন বলছিলি ইন্টারেস্টিং কথা। বল কি বলবি?"


      - "পুরীতে গিয়ে একটা কান্ড করেছি।"


      - "কি কান্ড?"


      - "পুরীতে গিয়ে একটা মাল তুলেছি। দিশি মাল নয়। একেবারে দিল্লিকা লাড্ডু।"


      - "এই আগে মুখের ভাষা ঠিক কর, তারপর আমার সঙ্গে কথা বলবি।"


      - "আরে পুরো কথা শোন। পুরীর ট্রেনে মায়ের এক পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা। আগে দিল্লিতে থাকতো, এখন কলকাতায় থাকে। তার ছেলে অনীককে লটকেছি। দিশি মাল হলে চিন্তা ছিল না। দিল্লির মাল, তাই বুঝতে পারছি না সত্যিই দিবানা নাকি খেলোয়াড়। এব্যাপারে তোকে একটু হেল্প করতে হবে। মানে অনীককে বাজিয়ে দেখতে হবে।"


      - "না না, ওসব বাজাতে টাজাতে পারবো না।"


      - "না, বললেতো শুনবো না। একমাত্র তুই পারবি অনীককে বাজাতে। তুই আমার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী। কি সুন্দর ফর্সা রঙ, টানাটানা চোখ, গোলাপি ঠোঁট! আমারই মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তোকে নিয়ে শুয়ে পড়ি। তাহলে তোকে দেখলে ছেলেদের কি অবস্থা হয় ভাবতো?"


      - "এই ফোটতো এখান থেকে। কত শখ, আমাকে নিয়ে শোবে! কি করবি আমাকে নিয়ে শুয়ে? পারবি আমাকে প্রেগনেন্ট করতে? তোর কাছে আছে সেইসব যন্ত্রপাতি?"


      - "প্রেগনেন্ট করতে না পারি, তোর ফর্সা গালে, গোলাপি ঠোঁটে কয়েকটা চুমুতো খেতে পারি।"


      - "আর চুমু খেতে হবে না। বল তোর জন্য কি করতে হবে?"


      - "যা বললাম, অনীককে বাজিয়ে দেখতে হবে।"


      - "বাজিয়ে দেখতে হবে! কেন অনীক কি তবলা?"


      - "তবলা নয়, অনীক হচ্ছে শ্রীখোল। দেখলেই বুঝতে পারবি ওর মধ্যে একটা কেষ্টো কেষ্টো ভাব আছে। তবে ওকি রাধিকা রমন কেষ্টো নাকি গোপিনী পরিবেষ্ঠিত কেষ্টো সেটা বুঝতে পারছি না!"  


      - "যদি গোপিনী পরিবেষ্টিত কেষ্টো হয়। মানে খেলোয়াড় হয় তখন কি করবি?"


      - "এখনো অতকিছু ভাবিনি। যা হবে দেখা যাবে।"


      কথামত কাজ শুরু করে দেয় সুদীপা। রিমি একদিন অনীকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় সুদীপার। অনীককে দেখে আপাত শান্ত, মৃদুভাষী সুদীপার মুখে যেন খই ফোটে। অনর্গল কথা বলে যেতে থাকে সে অনীকের সঙ্গে। কথাবার্তায় চৌখস অনীকও তাল মেলায়। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময়ে সুদীপার ফোন আসে অনীকের কাছে। দেখা করার বা কোনো রেস্টুরেন্টে সময় কাটানোর আব্দার। এড়াতে পারে না। অনীক এড়াতে পারে না সুন্দরী সুদীপার আকর্ষণ। কাজের দিনগুলো সন্ধ্যার পর সামান্য সময়ের জন্য দেখা হলেও রবিবার প্রায় সারাদিন সুদীপাকে নিয়ে অনীক উড়ে বেড়ায়। সুদীপাকে সময় দিতে গিয়ে অনেক সময় অনীক রিমির ডাকে সাড়া দিতে পারে না। হয়তো অনিচ্ছাতেই সে অবহেলা করে রিমিকে। রিমি অনুযোগ করলে অনীক বলে, "তোমার বন্ধুর ডাকে সাড়া না দিলে তুমি যদি রাগ করো সেই ভয়ে সুদীপার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি না। তাছাড়া সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। সেই মুখ যদি নারীর হয়..."।


      ক্রমশ যেন সুদীপার সঙ্গে অনীকের ঘনিষ্ঠতা বাড়াবাড়িতে পরিনত হতে থাকে। রিমির কপালে ভাঁজ পড়ে। ব্যাপারটা কোন দিকে যাচ্ছে সে বুঝতে পারে না। একদিন সুদীপার কাছে সে প্রকৃত ব্যাপারটা জানতে চায়। উত্তরে সুদীপা বলে, "অনীক এতটাই কিউট, এতটাই রোমান্টিক যে ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি না। কিছুতেই অনীককে এড়িয়ে যেতে পারি না। কি করবো বল? আমিওতো মানুষ। আমার মধ্যেওতো কামনা বাসনা আছে। তাছাড়া তুইতো আমাকে ওর সঙ্গে মিশতে দিয়েছিলি। এখন ব্যাপারটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অনীককে না দেখে আমি এক মুহূর্ত থাকতে পারিনা। আমাকে ক্ষমা কর রিমি।"


      অনীক বলছে সুদীপা ডাকে, সুদীপা বলছে অনীক ডাকে! তাহলে কে কাকে ডাকে বুঝতে পারে না রিমি। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে দুজনের কাছেই সে ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। তবে কি সে অনীককে চিনতে পারেনি! এত হাসি, এত কথা, মন দেওয়া নেওয়া সবই কি অনীকের কাছে কেবল সময় কাটানোর একটা খেলা ছিল? খেলার ছলে মানুষ মানুষকে এতবড় আঘাত দিতে পারে? আর সুদীপা? রিমি ভাবতে থাকে বন্ধুবেশী এতবড় বেইমান বোধহয় এর আগে কেউ আসেনি এই পৃথিবীতে। সুদীপার মুখ দেখতেও আর ইচ্ছা করে না রিমির। কিন্তু কলেজে দেখা হয়ে যায়। রিমির দিকে তাকিয়ে নির্লজ্জের মত হাসে সুদীপা। অসহ্য লাগে রিমির। কলেজও প্রায় শেষের দিকে। আর কয়েক মাস পরে সিক্সথ সেমিস্টারের পরীক্ষা। তাই কলেজে না এসে পারে না রিমি। ভাবে এই কটা মাস যেন কিছুতেই কাটছে না! প্রেমিক এবং সহপাঠী তথা বন্ধুকে হারিয়ে ক্রমশ যেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে রিমি। নিঃসঙ্গ রিমির জীবনকে গ্রাস করে শূণ্যতা। হারিয়ে ফেলা অনেক কিছুর স্মৃতিকে সঙ্গী করে দিন কাটতে থাকে রিমির। সে কলেজে যায়, পড়তে যায়। পড়াশোনায় ডুবে যেতে চায়। পড়াশোনার মাধ্যমে সে অনেক কিছুকে ভোলার চেষ্টা করে। এভাবেই একটা একটা করে দিন কাটতে থাকে।


      আর মাত্র কয়েকটা দিন কলেজে আসতে হবে। তারপর পরীক্ষা। পরীক্ষার পর আর সহপাঠীদের মুখ দেখতে হবে না। তারপর রিমি অন্যভাবে নিজেকে গুছিয়ে নেবে। আস্তে আস্তে সে ভুলে যাবে অনীককে। অনীককে ভুলে যাবে! সত্যিই কি রিমি পারবে অনীককে ভুলে যেতে? সেটা কি সম্ভব? কি করে সে ভুলে যাবে বেলাভুমিতে কাটানো সেই মুহুর্তগুলো? সব সময়ে সে শুনতে পায় সমুদ্রের গর্জন। মানস চক্ষে দেখতে পায় উত্তাল জলরাশি। হাত ধরাধরি করে অনীকের সঙ্গে বেলাভুমিতে হেঁটে বেড়ানো। পায়ের তলা থেকে বালি সরে যাওয়াতে পড়ে যেতে যেতে অনীককে ধরে ফেলা। পড়ে যেতে যেতে অনীকের দৃঢ় বাহু বন্ধনে নিশ্চিত আশ্রয় খুঁজে পাওয়া। সব স্মৃতি যেন রিমিকে ঘিরে রাখে। কিন্তু অনীকের বন্ধন যে এত পলকা, এত ভঙ্গুর সেটা ভাবতেও পারে না রিমি। কেন অনীক তার জীবনে এলো? আর কেনই বা হারিয়ে গেল? ভাবতে থাকে রিমি। ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে যায়!


      - "দিদি ভাড়াটা দিন।"


      কন্ডাক্টরের ডাকে সম্বিত ফিরে আসে রিমির। একটা একশো টাকার নোট কন্ডাক্টরকে দিয়ে বলে, "একটা দশ।"


      - "খুচরো দিন দিদি। সবাই একশোর নোট দিলে অত খুচরো কোথায় পাবো?"


      - "রোজই দশ টাকার নোট দিই। আজ নেই কি করবো?"


      - "আমিই বা কি করবো? কোথা থেকে এত খুচরো আনবো?"


      ক্রমশ বচসা বাড়তে থাকে। রিমির হয়ে অনেকেই গলা ফাটাতে থাকে। বাস দাঁড়িয়ে যায়। এমন সময়ে এগিয়ে আসে সরোজ। সেও একজন ঐ বাসের সহযাত্রী। সে কন্ডাক্টরের দিকে একটা দশ টাকার নোট এগিয়ে দেয়। রিমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সরোজ টিকিটটা কাটে।


      একটু অপ্রস্তুত হয়ে রিমি বলে, "আপনি আমার হয়ে টিকিট কাটলেন!"


      - "এতে অসুবিধার কি আছে?"


      - "না, আমি ভাবছি...।"


      - "অত ভাবার কিছু নেই। আমি এই পথেই যাতায়াত করি। যখন আপনার কাছে খুচরো থাকবে ফেরত দিয়ে দেবেন।"


      - "কিন্তু আপনাকে পাবো কোথায়? ঠিক আছে আপনার মোবাইল নাম্বারটা দিন।"


      মোবাইল নম্বর দিয়ে সরোজ বলে, "মাত্র পঁচিশ টাকা দিয়ে মেট্রোর টিকিট কেটে আমার অফিসে এসে আমার দশ টাকা ফেরত দিয়ে আবার মাত্র পঁচিশ টাকা দিয়ে মেট্রোর টিকিট কেটে ফিরে যাবেন।" হেসে ওঠে রিমি।


      রিমি মাঝে মাঝে ফোন করে সরোজকে। বাসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বারে বারে ধন্যবাদ জানায়। কখনো কখনো দেখা করে দুজনে। ছুটির দিনে বিভিন্ন কাফে, রেস্টুরেন্টে সরোজের সঙ্গে রিমিকে দেখা যায়।


      পৃথিবীতে কোনো শূণ্যস্থান চিরকাল শূণ্য থাকে না। কালের নিয়মে সব শূণ্যই একদিন পুর্ণ হয়ে যায়। রিমির জীবনকে গ্রাস করা শূণ্যকে ধিরে ধিরে পুরণ করে দিতে থাকে সরোজ। সরোজের সারল্য, সরোজের অনাবিল হাসি যেন চুম্বকের মত আকর্ষণ করে রিমিকে। কেবল ছুটির দিনে নয়, প্রত্যেক দিন সন্ধ্যার পর দুজনকে এক সাথে দেখা যেতে থাকে। আর ছুটির দিনগুলোতে দুজনে যেন মুক্ত বিহঙ্গ। কোনোদিন গঙ্গার ধারের বিভিন্ন পার্কে, কোনোদিন কিছুটা দুরে বালিগঞ্জের লেকে বসে দুজনকে বাদামের খোসা ছাড়াতে দেখা যায়। দুজনেই মন খুলে কথা বলে দুজনের কাছে। হয় ভাব বিনিময়।


      - "রিমি আমাকে তুমি ঠিক কোন চোখে দেখো? মানে তোমার মনের ঠিক কোন জায়গাতে আমি আছি?"


      - "এই মুহূর্তে তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোমার ওপর আমি অনেকখানি ডিপেন্ডেন্ট। তোমার সঙ্গ, তোমার সান্নিধ্য আমার বেঁচে থাকার রসদ।"


      - "শুধু এইটুকু! এর বেশি কি কিছু ভাবা যায় না?"


      - "না সরোজ, এর বেশি আমি ভাবতে পারি না। আমার পায়ে যে অদৃশ্য বেড়ি পরানো আছে। আমি যে অনীককে ভালোবেসেছিলাম। আমি যে অনীককে ভালোবাসি। অনীক যদিও আমাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। আমাকে খেলার পুতুল ভেবেছিলো। কিন্তু আমি যে অনীককে সত্যিই ভালোবাসি। অন্তর দিয়ে ভালোবাসি। হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি। আর সত্যিকারের ভালোবাসাতো জীবনে একবারই আসে সরোজ। তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু। তোমার স্থান আমার মনের মনিকোঠায়। সেই জায়গাটা শুধুমাত্র তোমার জন্য। সেখানে তুমি একচ্ছত্র সম্রাট।"


      - "ঠিক আছে রিমি, তুমি আর আমি পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসাবে আছি, থাকবো।"


      কাটতে থাকে দিন, কেটে যায় মাস। সরোজকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে যেন জীবনে পরিপূর্ণতা আসে রিমির। এমনই একদিন সরোজ রিমিকে বলে, " মা খুব চাপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য। পাত্রী ঠিক হয়েছে। আমার বন্ধুরা ধরেছে ব্যাচেলার্স পার্টি দিতে হবে। তুমি সেই পার্টিতে থাকবেতো?"


      - "আবার আমাকে কেন? আমাকে বাদ দাও?"


      - "তোমাকে বাদ দিলে পার্টিটাই বাদ দেবো।"


      - "না না পার্টি বাদ দেবে কেন? আমাকে বাদ দিতে বলছি তার কারণ পার্টি মানে রাতের ব্যাপার। বেশি রাত অবধি আমি বাড়ির বাইরে থাকি না।"


      - "ঠিক আছে রাতে নয় তোমার অনারে আমি দিনের বেলাতে পার্টি দেবো। তাহলে আপত্তি নেইতো?"


      রাজি হয় রিমি। নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট জায়গাতে রিমি পৌছে যায়। রিমিকে আসতে দেখে কে যেন ঘরের ভেতর থেকে বলে ওঠে, "এসো, লায়লা এসো। তোমার মজনু যে তোমার জন্য সকাল থেকে হাপিত্যেস করে বসে আছে।"


      ভেতরে ঢুকে সুদীপাকে দেখে রিমি সরোজকে প্রশ্ন করে, "এই মেয়েটা এখানে কি করছে?"


      তোতলাতে তোতলাতে সরোজ বলে, "এখানে... মানে... সুদীপা... মানে... ওর সঙ্গেইতো আমার বিয়ে হবে।"


      - "টানা চার বছর লাইন মারার পর।" ফোড়ন কাটে সুদীপা।


      - "মানে? কি বলছিস? কটাকে লটকে রেখেছিস?"একরাশ বিরক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করে রিমি।


      - "রিমি বেশি বড় বড় কথা বলিস না। তুই পারমিশন দিয়েছিলি তাই তোর মালের সঙ্গে লাইন মেরেছি। কিন্তু তুই কার পারমিশনে আমার মালকে নিয়ে টানাটানি করছিস? ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস। আবার বড় বড় কথা! ঠিক আছে এখন ওসব কথা ছাড়। পরিস্কার করে বল আমার মালের সব যন্ত্রপাতি ঠিক আছে? নাকি এই কমাসে সরোজের কলকব্জা ঢিলে করে দিয়েছিস?" 


      - "সুদীপা ভুল বলেনি। রিমির সঙ্গে ভাব জমাতে আমাকে কম মেহনত করতে হয়নি! দিনের পর দিন বাসে উঠেছি আর নেমেছি। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। তারপর একদিন বাস কন্ডাক্টর সুযোগ করে দিল রিমির সঙ্গে ভাব জমানোর। দৌড়দৌড়ি করতে করতে সত্যিই আমার সব কলকব্জা ঢিলে হয়ে গেছে।" বলে ওঠে সরোজ।


      সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে রিমির। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।


      - "আসতে পারি।" দরজা থেকে উঁকি মারে অনীক। অনীককে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয় রিমি।


      ঘরে ঢুকে অনীক বলতে শুরু করে, "একজন আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ভালোই হয়েছে। মুখটা আমার দিক থেকে অন্য দিকে ঘুরে গেল মানে কানটা আমার দিকে এলো। সেই কান এখন আমার কথা স্পষ্ট শুনতে পাবে। আমি স্রেফ দুটো কথা বলবো। কলেজের প্রথম দিনগুলোতে রিমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করতো সুদীপা বাস থেকে নেমে কাকে যেন হাত নাড়তো। কলেজের ছুটির পর কে যেন ওদের দেখে লুকিয়ে পড়তো! সে আর কেউ নয়, সে হচ্ছে সুদীপার দিবানা এই সরোজ কুমার। তারপর রিমি যখন একজনকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করলো আমার অ্যাসিড টেস্ট করবে বলে। সেই গুপ্তচর প্রথম দিনই হাসতে হাসতে আমাকে সব বলে দিলো। তারপর আমি আর সুদীপা মিলে পাল্টা ছক বাজি শুরু করলাম। ব্যস কয়েক দিনের মধ্যেই রিমি মেম সাহেব ক্লিন বোল্ড। কথা বলতে বলতে অনীক গান গেয়ে ওঠেন,


      "কফোঁটা চোখের জল

       ফেলেছো যে তুমি

       ভালোবাসবে ..."।    


      - "এই যাতো এখান থেকে। আমার বয়ে গেছে তোর জন্য চোখের জল ফেলতে।" অনীকের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় রিমি।


      - "বলছো, চোখের জল ফেলোনি? কিন্তু চোখের কোলেতো কালি পড়ে গেছে! কি আর করবে মেম সাহেব, দিল্লির লাড্ডু খেয়েছো, একটুতো পস্তাতে হবে!"


      - "কেন? কেন পস্তাবো?"


      - "কেন পস্তাবে? সত্যিইতো, কেন পস্তাবে?"


      - "কারণ ভালোবাসে।" আবার ফোড়ন কাটে সুদীপা।"

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024