ওকে ভর্তি করার পর জ্ঞান ফিরেছিল ঘন্টা খানেকের মধ্যে। রমার জ্ঞান ফেরার পর সে বাড়ী ফিরেছিলো একমাত্র তার অসুস্থ পিতার জন্য। এখন রমা কেমন আছে
তার চিন্তাতেও তার মনটা চঞ্চল। নার্সিংহোমের চার্জ বেশী। ওরাতো টাকা ছাড়া কথা বলে না। ওদের কাছে ধনী ও গরীবের বিচার্য্য নয়। জয়ন্তর ভাগ্যে দুঃখ ছাড়া আনন্দ নেই। ওরা টাকা ব্যাতীত কোন কথা শুনবে না। কত টাকা যে বিল হবে ঈশ্বর জানেন।
হঠাৎ কুশল বাবুর কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে এলো। তিনি বললেন, এখনো কত দূর
বাবা ?
জয়ন্ত নম্র কণ্ঠে বলল, বেশীদূর নয়।
হ্যাঁরে জয়ন্ত, মেয়েটি চন্দ্রার মতোই দেখতে?
জয়ন্ত পুনরায় বলল, যমজ বোন ছাড়া কেউ ধরতে পারবে না । মেয়েটির খুব চোট লেগেছে নাকি?
লেগেছে তবে
কি হলো চুপ করলি কেন ?
বিপদ জনক নয়।
তোর কাছে ওর চেহারার বিবরণ যেদিন শুনেছিলাম, আমার মনটা বড় ছটপট করছিলো। তাই গত রাত্রের বিপদের কথা শুনে মনকে স্থির রাখতে পারলাম না।
জয়ন্ত বললল, বাবা নার্সিংহোম এসে গেছি। নামতে হবে। গাড়ী হতে নেমে ওরা দোতলার ৫ নং রুমে উপস্থিত হয়ে কুশল বাবুর নজরে পড়ল ৩নং সিটের উপর রমা বসে আছে। তার নয়নাশ্রু দেখে কুশলবাবুর অন্তর কেঁপে উঠল। সেই চোখ, সেই মুখ সেই দেহের গড়ন। কে বলবে আমার মেয়ে চন্দ্রা নয়। জয়ন্তকে লক্ষ্য করতে গোপনে অশ্রু মুছে বলল, রমা -
জয়ন্তদা এবার আমি বিদায় নেব। আমার ইচ্ছে ছিল অতি ভোরে এখান হতে পালিয়ে যাবো। কিন্তু আপনি অনেক দেরী করলেন।
জয়ন্ত বলল, কোন উপায় ছিল না। পথিমাঝে একটা বাচ্চা মেয়ে প্রচন্ডভাবে এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাই ওকে কনক নার্সিংহোমে ভর্তি করে তারপর তোমার কাছে এলাম। মনে হচ্ছে বিকাশের বিয়ের দিনে মেয়েটিকে এক ঝলক দেখেছিলাম। মেয়েটির সাথে কোন গার্জেন ছিল না।
ওকথা শুনে রমার বুকটা কেঁপে উঠল। ও ময়না নয়তো। ময়নার প্রতিচ্ছবি তার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল। যদি তার খোঁজে ময়না রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল এও হতে পারে। রমা আর থাকতে পারলো না। মুখে কাপড় চাপা দিতে কাঁদতে শুরু করলো। জয়ন্ত ও কুশলবাবু বললেন, কাঁদছো কেন রমা।
কান্না অবস্থায় বলল, ও আর কেউ নয় জয়ন্ত দা, ও ময়না আমার মেয়ে।
জয়ন্ত বলল, মানে দেবীর মেয়ে।
হ্যাঁ জয়ন্তদা।
জয়ন্ত বলল, বাবা রমাকে নিচে নিয়ে যাও আমি নার্সিংহোমে নীচে তলার অফিসে চললাম। মোটেই বিলম্ব করা চলবে না।
কনক নার্সিংহোমে পৌঁছতে বেশী সময় লাগলো না। জয়ন্ত, কুশলবাবু ও রমা অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে দুই নাম্বার রুমে প্রবেশ করতেই সুশীলবাবুকে দেখে তার চক্ষু স্থির। রমার অনুমান ভুল নয়। এবার বুঝতে পারল ময়নার এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
তার নজরে পড়ল ময়নার মাথায় ব্যান্ডেজ, মাঝে মাঝে মা মা বলে ডাকছে। রমার আর ধৈর্য্য ধরলো না। দৌড়ে গিয়ে ময়নাকে বুকে চেপে ধরল। আমি এসে গেছি মা। চোখ খোল মা, চোখ খোল। ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বড় ভুল করেছিলাম ময়না। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলো না মা।
রমা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকল। ময়নাও কাঁদতে থাকল।
একজন নার্স বলল, কাঁদবেন না, পেসেন্ট ভালো আছে। বিপদ কেটে গেছে। বিপদ থাকলে আপনাকে জড়িয়ে ধরতো না। বিশেষ আঘাত লাগেনি ভয়ে সেন্সলেস্ হয়েছিল। আজই আপনার সাথে ও বাড়ীতে যাবে। আপনার ভালোবাসা পেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। ওকে আদর করুন।
রমার আদরে ময়না মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লো। মায়ের আঁচলের ঢাকাতে ময়না যেন গাঢ় নিদ্রায় ডুবে গেল। কখন যে হেমন্তবাবু, সুশীলবাবু ও দেবীদাস ময়নার পাশে এসে দাঁড়িয়ে চোখের জলে ভাসছেন তা লক্ষ্য করেনি রমা।
হেমন্তবাবুর প্রতি নজর পড়তেই ময়নাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হেমন্তবাবুর কাছে গিয়ে নত জানু হয়ে পা দুটোকে স্পর্শ করে অশ্রুনেত্রে বলল, বাবা আপনি আজকের মতো ময়নার কাছে থাকতে দিন। আমি ময়নাকে সুস্থ করে চলে যাবো। আমি অস্পৃশ্য, অপবিত্র বাবা, শুধু কয়েক ঘন্টা ময়নার কাছে থাকতে দিন বাবা।
হেমন্তবাবু কান্না ভেজা কণ্ঠে বললেন, কে বললো তুই অপবিত্র, অশুচি, বারবনিতা! তুই বা পতিতারা কোন দিনই অশুচিনয় মা। আমরা সবাই জানি মা, পতিতালয়ের মাটি না থাকলে জগৎ জননী, আনন্দময়ী মার কখনো পূজো হয় না। ওর কখনো ঘৃণার পাত্রী নয়। তারা কখনো অপবিত্র নয়।
কোন মা জননীর যদি দুই বার বিয়ে হয় তাহলে সেও তো অপবিত্র! তাহলে সমাজ তাদের ঠাই দেয় কেন? তোর সজল নেত্র, তোর জ্যোতিরময় মুখখানি, সাক্ষাৎ আমি যেন আমার জগৎ জননীকে দেখছি। তবে আমার একটা কথা শোন্ মা,আমি তোর প্রতি গভীর অন্যায় করেছি মা।
ওকথা বলবেন না বাবা। তুমি আমায় ক্ষমা করো। কেন তোকে ক্ষমা করবো, তুই কোন অন্যায় করিস নি মা। বাবা।
হ্যাঁ রে মা, আমায় বলতে দে, আমি আমার ঐশ্বর্য্য, ধন-সম্পত্তি, আভিজাত্যকে বড়াই করে আমি মহীয়ান হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যে পরিবারের লোকের জন্য আমি আমার জীনবনকে ফিরে পেয়ে ছিলাম তার কথা ভুলতে পারিনি মা। এ আমার লজ্জার কথা ঐ মহান মানুষটিকে এই কলকাতা নগরে এক মুঠো অন্নের জন্য পথে পথে ঘুরতে হবে, আমি ভাবতে পারিনি।
ঐ মহানুভব মানুষ এর ছেলে সুমন্ত এই কলকাতা শহরে ডাক্তারী পড়তে এসে, দেবীদাসের হাতে তাকে মৃত্যু বরণ করতে হবে এও আমি ভাবতে পারিনি। ঐ পরিবারের একমাত্র মেয়েকে আমার ছেলের জন্য পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করবে এও ভাবতে পারিনি। এই সবের মূল কান্ডারী হলো দেবীদাস। তার ক্ষমা হয় না মা। তাছাড়া দেবীদাসের সুস্থ করে তুলেছে এই আমার জগত্তারিনী মা আমার। তবে দেবীদাস যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে আমি জানতাম না ।
যখন সুশীল বাবুর কাছে শুনলাম এই সব ঘটনা। চন্ডীপুরের সীতাংশুশেখর সিংহের মেয়ে রমা, আমার হৃদয় কেঁপে উঠল।
আপনি আমার বাবাকে
চিনি, জানি এবং আমার প্রাণদাতা তিনি। ঐদিন আমাকে মৃত্যুর হাত হতে বাঁচিয়ে ছিলেন। সেই দিনের ঘটনা প্রকাশ না করলে তোমাদের কৌতুহল থেকে যাবে। যে যন্ত্রণা আপন বক্ষে ধারণ করে বয়ে বেড়াচ্ছি, তোমাদের কাছে প্রকাশ করলে হয়তো শীতল বারির স্পর্শে একটু শান্ত হতে পারে। শোন সকলে।
ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি, আমি ও আমার বন্ধু ষষ্ঠীচরণ দুইজন মিলে চন্ডীপুরের জংগলে শিকার করতে রওনা হলাম। শিকারের নেশা আমার স্কুল লাইফ থেকেই।
বাবার সাথে ঐ লাইফে অনেকবার শিকারে গিয়েছিলাম। আমরা যথা সময়ে চণ্ডীপুরের গভীর অরণ্যে হাজির হয়ে জংগলের পরিবেশ অনুকূল অবস্থা কিনা পরিদর্শন করে জংগল লাগোয়া ফাঁকা মাঠে তাঁবু তৈরী করে থাকার ব্যবস্থা করলাম
জংগলের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও পরিবেশ আমার এতো মনোরম লাগতো তা একমাত্র আমি অনুভব করতাম। কয়েকদিন কেটে যাবার পর একদিন রাত্রের শেষ ভাগে অর্থাৎ ব্রহ্ম মুহুর্তে আমাকে না জানিয়ে ষষ্ঠীচরণ বন্দুক নিয়ে শিকার করতে পাড়ী দিয়েছে আমি জানতে পারিনি। সূর্য উঠার অনেক পূর্বে হঠাৎ আমার নিদ্রা ভঙ্গ হতে ওর বিছানার প্রতি নজর পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। তৎক্ষণাৎ বাইরে এসে দেখলাম ষষ্ঠী চরণ নেই। ভয় যে পেলাম না তা নয়। আমাকে না জানিয়ে কোন দিন সে স্থান ত্যাগ করেনি। তাছাড়া সে শিকারী হলেও আমার মত পটু নয়।
বিলম্ব না করে ওর খোঁজে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় এক ঘন্টা খোঁজ করে ওর সন্ধান পেলাম না। তাহলে কি করবো ভাবছি, হঠাৎ অতর্কিতে এক বাঘিনী আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। আমি ছিটকে পড়লাম, বন্দুকও ছিটকে পড়লো। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালাম, বন্দুকটার দিকে নজর হলো, কয়েক হাত দূরেই ছিল। ওটাকে কব্জাগত করার জন্য উদ্যত হতেই সে পুনরায় আমাকে আক্রমণ করল। বুকের মধ্যে একটা থাবা বসিয়ে দিল।
No comments:
Post a Comment