নষ্টা - দেবযানি দত্ত প্রামাণিক || Nasta - Debjani Dutta Pramanik || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 নষ্টা 

দেবযানি দত্ত প্রামাণিক


ছোটবেলা থেকেই খুব জেদী মেয়ে মিমি। পড়াশুনায় মোটামুটি, কিন্তু দেখতে অপুর্ব সুন্দরী। খুব ভালো নাচতেও পারে মিমি। ওর বাবা বিরাট অফিসার, একটি মাল্টি ন্যাশনাল এর ডিরেক্টর , কিন্তু প্রচুর কাজের চাপ আর প্রায়শই টুরে যান। ওর মা ও সরকারী অফিসার, বিডিও, ওনার ও খুব কাজের চাপ। তারপর আবার তিন বছর অন্তর পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বদলি হন। ও মোটামুটি ওর ঠামির কাছেই মানুষ। বাবা মা কাছে না থাকায় ওর ঠামি ওকে মাত্রাধিক আদর দিতেন ,তাইতে ও বেশ বখেই গিয়েছিল। বাড়িতেই প্রচুর কাজের লোক, তাই মিমি কে কিছুই প্রায় করতে হত না। সাজগোজ, নাচ, আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানো, এই নিয়েই মেতে থাকত ও।দেখতে খুব সুন্দর হওয়াতে আর হাতে প্রচুর টাকা থাকাতে ওর অল্প বয়স থেকেই প্রচুর স্তাবক জুটে গিয়েছিল। তারা ওর যা নয় তাই প্রশংসা করত। নিজেকে ভীষণ কিছু ভাবত মিমি। ওর ধারণায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেয়ে ছিল ও।


মিমির মা কিন্তু বুঝতে পারতেন যে ওনাদের কোথায় ভুল হচ্ছে। কিন্তু মিমি তো ওনার কাছে সব সময় থাকতই না। প্রত্যেক ছুটিতে ও গিয়ে মার কাছে থাকত। একমাত্র ওই ছুটিতে মায়ের কাছে গেলেই উনি বকে ঝকে, বুঝিয়ে, আদর করে, ওকে এই ধরাধাম এ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতেন। যত্ন করে ওকে পড়ানো, নানা রকমের ভালো গল্প বলা, উদাহরণ দিয়ে বোঝানো, সব চেষ্টাই করতেন। ছোটবেলায় অত না বুঝলেও একটু বড় হতেই মিমির আর মায়ের কাছে যেতে ভালো লাগত না। পড়াশুনা , টিউশন, নাচের ক্লাস, ফাংশন, ইত্যাদি নানা ছুতোয় ও কলকাতায় থেকে যেত। বেগতিক দেখে ওর মা বাধ্য হয়ে ছুটি নিয়ে আসতে লাগলেন, কিন্তু সে তো মাত্র কয়েক দিনের জন্য, ওনার অফিসে তো আর স্কুলের মত ভ্যাকেশন নেই। মা এলে, সেই সময় টা কোনরকমে লক্ষ্মী মেয়ের অভিনয় করে কাটিয়ে দিত মিমি। ওর মা ওর বাবা কেও বলতেন মিমির কথা কিন্তু ও যে একমাত্র মেয়ে ! ওর বাবা ও নিজের ওকে সঙ্গ না দিতে পারার আত্মগ্লানি তে, খুব মাথায় তুলতেন ওকে। বাবা আর মা কদাচিত কলকাতায় একসাথে হতেন, তখন মা ওনাকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন কিন্তু উনি আমল করতেন না, মেয়েকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিতেন। ঠামির সাথেও এই নিয়ে খুব ঝামেলা লাগতো মায়ের। মিমি কিন্তু এই সব থেকেই ফায়দা লোটার চেষ্টা করত সব সময়।


মাত্র সতেরো বছর বয়েসেই মিমি এক বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলের সাথে প্রেম করে পালাল।সেই ছেলেটি ওর সব হ্যা তে হ্যা মেলাত,তাই মিমির ওকে খুব পছন্দ হলো। ছেলেটি মিমিকে বোম্বে তে সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ করে দাওয়ার ও ব্যবস্থা করে দেবে বলেছিল। তাই মিমি ওর ফাঁদে পড়ে গেলো ।সেই ছেলেটি বিয়ে না করেই ওকে দার্জিলিং নিয়ে গেলো, নিভৃতে প্রেম করার নাম করে। সেখানে তাদের একটি বাংলো ছিলো। সেখানে চুটিয়ে মিমি কে ভোগ করে একদিন ওকে বোম্বের এক মেয়ে পাচারকারী চক্রের হাতে বিক্রি করে দিলো। মিমি সিনেমায় চান্স পাবে ভেবে লাফাতে লাফাতে বোম্বে গেলো। ট্রেনে ওকে বোরখা পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। বোম্বে তে নেমে কিন্তু মিমি খুব বিপদে পড়লো। ওকে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে একটি পতিতালয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। মিমি খুব ছোটবেলায় বখে গেলেও, বেশি আদরে মানুষ হওয়াতে ওর পৃথিবীর বাস্তব সম্পর্কে কোনো ধারণা বা অভিজ্ঞতা ছিলো না। ও একদম অসহায় হয়ে পড়ল।


মিমির পালিয়ে যাবার পরে ওর বাবা ও মা পাগলের মত ওর খোঁজ করতে লাগলেন। ওনাদের একমাত্র মেয়ে কে ওনারা স্বাভাবিক ভাবেই খুব ভালবাসতেন। দিকে দিকে পুলিশ স্টেশনে ওর ছবি পাঠালেন। বদনামের ভয় টিভি তে অথবা কাগজে দিতে পারলেন না। ওর ঠামি দুঃখে কষ্টে বিছানা নিলেন, হয়ত উনি নিজেও কিছুটা হলেও নিজের ভুল বুঝতে পারছিলেন । এভাবে বেশ কিছুদিন যাবার পর ওর মা মিমির দার্জিলিং যাবার খবর পেলেন। বাবা মা দুজনেই তখনই দার্জিলিং এ চলে গেলেন। অনেক খোঁজা খুঁজির পর, ওপর মহলে যোগাযোগের পর জানতে পারলেন যে ওকে বোম্বে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওনারা সঙ্গে সঙ্গে বোম্বে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলেন। পরের দিনই প্লেনে করে ওরা দুজন বোম্বে চলে গেলেন। যে ভাবে হোক মিমিকে নিয়ে আসতেই হবে।

এইদিকে মিমি তখন একদম বন্দী । ওকে পতিতা পল্লীতে আটকে রাখা হয়েছে। ওর সুন্দর চেহারার জন্য ওর প্রচুর দাম পাওয়া গেছে। খুব দামী দামী মক্কেলদের কাছে রক্ষী সমেত ওকে পাঠানো হচ্ছে। নানা রকম ভাবে ওদের মনোরঞ্জন করতে হচ্ছে ওকে। রীতিমত ট্রেনিং নিতে হচ্ছে। এখানে ওর জেদ কোনো কাজ করছেনা। ওদের প্রত্যেকটি কথা ওকে শুনতে হচ্ছে নয়ত তুমুল ভাবে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে।এই সময় আশ্চর্য ভাবে ওর বারবার মায়ের কথা মনে পড়ছিলো।খালি মনে হচ্ছিল যদি ও ছোটবেলায় মায়ের কথা মানত তাহলে আজ ওর এই দশা হত না। ও শুধু কাঁদছিলো আর কিছুই করতে পারছিল না। আস্তে আস্তে ও ছাড়া পাবার, বা পালাবার সব আশা ছেড়ে দিচ্ছিল। সিনেমা অভিনয়ের ভুত ও মাথা থেকে নেবে গেছিলো পুরোদমে।


এইদিকে মিমির ছবি নিয়ে, পুলিশের সাথে ওর বাবা মা নানা জায়গায় ওকে খুঁজছিলেন। একদিন ওরা খবর পেলেন যে অমুক পতিতাপল্লি তে একটি নতুন মেয়ে এসেছে যে মিমির মত দেখতে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সাথে নিয়ে ওর বাবা মা ওখানে গেলেন। অনেক ঝামেলার পর মিমি কে পাওয়া গেলো। মাকে দেখেই ও ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। ওর অবস্থা দেখে ওর বাবা মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মিমি ও আনন্দে, কষ্টে, শান্তি তে অজ্ঞান হয়ে গেলো। মিমি কে উদ্ধার করেই ওর বাবা মা তড়িঘড়ি প্লেনে করে ওকে কলকাতায় নিয়ে চলে এলেন। এর মাঝে জ্ঞান ফিরে কিন্তু মিমি একদম চুপ হয়ে গেলো।ওর ভুল ও বুঝতে পেরেছে, খুব অপরাধবোধে ভুগতে লাগল। ওর বাবা মাও খুব অনুতপ্ত। ওনারা যদি প্রথম থেকেই একটু শক্ত হাতে ওকে মানুষ করতেন তাহলে ওনাদের আজ এই দিন দেখতে হত না। তত দিনে ওর ঠামিও মারা গেছেন। ধীরে ধীরে মিমি নিজেকে একদম গুটিয়ে নিল। ও সব কিছু থেকে নিজের আসক্তি হারাল।কলকাতায় ফিরে এসে কিছুদিন পরই ও একটি মহিলা আশ্রমে যোগদান করল। ততদিনে ও আঠেরো হয়েছে তাই ওর বাবা মা অনেক চেষ্টা করেও ওকে ফেরাতে পারলেন না। ওনারা অনেক কান্না কাটি করলেন কিন্তু মিমি কিছুতেই ফিরলো না। ও আবার আগের মত জেদ ধরে রইল।


আশ্রমে যোগদান করার কিছুদিন পরই ওই আশ্রম থেকে বদলি নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো মিমি। চিঠি লিখে রেখে গেলো যে ওনারা যেনো ওকে না খোঁজেন, তাহলে ও আত্মহত্যা করবে। বুকে পাথর চেপে একমাত্র মেয়ে কে মৃত মনে করেই থাকতে লাগল ওর বাবা মা। এদিকে, মিমি সুদূর ইউ পি তে ওই আশ্রমের একটি অন্য শাখা তে চলে গেল। সবাই কে অনুরোধ করে গেলো যে কেউ যেন ওর ঠিকানা কাউকে না জানায়। ওর বাবা মা কে ও না। ওখানে গিয়ে কিছুদিন পর মিমি একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিল। এই জন্যই ও বাবা মার থেকে দূরে পালিয়ে গিয়েছিল। ওর মায়ের ছোটবেলার কথাগুলো মনে করে করে ও সম্পূর্ন মনের মত করে ওর মেয়েকে মানুষ করতে লাগলো। ওর করা ভুল গুলো যেন কোনো ভাবেই ওর মেয়ে না করে, আপ্রাণ তাই চেষ্টা করে যেতে লাগল। ওর কাছে ওর বাবা মায়ের খবর আসত, ওর আশ্রমের কলকাতা শাখা থেকে, কিন্তু ওদের কোনো খবর ওর বাবা মা পেতেন না। এই রকম করে মেয়ের আঠেরো বছর হলো। এই বার মিমি ওর মেয়েকে কাছে বসিয়ে আদর করে সব কথা বললো। কিছু গোপন করল না। ওর বাবা যে কে সেটাও সঠিক জানে না, সেটাও মেয়েকে বলল। সব বলার পর মিমি ভয়ে ভয়ে মেয়ের দিকে তাকালো, ও যদি ওকে ঘেন্না করে। কিন্তু ভগবানের অনেক আশীর্বাদে ওর মেয়ে সব কিছু শুনে মা কে জড়িয়ে ধরল। ভাগ্যিস নিষ্ঠা, ওর মেয়ে , ওর মত হয়নি। খুশিতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো মিমি।


মেয়ের ছুটি পড়লে, আশ্রমে সব জানিয়ে মেয়ে কে নিয়ে কলকাতায় চললো মিমি। দুজনেই চুপ চাপ, অচেনা, অজানা ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। পরদিন হাওড়ায় পৌঁছলে, ট্রেন থেকে নেমেই সোজা ট্যাক্সি নিয়ে ওদের বাড়িতে গেলো মিমি। দরজা খুলে দিল যে মাসি, তাকে বললো " মা কে বলো যে মিমি এসেছে" । সন্দেহজনক দৃষ্টি তে ওর দিকে তাকিয়ে মহিলা টি ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই মা এলেন দরজায়। ওকে দেখে ওর মা আর থাকতে পারলেন না, এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকে। দুজনেই কেঁদে ফেলল । নিঃশব্দে কিছুক্ষণ একে অন্যের আবেশ নিয়ে,আস্তে আস্তে সরে দাড়ালো মিমি। " মা, এই দেখো আমার মেয়ে নিষ্ঠা। ওকে আমি একদম তোমার মত করে মানুষ করেছি মা। ওকে তোমরা গ্রহণ করো। তোমাদের ইচ্ছে মত আমি যা হতে পারিনি, ওকে সেই ভাবেই মানুষ করেছি "বলে উঠল মিমি। ততক্ষণে ওর বাবা ও এসে গেলেন। ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। সব কথা শুনে উনি ও কেঁদে ফেললেন । আজ অনেকদিন পর ওনারা এক সাথে খেলেন , হৈ হৈ করে সময় কাটল ওদের। নিষ্ঠা কে দেখে ওনারা খুব খুশি। সত্যিই মিমি কে যে রকম ভাবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন ওনারা, নিষ্ঠা ঠিক সেই রকমই হয়েছে। সুন্দরী, বিদুষী, নম্র ভদ্র। " বাবা, মা দেখো নিষ্ঠা সত্যিই খুব ভাল মেয়ে , ওকে একদম তোমাদের মত করে তৈরি করো। ও কিন্তু নষ্টা না আমার মত, সত্যিই নিষ্ঠা। ওকে তোমাদের কাছে রেখে আমি আবার বিদায় নেব। " বলে উঠল মিমি। হা, হা করে উঠলেন বাবা মা। " আমাকে বাধা দিও না দয়া করে। আমি তো তোমাদের ঠিকানা জানি, মাঝে মাঝেই চলে আসব। আমার নিষ্ঠা কেও দেখে যাবো। তোমরা আমাকে বিদায় দাও। আমি এবার ঈশ্বর সেবায় নিজেকে সমর্পণ করতে চাই ।"অনুরোধ করল মিমি। সবাই মিলে অনেক কান্নাকাটি করল। কিন্তু মিমি কে কিছুতেই আটকানো গেল না, ওর জেদ এর সাথে কেউ কোনোদিন পারেনি। সবার থেকে বিদায় নিয়ে ট্যাক্সি করে স্টেশনের দিকে রওনা দিল মিমি। আজ ও খুব খুশি, ওর চোখে জল কিন্তু মনে শান্তি।


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024