প্রবাহঝড়ের রাত্রিনাচন - মনোজ মন্ডল || Prabhao Jhararer Ratrinachon - Monoj Mondal || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

  প্রবাহঝড়ের রাত্রিনাচন

                  মনোজ মন্ডল


খরপ্রবাহ বৈশাখের দুপুর, রাস্তা দিয়ে গাড়ি মাইক বাজিয়ে আসে আবার মাইক বাজিয়ে চলে যায় ; কে কোন দলের মন্ত্রশক্তি নিয়ে আসছে তা শুনেই বোঝা যায়। এই গাঁয়ে থাকেন ভূদেববাবু মহাশয় ,তার ভালো নাম ভূপতিচন্দ্র মন্ডল ,একালের ছেলে কিনা তাই বাপের দেওয়া অতবড় নাম রাখতে নারাজ । বাপ তার কোম্পানিতে ট্যাক্স লয় ,এ গাঁয়ে চক্কতী বাড়ি আর তারাই একমাত্র শিক্ষিত লোক বাকি সব চাষাভুষা মানুষ , এমনও লোক আছে যারা দিনানি দিন খায়। ভূদেব এর পিতা পশুপতিচন্দ্র মন্ডল এই গ্রামকে ভীষণ ভালোবসেন তাইতো বাপ ও ব্যাটার মধ্যে মাঝে মাঝে লেগে যায় কোন্দল । 


এই গ্রামের মানুষদের মধ্যে একটা অভিশাপমুক্ত ফল কাজ করে ! তারা ধর্মে নয় কর্মে বিশ্বাসী , নিজ ধর্ম নিয়ে উভয় সমাজের মানুষ মিলেমিশে তিহার পালন করে যেটা ভূদেবকে খুবই প্রভাবিত করে । ভূদেব সেই জন্যই তার পদবী কোথাও ব্যাবহার করেন না , সে একটা কথাতেই বিশ্বাসী "সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই"তাইতো গ্রামের মানুষজনও ভূদেবকে খুব ভালবাসত।ভূদেব ও এ গাঁয়ের মোল্লা সাহেবের ছেলে বোবা লতিফ দুজন খুব মিশুকে বন্ধু ছিল । মোল্লা সাহেব এ গ্রামের সৎমানুষ ছিলেন ,কোনোদিন কারো দুটাকা মেরে খাইনি,তাদের পরিবারকে খুব সম্মানের চোখে দেখতেন পাড়ার মানুষজন ,খুব শ্রদ্ধা করতেন মোল্লা সাহেবকে । সেই জন্যই তো পাড়ার প্রাইমারি স্কুলের চাবি মাষ্টারমশাইরা বিশ্বাস করে মোল্লা সাহেবদের বাড়িতে রাখতো,গত বিশ বছর থেকে তার বাড়িতে ছবি রেখে আসছে কোনোদিন দুটো আলু পর্যন্ত চুরি হয়নি চাল ডাল তো দূরের কথা। লতিফ ছিল মুক্কসুক্ক ছেলে কিন্তু দিমাগ তার তেজ চলত। ভূদেব আজকাল কাজবাজ জোগাড় করতে না পারায় বাড়িতেই বসে লেখালেখি করে আর সেই লেখা লতিফকে শোনায় এবং লতিফও তার লেখা শুনে সহানুভূতি যোগায়। 


এই মরশুমে বিভিন্ন বাড়ি থেকে মাংস ভোজনের নেমন্তন্ন আসে ,বেশ আদর করে পিঠে হাত বুলিয়ে খাওয়ানো হয় , কেউ বাড়ির উঠানে ,কেউ ছাদে ,কেউবা বনে ,কেউবা খেলার ফিল্ড এ ,সবাই ভালোবেসে খাওয়াতে চায় , মোল্লা সাহেবের বাড়িতে নেমন্তন্ন আসে ভরে ভরে , লতিফরা যায় নেমন্তন্ন খেয়ে আসে ,এই মরশুমে গরীব মানুষদের- যারা দিনানি দিন খাটে তাদের একটু হলেও খুব উপকার হয় কিন্তু ভূদেবরা অন্যের বাড়িতে রাতবিরাতে আহার থেকে দূরে থাকে । গায়ের রতন ক্ষ্যাপা রোজ একবার করে ভূদেব কে বলে - কিরে ভূদেব্যা কাইল রাইতে পংখোজদের বাড়ি খেতে জাইসনাই? উত্তরে ভূদেব বলে - গিয়েছি তো দেখাসনাই? তারপর তড়িঘড়ি ভূদেব সেখান থেকে কেটে পড়ে । এভাবেই দিন যায় রাত যায়, চলে আসে বনভোজনের অন্তিমপর্ব এর পর আর খাওয়ার পাবেনা কেউ।


সময়টা ছিল বৈশাখের রাত। আকাশটা সারাদিন ধরেই মেঘলা । মেঘলা দিন থাকলেও ঝড়বৃষ্টির কোনো খবর ছিলনা , ভূদেব রাতের বেলা লেখালেখি শেষ করে ঘুমাতে যাবে এমন সময় বিদ্যুৎ প্রস্থান করলো । বিদ্যুৎ এর কথাটা না বলে আর পারলাম না ,তবে বলি শুনুন ,ছোটবেলা থেকেই ঝড় আসার আগে এই কথাটা ভাবাই ঝড়বৃষ্টি আসার আগেই বিদ্যুৎ চলে যায় কেনো ? এরকম পরিস্থিতি কলকাতার মত বড় শহরকে পোহাতে না হলেও গ্রামগঞ্জে এইরকম পরিস্থিতি নিত্যই লক্ষ্য করা যায় ; বিদ্যুৎ যাওয়ার ক্ষণেক পরেই ইন্দ্রবিদ্যুৎ এর আলোয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দুটো , জানলার দিকে মুখটা বাড়াতেই দেখি সে কোনো ছোটখাটো ঝড় নয় , এক ভয়ানক দৃশ্য ,সেই মুহূর্তের জন্য মনে হল এমন ঝড় হয়তো এর আগে কোনদিন চোখে পড়েনি, মুহূর্তের মধ্যে শুরু হলো ঝাঁই ঝাঁই - সাই সাই আওয়াজ ,বিদ্যুতের শিখা ও গর গর - ঘর ঘর আওয়াজ, যেনো আকাশ - পাতাল ভেদ করে বেরিয়ে আসছে মানুষখেকো বজ্রপাত ! মনে হচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে সব ঘরবাড়ি ভেঙ্গে তলিয়ে যাবে মাটিতে, বোধ হয় স্বয়ং ইন্দ্রদেব পৃথিবীর মানুষের আচরণের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে তার বজ্রবাণ চালাচ্ছেন ,যেন সেই বাণে পৃথিবীর উপর স্থাপিত সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করতে চান ,এভাবেই চললো সারারাতের নরকীয় ধ্বংসলীলা ,এভাবেই কখন ঘুমে লিপ্ত হয়ে এল আমার দুই চোখ বুঝতে পারিনি ।


সকালে মায়ের কান্না শুনে ভূদেবের ঘুম ভেঙে গেলো, মাকে বাইরে কাঁদতে কাঁদতে বেরোতে দেখে ভূদেব বাইরে বেড়িয়ে দেখে অতবড় ডালভরা সজনে গাছটা ভেঙে পড়েছে কালকের ঝড়ের তান্ডবে! সে ভাবে মায়ের সাধের লালন করা ছুটির গাছটা শেষ হয়ে গেলো । ছুটির গাছ পার করে আরেকটু দূরে চোখটা যেতেই দেখে লতিফদের ঘর ভির করেছে পাড়াসুদ্ধ মানুষজন সে ভাবে তাদের বাড়ির ডালপাত ভেঙে আসা আম গাছটা বোধহয় ঝড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে । গিয়ে ভিড় সরিয়ে দেখতে যাবে কি তার মাথায় হাত! স্তব্ধ ভাবে দাড়িয়ে রইল ভূদেব ,নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা ভূদেব । এ আমি কি দেখছি ! একি সত্যি লতিফ ?

লতিফের লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে ,পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রক্তের স্রোত ,শুধু তার একার না, তার পুরো পরিবারের , সেই রক্তে অধিকারের ভির বসিয়েছে বিভিন্ন অঙ্গের পিঁপড়েরা ,তার দিদির নগ্ন দেহ পড়ে আছে উঠানের পাশে বুঝলাম তার ওপর পাশবিক অত্যাচার কম হয়নি, মা গিয়ে একটা কাপড় জড়িয়ে কান্নায় জ্ঞান হারানোর অবস্থা ,আমি থ হয়ে দাড়িয়ে রয়েছি , কান্নায় ভেতর আমার ফেঁটে যাচ্ছে ,হায়রে বোবা লতিফ কাল রাত্রে যদি তোর গলায় ভগবান একটু আওয়াজ দিত, তুই ডেকেছিস অনেক কিন্তু শোনার জন্য সে কান ভগবান আমাদের কাউকেই দেয়নি , তোর বাবা নিশ্চয় খুব চেঁচিয়ে ছিল রে ভূদেব আই পশুপতি বাঁচা আমাদের , তাইতো তার গলায় ছুরি টা এখনও লেগে আছে রে ,

শেষ প্রচেষ্টা করেছে মোল্লা সাহেব স্কুলের চাবি সুরক্ষিত রাখার কিন্তু পারেনি কেড়ে নিয়ে গেছে দুষ্কৃতিরা । ভূদেব এর মাথায় সেদিন একটায় কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল "এই আমাদের দেশ , স্বাধীন হয়েছি আমরা , আপন অধিকারেই তার শেষ "


                                               

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024