পুরীর উল্টো রথ - অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় || Purir ulto roth - Ashok Bandopadhyay || Muktogoddo || মুক্ত গদ্য || রম্যরচনা || Rommo rochona

 পুরীর উল্টো রথ

           অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়



পুরীর রথ দেখার শখ ছিল যুবক বয়স থেকেই। কিন্তু এতো ভীড়ের মধ্যে রথ দেখার মতো কঠিন কাজ আর হয় না। তাই আগে কখনো সাহসে কুলায়নি। শেষ পর্যন্ত একদিন সেই পুরীর জগন্নাথদেবের রথ দেখলাম, তবে উল্টো রথে।

      গত ২০১৯ সালে দুই ছেলের সঙ্গে সস্ত্রীক বাঁকুড়া স্টেশনে চেপে বসলাম বৈদ্যনাথ ধাম পুরী এক্সপ্রেস ট্রেনে। ট্রেনটা খুব যে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন তা নয়। কিন্তু বাঁকুড়া থেকে সন্ধ্যা নাগাদ ছাড়ায় সুবিধা হয়েছিলো। ঘটনা চক্রে ঐ ট্রেনের কামরায় এমন একদল মহিলা যাত্রীর সঙ্গ ( সঙ্গে ওদের দুয়েক জন পুরুষ সহযাত্রীও ছিলো ) জুটলো যারা আসানসোলে চেপেছেন। ওনারা কেউ আসলে কলকাতার, কেউ আসানসোলের কেউ বা দুর্গাপুরের। প্রায় জনা পাঁচেক ঐ মহিলারা প্রত্যেকে পরস্পরের ভীষন বন্ধু। এবং ওরা এমন একটা ট্যুরিস্ট টিম যারা এই ভাবে একসাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান ছুটি ছাটা বা সুযোগ পেলেই। ওদের কেউ প্রোফেসর, কেউ শিক্ষিকা, কেউ বা সরকারি কর্মচারী। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম জেনে যে ওরা প্রতি বছর এই সময়ে পুরী যান শুধুমাত্র উল্টো রথ দেখতেই। প্রায় এক সপ্তাহ সেখানে থাকেন। ওদের অবশ্য প্রধান আকর্ষণ উল্টো রথের পরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা কে যখন আবার মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিক তার আগে যে অসাধারণ ও অজস্র মূল্যবান মণি রত্ন আভূষণে রাজবেশে সজ্জিত করা হয় তিন মূর্তিকে সেইটি দুচোখ ভরে দেখে নয়ন সার্থক করা। এবং ওরা এই কাজে ভীষন রকম সফল। 

      শুধু মাত্র এই জন্যই ওরা সব ভুলে ঠিক এই রকম সময়ে পুরী যান পাঁচ হরিহর আত্মা বন্ধু মিলে এবং পুরীর শ্রী জগন্নাথ দেবকে বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে নয়ণ মনোহর রূপে দেখে আনন্দে আবেগে আপ্লুত হয়ে এক অদ্ভুত অলৌকিক অনুভূতি ও উপলব্ধির আবেশে মন প্রাণ পরিপূর্ণ করে নূতন প্রাণ শক্তি ও দিব্য পরমানন্দে নিজের নিজের গৃহে ফিরে আসেন। কিন্তু উল্টো রথ এলেই ওরা আবার জগন্নাথ প্রভুর অলৌকিক আকর্ষণে বারে বারে এই ভাবে ছুটে যান। বলা বাহুল্য যে এরা প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েও সংসার জীবনে প্রবেশ করেননি।

      আমাদের মতো একটা ছিমছাম ফ্যামিলিকে সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে ওরা যে ভীষন খুশী সেকথা মুখ ফুটে বলেই স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করলেন। বললেন, "ভালোই হলো। আপনাদের মতো সহযাত্রী পেলাম এটা সত্যিই সৌভাগ্যের।" ক্রমশঃ আলাপ আলোচনা চলতে চলতে যখন জানতে পারলেন যে আমার দুই পুত্রের একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্য জন এইমসের ডাক্তার যার নীট ও এইমসের এন্ট্রান্সের অসাধারণ সাফল্য সারা রাজ্যের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল সে কথা শুনে ওরা তো আরো অভিভূত। রাত আটটার সময় আমরা নিজেদের বার্থে শোবার ব্যবস্থা করে সোয়া আটটায় ঘরের খাবার নিয়ে ডিনার করবার তোড়জোড় করতেই ওরাও আমাদের অনুসরণ করলেন। স্বীকার করলেন যে ট্রেনে রাতের খাবার তাড়াতাড়ি সেরে নেওয়াই ভালো। তারপর প্যাকেটের চিকেন, ফ্রায়েড রাইস বের করে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেতে শুরু করলেন। সঙ্গী দুই তিন জন পুরুষ সহযাত্রী আত্মীয়কেও খেতে দিলেন ফাইবার প্লেটে। ওদের খাওয়া দেখে মনে হলো যেন ট্রেনের মধ্যে ভোজ খাচ্ছে। তবে চলন্ত ট্রেনে বা বাসে আমার নিরামিষ, খুব বেশি হলে ডিমকারি খেতেই বেশি পছন্দ। মাছ বা মাংস কোন মতেই নয়। ঐ সব খেলে অন্য সহযাত্রীর অন্য রকম অসুবিধা হয়। তাছাড়া এই সব খাবার বড্ডো নোংরাও করে পরিপার্শ্ব।

      যাই হোক, যথারীতি সময় মতো শুয়ে পড়ে পরদিন ভোরে পুরী স্টেশনে নেমে বড়ো ছেলের বুক করে রাখা একটা ভালো হোটেলে গিয়ে উঠলাম। সেদিন হোটেলে পেট ভরে টিফিন করে সমুদ্র স্নান করে এলাম। দুপুরে লাঞ্চ করে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় কিছুটা টোটো করে রাজবাড়ী পেরিয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড পর্যন্ত যেয়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম গুন্ডিচা মন্দিরের দরজার সামনে যেখানে কি সুন্দর ভাবে পাশাপাশি জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার রথ দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাস্তায় তুমুল ভীড়। মন্দিরের ও রথের দেবতাদের প্রণাম করে রথের মোটা দড়িও স্পর্শ করে খুব আনন্দ পেলাম। তারপর চারিদিকে রথের মেলা, নানান পসরা দেখে, বড়ো ছেলের কেনা দারুন একটা আইসক্রিম খেয়ে ভীড়ের মধ্যে হেঁটে হেঁটে কোথাও রাস্তায় বাঁধা মঞ্চে গানের জলসা, কোথাও জগন্নাথ দেবের দৈবী ক্রিয়া কান্ড নিয়ে নাটক ইত্যাদি দেখতে দেখতে আবার টোটো করে হোটেলে ফিরে এলাম। এটা ছিল উল্টো রথের দিন।


      উল্টো রথের পরের দিনে বিকেলে রাস্তায় নেমে শুনলাম যে রথ গুলো জগন্নাথ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে যাবার জন্য সোজা রাস্তায় যাওয়া যাবে না, রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাই কোন টোটো ঐ পথে নিয়ে যেতে চাইলো না। অগত্যা পিছন দিকের এক গলিপথ ধরে টোটো করে কিছুটা এগিয়ে ভীড়ের মধ্যে নেমে যেতে হলো। আর যাবে না বললো টোটো ওয়ালা। সুতরাং সেই গলি রাস্তায় অনেকটা হেঁটে জানা গেল যে আর ওদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। পুলিশ রাস্তা আটকে রেখেছে। সুতরাং প্রচন্ড ভীড়ের জনতার পিছনে পিছনে প্রায় ঢেউয়ের ঠেলায় শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম ঠিক সেই খানে--একেবারে মূল মন্দিরের সিংহ দুয়ারের কাছে। আর ভীড়ের মধ্যে একটু মাথা উঁচু করে দেখতেই ভীষন ভাবে চমকে উঠলাম দেখে যে আমাদের থেকে মাত্র হাত তিরিশ দূরেই দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দেবের রথ। তার কিছুটা দূরেই সুভদ্রা ও বলরামের রথ। তিন রথের তিন রকম উচ্চতা, তিন রকম রঙ্গ, সজ্জা ও পতাকা। রথের উপর থেকে যেন স্বয়ং শ্রী জগন্নাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সেই অপূর্ব নয়ন মনোহর মূর্তি প্রতিমা দেখে এবং অসাধারণ ও চমৎকার সাজে সজ্জিত তিন দেব দেবীর রথ দেখে যুগপৎ মোহিত ও বিস্ময় বিমুঢ় হলাম। জীবনে এই প্রথম বার রথ দেখছি পুরীতে। ভাবতেই অবাক লাগছে। 

      এ ভাবে যে কতো ক্ষণ চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম সব ক্লান্তি, কষ্ট ভুলে মনে নেই। শুধু প্রভু জগন্নাথের এমন রাজবেশ দেখে দিব্য আনন্দে বিভোর হয়ে গেছলাম। আমার একটু আগেই ছ ফুটি দীর্ঘ বড়ো পুত্র হাতে তার নিকন ক্যামেরায় ফটাফট ফটো তুলে চলেছে। ছোট ছেলেও যথেষ্ট লম্বা। ওদের দুই ভাই তো মনের মতো সব দেখতে পেয়েছে। আমার অর্ধাঙ্গিনীকে একটু ঠেলে সামনে এগিয়ে মাথা উঁচিয়ে এমন অসাধারণ দিব্য ত্রয়ী রথের দৃশ্য দেখতে সাহায্য করলাম।  

      প্রায় আধ ঘন্টা ঐভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে উল্টো রথ দেখে চক্ষু সার্থক করে আবার পিছন ফিরে গলি দিয়ে হেঁটে রাস্তার পাশের দোকানে এখানকার বিখ্যাত রাবড়ি, মালপোয়া খেয়ে ফাঁকা জায়গায় এসে টোটো ধরে আমাদের হোটেলে ফিরে নৈশাহার সেরে বিশ্রাম নিলাম।

 মনে পড়লো আসার পথে ট্রেনের মহিলা সহযাত্রীদের কথা। কেন ওরা বারবার এমন সুন্দর অজাগতিক দৃশ্য দেখে আধ্যাত্মিক অনুভূতির দিব্য ভাবে আবিষ্ট হতে আসেন সেটা এবার সত্যিই বুঝতে পারলাম।



Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024