একটি অবাঞ্ছিত - আবদুস সালাম || Ekti Obanchito - Abdus Salam || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 একটি অবাঞ্ছিত

      আবদুস সালাম



(এক)



চুমকি হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে হাসপাতালের দিকে। রুক্ষসুক্ষ চুল। পরণে তার আধ ময়লা ছেঁড়া কাপড় 


       হিতম মাঝি ভোর ভোর বাড়ির মাচানে ধরা কয়েকটি ঝিঁঙে নিয়ে আসছিল মেলা তলার বাজারে বেচতে। তখন ও আঁধার আলোর মুখ দেখেনি।যা দুটো পয়সা পাবে তাই দিয়ে হাসান ডাক্তারের দোকানে ওষুধ নিয়ে যাবে তার অসুস্থ মেয়ের জন্য । দুদিন থেকে খুব জ্বর। শিব মন্দির তলায় তখন ও ঠিক মতো মুখ না চেনা আঁধার। একটি বেপরোয়া পিকআপ ভ্যান থেঁতলে দেয় তার ঝিঙের ঝুড়ি। বেশ লেগেছে তার কোমরে । নেশার ঘোরে ছিল। গত রাতে ভোট চাইতে এসেছিল ওরাই দিয়ে ছিলো ইংলিশ মাল। তীব্র আলো চোখে পড়ায় সে হতবম্ব হয়ে যায়।বেগতিক দেখে ড্রাইভার জোরে গাড়ি ছুটিয়ে পালায়। একাই বেচারী পড়ে আছে রাস্তায়।কেউ ওঠানোর লোক নেই।কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে কাঁদছে,আর বলছে ,"এয়া কি হুঁঙ গেলো রে চুমকি "।


            


  এই সময় মুখুজ্জে বাড়ি, হাজরা বাড়ি,ভটচাজ্ বাড়ির ছেলে মেয়েরা মর্নিং ওয়াকে বের হয়। আজ ও বেরিয়েছে।


       জমি দেখতে আসছিল হাসান ডাক্তার। একজন কে রাস্তায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে পাশে বাইক রেখে তাকে সোজা করে তোলাতে চেষ্টা করে ।হাত পায়ের রক্ত মুছিয়ে ধুয়ে দেয়। সোজা করে হাঁটানোর চেষ্টা করে। মর্নিং ওয়াকে আসা ছেলে মেয়েরা এই কান্ড দেখে মনে করে ঐ লোকটাই হয়তো আ্যক্সিডেন্টটা করেছে। এখন ব্যাটা সাধু সাজবার চেষ্টা করছে।


 হাসান ডাক্তার ওদের কে বোঝানোর চেষ্টা করছে আমার বাইকে হয়নি। একটা পিক আপ ভ্যানের এই কাজ। কিছুতেই ওর কথা শুনতে চাইছেনা । শালা ভালো মানুষ সাজছো না। দে দুই ঘা বেটার পাছায়। 


বলছি আমার বাইকে হয়নি । কিছুতেই শুনতে চাইছেনা তার কথা। বেশি কথা বললে ঠ্যাং ভেঙে দিবো ব্যাটা।


 ওমনি মারের ভয়ে বলে কি করতে হবে বলো? 


    ওরা বিধান দেয় ডাক্তার ,ওষুধ পত্র কিনতে যা খরচ হবে সব তোকেই করতে হবে। এক ঝুড়ি ঝিঙের দাম ও জরিমানা হিসেবে দিতে হবে। সব মাথা পেতে নেয়। 


ভালো মানুষি দেখাতে গিয়ে কেমন অযথা ঝঞ্ঝাটে পড়ে গেল। পালিয়ে গেলেই তো হতো। বিবেক তাকে পালিয়ে যেতে দেয়নি।অগত্যা জমি দেখা বাদ দিয়ে জঙ্গিপুর হাসপাতালে ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে আসে। কর্মরত ডাক্তারবাবু ছিঁড়ে যাওয়া জায়গা গুলো ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। একটা ছবি করে নেওয়ার পরামর্শ দেয় কিছু ভাঙাচোরা হয়েছে কি না জানতে।


    হিতমের বউ খবর পেয়ে ছুটে আসে হাসপাতালে ।হাউমাউ করে কাঁদে ।"এখুন হামি এখন পূজার দিনে কি করবো রে" । 


 তুকে অততো করি বুললাম শালা মদ খ্যাঁসন্যা । তাঁও খেল্লি ।এ্যাক্ষুন হামি কি ক্যোরব্যো- রে —--!কেঁদে কেঁদে হাসপাতাল তোলপাড় করে ।


 লোকেরা মনে করে হয়তো কেউ মারা গেছে। সহানুভূতির ঢেউ আছড়ে পড়ছে হাসপাতালের বারান্দায়।


  হাসান ওষুধ এনে খাইয়ে দেয় ।তারপর বলে তোমার তেমন কিছু হয়নি ।একটু লেগেছে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধ এনে দিয়েছি । ওগুলো খাও , আর থাকো । আমি বিকেলে আসবো ।তোমার খাবার সব দিয়ে গেলাম ।ডাক্তার এক্সেরে রিপোর্ট দেখে বলে কিছু হয়নি ।বিকেলে বাড়ি চলে যাবে।



দুই)



 হাসান বিকেলে হাসপাতাল এসে জানতে পারে কোন কিছু ভাঙাচোরা হয়নি। ডাক্তার ওকে ছেড়ে দিয়েছে। হাসান হিতম কে বলে তুমি বেডে থাকো আমরা আসছি। টোটো করে তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিবো । হাসানের সাথে চুমকি পেছনে পেছন যায় । বিকেল গড়াতেই ম্যাকেঞ্জি পার্কে শৈলেশের ফুচকা খেতে দলে দলে ছেলে মেয়েরা আসে।  


শৈলেশ দেখতে হ্যান্ডসাম। নায়ক নায়ক ভাব।সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কে প্রাধান্য দেয়।ওর ব্যাবহার টাও খুব ভালো । যুবতী মেয়েরা লাইন দিয়ে শৈলেশের ফুচকা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে । হাসি ,ঠাট্টা ইয়ার্কি ও করা হয় আর ফুচকা খাওয়াটা ও হয় ।


 সবাই যখন ফুচকা খাচ্ছে তখন চুমকির জিভ দিয়ে যেন জল ঝরছে ।বারবার ফুচকার স্টলের দিকে তাকায় আর হাঁটে । পেছন ফিরে হাসান দ্যাখে চুমকির চোখ মুখের অবস্থা ।


 এই চুমকি ফুচকা খাবি ? "না ডাক্তোর আমার ছোট বেটি না খেঁয়ে আছে । আজ চাল কিন্যা হয়নি তো ।তু এ্যকসোডিন টো করলি ।হামার ছ্যেইলা দুট্যা না খেঁই আছে সারাদিন। বাড়িতে এঁঠ্যা রাঁধা আছে রাইতের ।ওয়্যাই খেঁই আছে ডাক্তোর। হামাদের খুব অভাব। এদিকে বড়ো বিটিটোর জ্বর । ঝিঁঙা বিচ্যা পয়সা তে তো বিটিটোর জ্বরের ওষুধ লিত্যাম।"


       আরে না না তোর হিতম কে একটা মোটরে আ্যকসিডেন্ট করেছে। আমি ওকে পড়ে আছে দেখে ঝেড়ে ঝুড়ে দিচ্ছিলাম। "তবে ওই ছুঁড়া গিল্যান যি বুললে তুই মেরাছিস। তোকেই সব খরচ দিতে লারবে"। সব মিছে কথা।


 তোর ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে? খা । আমি পয়সা দিবো । না ডাক্তোর না বলে আর ফুচকার স্টলের দিকে চোখ রাখে ।ফুচকার দিকে একবার তাকায়,আর একবার হাসানের দিকে তাকায় । লজ্জা লজ্জা করছে ওর। বারবার বলাতে চুমকি ফুচকা ওয়ালার কাছে যায় । শৈলেশ কে বলে মেয়েটাকে দশ টাকার ফুচকা দাও তো। শালপাতার ঠোঙা করে চুমকির হাতে দেয় । ফুচকার মাঝখানটা ভেঙে আলু ভর্তা পুরে তেঁতুল ঘোলা জলে ডুবিয়ে শৈলেশ ঠোঙা তে দেয়। কেমন করে ফুচকা খেতে হবে চুমকি যে জানেনা ।বাড়ালা স্কুলের মেয়েদের খাওয়া দেখেছে ভেঁড়া চরাতে এসে। ফুচকা ওয়ালার কাছে যেতে সাহস হয়নি । একে তো টাকা নাই। তার উপর নোংরা কাপড়। ছেলে মেয়েরা যদি খারাপ কথা বলে । তেঁতুল ঘোলা জলে ডুবিয়ে যেই চুমকি ঠোঙাতে দিয়েছে, অমনি মুখে দিয়েছে পুরে। মশলা দেওয়া ঝাঁজ মাখানো তেতুল জল উঠে যায় তালুতে ।হাঁচিতে, কাশিতে ম্যাকেঞ্জি পার্কের ঢোকার মুখটাকে গরম করে তোলে।


    ফুচকা খাওয়া শেষ হলে ওকে নিয়ে যায় স্টাইল বাজার। ওর বাড়ির প্রয়োজনীয় চাল, ডাল ,চিনি ,বিস্কুট ,তেল ,নুন একটা ব্যাগে ভরে তুলে দেয় ওর টোটো তে ।



তিন)



ক্লাবের কয়েকজন ছেলে মিলে প্ল্যান করে আজ খেলা ভালোই হবে । বাসস্টপে ঢোকার মুখে সব জড়ো হয়।ঘোষপাড়া থেকে এসেছে সঞ্জয়, সুমিত ।হাজরা পাড়া থেকে এসেছে শুভম আর কালু ,কুন্ডু পাড়া থেকে এসেছে দেবু ,কালটু আর তাদের গোটা কয়েক সাগরেদ। মন্ডপ তলার একধারে বসে পরামর্শ করে । কি কি করতে হবে।সব লোকে ভাবছে কি ব্যাপার?এক সাথে সব মস্তান কয়টি এসে জুটেছে। কোন গন্ডোগোল তো নিশ্চয়ই হবে আজ। মন্ডপ তলার থমথমে অবস্থা ।কি যেন কি আজ হতে চলেছে।


    যেমন আসবে তেমনি শালাকে দেবো ধোলাই । জরিমানা আদায় করতেই হবে। কারোরই কোনো কথা শোনা হবে না।পরামর্শ মত সবাই প্রস্তুত। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ টোটো এসে হাজির। বসে আছে হিতম হিতমের বৌ আর হাসান ডাক্তার । সাথে তাদের আছে একটা বড়ো ব্যাগ । তাতে এক সপ্তাহ চলার মতো চাল ডাল সবজি সাবান সার্ফ ইত্যাদি ইত্যাদি। 


হাসান ডাক্তার যেমন নেমেছে তেমনি ছুটে এসেছে ওই ছোঁড়াদের দল। ওরা খোশ মেজাজেই ছিল।আজ একটা কিছু আদায় হবেই।ছোঁড়াগুলোর চোখের সামনে দিয়ে হিতম আর হিতমেরবৌ ডাক্তার বাবু কে প্রাণ ভরে আশির্বাদ করতে করতে টোটোতে চেপে চলে গেল মন্ডলপুরের দিকে। 


###






ভাগিদার


আবদুস সালাম


১৪৮৯


 ভাবতে ভালো লাগছে এমনি করে সেদিন প্রাণে বেঁচে ছিল সুপ্রিয়া। সুপ্রিয়া জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সংসার ও নিজেকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে । সুপ্রিয়া শোভন কে ভালবেসে বিয়ে করেছিল । কলেজের অফ পিরিয়ডে নিজেকে কলেজের পেছনে লিচু বাগানের গিয়ে গল্প করা । আধো-আলো ছায়ায় ভবিষ্যতের গহণ নদীতে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখতো দুজনে । এর জন্য কতদিন যে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । অন্য বন্ধুদের প্রক্সি দেওয়ার সুবাদে তাদের প্রেম অবলীলায় চলতে দোসর হয়েছিল। প্রেম যমুনায় তরী যখন উথাল পাথাল তখন কোনো বাধা আর দুজনকে বেঁধে রাখতে পারছে না ।মোহনার উদ্দেশ্যে গঙ্গা-যমুনা একই স্রোতে মিশতে শপথ গ্রহণ করেছে যেন । সমুদ্রের লোনা জল, তবুও মিশে যাওয়ার তীব্র আকুতি। বয়ে শত বাধা পেরিয়ে আবর্তিত ঘূর্ণাবর্তে ও তারা সংকল্পে অটল।


 শোভনের বাবা রাশভারী লোক। প্রথম দিকে খুব শাসন করেছে ছেলেকে । পরক্ষণে আবার সুচতুর বাবা ভবিষ্যৎ কিছু বড় রকমের প্রাপ্তির আশায় মত বদলাতে শুরু করেন। ওদের মেলামেশাতেও তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন নি ।গ্রামে আছে বিঘে ত্রিশেক জমি, পুকুর বাগান এবং রঘুনাথগঞ্জের মাদারল্যান্ড পল্লীতে প্রাসাদোপম বাড়ি । সুপ্রিয়ারা দুই বোন । দুই বোন সমান সমান ভাগ পেলেও আমার শোভন যে কিছু কম পাবে না তা তিনি ভালো ভাবে বুঝেছিলেন । এই আশাতেই রাশভারী লোকটা ছেলের প্রেমের পথের কাঁটা হননি। ফলস্বরূপ ওদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজে না গেলে ও বি্রোধিতা করেন নি । 


    প্রেমের জল যতদিন স্বচ্ছ থাকে ততদিনই সেই প্রেম স্বর্গীয় থাকে। অন্যদিকে জল যখন ঘোলা হতে শুরু করে তখন সেই জল গলধঃকরণ করা দুষ্কর হয়ে ওঠে ।প্রেমের নদীতে তখন আর জোয়ার আসে না । নিস্তেজ নদী প্রবাহহীনতার অসুখে ভোগে। অজস্র শৈবাল দাম আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে । জন্মনেয় বহু অবাঞ্ছিত জলজের । নদী তখন আর নদী থাকে না। এমনই সুপ্রিয়ার প্রেমের নদী পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত হয়ে গেছে ।


     ক্রমশ শোভনের লাগামছাড়া বায়নার হাতিয়ার হতে হতে বিধবা মা গত হয়েছে। চোখের জল ছিল তার নিত্য সঙ্গী ।সংসারের অশান্তিতে সুপ্রিয়া দিনদিন পোড়া কাঠ করে ফেলেছে নিজের চেহারাকে। আজ আর সেদিনের সুপ্রিয়া নেই । শর্মিলা ঠাকুরের মতো চুল বাঁধা। অনেক ছেলেই সুপ্রিয়া কে ভালবাসার বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছিল।




  সেদিনের সুপ্রিয়া আর আজকের সুপ্রিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ ।শোভনের চাল চাল চলন ও আদবের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে । মদের বোতল ছাড়া একটি দিন ও চলেনা। অবাঞ্ছিত মেয়েদের পাড়ায় শুরু হয়েছে যাতায়াত। বাড়িতে এলে সুপ্রিয়ার কপালে জোটে কথায় কথায় খিস্তি, আর তার সঙ্গে যোগ হয় হস্তযোগ্য উপহার যা কোন দিন ভাবতেই পারেনি সে ।


  বাড়িতে ছোট বোন সুভাষিনী জামাই নিয়ে থাকে। ঘরজামাই হয়ে এসেছিল কার্তিক। বেশ সুখেই তারা আছে । অতোবড়ো বাড়িটি একাই ভোগ করছে।


 সুপ্রিয়া বাবার বাড়ি এসেছে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে । বাবা মা না থাকলেও নিজের বোন তো আছে।এই ভরসায় দুদিন প্রাণের জ্বালা জুড়াতে। তার চেহারা দেখে সুভাষীনী অবাক । সে তার দুর্ভাগ্যের কথা বোনকে জানায় । জানায় শোভনের দিন দিন অত্যাচারের কথা। সুভাষিনী বলে" দিদি কেন তুমি ঐ চন্ডালের কাছে আছো? এক্ষুনি তুমি চলে এসো । ওই জানোয়ারটা তোমার কি হাল করেছে দেখেছো ? একদম তুমি ওখানে যেওনা দিদি ।কোনদিন শুনবো তুমি নেই ।


    অর্ধেক বাড়িতো তোমার । একখানা ঘর নিয়ে তুমি থাকবে আর দুখানা ভাড়া দিলে দিব্যি তোমার সংসার চলে যাবে । কিসের আশায় কার জন্য তুমি পড়ে থাকবে দিদি ? সুপ্রিয়া যেন হালে পানি পেল । ছোট বোনের এই জ্ঞানগর্ভ কথা তার মনে ধরেছে ।স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়তে শুরু করেছে ।এখন নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে সুপ্রিয়ার। সামান্য একটু ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে আজ । হায়রে প্রেম!!!


  দিন পনেরো ছোট বোনের কাছে থেকে গেল সুপ্রিয়া, আর নিজেকে নিজের বাড়িতে স্থিতু করার চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়ল ।এমনও চিন্তা করতে লাগল যে বাকি জীবন শোভনের কাছে ডিভোর্স নিয়ে ছোট বোনের কাছেই কাটিয়ে দেবে।


  কার্তিকের চিন্তাভাবনা কিন্তু অন্যরকম ।সে নিজের ছাড়া কিছুই বোঝে না। প্রথম প্রথম কার্তিক ভেবেছিল দিন কয়েক থেকে আবার সে স্বামীর কাছে ফিরে যাবে । প্রথমদিকে তাই আপ্যায়নের ত্রুটি রাখেনি কার্তিক। কিন্তু যখন জানতে পারল ও আমাদের সুখের সংসারে ভাগ বসাতে এসেছে, তখন কার্তিকের মাথাটা বিগড়ে গেলো। পুরনো স্বভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো তার ।


     কার্তিক প্রথম যৌবনে ছিল ফাঁসিতলার এক নম্বরের গুন্ডা। এহেন কাজ নেই যা সে করেনি ।কতো লোককে যে নিজ হাতে ফাঁসির দড়ি পরিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । সবুজ দ্বীপের নদীর ধারে পুঁতে দিয়েছে। কথায় কথায় চেম্বার বের করে মাথায় ঠেকিয়ে ওপারে পাঠানোর হুমকি দিয়েছে । সুপ্রিয়ার মামা তথা শশাঙ্কবাবুর পোষা গুন্ডা এই কার্তিক । শশাঙ্ক ভেবেছিলো কার্তিকের সঙ্গে যদি ভাগ্নি সুভাষীনীর বিয়ে দিয়ে দিই তবে সব সময় ওকে ব্যবহার করতে পারবো । বাড়িতে সবসময়ের জন্য তৈরী থাকবে তার হাতিয়ার। রাজনীতি করতে গেলে এই সব কার্তিঁকদের বিশেষ প্রয়োজন হয় । বুথ দখল, পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালানো ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে অকারণে এরাই প্রধান হাতিয়ার। কার্তিকের দৌলতেই শশাঙ্ক মামা হতে পেরেছিলেন চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের জামাই বলে কথা। জামাই হওয়ার সুবাদে বহু পয়সা এদিকে সেদিকে লুটে নিয়েছে । তবে এখন এইসব ছেড়ে দিয়েছে । মামা তার সাগরেদের সবাইকে কিছু না কিছু পেটের ভাত খাওয়ার মত কাজ জুটিয়ে দিয়েছে । এখানে সেখানে লাগিয়ে দিয়েছে । অনেকেই নিমকহারাম হয়ে যায়। কিন্তু মামা এ কাজ করে নি ।সব ক্যাডারদের খুশি করতে যতোটুকু পেরেছেন ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন । অনেকের ভোটে জেতার পর কিছু মনে থাকেনা। কিন্তু চালাক মামা আগামী ভোটের সময় যাতে মাটি খুঁজে না বেড়াতে হয় তার ব্যাবস্হা করে রেখেছেন।


     


    কার্তিক ও সুভাষিনী রাতের বেলায় ফিসফিস করে বলে হ্যাঁ গো শুনেছিলাম গোটা বাড়িটাই নাকি আমাদের হবে ?কিন্তু তো এখন দেখছি এটা ভাগাভাগি হবে।চোখ লাল করে সুভাষীনীকে বলে" মন খারাপ হয়েছে বাবা দু-পাঁচ দিন থাকবি খাবি- দাবি আবার যে গোহালের গরু সেই গোহালে গিয়ে উঠবি ।তা- না একেবারে পাকা পাকি ভাবে থাকার পরিকল্পনা।! কেমন মজা ! শালা নিজের বাড়ি হবে বলে কতো যত্ন করে বাড়িটাকে ঝকঝকে করে রেখেছি।


 থাম মজা দেখাচ্ছি। সাহস তো মন্দ নয়।সুভাষীনী তুমি যদি সাপোর্ট করো তোমার অবস্থা কেমন হবে তুমি বুঝতে পারছো তো?


         সুভাষিনীকে বলে , শোনো--- এই শোনো না ---। 


আরে বাবা আমি তো শুনছি । বলোনা --!


 আরে একটু কাছে এসো --- আরও কাছে---- আরও কাছে ---।


কেন এই তো একেবারেই কাছে আছি বলোনা ----। শুনছি তো ।আমি কি তোমার মতো ঠসা নাকি?


  আরে না না বলছি-- আমার দারুন একটা আইডিয়া এসেছে মাথায় ।এই বলে জোর করে সুভাষীনী কে জড়িয়ে ধরে এক্কেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওকে যদি সরিয়ে দিতে পারি তবে গোটা বাড়িটায় আমাদের হবে। শুনেই প্রথমে আঁৎকে উঠেছিল সে। হাজার নিজের মায়ের পেটের বোন তো বটে । তারপর বলল তা কেমন করে সরাবে শুনি?


বাড়ি আর সম্পত্তি পাওয়ার নেশায় বোধবুদ্ধি লোপ পেতে বসেছে কার্তিকের।


 তোমার দিদির তো জ্বর হয়েছে। ডাক্তারের কাছে গেছে ওষুধ আনতে। আনুক না ওষুধ। ওই ওষুধ ই হবে আমাদের তুরূপের তাস।ওই ওষুধের শিশিতেই সব সমস্যার সমাধান লিখা আছে প্রিয়তমা সুভাষীনী । নিশ্চয়ই কাসি যখন হয়েছে তখন শিরাপ তো অবশ্যই দিবে । ওই শিরাপের শিশিতেই দিবো বিষ মিশিয়ে! তারপরে চিন্তা করতে হবেনা।


 সমস্ত সম্পত্তি পাওয়ার আনন্দে কার্তিক সুভাষীনীকে জড়িয়ে ধরে চুমু চুমুতে ভরিয়ে দিল ।সব লাজলজ্জা কে বিসর্জন দিয়েছে কার্তিক ।


হঠাৎ তোমার ভালোবাসা উৎলে উঠেছে কেন আজ? অনেক দিন তো বিয়ে হয়েছে ।এমন করে তো একদিন ও জড়িয়ে ধরে চুমু খাওনি । কার্তিকের মন গেয়ে উঠছে "আজ কি আনন্দ আকাশে বাতাসে "-------


পরামর্শ মতো কার্তিক সুপ্রিয়ার শিরাপের শিশিতে দিল তীব্র বিশ মিশিয়ে । নিয়তির কি নিঠুর খেলা । যে এলো বাবার বাড়ি একটু বাঁচার আশায় তাকেই কি না মেরে ফেলার চক্রান্ত।হায় রে নিয়তি।


 নিয়তি ও দরজার আড়ালে মুখ টিপে টিপে হাসছে।


  ওষুধ খাচ্ছি বলে রাতের বেলা টেবিলের উপর ওষুধ রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সুপ্রিয়া। সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীর । পেটে খাবার পড়াতেই চোখে নেমে এসেছে রাজ্যের ঘুম । কতোদিন যে ভালো ভাবে ঘুমাতে পারে নি ওই মাতালটার অত্যাচারে ।দরজা খোলা পেয়ে ঘরে ঢুকেছিল বিড়াল ।এক লাফে টেবিলে উঠতেই শিরাপের শিশিটা গেল মেঝেতে পড়ে । শিশি ভেঙে শিরাপ ঘরময় পড়লো ছড়িয়ে । মিষ্টি জিনিসের গন্ধ পেয়ে বিড়ালে মজা করে খেয়েছে । পিঁপড়া আরশোলারাও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বিষের দাপটে ।তারপর মিয়াঁও মিয়াঁও করে ঘরময় দাপাদাপি করতে শুরু করে ।সেই সঙ্গে মুখে গ্যাঁজলা উঠে সাঙ্গ হলো বিড়ালের ইহলীলা। 




      সুপ্রিয়া ঘুম থেকে উঠে দেখে পড়ে থাকা শিরাপের পাশে মুখে গ্যাঁজলা বেরিয়ে পড়ে আছে বিড়ালটা । ঘরের চেহারা দেখে হতবাক হয়ে গেছে সুপ্রিয়া । আঁচ করতে পেরেছে এদের অভিসন্ধি। এখানে থাকা তার মোটেই সমীচীন হবে না ।মনের যন্ত্রণাকে দমিয়ে রেখে বিছানা থেকে উঠে একেবারে থানা।


 সাতসকালে মেয়ে মানুষকে থানায় দেখে কর্তব্যরত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন এতো ভোরে ভোরে এখানে কেন ?কোনো অঘটন ঘটেছে নাকি ? সুপ্রিয়া তখন হাউমাউ করে কেঁদে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে ফেললো সব ঘটনা।


    অন্য মানুষের কথায় হয়তো সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত করতে পাঠাতেন না । কেননা এমন ঘটনা তো হামেশাই ঘটছে ।এ আবার নতুন কি?


তবে মেয়ে ছেলে বলে কথা। ডাগর মেয়ে দেখলেই তো কর্তব্য বোধ উৎলে ওঠে অনেকের ।ও সি সাহেবের দরদ ও একই ফর্মুলায় উৎলে উঠলো। পাশে ছোটবাবু ঢুলছিলেন । ঝাঁঝাঁলো গলায় ডাক দিতেই ছোট বাবু ধড়ফড় করে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠলেন।


কি আপদ মাইরী।একটু ঘুমোতে ও দিবেন না।এই তো দুঘন্টা আগে হোটেল রেড করে বাড়ি ফিরলাম ।


কি হলো বলুন? 


ছোট বাবু একটু যান তো মেয়েটার সাথে। 


গাড়ি নিতে হবে নাকি ? 


না না এই তো কাছেই।


থানার পাঁচ ছ 'টি বাড়ির পরে। 


অগত্যা বড়ো বাবুর হুকুম মেনে সুপ্রিয়ার পেছনে পেছনে হাজির হলেন কার্তিকের বাড়ি।


   ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলেন সুপ্রিয়ার বিবরণ মতো ঘটনা ।


    কার্তিকের ঘরের দরজা ঠক ঠক করে ওঠানো হলো বাবুদের।সব পাওয়ার নেশায় একটু রঙিন ও হয়েছিল দুজনে। মিষ্টি মিষ্টি রামের গন্ধ তখন ও ঘরময় ম ম করছে। পুলিশের শব্দ শুনে অগোছালো শাড়ী নিয়ে সুভাষীনী খুললো দরজা।


ছোট বাবু ওদের কিছু বোঝার আগেই দুজনের হাতে হাত কড়া পড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে চললো থানায়...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024