সম্পর্কের ভাঙাগড়া - অসিত কুমার পাল || Somporker vanga gora - Asit Kumar pal || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

সম্পর্কের ভাঙাগড়া

               অসিত কুমার পাল



 রাধিকা আর নবীনের বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার রায়ের কাগজপত্র আজ পাওয়া গেছে । সেগুলো হাতে নিয়ে দুজনে একসঙ্গেই আদালত থেকে বেরিয়ে এল । দুজনেরই হাসিমুখ দেখে নিজের নিজের আত্মীয় বন্ধুদের মুখেও হাসি দেখা দিল।

 চার বছরের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে আজ আদালতে তাদের বিচ্ছেদ মঞ্জুর হয়েছে .

দশ বছর আগে ওদের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু ছ বছরের বেশি তারা একত্রে থাকতে পারে নি , শেষ চার বছর তো মামলা লড়তে লড়তেই কেটেছে ।


  বিয়ের সময়ে রাধিকার বাবা পণ বাবদ যে সব জিনিসপত্র দিয়েছিল তার একটা তালিকা রাধিকার হাতে ধরা আছে । নবীনের বাড়িতে গিয়ে তালিকা মিলিয়ে সেগুলো ফেরত নিতে হবে । তেমনই নবীনের হাতে ছিল সেসব গহনার তালিকা যেগুলো বিয়ের পরে নবীন রাধিকাকে দিয়েছিল । সেগুলোও তো ফেরত নিতে হবে ।


এছাড়াও আদালতের আদেশ অনুযায়ী নবীনকে খোরপোষ বাবদ রাধিকাকে এক কালীন দশ লাখ টাকা দিতে হবে । রাধিকা নবীনের সাথে একই অটোরিক্সায় চেপে নবীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল কারণ তাকে পনের জিনিসপত্রগুলো চিনে নিতে হবে । চার বছর পরে রাধিকা স্বশুর বাড়িতে যাচ্ছে , সম্ববত শেষ বারের মত ।


 আত্মীয় বন্ধুরা যে যার বাড়িতে ফিরে গেছে , কেবল নবীন রাধিকা আর রাধিকার মা থেকে গেছে । এখন থেকে নবীন তার ঘরে একাই থাকবে কারণ তার বাবা মা ভাই গ্রামের বাড়িতেই থাকে ।


আদালতের রায় অনুযায়ী নবীন আর রাধিকার একমাত্র সাত বছর বয়সী ছেলে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তার মায়ের তত্বাবধানে থাকবে । নবীন মাসে একদিন তাকে দেখতে যেতে পারবে ।


নবীনের বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র রাধিকার পুরানো দিনের নানা কথা মনে পড়ল । সে কত পরিশ্রম করে ঘর সাজিয়ে তুলেছিল ।

প্রতিটি জিনিসের সাথে তার স্মৃতি জড়িয়ে আছে । ঘরের প্রতিটি ইট তার চেনা । এই ঘর তার স্বপ্নের ঘর ছিল । নবীন খুশিমনে তার স্বপ্নকে রূপ দিয়েছিল ।


নবীন ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফার উপরে বসে পড়ল। রাধিকাকে বলল - তুমি যা চাও সব নিয়ে যাও । রাধিকা অন্য দৃষ্টি দিয়ে নবীনের দিকে তাকাল , তার মনে হল গত চার বছরে নবীন অনেক বদলে গেছে । তার চুলে পাক ধরেছে, শরীর ও অনেকটা ভেঙে গেছ, দেহের ঔজ্বল্য হারিয়ে গেছে ।


 পণে র জিনিসপত্র যে ঘরে রাখা আছে রাধিকা সেদিকে এগিয়ে গেল । বেশিরভাগ জিনিসই পুরানো ধাঁচের বলে সেগুলো অচল জিনিসপত্রের সাথে গুদাম ঘরেই রেখে দেওয়া হয়েছিল । অবশ্য পণ হিসাবে তেমন কিছু জিনিস দেওয়া হয়নি । ওরা প্রেম করেই বিয়ে করেছিল , দুই পরিবার বাধ্য হয়েই ওদের বিয়েটা দিয়েছিল । কিন্তু তাতেই বোধ হয় কারো কুনজর পড়েছিল । অনেকেই চায় এ ধরনের বিয়ে ভেঙে যাক ।


 একবার নবীন মদ্যপান করে মাতাল হয়ে পড়েছিল , একটা কারনে রেগে গিয়ে রাধিকার গায়ে হাত তুলেছিল । আর তাতেই রাধিকা ক্রুদ্ধ হয়ে নবীনের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল ।

এরপরে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিল , একদিকে নবীনের দাদা বৌদি আর অন্য দিকে রাধিকার মা তাতে সামিল হয়েছিল । কিন্তু নবীন তাকে ফিরিয়ে আনতে যায়নি , রাধিকাও ফিরে আসেনি । শেষ পর্যন্ত নবীন আদালতে গিয়েছিল যার অন্তিম পরিণতি এই ডিভোর্স ।


 রাধিকার মা বলল - তোর জিনিসপত্র সব কোথায় ? মাতালটা বিক্রি করে দেয়নি তো ? নবীন মাতাল বলা টা রাধিকার ভাল লাগেনি । সে রেগে উঠে বলল - তুমি চুপ করে থাক ।

এর পরে সে গুদাম ঘর থেকে তালিকা মিলিয়ে নিজের জিনিসপত্র খুঁজে বের করল । বাকি কিছু জিনিস অন্য ঘরে আছে । রাধিকা কেবল নিজের জিনিসপত্র বেছে নিল , নবীনের জিনিসপত্র ছুঁয়েও দেখল না । তার পরে নবীনের দেওয়া গহনাগুলো যে ব্যাগে ছিল সেটা নবীনের হাতে ধরিয়ে দিল । নবীন সেটা আবার রাধিকার হতে দিয়ে বলল - রেখে দাও ।


 আমার তো কোন কাজে লাগবে না , বরং দরকারে তোমার কাজে লাগবে । ঘনাগুলোরর দাম কম করেও পনেরো লাখ হবে । রাধিকা বলল - আমি রাখব কেন ? আদালতে তো তোমার উকিল বারবার গহনা গহনা বলে চিৎকার করছিল ।


নবীন বলল - আদালতের কথা আদালতেই মিটে গেছে । তোমার উকিল ও তো আমাকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জানোয়ার বলে প্রমাণ করে দিয়েছে । এবার রাধিকার মা নাক গলাল - কোন দরকার নেই । এমনকি খোরপোষের দশ লাখ টাকাও দিতে হবে না ।


 নবীন জোর গলায় বলল - কেন ?

রাধিকা অন্য দিকে মুখ করে বলল - এমনিই ।

 নবীন বলল - তোমার বয়স বেশি নয় , এখনো বহুদিন বাঁচবে । ওগুলো নিয়ে নেওয়াই ভাল । নবীনের চোখ জলে ভরে গিয়েছিল সেটা লুকোতে নবীন অন্য ঘরে চলে গেল । রাধিকার মা ফোন করে একটা গাড়ি ডাকার জন্য ব্যস্ত ছিল । রাধিকা এই সুযোগে নবীনের পিছনে পিছনে গেল ।


দুজনেই কাঁদছিল আর সেই কান্না চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল । রাধিকা নবীনকে কখনো কাঁদতে দেখেনি । আজ প্রথমবার তাকে কাঁদতে দেখে তার মন নরম হয়ে গেল । কিন্তু তার মনোভাব প্রকাশ করল না । কেবল শান্তভাবে বলল - আমার কথা এত যদি ভাব তাহলে ডিভোর্স দিলে কেন ?


 নবীন বলল - আমি নয় তুমিই ডিভোর্স দিয়েছ ।

রাধিকা বলল - তুমিও তো দরখাস্তের সই করেছিলে । 

- তুমি একবার ক্ষমা চাইতে পারতে তো ?

- তুমি তো সে সুযোগ দাওনি । ফোন করলে কেটে দিতে ।

- বাড়িতে চলে আসতে পারতে ।

- সাহস হয় নি ।


 এই সময়ে রাধিকার মা এসে তার হাত ধরে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বলল - এখন কান্নাকাটি করে লাভ কি । সম্পর্ক তো শেষ হয়ে গেছে ।

 তারা দুজনে বারান্দায় রাখা সোফায় বসে গাড়ির অপেক্ষা করতে লাগল ।


রাধিকার বুক ফেটে যাচ্ছিল । সে একমনে সোফার দিকে তাকিয়ে থাকল । দুজনেই অনেকদিন ধরে সংসার খরচ বাঁচিয়ে নানা দোকান ঘুরে সোফা টি পছন্দ করেছিল ।

এর পর তার দৃষ্টি পড়ল উঠানের একপাশে তুলসী মঞ্চের শুকনো গাছটির উপরে । সে অনেক যত্নে গাছটি বাঁচিয়ে রেখেছিল ।


 অস্থিরতা নিয়ে সে সোফা থেকে উঠে আবার নবীনের ঘরে গিয়ে ঢুকল । মা ডাকলেও রাধিকা সাড়া দিল না । নবীন তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল । রাধিকার মায়া হল , কিন্তু সবকিছু তো শেষ ই হয়ে গেছে । সে ঘরের এদিকে ওদিকে চোখ বোলাল । পুরো ঘরটা অগোছালো হয়ে আছে । কোণের দিকে মাকরসা জাল বুনেছে । অথচ সে মাকড়সা কে কত ভয় পেত ।


এর পর তার নজর গেল দেওয়ালে টাঙানো ছবি গুলোর দিকে যাতে নবীনকে জড়িয়ে ধরে রাধিকাকে হাসতে দেখা যাচ্ছে । সেসব দিনগুলো কত সুখের ছিল । মা আবার এসে রাধিকার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেল । বাইরে গাড়ি এসে গেল । মালপত্র গাড়িতে তোলা হল । কিন্তু রাধিকা শূন্য মন নিয়ে বসেই রইল । গাড়ির শব্দ পেয়ে নবীন বাইরে এল । হঠাৎ সে কান ধরে রাধিকার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বলল - আমাকে ক্ষমা কর । তুমি যেও না ।


 রাধিকা বোধ হয় এই কথাগুলো শোনার অপেক্ষাতেই ছিল । তার মনের সমস্ত বাধা দুর হয়ে গেল । রাধিকা তার হাতে ধরা আদালতের রাতের কপি ছিঁড়ে ফেলল ।

আর মা কিছু বলার আগেই সে নবীনকে বুকে জড়িয়ে ধরল । দুজনেই সমান ভাবে কেঁদে যাচ্ছিল ।


দূরে দাঁড়িয়ে রাধিকার মা সবকিছু বুঝতে পারল আদালতের রায়ের থেকে মানুষের মনের রায়ের মুল্য অনেক বেশি । তারা সেটা আগে বুঝতে পারেনি । ক্ষমা চাইলেই যদি ভাঙ্গা সম্পর্ক জুড়ে যায় তাহলে ক্ষমা চাওয়াটাই ভাল ।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024