কুমুদ কথায় অজয় - তন্ময় কবিরাজ || Kumud Kothay Ajay - Tanmay Kabiraj || প্রবন্ধ || Article || নিবন্ধ

 কুমুদ কথায় অজয়

        তন্ময় কবিরাজ



"ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, বলো কোথায় তোমার দেশ তোমার নেই কি চলার শেষ ও নদীরে..."হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই কালজয়ী গানের কথাই মনে এলো কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের সঙ্গে অজয় নদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে। কারন কবি কুমুদ রঞ্জনের জীবনে মিশে গেছে অজয়ের স্রোত। রূপসী বাংলার মাধুর্য্য খুঁজতে গিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ পেয়েছিলেন গাঙ্গুর- বেহুলা, জীবন সংগ্রামের ইতিকথার জীবন্ত দলিল হয়ে রয়েছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা, বা কখনও তারাশঙ্করের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা। কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের কাছে নদী কেবল চলমান স্রোতের গতিধারা নয়,তিনি অজয়ের মধ্যেই গ্রামীণ জীবনের উঠানামার গল্প রচনা করেছেন। অজয় কবি কুমুদ রঞ্জনের সুখের কাব্যিক মেটাফরে সীমাবন্ধ থাকেনি, বরং পথচলতি জীবনের সাক্ষ্য বহন করা বন্ধু। তাই হাজার বিপত্তি কাটিয়ে তিনি বলেন,"অভয় মাগি মনের কথা বলতে পারি কি/উজানি আর অজয় আমার প্রাণের সামগ্রী।"কবিতায় আমার শব্দের অর্থ শুধু ব্যক্তি কবিই নন, বরং তার সঙ্গে জড়িত নদী তীরবর্তী জীবন। নদীর বাধা থাকলেও নদী মাত্রিক বাংলাদেশে নদীকে ছাড়া জীবন কল্পনা করা যায় না। আয়ারল্যান্ডের "রাইডার্স টু দ্যা সী" নাটকে মরিয়া নদীতে তাঁর সব সন্তানদের তিনি হারিয়েছেন, আবার নদীই তাঁর জীবিকার উৎস। নিয়তির এই দেওয়া নেওয়ার মধ্যেই এক স্বতন্ত্র জীবন বয়ে চলে যাকে যুক্তি বুদ্ধিতে সবসময় গ্রহণ করা অসম্ভব। কবি কুমুদ রঞ্জন তাঁর প্রিয় অজয়ের উদ্দেশ্যে লিখছেন,"অজয় আমার ভাঙবে গৃহ, হয়তো দুদিন বই/তবু তাহার প্রীতির বাঁধন টুটতে পারি কই?/সে তো কেবল নদ নহেক, নয়ক সে জল/সে তরল গীতগোবিন্দ চৈতন্যমঙ্গল।"অজয়ের বানের ভাঙন আসবেই। জীবনের দুর্দশার কাছে মানুষের কি করার আছে? নিয়তির কাছে সব সঁপে দিলেই সবাইকে ভালবাসা যায়। কারন কবি জানেন,এই অজয়ের তীরে জয়দেবের গীতগোবিন্দ, আবার এই অজয়ের কৃপায় "বনকে করে শ্যামল এবং মনকে করে সমৃদ্ধি।"কবি অজয়ের তীরে যেমন গ্রাম্য জীবনকে উপভোগ করেছেন, তেমনই অজয়ের ধারে তিনি খুজেঁ বেড়িয়েছেন ইতিহাসের গলিপথ। অজয় যেনো কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের বারানসির গঙ্গা , যার তীরে কাশী বিশ্বনাথ থেকে মনিকর্নিকার চির আগুনে মিশে গেছে পুরাণের সঙ্গে বিশ্বাস যা আজও প্রবাহমান। অজয়ই হয়ে উঠেছে কবির কাব্য প্রেরণা, মঙ্গল বৈষ্ণব কাব্যের আঁতুড়ঘর।তিনি তাঁর "লোচনদাস" কবিতায় লিখেছিলেন,"অজয়ের তীরে রহিতেন কবি পর্ণকুটিরবাসী/লোষ্ট্র সমান দূরে কত ত্যক্ত বিভর রাশি।"শুধু অজয়কে ভালোবেসে তিনি তাঁর কবিতায় ছন্দে এনেছেন পরিবর্তন, উপমা হয়েছে সহজ সরল, আরোও শ্রুতিমধুর। বক্তব্যের বিষয়কে কবি একই রেখে দিয়েছেন, শুধু পরিবেশনে এনেছেন নতুনত্ব। তাই কুমুদ রঞ্জনের কবিতায় ক্লান্তি নেই। বরং নতুনের স্বাদে আরোও কিছুটা সময় অজয়ে ডুবে থাকা যায় অরূপ রতনের আশায়। "আমাদের সঙ্গী" কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"অজয়ের ভাঙনেতে করে বাড়ি ভঙ্গ/তবু নিতি নিতি হেরি নব নব রঙ্গ।"কবিতায় উঠে এসেছে কবির নিজের কথা। নদীর সঙ্গে লড়াই করার ইতি বৃত্তান্ত।' আমার বাড়ি "কবিতায় সেই কথাই প্রতিফলিত হয়েছে,"বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদীর বাঁকে/জল সেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে।"আবার কখনও ভাঙনের গল্প ভুলে কবি হারিয়ে যায় হারান দিনের নস্টালজিয়াতে। অজয় নদের অ্যালবামে সযত্নে লালিত শৈশবের ফেলে আসা দিনলিপি। তাই "বকুল তরু "কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"পাঁচশো বছর হেতাই ছিল প্রাচীণ বকুলগাছ/অজয় নদের ভাঙনেতে পড়লে ভেঙ্গে যায়।"শৈশব যেমন অজয়কে দেখেছে, তেমনই অজয়ও আসতে আসতে মুছে দিচ্ছে ছেলেবেলার সব স্মৃতি।অভিমান যন্ত্রণার মধ্যে নদী বড়োই নীরব। দুজন দুজনের সমান্তরালে হেঁটে গেলেও কেউ কারো খবর রাখে না। তবু জীবন আর নদীর নিবিড় সম্পর্কের যে দর্শন রচিত হয় তার টানেই সভ্যতার ভীত গড়ে উঠে এই নদের তীরে।বড়ো বিচিত্র। বড়ো মোহময় নিজেকে জানা, নিজেকে চেনা।যাকে দেখে অভিমান বাসা বাঁধে, আবার তার জীর্ণ রুগ্ন অবস্থায় মন খারাপ করে।" শীতের অজয়' কবিতায় কবি সমব্যাথী হয়েছেন কারন শুকনো অজয়ের আজ জলধারা স্থিমিত। তাঁর কল্পনায় অজয় তো শিশু যার বিকাশে দরকার মায়ের স্নেহ ভালবাসার পরশ। অনাহারে জীর্ণ অজয়কে দেখে কবির হৃদয় আন্দোলিত হয় কারন অজয় তাঁর প্রানের প্রতিবেশী।কবি স্বার্থপর নয়।প্রতিবেশীর কষ্টে তাঁর মন কাঁদে।তিনি লেখেন,"সিকতায় লীন শীর্ণ সলিল ধারা/আজ জননীর স্নেহ হতে যেন হারা।"কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক মনে করেন,তিনি তাঁর ভাবনায় সুখী।তিনি তো কবি। আর চিন্তা মননের পথেই তো একজন কবি হেঁটে বেড়ান, আনন্দ উপভোগ করেন যা পরবর্তীকালে পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।" কবিতার সুখ "কবিতায় তাই কুমুদ রঞ্জন স্বীকার করেন,"কবিতা লিখিয়া পাইনি অর্থ, পাইনি নি কোনো খ্যাতি ভাই/হয়েছি স্বপ্ন বিলাসী অলস অনিযোগ দিবারাতি তাই।"কবি প্রাসঙ্গিক দ্বন্দ্ব বা বিষয়কে তুলেছেন - খ্যাতি বনাম সুখ।তিনি অর্থের মধ্যে জীবনকে দেখতে পাননি। নীরব বস্তুতে পরখ করেছেন প্রাণের স্পন্দন, যেখানে চলে হৃদয়ের দেওয়া নেওয়া। কবি কুমুদ রঞ্জনের সৃষ্টিতে রয়েছে সংশয়।তিনি বিশ্বাস করেন না, তাঁর কবিতা পাঠযোগ্য। "কবিমানস" কবিতায় তিনি প্রশ্ন তোলেন,"বন্ধুরা কন আমার কবিতা কেহই পড়ে না শুনি/পড়িবার মত কি আছে তাহাতে কেন পড়িবেন শুনি।"টু বি আর নোট টু বি এর শ্বাশত দ্বন্দ্বের প্রতিমূর্তি তিনি।মনের ভেতরে অবিরাম কনফ্লিক্ট এর গতিতে সৃষ্টি হয় একের পর এক অনবদ্য সব কবিতা। থেমে যাওয়া নয়, প্রতিদিন জীবনকে শুধরে নিয়ে এগিয়ে যাবার কথাই বলতে ভালোবাসেন কবি কুমুদ রঞ্জন। কবি দেখেছেন, নদীকে ঘিরে রাজনীতি,সামাজিক শোষণ। বন্যার কবলে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান যখন শাসকের রাজধর্ম তখন সেই শাসকই তার প্রজাকে অনুগত ভৃতে পরিনত করে, যাতে সে তার মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। বারবার বন্যা হয়েছে। অতি বৃষ্টিতে সেটাই স্বাভাবিক। দরকার নদী সংস্কার।কবি বলছেন,"বন্যা হয়েছে হয়েছে এবং প্রতিকার নাই যবে।"বন্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থা কবি তাই নিজেই বলে দিচ্ছেন,"ফায়ার ব্রিগেডের সঙ্গে বন্যা ব্রিগেড গড়িতে হবে।"কারন কবি মনে করেন, গ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামই সভ্যতার সোপান। শাসককে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।"পল্লী হতেছে অবাসযোগ্য রুক্ষ হে ভগবান/শহর বাঁচুক সঙ্গে তাহার পল্লীকে বাঁচাইও/.. রিলিফ আসিছে ভিক্ষা আলিছে কম্বল পিছু পিছু।"বন্যতে জীবন দুর্বিষহ, গৃহহীন, ভেসে গেছে বসতবাড়ি। "অজয়ের প্রতি" কবিতায় কবি প্রতিবাদ করেন তাঁর প্রিয় অজয়ের বিরূদ্ধে,"তোমার এ বারি নয় তো অজয় - এ বারি গরল ভরা/তোমার স্নেহের কনা নাই এতে এ শুধু বিষের ছড়া।"কবি বিশ্বাস করতে পারছেন না ভালবাসা এতো নির্মম।প্রেম যেমন গড়তে জানে তেমনই ভাঙতেও জানে। শূন্যতায় যে যাত্রার শুরু শূন্যতাতেই তার ইতি। দর্শন সরণে এ পদার্থবিদ্যা বড্ড জটিল অথচ মৌলিক। তাই আক্ষেপের মধ্যেও ত্যাগের বার্তা লুকিয়ে,"কতো বার বাড়ী ভাঙ্গিলে তুমি হে - গড়ি বা আমি কত/বিপদ যে তোমার দুর্দমনীয় - বড়োই অসংগত।"কবি কুমুদ রঞ্জনের কবিতায় তাই পল্লীজীবনের সাহিত্য ভাবনায় যেমন প্রাণের বাংলার প্রতি তাঁর স্নেহ ভালবাসাকে উজার করে দিয়েছেন আবার কখনও সমাজজীবনে তিনিই রচনা করেছেন ব্যঙ্গ কাব্য।রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যের স্বাদে ফিরে যান সাবেক বাংলার তুলসিমঞ্চ, সন্ধ্যা প্রদীপ,মঙ্গল শঙ্খর ইতিহাসে। তবে এতো কথা,এতো গল্পের আড়ালে বয়ে গেছে অজয়, এ যেন ব্রিটিশ কবি ওয়ার্দওয়ার্থের টেমসের রূপকথা। কবি কুমুদ রঞ্জনের আর অজয় সমার্থক। অজয়ের পাড়েই বসেই তার জেগে উঠে বাঙালি সত্তা। তিনি লেখেন,"আমরা বাঙালি হয়তো বা বটি দুষি/মোদের নিন্দাকে যার যত খুশী।"অজয়কেই তিনি তাঁর সব অব্যাক্ত ব্যাক্ত করেছেন। কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের কাছে অজয়ই সেই ক্ষুধিত পাষাণ বা জসীমউদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ যা আজও প্রবাহের স্রোতে কথা বলে যায়।




বিষয়: রূপসী বাংলার জসীমউদ্দীন


ভালবাসা অন্ধ? এ প্রশ্নের উত্তর কি হবে তা আমার জানা নেই। তবে গ্রামবাংলাকে ভালোবেসে কবি জসীমউদ্দীন যে আবেগ উজাড় করে দিয়েছেন তাতে তিনি সত্যিই অন্ধ।তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত গ্রাম্য জীবনের জটিলতা, আর্থ সামাজিক অস্থিরতা কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় নেই।তিনি রূপসী বাংলার কাছে সঁপে দিয়েছেন নিজেকে। বাংলার প্রতি তাঁর ভালবাসাই প্রধান হয়ে উঠেছে। তাঁর বর্ণনায় আড়ালে উঁকি দিয়েছে কিছু সাময়িক অস্থিরতা। কখনও কবিতায় শোনা যায়, লালনের মত বৈরাগী জীবনের কথা।কবি বাংলার অলিগলি হেঁটে গেছেন শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করবেন বলে। "মুসাফির "কবিতায় কবি জসীমউদ্দীন লিখেছিলেন,"চলে মুসাফির গাহি/এ জীবন ব্যাথা আছে শুধু, ব্যাথার দোসর নাহি/... হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি, কেউ নাই শুনিবার।"কাব্যিক অলঙ্কারে আলিটারেশন,কখনও অ্যন্টিথেসিসে মিশে গেছে "আছে - নাহি"শব্দের রসায়ন,

প্রকট হয়েছে দর্শন - সমস্যাময় জীবনে সমাধান নেই, কথা আছে অথচ কথা বলার বা শোনার মত মানুষ নেই। সৌন্দর্যে ডুবে থাকা কবি জসীমউদ্দীনের এইরূপ হৃদয় যন্ত্রণা হয়তো অনেকের কাছেই অপরিচিত। সৌন্দর্য বোধ কবির চিন্তনে ভাবনার জন্ম দেয়। ব্যক্তি জসীমউদ্দীন থেকে তিনি হয়ে উঠেন দার্শনিক যার স্বাদ তখন সর্বজনীন। বাংলার মেয়েদের তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন, বর্ণনা করেছেন সহজ ভাষায়। যৌনতার প্রলেপ নেই, রয়েছে তাকিয়ে থাকার আনন্দ।তিনি তাঁর সৃষ্টিতে পাঠকের মনে উত্তেজনার বীজ বপন করেননি, বরং ভালোবাসার সহজপাঠ রচনা করেছেন। ব্রিটিশ কবি ওয়াডসওয়ার্থ যেমন প্রকৃতিকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যান লুসিতে বা নির্জন উপত্যকায় গান গাওয়া মেয়েটির মধ্যে, কবি জসীমউদ্দীনও মনে করতেন, বাংলার মেয়েরাই অপরূপ বাংলার মানবিক প্রতিমূর্তি। কল্যানী কবিতায় কবি লিখেছিলেন,"শোন, শোন মেয়ে, কার ঘর তুমি জড়ায়াছ জোছনায়/রাঙা অনুরাগ ছরায়েছ তুমি কার মেহেদির ছায়।"অপূর্ব শব্দের বাহারি যুগলবন্দিতে কবি মেয়েদের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। কখনও তিনি বলেছেন,"পড়শীরা কয় মেয়ে তো নয়, হলদে পাখির ছা /ডানা পালিয়ে যেতে ছেড়ে তাদের গাঁ।"মেয়েদের বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি মনখোলা, নিখুঁত।"ও গাঁর মেয়ে আসছিল নূপুর পরা পায়ে।"কবি কোনো পাউডার বিউটির কথা বলেননি। বরং বিভূতিভূষনের ভানুমতির মত নারী মিশে গেছে প্রকৃতির চেনা সোহাগে,যার ভালোবাসো অমলিন।কবি লিখছেন,"লাল মোরগের পাখার মত উড়ে তাহার শাড়ি।"অন্যদিকে গ্রাম্য জীবনের বিবাদও ধরা দিয়েছে তাঁর লেখায় মাঝেমধ্যে।"এ গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও গাঁর লোকের সনে/কাইজা ফ্যাসাদে করেছে যা জানেই জনে জনে।"বাংলার মেঠো আলপথে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। চলার পথে যখন যা দেখেছেন তখন তাই সংগ্রহ করে রেখেছেন মনের গোপন ঘরে। কারন তারাই কবির নীরব সময়ের আশীর্বাদ, কাব্যিকতার রসদ। চেনা জীবনকে আরোও সহজ সরস করে তুলতে তিনি তাঁর ছন্দ বর্ণনার রীতি ভেঙেছেন।পারিবারিক জীবনের মধ্যেও দেখেছেন শামুকের পায়ের অপূর্ব আলপনা।কবি লিখেছিলেন,"আমার বাড়ি ডালিম গাছে/ডালিম ফুলের হাসি/কাজলা দীঘির কালো জলে/হাঁসগুলো যায় ভাসি।"প্রকৃতির অলঙ্কারে সেজেছে মানুষ। মানুষ আর প্রকৃতি সব দ্বন্দ্ব ভুলে আনন্দের সংহতি রচনা করেছে। কাজল জলে হাঁসগুলো যখন ভেসে তখন কবি নস্টালজিক। অনেকেরই আবার কবি ইয়েটসের দ্যা উইল্ড সোয়ান অ্যাট কুলি কবিতার কথা মনে যায়।কবি জসীমউদ্দীন তো জীবনানন্দের রূপসী বাংলার প্রতিবেশী। জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে জীবনানন্দ আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন, কবিতায় এসেছিল চলমান জীবনের সব কথা,কিন্তু জসীমউদ্দীনের কবিতা রয়ে গেছে হারানো সুরেই, ফার ফ্রম দ্যা মাডিং ক্রাউড।তাই জসীমউদ্দীনের কবিতা পড়লে গ্রের এলিজির মত আমরাও হতভাগ্য গ্রাম্য জীবনের প্রতি সমব্যাথী হয়ে যাই।বনলতা সেন যদি জীবনানন্দকে শান্তি দিয়ে থাকে, তবে বাংলার অপার্থিব সৌন্দর্য কবি জসীমউদ্দীনকেও সেই শান্তি উপহার দিয়েছিল। কবি জন কিটসের টু ওয়ান হু হাস বিন লং ইন সিটি পেন্ট কবিতার আবেগ এসে ধরা দেয় জসীমউদ্দীনের ভালোবাসায়। তাঁর "নিমন্ত্রণ"এ সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না।"তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোটো গাঁয়।"


বাংলার প্রতি জসীমউদ্দীনের ছিল অহংকার।তিনি লিখেছিলেন,"চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।"প্রাক ব্রিটিশ রোমান্টিক কবিদের মত তিনি প্রকৃতির মধ্যে জীবনকে বোঝার চেস্টা করেছেন। কখনও মিশে গেছেন,তো কখনও আবার স্বতন্ত্র জীবনের সন্ধানে অন্যভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছেন।"চৈত্র গেলো ভীষণ খরায়, বোশেখে রোদ ফাটে।"মৌলিক ভাষার বানান তিনি ব্যবহার করেছেন। পাশপাশি, প্রকৃতির খামখেয়ালী চরিত্রেও তিনি সজাগ।"এই এক গাঁও মধ্যে ধু ধূ মাঠ/ধান কাউর লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ।"ইতিহাসের মুখবন্ধে লেখা থাকবে এ কথা কারন সভ্যতা তখনও গ্রামীণ জীবনে অগ্রসর হতে পারেনি। চারদিকে মাঠ মাঝখানে গ্রাম। প্রকৃতির উদার যাতায়াতে নেই আধুনিকতার অনুপ্রবেশ।কবি প্রকৃতির অনাবিল সুখকে বিলিয়ে দিয়েছেন চেনা জীবনের স্রোতে।তিনি লিখেছিলেন,"কচি ধানের তুলতে চারা হয়তো কোনো চাষী/মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি।"সুখের চাহিদাতে প্রকৃতির হাতছানি।কবি বাংলার জীবন প্রকৃতির মধ্যে সুর খুঁজেছেন। গান তাঁর অন্যতম ভালো লাগা। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে জারি গান, মুর্শিদা গান।তিনি মানুষ হিসাবে প্রগতিশীল। অস্থির সময় তিনি দেখেছেন।তবু পল্লীবাংলাকে ভালবেসে সব ভুলে শান্তি পেয়েছেন। নজরুলের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন,রবীন্দ্রনাথের কাব্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতা। তাঁর কবিতা তো পল্লীজীবনের অ্যালবাম। নন্দলাল বসু বলেছিলেন, শিল্পবোধ তৈরি করতে হলে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক আরোও নিবিড় করতে হবে, তেমনি পল্লীবাংলার ইতিহাসের খোঁজ নিতে হলে আগামীতে চলে আসতে হবে জসীমউদ্দীনের কবিতার মিউজিয়ামে। সাবেক বাংলাই তো তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়।







Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024