স্বর্ণমণি - সিদ্ধার্থ সিংহ || Sawarna moni - Sidhartha singha || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প

 স্বর্ণমণি

সিদ্ধার্থ সিংহ



বাগানবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা রাখতেই সৌম্য বুঝতে পারল, স্বর্ণমণিকে কত লোক ভালবাসত। না হলে এইটুকু সময়ের মধ্যে এত লোক এসে জড়ো হয়! গোটা বাড়ি জুড়ে থিকথিক করছে লোক। তার মধ্যে আশপাশের মেয়ে-বউই বেশি। ও যে সবাইকে চেনে বা ওকেও যে সবাই চেনে, তা নয়। তবে স্বর্ণমণিকে নিশ্চয়ই এরা সবাই চেনে।


ও তখন মেজদির বাড়িতে রাখী পরতে গেছে। জামাইবাবুর আনা মটন বিরিয়ানি খেতে খেতেই শুনল মেজদির ফোনে রিং হচ্ছে। মেজদির কথা শুনেই বুঝতে পারল মাধুকাকা ফোন করেছে।

মা মারা যাওয়ার পর তাদের এই অকৃতদার কাকাই তাদের বারুইপুরের বাগানবাড়িতে থাকেন। পঁচাত্তর পেরিয়ে গেলেও শরীর এখনও যথেষ্ট সুঠাম। কিন্তু তিনি ওখানে একা থাকবেন কী করে! রান্নাবান্না কে করে দেবে! তাই খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের সংসাররের যাবতীয় কাজকর্ম যে দু'হাতে একাই সামলাচ্ছে, সেই স্বর্ণমণিকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওখানে।

খুব ছোটবেলায় বাপ-মা মরা পলাশীর এই মেয়েটিকে তার বৌদি এত অত্যাচার করত যে, সে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতার ট্রেনে চেপে বসেছিল। সেই ট্রেনে ছিলেন সৌম্যর মা।

সে বহু যুগ আগের কথা। সৌম্য তখন ফাইভ কি সিক্সে পড়ে।

ওর মা উলটো দিকের সিটে মেয়েটিকে ও ভাবে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কোথায় যাবে?

ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মেয়েটি কোনও রকমে বলেছিল, এই ট্রেনটা যেখানে যাবে সেখানে।

উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কোথায় থাকো?

ও বলেছিল, পলাশীতে।

--- তোমার নাম কি?

মেয়েটি বলেছিল, স্বর্ণ।

ওর মা জানতে চেয়েছিলেন, ওখানে কার কাছে যাবে?

মেয়েটির আমতা-আমতা করা দেখেই তিনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন, মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। দেখতে-শুনতে আদিবাসীদের মতো হলেও অল্প বয়স তো, চারিদিকে হাজার রকমের লোক ঘুরে বেড়ায়, কোথায় কখন কোন বিপদে পড়ে যাবে, তাই তাকে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের বলেছিলেন, এটা হচ্ছে তোদের একটা মণি। যেমন মাসিমণি, পিসিমণি, ঠিক তেমনি এটাও একটা মণি। তোরা ওকে মণি বলেই ডাকবি, বুঝেছিস?

কেউ কেউ মণি বললেও সৌম্য যেহেতু একটু পাকা ছিল, তাই মণি নয়, স্বর্ণকে স্বর্ণমণি বলেই ডাকত। আর স্বর্ণও তাদের এত ভালবেসে ফেলেছিল যে, আসার ক'দিন পর থেকেই তাদের সংসারটাকে নিজের সংসার মনে করেই দু'হাতে সামলাত। 


সৌম্যরা সব ক'টা ভাইবোনই পশুপাখি খুব ভালবাসে। তাদের কলকাতার বাড়িতে কুকুর, বিড়াল, টিয়াপাখি, কাকাতুয়া, খরগোশের পাশাপাশি সৌম্যর ভাই দর্শন একটা ছোট্ট বাঁদরের বাচ্চা পুষতে শুরু করেছিল। আদর করে নাম রেখেছিল র‍্যাঞ্চো।

দেখতে দেখতে তার বয়সও সাত-আট বছর হয়ে গেল। এত দিন কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু কিছু দিন আগে তাদের এলাকায় যখন বনদফতর থেকে ঘনঘন হানা দিতে শুরু করল, যে দিন তাদের পাড়া থেকে একজনের পোষা বাজপাখিটাকে জোর করে নিয়ে গেল, তখন ভয় পেয়ে তার পর দিনই ভোররাতে একটা ছোট্ট ম্যাটাডর ভাড়া করে খাঁচাশুদ্ধু র‍্যাঞ্চোকে নিয়ে বারুইপুরের বাগানবাড়িতে রেখে এসেছিল দর্শন।

না, এ বাঁদর, মানে র‍্যাঞ্চো কলা খায় না। দই খায়। শশা খায়। লিচুর সময় লিচু, আঁশফল, সন্দেশ, কড়াইশুঁটি, পেয়ারা।

সে দিন নাকি ওকে কিছুতেই খাওয়ানো যায়নি। স্বর্ণকে মাধুকাকা বলেছিলেন, এই দুপুরবেলায় ও না খেয়ে থাকবে! যা, ওকে তা হলে দুটো রসগোল্লা খাইয়ে আয়।

র‍্যাঞ্চো যখন কলকাতায় ছিল, ছাড়াই থাকত। দর্শনের বুক জড়িয়ে কিংবা কাঁধে চড়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত। শুধু সৌম্যদের বাড়ির লোকেরাই নয়, ওকে ভালবাসত পাড়ার প্রায় সকলেই।

দর্শনের খুব ন্যাওটা ছিল ও। খানিকক্ষণ না দেখলেই দর্শন যে যে জায়গায় আড্ডা দিত, হুটহাট করে সে সব জায়গায় চলে যেত। 

একদিন খুব ভোরবেলায় পাঁচিল টপকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল।

ওদের পাড়ায় ছিল মাদার ডেয়ারির একটি দোকান। যাঁরা দুধ দিতে আসতেন তাঁরা সবাই র‍্যাঞ্চোকে চিনতেন। কিন্তু সে দিন এসেছিলেন একদম নতুন একজন লোক। তিনি দুধের পাউচ ভর্তি ট্রে-টা মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘর্ষণের সেই বিচ্ছিরি আওয়াজ শুনে লোকটার দিকে তেড়ে গিয়েছিল র‍্যাঞ্চো।

বাঁদরটাকে ওই ভাবে তেড়ে আসতে দেখে লোকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যদি কামড়ে দেয়! তাই আগের দিন রাস্তার ধারে খুলে রাখা প্যান্ডেলের একটা বাঁশ তুলে সজোরে মেরেছিল বাঁদরটাকে। একটা নয়, পর পর বেশ কয়েক ঘা।

সেই যে লোকটা ওকে মারল, সে তো ওকে মেরে চলে গেল। আর তার পর থেকে কোনও লোক দেখলেই হল, তাকে কামড়ানোর জন্য তেড়ে যেতে লাগল। বাধা দিতে গিয়ে কামড় খেল দর্শনও। কামড়ে দিল বেশ কয়েক জন পথচলতি মানুষকেও।

বাঁদর পোষার জন্য তখন প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে দর্শনকে। পাশাপাশি দিতে হয়েছে তাদের যাবতীয় চিকিৎসার খরচ। তখনই ঠিক করা হয়, আবার কখন কাকে কামড়ে দেবে, তখন হয়তো শুধু ভর্তুকি দিলেই হবে না, এই নিয়ে থানা-পুলিশও হবে, তার চে' বরং ওর জন্য একটা খাঁচার ব্যবস্থা করি।

তখন ওদের মাথাটা কাজ করেনি, একবারও মনে হয়নি আর কিছু দিন পরে সে যখন আরও বড় হবে, তখন এই খাঁচাটা ওর তুলনায় ছোট হয়ে যাবে। তাই বারুইপুরে নিয়ে আসার পরে একটা পুরো ঘরের সমান খাঁচা বানানো হয় র‍্যাঞ্চোর জন্য। যাতে সে হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারে। তখনই ভাবনাচিন্তা করা হয়, খাঁচাটা যখন এত বড় করাই হচ্ছে, তখন একটা মেয়ে বাঁদর আনলে কেমন হয়!

তখনই ঠিক হয়, এখন যেখানে খাঁচাটা আছে সেখানেই বড় খাঁচাটা রাখা হবে। কিন্তু একবার বড় খাঁচাটা তৈরি হয়ে গেলে সেটাকে টেনেহিঁচড়ে ওখানে নিয়ে যাওয়াটা খুব মুশকিল হবে। তাই র‍্যাঞ্চোর খাঁচাটাকে একটু দূরে সরিয়ে সেখানেই পাকাপাকি ভাবে তৈরি করা শুরু হয় বড় খাঁচাটি।

এত দিন যেখানে ছিল সেখান থেকে খাঁচাটি সরানোর জন্যই বুঝি সে খুব রেগে ছিল। তাই মাধুকাকা যখন বলল, যা, ওকে তা হলে দুটো রসগোল্লা খাইয়ে আয়।

সেটা খাওয়াতে গিয়েই এই বিপত্তি। স্বর্ণ যখন রসগোল্লা খাওয়ানোর জন্য খাঁচাটার সামনে গেল, দেখল, না-খাওয়ার জন্য খাঁচার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সে ছুটোছুটি করছে। মাঝেমাঝেই ওপরে উঠে রড ধরে বসে থাকছে। হাজার ডাকলেও নামছে না।

স্বর্ণ তখন ওকে খাওয়ানোর জন্য ঘুরে ঘুরে খাঁচার এ দিকে ও দিকে গিয়ে ওর মুখের সামনে রসগোল্লা ধরছে।

হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝট করে ওর হাতটা টেনে নিয়ে র‍্যাঞ্চো এমন মারণ কামড় কামড়ে ছিল যে, সেই যে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোনো শুরু হল, একটা গোটা কোলগেট পেস্ট দিয়েও সেই রক্ত বন্ধ করা গেল না। শেষে পাশের বাড়ির যে ভদ্রমহিলা সারা দিনে পঞ্চাশ বার পান সেজে খান, তাঁর কাছ থেকে একগাদা চুন এনে কোনও রকমে বন্ধ করা হয় রক্ত।

স্বর্ণকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, ও কিন্তু ডাক্তারকে একবারও বলেনি বাঁদর কামড়েছে। যাদের ভয়ে ওকে কলকাতা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, জানাজানি হলে যদি সেই বন দফতরের লোকেরা এসে ওকে নিয়ে যায়, তখন? তাই স্বর্ণ বলেছিল, বঁড়শি গেঁথে গেছে।

ডাক্তার সেই হিসেবেই ট্রিটমেন্ট করেছিলেন। ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন। ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। খাবার ট্যাবলেটও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁদর কামড়ালে যে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, ওকে তো সেটা দেওয়া হয়নি। রাত থেকেই শুরু হয়েছিল যন্ত্রণা। কাটা পাঁঠার মতো দপাদাপি করেছে সারা রাত।

স্বর্ণর অবস্থা বেগতিক দেখে দর্শনকে বারবার ফোন করেছিল মাধুকাকা। দর্শনকে না পেয়ে বাধ্য হয়েই ফোন করেছিল মেজদিকে।

আজ রাখিপূর্ণিমা। নিশ্চয় ওরা দু'ভাই তাদের মেজদির বাড়িতে প্রতিবারের মতো রাখী পরতে যাবে। ওখানে যাওয়া মাত্রই দর্শন যাতে খবরটা পায়, সে জন্যই উনি ফোন করেছিলেন।


ফোন রেখেই সৌম্যর দিকে তাকিয়ে মেজদি বলেছিলেন, স্বর্ণর অবস্থা খুব খারাপ রে। গোটা শরীর নাকি বেঁকে গেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ওর চিৎকারে আশপাশের লোকজন সব জড়ো হয়ে গেছে। দর্শনকে ফোনে পাচ্ছে না। ও তো এইমাত্র রাখী পরে গেল। ফোন কর তো, ফোন কর, ফোন কর। এক্ষুনি ফোন কর।

সৌম্য যখন শুনল স্বর্ণমণির শরীর বেঁকে গেছে, তার মানে ওর ধনুষ্টংকার হয়েছে। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে না গেলে ওকে বাঁচানো মুশকিল। তাই খাওয়া থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দর্শনকে ফোন করল সৌম্য। কিন্তু ফোন বেজে গেল, বেজেই গেল। আবার। আবার। আবার। অনেক বার চেষ্টা করেও ওকে না পেয়ে ফোন করল মিঠুকে।

মিঠু দর্শনের ছেলে। সে বলল, হ্যাঁ, বাবাকে না পেয়ে দাদু আমাকে ফোন করেছিল। আমিও বাবাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু পাইনি। তাই আমি একটা বন্ধুর বাইকে করে এক্ষুনি বারুইপুরে যাচ্ছি।

সত্যিই খুব খারাপ অবস্থা স্বর্ণর।। আর ভাবতে পারল না সৌম্য। সেই কোন ছোটবেলা থেকে সে তাদের সংসারটা সামলাচ্ছে। আজ তার এই অবস্থা! ফোন করল বড়দিকে--- শুনেছিস? স্বর্ণমণির কি হয়েছে?

--- কী হয়েছে?‍ দিদি জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, মাধুকাকা যা বলল, তাতে ও বাঁচবে কি না সন্দেহ আছে।

সৌম্যদের বাড়ির উলটো দিকেই থাকে সৌম্যর ছোটবোন। বারান্দার গ্রিলের ও পারে দেখতে পেয়ে তাকে বলল, স্বর্ণমণি বোধহয় আর বাঁচবে না রে!


খানিক পরেই ফোন করল মিঠুকে। তার বন্ধু এত জোরে বাইক চালিয়ে নিয়ে গেছে যে, পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই কসবা থেকে বারুইপুরে পৌঁছে গেছে।

সৌম্য জিজ্ঞেস করল, স্বর্ণমণি এখন কেমন আছে? মিঠু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নেই।

সৌম্য এই ভয়টাই পাচ্ছিল। ও যে কেন প্রথমেই ডাক্তারকে বলল না বাঁদর কামড়েছে, তা হলে তো ঠিকঠাক ইঞ্জেকশনটা পড়ত। এ ভাবে অঘোরে প্রাণ দিতে হত না। এই দুঃসংবাদ ও কাউকে বলবে কী করে! কিন্তু এ সংবাদ তো চেপে রাখারও নয়। জানাজানি হবেই। তাই মেজদিকে ফোন করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মেজদি, স্বর্ণ আর নেই রে...

--- কী বলছিস? আঁতকে উঠল মেজদি।


ফোন করল বড়দিকে। বড়দি স্তম্ভিত। সে কী রে! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। এই তো শেতলা পুজোর সময় যখন বারুইপুর থেকে আসছি, জোর করে একগাদা গোটা ফল আমার ব্যাগের মধ্যে ভরে দিল। বলল, নিয়া যান। পরে খাইতে পারবেন। এখানে তো খাওনের লোক নাই। পইরা থাইকা থাইকা নষ্ট হইব। তুই কখন খবর পেলি?

--- এই তো একটু আগে। মিঠু বলল।

--- আমি ভাবতে পারছি না রে, মেয়েটার কী হল!আমার হাত-পা কেমন কাঁপছে। এ কী খবর শোনালি তুই...


ফোন করল ছোটবোনকে। সে বলল, আমাদের তো ওখানে যাওয়া দরকার। কী করে যাই বল তো! বডি কি বাড়িতেই আছে, না হাসপাতালে?

--- আমি এখনও ঠিক পুরোটা জানি না।

--- না, ওখানে তো মাধুকাকা ছাড়া কেউ নেই। সবাই তো এ দিকেই থাকে। সবাই মিলে দল বেঁধে যেতে গেলে কখন গিয়ে পৌঁছব কোনও ঠিক নেই। এতটা পথ... যেতেও তো সময় লাগবে। তার চেয়ে বরং ওর বডিটা যদি এখানে আনা যায়, দ্যাখ না... তা হলে শেষ চোখের দেখাটা একবার দেখতে পাই।


বারুইপুরে দাহ করার জায়গা বলতে ওই একটাই। জোড়া মন্দির। তা হলে কি ও মাধুকাকাকে ফোন করে একবার বলবে, আমাদের ফ্যামিলির যারা মারা যায় তাদের সবাইকে তো কেওড়াতলাতেই দাহ করা হয়, ও তো আমাদের পরিবারেরই একজন। ওকে এখানে দাহ করলে হয় না?

কিন্তু না, বেশ কয়েক বার ফোন করেও মাধুকাকাকে না পেয়ে ও সোজা রওনা হয়ে গিয়েছিল বারুইপুরে। যে তাদের জন্য সারাটা জীবন দিয়েছে, শেষকৃত্যে তার পাশে না থাকলে হয়! লোকে কী বলবে!


বাগানবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা রাখতেই সৌম্য বুঝতে পাড়ল, স্বর্ণমণিকে কত লোক ভালবাসত।

বাড়ির উঠোন জুড়ে এদিকে-সেদিকে জটলা। ওকে দেখেই সবাই সরে গিয়ে জায়গা ছেড়ে দিল।

ও ঘরে ঢুকেই একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। দেখল, মাধুকাকা খাটের উপরে বসে আছেন। আর তার ঠিক উলটো দিকের সোফায় স্বর্ণমণি। ওকে দেখেই স্বর্ণ বলল, আপনে?

--- তুই?

--- এই তো ডাক্তার দেখাইয়া আইলাম।

--- ডাক্তার দেখিয়ে! বলেই, ওর মনে পড়ে গেল মিঠুই তো তাকে বলেছিল, ও নেই। তার মানে? তাই সৌম্য জিজ্ঞেস করল, মিঠু কোথায়?

মাধুকাকা বললেন, এই তো ছিল, এখানে তো টাওয়ার পাওয়া যায় না... ফোন করার জন্য মনে হয় বাইরে গেছে, দ্যাখ না... উঠোনে গিয়ে দ্যাখ, ওখানে আছে মনে হয়।

মাধুকাকা এই ভাবে কখনও ওর সঙ্গে কথা বলে না। তার মানে স্বর্ণমণিকে নিয়ে উনি খুব টেনশনে ছিলেন। সেই রেশ এখনও কাটেনি। তার ওপর কে যে রটিয়েছে, ও মারা গেছে... সেই নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে আছেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে সৌম্য দেখল, উঠোনের ও দিকে পায়চারি করতে করতে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে মিঠু। ও সঙ্গে সঙ্গে মিঠুর কাছে গিয়ে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলল, তুই আমাকে কী বলেছিলি?

জেঠুর কথা বলার এই টোন সে চেনে। তাই ফোনের ও প্রান্তে যে আছে তাকে বলল, এই, একটু পরে ফোন করছি... বলেই লাইনটা কেটে দিয়ে জেঠুকে বলল, কী বলেছি?

--- তুই যে বললি স্বর্ণমণি নেই!

--- ছিল না তো... ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। আমি এসে দেখলাম নেই। তাই তুমি জিজ্ঞেস করতেই বললাম, নেই। কেন, কী হয়েছে?

--- ও তো ঠিকই আছে দেখছি।

--- হ্যাঁ, ডাক্তার দেখিয়ে এল তো...

--- না, মাধুকাকা যে মেজদিকে বলল, ওর শরীর বেঁকে গেছে!

--- তাই নাকি? বেঁকে গেছে বলেছে? তা হলে যাও দাদুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। ঘরে আছে তো।

সৌম্যরও মনে হল এটা জিজ্ঞেস করা দরকার। তাই ঘরে গিয়ে মাধুকাকাকে ও জিজ্ঞেস করল, আপনি মেজদিকে ফোন করে বলেছিলেন ও বেঁকে গেছে... কোথায়? ও তো দিব্যি আছে।

--- বেঁকে গেছে? কে বলল? আমি তো ওকে বললাম পেকে গেছে। বাঁদরটা যেখানে কামড়েছিল সেই জায়গাটা পেকে গেছে।

তার মানে মেজদি 'পেকে'টাকে 'বেঁকে' শুনেছিল। আর বেঁকে গেছে শুনেই তার মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই ধনুষ্টংকার হয়ে গেছে। আর ধনুষ্টংকার মানেই... তার ওপরে মিঠু যখন বলল নেই, তখন তার মনে হয়েছিল 'নেই' মানে, স্বর্ণ আর বেঁচে নেই। আর বেঁচে নেই ভেবেই, সে নিজেই সবাইকে ফোন করতে শুরু করেছিল।

সামান্য ভুল শোনা, আর সেই শোনার ত্তপরে ভিত্তি করে অনেক কিছু ভেবে নেওয়ার জন্যই এই বিপত্তি!

যাক বাবা, যতই ভুল বোঝাবুঝি হোক, ও তো বেঁচে আছে, থুড়ি ভাল আছে, সেটাই অনেক। এ বার আবার তাকে একের পর এক ফোন করতে হবে। মেজদিকে, বড়দিকে এবং ছোটবোনকে। বলতে হবে। গুছিয়ে বলতে হবে। এমন ভাবে বলতে হবে, সেটা নিয়ে যাতে আর কোনও ভুল বোঝাবুঝি না হয়। কিন্তু কী বলবে সে! কী!


-----------------------------------


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩১ || Sarod sonkha 1431 || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র