সেই রাত - প্রদীপ সেনগুপ্ত || Sei Rat - Pradip Sengupta || Story || Short Story || Bengali Story || Bengali Short Story || গল্প || ছোট গল্প || অনুগল্প
সেই রাত
প্রদীপ সেনগুপ্ত
বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল বীতশোক, কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সকাল থেকেই একটা অস্বস্তি ওকে চেপে ধরেছে -- কিছুতেই ভুলতে পারছে না লোকটার কথা।
সকালে বীতশোক বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, উদ্দেশ্য তাড়াতাড়ি বাজারে পৌঁছানো। আজ বহুদিন পর ওর বড় শালা বিক্রম আসছে সপরিবারে, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করবে। বাজারে যেতে বেশ দেরি হয়ে গেছে বলেই ওই রাস্তায় যাওয়া। ওই রাস্তা পারতপক্ষে সবাই এড়িয়ে যায়, কারন - রাস্তাটা আদপেই চলার যোগ্য নয়। ফলে, চারিদিকে পরিত্যক্ত জঞ্জাল। তবে দিনের বেলায় তবু স্থানীয় দু'একজন যাতায়াত করে।
বীতশোক রাস্তায় যেতে যেতে টের পেল
পিছনে কেউ যেন আসছে। পিছনে তাকিয়ে দেখল, একটা রোগা লোক কেমন হন হন করে এগিয়ে আসছে। লোকটাকে আগে কখনো দেখে নি বীতশোক।
লোকটা কাছে এসে বিশ্রী রকম হেসে বলল,
' বাড়িতে অতিথি আসছে বুঝি? '
এ' রকম গায়ে পরা লোক ও দেখে নি কখনো। বীতশোক বেশ ঝাঁঝিয়ে উত্তর দিল,
' আপনি কে বলুন তো? আগে কখনো দেখিনি তো! আর, আপনার দরকার কি জানার আমার বাড়িতে কে আসছে বা না আসছে? '
লোকটা আবার দেঁতো হাসি হেসে বলল,
' আমাকে আগে দেখেছেন, বিলক্ষণ দেখেছেন -- মনে করতে পারছেন না। আমি বলছিলাম, সব মানুষই তো একবার না একবার চলতে চলতে পিছন ফিরে তাকায়। আজকে কিন্তু আপনার সামনে বিরাট সুযোগ আসবে, আপনার ভিতরের কুঁকড়ে থাকা মানুষটাকে মুক্তি দিন। '
বীতশোক এবার সত্যিই রেগে গেল,
' কি যা তা বলছেন বলুন তো? '
লোকটা বীতশোককে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল, জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
' ভালোর জন্যই বলেছিলাম, আপনার শ্বশুরমশায়ের গচ্ছিত জিনিস আসল লোককে ফিরিয়ে দিন। উপর থেকে কিন্তু একজন সব দেখে রাখেন, প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পেয়েও যদি আপনি তার সঠিক ব্যবহার না করেন তবে... '
' তবে কি? '
লোকটা আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল,
' সে'টা তো তিনিই জানেন! আর একটা কথা, আজই কিন্তু শেষ সুযোগ, না হলে কালকের সকাল দেখবেন কি না কে জানে! '
এই বলেই লোকটা অসম্ভব দ্রুত বেগে রাস্তার মুখে পৌঁছে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
বীতশোকের গলা কেমন শুকিয়ে এল। লোকটা এত গোপন একটা কথা কি করে জানল? ওর শ্বশুর মশায়ের সাথে বিক্রমের যোগাযোগ ছিল না বহুকাল, বলা যায় মুখ দেখাদেখি বন্ধই ছিল। বিক্রম বাবার উপর অভিমান করেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু বাবা ছেলের বিরোধ কি নিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি কেউ কখনো জানতে পারে নি। বীতশোকের বৌ জয়া বাবার বিশাল সম্পত্তির মালিকানা পাবে, এ'কথা সবাই জানতো। কিন্তু জয়ার বাবা ব্রজলাল বাবু একদিন বীতশোককে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন,
' দেখো বাবাজীবন, বিক্রম আমার বংশের প্রদীপ। ও যদি অভিমান ভুলে কখনো ফিরে আসে তবে এই উইলটা ওকে দেখিও, ভাইবোনকে সব সমান ভাগ করে দিয়েছি '।
এরপর বেশি দিন বাঁচেন নি ব্রজবাবু। বীতশোক সেই কাগজটা রাতারাতি নষ্ট করে ফেলে।
এরপর বিক্রম আর ফিরে আসে নি। আজ দীর্ঘ কাল পর ও আসছে।
বিক্রম বিকেলেই চলে গেল। জয়ার বেশ খুশি খুশি ভাব। ওরা যতক্ষণ ছিল - বীতশোকের সেই লোকটার কথা মনে হয় নি। কিন্তু বাড়ি খালি হতেই ওর মনে পরে গেলো সেই লোকটার কথা। একটা অজানা ভয় ওকে কেমন ঘিরে ধরল। রাতটা বীতশোকের কাছে একটা অভিশাপ মনে হতে লাগল। আর ভাবতে পারছে না ও। বুকের ভিতরটা ভারি হয়ে আসছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ডাক্তার মুখার্জী সব দেখে বললেন,
' একটা ম্যাসিভ এট্যাক হয়েছিল, নিতে পারেন নি বীতশোক বাবু। ভোরের দিকেই মারা গেছেন। '
Comments