উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -32
বাড়ীতে উপস্থিত হয়ে দেবীদাস সেদিন ঐ অবস্থায় কোন মতে থাকতে পারল না। বিছানায় শুয়ে সর্বদা ছটপট করতে থাকে। দেহের সমস্ত স্থানে যেন বিছুটির আঘাতে যন্ত্রণা অনুভব করছে। বুঝতে পারল যে, ঐ চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র হতে নিস্তার পাবার কোন উপায় নেই। অগাধ ধন দৌলত, টাকা কড়ি থাকা সত্বেও যে অভাবনীয় চিন্তা সারা মনকে ক্লান্ত করবে কোন দিন কল্পনা করেননি।
সারারাত্রি কোন প্রকারে চোখ দুটোকে মুদতে পারল না। এতদিন পরে তার জ্ঞান চক্ষুর উন্মেষ ঘটলো কেন ঐ অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করেছিল সে? কেন এক নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে ছিলো? এত সব ভাবলে কোন কাজ হবে না। থেকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়।
এক সময় চন্দ্রার মুখপানে তাকিয়ে দেখলো সে জেগে আছে। স্বামীর মনের কণ্ঠ সে বুঝতে পেরেছে তবু ও কোন কিছু বলার শক্তি পায় না। কারণ দেবী তার প্রতি অনেক অন্যায় আচরণ করেছে। ওর কোলে তিন বছরের কচি শিশু ময়না ঘুমাচ্ছে। অবোধ শিশুর পানে তাকাতেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। কোনদিন একটিবার কোলে নিয়ে আমোদ আল্লাদ করেনি। ভাগ্যহীনার প্রতি সর্বদায়ই কটাক্ষপাত ফেলেছে সন্দেহবশতঃ ওকে আপন মেয়ে নয় বলে ঘৃণার চোখে দেখেছে।
কিন্তু ওদের দুঃখ ক্লেশ দেখে মনটা একেবারে ভেঙ্গে গেলো। নিজেকে স্থির রাখতে পারল না সমস্ত অপরাধের বোঝা এসে উপস্থিত হয়েছে। দেবীদাস চিন্তা করে ময়নাকে একবার কোলে নিয়ে চুমু খাবে একটু আদর করবে। তাই ধৈর্য্য হারিয়ে ওর দিকে হাত দুটো প্রসারিত করতেই বাধা পড়ল। চন্দ্রার সাথে তার চোখ এক হতেই দেখল ওর চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বেরিয়ে আসছে। কোন প্রকারে একটুক্ষণ ষ্টাচুর মতো দাড়িয়ে থেকে বারান্দায় এসে উপস্থিত হলো। মাথা উঁচু করে ওর সামনের দাঁড়াবার কোন ক্ষমতাই তার নেই। কারণ ওর কাছে সে নানা ভাবে অপরাধী। ওকে কেন্দ্র করে তার ফেলে আসা দিনগুলি তার চোখের সামনে ভাসতে থাকল।
চন্দ্রা কখন যে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি। সে শান্তস্বরে বলল, তুমি যেমনভাবে ছটপট করছো কেন? আমি কি কোন অপরাধ করেছি? বিশ্বাস করো বাবাকে বারবার নিষেধ করে ছিলাম বাড়ীতে আসতে। সে শুনেনি বলে তার অপরাধ নিওনা। বাবা কথা দিয়েছে, আর কখনো এ বাড়ীতে আসবে না।
চন্দ্রার কথা শুনে তার হৃদয় কেঁদে উঠল। যেমন ক্লান্ত অশ্বের অঙ্গ হতে স্বেদধারা বয়ে যায়, ঠিক তারও সেইরূপ অবস্থা হলো। বলল, বাবা কোথায় গেছেন? - তীর্থে গেছেন।
ও কথা শুনে আরো মুষড়ে পড়ল দেবীদাস। বাবার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার ক্ষমতা কোনদিনই তার ছিল না। তবু এই বিপদে তার বাবার কাছে নিজেকে সারেন্ডার করতো। তিনি যে কতদিন পর বাড়ীতে ফিরবেন তা তার অজানা নয়। এখন আট হতে দশ মাস তো দেরী হবেই। যে স্ত্রীর সাথে ভালোভাবে কোনদিন কথা বলেনি, যাকে কাছে টানবার ইচ্ছে জাগেনি ; হয়তো মাতাল অবস্থায় বাড়ীতে এসে কয়েকবার কাছে টেনেছিলো, তার মলিন মুখখানি দেখে স্থির থাকতে পারল না।
ওর হাত দুটো ধরে বলল, আমাকে ক্ষমা করো চন্দ্রা, অনেক অবিচার করেছি তোমার প্রতি। মনে হয় সে জন্য ভগবান আজ বিচার করছেন। তুমি তো প্রতিশোধ।
নেবার চেষ্টা করোনি। তাই তোমার হয়ে আরেকজন নিচ্ছেন। তবে বলে রাখছি এই বিপদ হতে কোনদিন যদি রক্ষা পেয়ে থাকি ; তোমার কাছে ফিরে আসবো।
ওখান হতে সরে পড়ার চেষ্টা করতেই সে দেবীর পথ অবরোধ করে বলল, কি এমন বিপদ তোমার, আমি কি তার ঝুঁকি নিতে পারি না।
কোন উত্তর না দিয়ে কোন প্রকারে সরে পড়লো দেবীদাস। শুধু চোখ দুটো তার ছলছল করে উঠল। শেষ পর্যন্ত ওদের আড্ডায় যেতে হলো দেবীদাসকে। ভেবেছিল সুশীল বাবুর সাথে পরামর্শ করবে ওদের আড্ডায় যাবার আগে, কিন্তু পারেনি। হেমন্তবাবু তাঁর উপর ব্যবসার সমস্ত ভার দিয়ে তীর্থে গেছেন। একমাত্র দেবীদাসের অত্যাচারের জন্য তার অশান্তিময় জীবনে কিছুটা শান্তির স্পর্শ লাভের জন্য।
ওদের আড্ডায় পৌঁছতে মিঃ জ্যাকি অর্থাৎ ওদের বস তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। যেন দেবীদাস তার কত কালের পরিচিত। ট্রেনিং শুরু হলো। মদ, মাংস এবং নারীর কোন অভাব ছিল না। যখন যাকে প্রয়োজন সব দিক দিয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া যাবে।
এবার দেবীদাসের মধ্যে পশবিক বৃত্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তার ছন্নছাড়া ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কি করুন পরিনতি। এই আড্ডাতে এনে চন্দ্রার কথা ভুলে গেল। E.C.G. মেসিন চুরি করার ট্রেনিং হয় প্রতিদিন। রাত্রিতেও এর ব্যতিক্রম হয় না।
একদিন স্থির হলো দেবীদাসকে এবার কাজে নামতে হবে, যে কাজের জন্য তাকে আনা হয়েছে এখন সে কাজ করার সক্ষম হয়েছে। মিষ্টার জ্যাকি বললেন, শুনিয়ে দেবদাস বাবু, হামলোগ চোর, ডাকু, স্মাগলার হতে পারি, লেকিন হামাদের দিল বহুত উঁচা আছে। হাপনি এ বাত ইয়াদ রাখবেন না হাপনাকে জিন্দেগী ভর হামারা সাথ থাকতে হোবে। হাপনার কাম হাসিল হলে পর হাপনি এখান হতে খালাস পাইবেন লেকিন এক শর্ত মে, যদি বেইমানি করবেন এই দুনিয়া হতে হট যাইবেন। মিষ্টার চৌবে দেবদাস বাবুকে সমঝে দিন ক্যায়সে কাম হাসিল হোবে। জরুরি কামমে হামি বাহার যাচ্ছি।
মিষ্টার চৌবে শেষবারের মতো ডিরেকশান দিলেন। ও পরের পর কাজ বাতলে দিলেন। তাড়াহুড়ো করবার কোন প্রয়োজন নেই, তবে সর্বদা মনে রাখতে হবে কাজের সময় যদি কেউ বাধা দিতে আসে তাহলে প্রয়োজন হলে জীবন নাশও করতে হবে। তাতে ভাই, বন্ধু আত্মীয় পরিজন যে কোন ব্যক্তি হোক না কেন। একটা পিস্তুল তার হাতে তুলে দিলেন। অবশ্য কাজ শেষ হলে ওটা ফেরৎ দেবার নির্দ্দেশ রইলো। বারবার সতর্ক করে দিলেন দেবীর কাজে যেন কোনরূপ বাধা না পড়ে।
পর দিন সন্ধ্যের সময় দেবীর অভিযান শুরু হলো। থমথমে কালো অন্ধকারে বুকচিরে এগিয়ে চলেছে কলেজের ল্যাবরেটরি রুমের দিকে। আকণ্ঠ মদ পান করেছে।
তবুও চলতে চলতে পা কাঁপছে না দেহ তার পরিশ্রান্ত হচ্ছে না। দেবী স্বচ্ছন্দে হেঁটে চলেছে। ল্যাবরেটরি রুমের পাশে কয়েকটা ছোট ছোট ঘর সময় বিশেষে ও গুলো নিয়ে মেডিকেল ছাত্রদের মধ্যে গবেষণা হয়ে থাকে।
Comments