ছোট গল্প - একটু সাবধান || লেখক - সুমিত রায় || Written by Ektu Sabdhan || Short story - Sumit Roy
একটু সাবধান!
সুমিত রায়
ক্লাবে কয়েকদিন ধরে প্রতুলবাবু সান্ধ্য আড্ডায় অংশ নিচ্ছেন না দেখে, ক্লাব সম্পাদক মৃনালবাবু ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন- না আসার কারণ। উত্তরে জানলেন, কয়েকদিন যাবৎ পেটে প্রচন্ড যন্ত্রণা। এপেনডিক্সের ব্যথা সন্দেহে বাজার থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। ডাক্তার এখনও দেখাননি। মৃনালবাবু ফোনটা রেখে দিলেন!
মৃনালবাবু ক্লাবের অন্য দুই সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে চললেন প্রতুলবাবুর বাড়ি। প্রতুলবাবুর বাড়িতে গিয়ে তিনি রেগে গেলেন-যখন শুনলেন, একই ওষুধ দশ দিন ধরে বাড়ির পাশের ফার্মেসি থেকে কিনে কিনে খাচ্ছেন, ডাক্তার দেখানোর কোন নাম গন্ধ নেই। নিজে নিজেই বলছেন,-' এপেনডিক্সের ব্যথা।'
কি আশ্চর্য ব্যাপার! এই অবস্থায় কেউ ডাক্তার না-দেখায় থাকতে পারে কীভাবে? আগামীকাল ডাক্তার দেখানোর কথা জোর করে বললেন মৃণালবাবু।
পরের দিন মৃণালবাবু , প্রতুলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে মেডিকেল কলেজে গেলেন। সেখানে নানা পরীক্ষা করার পর জানা গেল, প্রতুলবাবু পেটের ব্যথা নিয়ে যে সন্দেহ করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ ভুল সন্দেহ। আরও কিছুদিন এরকম এপেনডিক্সের ব্যথা সন্দেহে ওষুধ খেলে- সমস্যা অন্য দিকে মোড় নিত, অন্য কোনো কঠিন রোগের শিকারী হয়ে যেতেন প্রতুলবাবু।উনার পেটের ব্যথার কারণ হিসেবে ধরা পরল গ্যাস্ট্রিক। কয়েকদিনের চিকিৎসায় প্রতুলবাবু সুস্থ হয়ে উঠলেন। বাড়ি ফিরলেন।
আজ রোববার, অনেকদিন পর প্রতুলবাবু ক্লাবের সান্ধ্য আড্ডায় আবার যোগ দিলেন। হাসি-ঠাট্টা চলল আগের মতন। ক্লাব সম্পাদক মৃনালবাবুর পরামর্শে ডাক্তার না দেখালে, না জানি কী বড় বিপদের সম্মুখীন হতেন-তা অকপটে স্বীকার করলেন ক্লাব সদস্য প্রতুলবাবু। নিজে নিজে রোগের সন্দেহ করে ওষুধ খাওয়া যে একেবারেই ঠিক নয়, তা কত বড় যে অন্যায়, সেটি হাঁড়ে হাঁড়ে বুঝতে পারলেন- প্রতুল বাবুসহ ক্লাবের আরও অনেক সদস্য।
মৃনালবাবু হাসতে হাসতে প্রতুলবাবুকে বললেন,-"প্রতুল দাসকে কতটা উৎফুল্ল লাগছে! আজ অনেকদিন পর আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় এসেছে, প্রতুল। প্রতুল, তুমি এতটা শিক্ষিত হয়ে কীভাবে এপেনডিক্সের ব্যথা সন্দেহে পেট ব্যথা নিয়ে বাড়িতে এতদিন কষ্ট করছিলে? -এটা ভাবলেই তোমার উপর আমার প্রচন্ড রাগ হয়। তুমি কি এটাও ভুলে গেছিলে, যে কোন রোগের উপযুক্ত ওষুধ একমাত্র দিতে পারেন স্বয়ং ডাক্তার। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের রোগের ওষুধ ঠিক করে ফেলি, তাহলে ডাক্তাররা আছেন কী জন্যে? তুমি যে পেটের ব্যথাকে এপেনডিক্সের ব্যথা সন্দেহে ওষুধ খেয়ে যাচ্ছিলে দীর্ঘদিন, তাতে কি সর্বনাশ হতে পারতো, তা কখনো ভেবেছো?তোমার পরিবারের দিকে তুমি একটিবারও চিন্তা করোনি? কপাল ভালো মেডিকেল কলেজে তোমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। না হলে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ হয়তো আমাদের সামনে এসে দাঁড়াত।
নিজে নিজেই রোগ সন্দেহ করে ওষুধ খেয়ে কী সর্বনাশ ঘটেছিল আমার অফিসের এক সহকর্মীর, যেটা আমি খুব ভালোভাবে জানি। সেটাই তোমাদের আজ বলব-
অনিমেষ দত্ত, আমার অফিসের করণিক। আমার থেকে কয়েক বছরের বড়।সব বিষয়ে তার মাতব্বর ভাব কাজ করতো, এটা আমরা অফিসের সকলেই কয়েক বছরের মধ্যেই পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলাম। এইজন্য উনাকে আমরা কেউ কোন পরামর্শ দিতে যেতাম না। অনেকদিন ধরে তার ঘাড়ে ব্যথা, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, -'স্পন্ডালাইসিস এর ব্যথা।'
কোন ডাক্তার দেখাতে চাইতেন না, ব্যথা বাড়লে ফার্মেসি থেকে ব্যথা কমানোর ওষুধ এনে খেতেন। ব্যথা কমলেই আবার যেই আর সেই। ডাক্তার দেখানোর কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই।
এরকমভাবে কয়েক বছর কেটে যায়। পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুই থেকে চার-এ পৌঁছায়। ধীরে ধীরে ঘাড়ের ও কোমরের ব্যথা বাড়তে থাকে। ব্যথা কমানোর ওষুধ খান।বেশ কিছুদিন ভালো থাকেন, তারপর আবার ব্যথা শুরু হয়।
গত দু'বছর আগে, একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে । একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিন আসছেন না অনিমেষ বাবু। জানতে পারলাম ঘাড় ও কোমরের অসহ্য ব্যথায় বাড়িতেই আছেন। কিন্তু সেবারের ব্যথার লক্ষণ একটু আলাদা রূপে দেখা দেয়। হাত-পা ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে হাত-পায়ের জোর হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। হাঁটতে পারতেন না। হাত দিয়ে কোন কিছু খেতে পারতেন না। একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল বাড়ির সকলে।
করণিক পদে চাকরি, আর্থিক স্বচ্ছলতা সেরকম ভাল না। কি করবেন একটাই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করতে লাগল পরিবারের মধ্যে।
একমাত্র বাড়ির ফাঁকা কিছুটা জায়গার, বিক্রির টাকায় অবশেষে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাওয়া হল। সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম। ব্যাঙ্গালোরে নামকরা নার্ভের চিকিৎসালয়ে অনিমেষবাবুর চিকিৎসা আরম্ভ হল। প্রাথমিক পর্যায়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনিমেষবাবুর সঠিক চিকিৎসার পথ খুঁজে চলছেন চিকিৎসকেরা।
আমি চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করেছিলাম,-'স্যার আপনার কী সন্দেহ হয়?
'সন্দেহ! সন্দেহ করে কিছু বলা যায় না, পরীক্ষা চলছে, রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে- কী হয়েছে উনার।' কিছুটা জোর গলায় বললেন চিকিৎসক।
আমরা হসপিটালের পাশে যে ঘরটি ভাড়া নিয়েছিলাম, সেই ঘরে যাওয়ার রাস্তায় অনিমেষবাবুকে যে চিকিৎসক দেখছিলেন তার সাথে দেখা হয়ে যায় একদিন। আমাকে চিন্তাম্বিত অবস্থায় দেখতে পেয়ে ডাক্তারবাবু হাঁটতে হাঁটতে নিজেই বললেন,-'আপনার পেশেন্টের ভয়ের কোন কারণ নেই। উনার ঘাড়ে ব্যথা দুটো কারণে হতে পারে, একটি টিউমারের ব্যথার কারণে , অন্যটি টি.বি.। মেরুদন্ডে অনেক ধরনের টি.বি. হয়। আগে অনেক বেশি হত, তবে এখন আমাদের সৌভাগ্য যে টি বি. অনেক কমে গেছে। অনেকে বুঝতে পারেন না, হাঁড়ে আবার কেন টি.বি. হবে।সাধারণ লোকের ধারণা কেবল ফুসফুসে টি.বি. হবে। কাজেই তাদের জেনে রাখা উচিত টি.বি. কিন্তু হাঁড়েও হয়। হাঁড়ে টি.বি হলে সেখান থেকেও ঘাড়ে ও কোমরে ব্যথার সূত্রপাত হয়।
এছাড়া আমাদের ঘাড়ে ও কোমরে অনেক গ্রন্থি রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে লিম্ফোয়েড গ্রন্থি, যেগুলোতে টি.বি. সংক্রামিত হয়। সংক্রামিত এই লিম্ফোয়েড গ্রন্থিগুলো এক সঙ্গে মিশে জোড়া পাকিয়ে যায়। মিশে জোড়া পাকানো লিম্ফোয়েড গ্রন্থির এই অবস্থাকে আমরা বলি- ম্যাটেট লিম্ফোয়েড, তখন এগুলোতে প্রচন্ড ব্যথা হতে থাকে। সেই ব্যথাই ঘাড়ে ও কোমরে প্রকাশ পায়।'
পুরো দুদিন পর সমস্ত পরীক্ষার রিপোর্ট এলে জানা গেল অনিমেষবাবুর আর্থ্রাইটিস হয়েছে। সেই রোগের চিকিৎসা চলে প্রায় দশ দিন ধরে। অনেকটাই সুস্থতা ফিরে পেলে, অনিমেষবাবুর বাড়ি ফেরার অনুমতি মিলল।
অনিমেষবাবুর ছুটির পর চিকিৎসক আমাদের বলেছিলেন, -'আপনারা কোন রোগের সন্দেহবশত ওষুধ খাবেন না। আজকে এই পেসেন্ট স্পন্ডেলাইসিস সন্দেহে যে ওষুধ খেয়েছিলেন, সেটি যদি আরও কিছু দিন খেতেন, তবে তার নার্ভ কার্যক্ষমতা হারিয়ে- উনাকে পঙ্গু করে ফেলত। ঈশ্বর সহায় উনি এখানে এসেছেন এবং সঠিক রোগের চিকিৎসায় উনি সুস্থ হচ্ছেন এবং আগামীতে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন।'
আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম চিকিৎসকের কথা শুনে। ওই চিকিৎসকের ওই কথাগুলো আমি আজও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলছি। অসুস্থ অনুভব করলেই, ডাক্তার না দেখিয়ে ওষুধ খাই না। আমার সহকর্মীকে সেদিন যদি ব্যাঙ্গালোরে না নিয়ে যাওয়া হত, তবে ভুল ওষুধের দাপটে তাকে আজ পঙ্গু হয়ে থাকতে হতো। আমি ক্লাবের প্রত্যেক সদস্যের উদ্দেশ্যে বলছি - শরীরের কোন জায়গায় ব্যথা হলে, আপনারা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাবেন। আপনাদের যত পরিচিতি মহল রয়েছে, তাদের প্রত্যেককে এই কথাটি মানতে বলবেন।
আজকের সান্ধ্য আড্ডাটা একটু অন্যরকম ভাবে পালন করলাম।আগামীতে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে সচেতনতামূলক কর্মসূচি আমরা সকলের সামনে তুলে ধরব।"
Comments