ছোট গল্প - ঠকাসের বিয়েতে || লেখক - অরুণোদয় ভট্টাচার্য || Written by Arunodoy Bhattacharya || Short story - Thokaser Biyete


 

ঠকাসের বিয়েতে 

            অরুণোদয় ভট্টাচার্য 




বাপ নেই ।মা নেই । কাকা-কাকি,দাদা-বৌদি, এমন কি দিদিও নেই ।তাই ঠকাসের বৌ জোটে নি।একবার,শুনেছি, প্রেম করতে গিয়েছিল ।তা এমনই বরাত যে,বেধড়ক মার খেয়ে একুশ দিন নার্সিংহোমে থাকতে হয়েছিল ।কিন্তু সম্বন্ধ করে বিয়ে দিতে গেলে তো গার্জেন লাগে,সার্জনের সার্টিফিকেট কাজে আসে না ।দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা বলতেন, হ্যাঁরে,এবার একটা বিয়ে করে ফ্যাল, বয়েসটা যে... 

ও শুকনো হেসে বলত,-দিন না একটা সুলক্ষণা ঘরোয়া মেয়ে দেখে ।বলতে বলতে ঠকাস গত চৈত্রেই পঞ্চাশে পা দিয়েছে ।এখন আসছে আষাঢ় মাস ।

হঠাৎই একদিন অফিসে ঠকাসের ফোন পেলাম ।বলল—প্রণব দা,আমার বিয়ে আগামী শনিবার ।সোমবার বৌভাত ।তোমাকে দু’দিনই যোগ দিতে হবে ।বরযাত্রী যেতেই হবে ।বুঝতেই পারছ,আমার তো কেউ নেই, বরকর্তামণ্ডলীর মধ্যে তোমার থাকা খুব দরকার ।

বিস্মিত হলাম ।একটু আনন্দও পেলাম ।তবু খবরটাকেঠিক সর্বান্তঃকরণে বরণ করতে পারছিলাম না ।এটা মানুষের বেয়াড়া মনস্তত্ত্ব ।গাণিতিক স্বতঃসিদ্ধের মত কতকগুলো জিনিসের পরিবর্তন হবে না,এটা ধরে নিই।ঠকাসের আইবুড়োত্ব সেই পর্যায়ের একটা আইটেম ছিল ।তার বিয়ে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা,নানা মন্তব্য, হাসি তামাসা,এমন কি দীর্ঘশ্বাসমোচন,সবই চলে । কিন্তু অনুষ্ঠানটা সত্যিই ঘটবে,ঠিক ভাবা যায় না । ব্যাপারটা যেন ওর নামের মতোই ঠকাস করে ঘটতে চলেছে!প্রজাপতি ঋষি দিলেন খটাস্ করে দুটো মাথা ঠুকে!

বাড়ি এসে সোমাকে বলতেই ও লাফিয়ে উঠল—গ্রেট নিউজ!এই শোন,তুমি কিন্তু সোমবার পুরো ছুটি নেবে ।আমি ঐ দিন সকাল থেকেই দেবেন্দ্রনগরে গিয়ে থাকব ।ঠকাসের নতুন ফ্ল্যাটটা তো দেখাই হয়নি।

আসলে ঠকাসের সঙ্গে আমার আলাপ শ্বশুর বাড়ির সূত্রে ।ছোটবেলায় ওদের আর সোমাদের পরিবারবসিরহাটে খুব কাছাকাছি বাস করত ।সোমা আর ঠকাস প্রয় একবয়সী ।ঠকাসের মাকে ও জেঠিমা বলে ডাকত ।তিনি ওকে নিজের ছেলের চেয়েও,,,ইত্যাদি ইত্যাদি ।তাই সম্পর্কে ও আমার  শ্যালক ।সায়ান্স গ্র্যাজুয়েট,চাকরিটা সামান্য ।তাই কিছু টিউশান্ করতে হয় উপার্জনটা ভদ্রোচিত করতে। মাঝে মাঝে সময় পেলে আমার ভবানীপুরের বাড়িতে আড্ডা মারতে আসে ।আর কমপক্ষে তিন কাপ চা নিঃশেষ না করে ওঠে না ।

 

ফোনে বলেই ক্ষান্ত থাকেনি ঠকাস ।দু’দিন পরেই ওর এক মাসী-স্থানীয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসে একেবারে কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করে গেল ।ওনার স্বামী বরকর্তা ।চিঠিতে নিমন্ত্রণ তিনিই জানিয়েছেন—আমার ভাগিনেয় শ্রীমান সুরেন্দ্রর সহিত সোদপুর নিবাসী শ্রী মাধব চক্রবর্তীর তৃতীয়া কন্যা কল্যাণীয়া প্রণতির শুভবিবাহ....

সোমা পরমোৎসাহে শুরু করল—প্রণতিকে কেমন দেখলি? র না দিয়ে মুখে ফিকে হাসির ফাটল ধরাল ।

সোমা চেপে ধরল—তোর তো অনেক খুঁতখুঁতুনি ।একে এক কথায়...

ওর মাসি বললেন—সে আর ব’লো না ।আমি এক মাসের মধ্যে এনার জন্যে বাধ্য হয়েএগারোটা মেয়ে দেখেছি ।তারপর নোটিশ দিলাম,আর পারব না ।

এবার ঠকাস সোমাকে বলল—চেহারা খুব অর্ডিনারি ।আর রূপসী খোঁজার বয়স কোথায়,বল?তবে কথাবার্তা ভাল,হাসিখুশি ।আজকালকার মেয়েদের মতো ন্যাকামি নেই ।তাছাড়া ভাল স্বাস্থ্য

ঠকাস উত্ত

 

আমি ওকে অভয় দিলাম—বয়সের জন্য ঘাবড়িও না ।ওটা কোন ব্যাপার নয় ।মূরলীধরের এক প্রফেসার রিটায়ার করার পর তাঁর মেয়ের বয়সী এক এক্স-ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন ।সে দিচ্ছে সেবা-যত্ন,উনি তাকে দিচ্ছেন অর্থ ।দিয়ে যাবেন মোটা টাকা আর কলকাতার সেন্ট্রাল জায়গায় দোতলা বাড়ি ।

সোমা বলল—ধুর!ওসব রাখ তো!এই ঠকাস,প্রণতির বয়স কত রে?

ঠকাস উত্তর দিল—ওরা বলছে তিরিশ ।আর পাঁচ যোগ করতে পারিস ।

--আহা, তোরও তো পঞ্চাশ হয়ে গেল ।ওদের কত বলেছিস?

--যা বলা উচিত ।চল্লিশ ।

সোমার প্রশ্নের সিরিজ চলতে থাকল ।

-ওরা ক’ভাই-বোন?

-দু’ ভাই সাত বোন ।

-অ্যাঁ!এই বিশাল গুষ্ঠিতে বিয়ে করবি?

সোমার সমালোচনার ঝাঁঝে ঠকাস বেচারা মুষড়ে না পড়ে,ভেবে বললাম একটু রসিকতা করে,- এতো থার্ড বোন ।ওপরের দুটো ম্যারেড,মানে, অন্যের সম্পত্তি হয়ে গেছে ।বাকি থাকল চার আইবুড়ো শালী ।তারাও তোমার হাফ্ বৌ ।তার মানে বুঝলে?

ঠকাস ফ্যালফেলিয়ে রইল ।

বললাম,- তার মানে তোমার সবুরে মেওয়া ফলেছে ।বয়সে বিয়ে করে তোমার সাকুল্যে তিনটি বৌ জুটল ।আর আমি দেখ বিলকুল অ-শালী ।অশালীন হবার কোন প্রশ্নই ওঠে না ।

সোমা ঝামটা দিয়ে আমার হাসি থামিয়ে দেয়—থাক, তোমাকে আর শিব্রামী করতে হবে না!অঙ্কের হিসেবে তো ভুল করেছ!চার ছোট শালীর ওপর আগের দুই জামাইবাবুর ভাগ আছে না?তাহলে ঠকাসের ভাগে কটা বৌ হল?

দু’হাত তুলে সারেণ্ডার করে বললাম, দেখলে তো, ভায়া, বিবাহিত লোকের বাক্-স্বাধীনতা বলে কোন জিনিস থাকতে পারে না!

এসব হাল্কা কথার পর ঠকাস যা বলল, তা একেবারে শরদিন্দুর রহস্যোপন্যাসের মেটিরিয়াল ।বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা ওকে দ্রুত নিতে হল নাকি আত্মরক্ষার তাগিদে!নতুন ফ্ল্যাটটা ওদের দু’ভাইয়ের ‘কমন’ প্রপার্টি । দু’জনের ভাগে একটা করে বেডরুম,তথাকথিত কিচেন আর বাথরুম ।ড্রইংরুমটা এজমালি ।ছোট ভাই বরুণ বছর দুই আগেই বিয়ে করেছে ।সে শাশুড়ির বড় অনুগত জামাই, আর তার স্ত্রী ইতিমধ্যে সন্তানসম্ভবা ।ওরা কত্তা-গিন্নি নাকি কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় ‘ফটাস’ অর্থাৎ ক্ষতম করে ফেলার!যাতে পুরো ফল্যাটটা তাদের ভোগে আসে ।কিছু একটা ঘটে গেলে কে আর তদন্তের জন্য খোঁচাবে?তিন কুলে আছে কে ঠকাসের জন্য সত্যিকার দরদ অনুভব করার?তেমন ফ্যাকড়া দেখলে ওরা বড়জোর পুলিশকে কিছু খাইয়ে দেবে ।ব্যস, তারপর গোটা ফ্ল্যাটে সুখের সংসার ।

আমরা যখন জেরা করলাম,এমন আশঙ্কার কি কারণ ঘটেছে, ঠকাস পরপর কয়েকটা ঘটনা বলে গেল । দু’মাস আগে ঠিক ওর অফিস বেরোবার সময় সিঁড়ির মুখে হড়হড়ে সাবান-জল ফেলে রেখেছিল ওরা । ও খুব জোর সামলে নিয়েছিল রেলিং ধরে ।এক রাত্তিরে গ্যাস সিলিণ্ডার এবং ওভেনের চাবি খোলা ছিল। ওরা বেলা করে ওঠে এবং জানে ঠকাস ভোরবেলায় উঠে চা করবে;সুতরাং মরার চান্স ।আর একদিন ও আবিষ্কার করেছে, ওর সর্ষের তেলের শিশিতে তেল নয়, পেট্রল ভর্তি রয়েছে!ব্যাপারটা হাইলি সাসপিশাস্ ।ধরা পড়ার পর ওরা হিজিবিজি ওজুহাত দেখিয়ে বলেছে ‘তোমার সবটাতেই বাড়াবাড়ি!’ তারপর সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ঘটে মাত্র মাস দেড়েক আগে ।একই রান্না বাড়ির সবাই খেয়েছে ।কিন্তু শুধু ঠকাসকে ফুড-পয়জনড্ হয়ে তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হল!

এর পরই সে অবিলম্বে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।তাহলে তাকে এইভাবে ফুস্ করে সরিয়ে দেবার সুযোগ থাকবে না ।সে চেষ্টাও করতে সাহস পাবে না ।কারণ একজন গেলেও সম্পত্তির আর এক দাবিদার থেকে যাবে ।

ঠকাসকে জানিয়ে দিলাম, বরযাত্রী যাওয়া থেকে আমায় রেহাই দিতে হবে ।তবে বৌভাতের দিন সকাল থেকেই সোমা আর আমি গিয়ে হাজির হব ওদের বাড়ি ।

ও চলে যাবার পর আমরা দুজন খানিক গবেষণা করলাম ওর পিছনে বরুণের চক্রান্ত নিয়ে ।সোমা বলল,ও একটু বেশি ভাবছে ।সন্দেহবাতিক হয়ে গেছে ।

--রজ্জুতে সর্পভ্রম বলছ?নাও হতে পারে ।আজকাল কাগজে,টিভি সিরিয়ালে যা সব দেখাচ্ছে, ডিরেক্ট বা ইনডিরেক্ট মার্ডার আলুকাবলি বানানোর মত ইজি হয়ে গেছে ।তাছাড়া মোটিভটা বেশ স্ট্রং!

--আর ইউ সিরিয়াস,মিঃ বক্সী?—সোমা ঠাট্টা করল ।

আমি হেসে ফেললাম ।বললাম,বরুণকে তো চোখেই দেখিনি!ওদের কমন ফ্ল্যাটটাও না ।


                          (২)

ভয় ছিল নেমন্তন্নর দিন যদি প্রবল বর্ষা হয় ।কারণ মাসটা জুলাই ।কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল বিপত্তি—ঠিক আগের রাত থেকে সোমা ঘোরতর অসুস্থ হল ।ভাইরাল ফিভার ।সারা শহর আজকাল এর দাপটে বিপর্যস্ত ।প্রবল জ্বর,মাথায় তীব্র যন্ত্রণা,সারা গায়ে ব্যথা,মুখে অরুচি,এবং কোন ওষুধেই উপশম নেই ।চলবে তিন থেকে পাঁচ দিন ।

উপহারের শাড়ি কেনা হয়ে গিয়েছিল ।কিন্তু সোমা ছাড়া আমি ওদের কাছে নো-বডি ।ওদিকে আবার কথা দেয়া আছে, যাওয়াটা কর্তব্য ।আমি একলা গেলে যদিও কোন তরফের তৃপ্তি হবে না, তবু অন্ততঃ ভবিষ্যতে কিছু অভিযোগ থাকবে না ।

যাব-কি-যাবনা করতে করতে শেষে যাওয়াই সাব্যস্ত করলাম সোমার তাগাদায় ।তবে সকালে নয়, বিকেলে ।এবং ঠকাসের ফ্ল্যাটে নয়, একেবারে অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া করা বাড়িতে, যার ঠিকানা কার্ডে দেয়া ছিল ।বেরবার সময় সোমা শারীরীক ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতেই রসিকতা করে বলল—পারলে ঠকাসের ফ্ল্যাটটাও একবার স্টাডি করে এসো ।কোথায় গ্যাস সিলিণ্ডার থাকে, সিঁড়ির ল্যান্ডিং কতটা চওড়া ।আর বরুণকে তো দেখবেই ।টেক কেয়ার অব ইয়োরসেল্ফ্ ।

                           (৩)

মেট্রো রেলে শ্যামবাজার ।তারপর শেয়ারের ট্যাক্সিতে ডানলপ ।বিকেলের আলো থাকতেই বিটি রোডের বাঁ দিকের একটা সরু রাস্তা দিয়ে খানিক এগিয়ে, এবং স্থানীয় লোককে দু’বার জিজ্ঞাসা করেই অভীষ্ট ঠিকানা পেয়ে গেলাম ।বিয়েবাড়ি বা বৌভাতবাড়ি বলে চেনার অবশ্য কোন উপায় নেই ।ডেকরেটেড গেট নেই, সানাই নেই, এবং সম্পূর্ণ অ-মাইক ।‘সুরেন্দ্র ওয়েডস্ প্রণতি’—এমন বিজ্ঞপ্তিও নেই ।আসলে এটা স্থানীয় ছেলেদের ক্লাবরুম ।ঠকাস সেক্রেটারির ছেলেকে পড়ায় ।সেই সূত্রেই জায়গাটা একদিনের জন্য ম্যানেজ করা গেছে ।

ঘরটা অবশ্য খুব ছোট নয়, হল বলেও ধরা যায় ।জনা চল্লিশ লোক চেয়ার-টেবিল পেতেবসে খেতে পারে ।এক দিকের দেয়ালে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে দুটি ক্যারম বোর্ড ।এক কোণে দুটি জীর্ণ টেবিল ।তারই পাশে মোটা করে টেপ-জড়ানো এবং ঝুলমাখা একটি ক্রিকেট ব্যাট ।আর এক দেয়াল ঘেঁসে সারি সারি তিনটি আলমারি ।নিশ্চয়ই তার ভিতর ক্লাবের খেলার সরঞ্জাম ।ঘাড় ঘোরাতে চোখে পড়ল স্তূপীকৃত বেশ কিছু ফোল্ডিং চেয়ার ।আর এক কোণে বৌ বসার উঁচু ভেলভেট দেওয়া লৌহাসন ।তাতে এখন একটা নেড়ি কুকুর দেহ এলিয়ে তোফা নিদ্রায় মগ্ন ।ভিতরে খোলা দরজা দিয়ে একফালি উঠোন দেখা যায়। সেখানে কিছু আলু মুলো পেঁয়াজ একটা টবে ঢালা রয়েছে ।এবং সম্ভবত স্টোভে কিছু রান্না চড়েছে ।সেই স্পটে দু’জন কর্মব্যস্ত গামছা পরা লোক চোখে পড়ল ।কিন্তু অভ্যাগত বা আপ্যায়নকারী কোন সম্প্রদায়ের একজনকেও দেখতে পেলাম না ।ঘরের মাঝ-বরাবর একটা সিলিং ফ্যান চালু ছিল ।তার তলায় একটা চেয়ার টেনে বসলাম ।হাঁ করে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম, কিংকর্তব্য ভাবতে ভাবতে ।

মিনিট দশ পর এক ছোকরা রাস্তা থেকে ঘরে ঢুকল ।আমার সম্পূর্ণ অচেনা মুখ এবং পোশাক-আসাক খুঁটিয়ে দেখল ।তারপর খানিকটা ইতস্ততঃ করে বলল—আপনি সাউথ থেকে আসছেন?ঠকাসদার বিয়ের নেমন্তন্ন?

‘হ্যাঁ’ বলে প্রমাণস্বরূপ নিমন্ত্রণ পত্রটাও পকেট থেকে বার করলাম ।

ছোকরা তখন দয়াপরবশ হয়ে বলল—ওঁদের আসতে সাতটা বাজবে ।আপনি বরং ঠকাসদার বাড়ি চলে যান ।রিক্সা রেডি আছে, আজ সারাদিন এবাড়ি ওবাড়ি করার জন্য ।আমার নাম শঙ্কর ।আমি রান্নাবান্না দেখাশোনা করছি ।

প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম ।শঙ্কর রিক্সাঅলাকে ডেকে বলে দিল—দাদাকে সোজা ফ্ল্যাটে নিয়ে যাও ।

রিক্সায় উঠেই পরিস্থিতিটা ঝালিয়ে নিলাম ।এটা এখন সাধারণ রিক্সা নয়, এই নির্দিষ্ট রাস্তাটা যাতায়াতের জন্য,এবং আজকের ভিআইপিদের বহনের জন্য ।বিশিষ্টদের জন্য যেমন স্টেশান বা এয়ারপোর্টে মোটর গাড়ি পাঠানো হয়,যেমন রাজারাজড়ারা হাতি পাঠাতেন, গ্রামের জমিদার এবং বর্ধিষ্ণু লোকেরা গোরুর গাড়ি পাঠাতেন ।তেমনই এই বাঁধা রিক্সা ।এ রাইড সম্মানের, এবং এটা ফ্রী রাইড ।ঠকাস জিন্দাবাদ ।

বিটি রোডে বেরিয়ে উত্তর মখে এগচ্ছিল রিক্সা ।রিক্সাওলাকে শুধোলাম—এখান থেকে ফ্ল্যাট কতক্ষণ লাগবে?

সে বলল—এই তো কাছে ।সাত-আট মিনিট...বলতে বলতে  ডান দিকে এক এবড়ো-খেবড়ো সরু রাস্তায় ঢুকিয়ে দিল রিক্সাটা ।

কোনরকমে শারীরীক ভারসাম্য রক্ষা করে পতন থেকে বাঁচালাম নিজেকে ।তারপর বর্ষায়-যথেচ্ছ-গজানো বনজঙ্গল,পুকুরপাড় ও খানাখন্দ পাশ কাটিয়ে এক সময় এসে পড়লাম দেবেন্দ্রনগরের তাকলাগানো ফ্যাশান-দোরস্ত কিছু ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে ।এরই একটার গেটে থামল রিক্সা ।

                            (৪)

ঠকাসদের ‘কমন’ ফ্ল্যাট তিন তলায় ।দেখা যাক সিঁড়ি কতখানি খাড়া, কতটা এ্যাক্সিডেন্ট-প্রবণ।বুঝলাম,আশঙ্কার কারণ আছে ।সরু সিঁড়িতে আমার পা খানিকটা বেরিয়ে থাকছে ।ল্যাণ্ডিংও তেমন চওড়া নয় ।

ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল ।স্বয়ং ঠকাসই অভ্যর্থনা করল ক্লান্ত অথচ খুশি মুখে ।ওর চোখদুটো সোমাকে খুঁজল ।দুঃখিত মুখে ওকে ভাইরাল ফিভারের দুঃসংবাদটা দিলাম ।বুঝল ।সোমার প্রতিনিধি হিসাবে আমাকেই মেয়ের বাড়ি থেকে পাঠানো তত্ত্বেরট্রেগুলো দেখাল ।পাশের ফ্ল্যাটের ব্যাচিলর ছেলেটি এই উপলক্ষে তার ড্রইংরুম ছেড়ে দিয়েছিল ।সেখানে বসিয়ে আমায় চা খাওয়াল ।বরুণের কথা জিগ্যেস করতে জানালো,ও শ্বশুরবাড়ি থেকে সরাসরি খাবার জায়গায় চলে যাবে ।আর ওর বৌয়ের এখন এ্যাডভান্সড্ স্টেজ, আসতে পারবে না ।

আমার হাতের শাড়ির প্যাকেটটা ঠকাসকেই গছাতে চাইছিলাম ।ও বলল, এসো না, প্রণতির হাতেই দাও ।তোমাদের কথা ও সব জানে ।ব’লে প্রণতির উদ্দেশে বলল—এ্যাই, তোমার সাজগোজ হয়েছে? দ্যাখ প্রণবদা এসেছে ।

বেডরুমের দরজা খুলে প্রণতি বেরল ।নববধূর সাজ সারা হয়ে গেছে তার ।গোলাপী শাড়ি,অলঙ্কার কিছু, মুখে চন্দন-কুমকুম, মাথায় একটা টায়রা পর্যন্ত ।কিন্তু মুগ্ধ হবার কোন ব্যাপার নেই তার শ্যামলা অতিসাধারণ চেহারায় ।শুধু চোখের চাউনি থেকে বোঝা যায় বুদ্ধির ঘাটতি নেই ।আমার হাত থেকে শাড়ির প্যাকেটটা নিতে নিতে বলল—সোমাদি কই? ওর কাছে অনেক শুনেছি আপনাদের কথা ।

বললাম—সোমাও তোমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল ।এমন সময় অসুস্থ হয়ে ও নিজেই নিজের ওপর রাগ করছে ।তোমরা শিগগিরি একদিন এসো আমাদের বাড়ি ।ও যদি তোমায় না নিয়ে যায়, তুমিই ওকে নিয়ে যেও ।

ঠকাস ওর দূর সম্পর্কের মামা এবং রাউরকেল্লা থেকে হঠাৎ এসে পড়া মামাতো ভাই অমলের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল ।দু’চার কথার পর আমরা সবাই ভোজনস্থলে রওনা হবার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলাম ।

আমি ক্লাবঘর হয়ে এসেছি শুনে ঠকাস বলল, তাহলে প্রণতি, মাইমা আর রাকা বৌদি আগে চলে যাক প্রণবদার সঙ্গে অমলের মোটরে ।কি অমল,তোমার ড্রাইভার আছে তো?

অমল একটা টিপিক্যাল ওস্তাদি ভঙ্গিতে কথা বলে,--ড্রাইভার ছাড়া কলকাতার রাস্তায় বেরন যায়? সামনের গ্যারেজ থেকে পিক্আপ করেছি আজকের ছোঁড়াটাকে ।কিছু এক্সট্রা প্রমিস করতে হয়েছে ।

সেই ব্যবস্থামত অমলের গাড়িতে নতুন বৌ ও দুই প্রবীণ মহিলার এসকর্ট হিসাবে আমি রওনা দিলাম ঠকাসের ফ্ল্যাট থেকে ।রিক্সায় ক্লাব থেকে এখানে আসতে পাক্কা কুড়ি মিনিট লেগেছিল ।তারপর রাস্তায় ঐ রামঝাঁকুনি ।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, যাক এবার স্মুথলি ভদ্রলোকের মতো যাওয়া যাবে ।আর কোন ঝামেলা নেই ।শুধু আরাম করে হাওয়া খাওয়া ।মহিলাদের পিছনের সীটে বসিয়ে দরজা লক্ করিয়ে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসলাম ।গাড়ি ছাড়ল ।গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলাম—অ্যায়সা লাগতা হ্যায়, জো না হুয়া, হো নে কো হ্যায়...


                           (৫)

সত্যিই অভাবিত ঘটনাটা ঘটে গেল হঠাৎ, চরম পরিহাসের মত ।যে গাড়ির আশ্রয়ে পরম নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা বোধ করছিলাম, সে-ই বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল ।অবশ্য দোষটা ঠিক গাড়ির নয়,চালকের। 

প্রথম বাঁয়ে ঘুরে একবার ডাইনে তারপর আবার বাঁয়ের রাস্তা ।ওদিক থেকে একটা টেম্পো ঢুকছিল । আমাদের গাড়ি একটু থেমে ব্যাক করে তাকে পাশ দিতে গেল ।আনাড়ি ড্রাইভার কিছু বোঝার আগে বাঁ দিকের পিছনের চাকাটা খানিক নেমে গেল রাস্তার ধারে নালার ঢালে ।গাড়ি কাত হয়ে গেল কুড়ি ডিগ্রি এ্যাঙ্গলে!

বড় রাস্তা হলে আমাদের সমবেত আর্তনাদে শ’দুয়েক লোক জড়ো হয়ে যেত ।কিন্তু এখানে দু-এক জন পথচলতি লোক একপলক তাকিয়ে চলে গেল ।

কী ভাগ্য দরজা জ্যাম হয়ে যায় নি ।ডান দিক দিয়ে সকলে নিরাপদে গাড়ি থেকে নামতে পারলাম । বিয়ের ব্যাপারে ঠকাসের একটা ফাঁড়া আছে, পরিষ্কার বুঝতে পারলাম ।আর একটু বেশি কিছু হলে হয়তো ফুলশয্যার রাত হাসপাতালে কাটাত বৌটা ।আর শ্বশুর ওকে শ্রীঘরে পাঠাত ।কিন্তু এ ব্যাপারে অন্তত বরুণের কোন হাত নেই, এটা হলফ করে বলতে পারি ।

সবাই বেরোবার পর ড্রাইভারকে বললাম—এইবার গীয়ার এ্যাকসিলারেটর বাড়িয়ে দেখ, তোলা যায় কি না গাড়িটা ।

দু’বার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল ছোকরা ।সাফ বলে দিল, লোক ডাকতে হবে ।

গাড্ডায় গড়াতে অন্যকে অনেক দেখেছি; গাড্ডায় পড়া কথাটা জন্ম থেকেই শুনে আসছি ।কিন্তু আক্ষরিক অর্থে আজ প্রথম অভিজ্ঞতা হল ।এখন কি করা যায়? যা করার তো আমাকেই করতে হবে ।সঙ্গে নতুন সালঙ্কারা নবোঢ়া পরস্ত্রী ।রাস্তার মিটমিটে আলোয় ।সন্দেহজনক পরিবেশ ।রাত বাড়ছে ।টিপটিপ বৃষ্টি।এটা ঝেঁপে এলে বিপদের ষোল কলা পূর্ণ হয় ।

মহিলাদের উদ্দেশে বললাম—এমন মাঝপথে ব্যাপারটা হল, এখন আপনাদের ফেলে ফ্ল্যাটে খবর দিতেই বা যাই কি করে!

ঠকাসের মাইমা বললেন—না না,আমরা অপেক্ষা করি ।ওরা কেউ নিশ্চয়ই রিক্সাতে যাবে এ পথ দিয়ে ।

আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম একটা লাইটপোস্টের তলায় হতভম্ব হয়ে ।এদিক ওদিক বাড়ির জানলা ও বারান্দা থেকে কৌতুহলী মহিলা ও শিশুরা নতুন বৌ দেখতে লাগল অবাক চোখে ।চূড়ান্ত বিব্রত মনে হতে লাগল নিজেকে ।

হঠাৎ প্রণতি আমাকে বলল—দাদা, আপনার বেল্টটা দেবেন একটু? চেষ্টা করে দেখি ।

আমি তো অবাক!প্রথমটা বুঝতে পারলাম না কি বলতে চায় নতুন বৌ ।

ও বুঝিয়ে বলল,--আপনার বেল্টটা আমার কোমরে বাঁধব ।আমার কারাটে জুডো অভ্যাস আছে ।আপনি আর ড্রাইভার গাড়ির ডানদিকটা ঠেলবেন ।আমি বাঁ দিকটা তুলছি ।

আমি তখনো হাঁ করে আছি ।প্রণতি শাড়ি খানিক তুলে কোমরে গুঁজে তার নীচে আমার বেল্টটা বেঁধে নিল ।ড্রাইভারকে বলল স্টার্ট দিতে ।নিজে নেমে গেল বাঁদিকের খানায় ।আমি নির্দেশমত গাড়ির ডান দিকটা প্রাণপণেঠেলতে লাগলাম ।

চোখের সামনে যা দেখলাম,একটা অবিশ্বাস্য স্বপ্নের মতো ।সোমাকে গিয়ে যখন বলব,ও হয়ত টন্ট করে বলবে—গল্পের গরু গাছে উঠতে পারে, কিন্তু বৌভাতের সন্ধ্যায় আধুনিক বৌ কোমর বেঁধে গাড্ডা থেকে মোটর গাড়ি তুলবে...ইটস্ টূ মাচ!

কিন্তু দেখলাম,বাস্তব কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত হতে পারে ।

‘ইয়াক্’ করে এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ ।হঠাৎ এক ঝটকায় গাড্ডা থেকে উঠে পড়ে খানিকটা এগিয়ে গেল মারুতি!

ঘাসে পায়ের কাদা মুছে, শাড়ি গুছিয়ে নিয়ে প্রণতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে এল ।এরপর গাড়ি নিরাপদে পৌঁছল গন্তব্যে ।নামার আগে কাঁধে মৃদু ঠেলা খেয়ে পিছন ফিরলাম ।আপনার বেল্টটা ।প্রণতি আমার হাতে ধরিয়ে দিল ।

                             (৬)

ঠকাস ভোজবাড়িতে এসে পৌঁছতে আগে আমিই ওকে ঘটনাটা জানালাম ।শুনে ভয়, বিস্ময়, উদ্বেগ, আনন্দ কিছুই প্রকাশ করতে পারল না ও ।কেবল কয়েক বার চোখ পিটপিট্ করে শেষে বলল—যাক কারো কোন ইনজুরি হয়নি তাই ভাল ।

বললাম, যাও প্রণতির রিস্ট দুটো একটু মাসাজ করে দাও!

ঠকাস এবার বলল—না, শুনে ভয় বাড়ল ।কথা না শুনলেই ধরে ঠ্যাঙাবে!

হাসতে হাসতে বললাম, ভয়ে ভয়েই জীবনটা কাটাবে নাকি?

ঠকাস বলল—আমার প্রফেশানে তো ভয়ই ভয় ।কবে কে ছেড়ে দেয়,ঈশ্বরও বলতে পারেন না ।অফিসেও টেম্পোরারি, আর টিউশানির ক্ষেত্রে গার্জেন ও স্টুডেন্ট দু’তরফের মনোরঞ্জন করে চলা সার্কাসের দড়ির খেলার মতই কঠিন কাজ ।তার ওপর বরুণের কথা তো বললামই ।যাই হোক, সব চে’ বেশি ভয় পেয়েছিলাম এক প্রাইভেট ছাত্রের বাড়িতে ।সে কথা বলেছি কি?...বলি নি ।সেটা একটা অলৌকিক স্টোরির মত ।শোন ।

                        

ছাত্র ক্লাস টুয়েল্ভ-এ পড়ে ।বাবা বিজনেস্ ম্যাগনেট ।বাড়ি আলিপুর রোডের নির্জনে ।আমার পড়ানোর সময় উইকে তিন দিন সন্ধে ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা ।

তখন শীতকাল ।এক দিন হঠাৎ লোডশেড হয়ে গেল সাতটার সময় ।ঘুটঘুটে অন্ধকার ।অরিন্দম বলল, স্যার, জেনারেটারটা খারাপ হয়ে গেছে ।কারেন্ট আসা পর্যন্ত ওয়েট করা ছাড়া উপায় নেই ।

তাই করতে লাগলাম ।

হঠাৎ শুনি ওদের ল্যাব্রাডারটা ভীষণ চেঁচাচ্ছে ।যেন বাড়িতে চোর ঢুকেছে ।অরিন্দম ফ্যান্টম্!ফ্যান্টম্!বলে কুকুরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভিতরের ঘরে গেল ।আমি একা, এমন সময় বাগানের দিকের জানল দিয়ে হুহু করে খানিকটা ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকল, আর তারপরই ঢুকল একটা পাখি...না,না, বাদুড়!তখনি মনে হল শুনেছি, কোন কোন বাদুড় রক্ত চোষে ।এটা যদি রক্তচোষা হয়!

ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, অরিন্দম!অরিন্দম!একটা টর্চ নিয়ে এসো শিগগির!

কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না ।

বাদুড়টা আমার মাথার ওপর চক্কর মেরে উড়তে লাগল ।

শীতের সন্ধেতেও আমার কপাল ঘেমে উঠল ।

যাই হোক,খানিক পরে কারেন্ট এল ।বাদুড় বাবাজিও তার কেরামতি দেখিয়ে যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই বিদায় নিলেন ।

কিন্তু অরিন্দম ঘরে ঢুকে যা বলল, তাতে নতুন করে আমার মাথা ঘুরে গেল ।

‘দিয়েছি ব্যাটাকে জাহান্নমে পাঠিয়ে!’

-‘কাকে আবার জাহান্নমে পাঠালে?’

‘বাবুর্চি সুখদেবকে ।খামোখা কুকুরটাকে ধরে পেটাচ্ছিল!’

-‘তুমি কী করলে?’

একটা ভারি হাতা দিয়ে দিয়ছি মাথায় এক জোর ব্লো ।একদম ফ্ল্যাট!বোধ হয় মরে গেছে ।’

শিউরে উঠে বললাম, ‘সে কী!খুন করলে তো পুলিশ ধরবে তোমায়!জেলে যেতে হবে!’

অরিন্দম অদ্ভুত উদাস গলায় বলল, ‘পুলিশ তো ডাকব যদি ও আধ ঘন্টার মধ্যে রিকভার না করে ! কিন্তু আপনি তার আগে কেটে পড়ুন ।পুলিশ এলে আপনাকে বিস্তর জেরা করে রাত কাবার করে দেবে!’ 

আমার একবার মনে হল ডাক্তার ডাকতে বলি ।কিন্তু আত্মরক্ষার তাগিদটা আরো বড় মনে হল ।

বললাম, ‘ঠিক বলেছ!তাহলে আমি আসি এখন!’ 

দরজা দিয়ে সবেগে বেরিয়ে রাস্তায় নামলাম ।তারপর জাজেস্ রোড ধরে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটে শেষ পর্যন্ত গোপালনগরের মোড়ে লোকের ভিড়ের মধ্যে এসে স্বস্তি পেলাম ।***

                         (৭)

গল্পটা শুনে বললাম, ‘দারুণ ইন্টারেস্টিং এক্সপিরিয়েন্স তো!...তারপর তুমি আবার ঐ ছাত্রকে পড়াতে গিয়েছিলে?’

ঠকাস বলল, ‘কয়েক দিন পরে একদিন সকালে গিয়েছিলাম ওদের ওখানে ।কয়েকবার কলিং-বেল দিয়ে বুঝলাম ভিতরে কেউ নেই ।এই দরজা আর খুলবে না ।কী যে সে রাতে হয়েছিল, মানে বাবুর্চিটা—যে আমাকে অনেক ফিশফ্রাই, বিরিয়ানি খাইয়েছে—সত্যি মারা গিয়েছিল কি না, সেটা কোনদিন হয়তো জানতে পারব না!’

-‘যাক গে এখন আমাদের ফিশফ্রাই খেতে আর দেরি করা যাবে না!খাবার বন্দোবস্ত ঠিকমত হচ্ছে তো?’

ঠকাস বলল, ‘ও নিয়ে ভাবনা নেই ।সন্টা দা’কে ইন-চার্জ করে দিয়েছি ।সব কাজ ঠিকঠাক হবে ।’

                       

পরের দৃশ্য ।সেই ক্লাবঘর এখন রীতিমত ভোজঘরে রূপান্তরিত ।ঘড়িতে আটটা ।যারা আসার প্রায় সব এসে গেছে ।বুফে স্টার্ট হয়ে গেছে ।নতুন বৌ সিংহাসনে বসেছে মানানসই ভাবে ।হেসে হেসে গল্প করছে নিজের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ।ঠকাসের মামা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পলিটিক্স আলোচনা করছেন ঠকাসের শ্বশুরের সঙ্গে ।দু-চার জন প্রতিবেশী ।ঠকাসের কিছু অফিস কলীগ ।

সাড়ে আটটা ।মুরগীর ঠ্যাং চুষতে চুষতে লক্ষ্য করছি লোকজন ।আর থেকে প্রণতির অদ্ভুত ক্ষমতার কথা ভাবছি ।ওর চেহারার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছি না ।

চোখ পড়ল বরুণের দিকে ।কে একজন ওর নাম ধরে ডাকল বলেই বুঝলাম ।চেহারায় মিল আছে ঠকাসের সঙ্গে ।তবে গোঁফ নেই, আর গতরে একটু ভারি ।চোখের ধূর্ত ভাবটা হয়তো আমার স্বকল্পিত।একজনকে বরুণ বলছিল, বেশি করে নিন ।বুফেতে এটাই সুবিধে ।ও কি খাবার শর্ট পড়িয়ে ভাইকে অপদস্থ করার তাল করছে?ছেলেমানুষের মত আমার চোখ বেশ খানিকক্ষণ অনুসরণ করল ওর প্রতিটি মুভমেন্ট ।যদি তদারকি করার অছিলায় কোন খাবারের পাত্রে পকেট থেকে কিছু বার করে মিশিয়ে দেয়!

আবার সিংহাসনের দিকে তাকালাম ।ক্লাবের সেক্রেটারি এসেছেন ।ঠকাস পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ।প্রণতি মুচকি হেসে তাঁর হাত থেকে ফুলের তোড়া নিচ্ছে ।

না,ঠকাসের চয়েস একদম রাইট চয়েস ।প্রণতি ঠিক সামলে দেব ।বিপদ বা সমস্যা যাই হোক ।আমি নিশ্চিন্ত মনে আইসক্রিমের দিকে হাত বাড়ালাম ।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024