ছোট গল্প - ছায়াজীবনের বিন্দু || লেখক - ঋভু চট্টোপাধ্যায় || Written by Rivu Chattyapadhay || Short story - Chaya Jiboner Bondhu


 


ছায়াজীবনের বিন্দু                   

 ঋভু চট্টোপাধ্যায়


 বাইরে বেরিয়েই গায়ে তাপ লাগল মনসুর চাচার।একবার আশমানের দিকে তাকিয়েও নিল, ‘হায় আল্লা, এই সকালেই এত তাপ।’একটু আগে বিছানা ছেড়ে উঠেই চালের নিচে শুকনো ডাবাগুলো একবার সরিয়ে সরিয়ে রাখল, এটা অবশ্যি ঘুম থেকে উঠে রোজের কাজ, যেদিন পানি হবে যদি কয়েকটা ফোঁটাও ডাবাতে পড়ে এই আশাতেই রাখা।তারপর ডান হাতের লাঠিটা আর একটু শক্ত করে ধরে একপা একপা করে এগিয়ে সামনে হাসমতের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই দেখল ও তখন উনুনে পাখা করছে।চাচা এক বার গলা হেঁকারি দিয়ে বলে, ‘কি রে এত দেরি করলি কেনে?’ 

–কি যে বল চাচা, রোজার মাসে চা আর বিক্রি হচে কই? কিন্তু তুমি আজ কি মনে করে ?

-আজ আর সাহরি খেতে উঠি নাই,কাল পা ট কেটি গেছে, গল গল রক্ত, আজ আর রাখব নাই,কাল শরীর ভালো লাগলে রাখব, নইলে সেই সাতাশে।

–পায়ে হল কি?

-হুতরোতে ঘা লেগিছে রে পোতা, পাটা বাঁধার সময়।

উনোনের ধোঁয়ার মাঝেই বেঞ্চে বসতে বসতে বলে,‘সিয়াম রোজা রাখার জন্য স্ময়ং আল্লা আমাদের ফরজ করেছেন, এতে তাকওয়া লাভ হয়, তবে আমার তো বয়স বাড়ছে, আর সবগুলো পেরে উঠিনা।’ তারপর আবার বিড় বিড় করে, ‘রোজা মানে শুধুই না খেয়ে থাকা নয়, সব সময় ভালো থাকতে হবেক, নিজেকে বাঁধতে হবেক, তবে যে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে থাকা যাবে।’ কিছুক্ষনের মধ্যে আরো কয়েকজন হাসমতের দোকানে এসে বসে, মনসুর চাচা তাদেরকেও রোজা না করবার কারণ বলে।

 দোকানে সবাই বসলেও সবাই চা পান করে না।হিন্দু পাড়া থেকে যারা এই রাস্তা দিয়ে কাজে বেরায় তারা মাঝে মাঝে এই দোকানে বসে চা পান করে।তাও হাসমত প্রতিদিন সকাল সন্ধে দোকান খোলে, গল্প করে।সাহা পাড়ার বিনোদ এসে দোকানের কাছে দাঁড়াতে যায়।উনোনে তখনও ধোঁয়া উঠছে দেখে আর না দাঁড়িয়ে চলে যায়, যাবার আগে বলে যায়, ‘এত দেরি করে উনোন জ্বালালে হবে, আমরা কাজে যাবো না।’

-রোজার মাসে সকালে এ’পাড়াতে বিক্রি নাইরে।

মনসুর চাচা চুপ করে বসে থাকে,এখন আর ভালো করে দাঁড়াতে পারে না, হাঁটা চলা করলেও সেরকম জোর নাই।বসে বসে গুন গুন করে গান গায়, কয়েক জনকে আসতে দেখেই জিজ্ঞেস করে,‘বীজ কিনলি রে পটল? কত লিছে?’

 –লাল সন্ন, সত্তর,তাও চাচা ভকতের দোকানে খুব লাইন,আমি পাশেরট থেকে নিলম, মনে খুঁত রই গেল। ভকতের দাম বেশি, কিন্তু বীজট ভালো। 

মনসুর চাচা লম্বা শ্বাস ফেলে পটলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বীজ তো হবেক পানি কই? আশমানের কুনু ম্যাগ নাই, সরকার পানি দিবেক কুনু কথা জানিস?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,‘তুই কি আর বাজারের পানে যাবি? তইলে আমার কিলো বিশ আনতিস।’

–তুমি অত কিলো লিয়ে কি করবে চাচা, তুমার তো মোটে চার বিঘা জমি।

মনসুর হাসে, ‘জামাই ঘরে পাঠাতে হবেক রে, উখানে ভালো বীজ নাই।’

-ইবার জমি বিচি দাও চাচা, দেখবেক কে?

 মনসুর চাচা এর উত্তর না দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘পানি দিবেক কিনা সেট বল? কি শুনলি তুরা, গত বছর তো দেয় নাই,  উপরের অবস্থা ভালো লয়, অম্বুবাচির আগে বীজ না ফেললে হবেক কেনে?’

-আজ গাঁয়ের সবাই বিডিও অপিসে যাবেক বলছিলেক, জলের কথা হবে, তুমি যাবে?

-আমি!গেলেই পানি দিবেক, গেল বছরের আগের বছর তো গেছলম, দিলেক কিছু?

-বীজ ফেললে পানি না হলেও তো সেই ফের।

চাচা একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে  আস্তে আস্তে উঠে দোকানের পিছনে যায়, ফিরে সামনে এসে বলে, ‘হাসমত, তু তো ডাবা গুলান রাখিস নাই, পানি জমলে তুরই ভালো।’

-আ চাচা, তুমার বেরাম এখনো গেলেক নাই, এই ডাবার পানিতে কি হবেক? একজন শুধায়।

আরেক জন জিজ্ঞেস করে,‘চাচা এখন ক’টা ডাবা রাখলে?’ চাচা উত্তর না দিলেও পাশের থেকে হাসমত বলে ওঠে,‘অনেক কটাই হল, আমার দুকানে, মসজিদে, চাচার ঘরে, মোহরদের ঘরে।ইদগারের পাশকে একটক গোঁরেও করিছে।’

দোকানে আরো কয়েকজন ছিল, তারাও হেসে উঠে বলে, তাদের একজন বলে,‘চাচাতো ইবার ভোদার পানিও জমাইবার লগে বলবেন, অত পানি পানি করে মরবেন, ঘরে তো কেউ নাই, পানি বাঁচাইবার কথা বলেন, ঘরের কাউরে তো বাঁচাইতে পারেন নাই।’

চাচা একপা এগিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কার ব্যাটা? হাকিমের ?’ 

–হঁ, চাচা। 

-শুনরে পোতা মরা মানে তো আবার আল্লার কাছেই ফিরে যাওয়া, মালাক উল মউত, আজরাইল যেদিন ডাকবে সেদিন তো যেতে হবেই, আমি পানি রাখতে পারব, কিন্তু আখিরাতের দরজাতো বাঁধতে পারব নাই।

–সিরাজুলের কত বয়স হত চাচা?

চাচা আরেকবার যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়, ‘হিসাব তো করতে পারব নাই, মুদুনির লিখাটও মুছি গেছে, তবে মোল্লা পাড়ার আসগর ও সিরাজুল দোস্ত ছিল।’ 

–আসগর মানে মনিরুলের আব্বা,তারমানে চল্লিশ পেরায় গেছে,তুমার নাতিনট কুথাকে থাকে?

-উয়ার নানির বাড়ি, আমার কাছকে থাকলেক নাই, না উ, না উয়ার আম্মি।

মনসুর চাচা আর কিছু না বলে এক পা এক পা করে এগিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর আগে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আমার বীজটা এনে দেবার কি করবি?’ 

-জলিলের বাড়ি যাও, কালকে ভগতের দোকানে বীজ কিনতে পারে নাই, ভিড় ছিল, আমার সাথে দেখা হনছিল। মনসুর চাচা জলিলের বাড়ির দিকে পা বাড়াতে আরম্ভ করে।   

 পথে একবার মসজিদে যায়, ধূপ জ্বালায়, ইমামের সাথে কথা বলে, ডাবাগুলো দেখে।‌চোখ দুটো ভিজে যায়। বাড়িটা এক্কেবারে শেষ হয়ে গেল, একমাত্র ছেলেটা একদিন কেমন হট করে মরে গেল।পতাকা লাগাতে গিয়ে ঝামেলা, একই পার্টি, তাও মাথায় মারল, শেষ।মনসুর আবার সেদিন মেয়ের বাড়িতে ছিল, একটা লাতিনের নিকার কাচের কথা হচিল, এর মাঝেই খবর এল।সে কি ভয়ানক চেহেরা, হাসপাতাল থেকে লাশটা পেল দুদিন পর, গোটা মাথা ব্যান্ডেজ বাঁধা।বুকটা ধক করে উঠেছিল।সেই কয়েকবছর আগে বিবিটা একদিন হঠাৎ করে তিনদিনের জ্বরে মরল, ছেলের নিকা দিল, পোতা হল, বেশ সুখেই চলছিল।

‘হে আল্লা আমি তো কুরান ও সুন্নাহ অনুযায়ী নেক আমল করে নামাজ, রোজা, জাকাত পালন করিছি, শুধু হজ হয় নাই,হে আল্লা, আমার পোলাটাকে দুনিয়ার ফেতনা থেকে রক্ষা কর।’

মনসুরের চোখের পানিতে মনে হয় যেন আবার কাফন ভিজে যাবে।ভালোই হয়েছে এই সময় ওর আম্মিও নেই, এটা আম্মির নসিবে সইত না। 

মনসুর চাচা এই সব ভাবতে ভাবতেই একপা একপা করে এগিয়ে জলিলের বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁক দেয়, বীজ কেনার কথা বলে।জলিল বলে, ‘চাচা, বীজ কাল রেতে নিয়ে নিনছি, আশমানে পানির অবস্থা ভালো লয়, ধুলোর বীজ করব, নিয়াজে লাভ হবেক নাই, গত বছর নিয়াজ করে পাঁচ’ছ কিলো বীজ পচে গেল, এবার আর বীজ কেনার টাকা নাই, এখনো তো ধান বিক্রির টাকা ঢুকে নাই, কুথাকে পাবো বল?’ 

–তইলে আমি বীজট আনবো কুথাকে?

-আরে চাচা বীজের ব্যবস্থা হবেক, কিন্তু পানি, উটোতো কিনতে লাড়বে।

–সরকার দিবে নাই?

-আগের বছর থেকেই তো দিছে নাই।

–জল কিনতে হবেক, দেখি কার পাম্প লাগাবেক?

–কুথা থেকে কিনবে চাচা, মাটির জল লিতে দিছে নাই, অবস্থা ভালো লয়, কয়েক দিন দেখ পানির ব্যবস্থা হোক, বীজের ব্যবস্থাও হয়ি যাবেক। 

মনসুর চাচা আর কিছু বলে না।কথাগুলো তো সত্যি, চোখ বন্ধ করতেই মাঠের মাঝে তার আব্বা আসে, পাশে ছোট্ট মনসুর,আব্বার এক জোড়া বলদের মাঝে পাচন।পাচনে, বলদের পায়ে কাদা লাগে। মনসুরের গায়ে কাদা লাগে, মাথায় পানি পড়ে।আব্বা পানিতে ভিজে হাল চালায়, মা ধান ঝাড়ে।কুটো কুড়ায়, মায়ের পেট হয়, নতুন ভাই আসে, বোন আসে, তারা বড় হয়, আব্বার সাথে সবাই মাঠে নামে।মনসুরের দুচোখে পানি নামে।আশমানে শুখা ভাব, এই সকালেই গায়ে জ্বালা ধরে।গ্রামের অনেকেই হাসপাতালে ভরতি।হিন্দু পাড়ায় চব্বিশ পহর হল, ছোট বেলা আব্বা বলত, ‘ঐ শুন, হরিনাম হচে, ইবার পানি নামবেক।’ মনসুর আশমানের পানে তাকিয়ে পানি খুঁজত, পানি পড়ত, মাঠ জল থৈ থৈ করত, কত দিন পাড়ার রহমত, বিলাল, সাবিরদের সাথে চাষের মাঠেই সাঁতার দিত। সাবিরট আলকেউটের কামড়ে মরে গেল, ওর আম্মির সে কি কান্না, মনসুরের চোখের পানির সাথে সাবিরের আম্মির চোখের পানি এক হয়।মনসুর চাচার বুক কাঁপে, শরীরে গরম লাগে, ঘামে ভাসে খালি গা, গলায় গামছা, ঘাম মোছে। 

 চাচা জলিলের ঘর থেকে বেরোনোর পর একটা গাছের নিচে বসে।জলিল বেশি কথা বলতে পারে না, হাটে যাবার তাড়া দেখায়। মুখে বলে,‘চাচা, আজ ইমাম সাহেবের খাবার পালি ছিল, রোজা চলছে, উনি বললেন ইফতার দিয়ে দিতে।’ জলিল হাটে যায়, কিন্তু চাচা যাবে কই?একা একা হাটে যেতে সাহসে কুলায় না,ঘরের ভিতর গরম, পাখা নাই, কারেন্ট নাই, রেতে বাইরের বারান্দাতে শুতে হয়।এক ভাইয়ের পোলা জামিল, দুবেলা ভাত দেয়, চাল নেয়, চাষের ভাগ নেয়, ব্যাটার নিজের জমি নাই, বাপে দেয় নাই, গাঁয়ে গাঁয়ে ফেরি করে।জামিলের বিবি হাসিনা।আর কিছু দেয় না, সকালে এমনি মাসে ভুক লাগে তবে জানে জোর নাই,একবার ডাক্তার ঘর যেতে পারলে হত, কে নিয়ে যাবে? মনসুর চাচা একপা একপা করে এগোয়। 

–চাচা ধানের টাকা ঢুকল ? 

কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়ায় মনসুর, ‘ও, হিরু! আমি তো সরকারের কাছে ধান বিচি নাই, মিলে দিনছি, তাও ইবার পুরো টাকা দেয় নাই,ইয়ার থেকে মোহনকে দিলেই ভালো হত হাতে হাতে টাকা তো দিত।’

–আমিও তাই ভাবছি, কিন্তু উটো মহা ফোড়ে।গেল বছরের চাপানের টাকা দিতে পারি নাই, এবছর পুরো টাকা না মেটালে চাপান তুলতেই দিবে নাই।

–হিরু, আমার জন্য দু’বস্তা রেখে দিবি বাবা, আমার তো আর বাইরে থেকে আনার খেমতা নাই।

-সে হবে ক্ষণ, আমি পেলে তুমিও পাবে, তবে এখন ঘরে চলি যাও, গরমে বেশি ক্ষণ বাইরে থেকো না, এই দুদিন আগে এক জন গরমে মরি গেল, হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া গেল না।

–আর বাবা আমার কি আর নসিবে এত সুখ আছে ?

-এরকম কেন বলছ চাচা? জন্ম মৃত্যু সব তো ভগবানের দয়া, দান, তুমি আমি কেউইতো নিয়মের বাইরে নয়। শেষের কথাগুলো বলতে বলতে হিরু সামনের দিকে এগোতে আরম্ভ করতেই চাচা পিছন ডাকে,‘তুই বীজ কিনতে গেলে আমার লগে আনিস, কিলো বিশ আনতে হবে, আমি আনবার খরচ দিব।’ 

-আমি একটু বেলার দিকে যেছি, তুমাকে বলে যাবো। 

মনসুরের প্রাণ জুড়োয়।বাইরেটা দোজখের আগুনের মত, গায়ে ফোস্কা পড়ে।ছোট বেলাতে তো অতটা তাপ দেখে নাই, গরম কালে দিব্যি সব কাজ করা যেত, চাষ হত, পানি নামত।এবছর বোরোর চাষ নাই, ধানের টাকা নাই। গ্রামের কুয়োতে পানি কমছে, গেরামের পি.এইচ, এক বার জল দিছে।

হিরু  কিছু দূর গিয়ে ফিরে আসে, ‘চাচা একট কথা বলব? এবছর জমির চাষ আমি করি, অধের্ক হিসাব, কেউ কিছু বলবেক নাই।’

 চাচা শ্বাস ফেলে, ‘ভেবে দেখব, তবে জানিস তো অর্ধেকে আমার হবেক নাই, মেয়েকে প্রতি বছর টাকা দিতে হয়, জামাই যে খুব পাজি, এক্কেবারে ইবলিশ, হাসমতকে দিতে হয়, উয়ার তো জমিন নাই।’ কিছু সময় থেকে বলে, ‘তুদের পাড়ার কালি পুজো কবে?’

-দাঁড়াও ছুটু লোকদের মনসার পুজোট হোক, গেল বছর শুনলে নাই কেমন ঝামেলা হল, ই’বছর বলি দিছি, শালাদের মনসা আগে হোক, তারপর আমাদের কালি হবে।এবছর আমরা মনসার কুনু চাঁদা দিছি নাই চাচা।

মনসুর চাচা আবার শ্বাস ছাড়ে।হিন্দু পাড়ার মনসাটা খুব পুরানো, মনসুর চাচাও ছোট বেলাতে পুজো দেখতে যেত, কতবার ওষুধ এনেছে, এই মুসলিম পাড়ার অনেকের মনসার ওষুধে পেট হইছে, শুনেছে মনসার থানট নাকি সারায়ছে।একবার গিয়ে দেখে আসবার স্বাদ হয়, ভয়ও হয়, পায়ের জোর নাই।গেল বছর মনসার পুজোর সময় ফের ছিল, থানা পুলিশ, কত জনকে পুলিশে ধরে লিয়ে গেছিল, ই’পাড়াতে বসে বসে সব শুনিছে মনসুর।মনসার পুজোতে পার্টিও জড়ায় গেছিল।ই’পাড়াতেও জড়ায় ছে।কয়েকমাস আগে ইসমাইলের ব্যাটটকে মসজিদের থামে  সারারাত বেঁধে বিচার করলেক, ব্যাটাট অন্য পার্টির পতাকা লাগায়ছিল, কি মার মার।ইসমাইল  হাতে পায়ে ধরে,  উয়ার বিবিও পা ধরে।গ্রাম থেকে তার কাছে জরিমানা চায়, কত টাকা মনসুর চাচা জানে না, তবে অনেক টাকা, অত টাকা চোখে দেখে নাই।ইসমাইল জমি বিক্রি করে। সাইকেল, থালা বাটিও বেচে, তাও টাকা ওঠে নাই, গাঁ ছাড়া হয়। 

মনসুর আবার হাঁটতে আরম্ভ করে।একটু ফেরিঘাটের পানে যেতে হবে। পানি থাকলে কারোর কাছে পাম্পটা নিয়ে   ছড়ানো যাবে।একটু আগে করলে লেবার পাওয়া যাবে, এখন আর সাঁওতালগুলো আসতে খুঁজে না, ফিকির বানায়।আগে দল বেঁধে গাঁয়ে আসত, থাকত। একবার রোয়ার সময়, একবার কাটার সময়। চাপানটা গাঁয়ের লেবার দিয়ে হত। হিন্দু পাড়ার ঘোষেদের সাধন ঘোষ প্রতিবছর পাঁকুড় যেত, তখন ফোন ছিল না, সাঁওতাল লেবারদের গ্রামে আনবার জন্য আগে থেকে আসার ভাড়া দিয়ে আসতে হত।একবছর  ফিরে এসে কয়েকদিনের জ্বরে মারা গেল।সবাই একটু অবাক হয়ে গেছিল, কেউ বলল মশা কামড়ে দিয়েছে, কেউ বা, ‘কিছু খাইয়ে দিয়েছিল।’ চাচা শুনল ঘোষের নাকি চরিত্র মোটেই ভালো ছিল না, ওখানেও কিসব বদমাইশি করেছিল, ওরাই কিছু খাইয়ে দিয়েছিল, ঘরে ফিরে মারা গেল।তারপর থেকে কেউ আর পাঁকুড় যায় না, দু’বছর ওদের ওখান থেকে কেউ আসে নাই, আবার আসছে, তবে এখন  ফোনে বললেই হয়, যারা পারে আসে, সব কাজ করে তারপর টাকা নেয়।  এখন লেবারও কম লাগে, সব মেসিনে হয়, ঘন্টায় আড়াই হাজার দাও ধান কাটো, মিনিটে পঞ্চাশ থেকে একশ টাকা দাও  ট্রাকটর চালাও।মনসুর চাচা জমির দিকে তাকায়, ফাটা জমি, মায়ের পায়ের মত, শুধু জমির বুক খুঁজে পায় না,তাও এক পা একপা করে লাঠি ধরে ধরে যায়, জমির আল ধরে বড় রাস্তা ধরে।ক্যানেলের কাছে গিয়ে অবাক হয়ে যায়, পানি কই, এ’তো ভিতরের পাথরগুলো সব গোনা যেছে, হাঁটুও ডুববে না,‘হায় আল্লা! এই সময় পয়ার উবছে পানি আসে, এখন রুখা শুখা, ভালো লাগে না।’

 এত দূর চলে আসার পর মনসুর চাচার ভয় লাগে, হেবি ভয়।চাচা, ক্যানেলের মুখে দাঁড়ায়।কেউরে নিশ্চয় পাওয়া যাবে, গাঁয়ে ছেড়ে দিতে বলবে,এই রোদে লুক কই? চাচা হাঁটার কথা ভাবে, পারে না, ক্যানেলের পারে বাঁজা আম গাছের নিচে বসে।খোলা আশমানের নিচে দাঁড়ালে গায়ে ফোস্কা পড়ে, এটাই কি দোজখ? রাসুলুল্লাহ আরাইহি ওয়া সাল্লাম।জানে হাল্কা বাতাস লাগে।চাচা গাছের গায়ে হেলান দেয়, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে।একটু পরেই চমকে ওঠে।হা,আল্লা চোখ লেগে গেছিল নাকি? চাচা উঠে ক্যানেলের জল চোখ মুখে ছেটায়, তারপর আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে যেতে যাবে এমন সময় একটা ভিড় তার দিকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ায়।গাঁ থেকেই আসছে তো, এত লোক কুথাকে যাবেক।ভিড়টা চাচা চিনতে পারে, সবাই তার নিজের পাড়ার লোক।আরো সামনে আসতেই চাচা হাঁক দেয়, ‘আরে লিয়াকত, এই গরমে যাস কুথা?’

-চাচা তুমার সাথে এসে কথা বলব, এখন তাড়া আছে।কোমলপুরে হিন্দুরা আমাদের আল কেটে দিনছে, পানি দিলে উদের গাঁকে ঢুকি যাবেক।

–পানি কই, হুই দ্যাখ, পাথর দেখাচ্ছে।

-তুমি বীজতলা করগে যাও পানি দিবেকই, বিডিও অপিসে কথা বলিছি, না দিলে ভেঙি দিব অপিস। 

চাচা আর উত্তর দিতে পারে না।জানটা একটু জুড়াল,বাড়ির রাস্তা ধরে।

একটু বেলা হতেই গ্রামে হল্লা পড়ে।কোমলপুরের সাথে মোহনপুর গ্রামেও হিন্দুরা ক্যানেলের পানি নেবার লগে আল কাটে, তার একটু আগে ভবদিয়ার মুসলিমরা আল কাটে।বিডিও অফিস থেকে সামসের এসে খবর দেয়, খুব ঝামেলা হচে, পুলিশ এয়েছে।জল সবাই নিবেক, চাষ হবেক। চাচার কানে সব কথা আসে, চাচা তাও বসে থাকে, ট্যাঁকে টাকা গোঁজা, হাতে থলি, বীজ কিনতে হবেক।ভয় লাগে, জলের জন্য যদি গ্রাম জ্বলে, কে নেভাবে, কে জমিতে নামবে, কে বীজ ছড়াবে? গেরামের জুয়ান সব যদি গেরাম ছাড়া হয়?সেই যে বছর সিরাজুল মরল, সে বছর গাঁয়ের জোয়ানরা সব গাঁ ছাড়া ছিল, এক মাসের বেশি।চাচা আশমানের  দিকে তাকায় রুখা আশমান, ভয়ে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে যায়, দুপুরের রোদ আরো বাড়ে, চারদিক শুখা।মনসুর চাচা বাড়ি ফিরে ভাত দিতে বলে,কেউ শোনে না, লোক নাই।একটা নাতিনকে ডাকে, ভাত দিতে বলে।লাতিন বলে, ‘কে দেবে, আম্মি নাই, আব্বাও জলের অপিস গেছে।’

-তুরা খাস নাই?

-আমাদের আম্মি ভাত রেখে ছিল, তুমি ছিলে নাই।

মনসুর চাচা লাঠি ধরে ধরেই আবার নিজের ঘরের ভিতরে যায়, তাক থেকে মুড়ি বের করে, জল ভিজেয়ে মুড়ি খায়।সারাদিন খুব ঘোরাঘুরি হয়েছে, শরীরে আর যুত নাই।ঘরের ভিতরে খুব গরম, দাওয়াতেই একটা শীতলপাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।চোখও লেগে যায়, কতক্ষণ লেগে ছিল, জানে শান নাই, চোখ দুটো খুলতেই দেখে  চারদিকটা কেমন যেন আঁধার পারা হয়ে গেছে।মাথার কাছকে ভাতের থালা নাই, সাঁজে ভাত খেতেও ইচ্ছে করে না।একপা একপা করে মসজিদের দিকে যায়, ইফতার কি হয়ে গেছে, হলেও বা কিছু না কিছু ঠিক খাওয়া যাবে, না হলে ইমামের ঘরেও কিছু পাওয়া যাবে।চলার পথে বিড় বিড় করে ‘জাহাবাজ জামাউ;ওয়াবতালতিল উ’রুকু; ওয়া ছাবাতাল আঝরু ইনশাআল্লাহ।’( ইফতারের মাধ্যমে পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান সাওয়াবও স্থির হলো।’)।মসজিদের কাছে আসতেই থমকে ওঠে, কে রে বাবা, এত লোক! মনসুর গিয়ে ইমামের কাছে বসে।শুধায়, ‘কি হল জি?’

-চাচা কি কবর থেকে উঠে এলে, গাঁয়ের খবর কিছুই জানো না নাকি?

মনসুর ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘না গো বাবা, কিছুর খবর নাই, বয়স হয়ছে তো, জান খারাপ।’

-গাঁয়ের অনেককে পুলিশে বিডিও অফিস থেকেই তুলে লি গেছে, তুমি কিছুই জানো না?

–না গো বাবা, কত জনকে? 

-অনেক পুরুষকে, এই যারা অফিসে যায় নাই তারাই আছে।

মনসুরের আস্তে আস্তে অনেক কিছু মনে আসে।লিয়াকতরা সকালে অফিসে যাচ্ছিল। চাচা বলে, ‘ কোমলপুর আর মোহনপুরের হিন্দুরা ক্যানেলের ড্রেন কেটে নিজেদের গ্রামে পানি ঢোকাচ্ছে।তার মানে ওরাই ঝগড়া করছে?’ 

–ঐ মোহনপুর আর কোমলপুর গ্রামের সাথে কি মারামারি হইছে?

-শুধু হিন্দু গ্রামের দোষ দিয়ে কি লাভ চাচা, আমাদের গ্রামে পানি এলে সবাই পাবে, মোহনপুর কোমলপুরেও মুসলিম আছে।

–ওদের গাঁয়ে পুলিশ এয়েছিল, কয়েকজনকে খুঁজছিল, আমাদের গাঁয়েও আসতে পারেক, বাবুল, জুসিম পালাইছে। 

চাচা কথা বলে না, তবুও জোরে শ্বাস পড়ে।আজ ইফতার হয় নাই, সবাই পানি দিয়ে কোন রকমে রোজা খুলেছে। কাউরির খাবার মন নাই।

–তুমার জামিলও হাসপাতালে ভর্তি সেটো জানো ? 

চমকে ওঠে চাচা,‘কই, বৌ তো কিছু বললে নাকো?’

জামিলের তো জমি নাই, উয়ার বাপ এক ছটাক জমিও দেয় নাই, বেচারা গাঁয়ে গাঁয়ে ফিরি করে বেড়ায়।

–উয়াকে মারলেক কেনে ?

-তা তো জানি না, বিডিও অপিসে গাঁয়ের কয়েকজন ছিল তারাই হাসপাতালে নিয়ে গেছে, হাসিনা তো থাকছে গা। মনসুর চাচার সব মনে পড়ে, এই জন্য দুপুরে ভাত পায় নাই।কিন্তু একবার বলে যেতে পারত। চাচার চোখের সামনে সিরাজুলেও মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছবিটা চলে ভেসে আসে। কি ভয়ানক, এখনো তো উয়ার খিলালের ত্যানাগুলান মাটিতে মেশে নাই।

 চাচার হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করে।একপা এগিয়েও মসজিদের চাতালে বসে পড়ে।কয়েকজন তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞেস করে,‘চাচা, জান খারাপ লাগছে নাকি, ঘরকে যাবে?’ 

চাচা রা কাড়ে না।হাতে লাঠিটা ধরেই বসে থাকে।জামিলটা  সিরাজুল হয়ে যাবে না তো? মনসুর আল্লাহ তায়ালার কাছে দয়া রহমত চায়, দোয়া মোমিনের অস্ত্র,দীনের স্তম্ভ, আসমান ও জমিনের নুর, তার কাছে আর কোন জিনিস এর বেশি ফজিলত ও সম্মানের নেই।জামিলের বড় ব্যাটাটাও তো ছুটু, ঘরে একাই আছে, হাসপাতালেও তো হাসিনা একা, তাহলে?

চাচা কিছু সময় চুপ করে বসে থেকে লাঠি ধরেই ইমামের কাছে গিয়ে বলে,‘হুজুর গাঁ থেকে কেউকে আজকের রাতে জামিলের কাছকে যাবেক নাই?’ 

হুজুর কিছু সময় চুপ থেকে উত্তর দেয়, ‘এমন কথা কেন বলছেন চাচা? বুঝেন তো অনেক জনকে পুলিশ ধরিছে, উখানেও যেতি হবেক।’

-কিন্তু হুজুর আমার জামিলটাও যে খুব একা।

শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই চাচা ডুকরে কেঁদে ওঠে।সবাই অবাক হয়,আশমানের পানে তাকায়, কে’জানে কতজন দোয়া করে আর কতজন আশমানের ঘরে এক টুকরো মেঘ খোঁজে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024