ছোট গল্প - এমনও হয় || লেখক - সিঞ্চিতা বসু || Written by Sinchita Basu || Short story - Emono Hoi


 

এমনও হয়


সিঞ্চিতা বসু 



যন্ত্রমানবের শতবর্ষে এসে আজ আপনাদের এক যন্ত্র দুনিয়ার গল্প শোনাই l প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ডঃ রজত গোস্বামীর কাছ থেকে জানা ঘটনাটি বলছি,যদিও এর শেষ আমার জানা নেই l কারণটা হলো টেলিপ্যাথির মাধ্যমে ওনার সাথে যতটুকু যোগাযোগ ছিল,ততটুকুর কাহিনী আমরা জানতে পেরেছি l ক্রমে যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে,সিগন্যাল  ক্ষীণ হতে হতে হারিয়ে গেছে l

               ডঃ রজত গোস্বামীর কাজ ছিল এসকেপ ভেলোসিটি বা মুক্তি বেগ নিয়ে l পাঠকরা নিশ্চই মুক্তিবেগ কি তা জানেন,মানে গতিবেগে ছেড়ে দিলে কোনো কিছু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে তুচ্ছ করে মহাকাশে বেরিয়ে যাবে,আর পৃথিবী নিজের কেন্দ্রের দিকে তাকে টানবে না l এতদিন বিজ্ঞানীরা মুক্তিবেগ কাজে লাগিয়ে রকেট,কৃত্তিম উপগ্রহ ইত্যাদি পাঠিয়েছেন,কিন্তু রজতবাবুর মাথায় কি যে ভূত চাপলো,উনি এটমিক এনার্জি দিয়ে একটা ছোটো অ্যালুমিনিয়াম নির্মিত এরোপ্লেন মুক্তিবেগে উড়িয়ে দিলেন l প্লেনটি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাকাশে এসে পড়লো,তারপর দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে  সূর্যের মতো আর একটি নক্ষত্রের একটি প্ল্যানেটে গোঁত্তা খেয়ে পড়লো l একটা ছোটো টিলাতে ধাক্কা খেয়ে ছোট্ট  মহাকাশযানটি ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল,সেই সাথে রজতবাবুর  নিজেভূমে ফিরে যাওয়ার স্বপ্নও খানখান হয়ে গেল l উনি বেশ কিছুটা সময় অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকার পর ঠান্ডা বাতাস চোখে মুখে মেখে উঠে বসলেন l এস্ট্রোনটদের মাথায় যে হেলমেট থাকে তা ছিটকে গেছে,ফলে অক্সিজেন সাপ্লাই বিচ্ছিন্ন হয়েছে,কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি উঠে বসে দেখলেন দিব্যি নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারছেন l মনে মনে ভাবলেন -"জায়গাটা তো বেশ,প্রায় পৃথিবীর মতোই l তবে কি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর ধারণাটাই সঠিক?সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব যতটা,ঠিক ততটা দূরত্ব বজায় থাকলে বায়ুমন্ডল,জল থাকা সম্ভব,প্রাণের অস্তিত্বও থাকতে পারে হয়তো l এটা কি তেমনই একটা গ্রহ বা উপগ্রহ?"

              রজত স্যারের রিপোর্ট

             ----------------------------------

                পৃথিবীর মতো তবু পৃথিবী নয় l এখানে সবকিছু যন্ত্রচালিত,মানুষ পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর l যন্ত্র গ্রাস করেছে এ শহরের মানুষদের শরীর,মন,মেধা অনুভূতি,চাহিদা সবকিছু l চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না,এ যেন সেই ছোটবেলায় দেখা সত্যজিৎ বাবুর হীরক রাজার দেশের যন্তর মন্তর l সারা শহরে এমন কতই না কেন্দ্র,সবগুলোই কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত,রোবট চালিত l গ্রিক শব্দ রোবোটাস থেকে রোবট কথাটি এসেছে,মানুষের অনুচরবৃত্তি করার জন্য সৃষ্ট যান্ত্রিক দাস এখন মানুষকেই দাস বানিয়ে ছেড়েছে l এখানে সবুজ গাছপালা,ফুল ফল সবজির কোনও চিহ্ন নেই l এদের কোনো ভাষা নেই,নির্ভর করে বাইনারি ইন্সট্রাকশন আর কোডিং এর উপর l এলাকা বেশির ভাগ সময়ই ফাঁকা,যে কজন মানুষ আছে,তারা দেখতে অনেকটা মানুষের মতো হলেও,আদপে আগাপাশতলা এক একটা রোবট l

তারা উচ্চ প্রযুক্তির গাড়ি বানায়,ব্রিজ বানায়,গগনচুম্বী বাড়ি বানায় l সবই নিক্তিতে মাপা, কোথাও কোনো ভুল হওয়ার উপায় নেই l মানুষের প্রয়োজন হলে কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে নারী পুরুষের জোড় নির্বাচন করে তাদের থেকে ডি.এন.এ  সংগ্রহ করে তার ক্লোন বানানো হয় l যন্ত্রই ঠিক করে দেয় ভ্রূণটিতে কতো শতাংশ জল,কার্বন,অক্সিজেন,লোহা ইত্যাদি থাকবে l হিসেবের জন্য ফর্মুলাও কম্পিউটারে মেমোরিতে পুরে রাখা আছে l এরপর শিশুটির জন্মের দুমাস পর থেকেই শুরু হয় ব্রেন ওয়াশ l ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কিছু বাইনারি ডিজিটের সংকেত,বের করে নেওয়া হয় মানবিক অনুভূতিসমূহ lখাবার দাবারের দরকারই হয় না,কারণ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন,কার্বহাইড্রেট,মিনারেল ইত্যাদির চাহিদা মেটানোর জন্য আছে নানারকম ট্যাবলেট,ক্যাপসুল,ইনজেকশন l 

        এহেন বাইনারি শহরে তো কোনো সমস্যা থাকার কথা না,কিন্তু গোল বাঁধলো অন্যত্র l ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্টের কারণে এমন কিছু মানুষের জন্ম হয়েছে,যাদের মনের অনুভূতি ও সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো রয়ে গেছে ভীষণভাবে l  যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ভালোবাসা,গান,সুর ইত্যাদি মান্ধাতার আমলের অনুভুতিগুলি তাদের মনে প্রাণে জড়িয়ে গেছে,অনুভূতির নৈবেদ্য সাজিয়ে বসে আছে l একেবারে গোড়ায় গলদ! যাদের জন্ম হয়েছে তারা সবাই নারী l বাইনারি শহরে এদের স্থান হয়নি,বিজ্ঞান নগরী এদের ত্যাগ করেছে l জন্মের সময়েই এই ডিফেক্ট পূর্ণ ভ্রূণগুলোকে নষ্ট করার জন্য প্রোগ্রাম বানিয়ে কম্পিউটারের মগজে ভরে দেওয়ার আগেই সুকুমার প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মে গেছে কিছু কন্যাসন্তান l শহরের প্রান্তে দেওয়াল তুলে,যন্ত্র মানব মানবীদের থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা বাস করে l এরা প্রযুক্তি ও যন্ত্র নির্ভর না l শহরের বাকি অঞ্চলের তুলনায় একেবারেই অনুন্নতl প্রত্যেকের হৃদয় আছে,হৃদয়ে সুর আছে,আর আছে বেদনা l এরা প্রায় সবাই প্রবীণা l ব্যাতিক্রম শুধু একজন,তার নাম  অরোরা l পুরুষের এভাবে বংশবৃদ্ধি একেবারে থমকে গেছে l সব সময় একটা ভয় এদের তাড়া করে বেড়ায়,মৃত্যুর পরে সব শেষ l তাদের এই স্থানটির দখল নেবে যন্ত্র,ভুখন্ড থেকে মুছে যাবে সুর,ভাষা,মানবিক অনুভূতি সমূহ l 

                   ডঃ গোস্বামীর বয়ানে

              ---------------------------------------

   আমি এদের ভাষা বুঝিনা,কিন্তু সাথে থাকা কালো বোতামের মতো ইন্টারপ্রেটর যন্ত্রের সাহায্যে এদের মনের ভাব বুঝে নিতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না l আমি আসলে মহাকাশযান ভেঙে এদের এরিয়ার মধ্যে এসেই পড়েছিলাম,যন্ত্র সভ্যতার কথা এদের থেকেই জেনেছি l পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই বুঝে এদের সঙ্গে মিশে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল l আশ্রয় যখন দিয়েছে,ঠিক করলাম যথাসাধ্য সাহায্য করার l যন্ত্র দুনিয়ার গ্রাস থেকে এদের বাঁচাতেই হবে l সামান্য উপকরণ জোগাড় করে কাজ শুরু করলাম l অরোরার শরীরের ডিম্বাণু আর আমার স্পর্ম নিয়ে তৈরি হলো জাইগোট l ধীরে ধীরে টিউবের মধ্যে বড়ো হতে লাগলো l অরোরার শরীর তা স্থাপনও করলাম l একদিন একটা ফুটফুটে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো,এদের সমাজের প্রথম ছেলে l আমার পড়া বায়ো কেমিস্ট্রির বিদ্যে নিয়ে শিশুটির ক্লোন তৈরির কাজ শুরু করলাম l বারবার ব্যর্থ হচ্ছি,কিন্তু হাল না ছেড়ে চললো উদায়াস্ত পরিশ্রম l স্বপ্ন দেখছি এদের সমাজ ভরে উঠবে,সংখ্যায় বেড়ে উঠে যন্ত্র সভ্যতার মোকাবিলা করবেl

      পুনশ্চ : এর পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াতে আর বিশেষ কিছু জানা যায়নি l তবে আমার স্থির বিশ্বাস যে ডঃ গোস্বামীর মতো ট্যালেন্টেড বিজ্ঞানী নিশ্চই সফল হয়েছেন l হয়তো আবার কোনো নভশ্চর ওখানে গিয়ে পড়লে দেখতে পাবেন বাইনারি শহরের সাথে টেক্কা দিয়ে বেড়ে উঠেছে আর এক মানবিক গুনসম্পন্ন শহর l হয়তো দেখতে পাবেন নারীপুরুষের চিরন্তন আকর্ষণে বাঁধা পড়েছে রজত স্যার আর অরোরা,হয়তো টেস্ট টিউব বেবি না -তাদের কোলে এসেছে তাদের ভালোবাসার ফসল,হয়তো,হয়তো......

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024