দংশন - মাইসার মন্ডল || গল্প || ছোটগল্প || Short story || Bengali Short story
দংশন
মাইসার মন্ডল
এসএসসি পরীক্ষার্থী সন্তোষ বেশ কয়েকবার উত্তরপত্রে চোখ বোলাল। তারপর অস্ফুটস্বরে বলল , " নি:সন্দেহে ভাল রেজাল্ট হবে। ইন্টারভিউ-এর রেজাল্টটাও এরকম হলেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাব। "
ওর এরকম আশা করাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ও স্কুল- কলেজ- ইউনিভার্সিটির প্রত্যেকটি পরীক্ষাতেই বরাবর ভালো রেজাল্ট করেছে। বি.এড ট্রেনিং করেছে।আবার এসএসসি পরীক্ষাতেও প্রায় প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর লেখেছে।এইসব কারণে ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার আশা করল।ঠিক সময়ে ইন্টারভিউও দিল।তাতেও ভালো রেজাল্ট হওয়ার আঁচ পেল।সেজন্য আত্মবিশ্বাস নামের অসংখ্য সুতো দিয়ে চাকরি পাওয়ার দুর্মর আশার জাল বুনতে বুনতে ওর অনেকদিন কেটে গেল । তবুও ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আকাশের চাঁদ হয়েই থেকে গেল।
কিন্তু ওর ক্লাসফ্রেন্ড এবং এ-বারের এসএসসি পরীক্ষার্থী , মহেশের হাতে ঠিক সময়েই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পৌঁছে গেল।ব্যাপারটা ঠিক আকাশের চাঁদ মহেশের হাতের মুঠোয় নেমে আসার মতো। খবরটা শুনে সন্তোষ অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে উঠল।ব্যাপারটা ওর খুবই রহস্যজনক মনে হল। ও একদিন বিশেষ সূত্রে মহেশের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার রহস্যটা উদ্ঘাটন করল।
নিশিকান্ত একজন ডাকসাইটে দালাল। ও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য এ-বারের অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েছিল।তার বিনিময়ে
অযোগ্য মহেশ শিক্ষাজগতের মহাসম্রাটে পরিণত হয়ে 'শিক্ষক পদ ' নামের একটা সিংহাসন দখল করে নিয়েছে।
এই বিচিত্র রহস্যটি উদ্ঘাটিত হওয়ায় সন্তোষ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল যে , আজকাল চাকরিও বাজারের পণ্যদ্রব্যের মতো । এই কারণেই যার ট্যা়ঁকে টাকা থাকবে চাকরির খেলায় সে-ই জিতে যাব। অমেধাবী পরীক্ষার্থীটিও ' ম্যান অফ দ্য সার্ভিস ম্যাচ ' হয়ে যাবে।আর যার ট্যাঁকে টাকা থাকবে না তার বেলা চাকরি আকাশের চাঁদ হয়ে গিয়ে ধরাছোঁয়ার অনেক--- অ-নে-ক বাইরেই থেকে যাবে।
সেজন্য টাকাহীন সন্তোষ ওটাকে ছ়ু়ঁতে না পেয়ে বেকারত্বের যন্ত্রণা নামের বাসুকি নাগের বিরামহীন দংশনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠল।ওই ক্ষতগুলোর অসহ্য যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ওয়াগন ব্রেকার দলের দলপতির বাড়িতে ধর্ণা পাতল।ওকে দেখে দলপতি বিস্ময়ে হতবাক হল।মুহূর্তের মধ্যেই ওকে দলে নেওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। সন্তোষের হৃদয়বৃক্ষের কোটরে কোটরে হতাশার যে -পাখিগুলো বাসা বেঁধেছিল তারা বাসা ছেড়ে পালিয়ে গেল।সন্তোষের জীবনসমুদ্রে ব্যর্থতার ভরা জোয়ার ওঠে তান্ডবলীলাও ঘটাতে পারল না। ও ঠিক সময়েই কাজে যোগ দিল।অল্পস্বল্প মদ না খেলে ওই কাজে নাকি ভালো যশ হয় না।সেজন্য সন্তোষও মদ খেতে শুরু করল।
ও একদিন বেপরোয়াভাবে দু-বোতল মদ
গ্রাস করে ফেলল।সেজন্য নেশায় বিভোর হয়ে উঠল। মাথাটা বোঁ বোঁ করে প্রচন্ড ঘুরপাক খেতে শুরু করল।নেশার প্রেতনী মাথায় চেপে পুরো শরীরটাকেই যেন টারবাইন এর মতো একটা ঘূর্ণমান যন্ত্রে পরিণত করল।ভয়ঙ্কর মূর্তিধারণ করল। ওকে দেখে স্বয়ং যমদূতও যেন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাবে।আর না পালালে ভবের ক্ষেতে ডাঁশা পটল তুলে বসবে। সন্তোষ পথে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেল। হাঁটু থেকে তাজা রক্ত ঝরতে লাগল।কষ্টেসৃষ্টে বাড়ি ফিরল। একটা বাঁশের খ়ু়ঁটিতে হেলান দিয়ে বসল।কীসব আকশ- পাতাল এলোপাতাড়ি চিন্তাভাবনা করতে লাগল।
শিখা কী-একটা কাজের জন্য ঘোষপাড়ায় গিয়েছিল।ওখানে এক আত্মীয়র মুখ থেকে সন্তোষের ওয়াগন বেকারের দলে যোগ দেওয়ার খবরটা শুনে ওর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। জোর কদমে বাড়ি ঢুকতেই সন্তোষ বলল, "কোথায় গিয়েছিলি রে মুখপুড়ি! শিখা কী-একটা কথা বলতে যাচ্ছিল।কিন্ত ও স্বামীর ভাবমূর্তি দেখে ; ব্যাপারটা টের পেতেই বিস্মিত হয়ে উঠল। শিখার গৃহশিক্ষক সন্তোষ এবং আজকের সন্তোষের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে গিয়েই ওর মস্তিষ্কে সজোর একটা চোট লাগল।
হৃদয়ে ধ্বংসমাতাল ঘূর্ণিঝড় উঠল।বেদনার বিষবাষ্প বুক ঠেলে বেরিয়ে এল!
---তুমি মদ খেয়েছ ?
---হ্যাঁ-য়্যা।
---ছি!ছি! ইতর!অসভ্য কোথাকার!
--- অ-স-অ-ভ-ভো ? ই-তো-ওর আ -আমি?
---হ্যাঁ, হ্যাঁ।তুমি চোর, মদখোর।শিক্ষিতজগতের কলঙ্ক!
---শি-ই-খা!মু-মু-উখ ভে-এ-ঙে দে-এ-ব।
---যে-চরিত্রের গুণে মুগ্ধ হয়ে: গ্রামের সবচেয়ে ধনী ঘরের মেয়ে হয়েও--- সকলের বাধানিষেধের পর্বত ডিঙিয়ে ; তোমার মত চালচুলোহীনের
হাত ধরে ; অচেনা পথে পা রেখেছিলাম,আজ তার এই পরিণতি ?
শিখা ডুকরে কেঁদে উঠল।অশ্রধারা বাগ মানল না। আশাহত গলায় বলল, " সমাজে বুক ফুলিয়ে বলতাম , আমার স্বামী গরিব হলেও জ্ঞানগরিমা ও মানমর্যাদায় অনেক উঁচু দরের লোক। কিন্তু তুমি এত নীচু পথে নেমেছ যে, তোমার চেয়ে নিকৃষ্ট লোক সমাজে খুবই কম আছে। শিখা কোনওদিন স্বপ্নেও জানত না যে, ওর জীবনের আকাশটি এমন দুর্যোগের মেঘে ছেয়ে যাব। দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করেও ও অসীম সুখানুভব করত। ওটা থেকেও ও আজ বঞ্চিত হল।ওর জীবনের রঙ্গশালায় সুখনাট্যের শেষ দৃশ্যটিও মনে হয় অভিনীত হয়ে যবনিকাপাতও হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর সন্তোষের নেশা একটু কমল।কিন্ত ক্ষোভের আগুন সমানেই জ্বলতে থাকল। ক্ষোভের সুরে ও ওর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে লাগল, " আমার ক্লাসফ্রেন্ড মহেশ মাধ্যমিক নামের ক্ষুদে নালাটা পার হতে গিয়ে দু-দুবার জলে-কাদায় হামাগুড়ি দিয়েছে। তিন বারের বেলা কোনরকমে জলে ভিজে ; কাদা মেখে পার হয়েছে।আর হায়ার সেকেন্ডারি নামের ডোবা এবং বি.এ নামের পুকুরটা পার হয়েছে টুকলি নামের জলজাহাজের সাহায্যে---মানে বই-খাতা ছিঁড়ে-লেখে।আর শালা মহেশই টাকার বলে উপযুক্ত শিক্ষক হয়ে গেল।আমি এক চান্সে এম.এ.বি.এড নামের মহাসাগরটা পাড়ি দিয়েও ঘোড়ার ঘাস কাটা।সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!" সন্তোষ একসময় বিড় বিড় করতে-করতে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ল ।
তারপর বিশেষ কারণে রাতে মদ জুটল না।আজকাল মদের নেশা কেটে গেলেই সন্তোষেরর হৃদয়াকাশে 'সত্য ও ন্যয় ' নামের দুটি বিশালাকারের সূর্য ওঠে।রাতে মদ না জোটার কারণে ওই সূর্যদুটি উঠে পড়ল। সেজন্য সন্তোষ ওর নিজের কর্মধারার সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে নিজেকে শিক্ষিতসমাজের কলঙ্ক ও ঘূণ আখ্যা দিল। এমনকী ' শিক্ষিত পশু ' আখ্যা দিতেও দ্বিধাবোধ করল না। অপরাধ স্বীকার করার সুরে বলল , " দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো একটা চাকরি জুটলে কখনোই শিক্ষিত পশুতে পরিণত হয়ে শিক্ষিতসমাজের মুখে চুনকালি লেপে দিতাম না।" সন্তোষ ' বিবেক ' নামের বাসুকি নাগের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল।কাকভোরেই মদের ঠেকে কয়েকটা বোতল উজাড় করল। তারপর আরও কয়েকটা বোতল নিয়ে বাড়ি ফিরল।
শিখাকে বলল, " একটা গ্লাস এনে দাও। মালটা পেটে পড়লেই ব্যস ,বাবা ভোলানাথের আশীর্বাদে সব যন্ত্রণার আকাশছোঁয়া পর্বতটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে পথের ধূলোয় মিশে যাবে।" শিখা কোনও কথা বলল না।কিছুক্ষণ পর সন্তোষ বিরক্ত হয়ে বলল , " কই রে মুখপুড়ি তোর গ্লাস! " শিখা বিড় বিড় করে কীসব অশ্লীল কথা বলল।নেশাগ্রস্ত সন্তোষ উত্তেজিত হয়ে উঠল। একটা মদের বোতল দিয়ে শিখার মাথায় সজোরে আঘাত করল।বোতলটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল।শিখার মাথা ফেটে দু-গাল বেয়ে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল।ও অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
তারপর জ্ঞান ফিরতেই দেখল হাসপাতালের বিছানায়।অনেক রক্তপাত হওয়ার জন্য শরীরটা খুব দুর্বল মনে হল।কীসব সাত-পাঁচ চিন্তা করত করতে অভিমানের সুরে বলল, "পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউই থাকল না। দেখ, ওগো বিশ্বের মানুষ,সোনার চামচ মুখে নিয়ে যার জন্ম সে আজ সর্বহারা। বিষাদাবেগে দরদর করে বুক বেয়ে শিখার চোখের জল পড়তে থাকল। বিষণ্নকণ্ঠে বলল, " সব আশাই তো শেষ হয়ে গেল।আর কিসের জন্য বেঁচে থাকব! শিখা চোখ বুঁজে শুয়ে পড়ল। ঘুম এল না। করুণকণ্ঠে বলল, "ভগবান, ঘর -সংসার নামের যমের রাজত্বে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না।হাসপাতালের বিছানাতেই যেন আমার মরণ হয় ।"
সন্তোষ ওর তিন বছরের ছেলে, প্রদীপকে
সঙ্গে নিয়ে শিখার বারো নম্বর বেডে পৌঁছাল।প্রদীপ ওর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, " মা তোমার অসুখ সেরে গেছে?" শিখা কোনও কথা বলল না। প্রদীপ করুণ চোখে ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
কীভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে একরোখা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেবে----- সেই
বিষয়েই সন্তোষ এতক্ষণ ধরে একচোট চিন্তাভাবনা করছিল।নরম গলায় বলল,
"আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ি চলো। তা না হলে বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে।" শিখা একরোখা সুরে বলল, " যাব তো বটেই।কিন্তু অচেনা পথ ধরে একাই যাব।" সন্তোষ বিস্ময়াবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, " কীসব অলক্ষুণে কথা বলছ তুমি!" করুণকণ্ঠে শিখা বলল, " জীবনের খেলায় আমি হেরে গেছি।আমার আশার বাগান শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।তাই ওখানে ছায়া নেই।আছে শুধু খ়াঁ- খাঁ রোদ্দুর।ওটা আজ ধু-ধূ মরুভূমি হয়ে গেছে! ' তাই লু ' হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।আমার চলার পথের সবখানেই ছড়িয়ে আছে বিষাক্ত ফণিমনসার কাঁটা!ওই কাঁটার আঘাতে পা থেকে রক্ত ঝরছে।রক্তঝরা পায়ে আমি আর পথ চলতে পারছি না।তাই আমাকে অচেনা পথ ধরে--- মানে , যে পথে চোখ যাবে , সেই পথ ধরেই হাঁটতে হবে।" কান্নার আবেগে ওর ঠো়ঁটদুটো কাঁপতে লাগল ওর মানসিক অবস্থা দেখে সন্তোষ অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে উঠল।করুণ গলায় বলল, " শিখা, আমাকে আরেকবার শোধরানোর সুযোগ দাও।" শিখা ঝাঁঝাঁলো স্বরে বলল, " তুমি আর কোনও সুযোগ পাবে না।"
তারপর হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাইরে আসতেই---প্রদীপ "মা,মা " বলে কান্না করতে করতে শিখার শাড়ির আঁচল ধরে ফেলল।শিখা ওকে সজোর ধাক্কা মেরে ওর হাত থেকে টেনে -হেঁচড়ে শাড়ির আঁচলটা ছাড়িয়ে নিল। প্রদীপ আবার শাড়ির আঁচল ধরার জন্য কাছে যেতেই শিখার পায়ের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ল। ওর ঠোঁট কেটে গিয়ে শিখার পায়ের ওপরে কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়ে পড়ল।ও মাথা তুলতেই ওর ঠোঁট থেকে শিখা তাজা রক্তের স্রোত বইতে দেখল। অবিলম্বেই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিখা ডুকরে কেঁদে উঠল।
সন্তান-স্নেহরসে শিখা ওর হৃদয়ের ধূসর- তৃষ্ণার্ত মরুভূমি মুহূর্তের মধ্যেই সরস করে তুলল।তারপর এক মুহূর্তেই ওই মরুভূমির বুকে মায়া-মমতাব অসংখ্য বীজ ছড়িয়ে দিল। ওই বীজগুলো থেকে চারা গজানোমাত্রই ওগুলো বড় হয়ে গিয়ে মায়া-মমতার একটা বিশাল অরণ্য সৃষ্টি করল।শিখা ওই অরণ্যের ছায়ায় বসে প্রদীপকে চুমো খেতে লাগল। শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিল ক্ষতস্থানের রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য নানা রকমের কলাকৌশল প্রয়োগ করতে লাগল। সন্তোষ একটা মলম এনে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল।প্রদীপকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিখা বলল, " খোকা, মানিক আমার !তোর জন্য আমি স্বর্গে গিয়েও শান্তি পাব না রে।" চোখের জলে শিখার বুক ভেসে গেল।ও সন্তানস্নেহের বশীভূতা হয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হল। সন্তোষ প্রাণপণে চেষ্টা করেও মদ ছাড়তে পারল না।
একদিন আর.পি.এফ. -এর গুলিতে ওয়াগন ব্রেকার দলের কয়েকজন আহত হল ।কেউ কেউ ধরা পড়ে জেলে গেল ।সেজন্য দলটা ভেঙে গিয়ে সন্তোষের রোজগার বন্ধ হয়ে গেল।
সেজন্য শিখাদের রোজগারহীন সংসারে দিনের পর দিন অভাব বেড়েই চলল।যন্ত্রণার মমিরা জীবনের পিড়ামিড ঘিরে সারিবদ্ধ মিছিলে সামিল হতে লাপল। দিন দিন সন্তোষের মদ্যপানাসক্তি বাড়তেই থাকল।একদিন শিখা বিনীত গলায় বলল, " আজকাল বেকারদের জন্য সরকার কত রকমের ব্যবস্থা করছে।একবার বিডিও অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখনা। তা না হলে না খেয়ে মরতে হবে।" সন্তোষ কোনও কথাই বলল না।
তারপর ও একদিন রাতেও বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিল।কখনো দত্তদের আমবাগানের আমগাছের নিচেই , কখনো গ্রামের প্রথমিক বিদ্যালয়ের দাওয়ায় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাত কাটাতে লাগল। মদের ঠেকে বাকি পড়ায় সন্তোষকে মদ দেওয়া বন্ধ করে দিল।সেজন্য নিত্যসঙ্গী মদের বোতল'র সঙ্গে ওর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। সন্তোষ নিত্যসঙ্গীর বিরহে শশব্যস্ত হয়ে উঠল।
মদের ঠেকের বাকি টাকাটা শোধ করার একটা পরিকল্পনাও করে ফেলল।ওটা বাস্তবায়িত করার জন্য শিখাকে বলল , "ঘরের চালটা ছাওয়ার জন্য খড় কিনতে হবে।তা না হলে বর্ষায় ঘরে জল পড়বে।তাই বলছিলাম---তোমার কানের গয়না বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা আনতে হবে।শিখা রাজি হল না।
কারণ, সন্তোষ ঠিক এভাবেই প্রতারণা করে ওর গয়নাগাটি এবং অনেক টাকা-পয়সা তছরুপ করেছে।সন্তোষ মুহূর্তের মধ্যে একইসঙ্গে দু-কানে দু-হাত দিয়ে সজোরে টেনে শিখার কানের গয়না ছিনিয়ে নিল।শিখার দু-গাল বেয়ে রক্ত পড়তে থাকল। পর্বত ওপড়ানো বিভীষিকাময় ঘূর্ণিঝড় ওর হৃদয়ে উন্মত্ততা শুরু করল।সন্তোষ অবিলম্বেই একটা সোনার দোকানে হাজির হল।
প্রদীপ দাওয়ায় ঘুমোচ্ছিল।শিখা করুণ দৃষ্টিতে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর ও মাতৃহৃদয়ের স্নেহরসের শেষ বিন্দুটিও চুমোর সাহায্যে ঘুমন্ত প্রদীপের মুখমন্ডলে উজার করে ঢেলে দিল।ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।গায়ে কেরসিন ঢেলে একটা দেশলাই শলাকা ঠুকল। অস্ফুটস্বরে বলল, " অভাগিনী শিখা, এবার তুই কালনাগের দংশন থেকে মুক্তি পাবি।" জলন্ত দেশলাই শলাকাটা গায়ের কাছে নিয়ে যেতেই ওটার ওপরে শিখার চোখের এক ফোঁটা জল পড়ে ওটা নিভে গেল।আরেকটা দেশলাই শলাকা জ্বালাল।
প্রদীপের ঘুম ভেঙে গেল।ও বন্ধ দরজার কাছে পৌঁছাল।'মা,মা ' বলে কান্না করতে লাগল। ওর মুখচ্ছবি শিখার চোখের সামনে ঘুবপাক খেতে লাগল। যেন একটা বিষধর কালনাগ ওর মাতৃহৃদয়টিকে অবিরাম দংশন করতে থাকল।সন্তোষ ব্যাপারটা টের পেয়ে সজোরে লাথি মেরে , দরজা ভেঙে , শিখাকে বাইরে নিয়ে এল।প্রদীপকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিখা বলল, " পারলাম না রে খোকা ,মানিক আমার !এবারও তোর জন্যেই পরপারে যেতে পারলা না। তোর জন্য আলোর পথ খুঁজতে হবে।
শিখাদের জীবনের নাট্যমঞ্চে আলোর পথ খুঁজে পাওয়ার 'একটি দৃশ্যের সূচনা হল।সন্তোষ আঙিনার তালগাছটাতে বাবুই পাখিদের সুশৃঙ্খল জীবনধারাকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিচার-বিষ্লেশন করে জীবনবেদের সন্ধান পেল।ও ওটাকেই অনুসরণ করে চলার পরিকল্পনা করল। ওটাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে বিডিও সাহেবের পরামর্শে ফিশারি লোন নিল। ওর বাড়ির সামনের পুকুরটাতে মাছ চাষ শুরু করল।অল্পদিনের মধ্যেই ভালো রোজগার হল। শিখাও একজন মহিলা দর্জির কাছ থেকে সেলাই বিদ্যেটা রপ্ত করল।তারপর সন্তোযের রোজগারের টাকায় একটা সেলাই মেশিন কিনে কাজ শুরু করল।রেডিমেড পোষাক তৈরি করে হোলসেল দোকানে বিক্রি করতে থাকল।স্বামী-স্ত্রীর রোজগারের টাকায় সন্তোষ ওর ফিশারি পুকুরটার পাড়ে একটা আটচালা তৈরি করে কোচিং সেন্টার খুলল।
শিখা একাই দোকানদারদের চাহিদা মেটাতে পারল না।সেজন্য ও পাড়ার বেকার ছেলে-মেয়েদেরকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে সে্লাই-এর কাজে নিযুক্ত করল।কয়েকজন সেলসম্যানও জুটে গেল।ও একদিন একটা ফুড প্রডাকশন গ্রুপও তৈরি করল।
সন্তোষ একটা নার্সারি স্কুল খুলল। একদিন শিখার রেডিমেড পোশাক ও খাদ্য আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা করে নিল । সেজন্য ' শিখা গার্মেন্ট ' ও ' শিখা ফুড প্রোডাকশন প্রইভেট লিমিটেড ' নামে দুটি সংস্থা গড়ে উঠল। শিখা ওর অভিজ্ঞতায় স্পষ্টভাবেই বুঝলো যে, হাতের কাজ মানুষকে স্বাবলম্বী করে।সেজন্য ও 'প্রদীপ-শিখা টেকনোলজি কলেজ ' নামে একটি আইটিআই কলেজ তৈরি করল।সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হওয়া শিখার সাধের বাগানটি যেন মায়ামন্ত্রে শ্যামলিমায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল।পাখিদের কলতানে মুখর হতে থাকল।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওই দৃশ্যটি শেষ হয়ে সন্তোষের জীবনে অসহ্য যন্ত্রণার আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হওয়ার মত একটি দৃশ্যের সূচনা হল।কী-একটা দূরারোগ্য রোগে শিখা শয্যাশায়িনী হয়ে গেল।দেশ-বিদেশের কোনও চিকিৎসকই ওর রোগ সারাতে পারল না।দিন দিন ওর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে লাগল।
শিখা লোকমুখে শুনেছ যে , মৃত্যূর আগে মানুষ মৃত মা ,বাবা ইত্যাদি লোকদেরকে দেখতে পায়।
ও একদিন ওর মৃত আত্মীয়স্বজনদেরকে স্বপ্নে দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।
---ও গো ,এবার আমার যাবার সময় হয়েছে।
----বোল না শিখা, ও কথা বোল ন! আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে!
---সংসার জীবনে অনেক কটু কথা বলে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। ক্ষমা করে দাও।
---ও সব তো আমার ভুলেই হয়েছে শিখা।তুমি একটুও অপরাধ করনি।
সন্তোষ অনুশোচনার আগুনে পুড়তে লাগল।
মাঝরাতে প্রদীপের ঘুম ভেঙে গেল। শিখার মাথার কাছে বসল। ।
---মা ,এখন তোমাকে কেমন লাগছে ?
---তুই কোনও চিন্তা করিস না খোকা।আমার অসুখ সেরে যাবে।
প্রদীপের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অস্ফুটস্বরে শিখা বলল , " তোর মাথার ওপরে সবসময় আমার আশীর্বাদ থাকবে রে খোকা। আমি মরে গেলেও আমার আত্মা এই সংসারের দেখভাল করবে।"
ভোরের দিকে শিখা প্রায় মৃত্যূর দোরগোড়ায় পৌঁছাল।ওকে বড় বড় শ্বাস ফেলতে দেখে সন্তোষ ডুকরে কান্না করতে লাগল।প্রদীপও 'মা ,কথা বলো মা ' বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।অনুশোচনার সুরে সন্তোষ বলল, " হতভাগিনী আমার , দিনের পর দিন উপোষ করে কাটিয়েছ। কত লাঞ্ছনা সয়েছ।তবু ভালবাসার বাঁধন ছ়িঁড়োনি। আর আজ কোন্ অপরাধে সব বাঁধন ছিঁড়ে চলে যাবে? ও গো দয়াময় ভগবান, আমার শিখা অনেক ঘাম ঝরিয়ে সংসারে সুখ এনেছে।সেই সুখটুকূ ওকে ভোগ করতে দাও ভগবান, ভোগ করতে দাও। আমার আয়ূ ওকে আধাআধি ভাগ করে দাও। "
সন্তোষদের অতীতের দারিদ্রপিড়ীত সংসারের নানান দৃশ্যগুলো এবং মুমূর্ষু জীবনসঙ্গিনীর করুণ মুখ ; যেন দুটি বিশালাকারের বিষধর কালনাগে পরিণত হল। সন্তোষের হৃদয়টিকে অবিরাম দংশন করতে উন্মত্ত হয়ে উঠল।'ও আকাশের দিকে দু-হাত তুলে বলল , ' ও গো দয়াময় ভগবান , " আমার আয়ু আধাআধি করে শিখাকে ভাগ করে দাও।"
Comments