নিগ্রো কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা - শংকর ব্রহ্ম || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article Writing

 নিগ্রো কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা


শংকর ব্রহ্ম

------------------------------------------------------------------



                           নিগ্রো কবিতার ইতিহাস মাত্র চারশো বছরের।

প্রথম আমেরিকান নিগ্রো 'লুসি টেরী' প্রথম কবিতা লিখেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন মহিলা। 


তারপর কবিতা লেখেন ক্রীতদাসী একজন। নাম-জুপিটার হ্যামস। তারপর ফিলিস্ সুইটল। এই ভাবে একে একে অনেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন নিগ্রোদের মধ্যে ধীরে ধীরে।

                          নিগ্রো কবিতার ইতিহাস ঘাটতে গেলে, দুটি ধারা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রথম ধারা আফ্রিকার বা

তৎসংলগ্ন বসবাসকারী নিগ্রোদের লেখা কবিতা।

দ্বিতীয় ধারাটি যে সমস্ত নিগ্রোরা আমেরিকায় বাস করে, তাদের লেখা কবিতা।

                          দু'টি ধারার কারণ, আফ্রিকায় বসবাস

করে যে সব নিগ্রো তাদের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, 

সামাজিক পরিবেশ আমেরিকায় বসবাসকারী নিগ্রোদের চেয়ে আলাদা। সেই ঐতিহ্য ভাল হোক মন্দ হোক, কুসংস্কার আচ্ছন্ন হোক, তা তাদের নিজস্ব।

                     আর অন্যদিকে আমেরিকায় বসবাসকারী নিগ্রোদের প্রধান সমস্যা ছিল, তাদের শিকড়ের বিচ্ছিন্নতা। ফলে তারা ঐতিহ্যহীন, ইতিহাস বিচ্ছিন্ন।

    তাই আমেরিকান নিগ্রোরা আসলে, " They have been treated as outsider by the outsider. "

ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় আগত সাদা গায়ের রঙের মানুষজন, অত্যাচার করত কালো গায়ের রঙের ক্রীতদাসদের সঙ্গে শুধুমাত্র রঙ বৈষম্যের ভিত্তিতে।

সেই জন্যই সমাজবিদ - ডু বয়েস বলেছিলেন, 'বিংশ শতাব্দির প্রধান সমস্য হচ্ছে, বর্ণ বৈষম্য।'

' কবি রে ডারেম- এর নীচের এই কবিতাটি পড়লে, ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পারবেন -


রে ডারেম (জন্ম - ১৯১৫ সালে) 

---------------------------------------


বন্ধুত্ব

-------


আমার কিছু কিছু বন্ধু আছে

যাদের চামড়ার রঙ সাদা

অথচ আমি তো তাদের সঙ্গে

অন্য সবার মতোই 

ব্যবহার করি

ঠিক মানুষের মতোই।



                         ১৬১৯ সালের আগস্ট মাসে, স্পেনের লোকেরা প্রথম আফ্রিকান নিগ্রোদের ক্রীতদাস করে নিয়ে আসে আমেরিকার ভার্জিনিয়ার জেমসটাউন শহরে।

তারও কুড়ি বছর পরে আরও কিছু নিগ্রো ক্রীতদাস ইংল্যান্ডে আমদানী করা হয়। এই ভাবে নিগ্রো ক্রীতদাসদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকে আমেরিক ও ইংল্যান্ডে।

                         ১৬৬৪ সালে ম্যারীল্যান্ড আইন নিগ্রোদের আজীবন ক্রীতদাস হিসাবে থাকার অনুমতি দেয়।

১৮০০ সালে নিগ্রো ক্রীতদাসের সংখ্যা দাঁড়ায় নয় লক্ষের মতো। তাদের দাস হিসাবে লাগানো হতো - তামাক, আখ, তুলো, নীল, ধান চাষের কাজে। এদের আজীবন ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হতো।

                        তারা মাঝে মাঝেই অমানবিক অত্যাচারে শিকার হয়ে, বিক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহ করতো। এছাড়াও মুক্ত ( ক্রীতদাস নয় এমন) নিগ্রোদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ।

                         কবি পল লরেন্স ডানবার নিগ্রো রেঁনেসার যে বীজ বপন করেছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই তা হাজার পাপড়িতে বিকশিত হতে শুরু করে। 


পল লরেন্স ডানবার - এর কবিতা( জন্ম - ১৮৭১ সালে)

-----------------------------------------------------------------


মুখোশের মানুষ 

-----------------------


মুখোশের মানুষজন অনর্গল মিথ্যে বলে যায়

হাসে মুখোশের আড়ালে

আসল মুখ লুকোনো থাকে

ওই চাতুর্যের জন্য যে ঋণ শোধ করতে হয় 

আমাদের রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত হৃদয় দিয়ে

আমারা হেসে মিথ্যে ইমারত বানাই


আমাদের অশ্রুর

 দীর্ঘশ্বাসের হিসেব করার জন্য

কে-ই বা মাথা ঘামায়

বরং আমরা যখন মুখোশ পরে থাকব

তখনই যেন দেখা হয় তাদের সঙ্গে


আমাদের আর্তনাদ তাদের জন্যই উত্থিত

হে ভগবান নির্যাতিত আত্মার গান কেউ শোনে না

পায়ের নীচের পিছল মাটিতে এগোনো যায় না

ভাগ্যের দূরত্ব ক্রমশই বেড়ে যায়


কিন্ত শুধু সে'সব কিছু নয়

এই পৃথিবীর মানুষজন আমাদের 

অন্য চোখে দেখুক মুখোশ খুলে।



                          ততদিনে আড়াই'শ বছরের দাসত্ব জীবনের ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে।


                          প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গেই বিশিষ্ট নিগ্রো কবিরা আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। তাদের মধ্যে

ক্লড ম্যাকে, জেন টুমার, ল্যাংস্টন হিউজ প্রমুখদের নাম উল্লেখযোগ্য।



ক্লড ম্যাক-এর কবিতা ( জন্ম - ১৮৯০ সালে).

----------------------------------------------------


যদি মরতেই হয়

-----------------------


যদি মরতেই হয় তা যেন কুকুরের মত নয়

যেমন আমাদের দুর্ভাগ্যকে ব্যাঙ্গ করে 

অনেক ক্ষুধার্ত কুকুর চারদিক থেকে চিৎকার করে ছুটে আসে

যদি মরতেই হয়,

যেন তা হয় মহান,

মূল্যবান রক্তের এক ফোঁটাও যেন বৃথা না যায়

যে সব নরপিশাচদের যেন ঘৃণা করি আমরা

তারাও যেন মাথা শ্রদ্ধায় নোয়ায়। 


ওহে, শত্রুদের সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতেই হবে একসময়

যদিও লোকবল কম

তবুও যেন সাহসের অভাব না হয়,

সামনে কবরের রাস্তা না হয় সোজা না রইল

তাতে কি?


কাপুরুষ খুনিদের সাথে মোকাবিলা করতে চাই মানুষের মতো,

দেওয়ালে পিঠ ঠেকলেও, মৃত্যু হলেও

লড়াইয়ের উত্তেজনা যেন না হারায়।



জেন ট্যুমার- এর কবিতা( জন্ম -১৮৯৪ সালে).

------------------------------------------------------


পাঁচ মুখের চিত্র

---------------------


রক্ত লাল জাহাজগুলি

সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে

কালো মেঘের ভয়ে,


শত সেলাইয়েও

ছেঁড়া কাপড় উড়ে যায়

বাতাসে


আশি বছরের বুড়োও 

স্বাদু টুসটুসে আঙুর খেয়ে চলেছে

অসুস্থ হবার ভয়ে


আমার দুঃখ আবরণে আবৃত থাক

সেলাই করার সময়

তোমার আঙুলে সূঁচ ফুটে রক্ত যেন বের না হয়


বাচ্চা চিনা মেয়েটি পড়ে গেলে

যে কোন বাচ্চার মতোই কেঁদে ওঠে

সর্বত্র।



ল্যাংস্টন হিউজ- এর কবিতা( জন্ম -১৯০২ সালে)

----------------------------------------------------------


জঙ্গী

---------


যাই বল ভাই, যেই পারুক না কেন

কিল খেয়ে চুরি করতে

                  আমি পারব না অন্ততঃ

যখনই জেনেছি এটা ঠিক হচ্ছে না

আমি চিৎকার করে উঠি, 

              না কখনই নয় - বলে উঠি


সৎ পরিশ্রমের জন্য

অস্বাভিক কম মজুরী দিচ্ছো তুমি

আর সৎ স্বপ্নের জন্য

                     লাথি ঝাঁটা মারছো

মুখে থুতু দিচ্ছো সারাক্ষণ

তাই হাতের মুঠো দুটো শক্ত হয়ে উঠছে

তোমার চোয়ালে অমোঘ 

               তীব্র তীক্ষ্ণ ঘুষি মারার জন্য



ল্যাংস্টন হিউজ - এর আর একটি কবিতা -


" লাল অগ্নিশিখার মতো

   আগামী প্রভাত 

   আমাদের সামনে


   বিদায় বলেছি গতকালকে

   সূর্যাস্তের সঙ্গে

   হাত ধরে 

   ফিরে গেছে গতকাল।


   এখন 

   আজ যে পথ দিয়ে

   আসছি আমরা

   অভ্যর্থনায় রঙিন তোরণ

   সেই সব পথে। "



ম্যারী ইভান্স ( জন্ম - ১৯২১ সালে)

--------------------------------------------


বিদ্রোহী

----------


যখন 

মৃত্যু হবে আমার 

আমি জানি

বড়সড় একটা শোক সভার আয়োজন হবে নিশ্চয়ই

কৌতূহলী মানুষজন

চারিদিকে দাঁড়িয়ে দেখবে


ভিড় করে 

অনেকে আসবে দেখতে

আমি

সত্যি সত্যিই মরা গেছি

নাকি 

আবার একটা গোলমাল

পাকাবার চেষ্টা করছি শুধু।



অ্যাডিম ডেভিড মিলার ( জন্ম - ১৯২২ সালে )

-----------------------------------------------------


ক্ষুধার্থ কালো শিশুটি

------------------------


ক্ষমা করুন প্রভু

যদি অস্তগামী 

সূর্যকে টেনে হিঁচড়ে 

রাস্তার আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিই।


সন্ধ্যার আঁধারে ক্ষিদে যখন

পেটের ভিতরে ফুঁসে ওঠে সাতটা অজগর হয়ে

তখন মাঠে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে

দেখতে পাই সূর্যাস্তের লাল আভা

মনে হয় আমাদের বাড়িগুলি জ্বলছে

পেটের নাড়ির মতোই ক্ষিদেয় পুড়ে

সাদা ছাই হয়ে যাচ্ছে।



হেনরী ডুমাস ( জন্ম - ১৯৩৫ সালে )

--------------------------------------------


মহিষ

-----------


আমিই শেষ পর্যন্ত

ভয়ংকর ভয়াল মহিষটাকে

পেড়ে ফেলতে পেরেছিলাম অসীম সাহসে


ধূলো ছিটকে পড়েছিল 

বাতাসে

রক্তের ফোটার মতোন

আর আমি কিনা এতকাল

এর ভয়ে 

ভেবে এসেছিলাম,

ভয়াল জন্তুটা আমাকে আক্রমণ করলেই

আমি মরে যাব অনায়াসে।



অল ইয়ং (জন্ম - ১৯৩৯ সালে) 

—-------------------------------------

কবি
---------

ভালো থাকো হে কবি
কিন্তু সাবধান
খুব বেশী দিন থেকো না আড়ালে
হয়ে যেয়ো না গর্তের ইঁদুুর
কিংবা পোকা মাকড় 
বা গাছের শিকড়
অথবা পাথর

উজ্জ্বল আলোয় বেরিয়ে এসো
গর্ত থেকে
বুক ভরে নাও সবুজ নিঃশ্বাস
অনায়াসে পাথরে ধরাও ফাঁটল
সাপেদের সঙ্গে সহবাস রপ্ত কর
পাখিদের নায়ক তুমি কবি

মাটি থেকে তুলে ধরো মাথা
আলোক ঝলকানিতে
চোখ কুঁচকে দেখ চারিপাশ
উজানে সাঁতার কাটো অবলীলা ক্রমে ক্রমে
প্রয়োজনে উড়ে যেতে ভুলো না আবার।


                            ১৯২৫ সালে 'অ্যালেন লক' প্রকাশ করতে শুরু করেন, 'নিউ নিগ্রো' - নামে একটি পত্রিকা।
ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, আফ্রিকা, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায় 'New spirit' দানা বাঁধতে শুরু করে। মূলতঃ সব নিগ্রো কবিরাই ছিলেন কমিটেড। তাদের জ্বলন্ত জীবনের কথা, ভাল লাগা, ভালবাসা, সংগ্রামের কথা সহজ সরল ও স্বাভাবিক ভাষায় ফুটে উঠেছে তাদের কবিতায়,
যা প্রগতিশীল মানুষকে স্বভাবতই উদ্বুদ্ধ করে থাকে।

—--------------------------------------------------------------
ঋণ স্বীকার - মুকুল গুহ

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024